সমাজ

সমাজ

এক মহিলাকে তার স্বামীর হত্যার অভিযোগে আটক করে পুলিশ।তারপর তাকে কোর্টে চালান করা হয়।খুন টা হয়েছিল খুব নির্মম ভাবে।কুরবানির সময় যেভাবে হাড্ডি কাটা হয় কুচিকুচি করে ঠিক সেই ভাবে।ঘটনাস্থল থেকেই পুলিশ ওই মহিলাকে গ্রেফতার করে।আর মহিলা নিজের স্বীকারোক্তি তে খুনের অভিযোগ স্বীকার করে নেয়।

পুরো দেশ, গ্রামবাসী মহিলার বিরুদ্ধে নানান অভিযোগ পেশ করে।মহিলার পক্ষে কোন উকিল ও ছিল না।একতরফা সরকারী উকিল ঘটনার সত্যতা যাচাই করে দেয় খুব সহজেই।পুরো দেশবাসী এই মহিলার কঠিন থেকে কঠিন শাস্তির দাবী করে।মহিলার ৪বছরের একটি কন্যা সন্তান রয়েছে। মহিলার স্বামী বড় পদের একজন সরকারি কর্মচারী।মহিলা নিজেই গ্রাজুয়েশন কম্পলিট করেছে। এখন প্রশ্ন থেকে যায় এত টা শিক্ষিত একজন মানুষ কিভাবে এমন জঘন্য একটা কাজ কর‍তে পারে।আদালতের রায় ঘোষনা দেওয়ার আগে মহিলাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল আপনার কিছু বলার আছে??

মহিলা নিরব চোখে পুরো কোর্ট রুম টায় একবার চোখ বুলিয়ে নেয়।তারপর বলে হ্যা জজ সাহেব বলার আছে।আমি এখানেও স্বীকার করছি আমি আমার স্বামীকে হত্যা করেছি,আর সেটা খুব ভয়ংকর ভাবে।আমি জানি আমি অপরাধী।তবে আমি কোন ভুল করিনি।আমার এত টুকু ও আফসোস নেই যে আমি একটা মানুষ কে খুন করেছি। জজ সাহেব আবারো জিজ্ঞেস করলেন কারন টা কি তাকে হত্যা করার।মহিলা অতি সহজ ভাবে উত্তর দিলো সেটা আমি আপনার রায় শোনার পরেই বলবো।

সমস্ত তথ্যই ছিল মহিলার বিপক্ষে। জজ অনেক ভাবনা চিন্তা করে সিদ্ধান্ত জানালো মৃত্যুদন্ড। এবার আবারো মহিলার বলার পালা। আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ জজ সাহেব,।আমি আপনার রায়ে সন্তুষ্ট জানাচ্ছি।তবে আমার একটা অনুরোধ আমার ফাশি জেনো আমার বাড়ির সামনের সেই বড় ইদগাহ ময়দানে হয়।প্রত্যেক আসামীর শেষ ইচ্ছা পুরন করা হয়। আর আমার শেষ ইচ্ছাও এটাই।আমি সেদিন পুরো সমাজ আর লোকজনের সামনে সব কিছু বলে যেতে চাই। জজ সাহেব বললেন, দেখুন আমাদের দেশে এমন আইন নেই।এটা আমাদের আইনের বিরুদ্ধ কাজ।

প্লিজ জজ সাহেব।আমাকে সত্যিটা বলার সুযোগ দিন।আমি আমার সমাজের প্রতিটা মানুষকে চোখে আংগুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে চাই আমি ভুল ছিলাম না।আমি অন্যায় করিনি।আমি যোগ্য অপরাধী কে তার অপরাধের শাস্তি দিয়েছি।প্লিজ জজ সাহেব। বেশ কিছুক্ষন জজ সাহেব গম্ভীর ভাবে থেকে অবশেষে তার ইচ্ছা পুরনের স্বীকৃতি দিলো। মহিলাকে যখন নিয়ে যাওয়া হচ্ছিলো জেলে তখন তার ৪বছরের মেয়েটি মা মা বলে খুব চিতকার করছিল।মহিলার ডার্ক চার্কেল এ আবৃত চোখ ২টিতে তখনো জলের জোয়ার ছিলো।মেয়েটার কপালে একটা চুমু দিয়ে মহিলা চলে গেলো কন্সটেবল দের সাথে।ঠিক হাতে গোনা ৭দিন পরেই ফাঁশির ডেট। একটু একটু করে সেই সময় টা ঘনিয়ে আসতে লাগলো।

হাজারো আম- জনতা জড়ো হলো এই ভয়ানক মৃত্যুর সাক্ষি হওয়ার জন্য।ফাঁশির ১ঘন্টা আগে সকল ব্যবস্থা গ্রহন সম্পুর্ন হল।জজ,পুলিশ,ডাক্তার, আত্নীয় স্বজন সবাই সমবেত হল।মহিলা এসেই তার মেয়েটিকে জড়িয়ে ধরে অঝরে কাদতে লাগলেন।যে কান্নার কোন পরিচয় কারো কাছে ছিলোনা।ইচ্ছে মতো আদর করেছিল নিজের মেয়েটিকে সেদিন। সবশেষে মহিলার হাত পা বাধা হল।তার পর তাকে কিছু বলার সুযোগ দেওয়া হল। মহিলা বলতে শুরু করলেন,৷,,,

আমি জানি আমি খারাপ।তবে আজ সত্যি বলে যেতে চাই ওপারে।আমাকে এখানে অনেকেই চিনে।আমার নাম স্নিগ্ধা।হাজি রাহমান সাহেবের মেয়ে বলে এই পুরো শহর আমাকে চেনে।কিন্তু আমার সত্যি টা আমি আর আমার মৃত বাবা-মা ছাড়া কেউ জানেনা।আমার জন্মের পর ই আমাকে এক এতিম খানার সামনে কেউ ফেলে যায়।আমি জানিনা আমি কার পাপের ফসল নাকি বৈধ সন্তান।আমার বয়স যখন আট বছর তখন এক নিঃসন্তান দম্পতি আমাকে দত্তক নেয়।হাজী সাহেব আর উনার স্ত্রী মানে আমার পালক বাবা-মা।

আমি তাদের রিন কখনো পরিশোধ করতে পারবোনা।অবাদ আদর ভালোবাসায় তারা আমার জীবনের গল্পের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল।মাধ্যমিক এ পড়াকালীন সময়ে আমি জিসানের সাথে প্রেমের সম্পর্কে জড়াই।তারপর অনেক গুলি বছর কেটে যায়।বিশ্বাস ভরশা আমার পৃথিবী বলতেই ছিল জিসান।এত টা ডুবে গিয়েছিলাম ওর প্রতি যে ওকে ছাড়া নিজেকেই অসম্পূর্ণ মনে হত। আমার যখন গ্রাজুয়েশন ফাইনাল চলছিল তখন বাবা সব কিছু জেনে যায়।কারন বাবার একাউন্ট থেকে বেশ কয়েক লাখ টাকা আমি তুলেনিয়েছিলাম জিসানকে গুছিয়ে দেওয়ার জন্য। খোজ খবর নিয়ে বাবা জিসানের সাথে বিয়ে দিতে অমত করে।কিন্তু আমার জেদের কাছে হেরে যায় তার মনোবল।

পরিক্ষার পরেই বিয়ে দেয় আমার জিসানের সাথে।বাবা ছিলেন রিটায়ার্ড ম্যাজিস্ট্রেট। প্রচুর অর্থের মালিক ছিলেন।বাকি জীবন খেয়ে বসে কাটালেও টাকা শেষ হতোনা।বাবার অনুরোধেই জিসান একটি সরকারী চাকরী ও পেয়ে যায়। ভালোই চলছিল।বিয়ের ৫মাসের মাথায় আমি জানতে পারি আমি মা হতে যাচ্ছি।খবর টা শুনেই খুশিতে অত্নহারা হয়ে যাই।প্রথম মা হওয়ার অনুভুতি ই অন্যরকম।হাসপাতাল থেকে বাসায় ফিরে আসি।অপেক্ষায় থাকি রাতে জিসান ফিরলেই তাকে খুশির খবর টা দিবো।

বাসায় এসে দেখি এক মহিলা আমার জন্য অপেক্ষা করছে।তার সাথে একটা ছেলেও ছিল তখন ৫-৬বছর বয়সের।জিসানের বাবা মা গ্রামে থাকতো, আর তারা অনেক আগেই গত হয়েছেন এত টুকুই জানতাম আমি।কিন্তু ওই মহিলার ভাষ্যমতে তার বাবা-মা এখনো জীবিত আর ওই মহিলা জিসানের স্ত্রী সাথে বাচ্চা টা জিসানের ই সন্তান।মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছিল।ওই মহিলা আমাকে জানায় অনেক আগেই তাদের বিয়ে হয়,কিন্তু গত ৫মাস ধরে কোন খোজ খবর নেয় না।ওর এক বন্ধুর মারফতে আমার ঠিকানা নিয়ে আমার কাছে আসে।আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম না কি করা উচিত আমার।

আমি সেদিন খুব স্বার্থপর হয়ে গেছিলাম,সংসারের প্রতি প্রচুর লোভ এসে গেছিলো তায় বাবার কাছে থেকে ২লাখ টাকা নিয়ে ওই মহিলাকে বিদায় করে দিয়েছিলাম।শুধু একটু ভালো থাকার লোভে। রাতে জিসান ফিরার পর তাকে প্যাগন্যান্সির ব্যাপারে জানাতেই সে রেগে যায়।তার দাবী ছিল এই সন্তান তার নয়।কারন সে প্রটেকশন নিয়েছিল।আমার নিজেকে খুব অসহায় মনে হচ্ছিলো।তায় বাধ্য হয়ে তার গ্রামের স্ত্রী আর সন্তানের কথা বলে দিই।

শুরু হয় এক নতুন লড়াই।রোজ ছোট খাট ব্যাপার নিয়ে আমাকে মারধর করতো আমার স্বামী।এখন অনেকেই বলবে এমন টা হয়েই থাকে।হ্যা আমিও মেনে নিয়েছিলাম এমন টা হয়েই থাকে।আঘাত সহ্য করতাম কিন্তু ভয় হত বাচ্চার যেনো কোন ক্ষতি না হয়।বাবা -মাকে কিছুই জানাতে পারিনি তখনো।আমার যখন আট মাস চলে তখন আমার স্বামি আমাকে ধাক্কা দিয়ে বেসিনে ফেলে দেয়।আমার শরীর এত টাই খারাপ হয়ে যায় যে আমি আর কোন কাজ করতে পারিনি।বাধ্য হয়ে আমাদের বাড়ির কাজের মেয়েটাকে নিয়ে আসি আমার কাছে। ৫দিন পরে চুম্পা(কাজের মেয়ে) জানায় সে আর এখানে থাকবেনা।সেই ছোট থেকে টুম্পাকে চিনি।আমার সেবা করার ভয়ে নিশ্চিয় ও এমন টা বলছেনা।কারন জানতে চাইলে টুম্পা শুধু বলে আফা আপনে ওই বাড়িতে চলেন,আপনার সব সেবা করমু কিন্তু আমি আর এইখানে থাকতে পারুম নাহ।

আমি ওকে আটকাইনি।টুম্পা গিয়ে বাবা-মা কে সব কিছু বলে দেয়।আমার উপর অত্যাচারের কথা আর টুম্পাকে আমার স্বামীর ধর্ষনের কথা।নিজেকে ঠিক রাখতে পারিনি। বাকি সময় টা,বাবার বাড়িতে পার করি।আমার মেয়েটা হওয়ার পরেও আমার স্বামী আমাকে একটি বারের জন্য দেখতে যায়নি আর খোজ ও নেয়নি।আমার মেয়েটার যখন তিন বছর বয়স তখন একদিন রাতে আমার চোখের সামনে আমার স্বামী আমার বাবা মা-কে বালিশ চাপা দিয়ে হত্যা করে।আমার চেয়ারে হাত পা বেধে ফেলে রেখেছিল।আর সব সম্পত্তি নিজের করে নিয়েছিল।

এই সমাজ সংসার জানে তারা স্টোক করেছিলেন।অনেকেই বাহ বাহ দিচ্ছিলেন একসাথে মারা যাওয়াতে।তাদের ভালোবাসা আর মিল মোহাব্বাতের কথা ভেবে।সত্যিটা কেউ জানতে পারেনি। এরপর থেকেই আমাকে ইনজেকশন দিয়ে ধীরে ধীরে পাগলে পরিনত করে সে।তবুও আমি কোন প্রতিবাদ করতে পারিনি। একদিন রাতে ঘুম ভেঙে দেখি আমার এই ৪বছরের শিশু কন্যার উপর তার অমানুষিক নির্যাতন। শুনতে খারাপ লাগলেও এটাই সত্যি আর এটাই বাস্তব।সে ছিল নেশার ঘোরে আচ্ছন্ন।সেদিন আর আমি নিজেকে ঠিক রাখতে পারিনি।নিজের ঔরসজাত সন্তান কে ও ছাড় দেয়নি ওই অমানুষ টা।জানিনা আমার অন্তরালে আর কি কি করেছিল।তায় ভবিষ্যতে যেনো এই সুযোগ না পায় তায় আমি এর শেষ করে দিয়েছি।

নিজের হাতে প্রপেশনাল কসাই এর মত তার গলাটা প্রথমে কাটি।তারপর পুরো শরীর টুকরো টুকরো করি।আমার কোন অনুতাপ নেই।হ্যা পরকালে হয়তো ওকে তার পাপের শাস্তি দেওয়া হত।কিন্তু এই জগতের মানুষ গুলি সারা জীবন আমাদের মত মেয়েদের কেই দোষারোপ করে যাবে।হ্যা আমি খারাপ।অনেক খারাপ।সমাজের চোখে যে অপরাধ আমি করেছি তার প্রায়শ্চিত্ত আমাকে ফাশিঁর মাধ্যমে দেওয়া হচ্ছে। আমার সমস্ত সম্পত্তি আমি আমার মেয়ের নামে নয় একটা ফান্ড এ জমা করে দিয়েছি যাতে কেউ তাকে নিয়ে খেলতে না পারে।

এই সমাজের প্রতিটা বিবেকবান মানুষের কাছে আজ আমার একটাই প্রশ্ন আমি কি সত্যি ই অপরাধী। এই সত্যি গুলি সবাইকে জানানোর জন্যই আদালতে আমি চুপ ছিলাম।সেদিন যদি এই সত্যি গুলি আমি বলে দিতাম তাহলে হয়তো আমার সাজা কম হতো,,কিন্তু এই সমাজ কখনো সত্যিটা জানতোনা। আজ সবাইকে সব কিছু জানিয়ে আমি বিদায় নিচ্ছি।আল্লাহর হাতে আমার মেয়েটার ভবিষ্যৎ তুলে দিয়ে। পুরো একালাবাসি নিশ্চুপ হয়ে গেছিলো।অনেকের চোখেই পানি ঝরছিল।জল্লাদ অনেক আগেই আসামির হাত বেধে দিয়েছিল।সে চাইলেও তার চোখের জল গুলি মুছতে পারছেনা।

ফাশিঁর আর মাত্র ৫মিনিট বাকি আছে।জজ সাহেব ও কাদঁছেন।সেই মুহুর্তে তিনি এগিয়ে গিয়ে আসামির চোখের পানি গুলি মুছে দেন।তার বেধে রাখা হাত জোড়া খুলে দেন।আর সকলের উদ্দেশ্যে জানিয়ে দেয় যে উচ্চ আদালতে স্নিগ্ধার হয়ে আপিল করবেন।তিনি সমস্ত সাক্ষর উপর তার রায় পরিবর্তন করার সিদ্ধান্ত নেন।তবে সরাসরি মুক্তি না দিলেও সব দিক বিবেচনা করে স্নিগ্ধার শাস্তি কিছুটা মওকুফ করা সম্ভব। জজ এর কথার পর পুরো এলাকাবাসী করজোড়ে হাততালি দিয়ে উঠে।

অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ এর দিকে পা বাড়ায় স্নিগ্ধা। (আমরা এই রকম ঘটনার প্রত্যাশি নয়। আমরা চাইনা সমাজে এমন কিছুই ঘটুক।আমরা চাই মানবতার জয় হোক।সমাজ পরিবর্তন হোক।আর পরিবর্তন হোক এই সমাজে বসবাস করা নোংরা মানষিকতা সম্পুর্ন ব্যক্তিরা।আর গল্পের কিছু অংশ সত্যি ঘটনা অবলম্বনে।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত