পরিনতি

পরিনতি

কিছু কথা এমন থাকে যেগুলো নিজের কানে শুনেও অবিশ্বাস্য বলে মনে হয়। কারন আমাদের বিশ্বাসের জমিটা খুব ছোট আর পাতলা। প্রায় কিছুই না জেনে না বুঝে যৎসামান্য বুদ্ধি দিয়ে বিচার করতে চাই সবকিছু। কিন্তু জানি না নিজের জ্ঞানের পরিধিটা কতটুকু। বুঝিনা যা ঘটছে তার পেছনের কারনটা শুধু আমার নয় স্বয়ং কারনের‌ও প্রারব্ধ কাটিয়ে দিচ্ছে। পথের ধুলো গায়ে মাখলে মা যেমন দুটো চড় কষিয়ে দেন, তেমনি তৎক্ষনাৎ সাবান শ‍্যাম্পু দিয়ে সন্তানকে পরিস্কার করতেও লেগে যান। কারন সব পরিস্কার করিয়ে তারপর কোলে তুলে নিয়ে ফিরবেন তিনি। ময়লা শরীরের সন্তানকে ফেলে যাবেন না। ওই পরিস্কার হ‌ওয়ার সময়টাই বড় কঠিন বড় কষ্টের।

এই উপলব্ধি কোনকালেই আমার মতো গন্ডমূর্খ‍্যের ছিল না এবং আজো নেই। এখনো “মা কেন কষ্ট দাও” বলে হাপুস নয়নে কাঁদি। পালিয়ে যাওয়ার অক্ষম চেষ্টা করি। স্বয়ং মহেশ্বর যাঁর দাপটে পালাতে গিয়ে দশদিক থেকে আটকে গেছিলেন তাঁর হাত থেকে পালানোর ক্ষমতা কারো নেই। তিনি খপ করে সাবান শুদ্ধুই আমাকে ধরে ফেলেন এবং নবোদ‍্যমে ছোবড়া ঘষে ময়লা তুলতে লেগে পড়েন।

এই পালানো, ধরা পড়া আর ছোবড়া ঘষার মধ্যে হয়তো কেটে যায় কয়েক জন্ম। তারপর পরিস্কার হয়ে মায়ের কোলে ওঠে সেই শিশু। এতো জ্ঞানের কথা আমার মুখে শোভা পায় না। কারন আমি ওই পালাতে চাওয়ার দলে। মায়ের দিকে তাকিয়ে ভাবছিলাম আর কতদিন ছোবড়া ঘষবেন তিনি। কত ময়লা লাগিয়েছি বাপ!! বিচ্ছিরি রকমের বৃষ্টি হচ্ছে সকাল থেকেই। মন মেজাজ খুব একটা ভালো নয়। ছোবড়ার ঘষায় জ্বলে যাচ্ছে শরীর। যিনি ঘষছেন তাঁর কাছেই বসে তাঁকেই পালানোর রাস্তা করে দিতে বলছি এতটাই উজবুক আমি। কিন্তু যাবোই বা আর কোথায়! ” কালী বিনা কে আছে তোমার”।

সেই কালীঘাট, সেই নাটমন্দির কিন্তু মা চিরনতুন। রোজ‌ই দেখি কিন্তু কোনদিন এক মনে হয় না। অপরূপ সুন্দরী সেজে টানাটানা তিনটে উজ্জ্বল কমলা রঙের চোখে তাকিয়ে থাকেন তিনি। ফুলে ফুলে কাঁদি আর বলি ” এবার মুক্তি দে মা, আর যে পারি না।” পুজো দিতে আসা কিছু যাত্রী দেখেন, কিন্তু মায়ের কাছে বসে কাঁদার কারন কেউ জানতে চান না। এটার নাম দিয়েছি কান্নাঘর। আমি একা নয়। লুটিয়ে পড়ে কাঁদেন অনেকেই। ভাবি দেখে তখন ‘ এতো দুঃখ‌ও আছে মানুষের!’ থেমে যায় নিজের পিঠে ছোবড়া ঘষার যাতনা।

মাঝেমধ্যে ছুটে যাই বাপের কাছে। দেখি সেখানেও এক‌ই দৃশ্য। তিনি শুধু সস্নেহে সবার মাথায় হাত রেখে বলেন -‘ আচ্ছা যা, মাকে বলগে যা। আমি বলে দেবো তাকে।’ মায়ের দিকে তাকিয়ে ভাবছি নানা এলোমেলো কথা। হঠাৎ মনে পড়লো শুভজিৎ বাবুর কথা। গল্পটা আমি শুনেছিলাম বহুবছর আগে। হয়তো মনের কোন গোপন প্রকোষ্ঠে গেঁথে গেছিল। আজ এই বৃষ্টি মুখর দিনে মায়ের সামনে বসে মনে পড়লো। সেই কাহিনীও এখানেই শুরু হয়েছিল। তবে শেষ কোথায় তা আর জানা নেই। কালের কোন গভীরে মিশে গেছে কে জানে। শুধু রেখে গেছে তার ছাপটা। বছর পঁচিশ আগের কথা। শুভজিৎ বাবুর মতো গোঁড়া নাস্তিক খুঁজে পাওয়া কঠিন। রক্তমজ্জায় কমিউনিষ্ট। কিন্তু যেটা তাঁর ছিল না সেটা হচ্ছে ধর্মবোধ।

ধার্মিক না হয়েও ধর্মবোধটা রাখা যায়। অনেকেই আছেন যাঁরা তথাকথিত অর্থে ধার্মিক নন। পুরুষকার ও কর্মে বিশ্বাসী। শুভজিৎ বাবু অনেক গুনের অধিকারী হয়েও ওই ধর্মবোধটা আনতে পারেন নি। কলকাতার একটি নামী কলেজে সদ‍্য চাকরি পেয়েছেন তিনি। বছর খানেক হলো বিয়ে করেছেন। স্ত্রী সদ‍্য সন্তান সম্ভবা হয়েছেন। ইতিমধ্যে দলের কাজে দিন কয়েকের জন্য উত্তরবঙ্গ গেলেন শুভজিৎ বাবু। স্ত্রী অতি সাধারন মহিলা। তিনি বাপের বাড়ি গেছিলেন। কোনভাবে সেখান থেকেই বাড়ির লোকের সাথে কালীঘাট গেলেন। সন্তানের মঙ্গল কামনায় পুজো দিয়ে প্রসাদ নিয়ে বাড়ি ফিরলেন। প্রথমে ভেবেছিলেন স্বামীকে কিছু বলবেন না। তারপর মনে হলো মায়ের কাছে আশীর্বাদ নিয়ে এসেছেন তিনি দুজনের জন‍্য‌ই।

অনাগত সন্তান তো সঙ্গে করে ঘুরেই এলো। কিন্তু স্বামীর ভাগের আশীর্বাদ টা তো তাঁকেই দেওয়া উচিত। শুভজিৎ বাবু শিক্ষিত ও বিচক্ষন ব‍্যাক্তি। তিনি নিজের মতাদর্শ সচরাচর পরিবারের কারো ওপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন না। তাই শুভজিৎ বাবু কাজ সেরে যেদিন বাড়ি ফিরলেন সেদিন সন্ধ্যাবেলায় তিনি মায়ের প্রসাদী জবাফুল হাতে নিয়ে গেলেন স্বামীর কপালে ঠেকিয়ে মায়ের আশীর্বাদ দিতে। শুভজিৎ বাবু এক মুহুর্ত থমকে গিয়ে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে থাকলেন। তারপর স্ত্রীর হাত থেকে ফুলটা নিয়ে মাটিতে ফেলে সেটা আধপোড়া সিগারেটের মতো পায়ে পিষতে পিষতে বললেন -‘ যেটা করেছো, আর করো না। এসব আমি মানি না। পৃথিবীর কোন পাথরের মুর্তির ক্ষমতা নেই আমার ভালো করার বা খারাপ করার।’

বুকের ভেতরটা সেদিন কেঁপে গিয়েছিল তাঁর স্ত্রীর। কিন্তু মুখে একটিও কথা না বলে করজোড়ে মায়ের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেছিলেন তিনি। এই ঘটনার পর কেটে গেছে বহুদিন। তিনি নিজেও ভুলে গেছেন ঘটনাটা। যথা সময়ে সন্তান প্রসব করেছেন। ফুটফুটে একটি কন‍্যা হয়েছে। সুন্দর সুস্থ মেয়েকে নিয়ে বাবা, মা দুজনেই খুব খুশি। দিন কাটতে লাগলো আনন্দেই। মেয়ে চিৎ থেকে উপুড় হলো, উঠে বসলো এবং কালের নিয়মে হামা দিতেও শুরু করলো একদিন। প্রায় দেড় বছরের মাথায় বোঝা গেল, মেয়ে খাড়া হয়ে দাঁড়াতে পারছে না। ওর পায়ের পাতায় কোন জোর নেই। চাপ পড়লেই হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাচ্ছে।

বাবা, মা তড়িঘড়ি ছুটলেন ডাক্তার দেখাতে। ডাক্তার একটু পরীক্ষা করে এক্স রে করতে বললেন। রিপোর্ট আসার পর বোঝা গেল সমস্যা। গোড়ালির হাড়ের সাথে পাঁচটা সম্মিলিত হাড় নিয়ে তৈরি হয়, টার্সাল জয়েন্ট। সেখান থেকে আঙ্গুলের আগে অবধি থাকে মেটাটার্সাল হাড়ের সমষ্টি। আর তার মুখ থেকে শুরু হয় আঙ্গুলের জোড়ের মুখ। মেয়েটির টার্সালের পর থেকে বাকিটা তৈরি হয় নি। যে জন্য পায়ের পাতার সামনের দিকে কোন হাড় না থাকার জন্য দাঁড়ালে শরীরের ভারসাম্য বজায় রাখতে পারে না। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় রোগটির নাম “টার্সাল কোয়ালিশন”।

কিন্তু পায়ে কোন যন্ত্রনা নেই। শুধু পায়ের পাতাটা সাধারন মানুষের মতো শক্ত নয়। আঙুল দিলে বসে যায় ভেতরে। যতদিন না পুর্ণাঙ্গ হচ্ছে পায়ের পাতা ততদিন কোন ব‍্যবস্থা করা যাবে না। কারন প্লেট বসালে সেটা পায়ের পাতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ছোট হতে থাকবে। তখনকার দিনে এই চিকিৎসা করার অন্য পদ্ধতি দিতে পারেন নি কেউ। বড় হ‌ওয়ার পর অপারেশন করে তবে ওই স্থানে প্লেট দিয়ে জুড়ে দেওয়া যাবে।

শুভজিৎ বাবু আর তাঁর স্ত্রী আক্ষরিক অর্থেই উন্মাদের মতো নাহোক দশ পনেরো জায়গায় ছুটেও কোন সমাধান পেলেন না। এরমধ্যেই শুভজিৎ বাবু একদিন স্নানের সময় নিজের নাভির ময়লা পরিস্কার করতে গিয়ে বেকায়দায় নখের আঁচড় লাগিয়ে ফেললেন। অচিরাৎ সেপটিক হয়ে প্রান তাঁর যায় যায়। কিছুতেই আরোগ্য লাভ হচ্ছে না।
তাঁর স্ত্রী সবভুলে যেখানে যত ঠাকুর বাড়ি, মন্দির পেলেন সব ঘুরতে শুরু করলেন। শুভজিৎ বাবুর কাজের জায়গায় সমস্যা শুরু হলো।

এমতাবস্থায় একদিন তারাপীঠে যাওয়ার কথা উঠলো। শুভজিৎ বাবু বললেন -‘ এসব করে কোন লাভ নেই। শরীর থাকলে সমস্যা তো হবেই। ডাক্তার দেখিয়ে যা কমছে না সেটা কি তারাপীঠ শ্মশানের নোংরা মাটি লাগিয়ে কমবে?’ বলতে বলতে হাতে ধরা সিগারেটের শেষটা তিনি মাটিতে ফেলে চটি দিয়ে ঘষে দিলেন। তাঁর স্ত্রী যেন বিদ্যুৎ লাগার মতো চমকে গেলেন সেটা দেখে। তাঁর চোখের সামনে যেন ভেসে উঠলো একটি পুরনো দৃশ্য। তিনি নিজের অজান্তেই কয়েক পা এগিয়ে গেলেন স্বামীর দিকে।

শুভজিৎ বাবু মুখ তুলে তাকাতেই একটা সপাটে চড় এসে পড়লো তাঁর গালে। অসুস্থ শরীর বলে মাথার মধ্যে ঝিমঝিম করে উঠলো তাঁর। মুখ দিয়ে কিছু বলার আগেই হিসহিসে গলায় তাঁর স্ত্রী বললেন-‘ সেদিন যদি তোর মুখটাকে মায়ের মন্দিরে রেখে তার ওপরে এরকম চটি দিয়ে রগড়ে দিতে পারতাম তাহলে আজ আমাকে এই দিন দেখতে হতো না।’ শুভজিৎ বাবু আতঙ্কিত ভাবে কিছু বলতে গিয়েও কথা খুঁজে পেলেন না। আলুলায়িত চুল, খসে পড়ছে শাড়ির আঁচল। বড় চোখ দুটো আরো টানা টানা লাগছে। রক্তের মতো লাল হয়ে আছে দুটো ঠোঁট আর চোখে একটা ভয়ংকর খুনিয়া দৃষ্টি। বিষাক্ত সর্পিনীর মতো তাঁর স্ত্রীর গলা কানে এলো।

-‘ সেদিন এইভাবে তুই মায়ের প্রসাদী ফুল পায়ের জুতোয় রগড়েছিলি না! দ‍্যাখ, আজ তোর নয়নের মনির সেই জায়গার হাড়গুলোই গজায় নি। সন্তানের জন্য মায়ের আশীর্বাদ নিতে গেছিলাম ওই মেয়ের জন্য আশীর্বাদ নিতে গেছিলাম। তোর মতো পাষন্ড নরাধমের জন্য যাই নি। দ‍্যাখ, কি হলো। বাপ মায়ের কাছে সবচেয়ে বড় কষ্ট হলো সন্তানের কষ্ট। প্রতিনিয়ত সেই কষ্টে ভুগছি আজ। যে মা তোর আমার জন্মদাত্রী তাকে অপমান করার স্পর্ধা দেখিয়েছিস তুই। তাই আজ তোর সেই যোগসূত্রের স্থান নাভি নিয়ে ভুগছিস। জুতিয়ে মুখ ছিঁড়ে দেবো তোর। আবার এখন তারাপীঠে যাবো বলাতে জ্ঞান দিচ্ছিস তুই নরকের কীট!’ শুভজিৎ অজ্ঞান হ‌ওয়ার চেষ্টা করছিলেন। স্ত্রীর এই রুদ্রমূর্তি তাঁর সম্পূর্ন অজানা। অসুস্থ শরীরে নিতেও পারছিলেন না। ব‌ইতে পড়েছিলেন মা কালীর দশটা কি সব রূপ নাকি এরকমই দেখতে ছিল। এবং সেটা দেখে শিব‌ও নাকি জ্ঞান হারিয়ে ফেলার অবস্থায় চলে গেছিলেন। সেই কালী আজ তাঁর বৌয়ের ওপর চাপলো নাকি?

অনেক দিন ধরে টেনশন, দুঃখ, যন্ত্রনা নিতে না পেরে এই বিস্ফোরনটা হতেই তাঁর স্ত্রী কাটা কলাগাছের মতো লুটিয়ে পড়লেন মাটিতে। শুভজিৎ বাবু তোলার চেষ্টাও করলেন না বা কারোকে ডাকলেন‌ও না। তিনি নিজেও চোখ বন্ধ করে ভয়টা কাটাবার চেষ্টা করছিলেন। প্রায় মিনিট পনেরো গেল ধাতস্থ হতে। শুভজিৎ বাবু নিজেই কোনরকমে উঠে স্ত্রীকে জলের ঝাপটা দিলেন চোখে মুখে। তাঁকে অবাক করে তাঁর স্ত্রী উঠে বসে আঁচল সামলে নিয়ে বললেন-‘ আমি এখানে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছি, ডাকো নি কেন?’

শুভজিৎ বাবুর জিভ জড়িয়ে গেল ফের। “সাইকোলজিক্যাল ডিস‌অর্ডার” শব্দটা মাথায় এলেও চেপে গেলেন। “স্প্লিট পার্সোনালিটি” খুব ভয়ংকর জিনিস। একবার যদি চেপে ধরে তাহলে ডক্টর জেকিল থেকে মিষ্টার হাইড হতে সময় নেবে না। তিনি অসুস্থ মানুষ, সামলাতে পারবেন না যা রূপ দেখলেন। মাথাটা এখনো ঝিমঝিম করছে তাঁর চড়ের চোটে। এতোজোরে মানুষ লাথি মারেনা,যতজোরে চড় খেয়েছেন। ঠিক করলেন তারাপীঠ নিয়ে যাবেন স্ত্রীকে। নিজেও যাবেন কষ্ট হলেও। যদি কোনভাবে আবার সমস‍্যাটা আসে তাহলে মুশকিল হয়ে যাবে। কিন্তু এতবড়ো কান্ডটা সে পনেরো মিনিটের মধ্যে ভুলে গেল কি করে এটাই বুঝতে পারলেন না শুধু। এই ঘটনার এক সপ্তাহ পরে তারাপীঠের নাটমন্দিরে বসে আছেন দুজনে মেয়েকে নিয়ে। একটি ময়লা পোষাক পরা লোক এসে বসলো পাশে। শুভজিৎ বাবুর মেয়ের সাথে অবিলম্বে ভাব জমে গেল তার। মেয়ের মা চোখ বন্ধ করে শুধু কাঁদছেন মায়ের দিকে তাকিয়ে। শুভজিৎ বাবুর দিকে তাকিয়ে লোকটি মৃদু হেসে বলল-‘ তোমার বৌকে নিয়ে যেও কালীঘাটে। ওখানেই পথ আছে।’

শুভজিৎ বাবুর মাথায় কথাটা ঢোকার আগেই লোকটি তারা মাকে প্রনাম করে উঠে বেরিয়ে গেল। রাতে হোটেলের ঘরে কথাটা তিনি বললেন স্ত্রীকে। স্ত্রী কিছুক্ষন স্তব্ধ হয়ে থেকে বললেন-‘ কাল বাড়ি ফিরে পরশুই যাবো। আমি একলাই যাবো।’ কোথাও একটু খারাপ লাগা তৈরি হলো শুভজিৎ বাবুর এই প্রথমবার কোন মন্দিরে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হবে না শুনে। তিনি মৃদুস্বরে বললেন -‘ আমি নাহয় মন্দিরে উঠবো না তোমার আপত্তি থাকলে। নাকি সঙ্গে রাখবেই না?’গোল গোল চোখ করে তাঁর দিকে তাকিয়ে গিন্নী বললেন-‘ তুমি যেতে চাইছো?’ শুভজিৎ বাবু আর জবাব দিলেন না কথাটার। কিছু জবাব পেলেন‌ও না দেবার মতো।

দিন তিনেক পর স্ত্রী কালীঘাটের সোজা রাস্তা ধরে ভীড়ে মিশে যাওয়ার পর তিনি এদিক ওদিক ঘুরতে শুরু করলেন। শরীরের অবস্থা বেশ খারাপ। বেশি হাঁটতে গেলে লাগে পেটে। তাও পাক খাচ্ছিলেন এদিক ওদিক। হঠাৎ নজরে পড়লো বেশ বড়সড় আরেকটা মন্দির একটা রাস্তার বাঁকে। কাছাকাছি গিয়ে মনে হল শিব মন্দির। তবে বন্ধ। এমনকি ভেতরে কি আছে দেখাও যাচ্ছে না এতটাই মোড়া কাপড়, চট প্রভৃতি দিয়ে। পাশের দিকে রাখা সিমেন্টের স্ল‍্যাবে বসলেন তিনি। বৌয়ের দেরি হবে, সুতরাং হুড়োহুড়ি কিছু নেই। একবারও মনে হলোনা যে এইসব স্থানে তিনি কেন এসেছেন। যেন রোজ‌ই আসেন এমনি একটা সহজ অনুভূতি হচ্ছে তাঁর। তাঁর রাজনৈতিক মতাদর্শের সাথে এসবের কোন অমিল ভেতর থেকেই খুঁজে পাচ্ছিলেন না তিনি। পাশ থেকে কে বলল-‘ ভালো করেছো, এখানে বসো। বাবা খুশি হলে মাও খুশি হবে।’

চমকে ঘাড় ফিরিয়ে পাশের লোকটিকে দেখে আরো বেশি চমকিত হলেন শুভজিৎ বাবু। এতো সেই তারাপীঠের নাটমন্দিরের লোকটি। এখানে কি করে এলো? লোকটি যেন তাঁর মনের কথা পড়ে নিয়ে বলল-‘ গত পরশু রাতের ট্রেনে ফিরেছি। আমার বাড়ি এখানেই। আদিগঙ্গার ওপারে। তুমি যে এসেছো আমার কথা শুনে সেটাই দেখে খুব ভালো লাগলো।’ শুভজিৎ বাবু আমতা আমতা করে বললেন -‘ সে ঠিক আছে, কিন্তু তুমি ইয়ে আপনি সেদিন ওমন বললেন কেন একটু বলবেন!’ লোকটি খোঁচাখোঁচা একগাল দাড়ি চুলকে নিয়ে বলল-‘ মনে হল, তাই বলেছি। ক্ষতি করিনি তো কিছু। মায়ের কাছে আসবে তো তাতে আবার ওতো খতেন নেবার কি আছে?’

শুভজিৎ বাবু চুপ করে গেলেন। লোকটি নিজেই বলল-‘ প্রারব্ধ কাকে বলে জানো? মরার সময় যে কর্মের ফলটুকু বগলে করে নিয়ে মানুষ মরে, সেটাই তার প্রারব্ধ। এই প্রারব্ধ ভোগার জন্য‌ও একটি প্রারব্ধ যুক্ত কারনের দরকার হয়। ধরো তুমি খুব অত‍্যাচারী লোক। তুমি গুন্ডা দিয়ে মেরে একটা নির্দোষ ছেলের পা ভেঙে দিলে। কিন্তু সেটার জন্য কেউ তোমায় কিছু বলল না। তা বলে ভেবো না সেও ছেড়ে দেবে। সেই ছেলেটির বাপের একমাত্র সহায় ছিল সে। তার বাপের চোখের জলের দামতো তোমাকে চুকোতে হবে বাপ। আর যে গুন্ডাটি শুধু তোমাকে খুশি করতে টাকার জন্য একটা ছেলের পা ভাঙলো তার বিচার টাও তো থাকবে। দেখা গেল ওই গুন্ডাটাই এবারে তোমার ছেলে হয়ে এসে খোঁড়া হয়ে বসলো। তোমার ছেলের জন্য কষ্ট, তার‌ও নিজের খোঁড়া হবার জন্য কষ্ট দুটোই কিন্তু ওই মহামায়াই মিলিয়ে দিয়ে ভুগিয়ে দিয়ে কাটিয়ে দিল। নাহলে আরো বিচ্ছিরি হতো।

মানুষে আসলে মাকে দোষ দিয়ে ফেলে না বুঝে, না জেনে। গায়ের ময়লা কোন শিশু নিজের হাতে ঘষে তুলতে পারে কি? মাকেই ঘষে তুলে দিতে হয়। ওই ঘষে তোলার সময় যা কষ্ট। একবার উঠে গেলেই হয়ে গেল। ভেবো না, এখানে এসেছো যখন তখন মা ঠিক উপায় করে দেবেই। তবে না বুঝে মেলাই ময়লা মেখেছো। একটু তো কষ্ট হবে। অনুতাপে প্রারব্ধ নাশ হয়। আর অনুতাপের সাথে আর কোন প্রারব্ধ হবার মতো কাজ না করাটাই তপস্যা।’
শুভজিৎ বাবু যেন ঘোরে চলে গেছিলেন কথাগুলো শুনতে শুনতে। এবার সত্যিই তাঁর মাথা ঘুরে গেল। মিনিট পাঁচেক পর তাঁর যখন জ্ঞান ফেরালো স্থানীয় লোকজন জলের ঝাপটা মেরে তখন তাঁর পাশের স্থান খালি। কেউ নেই। অজ্ঞান অবস্থায় কি দেখেছেন সেটাও বলার মতো ক্ষমতা নেই তাঁর। তিনি খুব ধীরে ধীরে আবার মায়ের মন্দিরের কাছে এসে দাঁড়ালেন। দুচোখ বেয়ে জল পড়ছিল তাঁর শুধু।

শুভজিৎ বাবুর আর কোন খবর আমি পাই নি। শুধু অনেক বছর পর জানতে পেরেছিলাম যে মেয়ের পায়ে প্লেট বসিয়ে দেওয়া হয়েছে, পড়াশোনা করতে বিদেশে গেছে একলাই। তার মধ্যে বিন্দুমাত্র পঙ্গুত্ব নেই আর।
জানি না শুভজিৎ বাবুর তপস্যা চলছে কি না। তবে আমার মতো আরো অনেকেই যে এক‌ই তপস্যায় জুটে আছে সেটা বুঝলাম আজ এতো বছর পর এই কালীঘাটে এসে। তিনটে কমলা রঙের চোখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম একবার। বাইরে তখন রোজের মতো মাইকে শ‍্যামাসঙ্গীত শোনা যাচ্ছে “কালী কালী বল রসনা, কালী কালী বল রসনাকর পদধ‍্যান, নামামৃত পান হতে যদি ত্রান,থাকে বাসনা।।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত