ভ্রাম্যমাণ জীবন

ভ্রাম্যমাণ জীবন

নাফিসা এবার বেশ তোরজোড় দিয়েই বলে,

– বাবা এবারের শীতটা গ্রামেই কাটাবো।

জালাল উদ্দিন কিছু বলে না। মেয়েটা একরোখা হয়েছে। এই বয়সের মেয়েদের কথা না শুনলে বিপদ। তিনি মেয়েকে অভয় দেখিয়ে বললেন, ‘তোর মার সাথে কথা বলি। তার অফিসে ছুঁটি নিতে পারলে আমরা যাবো গ্রামে।’

নাফিসা মনেহয় একটু খুশি হয়েছে। খুশি হবারই কথা। নাফিসার গ্রাম দেখতে ভালো লাগে। খুব সকালে শিশিরভেজা দূর্বাঘাসে পা ভেজাতে ভালো লাগে। চুরি করে খেজুর গাছ থেকে রস খেতে ভালো লাগে। যদিও গাছে উঠতে পারে না সে। আরও অনেক কিছুই পারে না। সাইকেল চালাতে পারে না, সাঁতার কাটতে পারে না। তবে সাইকেলের পেছনে উঠতে ভালো লাগে। আর সবচেয়ে ভালো লাগে। আর ভাবতে পারে না নাফিসা। কেমন যেন লজ্জা পেয়েছে মনে হলো।

আজকে নাফিসার মনটা বেশ ফুরফুরে। আগামীকাল সকালে গ্রামে যাবে বলে জানিয়েছে তার বাবা। দুপুরের পর থেকেই উৎসবের মতো গোছানো হচ্ছে ব্যাগ। ব্যাগভর্তি জামাকাপড়। গ্রামে শীতের দাপট বেশি। তাই গরম কাপড় বেশি করে নিচ্ছে। তার চোখেমুখে স্পষ্ট উত্তেজনার ছাঁপ। যে কেউ চাইলেই পড়ে ফেলতে পারে।

নাফিসাদের বাস একটু একটু করে পেরিয়ে যাচ্ছে শহর। এদিকটায় জ্যাম কম। বাস চলছে দ্রুতগতিতে। নাফিসা চাইছিলো জানালা খুলে বাইরের পরিবেশ দেখতে। কিন্তু সম্ভব হচ্ছে না। প্রচন্ড বাতাস। জানালা একটু খুলে দিলেই সাইসাই করে বাতাস ঢুকে যায় বাসে। শীত লাগে। এজন্য আর জানালা খোলা হয় না। আজ বেশ কুয়াশা। সূর্যের দেখা নেই। অপর পাশের জানালার কাঁচে কুয়াশার প্রলেপ। মুখ থেকে ধোঁয়া বের করে জানালার কাঁচে লাগাতে থাকে সে। কেমন একটা আস্তর পড়ে যায় কাঁচে। সেখানে নানা আঁকিবুকি করতে থাকে নাফিসা। মনে হয় যেন ক্লাস ফাইভের ছোট্ট মেয়েটি আছে এখনো।

গ্রামে পৌঁছাতে পৌঁছাতে বিকেল হয়ে যায়। শীতের দিনের দুপুর আর ষোড়শী কন্যার মনোভাব, কোনোটাই ধরা যায় না, বোঝা যায় না। দীর্ঘ জার্নি করে সবাই বেশ ক্লান্ত। কোত্থেকে যেন তুলি এসে জরিয়ে ধরে নাফিসাকে। জরিয়ে ধরেই চিল্লাপাল্লা শুরু করে। সাথে যোগ দেয় নাফিসাও। হারিয়ে যাওয়া স্বর্ণ হঠাৎ খুঁজে পেলে যেমন অনুভূতি হয়, সবাইকে দেখাতে ইচ্ছে করে, যে, দেখো- আমি স্বর্ণটা পেয়ে গেছি, ঠিক তেমনই অনুভূতি হয় তুলির। যদিও বয়সে বছর দুয়েক ছোটোই হবে তুলি, তবুও তাদের মাঝে কোনো দূরত্ব নেই। দু’জন দু’জনকে অসম্ভব পছন্দ করে।

গ্রামের সাথে যোগাযোগটা কমে যাবার কারণে নাফিসার ছোটো চাচ্চুর যে একটি মেয়ে হয়েছে, অর্থাৎ নাফিসার আরও একটি বোন পৃথিবীতে এসেছে, এটা জানতো না তারা। গতকাল এসে শুনেছে। যদিও কোলে নেবার ইচ্ছে ছিলো নাফিসার, কিন্তু তার বোন, যে কিনা মাসকয়েক আগেই পৃথিবীতে এসেছে, সে ঘুমিয়ে ছিলো বলে কোলে নেওয়া হয়নি।

আজ সকাল সকালই সূর্য উঠেছে। কুয়াশা কেটে গেছে অনেকটা। নাফিসার ছোটো কাকিমা একটি প্লাস্টিকের লাল গামলায় পানি এনে রেখে দিয়েছে উঠানের মাঝখানে। তেড়ছা করে রোদ এসে পড়ছে সেই গামলায়। খানিকক্ষণ অপেক্ষা করলো সে। তারপর ছোট্ট শিশুটিকে নিয়ে বসলো গামলার সামনে। একটু একটু করে পানি দিয়ে ধুয়ে দিচ্ছিলো শিশুটার শরীর। রোদের তাপে পানি কিছুটা গরম হয়ে শীতল ভাবটাকে কাটিয়ে দিয়েছে। নাফিসা এই প্রথম তার চোখের সামনে কোনো শিশুকে গোসল করানো দেখলো। পানি দিয়ে গা ধুয়ে দেবার পর একটা ছোটো গামছা দিয়ে মুছে দিলো পুরো শরীর। তারপর জামা পরালো আরও কিছুটা সময় নিয়ে। এতোটা সময় নাফিসা আর তুলি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পর্যবেক্ষণ করেছে সব।

নাফিসার কোলে তুলে দেওয়া হলো শিশুটিকে। নাফিসার ভয় হচ্ছিলো, যদি হাত ফসকে পড়ে যায়! শিশুটার নাম রাখা হয়েছে মালিহা। নাফিসা বাচ্চাদের মতো করে মালিহার সাথে কথা বলতে চাইলো। বলতে থাকলো, ‘এএই পিচ্চু, এই মালিহা, গোসল করছো তুমি? হুউউউ? শীত লাগে? আম্মু গোসল করায় দিছে? আম্মু পঁচা? যাও,আম্মুকে মেরে দিচ্ছি। আর গোসল করাবে না।’ কথাগুলো বলতে বলতেই নাফিসার ফোনে একটা ম্যাসেজ আসে। ফোনটা ছিলো তুলির হাতে। তুলি মুচকি হাসি দিয়ে নাফিসাকে একটা টিপ্পনী দেয়। নাফিসার মন দ্বিগুণ ভালো হয়ে যায়। সে অপেক্ষায় ছিলো ম্যাসেজের। বুঝতে পারে, ম্যাসেজটা ছিলো তার প্রিয় মানুষটার।

স্কুল মাঠের পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলো সজল। নাফিসা দৌঁড়ে গিয়ে সজলের হাত চেপে ধরলো। সজল খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে হাত ছাড়িয়ে নিতে চেষ্টা করলো। নাফিসা যেন নিষিদ্ধ জিনিসকে আগ্রহ বেশি টাইপ মনোভাব গিয়ে আগের চেয়েও শক্ত করে ধরলো সজলের হাত। যেন এই হাত সে কোনোদিন ছাড়তে পারবে না। আজীবন এভাবেই ধরে রাখবে। সজল হ্যাঁচকা টান দিয়ে তার হাত ছাড়িয়ে নেয়। তারপর থামে। একটু সময় নিয়ে বলে,

– নাফিসা, এটা তোমার শহর না। এটা গ্রাম। তুমি আমার হাত ধরে আছো, এটা কেউ দেখলে কী হবে বুঝতে পারছো?
নাফিসার মন খারাপ হয়ে যায়। এই মানুষটাকে সে একদম বুঝতে পারে না। এই যে এতো এতো দিন তার সাথে কথা বলে, প্রায় বছর চারেক হয়ে গেলো, তবুও তাকে বুঝে উঠতে পারেনি। কী এক অদ্ভুত মানবজনম। নিয়ম করে কথা বলেও একজন আরেকজনকে বুঝতে পারে না, দীর্ঘ সময় একসাথে কাটিয়েও একেকজন রয়ে যায় অন্যজনের সম্পূর্ণ অচেনা, অজানা একজন মানুষ। নাফিসা এমনিতে চনমনা হলেও, বেশ অন্তর্মুখী। নিজের কষ্টের কথা কাউকে বলে না কখনো। এই যে মানুষটার সাথে দেখা করার জন্য, একটু কথা বলার জন্য এতোটা পথ পাড়ি দিয়ে, এতো টালবাহানা করে ছুটে এলো, মানুষটা কি কিছুই বুঝতে পারে না? মানুষগুলো কেন এমন হয়? নাফিসার মনের ভেতর প্রশ্নগুলো ঘুরপাক খেতে থাকে। সে কিছু বলে না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে, যেমন ছিলো। সজলই বলে আবার,

– স্যরি নাফিসা। এমন রিয়্যাক্ট করা উচিত হয়নি। প্লিজ কিছু মনে কোরো না। নাফিসা যেন কিছুই হয়নি এমন একটা ভাব করে সজলকে বলে,
– এই চলো না, ভ্যানে ঘুরবো। সজল আবার অপ্রস্তুত হয়ে যায়। কী করবে, কী বলবে বুঝতে পারে না। তারপর বলে,
– এখন ভ্যান! কোথায় পাবো?
– তা আমি জানবো কী করে? তুমি ব্যবস্থা করো। সজল কিছু বলে না। নাফিসাকে নিয়ে একটু আড়ালে যায়। তুলি দাঁড়িয়ে থাকে একটু দূরে। তারপর সজল বলে,
– কবে যাবে ঢাকা?

নাফিসার মনটা আবারও খারাপ হয়ে যায়। এই মানুষটা এমন কেন? গ্রামে এলো দিনদুয়েক হলো, মানুষটার সাথে দেখাই হলো মাত্র, এর মাঝেই সে বলছে, কবে ঢাকা যাবো! কই, মানুষটা তো আগে এমন ছিলো না। আগে যখন গ্রামে আসতো, নাফিসাকে দেখার জন্য, নাফিসার সাথে কথা বলা কতটা ব্যাকুল হয়ে থাকতো মানুষটা। আর আজ! এমন করেই মানুষগুলো বদলে যায়? অবাক লাগে নাফিসার। ইচ্ছে করে সজলকে জরিয়ে ধরে হাউমাউ করে কান্না করুক। তারপর বুঝিয়ে দিক, কতটা আশা নিয়ে, কতটা ভালোবাসা নিয়ে সে এসেছিলো তার কাছে। কতটা অভিমান জমে আছে তার বুকে। এই যে, লাস্ট কয়েকমাস সজল নিয়ম করে ফোন দিচ্ছিলো না, কথা বলছিলো না, যেকোনো কথা এড়িয়ে যাচ্ছিলো, সেসব দিনগুলোতে তার কতটা খারাপ লেগেছে, কতটা নিঃসঙ্গ লেগেছে, সব বলতে চায় সজলকে, সব।

তুলে যেমন দাঁড়িয়ে ছিলো, তেমনই রইলো। তুলির কপালের কাছ দিয়ে উড়ে গেলো একটা ঘাসফড়িঙ। তুলির নজর গিয়ে পড়লো একটু দূরে। স্কুলমাঠের শেষ দিকটায়। দেখতে পায় একটা মানুষ দাঁড়িয়ে আছে সেখানে। সেখান থেকে তেড়ছাভাবে যেই জায়গাটা দেখা যায়, সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে সজল আর নাফিসা। তুলির বুক কাঁপতে শুরু করে। কী করবে সে? নাফিসাকে ডাকবে? ভাবতে পারে না কিছুই। তুলি দৌঁড়ে গিয়ে নাফিসার হাত ধরে, শক্ত করে। তারপর হ্যাঁচকা টান দিয়ে নিয়ে আসে নাফিসাকে। নাফিসা হতভম্ব হয়ে যায়। ‘কী করছিস? আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছিস? কী হয়েছে? বল, বল?’ কথাগুলো একটানা বলতে থাকে নাফিসা। তুলির কানে একটি শব্দও ঢোকে না। সে স্কুলমাঠের ওইপাড়ে যেই মানুষটিকে দেখেছিলেন, সে আর কেউ না। স্বয়ং নাফিসার বাবা জালাল উদ্দিন।

রাতে কিছুই খায় না নাফিসা। তার দাদী এই বয়সে এসে তাদের জন্য রান্না করেছে হাঁসের মাংস। এসবে কোনো রূচী নেই। তার মাথায় ঘুরছে তার বাবার কথাগুলো। এটা কি আসলেই সত্যি? তার বাবা যা বলেছে, সেটা মিথ্যা হতে পারে না? জগৎটা এমন কেন? এই কথাটা যদি মিথ্যে হয়, তাহলে সবচেয়ে বেশি খুশী হবে নাফিসা। সে বুঝতে পারছে না কী করবে। মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠলো। দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছে। মাথায় কিছুই ঢুকছে না। সে কাকে ভালোবেসেছিলো? এমন একজন মানুষকে? আচ্ছা, এমনটা কি হতে পারে না, তার বাবা তাকে মিথ্যে বলছে? আর তুলিটাই বা কেমন? সে কিছু জানাতে পারলো না তাকে? যদি জানাতো, তাহলে তো সে এই এতটা পথ অতিক্রম করে এখানে আসতো না। অপেক্ষা করতো না কারও জন্য।

নাফিসার মাথা আবার চক্কর দিয়ে ওঠে। সে বসে পড়ে পুকুরঘাটের মাটিতে। শীতে তার গা কেঁপে কেঁপে উঠছে। আর মাথায় চরকির মতো ঘুরপাক খাচ্ছে তার বাবার মুখের কথাগুলো, “আমি আরও আগেই জানতে পেরেছিলাম সজলের সাথে তোর রিলেশন চলছে। আমি কিছুই বলিনি কাউকে। একদিন তোর ফোনের টেক্সট দেখে জানতে পারি এই ঘটনা। নাম্বারটা নিয়ে কথা বলাই অন্য একজনকে দিয়ে। তারপর জানতে পারি সে আমাদের এলাকারই ছেলে। আমি মনে মনে মেনেই নিয়েছিলাম তোদেরকে। এদিকে টুকটাক খবরও রাখতাম তার বিষয়ে। হঠাৎ একদিন জানতে পারলাম সজল বিয়ে করেছে। আর সেই মেয়েটার সাথেও তার অনেক আগে থেকেই রিলেশন চলছিলো। তুই যখন গ্রামে আসবি বলছিলি, আমি তখনই বুঝতে পেরেছিলাম সজলের সাথে দেখা করতেই আসবি। আমিও না করলাম না। চল সজলের বাসায় গিয়ে তার বউকে দেখে আয়।”

কথাগুলো একটানা বলে নাফিসার বাবা নাফিসার হাতে একটা ছবি দেয়। সজলের বিয়ের ছবি। দুইজন মানুষ ছবিতে বসে আছে। একজন অপরিচিত। আর একজন খুব পরিচিত, খুব। যাকে সে জীবনসঙ্গিনী হিসেবে পেতে চেয়েছিলো, যাকে নিয়ে নানান সপ্ন দেখেছিলো, সেই মানুষটা। বিয়ের সাজে বসে আছে আরেক মেয়ের পাশে। কী করবে নাফিসা? চিৎকার করে কাঁদবে? সজলের কাছে গিয়ে সব জানতে চাইবে? নাফিসার চোখ বেয়ে দু’ফোটা জল গড়িয়ে পড়ে। গাল বেয়ে জল নিচে নেমে যায়। নিচে গিয়ে পড়ে নাফিসার হাতে থাকা ছবিটির ওপর।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত