আগন্তুক

আগন্তুক

ইঁটাচুনার দেবব্রত মিত্রের বাড়িতে সকাল থেকে উৎসবের মেজাজ।উৎসব তো বটেই,পুনর্মিলন উৎসব।প্রায় চল্লিশ বছর পর কলেজের চার বন্ধু, না চার বন্ধুই বা বলছে কেন,ছয় বন্ধুর মিলন হবে তার বাড়ির ছাদের তলায়।আশুতোষ কলেজের ফিজিক্স অনার্সের দেবব্রত মিত্র,সুপ্রতিম সান্যাল,নীলাদ্রি বোস এবং তথাগত রায়।একসময় হরিহর আত্মা ছিলো এরা।তারপর উচ্চশিক্ষার জন্য কেউ গেল বিদেশ,কেউ কর্মসূত্রে ভিন্ন রাজ্যে।

প্রথম প্রথম ফোনে বা চিঠিতে যোগাযোগ থাকলেও সময়ের সাথে সাথে একটা সময়ে বন্ধই হয়ে যায়।দেবব্রত বিয়ে করে ওদেরই ব্যাচ মেট হিস্ট্রি অনার্সের তৃপ্তিকে আর নীলাদ্রি বিয়ে করে হিস্ট্রি অনার্সেরই তণ্বীকে।বাকি দুজন পরিবারের পছন্দে।কারোরই যদিও কারোর বিয়েতে উপস্থিত থাকা হয়নি।সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেকদিন পর আবার পুরোনো বন্ধুদের মধ্যে যোগাযোগ হয়েছে। ‘সকাল থেকে কতবার ঘড়ি দেখলে’?হাসতে হাসতে বলে তৃপ্তি, ‘আমারও তো বন্ধু,কই আমি তো অতো ছটফট করছি না।বারোটার মধ্যে সবাই আসবে বলেছে,ঠিক এসে পড়বে’।

‘ছটফট না করলে কাল থেকে পঞ্চাশবার আমায় বাজারে পাঠাতে না।আজ তো মিনতিকে কোন রান্নাও করতে দিলে না।নিজের হাতে রান্না করে বন্ধুদের খাওয়াবে বলে।যবে থেকে আসবে শুনেছো,তবে থেকেই তো তণ্বীকে দেখার জন্য উতলা হয়ে আছো’,খবরের কাগজ টেবিলে রেখে গেটের দিকে উঁকি মারলেন দেবব্রত। তৃপ্তি ঠোঁটের কোণায় একটু দুষ্টুমি ফুটিয়ে বললো,তণ্বীর জন্য আমি উতলা হচ্ছি,না তুমি?কলেজে পড়ার সময় তো তণ্বীর রূপে হাবুডুবু খেতে। ‘সে কি শুধু আমি নাকি?কলেজের সব ছেলেরাই খেত।তণ্বীর ফিগারটা,ওর বাবা-মার দূরদৃষ্টি ছিল বলতে হবে।স্বার্থক নাম রেখেছিলেন মেয়ের’। ‘থাক,থাক হয়েছে।নীলুর সামনে আবার এসব বোলোনা।সেই কলেজ লাইফ থেকে তণ্বীর ব্যাপারে ও যা পসেসিভ।একবার তণ্বীকে কে যেন লাভ লেটার দিয়েছিলো বলে তাকে মেরে নাকই ফাটিয়ে দিয়েছিলো’।

দেবব্রত উত্তর দেওয়ার আগেই গাড়ির হর্ন শোনা গেলো।‘ওই ওরা বোধহয় এসে পড়েছে’,দুজনে তড়িঘড়ি করে গেটের কাছে গেলো।একটা দুধ সাদা রঙের টাটা সুমো ওদের গেটের কাছে এসে থামলো।ওরা সবাই কলকাতায় কোথাও মিট করে গাড়ি ভাড়া করে একসাথে আসবে সেরকমই কথা ছিলো।আজ রাতটা ওদের বাড়ি কাটিয়ে পরের দিন লাঞ্চ সেরে ফিরবে।গাড়ি থেকে এক এক করে সবাই নামলো।দেবব্রত আর তৃপ্তির আনন্দ আজ দেখবার মতো।ছেলে ব্যাঙ্গালোরে থাকে চাকরি সূত্রে।ছুটিছাটায় বাড়ি ফেরে পরিবার নিয়ে।অন্য সময় এতো বড় বাড়ি যেন গিলতে আসে ওদের। প্রাথমিক উচ্ছ্বাস পর্ব শেষ হলে সুপ্রতিম বললো,তথা দেখ,দেবু এখনো সেই আগের মতোই ধর্মেন্দ্র মার্কা চেহারাটা ধরে রেখেছে।তৃপ্তি কী খাওয়াস রে বরকে?আমার বউকে একটু শিখিয়ে দিস তো।শালা,দিন দিন কেষ্ট মুখার্জীর মতো হয়ে যাচ্ছি।সবাই হো হো করে হেসে উঠলো ওর কথায়। ‘তোর লোকের পিছনে লাগার স্বভাব আর গেলো না।তোরা ভেতরে যাবি না.এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবি’?সবাইকে অভ্যর্থনা করে অন্দরমহলে নিয়ে যায় তৃপ্তি।

মহলই বটে।দেবব্রতর দাদু ডাকসাইটে উকিল ছিলেন।প্রচুর সম্পত্তিও করেছিলেন।দেবব্রতর বাবা একমাত্র উত্তরাধিকারী হলেও উকিল হিসেবে তারও নাম ছিলো।দেবব্রত যদিও ওই পথে হাঁটেনি,সে সরকারী চাকুরে ছিলো।কলকাতায় বাড়ি,ওখানেই থাকতো এর আগে।রিটায়ারমেন্টের পর কী মনে হলো,ইঁটাচুনার বাড়িতে সবশুদ্ধ চলে এলো।দু’মহলা বিশাল বাড়ি,সামনে অনেকখানি জায়গা জুড়ে মরসুমি ফুলের বাগান।পিছনে পুকুর আর নানারকম ফল-সবজির গাছ।খাওয়া দাওয়ার পর সবাই ঠিক করলো বাঁধানো পুকুর পাড়ে বসেই আড্ডা দেবে।

‘নীলু তোকে আসা থেকেই এতো চুপচাপ লাগছে কেন রে’?দেবব্রত পান চিবোতে চিবোতে প্রশ্ন করলো।
‘ও কোনদিন আমাদের মতো ফাজিল ছিলো দেবু?ওতো বরাবরই সিরিয়াস ধরণের ভালো ছেলে।আর সেই কারণে আমাদের দৌড় ওই আশুতোষে শেষ হয়েছে,আর ওর অক্সফোর্ডে’,তথাগতর কথায় খানিকটা শ্লেষই মেশানো ছিলো।নীলাদ্রি অবশ্য কোন কথার উত্তর দিলো না,একমনে পুকুরের নিস্তরঙ্গ জলের দিকে তাকিয়ে থাকলো।তণ্বী একটু অপ্রস্তুত বোধ করে বললো,ওর ইদানিং কী হয়েছে কে জানে,আমার সাথেও ভালো করে কথা বলে না।

সুদীপা বললো,তোমর বর না হয় একটু শান্ত প্রকৃতির মানুষ,আমারটি তো তা নন।কোথাও গেলে একাই আসর মাতিয়ে রাখেন।সবাই সুপ্রতিমদা বলতে অজ্ঞান।আর বাড়িতে এলে টিভির সামনে থেকে নড়তেই চায়না।সারাটাদিন আমি একলা।মেয়েটাও বিয়ের পরে জার্মানি চলে গেছে।একটা কথা বলার লোক পর্যন্ত নেই।সব ছেলেরাই এক বুঝলে।ঘর জ্বালানি আর পর ভোলানি। তথাগতর স্ত্রী বাসবদত্তাও সুদীপাকে সমর্থন করে বললো,ঠিক বলেছো,আমারটিও ওই একই পদার্থ।আমার বৌমা অবশ্য আমার মতোই সারাদিন বকবক করে,তাই বাঁচোয়া। ‘তণ্বী তুই কিন্তু বিদেশের জলহাওয়ায় ঠিক আগের মতো রয়ে গেছিস।আমাকে দেখ কি মুটিয়েছি।তোকে দেখলে এখনো ছেলেরা প্রেমে পড়বে’,শেষ কথাটা বলে আড়চোখে বরের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো তৃপ্তি।

‘তা যা বলেছিস।আমাদের মেরিলিন মনরো আগের মতোই সেক্সি’,বলেই জিভ কাটলো তথাগত,‘এই রে,নীলুর সামনে তণ্বীকে টিস্ করে ফেললাম।এক্ষুণি না রক্তারক্তি কান্ড ঘটায়’।সবাই হেসে উঠলেও নীলুর মধ্যে কোন বিকার দেখা গেলো না।সে চুপচাপ জলের দিকে তাকিয়ে বললো,জীবনের ভুলগুলো যদি অন্তত একবার শোধরানো যেতো।সবার সাধারণ কথাবার্তার মাঝখানে নীলুর কথাটা সবার কাছেই কেমন বেসুরো ঠেকলো। তণ্বী ছাড়া প্রত্যেকে নিজেদের মধ্যে একবার চোখ চাওয়া-চাউয়ি করলো ‘এই তণ্বী,ওর কী হয়েছে রে’?সুপ্রতিম একটু সিরিয়াস হয়েই প্রশ্ন করলো। ‘জানিনা রে,মাঝে মাঝে মনে হয় ও বোধহয় আমাকে সহ্যই করতে পারেনা।হয়তো তোদের বৌদের মতো সন্তান সুখ দিতে পারিনি বলে’,চোখের কোণায় জল চিক চিক করে ওঠে তণ্বীর,‘অনেক ডাক্তার দেখিয়েছি, সবরকম পরীক্ষাও করিয়েছি।ওর বা আমার,দুজনের কারুরই কোন ফিজিক্যাল ফল্ট ছিলোনা।তবুও মা হওয়ার আনন্দ পেলাম না রে।এটা কী আমারও কম কষ্ট?জানি না কোন জন্মের পাপের ফল’।

‘যে জন্মের পাপ সেই জন্মেই ভোগ করে যেতে হয়’,চোয়াল কঠিন করে পুকুরে একটা ঢিল ছুঁড়লো নীলাদ্রি।
দেবব্রত কথা ঘোরানোর জন্য বললো,ছাড়তো এখন ওসব কথা।ছেলেমেয়ে থাকলেই বা কী?বছরে দুবার হয়তো তাদের মুখদর্শন হয়।বাকি সময় তো সেই একই।দিনের শেষে বুড়োর আছে বুড়ি আর বুড়ির আছে বুড়ো।
‘বুড়ো-বুড়ির মজলিশে আজ কোন দুঃখের কথা হবে না।আজ নো হা-পিত্যেশ,শুধুই নির্ভেজাল আড্ডা।দেবু তুই নাকি আজকাল লেখালেখি শুরু করেছিস?তৃপ্তি বলছিলো’। ‘হ্যাঁ রে তথা,এই একটু একটু আধটু।সময় কাটানোর কল বলতে পারিস’। ‘তুমি যে কলেজ লাইফ থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে কবিতা লিখতে সেটা তো তোমার বন্ধুরা আর জানে না।আমিই জানলাম বিয়ের পরে’,তৃপ্তি মুচকি হেসে স্বামীর দিকে তাকালো। ‘ব্যাটা ছুপা রুস্তম।শুধু কবিতা কেন,তোর সাথে যে লুকিয়ে লুকিয়ে প্রেম করতো সেটাও তো আমরা জানতাম না।কোথাও ম্যাগাজিন-ট্যাগাজিনে দিস, না এখনো ডাইরিতে বন্দি করে রাখিস’?

‘ওই কয়েকটা লিটল ম্যাগাজিনে মাঝে মধ্যে বেরোয়।নকশাল আন্দোলন,হাংরি মুভমেন্ট মেইনলি সত্তরের দশকের অস্থিরতা নিয়ে একটা প্রবন্ধ লিখছি এখন।অনেকটাই তো নিজের চোখে দেখা।বাকিটা বইপত্র পড়ে,গুগল ঘেঁটে’।
‘নকশাল আন্দোলনের কথা শুনলেই সুমন্তর কথা খুব মনে পড়ে যায় রে দেবু’,সুপ্রতিম উদাস সুরে বললো।
তথাগত মুখ দিয়ে একটা আক্ষেপের শব্দ করে বললো,আমাদের মধ্যে সবথেকে ব্রাইট ছিলো ছেলেটা।ওইসবে যদি না জড়াতো,অনেক ভালো কেরিয়ার হতে পারতো। ‘তখন সময়টাই তো উত্তাল ছিলো।আমাদের কলেজের কত ব্রিলিয়ান্ট ছেলেই যে। সুপ্রতিম বললো,জানিস সুমন্তর কথা মনে পড়লেই আমার ওর চেহারাটা ভেসে ওঠে এখনও।আমাদের মতো ভারিক্কি চেহারা নয়,ওর সেই কম বয়েসের চেহারা।একগাল দাড়ি,জ্বলজ্বলে দু’টো চোখ আর ওর গায়ে আমি সারাক্ষণ চারমিনার প্লেনের গন্ধ পেতাম।ব্যাটা বোধহয় স্নানও করতো না।

তথাগত বললো,আর কাঁধের ঝোলাটা?ফিজিক্স অনার্সের ছেলের ব্যাগে ফিজিক্স বইয়ের বদলে পার্টির ইস্তাহার থাকতো।তবে ও সিওর রাত জেগে পড়তো। সুপ্রতিম বাধা দিয়ে বললো,ধুর,সিরিয়াসলি পড়লো কোথায়? তথাগত কেমন ঘোরের মধ্যে বললো,না রে।একদিনের কথা আমার পরিষ্কার মনে আছে।সেদিন খুব বৃষ্টি ছিলো।তোরা কেউ কলেজে আসিস নি।আমাকে ক্যান্টিনে বসিয়ে বোস-আইনস্টাইন স্ট্যাটিসটিক্স বুঝিয়েছিলো। আমাদের স্যারও ওরকম বোঝাতে পারতেন না। সুপ্রতিম পরিবেশ হালকা করার জন্য বললো,আর ওর সেই অদ্ভুত শখ? ‘শখ’?তথা আর দেবু সমস্বরে বলে উঠলো।

সুপ্রতিম বললো,ওর সেই চেলপার্কের টার্কিশ ব্লু দিয়ে লেখার কথা মনে নেই?পরীক্ষাতেও ওই কালি দিয়ে লিখবে বলে জেদ করলো।অমন সুন্দর সবুজ কালি নাকি আর হয় না।এই নিয়ে কতো ঝামেলা কলেজে,তোদের মনে নেই?
দেবব্রত আর তথাগত একসাথে ঘাড় নাড়লো।তাদেরও মনে পড়েছে।কিছুক্ষণ সবাই চুপচাপ,বিষণ্ণ হয়ে পড়লো।
তিনজনের কথাবার্তার মাঝে নীলাদ্রি এতক্ষণ চুপ করে ছিলো।সে হঠাৎ বলে উঠলো,তোরা একটা কথা বোধহয় জানিস না।সুমন্ত একটা মেয়েকে ভালবাসতো। বাকি তিনজন প্রবলভাবে আপত্তি জানায়,অসম্ভব।সুমন্ত,যার জীবনে নকশাল আন্দোলন ছাড়া আর কিছু ছিলো না।সে ভালবাসবে একটা মেয়েকে?জীবনে কখনো কোন মেয়ের সাথে চোখ তুলে কথা পর্যন্ত বলেনি।সে করবে প্রেম?যতো বাজে কথা।

নীলাদ্রি বিরক্ত মুখে উঠতে উঠতে বললো,বিশ্বাস করা না করা তোদের ব্যাপার।তোরা আড্ডা মার।আমাকে একটা আর্জেন্ট ফোন করতে হবে।নীলাদ্রির আচরণে কিছুটা হলেও ছন্দ কাটে।তণ্বী হঠাৎ ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠলো।এতক্ষণ মেঘ বুকে জমিয়ে রেখেছিলো বোধহয়।বললো,দেখলি তো,এরকমই আনসোশ্যাল হয়ে গেছে আজকাল।এতোদিন বাদে দেশে ফিরেছি,তাও মাত্র দুমাসের জন্য।মানুষের কত উৎসাহ থাকে সবার সাথে দেখা করার।সেই যে এসেছে বাড়ি থেকে আর বেরোয়নি।এখানেও আসতে চাইছিলো না।

আমি অনেকবার জোর করায় তারপর এসেছে। পরিবেশটা আচমকাই কেমন ভারী হয়ে উঠলো।তৃপ্তি বললো,কাঁদিস না।হয়তো কোন কারণে আপসেট হয়ে আছে,ঠিক হয়ে যাবে।সেরকম মনে হলে একবার কাউন্সিলিং করিয়ে নে।আচ্ছা চল তো,আমি চা বানাবো,হেল্প করবি।সুদীপ্তা,বাসবদত্তা তোমরাও চলো।ওরা তিন বন্ধু কিছুক্ষণ নিজেরাই গল্প করুক।তৃপ্তি ওদের নিয়ে রান্নাঘরে চলে যায়।হেমন্তের মিষ্টি হাওয়ায় তিন বন্ধু স্মৃতির সরণি বেয়ে আবার নস্টালজিয়ায় ডুবে যায় । সন্ধে ছ’টা নাগাদ চা আর গরম গরম আলুর চপ নিয়ে আর এক প্রস্থ আড্ডা শুরু হলো।নীলাদ্রীও যোগ দিলো চায়ের টেবিলে।দুপুর থেকেই সবাই তৃপ্তির রান্নার প্রশংসায় পঞ্চমুখ।আলুর চপে আবার তার পুনরাবৃত্তি হলো।তৃপ্তি বললো,রান্না তো আজকাল করাই হয়না।আর্থারাইটিসের ব্যথার জন্য বেশিক্ষণ দাঁড়াতে পারিনা।রান্নার লোক আছে ওই সব করে।লোকজন এলে তখন আমি করি মাঝে মাঝে।

‘ইউটিউব দেখে যে মাঝে মাঝে রান্না করো,সেকথা বলেছো সবাইকে?কি দিনকাল পড়েছে,কম্পিউটার রান্নাও শেখাচ্ছে’,দেবব্রত হালকা স্বরে তৃপ্তির দিকে তাকিয়ে বললো। তৃপ্তিও পাল্টা জবাব দেয়,আর তুমি যে কম্পিউটার দেখে ভূত নামাচ্ছো,সেকথা বলেছো ওদের? ‘ভূত নামাচ্ছে মানে’?তড়াক করে লাফ দিয়ে ওঠে তথাগত,‘রিটায়ারমেন্টের পর ওঝাগিরি করছিস নাকি রে দেবু’? ‘গুরু তুমি আর কি কি করছো একটু খোলসা করে বলো তো’?সুপ্রতিম পাশ থেকে ফোঁড়ন কাটলো। ‘ধুর,ছাড় তো তৃপ্তির কথা,একটা লেখার জন্য কিছুদিন প্ল্যানচেট নিয়ে একটু পড়াশোনা করেছিলাম।হাতে কলমে কিছুই করিনি।আত্মা নামানোর কথা বললেই তো তৃপ্তির আত্মা খাঁচাছাড়া হয়ে যায়’।

‘ভূত দেখার আমার কতদিনের ইচ্ছে রে!রায়পুরে যখন থাকতাম,শুনেছিলাম ওখানে একটা পোড়োবাড়িতে নাকি ভূত দেখা যায়।একবার এক কলিগ কে নিয়ে ওই বাড়িতে রাত কাটাবো ঠিকও করেছিলাম,কিন্তু আমার গিন্নি সে আশায় এক বালতি জল ঢেলে দিলেন’,দুঃখী দুঃখী মুখ করে সুদীপার দিকে তাকালো সুপ্রতিম। ‘ভূত বলে কিছু হয়না’,বাঁকা হেসে নীলাদ্রি বললো,‘সব মনের ভুল।আর প্ল্যানচেট তো পুরোটাই বুজরুকি।আত্মা যদি সত্যি সত্যি ডাকলেই নেমে আসতো,তাহলে’। ‘তাহলে কী রে নীলু?আত্মা এসে তোর ঘাড়ে চাপতো’?হা হা করে হাসতে হাসতে বললো দেবু। নীলু কোন উত্তর দিলো না।দেবব্রত চায়ে একটা বড় চুমুক দিয়ে বললো,আমারও তোর মতো এইসবে বিশ্বাস ছিলো না।কিন্তু অনেক কিছু পড়ার পর একটু একটু বিশ্বাস জন্মেছে।যদিও তোর মতো কট্টর বামপন্থীরা কোনদিন ভূত বা ভগবান কোন কিছুতেই বিশ্বাস করে না।

‘ঠাকুরবাড়িতে তো প্রায়ই প্ল্যানচেট হতো শুনেছি।রবিঠাকুর তো নিজেই কাদম্বরী দেবী,মৃনালিনী দেবীর আত্মা নামিয়েছিলেন’।তথাগতর কথার রেশ টেনে সুপ্রতিম ঠাট্টা করে বললো,ঠাকুর বাড়িতে যখন হতো তখন মিত্র বাড়িতে হতেও বা ক্ষতি কী?দুধ কা দুধ,পানি কা পানিও হয়ে যাবে। দেবব্রত উত্তেজনায় চেয়ার ছেড়ে উঠে বললো,আমার মনের কথা বললি তুই।প্ল্যানচেট নিয়ে পড়ার পর থেকেই খুব ইচ্ছে হচ্ছিলো করার,কিন্তু সঙ্গী পাচ্ছিলাম না।আজ যখন তোরা আছিস তখন একবার অ্যাডভেঞ্চার হয়েই যাক।তার আগে তোমাদের গিন্নিদের থেকে পারমিশন নিয়ে নাও।

‘আমি তো রাজি,মহিলাদের নেবেন তো’?সুদীপা দেবব্রতর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো। ‘আলবাত নেবো।বাকি মহিলারা কি বলে দেখি’? তণ্বী আর বাসবদত্তাও রাজি হয় গেলো।তৃপ্তি একটু খুঁতখুঁত করছিলো,কিন্তু সবার চাপে ওকেও রাজি হতে হলো। সুপ্রতিম বললো,সে না হয় হলো।কিন্তু কার আত্মা নামাবি,কোন বিখ্যাত ব্যক্তির? দেবব্রত আপত্তি জানিয়ে বললো,বিখ্যাতদের কথা তো মোটামুটি সবাই জানে।চেনা জানা কারুর মনের কথা জানা গেলে বেশি মজা হতো।সেরকম কারুর কথা ভাব যাকে আমরা মোটামুটি সবাই চিনি’। ‘সুমন্তর আত্মা নামালে কেমন হয়’?নীলাদ্রি আচমকা বলে উঠলো,‘ওকে তো সুদীপা আর বাসবদত্তা ছাড়া আমরা সবাই চিনি’।

‘এটা দারুণ আইডিয়া।কী বলিস দেবু?তৃপ্তি,তণ্বী তোদের কোন আপত্তি নেই তো’? ‘হঠাৎ এতো লোক থাকতে সুমন্তর কথা বললে কেন’,তণ্বী বেশ বিরক্তির স্বরে নিলাদ্রীকে জিজ্ঞেস করে,আমার খুব একটা মত নেই’। ‘উফ তোর আবার মত না থাকার কী হলো।আমার দাদুর আত্মা নামালে তোর ইন্টারেস্ট থাকবে,না তোর দাদুর নামালে আমার?নিলাদ্রীর আইডিয়া একদম বেস্ট।তাছাড়া সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটেও পাশ হয়ে গেছে’। তণ্বী আর কিছুই বললো না।কিন্তু ওর মুখে চোখে একটা অস্বস্তির ভাব বেশ ফুটে উঠলো।

রাত বারোটায় প্ল্যানচেট শুরু হবে ঠিক হলো।নৈশভোজের পর রাত সাড়ে এগারোটায় সবাই দেবব্রতর চিলেকোঠার ঘরে হাজির। ‘একটা তেপায়া টেবিল হলে ভালো হতো।কিন্তু সেরকম তো কিছু নেই।দাদুর আমলের এই টেবিলটাই আছে।এতো বড় টেবিল ব্যবহার হয়না বলে এখানেই ফেলে রেখেছি।এটাতেই হোক তাহলে’?দেবব্রত সবার উদ্দেশ্যে বললো। নিচের থেকে আটটা চেয়ার আগেই আনা হয়ে গেছে। ‘তৃপ্তি মোমবাতি এনেছো তো’?দেবব্রতর প্রশ্নে তৃপ্তি ঘাড় নেড়ে বললো,আমার কিন্তু খুব ভয় করছে।যত উদ্ভট আইডিয়া।সবার সাথে এতদিন পরে দেখা হলো।কোথায় গল্পগাছা করে সময় কাটাবো তা নয়,যতো ভুলভাল পরিকল্পনা’।

‘শোন,আমি মিডিয়াম হচ্ছি।কাগজ আর পেন্সিল রাখলাম।তণ্বী মোমবাতিটা জ্বালিয়ে দে তো।তোরা সবাই আমার মতো দু’হাতের আঙ্গুলগুলোকে টেবিলের উপর আলতো করে ছুঁইয়ে রাখ।আলো নেভানোর পর কেউ কোন কথা বলবি না।একমনে সুমন্তর কথা ভাববি।কেউ যদি ভয় পাস উঠে গিয়ে লাইটটা জ্বালিয়ে দিস।লাইট জ্বালালে আত্মা আর থাকে না শুনেছি।বাকি সবকিছু তো তোদের আগেই শিখিয়ে দিয়েছি।তাহলে শুরু করা যাক?তথা,লাইটটা অফ করে দে’। দেবব্রতর নির্দেশ মতো সবকিছু ঠিকঠাক করে সবাই প্রতীক্ষা করতে লাগলো।ঘড়ির কাঁটা সেকেন্ড,মিনিট করে এগোতে থাকে।মোমটা প্রায় শেষ হয়ে আসছে।তার মৃদু আলোয় চেয়ারে বসে থাকা আটজনের ছায়াগুলো কাঁপছে।সবার মৃদু শ্বাস-প্রশ্বাস ছাড়া আর কোন শব্দ নেই।নিস্তব্ধ আবছা অন্ধকার ঘর। হঠাৎ সবার মনে হলো টেবিলটা যেন ঠকঠক করে একবার নড়ে উঠলো।তারপরই শোনা গেলো নীলাদ্রির গম্ভীর অথচ চাপা কন্ঠস্বর,সুমন্ত এসেছিস?

দু-তিন সেকেন্ড পর দেবব্রতর হাতের পেন্সিলটা কাঁপা কাঁপা হাতে লিখলো,হ্যাঁ।আমি আছি। প্রত্যেকের গায়ে মুহূর্তে কাঁটা দিয়ে উঠলো।তথাগত প্রশ্ন করলো,কেমন আছিস? দেবব্রতর পেন্সিল স্থির হয়ে রইলো,কিছু লেখা ফুটলো না। তথাগত মৃদু স্বরে বললো,এতো ব্রিলিয়ান্ট ছিলি।অথচ,তোর আফশোস হয়নি? দেবব্রত কেমন যেন মাথা ঝুঁকিয়ে ঘোরে পড়া মানুষের মতো বসে আছে।কাগজে এলোমেলো লেখা এলো,না। তথাগত আবার বললো,তুই জানিস,তুই মারা যাওয়ার পর মাসীমা,মেসোমশাই এক বছরের মধ্যেই মারা গেলেন?এক মাত্র ছেলের মৃত্যু মেনে নিতে পারেন নি। পেন্সিল আবারও স্থির হয়ে থাকলো।সুপ্রতিম বললো,তোকে জেলে খুব অত্যাচার করেছিলো শুনেছিলাম।তোকে মেরে মেরে পঙ্গু করে দিয়েছিলো।সত্যি?পেন্সিল আবার লিখলো,হ্যাঁ। সুপ্রতিম আবার বললো,খুব কষ্ট পেয়েছিলি?

সুপ্রতিমের একদম পাশেই বসে থাকা দেবব্রতর গলা দিয়ে এই প্রথম একটা ঘড়ঘড় শব্দ শোনা গেলো।তারপর তার হাতের আঙ্গুল আরো কাঁপতে কাঁপতে লিখলো,খুব কষ্ট…খুব কষ্ট। হঠাৎ সবাইকে চমকে দিয়ে তণ্বী প্রশ্ন করলো,তুই আমাকে খুব ভালবাসতিস, তাই না?দু’তিন সেকেন্ড পর আবার কাগজে লেখা ফুটে উঠলো,হ্যাঁ।তণ্বী যেন আরও সাহসী হয়ে উঠলো।কারুর তোয়াক্কা না করেই কান্না মিশ্রিত কণ্ঠে বললো,আমিও বাসতাম।কিন্তু কি করবো বল,তোর সম্পর্কে আমাকে ভুল বোঝানো হয়েছিলো। মোমবাতির কাঁপা কাঁপা আলোয় তণ্বীর চোখে ঘৃণা স্পষ্ট হলো। ‘তুই জানিস,সেদিন তোর গোপন আস্থানার খবর তোরই এক বন্ধু পুলিশকে জানিয়েছিলো’?নীলাদ্রি প্রশ্ন করে।
পেন্সিলে আবার লেখা হলো,হ্যাঁ।

নীলাদ্রি এবার আর নিজেকে সামলাতে পারলো না,কান্নায় ভেঙে পড়লো,এতোকাল বুকে অপরাধের বোঝা বয়ে নিয়ে বেরিয়েছি রে।আর সামলাতে পারছি না সুমন্ত।ভালবাসায় অন্ধ হয়ে গিয়েছিলাম।আমাকেক্ষমা করে দে ভাই।
সুপ্রতিম উঠে আলো জ্বালিয়ে দিয়ে রুক্ষস্বরে বললো,কি নাটক হচ্ছে এসব।তণ্বীর মুখ থমথমে।সুদীপা,বাসবদত্তা কেমন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে।তৃপ্তি বললো,আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।দেবব্রত পেন্সিল রেখে হো-হো করে হাসতে হাসতে বললো,দেখ নীলু,আমিও কিন্তু নাটকে কিছু কম যাই না।তোদের কত্তা-গিন্নির সাথে পাল্লা দিয়ে কেমন অভিনয় করে গেলাম বল তো? নীলাদ্রি তখনও স্বাভাবিক হতে পারেনি।তথাগত বলে উঠলো,এইসব ইয়ার্কি আমার একদম ভালো লাগে না। সুপ্রতিম বললো,আমিও বুঝতে পারিনি ওরা নাটক করছে।

পরিবেশ একটু হালকা হতে শুরু করছিলো।ঘরের গুমোট কেটেছে।হঠাৎ বাসবদত্তা বলে উঠলো,দেবুদা,আপনি পেন্সিলে লিখছিলেন না? দেবব্রত অবাক হলো,হ্যাঁ,কেন? বাসবদত্তা কাগজটা টেনে নিয়ে বললো,এই কাগজের লেখাগুলো তো পেন্সিলের নয়, সবুজ কালিতে লেখা। ‘আর টেবিলের উপর রাখা এই ম্যানিফেস্টো?এটা তো এখানে ছিলো না’? মুহূর্তে যেন বজ্রপাত হলো ঘরে।সবার শিড়দাঁড়া বেয়ে ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেলো।দেবব্রত টেবিল থেকে কাগজটা নিয়ে বিস্ফারিত চোখে দেখতে লাগলো।সত্যি পেন্সিলের বদলে টার্কিশ ব্লু কালিতে লেখা শব্দগুলো। ‘এইগুলো বদলে গেল কী করে?তাহলে কি সত্যিই’? কেউ কথা বললো না।একমাত্র নীলাদ্রিই ঘোলাটে চোখে সবার দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বললো,ও এসেছিলো,আমি টের পেয়েছি।

পিন পতনের নিস্তব্ধতা ঘর জুড়ে।তৃপ্তির হাত-পা কাঁপছে।সুদীপা,বাসবদত্তাও খুব ভয় পেয়েছে বোঝা যাচ্ছে।তণ্বী মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লো।তার সন্দেহ তাহলে সত্যিই ছিলো। সুপ্রতিম নিলাদ্রির দিকে অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,নীলু,তুই?তারপর ‘ছিঃ’ বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।একে একে সবাই চলে যাওয়ার পর শুধু একা নিলাদ্রী টেবিলের উপর মাথা গুঁজে বসে রইলো অনেকক্ষণ।এখন তার একা থাকার সময়।অনেক,অনেকদিন পর আজ তার একটু হালকা লাগছে।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত