বেওয়ারিশের শ্মশান

বেওয়ারিশের শ্মশান

সেদিন দুপুরে দুটো নাগাদ খবর টা পেল দীপ। উমা কাকিমা মারা গিয়েছেন। দীপ দের বাবারা চার ভাই। তার মধ্যে দীপের বাবা স্বপন বাবু থাকেন পরিবার নিয়ে কোলকাতায়। তিনিই সবার মধ্যে বড়ো। মেজো আর সেজো দুই কাকার মধ্যে একজন থাকেন মুম্বাই আর অপরজন থাকেন কানাডা। একমাত্র নিঃসন্তান ছোট কাকা সুজয় বাবুই স্ত্রী উমা কে নিয়ে চলে গিয়েছিলেন বেথুয়াডহরির ভেতরে এক গ্রামে। কারন সুজয় বাবুর বিয়ের মাস ছয়েক পরেই তাঁর চাকরি চলে যায়। লকআউট হয় তাঁর কোম্পানিতে।

ওদিকে ওনার শ্বশুর বাড়িতে শ্বশুর শ্বাশুড়ি কে দেখার কেউ ছিল না। কারন উমা ছিলেন একমাত্র মেয়ে। তাঁর ছোটভাই মাত্র বারো বছর বয়সে মারা গিয়েছিলেন। সেই কারনে চাকরি চলে যাওয়ার পর কিছুদিন এদিকে ওদিকে চাকরির চেষ্টা করে না পেয়ে আর অপেক্ষা করেননি সুজয় বাবু । শ্বশুরের ব‍্যবসা দেখবেন এই সিদ্ধান্ত নিয়ে স্ত্রী কে নিয়ে পাকাপাকি ভাবে চলে গিয়েছিলেন বেথুয়াডহরি ।

সেই উমা কাকিমার মৃত্যুর খবর এলো হঠাৎ সেদিন দুপুর দুটোয়। অসুস্থ ছিলেন বেশ কিছুদিন ধরেই। সুগার ছিল। ভালো চিকিৎসার অভাবে কিডনি খারাপ হয়ে গিয়েছিল। তাই ওনার মৃত্যু কোন অপ্রত্যাশিত ঘটনা নয়। কিন্তু সমস্যা যেটা হোল সেটা হোল , নিঃসন্তান ছোটকাকা মৃতদেহ আগলে বাড়িতে একা। শ্বশুর শ্বাশুড়ি মারা গিয়েছেন বহুদিন। তিনি নিজেও বৃদ্ধ হয়েছেন। এখন দীপ ছাড়া উমা কাকিমার শেষকৃত্য সম্পন্ন করার লোক নেই। কাকিমা মারা গিয়েছেন সকাল ছয়টায় । দীপ যখন খবর পেলো তখন বেলা দুটো। দীপ ছিলো অফিসে। সবকিছু ঠিকঠাক করে যখন অফিস থেকে বেরোলো তখন বেলা প্রায় তিনটে । অফিস থেকে বেরোনোর সময় বন্ধু সুকান্ত কে ফোন করলো দীপ। ওর সাথে যাওয়ার জন্য। সুকান্ত এক কথায় রাজি। খালি বলল ” তুই এগো আমি পরে ট্রেন ধরে আসছি।”

শিয়ালদহ থেকে ট্রেনে বেথুয়াডহরি পৌঁছতে প্রায় সন্ধ্যা সাতটা বেজে গেল। স্টেশনে নেমে আরও প্রায় দেড় দুই মাইল পাটুলি গ্রাম। এখানে এর আগে আসেনি দীপ। যা যোগাযোগ রাখার ছোট কাকু আর উমা কাকিমাই রাখতেন, মাঝে মাঝে কোলকাতায় গিয়ে। সেই কারনে এই অঞ্চলে দীপের আসা এই প্রথম। টোটো করে ছোট কাকার বাড়িতে গিয়ে দীপ যখন পৌঁছল তখন বাজে প্রায় সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা। একেবারে অজ গ্রাম বললেই চলে। চারিদিকে এর মধ্যেই নিঝুম অন্ধকার। টোটো চালক জানালো লোডশেডিং আজ সারাদিন। গোটা গ্রাম যেন এর মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়েছে। যাওয়ার পথে টিমটিমে লম্ফ জ্বালা ছোটখাটো দোকান ছাড়া আর তেমন কিছু চোখে পড়লো না।

কাকার বাড়িতে যখন পৌঁছল দীপ তখন বৃদ্ধ মানুষটি মৃতদেহ আগলে উঠোনে বসেছিলেন। তাঁর সামনে বসেছিলেন দুজন ভদ্রমহিলা। দীপ বুঝতে পারলো তাঁরা আশেপাশের বাড়ি থেকেই এসেছেন। উঠোনের দুদিকে শুধু দুটো লন্ঠন জ্বলছে। তার আলোতে বৃদ্ধ মানুষটি প্রথমে দীপ কে চিনতে পারেননি। ওকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন , ” কে ?” দীপ পরিচয় দিতে বললেন, ” অনেক দেরি করে এলি দীপ। আজ প্রথমবার এখানে এলি । যে তোকে আদর করে বসিয়ে যত্ন করে খাওয়াতো সেই আজ নেই।” বৃদ্ধের কন্ঠস্বর যেন হাহাকার করে উঠলো। ওঁকে সান্ত্বনা দিল দীপ, ” তুমি একটু শান্ত হও ছোট কাকা। আমি যখন এসে পড়েছি তখন আমার ওপর ছেড়ে দাও। আগে দেখি কাকিমার শেষ কাজ গুলো কত তাড়াতাড়ি করা যায়।” ” দীপ তোর কাকিমার ডেথ সার্টিফিকেট কিন্তু নেওয়া হয়নি। কারন ডাক্তার পাওয়া যায়নি।”

অনেক খুঁজে ঘন্টা খানেক পর একজন হোমিওপ্যাথি ডাক্তার কে নিয়ে ফিরল দীপ। কাকিমা অনেকদিন ধরেই ভুগছিলেন। সুগারের জন্য অনেক রকম সমস্যা হয়েছিল। দেখা গেল ডাক্তার বাবু সে বিষয়ে অবগত আছেন। মোটামুটিভাবে মৃতদেহ দেখে একটা ডেথ সার্টিফিকেট চট করে লিখে দিয়ে বললেন, ” উনি মারা গিয়েছেন সেই সকালে। অনেকক্ষণের মড়া। বরফ দেওয়া নেই। তাড়াতাড়ি আজ রাতেই পুড়িয়ে দিন। নাহলে কিন্তু গন্ধ বেরোবে।”

কিন্তু গোল বাধলো এরপর। তখনই বেজে গিয়েছিল রাত নটা। পাটুলি তে সেটা অনেক রাত। এমন কোন লোক পাওয়া গেল না যে মড়া পোড়াতে শ্মশানে যাবে। তার ওপরে সেদিন ছিল ঘোর অমাবস্যা। সাধ‍্য সাধনা করেও কাউকে রাজি করানো গেল না। সবথেকে বড় বিপদ মূল শ্মশান পাটুলি গ্রাম থেকে অনেক দুরে। এতরাতে সেখানে যাবেটাই বা কে ? ওদিকে দীপ পুরো একা। সুকান্ত এখনও এসে পৌঁছায়নি। ফোনেও বলছে ‘পরিষেবা সীমার বাইরে।’
কোলকাতা শহরের ছেলে দীপ। কোন অজ পাড়াগাঁয়ে নিছক একা এসে এমন বিপদে সে কোনদিন পড়েনি। মাঝখানে মা দুবার ফোন করেছিলেন। এখানকার অবস্থা শুনে দীপ কে দুম করে একা একা এখানে পাঠানোর জন্য আফশোষ করলেন। কিন্তু দীপের সমস্যা তাতে কমলো না।

অবশেষে দীপ কে একটা পরামর্শ দিলেন ঐ হোমিওপ্যাথি ডাক্তার বাবু। এতক্ষণ দীপের সঙ্গে ছিলেন। বললেন,
” আপনি একটা কাজ করতে পারেন। এখান থেকে দুই মাইল দুরে আরও গ্রামের ভেতর একটা শ্মশান আছে। যেখানে বেওয়ারিশ মড়া পোড়ানো হয়। সেখানে গিয়ে পোড়াতে পারেন। তবে সাবধান জায়গা টা কিন্তু ভালো নয়। অনেক বদনাম আছে। আর ওখানে কোন বার্নিং ঘাট সার্টিফিকেট পাবেন না। কারন অফিস বলতে কিছু নেই। কোন ডোম ও নেই কিন্তু। যা করার নিজেদেরই করে নিতে হয়। ” বলে চলে যাচ্ছিলেন। কিন্তু হঠাৎ থমকে গিয়ে বিড়বিড় করে বললেন, ” কিন্তু আজ আবার অমাবস্যা। তার ওপরে আপনি একা। আপনি মড়া নিয়ে অতদুর যাবেন কি করে ?” দীপ চুপচাপ হয়ে গিয়েছিল । এবার অধৈর্য্য হয়ে গেল। ” তাহলে এখন কি করি ডাক্তার বাবু ?” এমন সময় দুর থেকে একটা ভ‍্যান রিক্সা চালিয়ে একজন ভ‍্যান রিক্সা চালক কে আসতে দেখা গেল। দীপের মাথায় হঠাৎ কি খেলে গেল হাত দেখিয়ে দাঁড় করালো লোকটাকে।

লোকটাকে সব বুঝিয়ে বলাতে , দীপের সঙ্গে মড়া নিয়ে শ্মশানে যেতে রাজি হয়ে গেল লোকটা। যদিও টাকা চাইলো অনেক। ডাক্তার বাবু দাঁড়িয়ে সব দেখছিলেন। এবার বললেন, ” ওখানে গিয়ে ভয় কিন্তু পাবেন না। কারন জায়গা টা নির্জন, তার ওপরে চারপাশে জঙ্গল। আশেপাশে কোন জনবসতি দুরে থাক, আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র কেনার দোকানপাট ও পাবেন না। আর একটা ঘটনা ওখানে গিয়ে দেখতে পাবেন। অনেক নিভে যাওয়া চিতায় আধপোড়া মড়া। ওখানে যারা পোড়ে তারা তো সকলেই দূর্ভাগা। তাদের সঙ্গের লোকজন অনেক সময় তাদের ভালো করে না পুড়িয়েই চলে যায়। ওগুলো দেখে ভয় বা ঘেন্না পাবেন না।” এইকথা বলে ডাক্তার বাবু হনহন করে চলে গেলেন।

ভ‍্যান ওয়ালা কে নিয়ে ছোট কাকার বাড়িতে চলে এলো দীপ। বৃদ্ধ কিন্তু যেই শুনলেন তখনই দীপ কে বারন করলেন।
” আমি শুধু এইভাবে ভ‍্যান ওয়ালার ওপর ভরসা করে তোকে যেতে দিতে পারিনা। কারন আজ একে অমাবস্যা তার ওপরে একটু আগে পুরোহিত মশাই এসেছিলেন। উনি বললেন উমা ত্রিপাদ দোষ পেয়েছে। তাছাড়া ঐ শ্মশানটার অনেক বদনাম ও আছে। আজকে ছেড়ে দে। কালকে খুব ভোরে কোন ব্যবস্থা করা যাবে।” কিন্তু দীপ কে কাল কোলকাতায় ফিরতেই হবে।‌ তার ইচ্ছে আজকেই যা হবার হয়ে যাক। সে কিছুতেই সুজয় বাবুর কথায় রাজি হোল না।

ভ‍্যান ওয়ালা ছেলেটার নাম বাপী। ছেলেটা খুব ভালো। উমা দেবীর মৃতদেহ ভ‍্যানে তোলার থেকে শুরু করে কি কি শ্মশানে লাগবে সবকিছু তথ্য দিয়ে খুব সাহায্য করলো দীপ কে। সবকিছু গুছিয়ে মৃতদেহ ভ‍্যানে তুলে ওরা যখন রওনা হোল তখন রাত প্রায় দশটা। অমাবস্যার রাত। তায় পথেঘাটে আলো নেই। রাস্তার হাল ও ভালো নয়। কাকার বাড়ির থেকে একটা লন্ঠন জ্বালিয়ে এনেছিল দীপ। তার আলোতে ভরসা করেই পথ চলতে হচ্ছিল। কাকিমার মড়ার গা থেকে কেমন একটা আঁশটে গন্ধ বেরোচ্ছিল। সেই গন্ধ নাকে গিয়ে গা গুলিয়ে উঠছিল দীপের। কিছুদুর যাওয়ার পর একটা ছেলে হাত দেখিয়ে ভ‍্যানটাকে থামালো,

” দাদা সঙ্গে মড়া দেখছি, শ্মশানে যাচ্ছেন ?” বাপী ছেলেটাকে দেখে ভ‍্যান থামিয়ে দিয়েছিল।

” হ‍্যাঁ আমরা শ্মশানেই যাচ্ছি। কিন্তু আপনি কি শ্মশানে যাবেন নাকি ?”
” হ‍্যাঁ দাদা ওদিকেই যাব।”

ছেলেটা উঠে পড়লো ভ‍্যানে। ডায়াবেটিস রোগীর মড়া, তার ওপরে নানা ধরনের রোগে আক্রান্ত। উমা দেবীর শরীর শুকিয়ে ছোট্ট হয়ে গিয়েছিল। তাই ছেলেটার বসার কোন অসুবিধা হোল না। ছেলেটা উঠে বসার পর বাপী চালানোর গতি বাড়িয়ে দিয়েছিল। এমনিতেই মোটর লাগানো ভ‍্যান। সেটা চলছিল যেন হাওয়ার গতিতে। তবুও পথ যেন আর ফুরোয় না। একঘেয়েমি কাটাতে দীপ ছেলেটার সঙ্গে কথা বলতে শুরু করল।

” দাদা আপনার নাম টা তো জানা হোল না।”
” আমার নাম খেমো। আমাকে এখানে সবাই এই নামেই চেনে। আপনার নাম টা ?”
” দীপ। তা আপনি ওদিকে যাচ্ছেন কি মনে করে ?”
” হাঃ হাঃ হাঃ। ভালো কথাই জিজ্ঞেস করেছেন।

আসলে আমার এক বন্ধু খুন হয়েছিল গতকাল। পলিটিক্যাল মার্ডার। তাই ওর পোস্টমর্টেম ও হয়নি কোন কেস ও হয়নি। সৎকারের জন্য ঠাঁই হয়েছিল এই শ্মশানে। কিন্তু যারা পোড়াতে নিয়ে গিয়েছিল তারা ওর দেহ টা ওখানেই ফেলে রেখেই পালিয়েছে। আমি ও শ্মশানযাত্রী দের সঙ্গে গিয়েছিলাম। সবাই হঠাৎ করে চলে আসায় আমি ও চলে আসি। কিন্তু মনে হোল শেষ সৎকার টা হবেনা দেহটার ? এই ভাবতে ভাবতেই দেখলাম আপনারা ওদিকে যাচ্ছেন। তাই ভাবলাম আপনাদের সঙ্গে ফিরে যাই ওখানে। যদি কাজটা সেরে আসতে পারি।”

কথা বলতে বলতেই হঠাৎ গাড়ি থেমে যাওয়াতে চমকে উঠলো দীপ। খেমো গাড়ি থেকে নেমে পড়ে বলল, ” নামুন শ্মশান এসে গেছে। ” শ্মশানের পরিস্থিতি দেখে শিউরে উঠলো দীপ। চারিদিকে নিশ্ছিদ্র কালো অন্ধকার। আশেপাশে ঘন জঙ্গল। তার মাঝখানে মাঠের মতো কিছুটা জমি নদীর ধারে। এই হোল শ্মশান। মাঝে মাঝে দুর থেকে শিয়ালের ডাক শোনা যাচ্ছে। ওরা তিনজন ছাড়া জন মানুষের চিহ্ন মাত্র নেই।

তিনজনে মিলে ধরাধরি করে উমা দেবীর মড়া নামাতে কোন বেগ পেতে হোল না। এরপর এলো চিতা সাজানোর প্রশ্ন। দীপ আগাগোড়া মড়া ছুঁয়ে এসেছে। তাই ওকে মৃতদেহের কাছে বসিয়ে রেখে, বাপী আর খেমো গেল জঙ্গলের ভেতর কাঠের ব্যবস্থা করতে। চলে যাবার আগে খেমো দীপ কে একটু দুরে রাখা সাদা কাপড় ঢাকা একটা মৃতদেহ দেখালো। ” ঐ যে আমার বন্ধুর মৃতদেহ।” এছাড়াও আরও একটু দুরে একটা চিতায় যে আর একটা মৃতদেহ রয়েছে সেটা দীপ আগেই দেখেছিল। খেমো আর বাপী যাবার আগে দীপ কে বারবার বলে গেল যাই ঘটুক দীপ যেন ভয় না পায়। এখানে ভয় পেলে বিপদ আছে।

ওরা চলে যাবার পর নৈঃশব্দ্য দীপ কে আরও চেপে ধরলো। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে অন্ধকার। একমাত্র লন্ঠন টা ওরা নিয়ে গেছে। তার ওপরে আজ অমাবস্যা। চারিদিকে কোথাও যেন প্রাণের অস্তিত্ব নেই। হঠাৎ চারপাশের নৈঃশব্দ্য খানখান করে দিয়ে জঙ্গলের ভেতর থেকে একটা বিকট হাড়হিম করা চিৎকার শোনা গেল। একটা নয় অনেক গুলো স্বর একসাথে। কারা যেন সমস্বরে আর্ত চিৎকার করছে। ” জল, জল। আগুন দাও মুক্তি দাও।” এই চিৎকার শুনে দীপের বুক হিম হয়ে গেল। কিন্তু ভয় পাওয়া আজ মানা। তাই দীপ সাহস করে বসে রইল। কিন্তু চিৎকার কিছুতেই থামেনা। দীপ ভাবলো উঠে গিয়ে একবার জঙ্গলের ভেতর ঢুকে দেখে আসে ব‍্যাপারটা কি ! এমন সময় কাছাকাছি কেউ বলে উঠলো,

” আমার মুখে আগুন না দিয়ে যাবেন না দাদা। ” চমকে উঠে ঘুরে তাকিয়ে স্তম্ভিত হয়ে গেল দীপ। খেমোর বন্ধুর মড়া টা খাটের ওপর উঠে বসেছে। মুখ টা সাদা কাপড় দিয়ে ঢাকা। এবার মুখ থেকে সাদা কাপড় টা সরিয়ে নিল মড়া টা। দীপ হতবাক হয়ে দেখল ওটা আর কেউ না খেমো। চিৎকার করতে গিয়েও থেমে গেল দীপ। আজ তার ভয় পাওয়া মানা। এমন সময় বাপী চলে এলো । দীপ বললো,

” বাপী খেমো মানুষ নয়। ও একটা মড়া।”
” আর ওপাশের আধপোড়া মড়া টা ?”

দীপ সভয়ে দেখল ওপাশের আধপোড়া মড়া টাও উঠে দীপের দিকে এগিয়ে আসছে। এবার আর্ত চিৎকার করে উঠলো দীপ। কারন ঐ মড়া টা আর কারোর না, বাপীর। দীপ বুঝতে পারলো তার সামনে ভয়ানক বিপদ। আর এখানে নয়। দীপ ছুটে পালাতে যাবে এমন সময় উমা কাকিমা উঠে একটা হাত দিয়ে দীপের একটা হাত চেপে ধরলেন। কি কনকনে ঠাণ্ডা সেই হাত। ” চলে যাচ্ছিস কোথায় দীপ। তুই ও আমাদের দলে চলে আয়।” কিরকম একটা অদ্ভুত বিকট দৃষ্টি দিয়ে উনি দীপের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। মুখে কেমন একটা হাসি আর চোখের তারা দুটো স্থির। দীপের হঠাৎ মনে হোল এ উমা কাকিমা নয়। এ অন‍্য কেউ।

দীপের দেওয়া ঠিকানা ধরে খুঁজে খুঁজে সুকান্ত যখন সুজয় বাবুর বাড়িতে পৌঁছল তখন রাত প্রায় এগারোটা । বৃদ্ধ বাড়িতে একাই ছিলেন। তাঁর কাছ থেকে শ্মশানের রাস্তা জেনে সাথে সাথেই যে টোটো স্টেশন থেকে ধরেছিল তাকে নিয়ে শ্মশানের পথে রওনা হোল সুকান্ত। শ্মশান ওখান থেকে অনেক দূরে। ঐ রাতে ঐ অন্ধকারে টোটো ওয়ালা পুরো রাস্তা যেতে রাজি হোল না। মাঝ রাস্তায় এক জায়গায় সুকান্ত কে নামিয়ে দিয়ে টাকা বুঝে নিয়ে সে ফিরে গেল তার বাড়ি। ঐ ঘন অন্ধকারে জঙ্গলাকীর্ণ পথে কিভাবে শ্মশানের দিকে এগোবে টোটো থেকে নেমে তাই ভাবছিল সুকান্ত। এমন সময় দুর থেকে একটা ভ‍্যান রিক্সা আসতে দেখা গেল। ভ‍্যান চালক সুকান্তর সামনে এসে গাড়ি থামিয়ে দিল।

” কোথায় যাবেন ?”
” শ্মশানে।”
” চলুন। মড়া নিয়ে আমিও ওখানেই যাচ্ছি।”

সুকান্ত দেখলো ভ‍্যানে একটা মড়া রয়েছে। সাহসী ছেলে সুকান্ত। সে এককথায় রাজি হয়ে মড়াটার পাশেই উঠে বসলো। কিছুদুর যেতেই অন্ধকার রাস্তায় একটি লোক হাত দেখিয়ে ভ‍্যান থামালো। ভ‍্যান চালক ভ‍্যান থামাতেই, টর্চ জ্বালালো সুকান্ত। লোকটা আর কেউ নয় দীপ। দীপ কে দেখে সুকান্তর মনে হোল এই কয়েক ঘণ্টাতেই দীপের চেহারা যেন অর্ধেক হয়ে গেছে।

” কিরে তুই এখানে ?”
” আরে তোর জন্যে দাঁড়িয়ে আছি। ওদিকে কোন কাজ হয়নি যাতা অবস্থা। চল গিয়ে কাজ গুলো সেরে ফেলতে হবে।”

দীপ উঠে বসতেই ভ‍্যান যেন হাওয়ার বেগে ছুটে চললো। হাওয়ার তোড়ে মড়ার মুখের কাপড় টা কেঁপে কেঁপে উঠছে। চারপাশের গাছ গুলো যেন কোন অশুভ বাজনার তালে প্রবল বেগে নাচতে লাগলো। তাদের দোলায় হাওয়া এমন বিকট হা হা স্বরে বইতে লাগলো যে মনে হতে লাগলো মাটির নিচে থেকে সমস্ত অশুভ আত্মার দল যেন অট্টহাসি হাসছে। এমন সময় আশেপাশের জঙ্গলের ভেতর থেকে সমস্বরে আর্ত চিৎকার ভেসে এলো।

” আগুন দাও। মুক্তি দাও।” দীপ ভ‍্যান ওয়ালা কে বললো, ” বাপী আরও জোরে আর সময় নেই।” সুকান্ত ভয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গিয়ে জড়োসড়ো হয়ে বসেছিল। হঠাৎ প্রবল হাওয়ায় মড়ার মুখের চাদরটা উড়ে গেল। মড়ার মুখের জায়গায় দীপের মুখ টা দেখতে পেয়ে আর্ত চিৎকার করে উঠলো সুকান্ত। দীপ আর বাপী তখন হা হা করে হাসছে। ঠিক ধরেছেন। দীপ আর সুকান্ত আর কোনদিন ঘরে ফেরেনি।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত