অনেকদিন চেষ্টা করার পর একটা বেসরকারি কোম্পানির চাকরী কপালে জুটল । আমার বাড়ি গ্রামেই। অফিস যাওয়ার পথটা আগে বর্ণনা করে দেওয়া ভালো…আমার বাড়ি থেকে হাঁটা পথে মিনিট পাঁচেক, তারপর ভাগীরথী নদীর বিশাল চর পেরোতে মিনিট দশেক সময় লাগে,এরপর নৌকো করে নদী পার করে ওপারে গিয়ে বাস ধরে দুই ঘন্টার রাস্তা… তারপর অফিস পৌঁছাতাম। যেতাম সকাল এগারোটা নাগাদ আর বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত প্রায় এগারোটা বেজে যেত। ওপারে শহুরে এলাকা…রাস্তাঘাটে পরিষ্কার ঝকঝকে আলো,কোনো সমস্যা হত না… কিন্তু নদী পার করলেই আমাদের এদিকে পুরোটাই অন্ধকার, আর রাত এগারোটা মানে পুরো গ্রাম তখন নিস্তব্ধ…
তখন শীতের রাত, অগ্রহায়ণ মাস বেশ ঠান্ডা। অফিস থেকে বের হয়ে হাতঘড়িটায় দেখলাম আটটা বেজে তিরিশ মিনিট। এরপর বাসে করে যখন নৌকো ঘাটে পৌঁছলাম তখন পৌনে এগারোটা বাজলো,শেষ নৌকো রাত বারোটা পর্যন্ত। এরপর পার হতে গেলে ভাড়া বেশি দিতে হতো…এই ভয়ে একটু তাড়াতাড়িই আসার চেষ্টা করতাম। যাইহোক নদী পার করে এপারে এলাম। এবার পালা নদীর চর টুকু পার করা…মাঝে মাঝে যখন দেখতাম দূরে শশ্মানে মড়া পোড়ানো হচ্ছে…তখন চর টুকু পার করতে একটু গা টা ভার হয়ে আসতো! এদিক থেকে একটু ভীতুই আমি, এর জন্য বন্ধুরাও পেছনে লাগতো খুব। সেদিন কুয়াশার আবরণ যেন গোটা নদীর পাড়টাকে আরো ভয়াবহ করে তুলেছে। রোজ দিনের মতো পকেট থেকে লাইটার টা বের করে একটা সিগারেট ধরালাম আর হাঁটা পায়ে রওনা দিলাম বাড়ির উদ্দেশ্যে। গ্ৰাম্য এলাকা, আলোর ব্যবস্থা নেয়, তাই হাতের টর্চটাই রাতে যাওয়া আসার একমাএ সম্বল। সিগারেট টানতে টানতে আপন মনে যাচ্ছি, হঠাৎ পেছন থেকে কে যেন বলে উঠল
—আরে! কৌশিক না! কেমন আছিস? (পেছনে টর্চ ফেলে মুখটা দেখলাম)
— দেখলাম বিজয়! ঔ চলছে কোনোরকম রে। তুই কেমন আছিস?অনেকদিন পর দেখা তো!
বিজয়ের সম্বন্ধে একটু বলি— আমরা ছোটোবেলায় একসাথেই পড়াশোনা করেছি, ওর বাড়ি আমাদের পাড়া থেকে দুটো পাড়া পর। কলেজে ওঠার পর ও আর পড়াশোনা চালায় নি,পরে শুনতে পেয়েছিলাম অনেক বাজে নেশায় জড়িয়ে পড়েছিল। সবসময় লোকাল গুন্ডাদল এর সাথে ঘোরাফেরা করতো আর ওর একটা বাজে স্বভাব ছিল – সবার কাছে টাকা ধার করতো আর ঐ দিয়ে গাজা, মদ প্রভৃতির নেশা করতো।
—বিজয় বলল… আমার তো সবসময়ই আনন্দে কাটে (মুখ থেকে মদের গন্ধ)। তা এত রাতে কোথায় গেছিলি?
— একটা চাকরি পেয়েছি ওখান থেকেই ফিরলাম।
—বিজয় বলে উঠল, চল তাহলে একসাথেই বাড়ি যাই। একটা সিগারেট দে তো?
আমার মুখেরটাই শেষ সিগারেট ছিল… তাই দুজনে ওটা টানতে টানতেই কথা বলতে বলতে হাঁটা দিলাম । তারপর মাঝেসাঝে ওকে ঐ গুন্ডা দলের সাথেই সেই চরে বাজি ধরে খেলতে দেখতাম।
বেশ কিছু দিন পর, অফিস থেকে আমাকে একটা কাজের সুবাদে পনেরো দিনের জন্য বাইরে পাঠানো হয়। ফেরার দিনটি স্পষ্ট মনে আছে, সেদিন তারিখ ছিল ১২ ই ডিসেম্বর। কাজ শেষ করে রাতের ট্রেনে ফিরলাম। রাত তখন প্রায় ১২.৩০ হবে। নৌকার মাঝি কে একটু বেশি টাকা দিলে, নদী পার করিয়ে দিত । ডিসেম্বর মাস, হাড় কাঁপানো ঠান্ডা পড়েছে চারিদিকে কুয়াশার চাদর আর কানের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ঠান্ডা হাওয়ার শো শো শব্দ। যাইহোক, মাঝিকে একটু বেশি ভাড়া দিয়েই নদী পার হলাম।
আমার প্রত্যেক দিনের সঙ্গী মানে, সিগারেট টা ধরিয়ে আর টর্চের আলো সামনের দিকে ফেলে এগোচ্ছি। চারিদিকে এতোই নিস্তব্ধতা যে আমার পায়ের আওয়াজ আর মাঝে মাঝে দূরে কোথাও শেয়াল ডাকার আওয়াজ ছাড়া কিচ্ছুটি শোনা যাচ্ছে না। মনে মনে একটু ভয় ও লাগছে ঐ যে আগেই বলেছি আমি একটু ভীতু। ভাবলাম, কেউ যদি সাথে থাকত তারপর আবার নিজেই নিজেকে সান্ত্বনা দিতে লাগলাম না না ওসব ভূত -টুত বলে কিছু নেই, তুই শুধু শুধুই ভয় পাস। এই ভেবে একটু পা চালিয়ে হাঁটতে লাগলাম।
কিছুদূর হেঁটেছি মাত্র, হাঁটতে হাঁটতেই মনে হল…আমার পায়ের আওয়াজ বাদেও আরও একটি পায়ের আওয়াজ শুনতে পেলাম! আমার পাশেই যেন কেউ হাঁটছে! সঙ্গে সঙ্গে টর্চ টা এদিক ওদিক ঘোরালাম, দেখি কেউ নেই! বুকের ভেতরের হৃদকম্পনটা হঠাৎ বেড়ে গেল, আমি কোনো কিছু না ভেবে আবার চলতে শুরু করলাম ভয়ে ভয়ে হাঁটছি ,পেছন থেকে একটা হাত আমার ঘাড়ের ওপর রেখে কে যেন আমার কানের খুব কাছে খুব মৃদু আওয়াজে বলে উঠল কৌশিক ! আমি পেছনে ঘুরে কাউকে দেখতে না পেয়ে কিছু বুঝে ওঠার আগেই হঠাৎ দূর থেকে বীভৎস আওয়াজে শোনা গেল বাঁচাও! বাঁচাও! আমি চিৎকার করে বললাম — কে ওখানে! কে ! কিন্তু আবার সেই নিস্তব্ধতা, কই কেউ তো নেয়!
আমার আর বুঝতে দেরি হলোনা, ফটাফট পা চালিয়ে ভগবানের নাম নিয়ে এগোতে থাকলাম। যে চর টুকু পার হতে মাত্র ১০ মিনিট লাগে আজ যেন কিছুতেই শেষ হতে চাইছে না। আবার পেছন থেকে কে যেন ভারী গলায় ডাক দিল কৌশিক? কৌশিক? আমি ভয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম, পা যেন চলছে না আর না পেছনে তাকায় নি কিন্তু ভয়ে আমার হাত থেকে টর্চ টা পড়ে গেল কোনোমতে কাঁপতে কাঁপতে টর্চ টা মাটি থেকে তুলে সামনে যা দেখলাম তাতে আমার শরীর অসাড় হয়ে আসল—
একিইই! বি বিজয়! কিন্তু ওর চোখদুটো কই! চোখের জায়গা দুটো গর্ত আর রক্ত গুলো গাল বেয়ে নীচে পড়ছে, গলাটা একদম মাঝ খান থেকে চেরা গোটা জামা রক্তে ভেজা , পেটের ওখানে ওটা কি! সেখানে চোখ পড়তেই দেখি ,নাড়ীভূ্ড়ি বেরিয়ে এসেছে পেটের কাঁটা জায়গা থেকে কিচ্ছু না ভেবে আমি উর্দ্ধশ্বাসে প্রানপ্রণে দৌড় দিলাম। কিছুতেই শেষ হতে চাইছে না নদীর চরটুকু মনে হচ্ছে যত ছুটছি তত নতুন রাস্তা আবার তৈরি হচ্ছে! দূর থেকে শুনতে পেলাম,বিকট আওয়াজে কে বলে চলেছে – “ওরা আমাকে ছাড়ে নি বাঁচতে দিল না আমাকে সামান্য টাকার জন্য আমাকে এভাবে মারল !” আবার বিকট হাসি আর কান্না মিশ্রিত গলা। আমি যত জোরে পারলাম দৌড়ে কোনোমতে বাড়ি পৌঁছে নিজের ঘরে গিয়ে বিছানায় অজ্ঞান হয়ে পড়লাম। তারপর আর কিছু মনে নেই আমার।
যখন চোখ খুললাম তখন দেখি ভোর হয়ে এসেছে, আমার ঘরের বিছানায় আমি পড়ে আছি আর ঘরের দরজাটাও খোলা। কাল রাতের কথা ভেবে বুকের ভেতরটা এখনো কাঁপছে, ভাবলাম আদেও কি এসব হয়েছিল?নাকি ভয়ানক কোনো স্বপ্ন দেখলাম?কিছুতেই মনটাকে শান্ত করতে পারছিলাম না । যাইহোক ভোরের আলো ফুটেছে। আমি জামা ছেড়ে চোখ মুখ ধুয়ে একটু হাঁটাহাঁটি করতে বাইরে বের হলাম, তখন সবাই ঘুম থেকে উঠে যে যার কাজে বের হচ্ছে। কি যে মনে হলো আমার, ভাবলাম একবার নদীর ধারে ঘুরে আসি।
কাল রাতের কথা ভেবে ভয়ে ভয়েই গেলাম। কিছুদূর হাঁটতেই দেখি দূরে একটা ভীড় জমেছে। কৌতূহল সামলাতে না পেরে সেখানে গেলাম, কোনোমতে ভীড় ঠেলে এগিয়ে গিয়ে যা দেখলাম তাতে আমার চোখ ছানাবড়া! দেখি বিজয়ের রক্তমাখা ঠিক কাল রাতে দেখা হুবহু ক্ষতবিক্ষত দেহ পড়ে আছে ! শীতের সকালে আমার গা ঘেমে উঠল, কপাল থেকে ঘাম গড়িয়ে পড়ছে, গা টা কেমন যেন গুলিয়ে উঠেছে, চোখের কোণে একফোঁটা জলও চলে এসেছে। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে সেখান থেকে বেরিয়ে এসে বাড়ি যেতে যেতে ভাবলাম — তাহলে কালরাতে সত্যিই বিজয় এসেছিল আমার কাছে !