নিহির মন খারাপ। কেবল খারাপ নয়। মারাত্মক খারাপ। রাতে না খেয়ে ঘুমিয়েছে। এখন পর্যন্ত কিচ্ছু মুখে দেয়নি। একটু পানিও না। নিহি বারান্দায় বসে আছে। বাইরের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কিছু সময় পরেই ওর মা ইরিনা মাহরুম ওর রুমে আসলেন। বললেন,
-কিরে? এখানে একা একা বসে আছিস যে? বাইরে আয়? তোর কাজিনরা চলে এসেছে। নিহি চুপ থাকে। এমন একটা ভাব করে যেন কিছুই হয়নি। কারো কথাই সে শুনতে পায়নি। এমনকি তার পাশে যে কেউ দাঁড়িয়ে আছে সেটাও সে দেখেনি। ইরিনা মাহরুম বিরক্ত হোন। অল্পতেই তিনি বিরক্ত হয়ে যান। রেগে যান। ভ্রু কুচকে বললেন,
-কী ব্যাপার? কিছু বলেছি আমি। শুনছিস তুই? নিহির মাঝে এবারেও কোনো পরিবর্তন দেখা গেল না। সে চুপচাপ বসে থাকে। ইরিনা মাহরুম এবার একটু জোর দিয়ে ডাকেন।
-নিহি?
নিহি উঠে দাঁড়ায়। বারান্দ থেকে রুমের ভেতর আসে। বিছানার উপর থেকে মোবাইল নেয়। বালিশের কাছ থেকে ইয়ারফোন নিয়ে কানে গুঁজে দেয়। বিছানার কাছের দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে পাঁ মেলে বসে। এক পাঁ আরেক পাঁয়ের উপর দেয়। তারপর ফোনে গান ছাড়ে। রবীন্দ্র সংগিত বাঝতে থাকে। নিহি চোখ বুঁজে গান শুনে। রবীন্দ্রসংগীত তার খুব পছন্দের। মেয়ের এমন কাণ্ড দেখে ইরিনা মাহরুম চূড়ান্ত পর্যায়ে অবাক হলেন। কেবল অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকলেন নিহির দিকে। তারপর দ্রুত পায়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। রাগে তাঁর গা গিজগিজ করছে। নিহি উঠে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দিলো। কান থেকে ইয়ারফোন খুলে ছুড়ে মারল বিছানার উপর। মোবাইলটা টেবিলের কাছে রাখল। রবীন্দ্র সঙ্গিত শুনতে ভালো লাগছে না ওর।
অসহ্য লাগছে। নিহি আবার বারান্দার কাছে গিয়ে বসল। খুব অস্থির লাগছে ওর। দম বন্ধ হয়ে আসছে। একদিন পেরিয়ে গেল, অথচ সোহানের সাথে ওর কথা হলো না। সোহান নিজেই ফোন দেয়নি। নিহি যে দিবে সেই সাহসটাও হচ্ছে না। এদিকে সোহানের সাথে কথা না বলতে পেরে সে যেন পাগল প্রায়। নিহি বারান্দা থেকে রুমে এলো। বিছানার কাছে বসল একবার। তারপর টেবিলের কাছে গেল। ফোনটা হাতে নিয়ে গ্যালারিতে ঢুকল। সোহানের ছবি গুলো দেখতে থাকল। একটা ছবি দেখতেই সে স্তব্ধ হয়ে গেল। ছবিটা ওদের দুজনের। একজন অন্যজনের হাত ধরে হাসিমুখে তাকিয়ে আছে। দুজনের চোখে চোখে কথা হচ্ছে। কী অপূর্ব ছবিটা। নিহির চোখে জল এসে গেল। সে ডুকরে কেঁদে উঠল। চেয়ারের উপর বসে কান্না করতে থাকল।
সোহান নামক ছেলেটা নিহির প্রেমিক।
ওদের প্রেমের বয়স তিন বছর। এই তিন বছরে সোহান ছেলেটা নিহির হৃদয়ে এমনভাবে যায়গা করে নিয়েছে যে সে এখন চাইলেই সোহানকে ভুলতে পারছে না। কেবল সোহানের কথাই মনে পড়ছে। যত চাইছে এই নামটা ভুলে যেতে ততই যেন সেটা প্রিয় হয়ে উঠছে। মন যেন এই সোহান নামটাই জোপে যাচ্ছে। নিহি নিজেই সোহানকে প্রোপজ করেছে। ভার্সিটিতে সোহানকে প্রথম দেখতেই নিহির মনে হলো এই মানুষটাকে ও এতদিন ধরে খুঁজছে। এই চোখ দুটো ও খুঁজছে। নিহির মাঝে পাগল পাগল একটা ভাব চলে এলো। আশ্চর্যরকম ভাবে নিহির হার্টবিটটাও যেন একটু বেড়ে গেল। বুকের বাঁ পাশের ধপ ধপ শব্দটা যেন ওকে অস্থির করে তুলছিল। ঠিক সেদিনই কলাকৌশলে নিহি সোহানের সাথে ফ্রেন্ডশিপ করে নেয়। সেদিন থেকে সোহানের নামের পাশে নিজের নামটা লিখে রাখে নিহি। সোহানের পিছু পড়ে থাকে। দুজনে প্রায় এক সাথেই থাকে। বলা বাহুল্য, নিহি নিজেই সোহানের পিছু ছাড়ে না।
আঠার মতো লেগে থাকে। সোহানও যেন ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হয়ে যায়। সেও বুঝতে পারে কিছুটা। তা না হলে অন্য মেয়েদের সাথে যখন সোহান কথা বলে তখন নিহি এতো রাগে কেন? এমনই একটা ঘটনা ঘটে যায় ভার্সিটিতে। নিহির সাথে সোহানের একদিন কথা কাটাকাটি হয়। তুমুল ঝগড়া হয় ওদের মাঝে। তারপর দু’জন দুদিকে। একদিন কেটে যায়। কেউ কারো সাথে কথা বলে না। দু’জন দুদিকে মুখ ফুলিয়ে বসে আছে। অভিমান ঝরে পড়ছে চোখ দিয়ে। নিহির কান্না যেন থামতেই চায় না। খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে পড়ে আছে একলা রুমে। এদিকে সোহান মুখ কালো করে আছে। তার ভীষণ অস্বস্তি। কিচ্ছু ভালো লাগছে না। যেন দম বন্ধ হয়ে আসছে। কিছু একটা যেন বুকের ভেতর আঁটকে আছে।
সোহান কী করবে ভেবে পেল না। একবার বিছানার উপর বসল। আবার উঠে গিয়ে পায়চারি করতে থাকল। কিছুক্ষন বারান্দায় গিয়ে বসল। সেখানেও ভালো লাগল না। গেল টং দোকানে চা খেতে। সেখানে মানুষজনের উল্টাপাল্টা কথায় মাথা গরম হয়ে যাচ্ছিল ওর। উঠে গেল সেখান থেকে। হাঁটতে থাকল। মন খারাপ থাকলে হাঁটে ও। হাঁটতে ভালো লাগে। মন যেন একটু শান্ত হয়। অনেকক্ষন হাঁটার পর ওর খেয়াল হলো যে ও অনেক দূরে চলে এসেছে। এতো দূর আশাটা ঠিক হয়নি। তারপর হুট করেই খেয়াল হলো যে আর দুটো বিল্ডিং পরেই তো নিহির বাসা। আশ্চর্য ও এদিকে এলো কেন? এখন যদি নিহি ওকে দেখে তাহলে কী ভাববে? সোহান কিছু সময় সেখানে বোকার মতো দাঁড়িয়ে থাকল। তারপর হুট করেই পেছন ফিরে হাঁটতে থাকল। কিছুদূর যেতেই মনে হলো এতদূর হেঁটে এসেছি, নিহিকে একবার দেখে গেলে হয় না? নিচ থেকে দাঁড়িয়েই দেখব।
যদি দেখা যায় আরকি। মেয়েটা কি বারান্দায় আছে এখন? বিকেল বেলা! বারান্দায় থাকার তো কথা। আচ্ছা যাবো? ধুরর! গেলে কী হবে! যাই একবার। মনটা কেমন জানি করে উঠল সোহানের। কী করবে ভেবে পেল না। সাতপাঁচ না ভেবে সে নিহিদের বাসার সামনে চলে এলো। নিহির দেখা পেল না। বারান্দার দরজা বন্ধ। সোহানের মুখ চুপসে গেল। সে চলে আসবে ঠিক তখনই দেখল নিহি গেইট দিয়ে বের হচ্ছে। সোহান হতবম্ভ হয়ে গেল। বরফ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। লজ্জায় কান কাটা যাচ্ছে যেন। ইশ! নিহি কী ভাববে এখন? ওকে এখানে দেখে কী মনে করবে? কিন্তু নিহি তো ওকে দেখেও নি। ওর দিকে তাকায়ও নি। ইগো দেখিয়ে সোজা সামনের দোকানটায় চলে গেল। পেছন ফিরেও দেখল না? কী আশ্চর্য ব্যাপার। সোহান অবাক হলো।
খানিকটা অপমান বোধ করল। মনে হলো নিহি ইচ্ছে করেই এই কাজটা করেছে। ওকে জ্বলানোর জন্যে। সোহান আর দাঁড়িয়ে থাকল না। ওই দোকানটার সামনে দিয়েই মাথা নিচু করে হেঁটে চলে এলো। অযথাই এখানে এসেছে। একদম অকারণেই। এখানে আশাই ঠিক হয়নি। ধ্যাত! কেন যে এলো। সোহানের মেজাজ গরম হয়ে গেল। মনে মনে স্থির করল আর কখনই নিহির সাথে কথা বলবে না। ওর কথা ভুলে যাবে। কী দেমাগ মেয়েটার! আমাকে ইচ্ছে করেই এভয়েড করল! সোহান আর কিচ্ছু ভাবতে পারলো না। মাথাটা ধরে এলো। পরের দিন সকালে ভার্সিটি গেল। নিহিও এলো। আগে অবশ্য নিহিই এসেছিল। তাই বন্ধুদের সাথে আগ থেকেই ছিল ও। সোহান যখন এসে নিহিকে বন্ধুদের আড্ডায় দেখল সে আর ওই দিকে গেল না। সোজা ক্লাসে চলে এলো। ক্লাসে এসে জানতে পারল প্রথম ক্লাসটা হবে না। তাসফি স্যার হঠাৎই অসুস্থ হয়ে গেলেন। অথচ স্যার পরশুও ক্লাস নিয়েছেন। কালও! কী জানি কী হয়েছে।
সোহান কী করবে ভেবে পেল না। কিছুক্ষন ক্লাসের সামনে দাঁড়িয়ে থাকল। তারপর সোজা লাইব্রেরিতে চলে এল। আর যাই হোক বাইরে যাওয়া যাবে না এখন। গেলেই নিহি নামক আপদটার সাথে দেখা হবে। দেখা হলেই কালকের কথাটা মনে পড়ে যাবে। তখন মেজাজ কোন দিকে যাবে কে জানে। সোহান লাইব্রেরিতে এলো। এখানে এসে পড়ল আরেক বিপদে। বিপদটার নাম অহনা। ক্লাসের সবচে পড়াকু ও বোরিং মেয়েটা। সারাক্ষণ পড়ে। একটা মানুষ এতো পড়ে কীভাবে কে জানে। সমস্যা সেখানে না। সমস্যা হলো মেয়েটা হুট করেই ওকে ডেকে বসল। খানিকটা অবাক হলো সোহান। আজ হঠাৎ এই বিদ্যাসাগরের ওকে প্রয়োজন পড়লো কী করে। সোহান গেল। ওর পাশে বসতেই ও ফিসফিস করে বলল,
-আমি থার্ড টপিকটা বুঝতেছি না। একটু হেল্প করবেন। সোহানের মেজাজ গরম হয়ে গেল। বলল,
-আপনি আপনি করছিস কেন? আমি কি তোর বড় নাকি?
-না আসলে এখনও পরিচয় হইনি তো। তাই!
-পরিচয় হওয়া লাগে? ক্লাসমেট তো ক্লাসমেটই। এখানে আপনির কিছু নেই। হয় তুই কিংবা তুমি। তুই ‘তুই’ করেই ডাকিস।
-আচ্ছা। এখন একটু হেল্প কর?
-ক্লাসে আয়। এখানে অন্যদের ডিস্টার্ব হবে। ক্লাসের সামনে আসতেই অহনা বলল,
-আচ্ছা মাঠে গিয়ে বসি? সকালের রোদটা উপকারি হয়। শীত ভালোই পড়ছে। রোদ আছে মোটামুটি। কাল তো সূর্যই দেখা যায়নি। সোহান আর অহনা মাঠে চলে গেল। সোহানের বন্ধু গুলো ওকে দেখতেই ডাক দিল। সোহান বলল,
-আসছি! তারপর অহনাকে নিয়ে একটা জায়গায় বসে পড়ল। ওর সাথে পড়া নিয়ে অনেকক্ষন কথাবার্তা হলো। মেয়েটা একদমই মিশুক নয়। অবশ্য সেটা সে নিজেই স্বীকার করেছে।
-আসলে আমি সহজে মানুষের সাথে মিশতে পারি না। কেমন জানি লাগে। সোহান বলল,
-সমস্যা নেই। তোর মতো কিছু এলিয়েন এখনও এই পৃথিবীতে আছে। চিন্তা করিস না।
অহনা খিলখিল করে হেসে উঠল। সোহানও না হেসে পারল না। ওদের এই হাস্যকর অবস্থা দেখে গা জ্বলে গেল নিহির। মাথার ভেতর ভনভন করতে থাকল। সে আড্ডা থেকে উঠে সোজা কমন রুমে চলে গেল। মুখে পানি দিল। কিছুক্ষন পায়চারি করল। অনেকটা পাগলের মতো লাগছিল ওকে। অল্প কিছু সময় পরই নিহি স্থির হয়ে বের হলো। কিন্তু যেই সোহান আর অহনাকে এক সাথে দেখছে তখনই রাগে যেন সব জ্বলে যাচ্ছে। নিহি কিছু না ভেবে সোজা বাসায় চলে এলো। পরেরদিন ভার্সিটি যাবে না বলে স্থির করলো। কিন্তু মনের ভেতর কেবল একটা ভয় হতে থাকল যে সোহানকে যদি অহনা মেয়েটা নিয়ে যায়?
ঠিক এই একটা ভয় ওকে পরেরদিন ভার্সিটি পৌঁছিয়ে দিল। আজ সোহানই আগে এসেছে। বসেছে অহনার পাশের সিটে। নিহির বুকটা যেন ছ্যাঁৎ করে উঠল। হায় আল্লাহ! এখন দেখছি সোহানের পিছু ছাড়ছে না মেয়েটা। নিহি এক পাশে বসে পড়ল। কিন্তু ওদের এভাবে বসাটা ঠিক নিতে পারল না। ওর যেন দম বন্ধ হয়ে আসছিল। হুট করেই রুম থেকে বের হয়ে গেল নিহি। সোহান একবার দেখল। মুচকি হাসল কেবল। মেয়েটাকে ভালোই জব্দ করা গিয়েছে। সোহান ক্লাস করলো। ক্লাস শেষে বের হলো ওরা দু’জনেই। পাশাপাশি হাঁটতে থাকল। টুকটাক কথা বলছিল। ঠিক তখনই কোত্থেকে যেন নিহি এসে দাঁড়ায় ওদের সামনে। অহনার দিকে অগ্নি মূর্তি হয়ে তাকায়। বলে,
-অহনা, তুই যা এখান থেকে। সোহানের সাথে কথা আছে আমার। অহনা অবাক হয়ে দেখল। সোহান বলল,
-অহনা,তুই বাইরে গিয়ে দাঁড়া। আমি আসছি। নিহি বলে উঠল,
-কোথাও দাঁড়াতে হবে না অহনার। অহনা তুই চলে যা।
-কেন অহনা চলে যাবে। ও থাকলে তোর প্রব্লেম কী!
-আমার প্রব্লেম কী মানে? তুই আমাকে জিজ্ঞেস করছিস এই কথা?
-হ্যাঁ। তোকে জিজ্ঞেস করছি। কেন? তোকে কি এটা জিজ্ঞেস করা যায় না? তুই কে? রানি ভিক্টোরিয়া?
-তুই আমার সাথে এভাবে কথা বলছিস কেন?
-তো কীভাবে কথা বলবো?
-আমার কান্না পাচ্ছে সোহান!
সোহান কিছুক্ষন চুপ থাকল। নিজেকে স্থির করলো। নিহি ততক্ষনে কান্না করে দিয়েছে। সোহানের দিকে তাকিয়েই কান্না করছে। সোহান অহনাকে চলে যেতে বলল। তারপর পকেট থেকে নিজের রুমাল বের করে দিল চোখ মুছতে। অহনা সেটা নিলো না। ঝাড়ি মেরে ফেলে দিলো। সে কেবল কাঁদতেই থাকল। সোহান কিছু বলল না। রুমালটা কুড়িয়ে এনে খানিকটা ঝাড়ি দিয়ে আবার নিহিকে দিলো। নিহি নিলো না। সে অঝোর ধারায় কাঁদতে থাকল। সোহান রুমালটা আবার বাড়িয়ে দিলো। বলল,
-রাখ না! চোখ গুলো মুছে নে! নিহি এবারেও নিলো না। কেবল কাঁদতে থাকল। সোহান রুমালটা নিয়ে নিহির চোখ মুছতে এগিয়ে গেল। নিহি ওকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিলো। কান্না মাখা কণ্ঠে বলল,
-লাগবে না তোর মোছা! সোহান এগিয়ে এলো। বলল,
-চুপ। একদম চুপ থাক। কথা বলবি না।
কথাটা বলে সে নিহির হাত টেনে ধরল। নিহিকে একদম কাছে নিয়ে এলো। রুমাল দিয়ে ওর চোখের কোণা মুছে দিলো। চিবুকটা মুছে দিলো। মুছতেই আবার পানি পড়তে থাকল নিহির চোখের কোণা বেয়ে। সোহান বলল,
-এতো জেদি কেন তুই? একদম কথা শুনিস না। আমার তো না-ই। নিহি ভেজা স্বরে বলল,
-তুই তো আরো বড় জেদি। আমার কথা শুনিস? আমি যেটাতে না বলি তুই সেটাকে হ্যাঁ করিয়েই ছাড়িস।
সোহান মৃদু হাসল। নিহির কান্নাটা যেন খানিকটা বন্ধ হয়ে এলো। মৃদ্যু স্বরে বলল,
-পারবি আমাকে আজীবন এভাবে কন্ট্রোল করতে? জানিস তো! খুব জেদ আমার। পারবি এই জেদি মেয়েটাকে নিজের করে নিতে? সোহানের চোখ যেন ছলছল করে উঠল। কিছু বলল না। হুট করেই নিহিকে জড়িয়ে ধরল। বলল,
-অবশ্যই। যদি কেউ সুযোগ দেয় আরকি!
-অবশ্যই দিবে। যদি কেউ অহনা সঙ্গ ত্যাগ করে!
-খুব জ্বলে তাই না?
-হুহ!হুট করেই সোহান নিহিকে ছেড়ে দেয়। বলে,
-আমি তো ভুলেই গিয়েছি সে কথা। তোদের বাড়ির সামনে গেলাম। তুই এমনটা ভাব করলি যেন…
-আর বলিস না। তুই একটা মহা হাদারাম। ভাবলাম তুই এগিয়ে এসে কথা বলবি। তাই বাসা থেকে দৌড়ে এসে বের হলাম। কোথায় কী! মহাশয় রেগেমেগে চলে গেল!
-ও আচ্ছা। তাহলে আপনি এই আশায় ছিলেন!
কথাটা বলে দুজনেই হেসে উঠল। এমন ছিল ওদের দিন গুলো। খুব আনন্দে কাটছিল। কিন্তু হুট করেই যেন কোত্থেকে একটা ঝড় এসে নিহি এবং সোহানের জীবনে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। একটা প্রকাণ্ড দেয়া হয়ে দাঁড়ায়। নিহির বিয়ে ঠিক হয়ে যায়। হুট করেই হয়। এবং বিয়ের কাজ দ্রুতই শুরু হতে থাকে। নিহি প্রথমে ব্যাপারটা বুঝতে পারেনি। পরে জানতে পারল যে ওর বাবা ওদের রিলেশনের ব্যাপারটা জেনে গিয়েছেন। তাই এতো তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দিচ্ছেন। ওর বাবা জনাব আফজাল আহমেদ একজন বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ। তার কাছে প্রেম ভালোবাসা এসব কিছুই না। তাই হয়তো নিহির ব্যাপারটা বুঝতে পারেননি। অযথাই নিহিকে বিয়ের জন্যে জোর করছেন। ভার্সিটি যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন। এমনকি সোহানের ব্যাপারে তিনি কঠোর একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সে ব্যাপারেও নিহি অবগত ছিল না। সোহান নিজেই ফোন করে জানিয়েছে। রাতের বেলা। নিহি মন খারাপ করে নিজের রুমে বসে আছে। ঠিক তখনই সোহানের ফোন আসে।
-হ্যালো? নিহি কান্না করে দেয়। কিছু বলতে পারে না। সোহান বলে,
-বেশি সময় নিবো না। অল্প কিছু কথা বলি। শুনো।
-সোহান আমার কষ্ট হচ্ছে এখানে!
-আমায় ক্ষমা করো নিহি। আমি তোমার এই কষ্ট দূর করতে পারবো না। নিহি অঝোর ধারায় কান্না করতে থাকে। বলে,
-আমায় নিয়ে পালিয়ে যাও না সোহান! আমি এভাবে পারবো না। সহ্য হচ্ছে না আমার। বিষ টিশ খেয়ে ফেলবো আমি।
-খবরদার যদি এমন কিছু করছো। মেরে তক্তা বানিয়ে ফেলবো তোমার লাশকে।
-তো আমি কী করবো সোহান? সোহান অনেকটা সময় চুপ থাকে। বলে,
-বিয়ে করে নাও প্লীজ। আমার এমন অবস্থান নেই যে এই মূহুর্তে তোমাকে নিয়ে পালিয়ে যাবো আমি। পালিয়ে যাওয়ার মতোও তেমন জায়গা নেই। আমি এখনও পড়াশোনা করছি। আমাকে জীবনে আরো কিছু স্টেপ পার হতে হবে নিহি। আমি পারবো না।
-তোমাকে ছাড়া কীভাবে থাকব আমি? সোহান খানিকটা চুপ থাকে। এরপর ধরে আসা গলায় বলে,
-এডজাস্ট করে নিও পাগলি। নিহি শব্দ করে কান্না করে দেয়। সোহান বলে,
-তোমার বাবা এসেছিলেন। বেশ কিছু টাকা অফার করেছিলেন। সাথে চাকরিও। আমি কী বলেছি জানো? নিহি জবাব দিলো না। সোহান বলল,
-আমি বলেছি আমাকে যা যা অফার করছেন সে সব আপনি নিয়ে নেন। নিহিকেও আমার প্রয়োজন নেই। আমি চাই নিহি পড়ুক। আপনি ওকে পড়তে দিন। তোমার বাবা আমাকে আশ্বাস দিয়েছেন। তিনি তা করবেন। কেবল বিয়েটা হলেই হবে। নিহি তুমি তোমার স্বপ্ন পূরণ করিও। বিসিএস দিও। আমার দোয়া তোমার জন্যে সব সময় রয়েছে। থাকবে। ভালো থেকো তুমি।
ফোন কাটা যায়। এরপর আর কথা হয়নি সোহানের সাথে। নিহি চেষ্টা করেছে। সম্ভব হয়নি। নাম্বার বন্ধ বলছে। কষ্টে নিহির বুকটা যেন পাথর হয়ে যাচ্ছে। আজ নিহির বিয়ে। পাত্র সরকারি চাকরি করে। নিহির বাবার মতে নিহির জন্যে উপযুক্ত পাত্র। অথচ তাঁর মেয়ের মনে যে কেউ একজন একটা ঘর তুলেছিল সেটা তিনি বুঝতে পারছেন না। বুঝতে চাইছেন না। ইশ! যদি এমন কোনো ব্যবস্থা থাকত, হৃদয় খুলে যদি ভালোবাসা গুলো দেখানো যেত, ভালোবাসায় বানানো ঘর গুলো দেখানো যেত, যদি দুটো মনের একত্রিত একগুচ্ছ স্বপ্নকে দেখানো যেত তাহলে হয়তো আজ অনেক গুলো প্রাণ বেঁচে যেত।
অনেক গুলো মানুষ বেঁচে থাকতো। সত্যিকারের ভালোবাসা মর্যাদা পেতো। আফজাল সাহেব বড় শক্ত মনের মানুষ। নিহি শেষ মূহুর্ত পর্যন্ত চেষ্টা করেছে উনাকে বুঝানোর। কিন্তু তিনি কিছুতেই বুঝতে রাজি নন। নিহিকে সাজানো হলো। খুব সুন্দর করে সাজানো হলো। অথচ মেয়েটা মুখটাকে পাথর করে রেখেছে। হাসতে পারছে না। মুখে হাসি আসছে না। মলিন হয়ে আছে চেহারা। কাঁদতে কাঁদতে চোখের নিচে কালি পর্যন্ত পড়ে গিয়েছে। অল্প কিছু পরেই নিহির ডাক পড়লো। ঠিক তখনই ওর ফোনে কল আসে। নিহি দৌড়ে গিয়ে ফোন নেয়। আননোন নাম্বার। রিসিভ করে। ওপাশ থেকে কোনো শব্দ আসে না। নিহির কণ্ঠ ভিজে আসে। বলে,
-হ্যালো! ওপাশ থেকে এরপরেও কোনো শব্দ আসে না। নিহির কান্না চলে আসে। বলে,
-সোহান? সোহান ডুকরে কেঁদে উঠে। এপাশ থেকে কী স্পষ্ট শুনা যায় সেই শব্দ। এপাশের মানুষটিও কাঁদে। বলে,
-কেন এমনটা হলো আমাদের সাথে! সোহান কিছু বলে না। কেবল কান্না করে যায়। নিহিও কিছু বলতে পারে না। মুখ দিয়ে শব্দ আসে না যেন। এক সময় সোহান বলে,
-খুব কষ্ট হয় বুকের ভেতর। বেশ চাপ পড়ে। কেমন জানি লাগে নিহি। ফাঁকা ফাঁকা লাগে। যেন দম নিতে পারছি না।
-আমার তেমন লাগছে সোহান।
এরপর প্রায় অনেকটা সময় নিরব থাকে দুজন। কেবল কান্নায় কান্নায় অন্তিম বিচ্ছেদ হয়। এর প্রায় বেশ কিছু বছর পর নিহি তার হাজবেন্ডের সাথে বাবার বাড়ি আসে। এর মাঝে আর আশা হয়নি। বিয়ের পর নিহি ইচ্ছে করেই বাবার বাড়ি আসেনি। কেন আসেনি সেটা কেউ জানে না। স্বামীর বাড়ি থেকে স্টাডি কম্পলিট করেছে। বিসিএস দিয়েছে। ক্যাডার হয়েছে। হয়তো সোহানের মতো কেউ তেমন চেয়েছিল বলে। অবশ্য বিয়ের পর পড়া নিয়ে অনেক ঝামেলা পোহাতে হয়। নিহির বাবা নিজেও রাজি হচ্ছিলেন না।
কথা দেয়ার ব্যাপারটা তিনি ভুলে গেলেন। সবাইই ভুলে যায়। কেবল নিহির মতো মেয়েরা ছাড়া। নিহি একাই লড়ে গেল। এইটা তার সোহানের ইচ্ছে। সে যে করেই হোক তার সোহানের জন্যে লড়বেই। এবং সে লড়েছে। সফল হয়েছে। ভাগ্য সুপ্রসন্নই বলতে হবে। স্বামী হিসেবে যাকে পেয়েছে ও তার সাপোর্ট পাওয়া গিয়েছে। এই অনেক। বাবার বাড়িতে প্রথম সন্ধ্যায় নিহির বাবা নিহিকে নিয়ে ছাদে আসেন। অনেকদিন বাবা মেয়ের কথা হয়। আজ সুযোগ হলো। আফজাল সাহেব সেই সুযোগ লুপে নিলেন। তিনি কথা বলে যাচ্ছেন। নিহি জবাব দিচ্ছে। এক পর্যায়ে তিনি জিজ্ঞেস করলেন,
-এখন সব তো হয়েছে। ক্যাডারও হয়েছিস। খুব ভালো আছিস, তাই না? আফজাল সাহেব হাসি মুখে কথাটা বললেন। নিহি চুপ করে থাকল। অনেকটা সময় চুপ করে থাকল। নিচের দিয়ে তাকিয়ে থাকল। আফজাল সাহেব এগিয়ে আসেন মেয়ের কাছে। মেয়ের মুখ তুলতেই দেখলেন মেয়ে কান্না করছে। চোখ ভর্তি জল। তিনি অবাক হলেন। নিহি বলল,
-আমি খুব ভালো আছি বাবা। খুব ভালো আছি। আমার সব আছে। সব। কেবল একজন ছাড়া। যে জন ছাড়া আমি আসলেই খুব সুখে আছি।
নিহি শব্দ করে কেঁদে দিলো। তারপর দৌড়ে চলে গেল। আফজাল সাহেব স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেন। রাজনীতিতে এ যাবত তিনি জয়ী হয়ে আসছেন। সকল ক্ষেত্রেই জয়ী। প্রয়োজনে জয় কিনে নিয়েছেন। তাঁকে কেউ বাধা দিতে পারেনি। অথচ আজ তাঁর মনে হলো তিনি আসলেই জয়ী নন। তিনি হেরে গিয়েছেন। যে বাবা তার সন্তাদের খুশি করতে পারে না সে বাবা কখনই জয়ী হয় না।
কখনই না। আফজাল সাহেব কেঁদে উঠলেন যেন। প্রচণ্ড অনুশোচনা বোধ উনার চোখে জল এনে দিল। মানুষের কিছু কিছু অনুভূতি থাকে, কারো কেউ একজন থাকে, কারো কিছু স্মৃতি থাকে, যেগুলো কিংবা যাদের কখনই ভোলা যায় না। ভোলা সম্ভব হয় না। তারা আজীবন প্রিয় থাকে। থেকে যায়। কেউ চাইলেই তাদের জায়গাটা নিয়ে নিতে পারে না। ভালো থাকুক নিহি-রা। ভালো থাকুক সোহানের মতো প্রেমিকরা।