পাটকু তার নতুন ফ্ল্যাটের বৈঠকখানাটা অ্যান্টিক আসবাবপত্র দিয়ে সাজিয়েছে | চিনা এবং জাপানী জলরংএর প্রাকৃতিক নিঃসর্গের ছবি, বেলজিয়াম কাঁচের ওয়াল মিরর, চাইনিজ ওয়াটার পট এবং ডিনার সেট, পার্শিয়ান গালিচা, অর্ধ উলঙ্গ ইটালিয়ান মার্বেলের নারীমূর্তি, জার্মান ব্রোন্চের আবক্ষমূর্তি | এছাড়া সেই ঘরের কাঠের সব ফার্নিচারও পুরোণ এবং কিউরিও শপ থেকে কেনা |
কিছু আফ্রিকান দুঃষ্প্রাপ্য মুখোশও তার সংগ্রহে আছে | এসব সে কিনেছে সংসারের সব খরচের পরও একটু একটু করে পয়সা জমিয়ে | আর এগুলো পার্ক স্ট্রীটের দু তিনটে কিউরিও শপ থেকে কেনা | তার স্ত্রী রুমু বারম্বার বলেছিল পুরোণ জিনিসপত্র দিয়ে নতুন ফ্ল্যাটের ড্রইং রুম না সাজাতে | রুমুর মতে পুরোণ জিনিস ঘরে রাখলে গৃহস্থর অমঙ্গল হয় | কিন্তু পাটকু এ ব্যাপারে একদমই নন কম্প্রোমাইজিনিং অ্যাটিচুডের | তাই বউয়ের এই একটা অনুরোধই সে মানতে পারে নি | রুমুও স্বভাবতই অভিমানবশতঃ ঐ ড্রইং রুমে ঢুকত না |
সেবার মিঃ দাশগুপ্তের শপ থেকে একটা চমৎকার দেওয়াল ঘড়ি পেয়ে গেল সে | অপূর্ব সুইস ঘড়ি| ব্ল্যাক উডের বডি, ঘড়ির মাথায় হরিণসহ কিছু জন্তু জানোয়ারের কাঠের মূর্তি, পেন্ডুলামটা রূপোর | ঘন্টা বাজে না | কিন্তু ঘড়িটা সচল | ঘড়িটা যেন পাটকুর ড্রইং রুমকে সম্পূর্ণ করল | অবশ্য এর জন্য তাকে নগদ আশী হাজার টাকাও খসাতে হল | যখনই সময় পেত, পাটকু হাঁ করে দেওয়াল ঘড়িটার দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকত | হ্যাঁ, একেই ঘড়ি বলে বটে !
পাটকু তার কিউরিও কালেকশন দেখানোর জন্য মাঝে মধ্যেই তার বন্ধু বান্ধবদের ড্রইংরুমে ডেকে নিত | পানাহার সহযোগে আড্ডা চলত | বন্ধুরা তার রুচি আর কালেকশনের তারিফ করত আর পাটকু সে সব তারিয়ে তারিয়ে নীরবে উপভোগ করত | কিন্তু নতুন ঘড়িটা দেখে, সাগর নামে তার এক অ্যাসেট্রোলজার বন্ধু বলল, ” ঘড়িটা খুব একটা শুভ নয় | গন্ডগোলের বস্তু ঠেকছে | পারলে ওটিকে বিদায় কর |” পাটকু এ সব মানে না | তাই সে ভাবল সাগর হয়ত আউট অফ জেলাসিতে এসব বলছে | ফলে এর পরের আড্ডাগুলোতে সে সাগরকে ডাকা বন্ধ করে দিল |
তাদের বেডরুমের পাশেই ড্রইংরুমটা | একদিন রাত চারটের সময় ঘড়ির ঢং ঢং শব্দে পাটকুর ঘুম ভেঙে গেল | দৌড়ে বেরিয়ে এসে পাটকু দেখল দেওয়াল ঘড়ির পেন্ডুলামটা দুলছে আর ঢং ঢং করে শব্দ হচ্ছে | যুগপৎ আনন্দিত এবং হতচকিত হয়ে পড়ল সে | স্বয়ং দোকানদার বলেছিল যে ঘড়ির ঘন্টা বাজবে না | আর এত মিষ্টি, গম্ভীর শব্দ সে আওয়াজের | পাটকু সোফার ওপর বসে অপেক্ষা করতে লাগল | দেখতে দেখতে পাঁচটা বাজল | কিন্তু পেন্ডুলামের ঘন্টা আর এবার বাজল না | পাটকু খুব অবাক হয়ে আরও এক ঘন্টা অপেক্ষা করল | কিন্তু ছটার সময়ও কোন ঘন্টা বাজল না | তখন পাটকু খুব চিন্তিত মনে শুতে গেল |
পরদিন দেরি করে ঘুম থেকে উঠে পাটকু শুনল তাদের প্রতিবেশী শর্মাজী ভোর চারটের সময় ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছেন | শুনে চমকে উঠল পাটকু | তার ঘড়িতেও তো চারটের সময় ঘন্টা বেজেছিল | অবশ্য যুক্তিবাদী পাটকু প্রাথমিক বিহ্বলতা কাটিয়ে ব্যাপারটাকে কাকতলীয় ভেবে মন থেকে উড়িয়ে দিল | কিন্তু তার মনে একটা প্রশ্ন রয়েই গেল – ঘড়ির অচল ঘন্টা চারটের সময় বাজল কিভাবে ? অবশ্য এসব নিয়ে সে কাউকে কিছু বললও না |
এর পরের ঘটনা ঘটল একমাস পরে | রুমু মেয়েকে নিয়ে আগের দিন বাপের বাড়ী গেছে | পাশের পাড়াতেই তার বাপের বাড়ী | রুমুর কাকা খুব অসুস্থ – হসপিটালাইজড্ | বেলা এগারোটার সময় ঘড়িটা ঢং ঢং করে বাজতে লাগল | আর তার দশমিনিট বাদে রুমুর কান্নাভেজা গলায় তার কাছে ফোন এল – কাকা আর নেই | এগারোটার সময় ডাক্তারদের সব প্রচেষ্টাকে ফেল করিয়ে উনি জীবনের পরপারে চলে গেছেন | এবার কিন্তু ভীষণ ঘাবড়ে গেল পাটকু !
পাটকু নিজেই সাগরের সঙ্গে দেখা করে তাকে সব কিছু জানাল | সাগর ভাল বন্ধু বলতেই হবে | এত অপমানের পরও সে পাটকুকে সদোপদেশ দিল- ” আমি ঘড়িটা দেখেই বুঝেছিলাম ওটা অত্যন্ত অশুভ | যত তাড়াতাড়ি পারিস, ঘড়িটা বিদায় কর | ” পাটকু সেদিনই বিকেলে মিঃ দাশগুপ্তর দোকানে গিয়ে তাকে বলল যে সে ঘড়িটা ফেরত দিতে চায় | প্রথমে মিঃ দাশগুপ্ত খুব অবাক হলেন | পাটকু তাকে ঘড়ি বিক্রী করার কোন কারণ বলে নি | কিন্তু যখন তিনি দেখলেন যে পাটকু বাড়ীতে ঘড়ি আর রাখবেই না বলেই মনস্থির করেছে, তখন তিনি বললেন, ” আমাকে একটু সময় দিন মিঃ সেনগুপ্ত | এত দামী ঘড়ি, খদ্দের পেতেও তো সময় লাগবে |” এই বলে তিনি মোবাইলে ঘড়িটার একটা ছবি তুলে নিলেন | আর পাটকুকে জানালেন খদ্দের এবং উপযুক্ত দাম পেলেই তিনি পাটকুকে ফোন করবেন | অগত্যা বিরসমনে পাটকু সেখান থেকে চলে এল |
ইতিমধ্যে প্রায় একমাস কেটে গেছে | মিঃ দাশগুপ্তর কাছ থেকে কোন ফোন আসে নি | ঘড়িটা মোট তিনবার বেজেছে | একদিন বিকেল পাঁচটার সময়, একদিন রাত আটটার সময় আর একদিন দুপুর দুটোর সময় | পাটকু খোঁজ খবর নিয়ে দেখেছে ঐ সময়গুলোতে একদিন পাড়ার একজন যুবক ডেঙ্গুতে আর বাড়ীর সামনের বড় রাস্তায় প্রতিবেশী একজন বাস অ্যাক্সিডেন্টে মারা যায় এবং পাড়ার একজন টিনেজার কিশোরী ব্যর্থ প্রেমের কারণে সুইসাইড করে | আর একটা জিনিস পাটকু লক্ষ্য করেছে – রুমু যখন ঘরে থাকে না, সেই রকম মুহুর্তেই ঘড়ির ঘন্টা বেজেছে |
পাটকু অস্থির হয়ে ওঠে | তার ঘড়ি মূর্তিমান শয়তানের ঘড়ি ! যখন সে বাজে, তখনই প্রতিবেশী কারও না কারও মৃত্যু হয় | পাটকুর কাছে ওই ঘন্টিধ্বনি ভয়াবহ ও ভীতিপ্রদ | সে ঠিক করল ঘড়িটা মিঃ দাশগুপ্তর দোকানে দিয়ে আসবে | কেউ কেনে ভাল, যদি দাম নাও পায়, তবু ভাল | কিন্তু মৃত্যু ঘোষণার এই যন্ত্রদূতকে সে আর ঘরে রাখবে না !
সিদ্ধান্তমত পাটকু পরদিনই ঘড়িটা বগলদাবা করে মিঃ দাশগুপ্তর দোকানে বিকাল সাড়ে পাঁচটা নাগাদ হাজির হল | তাকে দেখে মিঃ দাশগুপ্ত একগাল হেসে বললেন, ” আসুন মিঃ সেনগুপ্ত | আপনাকে আমি এখুনি ফোন করতে যাচ্ছিলাম | একজন খদ্দের পাওয়া গেছে | অ্যামেরিকান টুরিস্ট | দুদিন কলকাতায় আছেন | ছবি দেখে পছন্দ হয়েছে | দাম দিয়েছেন একলাখ দশ | আমি কিন্তু টোয়েন্টি পার্সেন্ট নেব আগেই বলে দিচ্ছি |”
অ্যামেরিকান ভদ্রোলোককে ফোন করা হল | উনি আধঘন্টার মধ্যে হাজির হলেন | ঘড়ির ছবি আগেই দেখেছিলেন, এবার চাক্ষুস জিনিসটা দেখে তিনি আনন্দে নেচে উঠলেন | পাটকুকে একলাখ দশ হাজার টাকা নগদ দিয়ে তিনি ঘড়িখানি কিনে বগলদাবা করে বিদায় নিলেন | পাটকুকে অবশ্য বাইশ হাজার টাকা মিঃ দাশগুপ্তকে গুনে দিতে হল | তাতে তার কোন দুঃখ নেই | আপদ বিদায় হয়েছে এবং তার কোন আর্থিক ক্ষতি হয় নি, এতেই সে মহাখুশী |
পরদিন সকালেই খবরের কাগজ খুলে একটা খবর পড়ে থ হয়ে গেল পাটকু | গতকাল সন্ধ্যা সাতটায় পিটিএসের সামনে এক অ্যামেরিকান পর্যটকের পথ দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে | ভদ্রলোক একখানা অ্যান্টিক সুইস ঘড়ি বগলে করে তাজবেঙ্গল হোটোলের দিকে যাচ্ছিলেন, যেখানে তিনি গত দুদিন ধরে উঠেছিলেন | দ্বিতীয় হুগলী ব্রীজগামী একটি বাস নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে তাকে ধাক্কা মারে | দুর্ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয় আর ঘড়িটাও চিঁড়ে চ্যাপটা হয়ে ভেঙে যায় | প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ অনুযায়ী দুর্ঘটনার আগের মুহুর্তে ঘড়িটা সাতবার বেজেছিল |