“অদ্ভুত একটি দৃশ্য সামনে দেখতে পাচ্ছি | যদি আমার ধারণা সঠিক হয়, তাহলে গুপ্তধনের সন্ধান পেয়েছি |” – এই ছিল কামেরনের পাঠানো শেষ অডিও বার্তা |
১৯শে অক্টোবর ২০১২
প্রশান্ত মহাসাগর থেকে যখন কামেরনের কোমরের বিশেষ ট্রান্সমিটার লাগানো বেল্টটি উদ্ধার করা হয়, তখন আত্মীয়-স্বজন, সহকর্মী সকলেই ছিলেন চরম বিষাদগ্রস্ত | ব্যতিক্রম শুধু স্ত্রী ইভা | সাংবাদিকদের সামনে ধীর অথচ দৃঢ় কণ্ঠে তিনি জানালেন, “বহু কঠিন লড়াই জিতেছে কামেরণ | এটাও জিতবে এই আমার বিশ্বাস |” বিশ্বের গভীরতম অংশ মারিয়ানা ট্রেঞ্চ | দুর্গমতম এই অংশে পৌঁছে নানারকম জীবের ছবি তুলেছেন কামেরণ | সেই সব দুর্লভ ছবির সম্ভার জমে রয়েছে সাবমেরিনের ক্যামেরার মাইক্রো চিপে |
কিন্তু ফিরে আসেনি সেই যন্ত্র | গভীর সমুদ্র বক্ষের কোন্ অংশে সাবমারসিবল সমাধিস্থ হল সে কথা কেউ জানে না | এখন ভরসা বলতে একমাত্র সেই বেল্টটি | বেল্টটির সাথে লাগানো ট্রান্সমিটার টির সাহায্যেই, এর সাথে সংযোগ স্থাপন করেছিলেন কন্ট্রোলরুমের সদস্যরা | এই ট্রান্সমিটারটির সাথেই যুক্ত আছে ইউটিলিটি টুল, যেটি এরোপ্লেনে লাগানো ব্ল্যাক বক্স এর মত কাজ করে | এখন এর তথ্য বিশ্লেষণ করেই জানা যেতে পারে ঠিক কি হয়েছিল কামেরনের শেষ পরিণতি সেই অতলান্ত গহবরে | যদিও কাজটি সময়সাপেক্ষ | কামেরণের শেষ মেসেজ এর আগেও দীর্ঘক্ষণ সংযোগ ছিল না সাবমারসিবল এর সাথে | এই সময় বাদে বাকি সময় প্রত্যেকটি খুঁটিনাটি ঘটনা সম্পর্কে কন্ট্রোল রুমে খবর পাঠিয়েছেন কামেরণ |
কামেরণ যখন 300 ফুট গভীরে , সূর্যের আলো সমুদ্রের জলে বিচ্ছুরিত হয়ে চতুর্দিক নীল আলোয় ভরিয়ে রেখেছিল | লাল- সাদা-গোলাপি রঙের কোরাল রিফ দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন কামেরণ | ঐ সময় কামেরণ একটি কচ্ছপকে পাথরে নিজের প্রস্তর কঠিন আচ্ছাদন কে ঘষতে দেখেন | সাধারণতঃ আমরা কচ্ছপের কবচ টিকে অনুভূতিহীন বলেই মনে করি | কিন্তু হয়তো আদতে তা নয় | এরপর কতগুলি হাঙর দেখতে পান কামেরণ | তাদের মধ্যে একটি বেশ কাছে এসে পড়ে | কিন্তু তেমন কোন বিপদ ঘটেনি |
সাবমেরিন যখন 500 ফুট গভীরতায়, সূর্যের আলো খুব সামান্যই পৌঁছতে পারছিল সেস্থানে | কামেরণের সামনে চতুর্দিক ধীরে ধীরে অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছিল তখন থেকেই | এমন সময় একটি বিকট শব্দ অডিও মিটারে ধরা পড়ে | শব্দ তরঙ্গের স্যাম্পেল সাথে সাথে কন্ট্রোল রুমে পাঠান কামেরণ | এটি পরীক্ষা করে চোখ কপালে ওঠে তাদের | কামেরণকে তারা জানান ,” যদিও এই শব্দ অনেক দূর থেকে আসছে | তবুও তোমাকে সাবধান করা প্রয়োজন | বিশেষজ্ঞদের মতে প্রথমত,এত তীব্রতার শব্দ সমুদ্রের গভীরতম অংশে ভূমিকম্প বা কোন আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের ফলে ঘটে যাওয়া ভূস্খলনের জন্য হয়ে থাকতে পারে | সেক্ষেত্রে আগামী 7-8 ঘন্টার মধ্যে সমুদ্রের এই অংশে সুনামি আছড়ে পড়তে পারে | কিন্তু দ্বিতীয় সম্ভাবনাটি আরও ভয়াবহ | যদি কোন জলজ প্রাণীর হুংকার বলে এটিকে ধরা হয়, তাহলে তার আয়তন কল্পনা করাও দুঃসাধ্য | আর এমনটা হয়ে থাকতেই পারে |”
সমুদ্রতল থেকে (১৯৭০) ফিট নিচে যে সোফার বা ডিপ সি চ্যানেল আছে, সেখানেই বাস করে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ প্রাণী ব্লু হোয়েল | এই বিরাটাকার মাছের দৈর্ঘ্য তিরিশ মিটার এবং ওজন দেড় লাখ কেজি পর্যন্ত হতে পারে | ডিপ সি চ্যানেলে শব্দের গতিবেগ অত্যন্ত কম | ব্লু হোয়েল তাদের হাজার মাইল দূরে থাকা বন্ধুদের সাথে নিজেদের ভাষায় শব্দতরঙ্গ ছুঁড়ে দিয়ে যোগাযোগ স্থাপন করে এভাবেই |”
যেহেতু দুই ক্ষেত্রেই অন্ততঃ 6-7 ঘন্টা সময় পাওয়া যাবে , কামেরণ সিদ্ধান্ত নেন যে তিনি এখনই ফিরবেন না | চেষ্টা করবেন ট্রেঞ্চের মাটি স্পর্শ করার | সেই অনুযায়ী তার সাবমারসিবল অগ্রসর হতে থাকে সমুদ্রের গভীরতম অংশের দিকে | সমুদ্রের প্রতি কামেরণের এই টান তার রক্তের মধ্যে | যখন খুব ছোট, তখন দাদুর কাছে কামেরণ একটি গল্প শুনেছিলেন নিজের অতি বৃদ্ধ প্রপিতামহ জোসেফ সম্পর্কে | তিনি ছিলেন এক সুনিপুণ যোদ্ধা এবং দক্ষ নাবিক | যে সমস্ত বানিজ্য জাহাজ তখন সমুদ্র পথে জলদস্যু কবলিত অঞ্চল দিয়ে যেত, তার বেশীরভাগের সুরক্ষার দায়িত্বই থাকত তাঁর কাঁধে | পঞ্চাশ জনের একটি দুর্ধর্ষ বাহিনীকে তিনি নেতৃত্ব দিতেন | জলদস্যুদের প্রতি তিনি এবং তাঁর বাহিনী ছিল সাংঘাতিক নির্মম | এক একটি দস্যুকে এমন বর্বরতার সাথে তাঁরা হত্যা করতেন, যে জলদস্যুরা ওই জাহাজ আক্রমণ করার থেকে বিরত থাকত, যার দায়িত্বে থাকতেন জোসেফ ও তাঁর বাহিনী | কিন্তু একবার একটি সম্পূর্ণ অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটে |
১৬ ই ডিসেম্বর ১৭৪৫
কিরিবাতি থেকে একটি জাহাজ রওনা দেয় সোলোমনের উদ্দেশ্যে | জাহাজের মধ্যে এক বিশেষ কুঠুরিতে রাখা ছিল একটি সুবিশাল হীরা | সম্রাটের বিশেষ উপহার তার প্রেয়সির জন্য | সেই হীরা থেকে বের হত নীলাভ আভা | অমূল্য সেই হীরার সাথে প্রচুর সোনার গয়নাও রাজা পাঠিয়েছিলেন | সুরক্ষার দায়িত্বে ছিল রাজার বিশেষ প্রশিক্ষিত বাহিনী | রাজার ইচ্ছা ছিল জোসেফকে এই গুরুদায়িত্ব দেবার | কিন্তু রাজ্যের সেনাপ্রধান জোসেফের প্রতি কিছুটা ঈর্ষা পরায়ণ ছিলেন | রাজাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে তিনি জোসেফের যাওয়া বন্ধ করেন |
যাত্রা শুরু হওয়ার কয়েকদিন পরই খবর আসে, মাঝ সমুদ্রে জলদস্যুদের আক্রমণে লুঠ হয়েছে সমস্ত সম্পদ | এই সংবাদ পাওয়া মাত্র মুষড়ে পড়েন সম্রাট | খবর যায় জোসেফ এর কাছে | নিজের প্রশিক্ষিত সেনাবাহিনী নিয়ে জোসেফ আক্রমণ করেন জলদস্যুদের ঘাঁটি | কিন্তু জোসেফ বা সম্রাট জানতেন না যে এটি ছিল সেই দুষ্টু সেনাপতি আর জলদস্যুদের মিলিত চক্রান্ত | তাই পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী জোসেফের বাহিনী আক্রমণ করার সাথে সাথে তাদের পর্যুদস্ত করে জলদস্যু এবং রাজার সৈন্যদের মিলিত বাহিনী | জোসেফের সারা শরীর ফালাফালা করে, হাত-পা বেঁধে জীবন্ত অবস্থায় ফেলে দেওয়া হয় সমুদ্রের জলে যাতে, মৃত্যুর আগের মুহূর্ত পর্যন্ত নোনা জল প্রতিটি রক্তবিন্দুর সাথে মিশে মর্মান্তিক যন্ত্রণার সৃষ্টি করে | কামেরণের মনে এই গল্প একটি গভীর প্রভাব ফেলেছিল | জোসেফের বীরত্ব এবং তার শেষ পরিণতিই খানিকটা তাকে উৎসাহিত করে সমুদ্রের গভীরে যাবার | তাই বারবার সমুদ্রগর্ভে ছুটে যান কামেরণ |
একুশে অক্টোবর 2012
দুদিন কেটে গেছে | সাবমারসিবলের খোঁজ পাওয়া যায়নি এখনো | কিন্তু একটি দুঃসংবাদ পাওয়া গেল মারিয়ানা দ্বীপ এর কিছু ধীবরের কাছ থেকে | গতকাল সমুদ্রে মাছ ধরতে গিয়ে তারা একটি অদ্ভুত ঘটনার সম্মুখীন হন | একটি দৈত্যাকার লাল রঙের মাছ সমুদ্রে বিরাট ঢেউ তুলে তাদের নৌকার পিছু নেয় | বেশ কিছু পথ ধাওয়া করার পর সেই ঢেউ এর আড়ালেই হঠাৎ হারিয়ে যায় মাছটি | কোনোরকমে প্রাণ বাঁচিয়ে যখন তারা পাড়ে ফেরেন, জানতে পারেন একটি ছোট্ট শিশু সমুদ্রের তীরে বসে খেলা করছিল | তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না | শুধু একজন দেখেছে সমুদ্রের জল সেখানে লাল হয়ে আছে |
কামেরণের সাবমারসিবল যখন নাইট জোনে অর্থাৎ চারহাজার ফুট গভীরতায়, সেই সময় তিনি একটি ব্ল্যাক ড্রাগণ ফিস কে দেখতে পান | কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে এই ভয়ঙ্কর জীব লক্ষ্য করেনি ক্যামেরনের সাবমেরিন কে | কন্ট্রোলরুমের সদস্যরা এর জন্য কামেরণ কে শুভেচ্ছাও জানান | কিন্তু এর পর থেকে আর কোনো তথ্য পায়নি কন্ট্রোলরুম |
26 শে অক্টোবর 2012
অবশেষে সুখবর পাওয়া গেল | ইউটিলিটি টুল এর তথ্য বিশ্লেষণ করে প্রথমদিন যে নতুন তথ্য বার হলো,তা আতঙ্কিত করল সবাইকে | পনেরোহাজার ফুট অতিক্রম করার পরপরই কামেরণ এর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন হয় কন্ট্রোল রুমের | তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে ,কামেরণ বহুবার চেষ্টা করছেন যে কোনোভাবে পুনরায় সম্পর্ক স্থাপন করার | কিন্তু বারবার তিনি ব্যর্থ হন | কামেরণ জানতেন না, একটু পরেই ঘনিয়ে আসছে বিপদ |
নিয়মমতো মিডনাইট জোন পেরোনোর পর আলো নিভিয়ে দেওয়ার কথা,এই অঞ্চলের ভয়ঙ্কর প্রাণীদের হাত থেকে বাঁচার জন্য | কিন্ত নিয়ম মানেন নি কামেরন | আর তার খেসারত ও দিতে হয় তাঁকে | 17000 ফুট গভীরতায় যখন কামেরণ পৌঁছান তখন ক্যামেরা স্ক্রিনে নজর পড়ে তাঁর | আতঙ্কে কেঁপে ওঠে তাঁর সারা শরীর | আটটি জ্বলজ্বলে ভাটার মতো চোখ তাকিয়ে আছে তাঁর দিকে | সেই প্রাণীদের দীর্ঘ ও ধারালো দাঁত যে কোনো প্রাণীকে ছিন্নভিন্ন করে দিতে পারে , এমন কি সাবমার্সিবেলের ও ক্ষতি করা অসম্ভব নয় | ঐ গভীরতায় জলের চাপ এমন ই সাঙ্ঘাতিক যে, সাবমারসিবেল এর ভিতর জল ঢুকতে শুরু করলে নিমেষে ফেটে যাবে কামেরণের শরীর |
এত দিন এই মাছের কথা শুধু বই এই পড়েছিলেন কামেরণ |এটির নাম এঙ্গলার ফিশ | আর একমূহূর্তও দেরী করেননি কামেরণ | নিভিয়ে দিয়েছেন আলো | কিন্তু নিজেদের শিকার এত সহজে ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নয় শিকারিরাও | কামেরণ উপলব্ধি করেন, বার বার কেঁপে উঠছে তাঁর সাবমারসিবল | মুহুর্মুহু ধাক্কায় , আঁচরে আর কামড়ে , জেরবার অবস্থা তখন সাবমার্সিবলের | ঠিক কতটা ক্ষতি হয়েছিল তার , তা জানতে পারেন নি কামেরণ | কিন্তু নিশ্চিতভাবে নিজের পথ থেকে বেশ কিছুটা সরে গিয়েছিলেন এই ধাক্কাধাক্কির জেরে |
27 শে অক্টোবর 2012
এরপর আর তেমন কোন বিপদের উল্লেখ পাওয়া যায় না, ইউটিলিটি টুলে | বরং গভীরতম অংশে বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণী কামেরণকে মুগ্ধ করেছিল | তারমধ্যে যেমন আলোকস্বচ্ছ মাছ এর কথা তিনি বলেছেন, তেমনই বলেছেন অনেক প্রাণীর কথা, যারা জৈব পদ্ধতিতে নিজের দেহ থেকে আলো নিঃসরণ করে | যেমন হলোথুরিয়াম বা বায়োলুমিনিসেন্টজেলিফিস | এছাড়াও সেখানে ঘুরতে দেখা যায় হোয়াইট অক্টোপাস ,হারমিট ক্র্যাব এবং জায়েন্ট গ্র্যান্ডিয়ার এর মত প্রাণী |
সাবমার্সিবল যখন মারিয়ানা ট্রেঞ্চের তলদেশ স্পর্শ করে তখন বালি সরে গিয়ে বুদবুদ উঠতে থাকে | রোবোটিক ক্যামেরা হ্যান্ডলার গুলোকে সচল করেন কামেরণ | জল কেটে মাছের মত সামনের দিকে এগোতে থাকে জলযান | বৈচিত্রে ভরা জল জগতের ছবি তুলতে তুলতে মোহাবিষ্ট হয়ে পড়েছিলেন কামেরণ, যখন হঠাৎ তাঁর নজরে পড়ে মাটি থেকে সামান্য মাথা উঁচু করে থাকা একটি লোহার খন্ডের উপর | যা দেখছেন তা যেন বিশ্বাস হচ্ছে না তাঁর | এমন সময় তিনি দেখলেন কন্ট্রোল রুমের সাথে আবার সম্পর্ক স্থাপন হয়েছে | তিনি মেসেজ পাঠালেন কন্ট্রোল রুমে |” অদ্ভুত একটি দৃশ্য সামনে দেখতে পাচ্ছি | যদি আমার ধারণা সঠিক হয়, তাহলে গুপ্তধনের সন্ধান পেয়েছি|”
কিন্তু কি ছিল সেই লোহার খন্ডে | কামেরণ দেখলেন,সেই খন্ডে খোদাই করা রয়েছে একটি বাজ এবং শিয়ালের মুখাবয়ব | এই চিহ্ন কামেরণের খুব পরিচিত | ঠিক এরকমই একটি টুকরো কামেরনের বাড়ির পুরনো আলমারিতে সাজানো রয়েছে | এটি ছিল জোসেফ আর তার বাহিনীর চিহ্ন | বাহিনীর প্রত্যেক সদস্যের টুপিতেই এই লৌহ খণ্ডটি লাগানো হতো | আর জোসেফের মাথার চিহ্ন টি ছিল সোনার | এক মুহূর্তের জন্য বাকরূদ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন কামেরণ | যে কাহিনী বুকে আগলে বড় হয়েছেন তিনি , আজ সেই কাহিনী জীবন্ত ইতিহাসের মত দাঁড়িয়ে আছে তাঁর সামনে | অথচ তাকে ছুঁয়ে দেখার উপায় নেই |
হঠাৎ কামেরণের মনে হলো, আর একটু খুঁজে দেখা যাক যদি আরও কিছু পাওয়া যায় | বেশ কিছুটা এগিয়ে তিনি একটা গহ্বর দেখতে পেলেন , যার মধ্যে সাবমারসিবল ঢুকতে পারে কোনো বাধা ছাড়াই | কামেরণ আবিষ্কার করলেন পেল্লায় এক জাহাজের খাঁচা এটি | দীর্ঘদিন ধরে জলের তলায় থেকে এর কাঠগুলো ক্ষয়ে গেছে | তার উপর জমেছে পাথর ও বালির আস্তরণ | তখনকার দিনে জাহাজের ডেকের উপর খোলা জায়গায় লাগানো থাকত স্টিয়ারিং হুইল বা হেম | এর পরেই ছিল ক্যানন রুম | লোহার সাতটি কামান এখনও সাজানো রয়েছে , দেখলেন কামেরণ |
আরো গভীরে ঢুকলেন কামেরণ | শক্তিশালী আলো জ্বালিয়ে দেখলেন মেরুদণ্ডহীন প্রাণীরা ভেসে বেড়াচ্ছে আনাচে-কানাচে | ভাঙা জাহাজের দেওয়ালে একটা তরোয়াল আর ছুরি ঝোলানো | আরো এগিয়ে পরের ঘরটিতে ঢুকলেন কামেরণ | ডেকের মেঝে বলে আর কিছু অবশিষ্ট নেই | তাই উপর থেকেই পুরোটা বেশ দেখা যায় | পরের ঘরটি সম্পূর্ণ খালি | শুধু মাঝ বরাবর একটি পাথরের আয়তাকার টুকরো | সেই টুকরোর মাঝ বরাবর একটি গোল গর্ত | সাবমার্সিবলের একটি ক্যামেরা বাড়িয়ে দিলেন কামেরণ সেই দিকে | ভাল করে চোখ বুলিয়ে বুঝতে চাইলেন আদতে কি রয়েছে ওখানে |
দেখা গেল ঐ প্রস্তর স্ল্যাবের তলায় রয়েছে একটি পাথরের চেয়ার, যার হাতল আর পায়ার সাথে এখনও বাঁধা রয়েছে মোটা লোহার শিকল | কামেরণ কল্পনা করতে পারছিলেন , কে সেই অভাগা যাকে এমন নিষ্ঠুর ভাবে হত্যা করা হয়েছিল | জোসেফ যাতে কোনোমতেই বেঁচে বেরোতে না পারে, তার জন্য তাঁর হাত পা বেঁধে এই পাথরের চেয়ারে বসানো হয় | তারপর এই স্ল্যাব টি পরিয়ে দেওয়া হয় তার গলায় | এত গভীরে জোসেফের শরীর খুব দ্রুত দ্রবীভূত হয়ে যায় জলে | তাই সামান্য অস্থিমজ্জাও অবশিষ্ট নেই এত বছর পর |
কামেরণ শিহরিত হয়ে ওঠেন | চিকচিক করে ওঠে তাঁর দুটো চোখ | জোসেফ এর মৃত্যু নিশ্চিত করার পন্থা দেখেই বোঝা যায়, কিরকম দুর্ধর্ষ যোদ্ধা ছিলেন তিনি | কামেরণের রক্তে সেই বীর যোদ্ধার রক্ত বইছে একথা ভেবেই গর্বে ভরে যায় বুক | পূর্বপুরুষ কে স্মরণ করে একবার বুক ভর্তি করে নিঃশ্বাস নেন কামেরণ |
এমন সময় হঠাৎ কামেরণ অনুভব করেন, তাঁর শাটল টি যেন ধীর লয়ে দুলছে | ক্রমশঃ সেই দোলন বাড়তে থাকল | অথচ চতুর্দিকের জল রয়োছে শান্ত | সম্ভবত কোনো শক্তিশালী চৌম্বকক্ষেত্রের মধ্যে পড়েছেন তিনি | কিছুক্ষণের মধ্যে শাটলের আলো গুলিও কাঁপতে শুরু করল | আর কোনো সন্দেহ নেই , নির্ঘাত মারাত্মক শক্তিশালী বৈদ্যুতিক-চৌম্বকীয় ক্ষেত্রের মধ্যে পড়েছেন তিনি | এদিকে কন্ট্রোলরুমের সাথেও কোনো সম্পর্ক নেই | ক্যামেরা গুলিও বিকল হয়ে যাচ্ছে | আর দেরী করা ঠিক হবে না | অথচ, আরও কিছু খুঁজে দেখার ইচ্ছা ছিল কামেরণের |
শেষমেশ শাটলটি আনলোড করার সিদ্ধান্ত নেন কামেরণ | সেই অনুযায়ী বাটন টিপে দেন তিনি | কয়েকবার মিস শট হয় |
আবার চেষ্টা করেন | নাঃ হচ্ছে না | এদিকে শাটলের অন্য যন্ত্র গুলিও ধীরে ধীরে বিকল হয়ে যাচ্ছে | ঠিক কি করবেন ভেবে পাচ্ছেন না কামেরণ | হঠাৎ তিনি অনুভব করলেন কেউ যেন তাঁর শাটলে তলার অংশে প্রবল জোরে ধাক্কা মারল | শাটলের ভিতরে বসেও ছিটকে গেলেন কামেরণ | আর সাবমারসিবল প্রবল বেগে চলতে থাকল উপরে | ধীরে ধীরে অন্যান্য যন্ত্র গুলিও কাজ করতে শুরু করছে | কামেরণ টের পেলেন আনলোডিং ও শুরু হয়েছে | তলার থেকে পাওয়া প্রবল ধাক্কা আর তার সাথে আনলোডিং এই দুয়ের দৌলতে বিরাট গতিতে উপরে উঠতে লাগল শাটলটি | এতে আবার আরেক বিপদ হল কামেরণের |
শাটলের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললেন তিনি | আর ঘটে গেল সেই বিপদ, যার আশঙ্কা কখনই করেন নি তিনি | সমুদ্রগর্ভের একটি পাহাড়ের সাথে ধাক্কায় চূর্ণ বিচূর্ণ হল কামেরণের সাবমার্সিবল | প্রবল ভাবে আহত হলেন কামেরণ | তিনি বুঝতে পারছিলেন, হয়তো আর বেশীক্ষণ তাঁর জ্ঞান থাকবেনা | সারা শরীরে প্রবল ব্যথা | অক্সিজেন মাস্ক চালু করলেন কামারণ আর কোমর থেকে খুলে দিলেন বেল্টটি | যাতে নিজে জীবিত অবস্থায় না পৌঁছতে না পারলেও মানুষ জানতে পারে, কি কি জানা গেল এই দুঃসাহসিক অভিযান থেকে | পুনশ্চঃ ২৯ শে অক্টোবর একটি জাহাজ উদ্ধার করে কামেরণ কে জীবিত অবস্থায় | কিন্তু সাবমার্সিবল এর খোঁজ আজও পাওয়া যায় নি |