পরিনতি

পরিনতি

খুব বৃষ্টি হচ্ছে । ছাতা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি বাইরে। রাস্তার পাশে। কোন রিকশা নেই রাস্তায়। জীবনের কঠিনতম একটা কাজ করে আসলাম। ভিতরে ভিতরে কি হচ্ছে বুঝতে পারছি না। এমন হবার কথা ছিল না। নাকি এমনই হয়ে থাকে।ভাবতে ভাবতে হঠাৎ রিকশাতে করে একটা ছেলেকে এইদিকে আসতে দেখলাম।আশেপাশে কোথাও কেউ নেই। ছেলেটি রিকশা থামিয়ে আমাকে ইশারায় ডাকল।

আমি ভাবছি, এই ছেলে আমাকে ডাকছে কেন? আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম। একদম নড়াচড়া নেই। অবশেষে ছেলেটিই নেমে আসল। এসে বলল, কি ব্যাপার এই বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে আছো কেন? আমি একটু অবাক হয়ে তাকালাম। প্রথম দেখায় ছেলেটি আমাকে এভাবে তুমি করে ডাকছে যেন আমাকে কবে থেকে চিনে। আমি একটু ভাল করে তাকালাম। আরে আমারও তো একটু একটু চেনা চেনা লাগছে। তবে মনে করতে পারছি না কোথায় দেখেছি।

– কি হল? কি বলছি? আমাকে চিনতে পাচ্ছ না? এত তারাতারি ভুলে গেছ? আমি মাথা নেড়ে বললাম যে না চিনতে পারছি না।

– আমি সুব্রত । কলেজে পড়তাম একসাথে আমরা। ঈশ্বর , তুমি ভুলে গেছ আমাকে? কত বিরক্ত করতাম তোমাকে।
একটু ভাল করে তাকালাম। হ্যাঁ, সুব্রত ই তো ।কত বদলে গেছে। চিকনা শরীর এখন মোটাসোটা হয়েছে। লম্বা মানুষ, অত শুকনা, আগে মনে হত, ভেঙ্গে চুরে পরে যাবে। এখন তাও শক্তিশালী লাগছে দেখতে, নাকের নিচে মোটা গোঁফ। কি অদ্ভুত লাগছে। এত পরিবর্তন হয়ে গেছে, চেনার কথা না। উপায় আছে? আমি বললাম- হ্যাঁ, চিনতে পেরেছি। তুমি তো অনেক বদলে গেছ। কেমন তামিল নায়কদের মত গোঁফ রাখছ। কি অদ্ভুত লাগছে দেখতে। গোঁফ রাখছ কেন?

-গোঁফের গল্প পরে হবে। ভিজে যাচ্ছ। রিকশাতে আসো তো।
– ও হ্যাঁ, চল।

নিজের অজান্তেই সুব্রত এর সাথে রিকশাতে গিয়ে বসলাম। আঁটসাঁট করে দুজন এক রিকশাতে বসে আছি। কত সহজে এত বছর পর আগের মত স্বাভাবিক ভাবেই ব্যবহার করল সুব্রত । ৫ বছর, অনেক সময়। ৫ বছর আগে শেষ দেখা হয়েছিল সুব্রত এর সাথে। ছেলেটা অনেক ভাল ছিল। ক্লাস এর সবচেয়ে ভাল ছাত্র। খুব ভাল করেই জানতাম ও আমাকে অনেক পছন্দ করে। মুখ ফুটে বলেনি কখনও। আর আমি স্বার্থপরের মত ওর এই ভাললাগার ব্যাপারটা কাজে লাগাতাম।

জানতাম কখনও সুব্রত কে কিছু বললে না করবে না,তাই পড়াশুনায় কিছু সমস্যা হলেই ওর কাছে ছুটে যেতাম, খুব সুন্দর করে বুঝিয়ে দিত। কখনও বিরক্ত হত না। আমার জন্য আলাদা করে প্রতিটা বিষয়ের নোট করত রাত জেগে,আমার প্রাকটিকাল খাতা গুলো পর্যন্ত ও করে দিয়েছিল। প্রতিদিন এসে জিজ্ঞেস করত হোম ওয়ার্ক করেছি কিনা, বই এনেছি কিনা। না আনলে নিজেরটা দিয়ে দিত, দিয়ে স্যারের বকা খেত। আর আমি স্বার্থপরের মত সেগুলো নিয়ে নিতাম। আসলেই কত স্বার্থপর ছিলাম। একবারের জন্যও বোঝার চেষ্টা করিনি কখনও। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকত সারাক্ষণ আমার দিকে। আমি তাকালেই অন্য দিকে তাকাত। ফাজিলটা একটা দিন এসে বলল না। এসে বললেই বা কি হত? ফিরিয়েই তো দিতাম।

– কেমন আছ সুব্রত ?
– হ্যাঁ, ভাল তুমি?
– এইতো আছি আর কি।
– এখানে দাঁড়িয়ে কি করছিলে?
– কিছু না। এমনি হাঁটতে হাঁটতে চলে এসেছিলাম।
– ও আচ্ছা।
– সুব্রত ?
-হুম।
– একটি সত্যি কথা বলবে?
– আমি মিথ্যা বলি না কখনও তোমার সাথে।
– তুমি কি এখনও আমাকে ভালবাস? আমি তাকালাম সুব্রত এর দিকে। ও নিচের দিকে তাকিয়ে আছ। নিচে তাকিয়েই বলল- কি মনে হয় তোমার?

– আমার মনে হওয়া দিয়ে কিছু না। বাস কিনা বল।
– তুমি যেটা ভাব সেটাই।
– বাস তাই না?
– তুমি এতখানি কি করে নিশ্চিত হলে আমি এতদিনেও কোন সম্পর্কে জড়াই নি? অন্য কাউকে ভালবাসি নি?
– আমি জানি বাস নি। শেষ যেদিন আমাদের দেখা হল, তুমি আমার হাত ধরেছিলে মনে আছে?
– হ্যাঁ।
– আমি সেদিনই বুঝেছি তুমি আমাকে কতটা ভালবাস। শেষ দিন। তুমি এসে আবদারের সুরে বললে, সমাপ্তি , আমার সাথে আজ রিকশাতে যাবে একটু?

আমি রাজি হলাম। তুমি পাশে বসে বললে, তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে। আমি কিছু না বলে চুপ করে ছিলাম। তোমাকে সেদিন খুব চালাক মনে হয়েছিল। প্রথম বারের মত। হাতটা ধরার জন্য কি এক ফন্দি আঁটলে। আমাকে বললে, তুমি হাত দেখতে পার। কি আমার জ্যোতিষী রে। আমার দিকে তাকিয়ে বললে, দেখি তো তোমার হাতটা । আমি হাত বাড়িয়ে দিলাম। তুমি আমার হাত টা হাতের তালুর মধ্যে নিয়ে ধরলে। তোমার হাতটা খুব কাঁপছিল। আমার হাতটা আস্তে আস্তে শক্ত করে ধরছিলে। হাত দেখে আবল তাবল কি সব বলছিলে। আমার সেদিকে খেয়াল নেই। আমি তোমার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। কত অবুঝ লাগছিল তোমাকে। আমি বুঝতে পারছিলাম, তোমার বুকের মাঝে ঝড় বয়ে যাচ্ছে, খুব প্রিয় কিছু কাছে পাওয়া, আর তা আবার হারানোর ভয়ে। চোখে ঝড়ের বৃষ্টির মেঘ দেখতে পাচ্ছিলাম আমি। খুব কষ্ট হচ্ছিল, সাথে ভাল লাগাও কাজ করছিল তোমার ভিতর। তুমি কেমন যেন আঁকড়ে ধরছিলে আমার হাত।

এমন ভাব যেন কখনও ছাড়বে না আমার হাত। আমি সেদিন খুব খারাপ একটা কাজ করেছিলাম , সেদিন সেই সত্যি কথাটা না বললে হয়ত হত। আমি তোমাকে বলেছিলাম, সুব্রত , তুমি আমার অনেক ভাল একটা বন্ধু। অথচ দেখ তুমি আমার ভালবাসার কথাই জানো না। তোমাকে আজ আমার ভালবাসার কথা বলব। বলা দরকার। আমার একটা ছেলের সাথে ৬ মাস ধরে রিলেশন। হৃদয় নাম। আমি ওকে অনেক ভালবাসি, ও ও আমাকে ভালবাসে অনেক। তুমি কথাটা শোনার পর আস্তে করে হাতটা ছেড়ে দিলে। ব্যস্ততা দেখিয়ে রিকশা থেকে নেমে পরলে। বুঝতে পেরেছি সেদিন আমার সামনে রিকশাতে যা করতে পারনি, লুকিয়ে তা করেছ। কেঁদেছ তুমি। তোমার চোখে আমি যে ভালবাসা দেখেছি তা অন্য কারও জন্য হতে পারে না। সুব্রত চুপ করে কথাগুলো শুনছে।

– হ্যাঁ, বাসি। তো? এখন এসব কথা বলছ কেন? আমি আস্তে করে হাতটা ধরলাম সুব্রতর । হাত দেখার ছলে না, ভালবাসার আকাঙ্ক্ষাআমি আস্তে করে হাতটা ধরলাম সুব্রতর । হাত দেখার ছলে না, ভালবাসার আকাঙ্ক্ষাহাত দেখার ছলে না, ভালবাসার আকাঙ্ক্ষাআমি আস্তে করে হাতটা ধরলাম সুব্রতর । হাত দেখার ছলে না, ভালবাসার আকাঙ্ক্ষায়।

-সুব্রত , আমি হেরে গেছি। হৃদয় আমাকে ঠকিয়েছে। ৫ বছরের সম্পর্ক কত সহজে নষ্ট করে দিল হৃদয়। আমরা লুকিয়ে বিয়ে করেছিলাম ২ বছর আগে। এখন আর ও স্বীকার করেনা,বলে এসব বিয়ে নাকি কোন বিয়ে না। মা বাবাকেও বলতে পারছি না। আমাকে নাকি আর ওর ভাল লাগে না, ও আমাকে এড়িয়ে চলছিল , ও অন্য একটা মেয়ের সাথে সম্পর্ক করেছে, আজ আমরা ডিভোর্স করে আসলাম।

খুব কাঁদতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু চোখ দিয়ে পানি বের হচ্ছে না। বুকের ভিতর খুব কষ্ট হচ্ছে। আমি সুব্রতর দিকে তাকিয়ে আছি কিছু শোনার অপেক্ষায়। সুব্রত আমার হাত দুটো আরও শক্ত করে ধরে বলল- আমি যদি চাই তোমাকে আমার জীবনে আবার, তুমি আসবে? আমি তোমাকে সত্যি এখনও অনেক ভালবাসি। থাকবে পাশে? ফিরিয়ে দিলে আবার সেদিনের মত চলে যাব, মুখ লুকিয়ে কাঁদবো। ফিরিয়ে দিও না। আমি তোমার হাতে হাত রেখে সারাজীবন থাকতে পারব। তোমাকে কখনও তোমার পিছনের জীবন নিয়ে কিছু বলব না। সত্যি। এবার অন্তত আমাকে ফিরিয়ে দিও না।

সুব্রত এর মুখের দিকে তাকিয়ে ,না করতে পারলাম না। আর একবার স্বার্থপরের মত নিজের ভালটা দেখে, সুব্রতকে ঠকালাম। ভালবাসি বলে দিলাম। খুব বৃষ্টি হচ্ছে। আমার চোখেও তার একটু আধটু। হাতের ভিতর হাত লুকিয়ে আমি আস্তে করে সুব্রতর এর বুকে মাথা রাখলাম। সুব্রত আমার মাথাতে আলতো করে হাত বুলিয়ে বুকের সাথে রেখে দিল। আশে পাশে কেউ নেই, থাকার দরকারও নেই, আমার পৃথিবী আমি পেয়ে গেছি, সুব্রত এর বুকের মাঝে। ভালবাসি অনেক বেশি তোমাকে, ফিসফিসিয়ে বললাম। সুব্রত শুনল না। কিছু কথা না হয় না শুনাই থাকল, এভাবেই না হয় সারাজীবন পাশে থাকল সুব্রতর মত কেউ। ভালবাসা কখনো চেহারা দেখে হয় না, মনে পবিত্রতা, আর একজন এর প্রতি আরেকজন এর সমর্পন ই পারে ভালবাসার সটিক নাম দিতে।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত