ফেরারি বর

ফেরারি বর

পুরো বাড়িতে আমার বিয়েতে আসা আত্মিয়-স্বজনে ভরপুর। আমার রুমে একটা মেয়ে বসে আছে। যে কিনা এখন আমার বউ! ভাবতেই অবাক লাগে। এই মেয়ে আমার বউ হয় কী করে? এমন তো হওয়ার কথা ছিল না! তিথিকে ছাড়া জীবনে কখনো কাউকে ভাবতেও পারিনি। ভাবার কথাও ছিল না। আমার জীবনের প্রতিটি বাকেই আমি তাকে পেয়েছি অতি আপন করে। সুখে-দুঃখে সে ছিল আমার পরম সঙ্গী।

কিন্তু আজ! আজ অচেনা এক রমনী আমার বউ হয়ে আমার ঘরে বসে আছে। সত্যিই অদ্ভুত! খুব অদ্ভুত! মাঝে মাঝে এমনই অদ্ভুত কিছু ঘটনা ঘটে যায়, যেখানে আমাদের কিছুই করার থাকে না। আমারও কিছু করার ছিল না!
ভাবানার একটা পর্যায় এসে কারো কন্ঠ শুনতে পেলাম। মনে হয় নাজমা ফুপি। ফুপি কিছুটা রাগাত সুরেই বলল, ‘কিরে, তুই এখানে কী করিস? রাত কত হইছে সে খেয়াল আছে? ঘরে যে বউটা একা একা বসে আছে।’ আমি মুচকি হেসে বললাম, এইত আসতেছি ফুপি, তুমি যাও। একটু রাগ দেখিয়ে ফুপি চলে গেল। মনে মনে আমারও খুব রাগ হল ফুপির উপর। উনার জন্যই আজ এত সব! আমাদের পরিবারে বাবা কাকা ও ফুপিদের মাঝে উনিই সবার বড়। উনার কথা ফেলবার মত কেউ নেই। আমি তো এক পুচকে ছোকরা! মনের মাঝে রাগটা পুষে রেখে রুমের দিকে চললাম।

চারোদিকে নানান রঙ্গের আলোয় জ্বলমল করছে। অনেকেই ঘুমিয়ে পড়েছে। তিন চাচা আর বড় ফুফা একসাথে বসে একটা রুমে তাস খেলছে। মনের আনন্দে মেতে উঠেছে তারা। আমার বিয়েকে কেন্দ্র করে পুরো বাড়িতে আজ এতই আনন্দ যে, ঘরে বসে তাস খেলা কিংবা বিয়ার খাওয়াও অপরাধ নয়! অন্যথায় আমার মা আর বড় ফুপি থাকতে এসব! সব কটাকে তুলা ধুনা করে দিত! আমি সামনে পা বারিয়ে রুমের দিকে যাই। এটা আমার রুম! ভাবতেই অবাক লাগছে। পুরো রুমটা ফুলে ফুলে ছেয়ে আছে। ফুলের ঘ্রাণে মৌ মৌ করছে চারোদিক। তবে সব সৌন্দর্যকে ম্লান করে দিচ্ছে খাটের উপরে বসে থাকা এক রমণী। মেয়েটার প্রতি আমার প্রচন্ড রাগ। তবুও মেয়েটাকে দেখে রাগটা বিলিন হয়ে গেল। তবে সবচেয়ে আকর্ষণিয় লাগছে, তার লাল শাড়ীর পাড় থেকে বেরিয়ে থাকা আলতা রাঙ্গানো পা জোড়া।

দরজার কাছ থেকে এই অপরূপাকে দেখেও খাটের দিকে আগালাম না। গায়ে একটা টি-শার্ট ছিল। আলনার কাছে গিয়ে একটা শার্ট পরে রুম থেকে বেরিয়ে গেলাম। তারপর বাড়ির প্রধান ফটক দিয়ে বেরিয়ে, মূল সড়ক ধরে আগাতে থাকি। চারোদিকে শুন-শান নীরবতা। বাড়ি থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরেই রেলস্টেশন। চলে গেলাম সেখানে।
নিবাসহীন পথিকের জন্য রাত কাটাবার জন্য এর থেকে উত্তম জায়গা আর নেই। পৃথিবীর মহত্‍ জায়গাগুলোর মাঝে রেলস্টেশন একটি। যা কিনা হাজারো ঘৃহহীন অসহায় মানুষের নিরাপদ আশ্রয়। শত শত মানুষকে দেখেছি, যারা এই রেলস্টেশনেই জীবনটা কাটিয়ে দিচ্ছে। নীরব দেখে একটা জায়গায় গিয়ে বসে পড়লাম। রাত গভীর বলে মানুষের আনা-গুনাও কম। যেখানে বসে আছি তার থেকে কিছুটা দূরেই মধ্য বয়স্ক এক দম্পতিকে দেখতে পেলাম। পাশে চার পাঁচ বছরের একটা ছেলে ঘুমিয়ে আছে।

স্টেশনের প্লাটফর্মের একটা পাশে পাটি বিছিয়ে শুয়ে পড়েছে ওরা। সেদিকে চোখ জোড়া আটকে গেল। মধ্যবয়স্ক লোকটি এদিকে-সেদিক তাকাচ্ছিল বারবার। তারপর স্ত্রীকে চোখে ইশারা করে। একটা পাটি নিয়ে ওরা চলে যায় পাশের টং দোকানটার আড়ালে। কিছু বুঝতে বাকি রইল না। তবে আর ভাবতে চাইলাম না। ভাবনায় চলে আসে অন্য কিছু। জীবনের কতটা কঠিন তম পর্যায় এসে একটা দম্পতি স্টেশনের প্লাটফর্মে মিলিত হতে হয়! ধিক্কার মানবতাকে! ধিক্কার মনুষত্যকে! তবে একটা জিনিস ভেবে খুব অবাক হতে হলো। জীবনের এতটা কঠিন মুহুর্তেও তাদের লজ্জানোভূতি কতটা প্রবল। লোকটির চারিপাশে তাকাবার চোখের দৃষ্টি আমার মন কেড়ে নেয়। সে দৃষ্টিতে ছিল ভয়, দ্বিধা, লজ্জা আর বুক ফাটা কষ্ট!

আর আমাদের অতি সভ্য সমাজের কতিপয় সভ্যতার নামধারী অসভ্য, চার দেয়ালের প্রাচীর থাকার পরও খুলা আকাশের নিচে অশ্লীলতায় লিপ্ত হয়ে গর্বিত হয়ে ওঠে। অদ্ভুত! সবই অদ্ভুত! রাত তখন গভীর থেকে গভীরে চলে গিয়েছে। স্টেশনের একটা দোকানে গিয়ে এক কাপ চায়ের অর্ডার দিলাম। তখন তিথির কথা খুব মনে পড়ছিল। চার বত্‍সরের ভালোবাসার সম্পর্কটাতে কতই না স্মৃতি জমে আছে। মেয়েটা বেশ চঞ্চল ছিল। সব সময় আমাকে মাতিয়ে রাখতো। এখন অন্য কাউকে মাতিয়ে রাখছে হয়তো খুব করে! আমার থেকেও অনেক বেশি। আবার নাও হতে পারে। হতেও পারে।

তিথির কথা ভাবলে এখন খুব বেশি কষ্ট লাগে না। অতীতের স্মৃতি গুলোতে ভবিষ্যতের স্বপ্ন গুলোর কথা ভাবলে এখন খুব হাসি পায়। এই হাসিটা হয়তো সুখের কান্নার মতই কষ্টের! ভাবনায় ভাবনায় এতটাই বিভোর হয়ে গিয়েছিলাম যে, নিজেকেই ভুলে গিয়েছিলাম। ভুলে গিয়েছিলাম যে আমি এক বাসর ঘরের ফেরারি বর। রুমে অপেক্ষা করছে এক অপরূপা রমণী। যে কিনা আমার সদ্য বিবাহিত স্ত্রী। কিন্তু তার প্রতি এ মনে কোনো আকর্ষণ নেই। ভালোবাসা নেই। শুধু করুণা হচ্ছে। নিস্পাপ একটা মেয়ের জীবন নষ্টের জন্য তার প্রতি করুণা হচ্ছে।

চা টা খেয়ে দোকানে বসে রইলাম। একটা সিগারেট নিলাম। বেনসন। খাব যখন দামি দেখেই খাই। সেই যে কবে ক্লাস এইটে থাকতে একবার একটা খেয়েছিলাম! আমার টেবিলের ভিতর কে যেন রেখছিল। বাবাই হয়তো। খাওয়ার কতক্ষণ পর দেখলাম বাবা আমার রুমে উঁকি-ঝুকি দিচ্ছিল। যতটা সম্ভব মায়ের ভয়ে বাবা কাজটা করতে পারে। তখন বাবার এই অবস্থা দেখে খুব হাসি পেয়েছিল আমার। কিন্তু বিপাকে পড়ি যখন মুখ থেকে গন্ধটা আর যাচ্ছিল না! সে যে কি যন্ত্রনা! সবার কাছ থেকে সারাদিন প্রায় পালিয়ে বেঁচেছিলাম।

সেদিনের পর আবার আজ। সিগারেটটা মুখে নিয়ে জ্বালালাম। মুখে নিয়ে একটু স্টাইল করে টানতেই খক খক করে কাশতে থাকি। দোকানদার আমার দিকে চেয়ে মিটি মিটি হাসতেছে। হয়তো ভাবছে এইটা আবার কেমন পাগল!
বিষয়টা যেমনি অসম্মানজনক, তেমনি বেশ বিব্রতকর। তাই ফটাফট দোকানদারকে টাকাটা দিয়ে উঠে চলে আসলাম। বন্ধুরা বলে যে দুঃশ্চিন্তায় সিগারেট নাকি খুব কাজে দেয়। তাই আজ একটা পরীক্ষা হয়ে যাক। প্রথম টানে খারাপ লাগলেও এখন ভালো লাগছে খুব। দুই টানেই নেশা ধরে গেছে। ভালো লাগতে শুরু করলো। অতঃপর রাতের বাকি অংশে আরো ছয়টা খেয়ে ফেললাম। নিজেকে বিরাট কিছু মনে হচ্ছে। কথা তাহলে মিথ্যে নয়!

রাত প্রায় শেষ হয়ে সকাল হতে চললো। এখন বাড়ির পথ ধরা উচিত। বড় ফুপির হাতে কোনো ভাবেই ধরা খাওয়া চলবে না। তাই দ্রুততার সাথে বাড়ি পৌঁছে গেলাম। রুমে এসে হালকা ধাক্কা দিতেই দরজাটা খুলে গেল। রুমের ভিতরে চোখ পড়তেই এক রাশ বিস্ময় ছেয়ে গেল আমায়। মেয়েটা তখনো বসে আছে। ঠিক পূর্বের মতো। আলতা রাঙ্গানো পা জোড়া শাড়ীর পাড় দিয়ে বেরিয়ে আছে। দরজাটা লক করে রুমে ঢুকেই ছোফায় শুয়ে পড়ি। ইচ্ছে করছিল মেয়েটাকে শুবার জন্য বলতে। তবে মুখ দিয়ে কথাটা বের হলো না। সারা দিনের ক্লান্তি ও সারা রাত্রির নির্ঘুমতায় শরীরটা নেতিয়ে পড়েছে। খুব দ্রুতই গভীর ঘুমে আচ্ছন্য হয়ে পড়ি আমি। অনেক বেলা করেই ঘুম ভাঙে আমার। বেলা ঠিক না, তখন প্রায় দুপুর হয়ে এসেছে। বড় ফুপি এসে ডাকা ডাকি করে একদম হাঙ্গামা করে ফেলে। উনার চ্যাঁচামেচিতেই ঘুম ভাঙলো। মেয়েটা তখন খাটে নেই। হবে হয়তো আশে পাশে কোথাও। সেদিকে আর মন দিলাম না। উঠে ফ্রেশ হয়ে খাওয়া দাওয়া করে নিলাম। মেয়েটা তখন বাড়ির টুকিটাকি কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।

খেয়ে দেয়ে আবারও বেরিয়ে পড়ি আমি। এবার আর রেলস্টেশন নয়। সোজা চলে গেলাম তৌকিরের বাসায়। রুমে ঢুকেই ওর সিগারেটের বক্স থেকে একটা সিগারেট নিয়ে জ্বালিয়ে টানতে থাকি। তৌকির চোখ জোড়া বড় বড় করে চেয়ে আছে আমার দিকে! হয়তো ভাবছে, যেই ছেলেটাকে দশ বছর একসাথে চলার পর হাতে সিগারেট ধরাতে পারলাম না, ঐ ছেলে আজ! ব্যাপারটা যেমনি বিস্ময়কর, তেমনি রহস্যজনকও বটে। তৌকির তার রহস্যময় চাহনিটা নিয়ে বলে, ‘কাল রাতে কোথায় ছিলি?’ প্রশ্ন শুনে একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যাই আমি। তবুও নিজেকে সামলে নিয়ে বলি, কোথায় ছিলাম মানে? ঘরে, আবার কোথায়! কথাটা তৌকির বিশ্বাস করেছে বলে মনে হয় না। ও আমার দিকে খুটিয়ে খুটিয়ে তাকাতে তাকাতে বলে, ‘এই প্রথম দেখলাম যে বাসর রাতে বউ তার সদ্য বিবাহিত বর কে সিগারেট খাইতে শিখায়! তুই কী আমাকে বলদ পাইছস? হাছা কইরা ক, কই ছিলা কাল?’ তৌকিরের কথা গুলিতে দৃঢ়তার সুর। খানিকটা সময় চুপ থেকে ও-ই আবার বলে, ‘বিয়ার খাবি?’ বিস্ময় নিয়ে বলি আমি, এখানে? তোর বউ কিছু বলবে না?

তৌকির কিঞ্চিত্ হেসে বলে, ‘বউ থাকলেতো বলবে! কাল তোর বিয়ে থেকে এসেই বাবার বাড়ি চলে গেছে। শরীর খারাপ লাগছিল নাকি। তোর ভাবি আবার খুব ভালো মানুষ। শরীর খারাপ লাগলে সোজা বাবার বাড়ি। আমি একটু হেসে বলি, খারাপ নয় বৈকি। তা বিয়ার কৈ? কিসের অপেক্ষা আর? তৌকির বিয়ার নিয়ে অসে। আমি ডগ ডগ করে কতখানি খেয়ে নিলাম। তৌকির একটু একটু করে খাচ্ছে। অনেকটা সময় পর কথা বলে তৌকির, ‘এবার সত্যি করে বল, কাল কোথায় ছিলি? বউ পছন্দ হয় নাই?’ বিয়ারে নেশা ধরে না। তবে মনে হয় আমার ধরেছে। তাই তৌকিরের প্রশ্নে ফর ফর করে সব সত্য বলতে থাকি, কাল ছিলাম ট্রেন স্টেশনে। খুব সুন্দর জায়গা। তারপর কিছুটা সময় থেমে আবার বলতে থাকি, ‘বউ! বউ পছন্দ হবে না কেন রে? চাঁদের মতো মেয়ে।

আমার তো আফসোস লাগে। এই মাইয়াটারে আমার কাছে কেন বিয়ে দিল? ভালো একটা বর পেলে, মেয়েটা বাসর রাতেই কত আদর সোহাগ পেত। আর এখন! এখন পাবে শুধু অবহেলা, একাকিত্ব ‘ কথাগুলো বলে আবারও ডগ ডগ করে খানিকটা বিয়ার খেয়ে নিলাম। তৌকির বিস্ময় নিয়ে চেয়ে আছে আমার দিকে। অনেকটা সময় পর, ও আমার হাতে হাতটা রেখে বলে, ‘যে মেয়েটা তোকে ছেড়ে চলে গেল। তাকে তুই ভালোবাসিস। আর যে মেয়েটা তোরজন্য, শুধু তোর অপেক্ষায় আছে, তাকে কষ্ট দিচ্ছিস! খুব বোকা রে তুই।’ তৌকিরের কথা শুনে অবাক না হয়ে পারি না। আসলে আমাকে কেউ বুঝে না। আমার অনুভূতি কেউ বুঝতে চেষ্টাও করে না! খুব রাগ হল আমার। উঠে চলে আসলাম।

রুমে শুয়ে ছিলাম। লম্বা একটা ঘোমটা টেনে মেয়েটা খাটের একটা কোণে এসে বসে। চোখ জোড়া তার অন্যদিকে ফিরানো। মিষ্টি করে ছোট কন্ঠে বলে সে, ‘রাত্রিতে বাহিরে থাকতে আপনার নিশ্চয়ই অনেক কষ্ট হয়েছে। আর এমনটা করবেন না। আপনি বিছানাতে শুয়ে পড়বেন। আমি ফ্লুরেই থাকতে পারবো।’ কথাগুলো বলে মেয়েটা উঠে চলে যায়। আমি যেন কেমন গোলক ধাঁধায় গুলিয়ে যাচ্ছি। মেয়েটাকে শুধু শুধু কেন কষ্ট দিচ্ছি? তাতে কী আমি খুব সুখে আছি! তৌকিরের কথাগুলো খুব মনে পড়ছে। ‘আসলেই তো, যে চলে গেল তার জন্য কেন সে এ নিস্পাপ মেয়েটাকে কষ্ট দিবে! তার কী সে অাধীকার আছে?’ একদম নেই। ভাবনায় হারিয়ে যাচ্ছিলাম। গভীর থেকে গভীরে।

রাত তখন প্রায় বারোটা বাজতে চললো। ছাদে দাঁড়িয়ে আছি। বাড়িটা আজ একদম নীরব। বড় ফুপিও চলে গেছে। আকাশে চাঁদ তারা কিছু নেই। মেঘ জমে আছে। হয়তো বৃষ্টি আসতে পারে। সেই মেঘ করা কালো আকাশের দিকেই তাকিয়ে ছিলাম। তখনি পিছনে কারো উপস্থিতি অনুভব করি। ফিরে তাকাতেই দেখি মেয়েটা। মানে আমার বউ। মেয়েটার নামটা এখনো জানা হয় না। মিষ্টি মেয়ের নাম হয়তো মিষ্টিই হবে। যাইহোক, সেদিকে আর গেলাম না। মেয়েটার দিকে দৃষ্টি দিতেই কোমল কন্ঠে বলে উঠে সে, ‘দুঃখিত, আপনাকে বিরক্ত করতে আসিনি। শুধু বলতে এসেছি যে, আমি ফ্লোরে শুয়ে পড়ছি। দয়া করে ঘরে চলে আসবেন।’ কথাগুলো বলে চলে যাচ্ছিল মেয়েটা। কিছু একটা বলার জন্য মনটা যেন কেমন আনচান করছিল। তবে মুখ ফুটে কিছুই বলতে পারছিলাম না। কেমন যেন মুখটা ধরে আসছে। মেয়েটা সিড়ি ঘরের চৌকাঠে পা রাখতেই মুখ ফসকে একটা কথা বেরিয়ে গেল, এই যে, শুনছেন? কথাটা শুনে আচমকা হচকিয়ে পিছনে তাকায় সে। তারপর পূর্বের মতোই কোমল কন্ঠে মিষ্টি করে হেসে বলে, ‘কিছু বলবেন?’

কিছু বলতে চেয়েও আবার যেন সব গুলিয়ে ফেলছিলাম। মেয়েটা অধির আগ্রহে আমার থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে আছে। অনেকটা সময় বহু সাধনার পর আমার মুখ ফুটে বেরিয়ে আসে কথাটা, ‘আচ্ছা, আপনার নাম কী? প্রশ্নটা করে নিজেকে নিজের কাছে বড্ড অসহায় লাগছিল। এ প্রশ্ন বড় বোকামীর। নিজের বউ এর নাম জিজ্ঞাসা করতেছি, তাও বিয়ের দ্বিতীয় দিন! এমন অকর্মা স্বামী ইতিহাসে না থাকাই ভালো। তবে মেয়েটার মাঝে তেমন কোনো বিস্ময় সূচক ভাব নেই। আমার দিকে এক পলক তাকিয়ে কিঞ্চিত্ মুচকি হেসে নামটা বলে সে, ‘মাধুবি লতা।’ নামটা ভারি সুন্দর। আমি একটু হেসে বলি, এ যে একদম কাব্যিক নাম! হুম। শুনেছি আপনি নাকি কবিতা লিখেন? হুম। মাঝে মাঝে। আমাকে একটা শুনাবেন?

মাধুবির এ আবদার শুনে আমি বিস্মিত না হয়ে পারি না। মেয়েটা কি সুকৌশলে তার অধীকার আদায় করে নিতে চাইছে? সে যাইহোক, আমার ভালো লাগছিল। এ মেয়ের মনটা সৃষ্টিকর্তা খুব সুন্দর করেই গড়ে দিয়েছেন। তার প্রতিটি কথা আমাকে গভীরভাবে টানে। সত্যি মাধুবির প্রতি কেমন একটা আকর্ষণ অনুভব করছি। মনে হচ্ছিল অচেনা অপরূপা কোনো রমণী। যার সাথে মন খুলে কথা বলতে মনটা আনচান করছিল। তবে অদৃশ্য এক বাধা সেখানে বাধ সাধছে। আমি সকল বাধা ছেদ করে এগিয়ে চলছি তার দিকে। অনেকটা সময় অপেক্ষা করে আমার কোনো প্রতি উত্তর না পেয়েই বিমর্ষ মুখে চলে যাচ্ছিল মাধুবি। ওর হয়তো এখন মনে হচ্ছিল, ও একটু বেশিই চেয়ে ফেলিছিল, যা ওর পাওয়ার নয়। কিছুটা পথ যেতেই আবারও পিছন থেকে ডেকে উঠি আমি, শুনেন। পিছন ফিরেই ভার কন্ঠে মাধুবি কথা বলে, ‘কি, বলেন।’ এদিকে আসবে একটু? কেন? কবিতা শুনবে না?

কথা শুনে মাধুবির মনটা হয়তো আনন্দে নেচে ওঠেছে। তবুও পিছু ফিরে আসছিল না। মনে হয় কিছু সংকোচ আর দ্বিধা কাজ করছিল অথবা অভিমান! আমিই ওর কাছে গেলাম। তারপর হাতটা ধরে ছাদের রেলিংয়ের কাছে এসে দাঁড়ালাম দু’জন। আমার হাতের স্পর্শে মেয়েটার পুরো শরীর শিহরিত হয়ে ওঠে। বিস্মিত নয়নে সে চেয়ে থাকে আমার দিকে। এ যেন ওর কাছে প্রত্যাশার চেয়েও অনেক বেশি। আমি ওর বিস্ময় মাখা লজ্জিত মুখের দিকে তাকিয়েই কবিতার কিছু লাইন আওড়াতে থাকি- লজ্জা কুমারী, লজ্জা পেলে তোমার রূপ যেন অগ্নিস্ফুলিঙ্গতে রূপ নেয়। যা ভস্ম করে দেয় আমার অন্তরের সব অনুভূতিকে। আমি দিশেহারা নাবিকের মত, শূন্যে তুলে দেই পাল। তোমার রূপ সুধা পান করতে করতে কেটে যায় অজস্র কাল।

তোমার নেশায়, আমি হারিয়ে যাই মহাকালের স্রোতে। জীবনের মাঝে খুঁজে পাই আরেক জীবন। তোমার লজ্জানুভূতিতে নিঃশেষ হব আমি। অনন্ত কালের জন্য নিয়াছি যে এই পণ। মেয়েটা নিশ্চুপ। অপলক চেয়ে আছে আমার দিকে। এবার যেন আমার লজ্জা লাগছিল। এভাবে কিছুটা সময় কাটার পর মাধুবি আমার দিকে তাকিয়ে মোহগ্রস্ত কণ্ঠে বলে, ‘অসম্ভব সুন্দর।’ তার বিস্ময় এর ঘোর তখনো কাটেনি। মুচকি হেসে আমিও ওর কথার প্রতিউত্তর দেই, তুমিও। মাধুবি মুখের বিস্ময় ভাব টা আরও ঘার করে বলে, ‘আমিও কী?’ অসম্ভব সুন্দর!

কথাটা শুনে ও একদম স্তব্ধ হয়ে থাকে। অনেক সময় এভাবেই বিমূর্তভাবে কাটাবার পর কন্ঠে কেমন একটা আকুতি নিয়ে বলে সে, ‘সত্যিই কী তাই ।’ আমিও যটফট উত্তর দিয়ে দেই, হ্যাঁ, সত্যি। মেয়েটা আর কিছু বলতে পারে না। লজ্জায় আরক্ত চেহারাটা নিয়ে অবনত মস্তকে চলে যাচ্ছিল। আমিও ওর পিছু গিয়ে ওর হাতটা ধরলাম। এক পরম প্রশান্তিতে ছেয়ে গেল আমার দেহ আর মন। হাতে হাত রেখে এগিয়ে চলি আমরা। এগিয়ে চলি স্বপ্নের পথে। যেখানে দুটি প্রাণ এক হওয়ার অপেক্ষায় থেমে আছে মহাকাল। সেই মহাকালেই আমাদের পথযাত্রা!

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত