( অনেক সময় অনেক কারণে গৃহস্থের ঘরে প্রেত প্রবেশ হয়। সেই ঘটনা পরিবারকে আস্তে আস্তে শেষের পথে ঠেলে দেয়। যে সমস্ত প্রেত প্রবেশ সংসারকে শেষের পথে ঠেলে দেয় , তার মধ্যে অন্যতম হলো কাচ্চা কালুয়া। এর উপস্থিতি চট করে জানান দেয়না , এতটাই ধূর্ত। যখন জানা যায় তখন হয়তো অনেকটাই দেরি হয়ে যায়। খুব কম বয়সী শিশু অপঘাতে মারা গেলে তার অতৃপ্ত আত্মা দিয়ে যখন কাজ করানো হয় সেই হলো কাচ্চা কালুয়া। এই ব্যাপারে যার কাছে তথ্য পেয়েছি সেই রিয়াদির ( grihini ria ) কাছে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে শুরু করলাম )।
শেষ আশ্বিনের ছায়া ছায়া সন্ধে নামছিল মিশ্র বাড়ির গাছপালা ঘেরা বাগানে। দিনকয় হলো বৃষ্টি থেমেছে। বাতাসে হালকা শিরশিরানী। উৎসবের মরশুম আসছে প্রকৃতির বুকে , এই বাড়িতে অবশ্য তার কোনো ছোঁয়া নেই। কি যেন চাপা গুমরানো অভিশাপ বুকে নিয়ে বাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে। এক কালের জমজমাট বাড়িটা এখন এখানে ওখানে ফাটল , যেখানে সেখানে গজিয়ে ওঠা গাছ আর অযত্নে অবহেলায় এক বুক দীর্ঘশ্বাস নিয়ে কোনোমতে দাঁড়িয়ে আছে।
ওপরের চিলেকোঠার ঘরে ঝন ঝন করে কি যেন পড়ে গেল ! তার পরেই দোতলার টানা বারান্দায় কে দুপদুপ করে ছুটে গেল ! এ বাড়িতে এখন তিনজন মাত্র মানুষ। মধুরা , তার বাবা অনিমেষ বাবু আর মা অনিতা। মধুরা দাঁড়িয়ে ছিল জানলার পাশে। এখন ওপরের ঘর গুলোতে পা টেনে টেনে কে জানি হেঁটে বেড়াচ্ছে। বিনা হাওয়ায় খানিক জানালাগুলো দুমদাম করে বন্ধ হলো । এসবে আর অবাকও হয়না মধুরা। আজ বহুদিন হলো এসব ঘটছে বাড়িটায়। প্রথম প্রথম হালকা দু চারটে আওয়াজ হতো, অন্ধকারে কার ছায়া যেন হঠাৎ সরে গেল মনে হত। এবাড়ির ওপর দিয়ে পর্যন্ত পাখি ওড়ে না। বহুদিন মধুরা ছাদে গিয়ে মরা খোবলানো পাখি , বেড়াল , ইঁদুর পরে থাকতে দেখেছে। আস্তে আস্তে এই উপদ্রব বেড়েই চলেছে। যেই থাক এ বাড়িতে , সে এখন তার উপস্থিতি সশব্দে জানান দেয়।
রাস্তায় আলো জ্বলে উঠছে একে একে। বহতা জীবনের ধারা আসন্ন উৎসবের আনন্দকে স্পর্শ করছে । এসবই এবাড়িতে প্রবেশ করেনা বহুদিন । মধুরার পিতামহ অখিলেশ নামকরা ব্যবসায়ী ছিলেন এ তল্লাটের। রমারমা অবস্থা ছিল তাঁর। হঠাৎই প্রথমে ব্যবসার মন্দা এলো, ধীরে ধীরে ব্যবসায় লালবাতি জ্বললো। এর মাঝেই হঠাৎ তাঁর ছোট ছেলে , মধুরার কাকা একদিন আচমকা মাঝ রাতে ছাদ থেকে পড়ে মারা গেল। অত রাতে ছাদে সে উঠেছিল কেন বা পড়ে গেল কি করে অমন তরতাজা যুবক, সেটা রহস্যই থেকে গেল। তার কিছুদিন পর এক তান্ত্রিকের কাছ থেকে বাড়ি ফিরছিলেন অখিলেশ সস্ত্রীক গাড়িতে করে। এক রক্ষীবিহীন লেভেল ক্রসিংয়ে গাড়িটা ট্রেনের ধাক্কায় আরোহী সমেত একসিডেন্ট করলো। মধুরার দাদু এবং ঠাকুমা দুজনেই ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছিলেন। এবাড়ি সেদিন থেকেই কি এক আতঙ্কে স্তব্ধ হয়ে গেছিল।
তবু যা হোক করে টিমটিম করে জীবন চলছিল মধুরা আর তার বাবা মায়ের। কিন্তু এবারও অভিশাপ তার থাবা বাড়ালো। একদিন অফিস যাওয়ার সময় দোতলা বাসের নীচে কি ভাবে যেন পিছলে চলে গেলেন অনিমেষ। কে যেন মৃদু ধাক্কা দিয়ে তাকে ঠেলে দিয়েছিল মৃত্যুর মুখে। প্রাণে মরলেন না কিন্তু একটা পা বাদ দিতে হলো তাঁর। আর তার ছয় মাসের মাথায় অনিতা স্ট্রোকে শরীরের এক দিকের সাড় হারিয়ে ফেললেন। একের পর এক ঘটনার অভিঘাত এই বয়সেই মধুরাকে লড়াই করতে শিখিয়ে দিচ্ছিলো আস্তে আস্তে। বাবার অফিস থেকে পাওয়া সামান্য কটা টাকার ভরসায় না থেকে তাই সে কলেজের পড়া শেষ করেই একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি নিলো। যা হোক করে চলছিল। কিন্তু কাল থেকে সে চাকরিও চলে গেছে তার।
দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই করে যাওয়া যায় কিন্তু অজ্ঞাত শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করা অসম্ভব। হ্যাঁ, মধুরার বেশ কিছুদিন থেকে বদ্ধমূল ধারণা তৈরি হয়েছে যে তাদের বংশে পরপর নেমে আসা এই সব দুর্ঘটনা শুধুই দুঃসময় নয়। এসব কোনো অপার্থিব অঙ্গুলি হেলনেই হচ্ছে। আজকাল তার বহু রাত বিনিদ্র কাটে। বাবা মা ওষুধ খেয়ে ঘুমোয় তাই তারা টের না পেলেও সে কিন্তু রাত্রে আচমকা কালো কোনো ছায়াকে সরে যেতে দেখে , কে যেন বাচ্চার গলায় খলখল করে হাসে খুব মৃদু শব্দে। রান্না ঘরে বাসন আপনা আপনি ঝনঝন করে পড়ে যায় , বারবার কল খুলে দেয় কেউ। ভয় পেতে পেতে আজকাল সে যেন কেমন ভয়ের সঙ্গে অসম লড়াই করতে শিখছে ! মধুরা আপ্রাণ চেষ্টা করেছে , বহু তান্ত্রিকের কাছে হত্যে দিয়েছে , বাড়িতে হোম যজ্ঞ হয়েছে । কিন্তু লাভ কিছুই হয়নি।
এবার একবার শেষ চেষ্টা করতে চায়। সে জানে এবারও কোনো রাস্তা না পেলে তাদের তিনজনকেই এভাবে তিল তিল করে মরতে হবে। পুজোয় তার বান্ধবী রুমনা আর তার বাড়ির লোকজন বেনারস যাবে। মধুরাও ওদের সঙ্গে একখানা টিকিট কেটেছে। হয়তো অসম্ভবের সন্ধানে , তবু বেনারসে তো বহু সাধকের বাস তাই একবার গিয়ে যদি কোনো সমাধান পাওয়া যায় , সেই উদ্দেশেই যাওয়া তার। বেনারসে এসে সবাই ঘুরতে , পুজো দিতে ব্যস্ত। মধুরা কিছুতেই শান্তি পাচ্ছিলনা। এ ঘাট থেকে সে ঘাটে একাই ঘুরছিল সে। কি জানি কিসের টানে !
সেদিন সন্ধ্যা নামছে গঙ্গার বুকে। গঙ্গা আরতির সময় হলো এবার। হরিশচন্দ্র ঘাটের এক দিকে হাঁটুতে মুখ রেখে চুপচাপ বসে অদৃষ্টের কথাই বোধ হয় ভাবছিল মধুরা , অসহায় হয়ে ঈশ্বরকে ডাকছিল আকুল হয়ে। আচমকা সামনে কালো ছায়ার মতো কে এসে দাঁড়ালো। চমকে মুখ তুললো মধুরা। একটা ছেঁড়া খোঁড়া জামা কাপড় পরা পাগল ধরণের লোক। গায়ে মাথার চুলে নোংরা। হলুদ দাঁত বের করে লোকটা হাত বাড়ালো তার দিকে। ভিক্ষা চাইছে। মধুরার ব্যাগে টাকা পয়সা অতি সামান্য। তবে একখানা বিস্কুটের প্যাকেট ছিল নতুন। সেটা বের করে সে লোকটার হাতে দিলো। সারাদিন কিছু খায়নি বোধ হয় লোকটা।
প্যাকেটটা পেয়েই দুটো বিস্কুট সামনে ছুঁড়ে দিলো। কোথা থেকে বেশ বড় একটা কালো কুকুর এসে ছোঁ মেরে বিস্কুট মুখে তুলে নিলো। তারপর লোকটাও ঘাটের সিঁড়িতে বসলো। মধুরার দিকে তাকিয়ে হিন্দিতে বললো, ” বড়ি তকলিফ মে হ্যায় ! ” চুপ করে তাকিয়ে ছিল মধুরা। লোকটাও চুপ করে জলের দিকে তাকিয়ে ছিল। মিনিট কয় পর মধুরা উঠে দাঁড়ালো। ফিরতে হবে এবার। লোকটাও উঠে দাঁড়ালো। সটান মধুরার দিকে তাকিয়ে বলল, ” বহুত খতরে মে হো। উও বাচ্চা তুম সব কো খতম করেগা। ” চমকে উঠলো মধুরা। এগিয়ে লোকটার একদম কাছে গিয়ে উদগ্রীব স্বরে বললো , ” কোন বাচ্ছা ? কার কথা বলছেন! ” লোকটা হোহো করে হেসে উঠলো এবার। তারপর বলে উঠলো ,” মানিকর্নিকা কে উত্তর ভাগ মে যা। ওহী তুমে বাচানেওলা মিল জায়েগা ” । বলে আবার হাসছিল হলুদ দাঁত বের করে পাগলাটে লোকটা।
পাশেই কুকুর ডেকে উঠলো খুব জোরে। মুহূর্তের জন্য ফিরে তাকিয়েছিল মধুরা। পরক্ষণেই তাকিয়ে দেখল ঘাটের সিঁড়ি শূন্য। লোকটা যেন মুহূর্তে হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। খানিকক্ষণ হতভম্ভ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো মধুরা। আবার জোরে কুকুর ডেকে উঠতেই তার সম্বিত ফিরলো। ঘাট থেকে বেরিয়ে এসে একটা অটো ধরে কোনোমতে মনিকর্নিকা পৌঁছালো সে। রাতের আঁধার ঘনিয়েছে তখন। এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে বিচিত্র চেহারার সব সাধু , তান্ত্রিক অঘোরীরা । কেউ চোখ বন্ধ করে , কেউ বা গাঁজায় দম দিতে ব্যস্ত। ঘুরতে ঘুরতে একবারে উত্তর দিকে এলো সে। এক সৌম্য কান্তি মধ্যবয়েসী সাধক বসে। গায়ে কালো বস্ত্র। সে কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়ালো । এর কথাই কি বলেছিল ওই লোকটা ! এগিয়ে গিয়ে মাটি ছুঁয়ে প্রনাম করলো সে।
” এই সময় এই জায়গায় কেন মা !” বাংলায় কথা শুনে ভারী অবাক হলো মধুরা। তারপর নিজের পরিচয় দিয়ে সাধককে আদ্যপান্ত খুলে বললো সে। সব শুনে কিছুক্ষন চোখ বন্ধ করে চুপ করে রইলেন শম্ভুনাথ। দুরুদুরু বুকে তার পানে তাকিয়েছিল মধুরা। এই বোধ হয় তার শেষ ভরসা। সে বড় ক্লান্ত অজানা সর্বগ্রাসী শক্তির বিরুদ্ধে ক্রমাগত লড়তে লড়তে। দুটো অসহায় অশক্ত মানুষকে ফেলে তাই আজ সমাধান খুঁজতে বেরোতে হয়েছে তাকে। আনমনা হয়ে ভাবছিল মধুরা। হঠাৎ সম্বিত ফিরলো সাধকের গলার আওয়াজে। মৃদু , ভরাট গলায় বললেন শম্ভুনাথ , ” বহুদিন থেকেই একবার কালীঘাটে যাবো ভাবছিলাম । হয়ে উঠছিলোনা। আজ আদেশ পেয়েছি মা, তোমায় সাহায্য করার আদেশ এসেছে। চলো যাই তোমার সঙ্গে দেখি কি করতে পারি ! তবে আমার ধারণা পরিস্থিতি খুব একটা ভালো নয় । আমি খুব ভালো লক্ষণ বুঝছিনা ।”
দুদিন পর যখন মধুরা শম্ভুনাথকে সঙ্গে নিয়ে তাদের বাড়ির গেট খুলে ঢুকলো তখন সূর্য পশ্চিম আকাশে ঢলতে শুরু করেছে। বাড়িতে ঢুকে ইস্তক শম্ভুনাথ খুব গম্ভীর হয়ে ভ্রু কুঁচকে কিছু ভাবছিলেন। সন্ধে থেকে অদ্ভুত সব ঘটনা শুরু হলো। দোতলার ঘরে কে যেন বাসনপত্র ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলতে লাগলো। সব ঘরের লাইট বিশ্রী ভাবে কাঁপতে শুরু করলো। বাইরের দিকের দুটো বাল্ব সশব্দে ফেটে কাঁচ ছড়িয়ে পড়লো। আর একটু রাত হতেই কে যেন সিঁড়িতে ওঠা নামা করছে মনে হতে লাগলো।
আতঙ্কে মধুরা তার বাবা মা সিঁটিয়ে গেছে। রাত গভীর হতে শম্ভুনাথ মধুরাদের শোয়ার ঘরের মাটিতে আসন পেতে বসলেন। ঘরের আলো নিভিয়ে মোটা একটা লাল মোম জ্বেলে দিলেন। মধুরার চারপাশে একটা গন্ডি দিলেন। তারপর অশ্রুত শব্দে মন্ত্র পড়তে লাগলেন। কিছুক্ষন পর মোমের শিখা অস্বাভাবিক ভাবে কাঁপতে লাগলো। বাইরের দেওয়ালের গায়ে কে যেন নখ দিয়ে আঁচড়াচ্ছে ! গায়ের রক্ত জল করা গজরানি আর সেই খলখল করে বাচ্চার গলার হাসি শুরু হলো। শম্ভুনাথ এক বারের জন্যেও মন্ত্র পড়া থামান নি। দেওয়ালের গায়ে এক মিশমিশে কালো ছায়া ফুটে উঠলো।
বড়জোর ফুট তিনেকের উচ্চতা। ঠিক যেন শিশুর অবয়ব। চোখের জায়গা দুটো টকটকে লাল। তার দাঁত দাঁত পেষার আওয়াজ পরিষ্কার। মন্ত্র থামিয়ে শম্ভুনাথ জিজ্ঞেস করলেন , ” কে তুই ! এখানে কি করছিস !” অপার্থিব আওয়াজ বেরিয়ে এলো তার গলা থেকে। একসঙ্গে যেন দুজন কথা বলছে। ঠিক কথা বলাও নয় , ভয়ঙ্কর একটা গজরানি। যা বোঝা গেল সে বহুদিন এখানে রয়েছে। সবাইকে শেষ করে তবে সে এই জায়গা ছাড়বে। শম্ভুনাথ আবার মেঘের মতো কণ্ঠস্বরে জিজ্ঞেস করলেন কি করলে সে এবাড়ি ছাড়বে। উত্তরে ঘরের মধ্যে যেন তোলপাড় করে ঘুরতে লাগলো সে। খলখল করে হাসতে হাসতে বললো , ” কিছুতেই না। কেউ তাড়াতে পারবিনা । কিছুতেই না। ”
কিছুক্ষন পর উধাও হলো সেই ছায়ামূর্তি। শম্ভুনাথ উঠে সারা বাড়িতে সাদা সাদা গুঁড়ো কিছু ছড়িয়ে দিলেন মন্ত্রোচ্চারণের সঙ্গে। তারপর আবার আসনে এসে বসলেন। তার মুখ অসম্ভব গম্ভীর। তিনি মধুরাকে বললেন , ” কিছু বুঝলে মা ?” মধুরা অসহায় ভাবে ঘাড় নাড়লো। তার মাথা কাজ করছিলোনা। শম্ভুনাথ বললেন তোমাদের এই ভিটেতে কাচ্চা কালুয়া বহুদিন আগেই প্রবেশ করেছে মা। বলা ভালো এই বংশকে শেষ করার জন্যে কোনো তান্ত্রিক ধরে কেউ তাকে এখানে পাঠিয়েছে। তাই এবাড়িতে একের পর এক মৃত্যু আর দুর্ঘটনা হয়েছে। একে সরানো বড় কঠিন। মধুরা হতবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, “কিন্তু কাচ্চা কালুয়া কি ? ” মৃদু হাসলেন শম্ভুনাথ। তারপর বললেন , ” ছোট বালক যদি অপঘাতে মারা যায় তার আত্মা অকালে জীবন ছেড়ে যাওয়ার ক্ষোভে শান্তি বা মুক্তি পায় না মা। সে তখন প্রেতাত্মা রূপে ঘুরতে থাকে।
এ ধরণের আত্মা অতি শক্তিশালী আর ক্ষতিকারক হয়। তার ওপর যদি সে কোনো দুষ্ট তান্ত্রিকের পাল্লায় পড়ে সে তাকে মুক্তির লোভ দেখিয়ে বহু অপকর্ম করিয়ে নেয়। ” একটু থামলেন শম্ভুনাথ। তারপর আবার বললেন , “তোমাদের বাড়িতেও তোমার পিতামহের কোনো শত্রু তোমাদের শেষ করে দেওয়ার উদ্দেশ্যে কাউকে ধরে একে পাঠিয়েছিল। এ কোন সাধারণ প্রেত নয় তাই শুধু হোম বা যজ্ঞ , পুজো পাঠ করে এর নিবারণ হবেনা। এর বিশেষ পদ্ধতি আছে। ” মধুরা শম্ভুনাথের দুটি পা আঁকড়ে ধরলো , ” বাবা বাঁচান আমাদের। দয়া করুন । ” হাঁহাঁ করে উঠলেন শম্ভুনাথ, ” আহা ও কি ! তোমাকে সাহায্য করার আদেশ পেয়েছি বলেই তো এত দূর আসা।”
পরদিন তিনি নিজে বাজারে গিয়ে দুটো কালো ধূসর মেশানো পায়রা আরো কিছু সামগ্রী কিনে আনলেন। নানা উপাচারে কিছু ক্রিয়া করে মধুরাকে বললেন , ” এই ধরণের প্রেতকে রক্ত দিতে হয় মা। আমাকে এই পায়রা ওর উদ্দেশ্যে বলি দিতে হবে। ” পায়রাগুলির মাথা ছিন্ন করে রাখলেন বাগানের একটা নির্দিষ্ট গাছের তলায়। তারপর সেখানে বসে মন্ত্র পড়তে পড়তে জোরে জোরে বললেন , ” নে মাসান তোর ভোগ দিলাম। গ্রহণ কর। তবে গ্রহণ করার পর আর তোর এখানে ঠাঁই হবে না। আর যদি স্বেচ্ছায় না যাস তবে তোকে কি করে জব্দ করতে হয় তাও জানি আমি। ” ঝড় উঠলো যেন বাগানে।
বাড়ির দোতলার বারান্দায় ঘর থেকে ছুঁড়ে বাসনপত্র ফেলতে লাগলো । কালো একটা বলের আকৃতি গোল হয়ে গড়াতে লাগলো। তারপরেই সেটা যেন একটা আগুনের গোলা হয়ে এদিক সেদিক ছিটকে ঘুরতে শুরু করলো। বাইরের প্রকৃতি তখন শান্ত । শুধু এই বাড়ির ভেতরে কি এক তান্ডব শুরু হয়ে গেল। একবারের জন্যেও মন্ত্র পাঠ থামাননি শম্ভুনাথ। একটা ঘট থেকে জল ছেটাতে লাগলেন তিনি আগুনের গোলাটার দিকে। ওখানেই পায়রার দেহ রেখে মধুরাকে নিয়ে ঘরে ফিরে এসে আসনে বসলেন তিনি। বাগানে শন শন করে একটা পাগল হাওয়া বইতে লাগলো। কিন্তু পায়রার শরীরটা কেউ ছুঁলো না। শম্ভুনাথ ও একটু চিন্তায় আছেন মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছিল। শেষমেষ ভোরের দিকে যেন বাগানের গাছপালা আছড়ে পড়তে লাগলো। কার তীব্র আক্রোশ যেন মাথা কুটে কুটে মরছে সেখানে।
শম্ভুনাথ এক ভাবে চোখ বন্ধ করে জপ করে যাচ্ছিলেন। ভোর হলে বাগানে গিয়ে দেখা গেল পায়রার শরীর নেই। কাচ্চা কালুয়া ভোগ নিয়েছে তাহলে ! স্বস্তির শ্বাস ফেললেন শম্ভুনাথ। তবে কাজ তখনও শেষ হয়নি। তাঁর নির্দেশে মধুরা ওই গাছের তলায় মাটি বেশ খানিকটা খুঁড়লো, আর সেখান থেকে বেরিয়ে এলো এক বহু পুরোনো শিশুর হাতের হাড়। ” এটা পুঁতেই কাজ করা হয়েছিল ” বললেন তিনি। এর সৎকার যতক্ষন না করা হবে ততক্ষণ ওই মাসান তার প্রেত যোনি থেকে মুক্তি পাবেনা । আর তার মুক্তি না হলে সে তার প্রতিশোধপরায়নতাদিয়ে মানুষের ক্ষতি করেই যাবে । এই পুঁতে রাখা হাড়টার টানে এই বাড়ি ছাড়তে পারছেনা ওই প্রেত। মধুরা আর শম্ভুনাথ স্থানীয় শ্মশানে গিয়ে হাড়টির যথাবিহিত সৎকার যখন করছেন তখন আঁধার ঘনিয়ে এসেছে।
মধুরা নদীতে ভস্ম ভাসিয়ে দিলো। শম্ভুনাথ তখন মন্দ্র কণ্ঠে পাঠ করছেন ,” মধুঋতা বাতায়তে , মধু ক্ষরন্তি সিন্ধব। মধুরাও ফিসফিস করে বলছিল , ‘ দীর্ঘ দিন পর আজ মুক্তি হোক তোমার। আলোর পথে নতুন জীবন লাভ করো ।” হঠাৎ যেন তার মনে হলো নদীর মধ্যে থেকে একটা নীল আলোর বল লাফিয়ে উঠলো ভেসে চললো উপরে আকাশ পানে । শীতল একটা বাতাস পাক খেয়ে খেয়ে ছোট্ট একটা ঘূর্ণি তুলে নদীর জলে পাক খেতে খেতে মিলিয়ে গেল মোহনার পানে। শরীরটা বড় হালকা হয়ে যাচ্ছিল মধুরার ।
এক বছর কেটে গেছে । আজ দীপাবলি। আলোর উৎসব। বহুদিন পর মিশ্র বাড়ি আজ আলোয় সেজেছে। মধুরা একটা বেশ ভালো চাকরির পরীক্ষায় সফল হয়ে এখন চাকরি করছে। বাড়ির সেই বিষন্ন ভাবটা আর নেই। তার মাও দীর্ঘদিন চিকিৎসার পর হঠাৎ একটু সাড়া দিতে শুরু করেছেন । প্রেত মুক্তি ঘটেছে এই বাড়ির। আলোর উৎসবে বিশ্ব সংসারের মতো মেতে উঠেছে এ বাড়িও , বহু বহুদিন পর। আজকের আলোর ধারায় আলোকিত হয়ে আপাত বোঝা যায়না। তবু ওরা আছে। আমাদের সাথেই ওদেরও সহাবস্থান। আজও কখনো কখনো ওরা আসে বৈকি , ভাবছিল মধুরা তাদের আলোকিত বাড়ির দিকে চেয়ে চেয়ে।