সেদিন বিকেলে অর্ক কলেজ থেকে ফিরতেই আমি উদ্ভাসিত মুখে বললাম, “জানো, পাশের বাড়ির ওই মাসীমা আসলে ভূত নন । আমাদেরই ভুল হয়েছিলো ।” মাত্র দু তিন সপ্তাহ হয়েছে এ পাড়ায় এসে গুছিয়ে বসেছি । সুন্দর ছিমছাম শহর এটা, কলকাতার বেশ কাছেই তবে পুরোনো, একটু মফস্বঃল মফঃস্বল ভাব আছে, অনেক গাছপালা পুরোনো বাড়ি ঘর । বিয়ের পরেই এখানকার কলেজে অর্ক অধ্যাপনার কাজটা পেয়ে গেলো, আর আমি একটু চেষ্টা করে কাছের স্কুলের আর্ট টিচারের চাকরি পেয়ে গিয়ে ভারি আহ্লাদিত হলাম । পাড়াটা মোটামুটি শান্ত, বাড়িগুলোর মধ্যে উঁচু উঁচু দেওয়াল বা বেড়া, কেউ কারো সাতে পাঁচে থাকে না । নিজেদের উঠোনে লাউকুমড়ো ফলাও বা চমরী গাই পোষো, কেউ দেখতে যাবে না । বাড়িটার খবর অর্কের এক পিতৃবন্ধু অশোকবাবু দিয়েছিলেন, উনিও ওই কলেজেই পড়ান । বলেছিলেন, “পাড়াটা পুরোনো নানারকম শোনা যায় তা, এমনিতে ঠিকই আছে” ।
এমনিতে আমাদের বাড়িটা খুবই পছন্দ হয়েছিল, কিন্তু ওই কথাটা শুনে একটু যেন কেমন কেমন লাগছিলো । কি আর করা, সব ঠিক হয়ে গিয়েছিলো। আমার আবার ভীষণ ভূতের ভয়, আর অর্কেরও একটু আধটু আছে জানি, মানতে না চাইলেও । আর সব ভূতের গপ্পো এভাবেই আরম্ভ হয়, নতুন স্বামী স্ত্রী কোনো এক বাড়িতে ওঠে, আর দেখা যায় চাদ্দিকে ভূত গিজগিজ করছে । হয় লালপাড় গরদের শাড়িপরা মহিলা যিনি সিঁড়ি দিয়ে নেমে এসে কুশলপ্রশ্ন করেন, পরে দেখা যায় তিনি পনেরো বছর আগেই মারা গিয়েছিলেন । কিংবা কোনো বিদেহী আত্মার করুণ কান্না প্রতি সন্ধ্যায় ভেসে বেড়ায় । তা দেখা গেল সেটা সামনের বাড়ির রায়দের বড় মেয়ের উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের রেওয়াজের সময় । আর আজ অর্ক হাত পা ছড়িয়ে সোফায় বসে পড়ে বললো, “বাঁচা গেল ! কি করে জানলে ?
আমি রান্নাঘর থেকে চায়ের আর গরম কুচো নিমকির ট্রে নিয়ে এসে বসলাম । হয়েছিলো কি, আমি প্রায়ই দেখতাম আমাদের বাঁপাশের বাড়িতে এক খেঁকুরে গোছের রোগামতো বয়স্কা মহিলা,তাঁতের শাড়ি সাদাসিধে করে পরা, চুলগুলো চূড়োমতো খোঁপায় করা, প্রায়ই এধার ওধার থেকে আমায় উঁকি মেরে নিঃশব্দে দেখছেন, এবং চট করে সরে যাচ্ছেন। নির্ঘাত প্রেতাত্মা । চুপচাপ বাড়িটায় আর কাউকে দেখতাম না। কিন্তু আজ শুনি আমাদের কাজের বৌ বিনতার সঙ্গে ওঁর দারুণ ঝগড়াঝাঁটি হচ্ছে।
নাকি বিনতা, যে ওবাড়িতেও কাজ করে, সে ওঁর পূজোর বাসন ভালো করে তেঁতুল দিয়ে মাজে নি । আমি স্কুল থেকে ফিরছিলাম, আমায় দেখে উনি “একটু দাঁড়াও তো মা, পেরায়ই তোমায় দেকি কিন্তু কতা বলার ফুরসত হয় নি কো” বলে আমায় ওঁর পূর্ণিমা পূজোর নাড়ু ফলের প্রসাদ এনে দিলেন । “কই নাড়ু ?” “খেয়ে ফেলেছি । বেশ ভালো ছিলো । তারপর শোনো না, ওঁর কত্তার বাতের ব্যথা তাই বিশেষ চলাফেরা করেন না, আর ওঁদের ছেলেপুলেরা সব বিদেশে। আর কিপটে বলে বেশি আলো জ্বালিয়ে রাখেন না । ভূত নয় বোঝা গেলো, বলো ।” আমি নিশ্চিন্ত হয়ে বললাম । “হুমম । আর ওই গুদামবাড়িতেও ভূত নেই তুমি যা-ই বলো বৃন্দা ।”
আমাদের বাড়ির ঠিক পিছনেই খানিকটা জমি । তার ওপাশে বদ্রীবাবুর চাল ডাল মশলা আরো কি কি-র গুদোম । সামনে মুদীর দোকান । আমি মাঝে মাঝে দেখেছি অনেক রাতে ওখানে ছায়া ছায়া কারা যেন চলা ফেরা করছে । ভূত ছাড়া কি-ই বা হতে পারে ? কিন্তু একদিন মাঝরাত্তিরে দারুণ চ্যাঁচামেচি শুনে পাড়ার সবার ঘুম ভাঙলো । চৌকিদার নাকি বস্তাশুদ্ধু চোরেদের ধরেছে । পরের দিন বদ্রীবাবু এসে আরো বকাবকি করলেন, চৌকিদারের তাড়া খেয়ে পালাতে গিয়ে নাকি চোরেরা তেলের টিন উলটে চিটেগুড়ের হাঁড়ি ভেঙে দামী বাসমতী চালের বস্তায় গুড় তেল মেখে টেখে একাকার হয়েছে ।
সে যাক গে । তবে একটা ব্যাপারে কেমন একটা খটকা সত্যিই লেগেছিলো । পিছনে একটু বাগানমতো, টগরফুল দোপাটি হাসনুহানার ঝোপ, ক’টা পেঁপে আর একটা লেবুগাছ । তার পিছনে উঁচু দেওয়ালের গায়ে ঘন কাঁটা ঝোপ, দেওয়ালের নিচের দিকটা বেশ খানিকটা উপর অবধি ঢেকে রেখেছে । খুব একটা যত্ন হয়নি বাগানের বোঝাই যায় । নাকি বুড়োবুড়ি দম্পতী থাকতেন শুধু । স্বামী মারা যেতে ছেলের কাছে শিকাগোয় চলে যান বৃদ্ধা । তাঁর ইচ্ছেয় এতোদিন বাড়িটা ভাড়া দেওয়া হয়নি, এখন তিনিও গত হয়েছেন ।
ওঁদের কি রকম আত্মীয় হন অশোকবাবু, ছেলেটির অনুরোধে দায়িত্ববান ভাড়াটে খুঁজে দিয়েছেন, মানে আমাদের । তা আসার দুয়েকদিন পর আমি পিছনের বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখি, পাঁচিলটার ওপারে কি সতেজ সুন্দর কলাগাছের ঝাড় মাথা উঁচু করে আছে । সুপুরি গাছ হাওয়ায় দুলছে । আম গাছে বোল ধরেছে । আতাগাছে – না আতা নয়, অন্য কি গাছ – ফল দেখা যাচ্ছে । আরো কি কি রঙীন ফুলের গাছ । তারও ওদিকে আরো কত সবুজ গাছপালা, সবগুলিরই মাথার দিকটা একটু একটু দেখা যাচ্ছে । আমি রান্নাঘরে ঢুকে বিনতাকে বললাম, “ওই পিছনের জমিটার সুন্দর কলা সুপুরি আম গাছগুলো কে দেখাশুনো করে গো ?” বিনতা পোস্ত বাটছিলো, মুখ তুলে অবাক হয়ে বললো, “কলা আমের গাছ আবার কই ওখেনে বৌদি ? ও তো পোড়ো জমি, শরিকি মামলার জন্য কবে থেকে ওমনি পড়ে আচে !” আমি ততোধিক অবাক হয়ে বললাম, “বাঃ, ওই তো।”
বিনতা বেরিয়ে এলো, আমি ওকে দেখাতে গিয়ে বোকা বনে গেলাম , সত্যিই তো কিচ্ছু নেই, শুধু দেওয়াল । বিনতা আমার দিকে একটু কেমন করে তাকিয়ে বললো, “তোমার ভুল হয়েচে গো, ওই বদ্রীবাবুর গুদামের পেচোনে যে ক’টা নারকোল গাচ আচে ঐগুলো দেখেচো বোধহয় ।” আমি ওখান থেকে সরে এলাম । ভুল করলাম ? কিন্তু স্পষ্ট দেখলাম যে? কি ভেবে সিঁড়ি দিয়ে ছাদে গেলাম । ওদিকের আলসের কাছে গিয়ে দেখি, সত্যিই পিছনে খানিকটা জমি শুধু, আর কিছু নেই, জমিটা বিবর্ণ ঘাস আর আগাছায় ঢাকা। নুড়িপাথর পড়ে আছে । মাঝে মাঝে বেঁটে বুনো কুলঝোপ আর কাঁটাগাছ । আস্তে আস্তে নেমে এলাম। সেদিন বিকেলে আবার দেখলাম গাছপালাগুলো, অর্ককে বললাম, “এদিকে এসো তো একটু !” “কি আবার ?” ল্যাপটপ ফেলে উঠে এলো । “আচ্ছা, ওদিকে দেখো তো ওই দেওয়ালের দিকে ।” হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলাম।
“কি দেখবো ? দেওয়াল আর কাঁটাঝোপ ?” হতাশ হয়ে দেখি আর কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না । অর্ককে সবটা বলতে বিরক্ত হয়ে বললো, “এই কি লেগপুলিংএর সময় হলো !” গজ গজ করতে করতে চলে গেলো । চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম । তারপর থেকে মাঝে মাঝেই দেখি গাছপালাগুলোকে । সবসময় নয় । ছবি তুলতে গিয়ে পারি নি, মিলিয়ে যায় । হ্যালুসিনেশন দেখছি না কি ? কাউকে কিছু বলি না । একদিন দেখি কি, অদ্ভুত একটা অচেনা পাখি এসে বসেছে দেওয়ালটার ওপর । নীল সাদা লম্বা লম্বা ডোরা পাখায়, বেগনী ঝুঁটি আর পা, হলদে ঠোঁট । বিনতা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসে আমায় জিজ্ঞেস করছিলো পটলগুলো ভাজবে না ডালনা করবে, হঠাৎ বললো, “দেখো বৌদি কত্ত বড় কাকটা, এই যাঃ হুসসস্।” আমি মুখ ফিরিয়ে দেখলাম, সত্যিই একটা কুচকুচে কাক, দেওয়ালের ওধারে উড়ে চলে গেলো।
শুক্রবার দিন অর্ক বললো ওর কাজ থেকে ফিরতে দেরী হবে, কি মিটিং আছে। বিনতা বললো ওর দিদি আসবে ওর বাড়ি, তাই তাড়াতাড়ি কাজ সেরে চলে যাবে। সেদিন আমার স্কুলে ক্লাস শেষ হয় বারোটায়। ভাবলাম দুপুরে একটু রং তুলি ক্যানভাস নিয়ে বসবো। তা মন লাগলো না, পায়ে পায়ে পিছনে বাগানে নেমে ঘোরাঘুরি করতে লাগলাম । দু একবার আড়চোখে দেখলাম, দেওয়ালের ওপারে গাছপালা কিছু দেখা যাচ্ছে না, যাক বাবা। সুনসান দুপুর ঝিমঝিম করছে, সব চুপচাপ শুধু বদ্রীবাবুর দোকানে কারা মাঝে মাঝে গলা তুলে কথা বলছে । টগরগাছে ফুল ধরেছে। দেওয়ালটার কাছে এগিয়ে গেলাম, পুরোনো পলেস্তরা খসে পড়ে মাঝে মাঝে ইঁট দেখা যাচ্ছে। ঘন কাঁটাঝোপে অনেকটাই ঢাকা, একদিন লোক লাগিয়ে একটু পরিষ্কার করিয়ে নিলে হয় আমি সাবধানে দেখছিলাম ঝোপগুলোর নিচে কোন ফুলগাছ আছে কিনা।
পাশের দিকে হাস্নুহানার বড় ঝাড়টার আড়ালে কাঁটাঝোপগুলো যেন একটু হালকা, দেওয়ালটা দেখা যাচ্ছে মাটি অবধি ওমা, দেওয়ালের কতকগুলো ইঁট খসে গিয়ে একটা বড় ফাঁকা মতো, যেন দরজা, দিব্যি গলে যাওয়া যায় একটা ঠাণ্ডা হাওয়ার ঝাপটা এসে মুখে লাগলো, জলের গন্ধ…মুখ তুলে দেখি দেওয়ালের ওপর দিয়ে সবুজ গাছপালা হাওয়ায় দুলছে, কি স্পষ্ট আর আমি কিচ্ছু না ভেবে এগিয়ে গিয়ে দেওয়ালের ফাঁকটা গলে ওধারে চলে এলাম মাথাটা কেমন ঘুরে গেল।
পোড়ো রুখু জমিটা কই ? পাশে বদ্রীবাবুর গুদোম দোকান, এপাশের মাদ্রাজীদের মেস, পুরো পাড়াটা, সে সব কোথায় গেলো! এ সব কি ? আমার পেছনেই ফাঁকটা সুদ্ধ দেওয়ালটা কিছুটা দেখা যাচ্ছে, বাকি সবকিছু ঘন গাছপালায় ঢাকা, মাথার উপর সবুজ ছায়া, দুপাশে পিছনে চলে গেছে দূরান্তরে। সামনে খানিকটা বালিয়াড়ি, আর দূরে ফিরোজা রঙের সমুদ্র দুলছে, দিগন্ত অবধি বিস্তৃত। ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে এলোমেলো গাছের ফাঁকে, তার সরসর ঝরঝর শব্দ, নোনা গন্ধ একটা । কেউ নেই কোথাও, কেমন অদ্ভুত একটা নির্জনতা। আমি দুধারে তাকালাম, গাছগুলো কয়েকটা চেনা মনে হলেও কিন্তু আসলে চেনা নয়, পাতা ফুল ফল সব একটু কেমন যেন অন্যরকম।
কলাগাছের গুঁড়িতে শক্ত বাকল, আতার মতো ফলগুলোতে লাল লাল ফুটকি, আর আমগাছটা থেকে কেমন ঝুরি নেমেছে আর অন্য গাছ লতা সব একেবারে অচেনা এ সবই কি আমার দৃষ্টিবিভ্রম? কি স্পষ্ট, পায়ের নিচে ভিজে ভিজে ঘাস আর বালি, কিসের একটা নীল ফুলের লতা একটু একটু দুলছে। ভীষণ ভয় করতে লাগলো হঠাৎ। আমি পিছন ফিরে সেই ফাঁকটা দিয়ে দ্রুত চলে এলাম এধারে, প্রায় ছুটে হাস্নুহানার ঝাড়টার পাশ দিয়ে বাগান পেরিয়ে বারান্দায় গিয়ে উঠলাম। চোখ বুঁজে ফেলে স্বাভাবিক শ্বাসপ্রশ্বাসে ফেরার চেষ্টা করছিলাম, তারপর তাকিয়ে দেখি দেওয়ালের ওপারে আর কিছু দেখা যাচ্ছে না। সব স্বাভাবিক, যেমন ছিলো। মাদ্রাজীদের কলতলায় কে যেন চেঁচিয়ে কি বললো। বদ্রীবাবুর দোকানের সামনে মালের ট্রাক এসে দাঁড়ালো।
তবে কি আমি হ্যালুনিশান দেখছি ? সবটাই আমার বিভ্রম ? অর্ক দেরী করে ফিরলো, খুব ক্লান্ত, ওকে কিছু বললাম না। তারপর ক’দিন কিছু দেখি নি। সব স্বাভাবিক, স্কুলে গিয়ে আঁকা শেখাই, সহকর্মীদের সঙ্গে আড্ডা দিই। ফোনে আত্মীয়দের সঙ্গে কথা বলি। একদিন অর্ক আর আমি গিয়ে একটা বাজে সিনেমা দেখে বাইরে চীনে খাবার খেয়ে এলাম । অর্কর এক প্রফেসার সহকর্মীর মেয়ের জন্মদিনে নেমন্তন্নে গিয়ে বেশ কিছু লোকের সঙ্গে আলাপ হলো। এর একদিন গিয়ে উঁকি মেরে দেখে এসেছি, দেওয়ালে ফাঁক আছে কিন্তু ওধারে ঐ খালি জমিটা ছাড়া আর কিছু নেই। তারপর একদিন দুপুরে বাড়ি ফিরলাম।
বিনতা রান্নাবান্না কাজকর্ম সেরে চলে গেলো। আমি অন্যমনস্কভাবে বারান্দায় গেলাম শুকনো কাপড় তুলে আনতে। চোখ তুলে দেখি দেওয়ালের ওধারে সবুজ ডালপালা খুব দুলছে। এদিকে গাঢ় গরম দুপুর, পাতাটি নড়ছে না। কি এক অদম্য আকর্ষণে আমি আস্তে আস্তে দেওয়ালের দিকে এগিয়ে গেলাম ফাঁকটার দিকে, ওপাশে চলে গেলাম। হুহু করে ভিজে হাওয়া বইছে সমুদ্র থেকে, আর বুকে মুখে লেগে আঁচল এলোমেলো করে দিলো। আমার দুপাশে গাছের ডাল পাতা আমায় ছুঁয়ে গেলো। কয়েক পা এগিয়ে গেলাম। পায়ের নিচে বালি। দিগন্ত থেকে মেঘ উঠে আসছে আকাশে। বালির ওপর ঢেউ এসে পড়ছে।
আমার হঠাৎ মনে হলো দিগন্ত সমুদ্র বন সবটা যেন ঘুরে গেছে একটু আমার ডানদিকে, দৃষ্টিকোণটা ঠিক এক নেই। খেয়াল হলো আমার সেলফোনটা আমার হাতে, তাড়াতাড়ি সেদিকে তাকাতেই দেখি, স্ক্রীনটা সম্পূর্ণ অন্ধকার। অথচ প্রায় পুরো চার্জ ছিলো। সমুদ্রের ওপরের আকাশে নীল বিদ্যুৎ ঝলসে গেলো, আমি ভয় পেয়ে পিছন ফিরে দেওয়ালটা ধরে ফেললাম, সবকিছু কেমন কেঁপে উঠলো । আমি দেওয়ালের এধারে আমার জগতে ফিরে এলাম, দুপুরবেলার নিস্তব্ধতা আমায় জড়িয়ে নিলো।
এমনিভাবেই দিন কাটতে লাগলো । আমি যেন কেমন একটা বাস্তব ও অবাস্তবের জগতের টানা-পোড়েনের মধ্যে বাঁধা পড়ে গেলাম । কাউকে কিছু বললাম না, কি বলবো ? দেওয়ালের ওপারে এক আলাদা জগত আছে যেটা আর কেউ দেখে না আমি ছাড়া ? অর্ক কলেজে নানা ঝামেলায় বিব্রত । ওর সেই পিতৃবন্ধু অশোকবাবু অসুস্হ হয়ে হাসপাতালে । তাঁর কোনো পরিবার নেই, অর্ক দেখাশোনা করছে । ওর ডিপার্টমেন্টে কে একজন অন্য কলেজে চলে গেছে, কাজের খুব চাপ ।
এইরকম সময় যদি ওর যদি মনে হয় ওর বৌ ভারসাম্যহীন মানসিক অবস্হায় একটা কাল্পনিক জগতের বিভ্রম দেখছে, তাহলে বেচারার নির্ঘাৎ নার্ভাস ব্রেকডাউন হবে । আর, আর ব্যাপারটা গোপন করে রাখার একটা প্রবল ইচ্ছে আমাকে নিষ্ক্রিয় করে রেখেছিলো ।এটা যেন আমার খুব নিজস্ব কোনো কথা । একদিন কি ভেবে একটা খালি বিস্কুটের লাল টিন পাঁচিলের ওধারে ফেলে দিয়েছিলাম । ওই সংকীর্ণ পথটা দিয়ে গেলে ওটাকে দেখতে পেতাম না, কিন্তু এমনি রাস্তা দিয়ে পেছনের রাস্তায় গিয়ে দেখেছিলাম পোড়ো জমিটায় ওদিকে পাঁচিলের নিচে লাল টিনটা পড়ে আছে ।
ওই জগতটা আমাকে প্রচণ্ড ভাবে আকর্ষণ করত কোনো নেশার মতো । যখনই দেখতে পেতাম পাঁচিলটার ওপাশে সেই জগতটার আভাস আমার ইচ্ছে হতো ওখানে যেতে । বালির ওপর গিয়ে সমুদ্রের দিকে এগিয়ে যেতাম । পায়ের কাছে কতো অদ্ভুত আকারের রঙীন ঝিনুক আর উজ্জ্বল নুড়ি পাথর আর রামধনু রঙের শাঁখ । প্রতিবারই মনে হতো দৃশ্যটা যেন একটু ঘুরে গেছে নাকি সব সময়েই খুব আস্তে ঘুরে যাচ্ছে । আবার একটা বিষম আতঙ্ক হতো আমি এধারে থাকার সময় যদি কখনো ওই পথটা বন্ধ হয়ে যায়, আর যদি খুঁজে না পাই। কিন্তু কিছুতেই পারি না ওই টানটা এড়াতে ।
সমুদ্রটা কিছুটা ডান দিকে এখন আমার তাই ধু ধু বালিয়াড়িটার অনেকটা দেখতে পাচ্ছি আজ । অনেক দূরে ধূসর উঁচু উঁচু কি যেন, কোনো স্থাপত্য, না কি কোনো টিলা? বাঁ দিকে বনটা আরো বিস্তৃত, আরো গভীর, গাছগুলো সব অচেনা । অদ্ভুত সব বিরাট লম্বা লম্বা নীলচে পাতা আর আঁকাবাঁকা সর্পিল শাখাগুলি একে অন্যের সঙ্গে বেণীর মতো জড়ানো, আর অধো অন্ধকারে কিসের যেন ছায়ারা নড়েচড়ে ঘুরে বেড়ায় । আমি বুঝতে পারছিলাম একটু একটু করে এ জগতটা আরো অদ্ভুত, অস্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছে । সমুদ্রের জলের নীচে কাদের যেন বিশাল অবয়ব দেখা দিয়েই মিলিয়ে যায়, জলের রঙ কেমন বদলে বদলে যায়, ঢেউগুলো ফুঁসে ওঠে ।
বালি থেকে ঝিনুক আর নুড়িপাথর কুড়িয়ে এনেছিলাম, দেওয়ালের এদিকে আসতেই সেগুলোর আমার মুঠোর মধ্যে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে ঝরে গিয়েছিল । ফুল পাতা আনলে তখুনি শুকিয়ে ধুলো হয়ে যেতো । একদিন একটা ছোট সবুজ-নীল শাঁখ এনে একটা বাটিতে রেখেছিলাম । অর্ক ফেরার আগেই বিবর্ণ হয়ে গেল, শুধু একমুঠো চূর্ণ পড়ে ছিল । তা হলে, কি করে প্রমাণ করবো এ জগতটা আমার কল্পনা নয় ! একটা ব্যাপার লক্ষ্য করেছিলাম, ওখানে যতক্ষণই থাকি না কেন, এখানে প্রায় যাওয়ার সময়েই ফিরে আসি । মানে ওখানকার সময়টা আলাদা । কিংবা সময় বলে কিছু নেই ওখানে । আমি আমার স্কেচখাতায় ওই জগতটার ছবি আঁকতাম। সমুদ্র বালি গাছপালা, ফুল ফল ঝিনুক পাথর। একদিন স্কুলে অফ পিরিয়ডে স্টাফ রুমে আমার বন্ধু সোহিনী বললো, “তুই আজকাল এত অন্যমনস্ক থাকিস কেন বল তো ?”
“কই না তো ?”
“কি করিস সারা দুপুর একা একা ?”
“এই বই টই পড়ি, ছবি আঁকি অর্ক ফিরলে বেরোই এদিক ওদিক” ।
আমি সতর্কভাবে বললাম । “দেখি কিসের ছবি আঁকছিস ।” স্কেচখাতাটা টেনে নিয়ে দেখতে লাগলো । আমি বাধা দিতে গিয়েও থেমে গেলাম । সোহিনী মনস্তত্ত্ব নিয়ে পড়াশুনো করেছে, এখানে আর আরো কয়েকটা স্কুলে কাউন্সেলিং করায়, ছাত্রছাত্রীদের নানা রকম সমস্যায় তাদের সাহায্য করে । ছবিগুলো দেখতে দেখতে ওর ভ্রূ ঈষৎ কুঁচকে গেলো । “এ সব কি এঁকেছিস রে কি অদ্ভুত সব এ সবই তোর কল্পনা নাকি ?” আমি তাড়াতাড়ি বললাম, “ না, না, ওই কি একটা টিভি শো দেখছিলাম সেদিন, বাচ্চাদের কোনো ফ্যান্টাসি বোধহয়, গ্র্যাফিকসগুলো বেশ ইন্টারেস্টিং ছিলো, তাই।”
“হুমম্ “ খাতাটা বন্ধ করে আমায় ফেরত দিয়ে সোহিনী আমার মুখের দিকে তাকালো । একটু চুপ করে থেকে বললো, “বৃন্দা, তুই ঠিক আছিস তো ? মানে কোনো সমস্যা হয় নি তো ? কিছু নিয়ে চিন্তা করছিস ? রাত্রে বোধহয় ঘুমোস না ঠিক করে ।” “আরে না রে, আমি ঠিক আছি । কলেজের ব্যাপারে অর্ক একটু ব্যস্ত আছে, দ্যাটস অল ।বাড়ির জন্য মন কেমন করে মাঝে মাঝে, বুঝেছিস তো ।” সোহিনী আর কিছু বললো না । রাত্রে আমি সত্যিই ভালো করো ঘুম হতো না । আধো ঘুমে কি সব এলোমেলো স্বপ্ন দেখতাম, সব ওই দেওয়ালের ওদিকের জগতটার । দেখতাম যেন হারিয়ে গেছি ওখানে, ফেরার পথ বন্ধ হয়ে গেছে, লতাপাতায় পা জড়িয়ে যাচ্ছে, ঝোড়ো হাওয়া বইছে । চমকে জেগে উঠতাম । অর্ক চিন্তিত হয়ে বললো একদিন, “তোমার শরীর-টরীর ঠিক আছে তো বৃন্দা ? কি ভাবো এত সব সময় ? কলকাতায় ঘুরে আসবে ক’দিনের ছুটি নিয়ে ?”
ওকে আশ্বস্ত করলাম, কিন্তু আমি বুঝতে পারছিলাম আমার অবচেতন আমায় বোধহয় সতর্ক করে দিচ্ছে, এভাবে দুটো আলাদা বাস্তবে আসা যাওয়া করা যায় না । কিন্তু নিষিদ্ধ কোনো মাদকের মতো ওই জগতটাকে আমি কিছুতেই ছাড়তে পারছিলাম না । ওই জগতে যাওয়ার পথটা খুললেই আমি যাওয়ার জন্য ছটফট করতাম । যতক্ষণ ওখানে কাটাতাম, কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে ঘুরে বেড়াতাম, বালিয়াড়িতে, সমুদ্রের জলে পা রাখতাম, গাছপালাগুলোকে ছুঁয়ে দেখতাম ।
একই সঙ্গে কেমন একটা ভয় আমায় আচ্ছন্ন করে রাখতো । মনে হতো এখানে আমার থাকার কথা নয় । যখন ফিরে আসতাম নিজের জগতটাতে, অসম্ভব একটা ক্লান্তি আমায় অবসন্ন করে দিতো, মনে হতো আমার জীবনীশক্তি যেন শেষ হয়ে যাচ্ছে । স্কুলে গরমের ছুটি পড়বে শিগগীরিই । পরীক্ষা ইত্যাদি নিয়ে একটু ব্যস্ত ছিলাম । সেদিন বাড়ি ফিরলাম, বিনতা কাজকর্ম শেষ করছিলো, ওর সঙ্গে এটা ওটা কথা বললাম । বিনতা হঠাৎ জিজ্ঞেস করলো, “বৌদি একটা কথা বলি তুমি ওই দ্যালের দিকে চেয়ে চেয়ে কি দ্যাখো বল তো ?” “কই না তো ? কি আবার দেখবো ।” আমি স্বাভাবিকভাবে বলার চেষ্টা করলাম ।
“দেখো না অত । এবাড়িতে যে বুড়োবাবু থাকতেন, আমিও তখন ওনাদের কাজ কত্তুম, উনিও এইখানে ইজিচেয়ারে বসে ওইরকম হাঁ করে দেখতেন, আর উলটো পাল্টা কথা কইতেন “কি বলতেন ?” আমার বুকটা কেঁপে গেলো । “এই ওই দ্যাখ ওদিকের গাছপালা গুলো নড়ছে, ওই দ্যাখ কেমন পাখিটা, ওই লম্বামতো কাদের যেন দ্যালের উপর দিয়ে দ্যাখা যাচ্ছে । অথচো কোতায় কি ! গা ছমছম করতো বাপু । ওনার গিন্নী বলতেন ভীমরতি হয়েচে । তাপ্পর তো অসুখবিসুখ হয়ে মারা গেলেন ।” বিনতা বাড়ি চলে গেলো । আমি বারান্দায় বসে রইলাম । কিছু খেতে ইচ্ছে করছিলো না । মুখ তুলে তাকালাম, আর দেওয়ালের ওপারের গাছগুলো আমায় হাতছানি দিলো, আমি এগিয়ে গেলাম ।
সমুদ্রটা আরো ডানদিকে ঘুরে গেছে । বনজঙ্গল বাঁ দিকে কোনাকুনি বেঁকে গেছে কিছুটা । আমার সামনে ধুধু বালি কতদূর চলে গেছে, কেমন যেন কুয়াশায় ঢাকা, আবছা উঁচু উঁচু সেই কি সব, একটু একটু দুলছে । আমার দেখা স্বপ্নের মতো ঝোড়ো হাওয়া বইছে এলোমেলো । আকাশটা আজ কেমন অনুজ্জ্বল । দেখি দূরে একটা ছায়ামূর্তি । স্হির নেই একজায়গা থেকে আরেক জায়গায় কেমন সরে সরে যাচ্ছে । আর যতো বার অন্য দিকে তাকিয়ে আবার ওটার দিকে দেখছি, ততো বার কি রকম এগিয়ে আসছে । সমুদ্রের একটা বড়ো ঢেউ আছড়ে পড়লো, চমকে সেদিকে চোখ ফিরিয়ে আবার এদিকে তাকাতেই দেখি মূর্তিটা কাছাকাছি চলে এসেছে চোখ বুঁজে ফেললাম, আবার চোখ খুলতেই দেখি একেবারে সামনে দাঁড়িয়ে আছে ।
মূর্তিটা যেন কেমন বদলে বদলে যাচ্ছিল আমার চোখের সামনে । একবার মনে হলো কেমন তেকোণা মুখ, সবজেটে চোখ, ঠোঁটটা খুব ছড়ানো, একটা ঢোলা মতো কি পরা পরমুহূর্তেই দেখি, না তো একটা উঁচু কালো মূর্তি, খুব লম্বা মুখ, হাতপাগুলো গায়ের সঙ্গে জোড়া, মণিহীন চোখে আমার দিকে চেয়ে আছে মিলিয়ে গেলো, তারপরেই একটা পাথুরে মতো কি যেন, মুখের জায়গায় কিচ্ছু নেই আর সরু লতানে হাতে অনেকগুলো করে লম্বা আঙুল আমার শরীর অবশ লাগছিলো, পিছিয়ে যাবার চেষ্টা করেও পারছিলাম না । আকাশটা আরো অন্ধকার হয়ে আসছিলো । বনের মধ্যে খসখস শব্দ আর সমুদ্রটাও যেন এগিয়ে আসছে ঢেউয়ে ঢেউয়ে পায়ে পায়ে । বাতাসে কেমন একটা শিসের মতো শব্দ । মাথার মধ্যে একটা শব্দ শুনতে পাচ্ছি বারবার, কে যেন কি বলছে, কিন্তু বুঝতে পারছি না । ধীরে ধীরে খানিকটা স্পষ্ট হলো, একটা ধাতব কণ্ঠ বলছে ,”চলে যাও, এখান থেকে চলে যাও” আবার দুর্বোধ্য প্রতিধ্বনি মাথার ভেতর, তীক্ষ্ন যন্ত্রণা, “এখানে থেকো না” সামনের মূর্তিটা এপাশে ওপাশে সরে সরে যাচ্ছে ।
পলকের জন্য মনে হল পায়ের নিচে রুক্ষ কাঁকুরে জমি, বুনো কুলঝোপ, ওপাশে বদ্রীবাবুর গুদোমটা যে দেখতে পেলাম, তারপর আবার সমুদ্র বালি বন, সামনে সেই কি যেন, কে যেন উঃ কি ঠাণ্ডা হাওয়া মাথাটা ঝনঝন করে উঠলো চলে যেতে বলছেবুঝতে পারছি এটা অন্য সময়, অন্য জায়গা, অন্য মাত্রা এখানে থাকলে আমার ভয়ঙ্কর বিপদ হবে শেষ শক্তিটুকু দিয়ে এক ঝটকায় পিছন ফিরে দেওয়ালটার দিকে ছুটলাম । কোথায় সেটা, শুধু গাছ আর বুনো লতা, এতো ঘন হয়ে উঠলো কখন না না এই তো, দুহাতে কাঁটালতা সরিয়ে ফাঁকটাকে পেলাম, কোনোরকমে ওপাশে যেতেই সব আবার চুপচাপ আর শান্ত দুপুর আর নিস্তব্ধ বাড়িটা আমার দিকে চেয়ে । আমি চোখের সামনে যেন অন্ধকার দেখছিলাম । বারান্দাটায় পৌঁছে বসে পড়লাম, আর কিছু মনে নেই ।
অর্ক এসে তুলেছিলো আমায়, গা পুড়ে যাচ্ছিলো জ্বরে, মাথায় যন্ত্রণা আর সেই তীক্ষ্ণ ধাতব শব্দ । ডাক্তার ওষুধ ইনজেকশন, দুতিন দিন কাটলো বিকারের ঘোরে । মাথার পাশে সারাক্ষণ অর্ক বসে, বিনতা ছিলো, এক সময় মনে হলো সোহিনী মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে, পাশের বাড়ির সেই ভূত-মাসীমা না, না, ভূত নন বলছেন নির্ঘাৎ কোনো নজর টজর লেগেচে এই বলে দিলুম । এই পেসাদী ফুলটুকু বৌমার মাতায় ছুঁইয়ে দাও দিকি বাছা। যেদিন জ্বর ছাড়লো, নির্জীবভাবে শুয়ে শুয়ে ভাবছিলাম আবারও যদি ওই অদম্য আকর্ষণ প্রতিরোধ করতে না পারি তবে কি হবে । একটা ছাড়া ছাড়া দুমদাম শব্দ পাচ্ছিলাম । বিনতা ঘরে ঢুকে বললো, “এই ফলের রসটুকু খেয়ে নাও দিকি ।” “কিসের আওয়াজ হচ্ছে গো বিনতা ?”
“ওমা, তুমি তো জানোনা, ঐ জমিটা নিয়ে শরিকি মামলা মিটে গেছে গো দিদি। কেউ জানতুম নি । তা ওখেনে নাকি দোতলা আপিস বাড়ি হবে, চাদ্দিকে ফুলের কেয়ারি হবে। ওই পুরোনো পাঁচিলটা ভেঙে ফেলচে, ওরাই সিমেন্টের পোক্ত দ্যাল তুলে দেবে গো । আমরা বল্লুম ঘরে রুগী, দুদিন পরে নয় ভাঙবে, তা মুখপোড়ারা বললো কন্টাক্ট আছে এখুনি করতে হবে । যাক বাবা আপদ যাবে ।” আমি আস্তে আস্তে বললাম, “ও” । অর্ক ঘরে ঢুকলো । পাশে বসে আমার হাত ধরে বললো, “এখন ঠিক আছো তো । ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে বৃন্দা । এবার থেকে আর রোদে রোদে বাগানে ঘুরো না তো । বিনতা বলেছে দেওয়াল ভাঙার কথা ? ও হ্যাঁ জানো এদিকের কাঁটা ঝোপটোপ ওরাই পরিষ্কার করে দেবে । ভালোই হবে ।” আমি কমলার রসের গ্লাস হাতে একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বললাম, “আচ্ছা ।”
যেদিন সুস্হ হয়ে স্কুলে গেলাম, দেখি তদ্দিনে ওরা দেওয়ালটাকে ভেঙে দিয়ে কাঁটাঝোপ পরিষ্কার করেছে । কদিনেই একটা মসৃণ সিমেন্টের দেওয়াল তুলে দিলো । কোনো ফাঁক ফোকর নেই । তারপরই গরমের ছুটিতে কিছুদিনের জন্য আমি আর অর্ক কলকাতায় গেলাম, এদিক ওদিক বেড়ালাম । ফিরে এসে দেখি বেশ সুন্দর আধুনিক একটা দোতলা অফিসবাড়ি হয়েছে পিছনের জমিটায় । আমি লোক লাগিয়ে বাগানের জমিতে সার দেওয়ালাম, দেয়ালের নিচে গোলাপচারা, গাঁদা আর বেলফুল লাগালাম ।
দেওয়ালে হুক পুঁতে মাধবীলতা তুলে দিলাম । রিমঝিম বৃষ্টি নামলো, বারান্দায় বসে দেখি আমার সবুজ চির চেনা গাছপালা ফুল লতাপাতা ভিজছে । মাঝে মাঝে অন্যমনস্ক হয়ে গিয়ে পাশে বসা অর্কের কথার উত্তর দিতে ভুলে যাই । চোখের সামনে ভাসে সেই সমুদ্রের ঢেউ আর বালিয়াড়ি আর সেই মূর্তি… ওই পরাবাস্তবের জগতটা আছে কোথাও ঠিক । কিন্তু না, আমি আর যেতে চাই না ওখানে ।
সমাপ্ত