পঁচিশে ডিসেম্বর

পঁচিশে ডিসেম্বর

ছোট বেলা থেকেই পঁচিশে ডিসেম্বর রাতে নতুন মোজার মধ্যে মনের ইচ্ছা চিরকূটে লিখে ভাজ করে জানালায় ঝুলিয়ে দেওয়া আমার অভ্যাস। এখন বড় হয়ে গিয়েছি,বিয়ে হয়েছে, সংসার হয়েছে। মা বাবাও মারা গিয়েছে। স্বামী অভি আর্মিতে আছে, শ্বশুর শ্বাশুড়ি গত হয়েছেন অনেক আগেই। বাড়িতে আমি আর ইশা, আমার মেয়ে।ওকে পড়ানো, আকার ক্লাসে নিয়ে যাওয়া, নাচ শেখানো —এসব করেই সময় কাটে বেশ। মাঝেমধ্যে অভি ছুটিতে এলে আরও ভালো হয়।

সেদিন রাতে আমি বিছানায় হেলান দিয়ে ‘পদ্মানদীর মাঝি ‘ পড়ছি।হঠাৎ মনে পড়লো আজ তো পঁচিশে ডিসেম্বর। সংগে সংগে ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে গেল। কদিন আগেই অনলাইন থেকে দুজোড়া মোজা কিনেছিলাম ইশার জন্য। তার থেকে একজোড়া এখনও ব্যবহার করা হয়নি। তার থেকেই একটা নিয়ে মনের ইচ্ছা চিরকূটে লিখে ভাজ করে মোজায় ঢুকিয়ে দিলাম, তারপর জানালার গ্রিলে ঝুলিয়ে দিলাম। পরদিন সকালে ঘুম ভেঙে দেখি চিরকূট রাখা মোজাটা ওখানে নেই। আশ্চর্য তো, বাড়িতে আমি আর ইশা ছাড়া কেও নেই। নিল কে মোজাটা। ইশাকে জিজ্ঞাসা করলাম, ইশাও কিছু জানেনা। হঠাৎ বাইরে কলিং বেলের শব্দ। এত সকালে কে এলো আবার!

দরজাটা খুলতেই আমি হতভম্ব। মাথা কাজ করছে না, হাত পা কাপছে। এও কি সম্ভব? সামনে অভি দাঁড়িয়ে। আমাকে দেখে প্রতিবারের মতোই জড়িয়ে ধরলো, তারপর ভিতরে ঢুকে ইশাকে কোলে তুলে নিল। আমি তখনো দরজাতেই দাঁড়িয়ে। ঘোর কাটতেই চাইছে না। কি লিখেছিলাম জানেন চিরকূটে?লিখেছিলাম —’ এবার যেন খুব তাড়াতাড়ি বাড়ি আসে অভি। ‘ কিন্তু সেই ইচ্ছা কি করে এত তাড়াতাড়ি পূরণ হবে? আমি তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে অভিকে জিজ্ঞেস করলাম — “কি ব্যাপার বলোতো? কিচ্ছুটি না জানিয়ে চলে এলে? ”

— কেন খুশি নও বুঝি?
—আরে ও কি কথা? খুশি কেন হবোনা? আসলে কি জানো তুমি তো বরাবরই জানিয়ে আসো, আজ আচমকা চলে এলে, তাছাড়া মনে মনে এটাই চাইছিলাম যেন তুমি খুব শিগগির ফেরো, আর সে ইচ্ছে এমন করে পূরণ হবে ভাবতেই পারিনি। স্বপ্ন মনে হচ্ছে সবটা।

— আসলে আমি নিজেই ভাবিনি এভাবে ফিরবো। কিন্তু ফিরতেই হলো। তোমার সান্তা দাদু নিয়ে এলো। তুমি চাইলে আমি যেন তাড়াতাড়ি বাড়ি আসি, আর আমি চেয়েছিলাম তাড়াতাড়ি যেন ফিরতে পারি। দুজনের ইচ্ছাই পূরণ করে দিল সান্তা দাদু। এবার খুশি তো?

—খুব খুশি। আবেগে গলা জড়িয়ে এলো আমার।

—ফ্রেশ হয়ে নাও। অনেকটা পথ জার্নি করে এসেছো। আমি ব্রেকফাস্ট রেডি করছি। ইশা তুমি এসো ব্রাশ করিয়ে দেব। বাবা এখন ফ্রেশ হয়ে নিক। এসো। ইশাকে কোলে তুলে বেসিনের দিকে এগোলাম। হঠাৎ হাতটা টেনে ধরলো অভি।

— কি হলো? ফ্রেশ হয়ে নাও।
— তৃষা, আমার একটা রিকোয়েস্ট রাখবে?

ইশাকে কোল থেকে নামিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “কি হয়েছে বলোতো তোমার? সেই থেকে দেখছি তোমার কথায় স্বাভাবিক স্ফূর্তি নেই। কেমন কেমন সুর কথায়। কি হয়েছে বলোতো? এনি প্রব্লেম? ”

—”অনেক বড়ো প্রব্লেম তৃষা। হাতে সময় নেই আর। আমি একবার তোমাদের দুজনকে জড়িয়ে ধরতে চাই। প্লিজ। ”
—”আরে তুমি আমার স্বামী, ইশার বাবা। তুমি আমাদের জড়িয়ে ধরতেই পারো। পারমিশন নিচ্ছো কেন? কি হয়েছে তোমার? আমার খুব টেনশন হচ্ছে। ” আমি অভির হাত দুটো ধরে বললাম —”বলো আমায়, কি হয়েছে? সব ঠিক আছে তো? ” অভি কিচ্ছু না বলে আমাকে আর ইশাকে একসাথে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।

—” আমাদের মেয়েকে মানুষের মত মানুষ করো। আমার যা কিছু সব তোমারই। আমি যখন থাকবো না নিজের জীবন নতুন ভাবে শুরু করো। কথা দাও আমাকে, নিজের জীবনের কোন ইচ্ছা আমার কথা ভেবে নষ্ট করবে না। আমি সবসময় থাকবো তোমার সাথে, স্মৃতি হয়ে। আমি ভবিষ্যতে তোমাকে সুখী দেখতে চাই।” অভির চোখের জল আমার কাধে পড়লো। অভি আমার কপালে একটা চুমু এঁকে দিল।অস্বাভাবিক ঠান্ডা ওর ঠোঁট। আমার বুকের ভিতর হাতুড়ি পিটছে। এসব কি কথা বলছে ও?

— অভি কি পাগলের মতো বলছো তুমি? আমরা একসাথে থাকবো। দুজনে ইশাকে মানুষ করবো। নতুন ভাবে শুরু করার মানে কি? আমার মাথায় কিছু ঢুকছেনা।

— “মানে একটাই। আমার মৃত্যুর পরে তোমাকে নিজের জীবন নতুন ভাবে শুরু করতেই হবে, আর আমাদের মেয়েকে মানুষের মত মানুষ করতে হবে। আমি না থাকায় যেন তোমার জীবন রঙহীন না হয়ে যায়, সেরকম মানুষ পেলে আবার ঘর বেধো। এটা আমার শেষ ইচ্ছা। ” আমার পায়ের তলার মাটি যেন সরে যাচ্ছে। অভি ছাড়া নিজেকে কল্পনা করতে পারছিনা। ওর বুকের উপর আছড়ে পড়ে পাগলের মতো কাদতে কাদতে বললাম —”মজা করছো তুমি তাইনা? এমন কেন বলছো? ”

— “নিজের মৃত্যু নিয়ে কেউ মজা করেনা পাগলী। আমার শেষ ইচ্ছা টুকু রেখো। ”

আমি ধপ করে বসে পড়লাম মাটিতে। ওর কথার প্রতিবাদ করার ভাষা নেই। অভি ইশাকে আদর করতে ব্যস্ত। হঠাৎ বাইরে কলিং বেলের শব্দ। অভি চোখের সামনে থেকে মিলিয়ে গেল। আমি বোবার মতো বসে আছি। ইশাও হতভম্ব। বাইরে বার বার কলিং বেলের শব্দ হতে থাকলো, শেষ মেশ দরজায় দুমদুম আওয়াজ। ঘোর কাটতেই দৌড়ে গিয়ে দরজা খুললাম।
বাইরে অনেক লোক। পাড়ার লোক, সাংবাদিক, অভির সহযোদ্ধারা আর তেরঙ্গা পতাকা -ফুলে সাজানো কফিন, যেখানে ঘুমাচ্ছে আমার স্বামী অভি। গত দুদিন অভির সাথে যোগাযোগ করতে পারিনি ফোন খারাপ ছিল তাই, ভেবেছিলাম আজই দোকানে যাবো। তাই হয়তো খবরটা পাইনি। ধীর পায়ে কফিনের দিকে এগিয়ে গেলাম। কানাঘুষো শুনলাম বুকটা নাকি ঝাঝরা হয়ে গিয়েছে বুলেটের আঘাতে। ভাগগিস আমাদের নিজেদের মা বাবারা বেচে নেই, তাহলে তাদের সামলাতাম কি করে? চোখ দুটো জলে ভেসে যাচ্ছে, আওয়াজ করে কাদলে হয়তো বুকের পাথরটা সরতো। ইশা সমানে বাবাকে ডেকে চলেছে। সাংবাদিকরা ছবি তুলছে।

লোকজন ফিসফাস করছে, অনেকে আমার আর আমার মেয়ের কি হবে তা নিয়ে চিন্তা প্রকাশ করছে। সবই হচ্ছে আমার চোখের সামনে, কিন্তু আমি কিছু দেখেও দেখছিনা। মনে মনে ভাবছি একটু আগেই অভি ছিল আমাদের সাথে, তবে এসব কি দেখছি? একটু একটু করে ভেঙে পড়ছি, ভিতরটা ভাঙছে নিজেকে ধরে রাখতে পারছিনা, জ্ঞান হারানোর আগে শুনলাম একজন অফিসার বলছেন —”Avi was murdered by enemy last Twenty Third December at Twelve Thirty AM. We tried to call you many times, but could not contact you. “

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত