শহরে এসেছিলো তুহিন ব্যবসার এক কাজে।কাজটা শেষ হতে হতে সন্ধ্যে নেমে এলো।বাড়ি ফেরার গাড়ি ধরবার জন্য বাস স্ট্যান্ড এর দিকে রওনা হবে এমন সময় মুষলধারে শুরু হলো বৃষ্টি।সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নামলো বৃষ্টি ছাড়ার নাম নেই।এদিকে রাস্তায় জলজমে নদীর মতো হয়ে গেছে। রিকশা ও একটা দেখছে না যে বাস স্ট্যান্ড যাবে।একটা দোকানের সামনে পথ চলতি লোকেদের সাথে ও দাঁড়িয়ে আছে। সঙ্গে ছাতা না নেওয়ায় খুব আফসোস হচ্ছে তুহিনের।আজ সকালে বেরোনোর সময় আকাশ পরিস্কার ছিল। রোদ ঝলমলে দিন দেখে মনে হয়নি বৃষ্টি হতে পারে। অবশ্য প্রকৃতির খামখেয়ালি পনা কে বা বুঝতে পারে। নিম্নচাপের প্রভাব মনে হচ্ছে। ভাবতে ভাবতে ঘন ঘন ঘড়ি দেখছে তুহিন। রাত আটটা বাজতে পনেরো। আটটায় শেষ বাস বাড়ি ফেরার।বৃষ্টির বেগ আগের থেকে কমলেও থামেনি ঝির ঝির করে পড়ছে।
আচমকা কেউ যেন ডাকলো। তুহিন নিজের নামে ডাকটা শুনে তাকাতে লাগলো চারিদিকে। একটু এদিক ওদিক তাকাতে ওর ঠিক পাশের দোকানে শিশিরকে দেখতে পেলো। ওই ডাকছে। সম্ভবত অফিস থেকে ফেরার পথে ও আঁটকে পড়েছে এই বৃষ্টিতে। শিশির ছোটবেলার বন্ধু এখন কর্মসূত্রে শহরে থাকে। লোকজন এর পাশ কাটিয়ে তুহিন পৌঁছুল শিশিরের কাছে।
শিশির –কী রে হটাৎ এখানে ?
তুহিন–একটা কাজে এসেছিলাম। বৃষ্টিতে আঁটকে পড়েছি। শেষ বাস মনে হচ্ছে ধরতে পারবো না ।
শিশির –তোকে আর শেষ বাস ধরতে হবে না । চল আমার সাথে। আমি আর আমার কলিগ দুজনে একটা বাড়িতে একটি ঘর শেয়ার করে থাকি। ও নেই চারদিনের ছুটিতে বাড়ি গেছে। চল আজ তুই আমার সাথে থেকে যাবি।
তুহিন -ঠিক আছে । একটা ফোন করে বাড়িতে জানিয়ে দি।
তুহিন বাড়িতে ফোন করে জানিয়ে দেয়। তারপর বৃষ্টি থামলে শিশিরের সাথে ওর ভাড়া বাড়িতে আসে। যাওয়ার সময় শিশির হোটেল থেকে দুজনের রাতের খাবার কিনে নেয়। তুহিন যখন শিশিরের সাথে ওর আস্তানায় পৌঁছয় তখন রাত প্রায় নটা। একটা একতলা বাড়ি । নিচে একটা ঘর ওরা ভাড়া নিয়েছে আর পাশের ঘরে দুই কলেজ ছাত্র থাকে ভাড়া নিয়ে। তুহিনকে বাড়িতে ঢুকে বলছিল শিশির। ততারপর ঘরে ঢুকে ওরা পোশাক পরিবর্তন করে। তুহিন সঙ্গে কোনো পোশাক না অন্যায় শিশিরের পোশাক পরে।
তারপর দুই বন্ধু অনেক দিনের জমে থাকা গল্প করতে করতে রাতের খাবার খায়। ওদের গল্প বেশ রাত পর্যন্ত চলতে থাকে। রাত বারোটা বাজে এবার দুজনে আলো বন্ধ করে শুয়ে পড়ে। শিশির ঘুমিয়ে পড়লেও তুহিনের নতুন জায়গায় একটু অস্বস্তি হচ্ছিল। ঘুম আসছিল না । ঘরটাও কেমন গুমোট । আসে পাশে গায়ে লাগা বাড়ি। জানলা থাকলেও আলো বাতাস ঠিক মতো প্রবেশ করে না মনে হচ্ছে। পুরোনো সিলিং ফ্যান কেমন একটা অস্বস্তি দায়ক যান্ত্রিক শব্দ করে ঘুরছে। গ্রামের খোলা হাওয়ায় থেকে অভ্যস্ত তুহিনের এই ঘরে দমবন্ধ হয়ে আসছিল। ঘরের দরজা খুলে সে বারান্দায় গেল। শিশিরের টর্চ জ্বালিয়ে বাড়িটার ভেতর দেখতে লাগলো।
কলেজ ছাত্র দুটো মনে হয় আসেনি আজ রাতে ওদের ঘরে তালাবন্ধ । টর্চের আলোর ছটাছাদে যাওয়ার সিঁড়িতে পড়তে তুহিনের মনে হলো কেউ যেন সরে গেল। তারপর ছাদে ওঠার সিঁড়িতে ধপ ধপ করে শব্দ। তুহিন দেখার জন্য সিঁড়ি দিয়ে ছাদে উঠতে দেখল দরজায় ভেতর থেকে শেকল দেওয়া। কিন্তু মনে হলো যেন কেউ ছাদে উঠলো। যাক হয়তো মনের ভুল। তুহিন ওসব চিন্তা মন থেকে দূরে সরিয়ে ছাদের দরজা খুলে খোলা ছাদে এলো। আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ আকাশে ভাসমান মেঘের সাথে যেন লুকোচুরি খেলছে। খোলা ছাদে বেশ আরাম লাগলো তুহিনের। বেশ কিছুক্ষণ থেকে সে নিচে নামতে যাবে এমন সময় কেউ যেন বললো –এই যে শুনুন ?
এত রাতে ছাদে মহিলা কণ্ঠ শুনে থমকে দাঁড়ালো তুহিন। ডাকটা অনুসরণ করে পেছনে তাকিয়ে দেখলো পাশের বাড়ির ছাদে এক মেয়ে দাঁড়িয়ে। আলোআঁধারীর মধ্যে একটা ছায়ার মতো দেখাচ্ছে। এত রাতে এই মেয়ে কী করছে ছাদে ? আর ওকে কী বলতে চায় ? প্রশ্ন জাগে তুহিনের মনে। কারণ সে এখানে কোনোদিন আসেনি আজই প্রথম এসেছে এক রাতের অতিথি হয়ে। মেয়েটার কোনো খারাপ মতলব নেই তো ? ভাবতে ভাবতে তুহিন দেখলো মেয়েটা ওকে হাতের ইশারায় কাছে ডাকছে। তুহিন ভাবলো দেখি কী বলে। নিশ্চয় কোনো সমস্যায় পড়ে ডাকছে। এগিয়ে যায় তুহিন। ছাদের রেলিং এর কাছে যেতে বুঝতে পারে দুটো ছাদ খুব কাছে। রেলিং পার করে অনায়াসে এপার ওপার করা যায়। তুহিন বলে বলুন কী জন্য ডাকছেন ?
মেয়েটা একটা চিঠি তুহিনের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে এটা আপনার পাশের ঘরে অনুপকে দিয়ে দিন না। তুহিন ? এই তুহিন ? শিশিরের গলায় ডাক শুনে পেছনে তাকায় তুহিন। দেখে ছাদে শিশির ও উঠে এসেছে। এই তো আমি । উত্তর দেয় তুহিন। এত রাতে ছাদে কী করছিস তুই ? শিগগির নেমে আয়। চল আমার সাথে ঘরে। তুহিন বুঝতে পারে শিশিরের গলার একটু রাগী স্বর শুনে যে সে নিশ্চয় কোনো ভুল করেছে। আর এত রাতে সম্পূর্ণ একটা অপরিচিত মেয়ের সাথে ওকে দেখে অবাক হয়েছে। তুহিন বলে আমি তো চলে যাচ্ছিলাম কিন্তু এই মেয়ে —মেয়েটির দিকে তাকাতে কথা অসমাপ্ত থেকে যায় তুহিনের ।
—কোথায় গেল ? এখনই তো ছিল ?
শিশির কোনো কিছু না বলে ওকে নিয়ে নিচে নিজের ঘরে আসে। তারপর ঘর বন্ধ করে তুহিনকে বলে —আমি বুঝেছি তুই কেন উপরে গেছিস ? না না বিশ্বাস কর শিশির আমি ঘুম আসছিল না বলে ওখানে গেছিলাম । কিন্তু ওই মেয়েটা পেছন থেকে ডেকে একটা চিঠি অনুপ নামে কাউকে দেওয়ার জন্য বলছিল।
তোকে কিছু বলতে হবেনা আমি বুঝে গেছি। ভুলটা আমার্ব তোকে আগেই সতর্ক করে দেওয়া উচিত ছিল। ও কোনো মেয়ে নয় ও এক আত্মা। এই বাড়িতে কোনো এক সময় অনুপ নামের কোনো এক ছেলে ভাড়া থাকতো আর পাশের বাড়িতে মেয়েটা। দুজনে প্রেম করতো। তারপর কোনো এক কারণে ওদের ব্রেক আপ হয়। তারপর অনুপ নামের ছেলেটি এই বাড়ি থেকে চলে যায়। মেয়েটিও একদিন ওই বাড়িতে আত্মহত্যা করে। তারপর থেকে রাতে ছাদে গেলে ওকে অনেকেই দেখেছে । মেয়েটি ডেকে একটা চিঠি দিয়ে অনুপকে দিয়ে দিতে বলে। যদিও এখনো পর্যন্ত কারো ক্ষতি হয়নি তবুও যারা জানে রাতে কেউ ছাদে যায় না । অনেক সময় পাশের ঘরের ছেলেরাও বলে রাতের দিকে দরজার বাইরে থেকে কোনো মেয়ে অনুপ নামে কাউকে ডাকছে। জানিস তুহিন সে মেয়েটি আজও আসে তার প্রেমিক কে খুঁজতে ।।
তুই সব জেনেও এই ভুতুরে বাড়িতে আছিস শিশির ? আরে আমি আগে জানতাম না। মাস খানেক আগে এই বাড়িতে এসেছি দুজন। ভাড়াটা কম আর পাড়াটাও বেশ নিরিবিলি। তবে এখানে এসে শুনেছি যে এরকম ঘটে বাড়িটায় যদিও আমি কখনো দেখিনি। তবে পাশের ঘরের ছেলে গুলোর কথা শুনে বিশ্বাস হয়েছে। তাইতো হঠাৎ ঘুম ভেঙে তোকে পাশে না দেখে ছুটে ছাদে গেছিলাম । তবে আমি তোর সাথে কোনো মেয়েকে দেখিনি। আমিও এই বাড়িতে আর থাকবো না । অন্য বাড়ি দেখে রেখেছি এই মাস শেষ হলে চলে যাবো।
সমাপ্ত