টান

টান

ভোর রাতের দিকে কি একটা স্বপ্ন দেখে ঘুম টা ভেঙে গেল আদিত্যর। মা যেন ওর পাশে দাঁড়িয়ে আছে। এক মুখ হাসি নিয়ে কোথাও যেন যাবার কথা বলছে মা। ঘুম ভাঙার পর থেকেই তীব্র অস্বস্তি তে ছেয়ে রয়েছে মনটা। কোথায় যাবে মা! মুখ ধুয়ে এসে নিজেই এককাপ চা করে নিয়ে ব্যালকনি তে এসে বসল আদিত্য। কাপের চা টা শেষ হবার আগেই ঠিক করে ফেলল, আজই যেতে হবে কাটোয়ার বাড়িতে। অনেক দিন দেখা হয়নি মায়ের সঙ্গে। দরকার হলে মাকে এখানেই এনে রাখবে কিছুদিন। প্রীতি হয়তো অসন্তুষ্ট হবে তাতে। কিন্তু সেসবে কান দিলে চলবে না। মায়ের তো সত্যিই ও ছাড়া আর কেউ নেই। সেকি! আজ কাটোয়া যাবে বলোনি তো আমায়! প্রীতি অবাক । বিষন্ন স্বরে আদিত্য বলে, শেষ রাতে এমন একটা স্বপ্ন দেখলাম, মনটা খারাপ লাগছে। যাই, একটু দেখেই আসি মাকে।

অবাক হয়েছে প্রীতি, একটু অসন্তুষ্টও। বলে, আজই যাবে? গাড়ি টা তো আজ আমার লাগবে। বুবলুর স্কুলবাস আজ আসবে না। কিসব কারণে ওরা যেন ধর্মঘট করেছে। শান্ত গলায় আদিত্য বলল, বেশ তো। আমি ট্রেনে চলে যাচ্ছি। নিশ্চিন্ত হয় প্রীতি। যাক, মানুষটাকে আর এখানে এনে তুলতে পারবে না আদিত্য। আর যাই হোক, ট্রেনে করে বুড়ি টা এখানে আসতে পারবে না। চোখে মুখে ফুটে বেরোনো উচ্ছাসটাকে চাপা দিতে আপন মনে বকবক করতে থাকে প্রীতি, কিসের যে এত ধর্মঘট বুঝি না বাবা। নিজেরা লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি চালাবে, গাড়ি গুলোর ঠিক মত দেখাশোনা করবে না, আর কেউ কিছু বললেই ব্যাস। হয়ে গেল ধর্মঘট।

খুব ভোরেই বেরিয়ে পড়েছিল আদিত্য। তাড়াতাড়ি ই পৌঁছে গেল আপনজনের গন্ধ মাখা গ্রামটায়। ওই তো সেই পুকুর টা, রোদ পড়ে জলটা কেমন চিকচিক করছে। মস্ত বড় তেঁতুল গাছটা বাড়ির সামনেটায় ছায়া ফেলে রেখেছে। সদর দরজায় দাঁড়িয়ে কড়াটা নাড়তে যাচ্ছিল আদিত্য। তার আগেই খুলে গেল দরজা টা। ওমা! আদি! কেমন আছিস বাবা? আয়। ভেতরে আয়। কদিন থেকেই তোদের দেখতে খুব ইচ্ছে করছিল। চোখ দুটো ছলছল করে উঠল বৃদ্ধার। মাকে জড়িয়ে ধরে আদিত্য বলে, এই তো চলে এলাম দেখো, একেই বলে নাড়ীর টান। আচ্ছা, কারোকে দিয়ে আমাদের ফোন করাতে পারতে তো। অভিমানী মুখে বৃদ্ধা বলে, ধ্যেৎ! ওই ফোননাম্বার টা দিয়ে কিছুই হয় না। ওই নম্বরে ফোন করলেই কিসব যেন বলতে থাকে। আদিত্য বলে, কই, দেখাও তো আমাকে নাম্বার টা। বৃদ্ধা বলে, সে এখন কোথায় আছে কে জানে! ছাড় তো ওসব কথা। আগে তোর জন্য একটু জলখাবার নিয়ে আসি। আজকেই তো চলে যাবি তুই। ওদিকে ফিরতে দেরি হলে বৌমা আবার চিন্তা করবে।

মায়ের চৌকিটার ওপরে চোখ বন্ধ করে শুয়ে ছিল আদিত্য। কত কথা মনে পড়ে যাচ্ছে এখন। সেই হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করার পর কলকাতায় আসা। এখানেই উচ্চশিক্ষা, এখানেই চাকরি। বিয়ের পর প্রীতির ইচ্ছায় কলকাতায় ফ্ল্যাট কেনা। প্রীতি এখানে যতটা স্বচ্ছন্দ, মা ততটা নয়। তাই গ্রামের বাড়িতে ই থাকে মা। একেবারেই একলা ঠিক বলা যায় না। পাশেই রয়েছে বাবার খুড়তুতো ভাই সোনাকাকার পরিবার। ওরা মাকে বেশ ভালবাসে। দরকারে – অদরকারে খোঁজ খবর নেয়। আর এখানকার মানুষজন খুব ভালো। মাকে এখানে রেখে একপ্রকার নিশ্চিন্তই আছে আদিত্য।
নে বাবা ওঠ, খেয়ে নে তো এটুকু। গরম গরম মোহনভোগের বাটি নিয়ে এসে আদিত্যর সামনে রাখেন বৃদ্ধা। চোখে জল আসে আদিত্যর। মা। এখনো মনে রেখেছো, মোহনভোগ আমার কত প্রিয়। আদিত্যর মাথায় সস্নেহে হাত বোলাতে থাকেন বৃদ্ধা। খাওয়ার পর ঘর থেকে বেরিয়ে আসে আদিত্য। মা। একটু সোনাকাকাদের বাড়ি থেকে ঘুরে আসছি।

আচ্ছা। আয় বাবা। তাড়াতাড়ি ফিরিস। আমি অপেক্ষা করব তোর জন্য। সদর দরজা টা বাইরে থেকে টেনে দিয়ে দু পা এগোতেই দেখা হয়ে গেল সোনা কাকার সাথে। কিন্তু এ কি চেহারা হয়েছে মানুষটার। মাথার চুলগুলো কেমন উস্কোখুস্কো, চোখদুটো লাল টকটক করছে। যেন কত রাত ঘুমোয়নি। কি হয়েছে সোনাকাকা? তোমার কি শরীর খারাপ? ওকে দেখে হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলেন সোনাকাকা। যাবার সময় তোর খুব নাম করছিল রে মানুষ টা। সেই এলি, অথচ। কথকথা টা শেষ করতে পারেন না সোনাকাকা। বুঝতে পারে না আদিত্য, কার কথা বলছো তুমি।

ওরে, তোর মারে, তোর মা। সে যে চলে গেল। আজ ভোর রাতে। বিস্ময়ের অভিঘাতে পাথর হয়ে যায় আদিত্য, মা আর নেই! তাহলে বাড়িতে কে। কথাটা শেষ করতে দেন না সোনা কাকা, বাড়ি তে এখন কেউ নেই। তোদের সাথে ফোনে যোগাযোগ করা যায়না। কি একটা ফোন নাম্বার দিয়েছিস। তাই ভোরবেলায় দুটো ছেলেকে পাঠালাম তোদের খবর দেওয়ার জন্য। সোনাকাকার কথা গুলো ওর কানে আর ঢুকছিল না। শুধু মনে পড়ছিল একটু আগের সেই স্নেহের পরশ, শিরা বের করা হাতে গরম মোহনভোগের বাটি এগিয়ে দেওয়া! দূর থেকেই নিজের গাড়িটা দেখতে পেয়েছিল আদিত্য। তার মানে প্রীতি আসছে। ছেলে দুটোর কাছ থেকে খবর পেয়েই বেরিয়ে পড়েছে। শান্ত ভাবে সোনাকাকার কাছ থেকে ফোন নাম্বার টা চাইল আদিত্য। প্রীতি তখন ওর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। পকেট থেকে কাগজের টুকরো টা বের করে ওর হাতে দিলেন সোনাকাকা।।

একঝলক দেখল আদিত্য। প্রীতির হাতের লেখা। মাকে ও ভুল ফোন নাম্বার লিখে দিয়েছিল, মা যাতে এখানে ফোন করতে না পারে। একটা মানুষ আর একটা মানুষ কে কতটা অপছন্দ করলে এরকম করতে পারে! ছিঃ। চিতায় অগ্নি সংযোগ করার আগে আর একবার মায়ের মুখটা ভালো করে দেখে নিল আদিত্য। এই তো সেই স্নেহমাখামুখ, স্বপ্নে এই মুখই তো দেখেছিল। আর সহ্য করতে পারে না আদিত্য।হাউ হাউ করে কেঁদে ওঠে। ক্ষমা করো মা। সব দোষ ক্ষমা করো। দাউদাউ করে জ্বলে উঠেছে চিতাগ্নি। ওখান থেকে সরে যাবার আগে চোখ মুছে আর একবার তাকায় আদিত্য। আর তখনই চোখে পড়ে, অসহ্য আগুনের মধ্যে মায়ের ডান হাত খানা আশির্বাদে ভঙ্গিতে উঁচু হয়ে আছে। দোলা ভট্টাচার্য।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত