অফিসে সবে ছুটি হয়েছে ।অরিন্দম চেয়ার ছেড়ে উঠে টেবিলে রাখা ব্যাগ নিয়ে লিফটের দিকে এগুলো। আজ বাড়ি যাওয়ার আগে একটু মার্কেটে যেতে হবে ছেলে বিশাল এর জন্য একটা গিফট কিনতে। আজ ওর জন্মদিন। তারপর সোজা বাড়ি। লিফটে করে গ্রাউন্ড ফ্লোরে নেমে বাইরে বেরিয়ে আসতে ফোনটা বেজে উঠলো । একটা অপরিচিত নাম্বার।ফোনটি কেটে দিলো অরিন্দম। সামনে বাস স্টপেজ । তাড়াতাড়ি পা চালালো ।বাস একটা এসে দাঁড়াতে বাসেউঠলো তখন আবার বেজে উঠলো ফোনটা ।
বাসে প্রচন্ড ভিড় । অফিস ছুটির পর সবার তারা থাকে নিজ নিজ গন্তব্যে পৌঁছবার । কোনরকমে সিঁড়ির উপর দাঁড়িয়ে সামনের একটা রড ডান হাত দিয়ে ধরে কোনো রকম ভারসাম্য রক্ষা করে দাঁড়িয়ে আছে অরিন্দম । বাম হাত দিয়ে বুকপকেট থেকে ফোনটা বের করে আবার কাটতে যাচ্ছিল কলটা দেখলো স্ত্রী অনিন্দিতা র কল। ফোন রিসিভ করতে অনিন্দিতার গলা — হ্যালো । তুমি কী অফিস থেকে বেরিয়েছো ? হ্যাঁ এখন বাসে। আসার সময় বাবুর গিফট আনতে ভুলে যেওনা যেন। তোমার তো আবার ভীষণ ভুলো মন। ভুলিনি। মনে আছে। তাই বাজার থেকে গিফট নিয়ে বাড়ি ফিরবো। এখন রাখছি। ওকে রাখো।
কল কেটে ফোনটা পকেটে রাখতে যাবে আবার বেজে উঠলো ফোনটা। দেখলো বিভাস ফোন করেছে। ফোন রিসিভ করে অরিন্দম বললো বল বিভাস । বিভাসের কন্ঠস্বর ভেসে এলো –তুই কোথায় এখন ? আমি বাসে অফিস থেকে বাড়ি ফিরছি। কিছু শুনেছিস ? কী ব্যাপারে বলতো ? অরিন্দম চিন্তিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো। শুভ্রর একটি দুর্ঘটনা ঘটেছে । বাইক নিয়ে ফিরছিল বাড়ি এই বিকেল চারটের দিকে পেছন থেকে একটা গাড়ি ধাক্কা দিয়েছে । ওকে স্থানীয়রা তুলে হাসপাতালে নিয়ে যায়। আমার এক আত্মীয়কে দেখতে গিয়ে আমিও সে সময় হাসপাতালে ছিলাম । ওখানে ওর ভায়ের সাথে দেখা ওই বললো । আমি আছি তুইও চলে আয় ওর অবস্থা ভালো নয় ।
অরিন্দমের চোখের সামনে ভেসে উঠলো বাল্য বন্ধু শুভ্রর মুখটা । হাসি খুশি প্রাণবন্ত একটা ছেলে সে কিনা হাসপাতালে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে।মনে পড়তে লাগলো বন্ধুত্বের সেই স্মৃতি গুলো যে দিন গুলো মুহূর্ত গুলো আর কখনোই ফিরে আসবে না । একসাথে কাটানো স্কুল কলেজ জীবনের মুহূর্ত । একসাথে খেলা আড্ডা পড়াশুনা তর্ক ঝগড়া আবার সব ভুলে বন্ধুত্বের ভালোবাসার টানে একসাথে হয়ে যাওয়া। এখনো স্মৃতির পাতায় জ্বল জ্বল করছে। শুভ্র বাঁচবে না । তাকে আর পাওয়া যাবেনা খুঁজে এটা ভাবতে ভাবতে বাসের রড এ ধরা হাতটা আলগা হয়ে এসেছিল অরিন্দমের।পড়ে যাচ্ছিল ও। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা খালাসি বুঝতে পেরে অরিন্দমের হাতটা ধরে নেয়। দাদা শরীর খারাপ করছে ? না না ঠিক আছি। একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম। শক্ত করে রড ধরে দাঁড়ান । ঠিক আছে ভাই ধরছি। পকেটে ফোন রেখে সামনে হাসপাতালে র স্টপেজে নামার একটা টিকেট কেটে নিলো।
হাসপাতালের কাছে বাস আসতে নেমে পড়লো অরিন্দম । বিভাসকে ফোন করলো । বিভাস আসতে অরিন্দম জিজ্ঞেস করলো — কী বলছে ডাক্তার ? অবস্থা ভালো নয় । চিকিৎসা চলছে । কখন কী হবে বলা যায় না । কী হলো বলতো বিভাস শুভ্রর ? আমি তো ভাবতে পারছিনা। এই তো গতকাল সন্ধ্যায় কত গল্প করলাম আড্ডা দিলাম আমি তুই আর শুভ্র । আর আজ শুভ্র মরা বাঁচার মাঝ খানে দাঁড়িয়ে আছে আর আমরা এসেছি দেখতে । আমাদের নীরব দর্শকের মতো দেখতে হচ্ছে। কথা গুলো বলতে বলতে চোখ জলে ভরে এলো অরিন্দমের। বিভাস ও নিজের চোখ মুছলো।
কিছুক্ষন পরে খবর এলো শুভ্র আর নেই। সে হার মেনে নিয়েছে মৃত্যুর কাছে। ওদের সামনে শুভ্রের পরিবার কান্নায় ভেঙে পড়েছে । কিন্তু কে কাকে সামলাবে অরিন্দম আর বিভাসেরও তো একই অবস্থা। রক্তের কোনো সম্পর্ক নেই কিন্তু টান যেন তার চেয়েও বেশি। অরিন্দম আর বিভাস ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলো শুভ্রর নিথর দেহটার কাছে। সারা মাথায় ব্যান্ডেজ দিয়ে জড়ানো । চোখটা ইসদ খোলা । শেষ বারের মতো বন্ধুকে মন ভরে যেন দেখে নিচ্ছে আর দুই বন্ধু । অরিন্দম ধীরে ধীরে ঝুঁকে জড়িয়ে ধরলো শুভ্রর নিথর দেহ। এমন তো কথা ছিলো না বন্ধু তাহলে এভাবে চলে গেলি কেন ? কালকেও তো কত প্রাণবন্ত ছিলিস আর আজ নিথর হয়ে পড়ে আছিস। ওদিকে বিভাস ও কেঁদে চলেছে।আজ যে আমার ছেলের জন্মদিনে তোর আসার কথা ছিল । কথা বল শুভ্র। কথা বল। অরিন্দম কোনো ভাবে শুভ্রর অকাল মৃত্যুকে মেনে নিতে পারছিল না । সে ভেঙে পড়েছিল। কারণ ছোট থেকে ও শুভ্র আর বিভাস খুব কাছের বন্ধু ছিলো। প্রত্যেকে প্রত্যেকের আনন্দে দুঃখে পাশে থাকতো।
এদিকে সাতটা বেজে গেল অরিন্দমের কোনো পাত্তা নেই। গিফট কিনতে এত সময় লাগে ? নিশ্চই বিভাস আর শুভ্রর সাথে আড্ডা দিচ্ছে। ওদেরকে না নিয়ে কী বাবু বাড়ি আসবেন । শুধু দেহ আলাদা কিন্তু যেন তিন জনেই এক আত্মা । যায় একটা ফোন করি । ফোনটা হাতে তুলে অরিন্দম এর নম্বর ডাইল করতে যাবে অনিন্দিতা ডোর বেল বেজে উঠলো। ফোনটা রেখে দৌড়ে গেল গেট খুলতে নিশ্চই অরিন্দম বিভাস আর শুভ্র এসেছে। গেট খুলতে অনিন্দিতা দেখলো আরিদম দাঁড়িয়ে । সে অরিন্দমের পেছনে উঁকি মারতে মারতে জিজ্ঞেস করলো বিভাস আর শুভ্র আসেনি ? না ।
কেন ? ওদের সাথে কী দেখা হয়নি তোমার ? ওরা কী পরে আসবে ? আসবে না অনিন্দিতা । শুভ্র আর নেই। বলতে বলতে বাড়ির দরজায় কান্নায় ভেঙে পড়ে অরিন্দম। অনিন্দিতা কথাটা শুনে হতবম্ব। বরের বন্ধু হলেও নিজের ভায়ের মতো শুভ্র আর বিভাস । অরিন্দম কখনো বাড়িতে না থাকলে যেকোনো সমস্যায় ওদের ডাকলে ওরা উপস্থিত হয়ে যেত। রক্তের সম্পর্ক না থাকলেও ওরা খুব আপন। সেই শুভ্র নেই । মুখটা চোখের সামনে যেন ভাসছে অনিন্দিতার। নিজের অজান্তেই চোখ ছাপিয়ে বেরিয়ে এলো জল। অরিন্দমের খবরে অন্তর যেন খালি হয়ে গেলো।
ছেলের জন্মদিনের আনন্দ বন্ধুদের নিয়ে আর করা হলো না অরিন্দমের পরিবারের।ঘরে তৈরি করা পোলাও মাংস যেমন কার তেমন রইলো। আজ সে যাচ্ছে বন্ধুর অন্তিম যাত্রায়।অনিন্দিতা অরিন্দম কে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে দরজা বন্ধ করলো।অরিন্দম আর বিভাস দাঁড়িয়ে থেকে হাসপাতালের সব পাট চুকিয়ে শুভ্রর দেহ সৎকার করে যখন বাড়ি ফিরছে তখন বিকেল। দুজনেই শোকে নির্বাক। বাড়িফিরে স্নান সেরে বিছানায় শরীরএলিয়ে দিলো অরিন্দম। প্রচন্ড শারীরিক ও মানসিক ধকলে চোখ বন্ধ হয়ে এলো ওর। চোখের সামনে ভেসে উঠতে লাগলো শুভ্রের মুখ ।
অরিন্দম । এই অরিন্দম । এই উঠ ভর সন্ধেতে ঘুমিয়ে আছিস কেন ? উঠ অনিন্দিতাকে বল চা করবে। কে ? প্রচন্ড ঘুমের মধ্যেও কথা গুলো অরিন্দমের ঘুম ভাঙিয়ে দিলো। চোখ একটু খুলতে অরিন্দম দেখলো হাসি মুখে শুভ্র দাঁড়িয়ে। শুভ্র তুই বোস বোস । আমি এখুনি অনিন্দিতাকে বলছি চা করতে। ঘুম চোখে বিছানায় উঠে বসতে বসতে আরিদম বললো অনিন্দিতা শুনছো ? শুভ্র এসেছে দু কাপ চা পাঠাও। রান্না ঘর থেকে অরিন্দমের কথা শুনে ছুটে আসে অনিন্দিতা। কী বললে শুভ্র এসেছে ? হ্যাঁ এই দেখ বিছানায় বসে আছে। অরিন্দম শুভ্রের দিকে আঙ্গুল তুলে দেখাতে দেখে কেউ নেই।
এই তো এখানেই তো বসেছিল। আমাকে ঘুম থেকে তুলে বললো অনিন্দিতাকে বল চা করতে। এই শুভ্র কোথায় গেলি ? অরিন্দম কিছুক্ষনের জন্য ভুলে গেছিলো যে আজ বিকেলে ও ওর সৎকার করে ফিরেছে। কিন্তু বন্ধুটি হৃদয়ে যেন এখনো বেঁচে আছে। অনিন্দিতার চোখ বেয়ে জলের ধারা নেমে আসে। অরিন্দম ও বুঝতে পেরে দীর্ঘশ্বাস ফেলে । জানো অনিন্দিতা শুভ্র আমাদের ছেড়ে ওখানে ভালো নেই তাই হয়তো এসেছিল বন্ধুত্বের টানে।