ফুটবল

ফুটবল

(আজকে ইস্টবেঙ্গল ক্লাব শতবর্ষে পদার্পণ করল। আর আমি নিজেও বাঙ্গাল। তাই এই সুযোগ হাতছাড়া না করে লিখে ফেললাম আমার দ্বিতীয় গল্প “ফুটবল”। করাল কিংবদন্তী ২ ইভেন্টে লেখা আমার প্রথম গল্প “চেঙ্গিস খানের সমাধি” পড়ে আপনারা যেভাবে উৎসাহ দিয়েছে তাতে আরেকটা গল্প লেখার লোভ সামলাতে পারলুম না। আমার মাতৃসম ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের প্রতি আমার ছোট্টো শ্রদ্ধাঞ্জলি।

এই গল্পের সমস্ত স্থান, কাল, চরিত্র কাল্পনিক। বাস্তবের সাথে মিল পেলে তা হবে নিতান্তই কাকতালীয়।)

“নাঃ ওদের হাত থেকে আমার নিস্তার নেই দেখছি। ছিনে জোঁকের মতন লেগে রয়েছে।” ব্যাজার মুখে মাঠে এসে নিজের স্পোর্টস কিটটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে মন্তব্য করল খোকন।

“ওরা আজকেও এসেছিল?” প্রশ্ন করল তপন।

“হু। রীতিমত থ্রেট দিয়েছে।”

খোকনের এই কথায় একটা মুচকি হাসির রোল পরে গেল সবার মধ্যে। হয়ত গর্বে বা অহংকারে বুকটা একটু ফুলেও উঠল খোকনের। কিন্তু কোচ হারাধন বাবুর মুখ কালো হয়ে গেল। তিনি পরিস্কার বুঝতে পারলেন আরও একবার ঝড় ঘনিয়ে আসছে। “কি হয়েছে কাকু? কোনো সমস্যা?” খোকনের কথায় সম্বিৎ ফেরে হারাধন বাবুর। “না কিছু না। প্র্যাক্টিসে চল।” টিম নিয়ে প্র্যাক্টিস করতে চলে গেলে হারাধন বাবু। খোকনের সহজ, সরল মুখ দেখে হারাধনবাবুর বুক মোচড় দিয়ে উঠল। বাচ্চা ছেলেটা জানেও না ওর সামনে কি অপেক্ষা করে আছে।

একটু ফ্ল্যাশব্যাকে যাওয়া যাক। ১৯৬২ সাল। নদীয়া জেলার একটি বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী গ্রাম ছাতিনা। স্বাধীনতার পরে ভারতের পূর্ব আর পশ্চিম প্রান্তের বিভিন্ন জনপদের মতন ছাতিনা গ্রামও ছিল শরণার্থীদের ভারে জর্জরিত। এই গ্রামেরই বাসিন্দা রমেন চৌধুরীর বিশাল আশি বিঘা জমির একটা অংশেই শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়া হয়েছিল।

চৌধুরী পরিবার এক সময়ে ছিল এই অঞ্চলের জমিদার। সেই বংশের উত্তরপুরুষ হচ্ছেন রমেন চৌধুরী। এখন জমিদারি না থাকলেও উত্তরাধিকার সূত্রে বিপুল জমির মালিকানা তিনি হাতে পেয়েছেন। তিনি আবার স্থানীয় বিধায়কও বটে। সেই রাজনৈতিক ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে ধুরন্ধর রমেন বাবু ছলে, বলে, কৌশলে জমির পরিমান আরও বাড়িয়ে নিয়েছেন। সেই জমিরই একটা অংশে শরণার্থীদের থাকতে দিয়েছিলেন তিনি। ভেবেছিলেন এতে কিছুটা পলিটিকাল মাইলেজ পাবেন। ভোটে জিতে যাবার পরে ওই ছোটোলোক উদ্বাস্তু গুলোকে জায়গা থেকে হাটিয়ে দেবেন। কিন্তু সেটা আর তিনি করতে পারেন নি। ধীরে ধীরে ওই জায়গায় বাঙ্গাল কলোনি তৈরি হয়। স্কুল, কলেজ, ক্লাব তৈরি হয়। রমেন বাবু বুঝতে পারেন অবস্থা হাতের বাইরে চলে গেছে। এমনিতেই ঐ সময় ঘটিরা অর্থাৎ এপার বাংলার লোকজন বেশিরভাগই শরণার্থীদের স্বাভাবিক ভাবে মেনে নেয়নি। তার উপরে এই ঘটনায় রমেন বাবু আরও ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলন। নিস্ফল ক্রোধে তিনি হয়ে উঠলেন চূড়ান্ত বাঙ্গাল বিদ্বেষী।

যেই সময়ের কথা বলা হচ্ছে সেই সময়ে গ্রাম বাংলার মানুষের জীবন ছিল নিস্তরঙ্গ দীঘির মতই একঘেয়ে। পুরুষেরা পরনিন্দা পরচর্চা করে আর মহিলারা পরনিন্দা পরচর্চার সাথেই একে অপরের মাথার উকুন বেছে অবসর সময় কাটাত। আর ছিল ফুটবল। একঘেয়ে সাদামাটা জীবন যাপনে অভ্যস্ত মানুষগুলোর কাছে ফুটবল খেলা ছিল মৃত সঞ্জীবনী। গ্রামে নিয়মিত ফুটবল টুর্নামেন্ট হত আর সেই সময় পুরো গ্রামের পরিবেশই যেন পাল্টে যেত। সাধে কি আর বলা হয় “সব খেলার সেরা বাঙ্গালীর তুমি ফুটবল রমেন বাবুর নিজেও ছিলেন ফুটবল খেলার বড় অনুরাগী। স্থানীয় ফুটবল ক্লাব ছাতিনা একাদশের কর্ণধার এবং বড় পৃষ্ঠপোষক ছিলেন তিনি। টুর্নামেন্ট জেতার জন্যে বিভিন্ন জায়গা থেকে ভাল ভাল খেলোয়াড় ভাড়া করে আনতেন তিনি। সেইজন্যে পয়সা ছড়াতে বিন্দুমাত্র কসুর করতেন না তিনি। গোটা নদীয়া জেলায় ছাতিনা একাদশের মতন টিম আর ছিল না। এই জন্যে রমেনবাবুর বেশ অহংকারও ছিল।

কিন্তু রমেনবাবুর এই অহংকার চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে শুরু করল যখন বাঙ্গাল কলোনিতে ইলেভেন বুলেটস বলে একটা ফুটবল ক্লাব তৈরি হল। অহংকারী রমেনবাবু প্রথমে পাত্তা দিতে চাননি। স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিমায় ভেবেছিলেন ছোটোলোক বাঙ্গালগুলো আর কি ফুটবল খেলবে? বল নিয়ে লাথালাথি করলেই কি খেলা হয় নাকি? তবে তার এই ভুল ভাঙ্গতে বেশিদিন সময় লাগল না।

ভিটেমাটিহীন ছিন্নমূল মানুষগুলোর কাছে ইলেভেন বুলেটস শুধুই একটা ফুটবল ক্লাব ছিল না। ছিল অপমানের বদলা নেবার একটা মাধ্যম। দেশভাগের যন্ত্রণা, এপার বাংলার মানুষদের বঞ্চনা, নিজেদের পাওয়া না পাওয়ার খতিয়ানে ইলেভেন বুলেটস হয়ে উঠল শরণার্থীদের কাছে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার একটা মাধ্যম। ফলে খুব দ্রুতই খেলায় উন্নতি করতে লাগল ইলেভেন বুলেটস।

ফ্ল্যাশব্যাক থেকে আবার বাস্তবে ফিরে আসি। প্র্যাক্টিস শেষ করে বাড়ির পথ ধরে খোকন। আজকে একটু বেশিই রাত হয়ে গেল। মাত্র একমাস পরেই টুর্নামেন্ট। তাই একটু বেশি সময় অনুশীলন করতে হচ্ছে আজকাল। তার উপরে খোকন হচ্ছে ইলেভেন বুলেটসের সেরা প্লেয়ার। বাড়তি দায়িত্ব আছে ওর উপর। তাই কোচ হারাধন বাবুও একটু বিশেষ নজর রাখেন তার সেরা অস্ত্রটির উপরে।

নির্জন রাস্তা দিয়ে নিজের মনেই হাটছিল খোকন। হঠাতই কেউ যেন খোকনকে ধাক্কা দিয়ে রাস্তার পাশে ফেলে দিল। কিছু বুঝে ওঠার আগেই খোকন দেখল ও যেখান দিয়ে হাটছিল ঠিক সেখান দিয়েই হুঁশ করে একটা ট্রাক বেরিয়ে গেল। অর্থাৎ সঠিক সময়ে ধাক্কা দিয়ে না ফেলে দিলে এখানেই ওর জীবনের ইতি হয়ে যেত। হতবুদ্ধি হয়ে রাস্তার পাশেই কিছুক্ষণ বসে থাকল খোকন। হয়ত বুঝতে চেষ্টা করল কে এই উপকারী বন্ধু। কিন্তু নির্জন এই রাস্তায় ঘন অন্ধকারের মধ্যে কাউকেই দেখতে পেল না। হতাশ হয়ে বাড়ির পথ ধরতেই পিছন থেকে একটা ডাক ভেসে আসল “খোকন।”

পিছন ফিরে খোকন দেখল তার সামনে অন্ধকারটা যেন ধীরে ধীরে জমাট বেঁধে একটা পূর্ণাঙ্গ মানুষের রূপ নিচ্ছে। অবশেষে তার সামনে যেই অবয়ব প্রকট হল সেটা দেখেই খোকনের অজ্ঞান হয়ে যাবার মতন অবস্থা। এ কাকে দেখছে সে!! ইলেভেন বুলেটস ক্লাবে যার ছবি টাঙ্গানো থাকে, যার সুখ্যাতি অনেক শুনেছে সে, সেই নীহার বসাক। কিন্তু ইনি তো অনেক বছর আগেই আর ভাবতে পারছে না খোকন। কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সে। যথেষ্ট সাহসী ছেলে সে। ভূত প্রেত মানে না। কিন্তু এখন যেন নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছে না যে কি হচ্ছে এখানে।

“ভয় পেয়ো না খোকন। আমি তোমার উপকার করতেই এসেছি।” বলে উঠল নীহার থুড়ি নীহারের ছায়ামূর্তি। “কি  কিন্তু আ…আ…আপনি তো মানে মানে অনেকদিন আগে” ভয়ে, উত্তেজনায় খোকন যেন ঠিক করে কথাও বলতে পারছিল না। “হ্যা, পাঁচ বছর আগে আমি মারা গেছিলাম। খুন হয়েছিলাম।” “খুন? কিন্তু সবাই তো জানে খোকনের কথা শেষ হবার আগেই ছায়ামূর্তি বলে উঠল, “রমেন চৌধুরীর লোক আমাকে খুন করে সেটা দুর্ঘটনা বলে চালিয়ে দেয়। একমাত্র হারাধন কাকুই সত্যিটা জানে।” কৌতূহল চাপতে না পেরে খোকন জিগ্যেস করল, “খুন করার কারণ?”

“রমেন চৌধুরী লোকটা বাঙ্গাল বিদ্বেষী হলেও গুণের কদর করতে জানে। টুর্নামেন্টে নিজের ক্লাব ছাতিনা একাদশকে জেতানোর জন্যে বেশি টাকা দিয়ে প্লেয়ার কেনা ছিল ওর কাছে জলভাত। সেই কারণে আমার কাছেও ও দলবদলের অফাস নিয়ে এসেছিল। কিন্তু আমি রাজি হইনি। বাঙ্গালরা অর্থের কাছে মান সম্মান বিকিয়ে দেয় না। আমাকে দলে টানতে না পেরে এরকমই একদিন রাতে আমাকে গাড়ি চাপা দিয়ে মেরে ফেলে। পরে সেটাকেই দুর্ঘটনা বলে চালিয়ে দেয়। ও কোনোভাবেই চায়না ইলেভেন বুলেটস কাপ জিতুক।”

খোকনের মনে পড়ল একটু আগের ঘটনা। রমেন চৌধুরীর হুমকি দেওয়ার খবর শুনে সবাই যখন আনন্দ করছিল তখন একমাত্র হারাধন কাকুর মুখেই দুশ্চিন্তার ছায়া দেখেছিল ও। হয়ত নীহারের মতন খোকনেরও একই ভবিষ্যতের কথা ভেবে আশঙ্কায় বুক কেঁপে উঠেছিল ওনার। কারণ বেশ কয়েকদিন ধরে ইলেভেন বুলেটসের সেরা প্লেয়ার খোকনকে নিজের দলে টানার চেষ্টা যে রমেন বাবু করছেন একথা ক্লাবের সবাই জানে। এক অজানা আশঙ্কায় কেঁপে উঠল খোকন। কোনোমতে বলল, “এখন আমি কি করব?” একটু চুপ করে থেকে নীহার উত্তর দিল, “তোমার মধ্যে বড় খেলোয়াড় হবার সবগুণ আছে। তুমিই পারবে রমেন চৌধুরীর অহংকার ভেঙ্গে দিতে। কাল থেকে সবাই চলে যাবার পরে মাঠে আসবে। আমি তোমাকে প্র্যাকটিস করাব। ইলেভেন বুলেটসের প্রথম কাপ জয় আর আমার মুক্তি এখন তোমার হাতেই।” “আপনার মুক্তি!!!!!”

“হ্যা” বলল নীহার “রমেন চৌধুরীর অহংকার না ভাঙ্গলে আমার মুক্তি হবে না। অনেকদিন পরে ইলেভেন বুলেটসে তোমার মতন খেলোয়াড় এসেছে যার মধ্যে সেই ক্ষমতা আছে। তুমিই পারবে আমাকে মুক্তি দিতে।” বলতে বলতে হাওয়ায় মিলিয়ে গেল নীহারের ছায়ামূর্তি। অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল খোকন। ও এই ক্লাবে নতুন। নীহার বসাকের খেলা দেখেনি ও। শুধু নাম শুনেছে। আজকে এরকম ভাবে তার দেখা পাবে স্বপ্নেও ভাবেনি খোকন। পরেরদিন থেকে শুরু হল খোকনের কড়া অধ্যবসায়। সবার সাথে প্র্যাক্টিস করার পরে রাত্রেবেলা একা একা মাঠে যেত নীহারের তত্ত্বাবধানে অনুশীলন করার জন্যে। এর মাঝে বেশ কয়েকবার রমেন বাবু এসে প্রলোভন দেখালেও কোনো কাজ হয়নি। দেখতে দেখতে এসে গেল বহু প্রতীক্ষিত ফুটবল টুর্নামেন্ট।

গোটা টুর্নামেন্টে দারুন খেলল ইলেভেন বুলেটস। খোকনের ড্রিবলিং দেখে অনেকেই বলাবলি করেছে পাঁচ বছর আগে প্রয়াত নীহার বসাকের ছায়া দেখা যাচ্ছে খোকনের মধ্যে। অবশেষে ফাইনালে মুখোমুখি ইলেভেন বুলেটস আর চির প্রতিদ্বন্দ্বী ছাতিনা একাদশ।

ফাইনালের আগের দিন দুই দলের খেলোয়াড়দেরই উত্তেজনা চরমে। একটা দলের সামনে রয়েছে ইতিহাস সৃষ্টির হাতছানি, মর্যাদার লড়াই। আরেকটা দলের কাছে মর্যাদা ধরে রাখার লড়াই। খোকনের অনবদ্য ফর্মে যখন আত্মবিশ্বাসের তুঙ্গে রয়েছে ইলেভেন বুলেটস, তখন সেই একই কারণে কপালে চিন্তার ভাঁজ ছাতিনা একাদশের। সেই সাথে চিন্তিত রয়েছে আরও একজন। কেউ জানেনা কপালে কি আছে।

পরেরদিন ফাইনাল। গোটা গ্রাম উত্তেজনায় ফুটছে। এদিকে ইলেভেন বুলেটস ক্লাবে যেন শ্মশানের নিস্তব্ধতা নেমে এসেছে। তাদের সেরা স্ট্রাইকার খোকন নিখোঁজ। আগেরদিন রাতেও সব ঠিক ছিল। তাহলে এখন এভাবে কোথায় গেল? চারিদিকে লোক পাঠিয়ে তন্ন তন্ন করে খুজেও খোকনের খোঁজ পাওয়া গেল না। কোচ হারাধন বাবুর মনে জেগে উঠল অন্য আশঙ্কা। পাঁচ বছর আগে নীহার বসাকের মৃত্যুর কথা মনে পড়ল। আর কেউ না জানুক তিনি জানেন নীহারকে গাড়ি চাপা দিয়ে খুন কড়া হয়েছে। তিনি ছিলেন ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী। আর সেই খুন যে রমেন চৌধুরীর লোকজনই করেছে সেটা জানার জন্যে বিশেষজ্ঞ হতে হয় না। তবে কি নীহারের মতন একই পরিণতি হল খোকনের? এভাবে কি একটা শয়তান লোকের হাতে একে একে ঝরে যাবে তাজা প্রাণগুলো? নাঃ আর ভাবতে পারছেন না উনি। ম্যাচের সময় এগিয়ে আসছে। খেলা শেষ হোক। তারপর দেখা যাবে। প্রিয় ছাত্রের এই অবস্থায় হারাধনবাবু ঠিক করেছেন এর শেষ দেখে ছাড়বেন।

ফাইনাল ম্যাচ শুরু হবার মাত্র কিছুক্ষণ বাকি আছে। এমন সময় হঠাত ইলেভেন বুলেটস শিবিরে যেন খুশির স্রোত উঠল। ভোজবাজির মতন কোথা থেকে খোকন ফিরে এসেছে। হারাধনবাবু জিগ্যেস করলেন, “এতক্ষণ কোথায় ছিলি?” “রমেন বাবুর লোক আটকে রেখেছিল। ভাগ্যক্রমে ছাড়া পেয়েছি।” চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল হারাধনবাবুর। “ঠিক আছে। তাড়াতাড়ি মাঠে যা।” এই বলে তাড়াতাড়ি দলকে মাঠে নামিয়ে দিলেন তিনি। অন্তর্ধান নিয়ে পরে কথা বলা যাবে।

এদিকে খোকনকে মাঠে দেখে চোখ কপালে উঠে গেল রমেন চৌধুরীর। আপন মনেই বললেন ব্যাটাছেলেকে ভাল করে বেঁধে রেখে তিনজনকে পাহাড়ায় বসিয়ে রেখে আসলাম। তাও ফিরে আসল কোথা থেকে? এমন সময় রমেন বাবু দেখলেন তার সামনে একটা ধোঁয়া উদয় হয়ে ধীরে ধীরে মানুষের আকৃতি নিচ্ছে। পূর্ণ আকৃতি নেওয়ার পরে যাকে দেখলেন সেটা দেখার জন্যে কোনোভাবেই প্রস্তুত ছিলেন না রমেন বাবু। চিৎকার করে উঠলেন, “তুমি? তুমি কি করে? তুমি তো পাঁচ বছর আগেই “মরে গেছিলাম না?” হেসে উঠল সেই ধোঁয়া মানব, “অনেক অপরাধ করেছেন রমেন বাবু। সামান্য ফুটবল খেলার জন্যে আমাকে মেরেছেন। আজকে আমার পালা।” “কি চাই তোমার? যাও এখান থেকে।” চিৎকার উঠলেন রমেন বাবু।

আশেপাশের লোকজন দেখল একা একাই চিৎকার করছেন রমেন বাবু। যেন অদৃশ্য কারোর সাথে কথা বলছেন। তাদের মধ্যে একজন জিগ্যেস করলেন, “কি হয়েছে রমেনদা? কার সাথে কথা বলছেন?” “ওই যে দেখতে পাচ্ছ না? নীহার এসেছে।” বলেই জ্ঞান হারিয়ে পরে গেলেন রমেন চৌধুরী। লোকজন ধরাধরি করে ওনাকে বাড়িতে নিয়ে গেল।

এদিকে ফাইনাল ম্যাচে দারুন খেলল ইলেভেন বুলেটস। পাঁচ শূন্য গোলে ছাতিনা একাদশকে হারিয়ে প্রথম বারের মতন টুর্নামেন্ট জিতল ইলেভেন বুলেটস। ছিন্নমূল সহায় সম্বলহীন মানুষগুলো নতুন ভাবে উজ্জীবিত হয়ে উঠল এই জয়ে। আর বাঙ্গালদের এই জয় সহ্য করতে না পেরে সেই দিনেই হার্ট অ্যাটাকে মারা যায় রমেন চৌধুরী।

সেইদিন গভীর রাতে নিজের বাড়িতে শুয়েছিল খোকন। হঠাত একটা পরিচিত কন্ঠস্বরে ঘুম ভেঙ্গে যায় খোকনের। চোখ খুলে দেখে সামনে নীহার বসাক দাঁড়িয়ে। একটা প্রণাম করে খোকন বলল, “আজকে তোমার জন্যেই জিতলাম নীহার দা। আমি সারাক্ষণ আজকে আমার পাশে তোমার অস্তিত্ব টের পেয়েছি।”

একটু হেসে নীহার উত্তর দিল, “ আমি শুধু তোকে উৎসাহ দিয়েছি আর রমেন চৌধুরী নামক কাঁটা দূর করেছি। খেলেছিস তুই। এই জিত তোর। এই জিত ইলেভেন বুলেটসের।” একটু চুপ করে থেকে নীহার আবার বলে উঠল, “দাদা বলে যখন ডাকলি তখন একটা শেষ কাজ করে দিবি?” “কি বলো?” “গঙ্গায় গিয়ে আমার নামে পিন্ডি দিবি? নাহলে মুক্তি পাচ্ছি না আমি।” “অবশ্যই দেব দাদা।” মিলিয়ে গেল নীহারের ছায়ামূর্তি।

পরেরদিন ভোরে গঙ্গার ঘাটে এসে যথাবিধি নিয়ম পালন করে পিন্ডদান করল খোকন। স্নান করে যখন নদী থেকে উঠতে যাবে তখন হঠাত ওর সামনে এসে পড়ল একটা বড়সড় ইলিশ মাছ। সাধারনত এইভাবে নদীর পাড় থেকে ইলিশ ধরা যায়না। এরা গভীর জলের মাছ। প্রচন্ড অবাক হয়ে খোকন মাছটা হাতে নিয়ে একবার আকাশের দিকে তাকাল। দেখল হাত নাড়তে নাড়তে হাসিমুখে মিলিয়ে যাচ্ছে নীহার বসাক। আর কিছুই বুঝতে বাকি রইল না খোকনের। মাছটা হাতে নিয়ে হাসিমুখে রওনা দিল বাড়ির দিকে।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত