ভার্চুয়াল প্রেম

ভার্চুয়াল প্রেম

ভার্চুয়াল জগৎ থেকে আমি মুক্তি চাই এ জগৎ আমার জন্য না। সিদ্ধান্ত নিলাম স্মার্ট ফোন বিক্রি করে দেবো তাহলেই মুক্তি পাবো। একবছর আগে ভার্চুয়াল জগৎ সম্পর্কে কিছুই জানতাম না। আমি ছিলাম গ্রামের সাধারণ এক মেধাবী মেয়ে। একবছর আগে, যেদিন আমার এসএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট দেবে সেদিন সকাল থেকে বুকের ভেতর কেঁপে কেমন যেন দম বন্ধ হয়ে আসছে। আব্বা কাজে না যেয়ে বারান্দায় বসে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। মা একমনে কোরআন পড়ছে।

ঘনিষ্ঠ বান্ধবী সুমি এসে বললো, ময়না বুকের ভেতর কাঁপছে বল?সুমিদের বাড়ি আমাদের বাড়ির পাশে সুমিও এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। আমাদের বাড়ি গ্রামে আব্বার অল্প জমি জায়গা আছে তা দিয়ে মোটামুটি ভাবে চলে যাই। আমরা দুই বোনই পড়াশোনায় ভাল।ছোট বোন অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। দুপুরে হেড স্যার হাঁকডাক করতে করতে আমাদের বাড়ি ঢুকলেন, কই গো আক্কাস মিয়া তোমার মেয়ে তো খুব ভাল রেজাল্ট করেছে। ছুটে যেয়ে জিগ্যেস করলাম, স্যার রেজাল্ট কি হয়েছে?

খুব ভাল রেজাল্ট করেছিস রে বেটি, গোল্ডেন প্লাস হয়েছে শুধু তাই না তুই চৌগাছা থানার থেকে একমাত্র গোল্ডেন প্লাস পেয়েছিস। আনন্দে আমার চোখে পানি এসে গেল। আব্বা আনন্দে চোখের পানি মুছে বললো,স্যার একটু বসেন আমি মিষ্টি কিনে আনি। না গো আক্কাস মিয়া আজ আর বসবো না খুব ব্যাস্ত। আরেকদিন এসে গোশ ভাত খাবো। মা তাড়াতাড়ি পিরিচে করে চিনি এনে স্যারের সামনে দিলো, স্যার এতো ভাল খবর একটু চিনি মুখে দিয়ে যান।

মা অনেক কষ্টে টাকা জমিয়েছে রাইস কুকার কেনবে মার খুব শখ, গ্রামে সবার ঘরে এখন রাইস কুকার। মা সেই টাকা বের করে আব্বার হাতে দিলো। ময়নার আব্বা তাড়াতাড়ি মিষ্টি কিনে আনো পাড়ায় মিষ্টি দিতে হবে। রাতারাতি আমার আব্বা কে সবাই সন্মান দিয়ে কথা বলতে লাগলো। কন্যা গর্বে আব্বা গর্বিত। আব্বা আমাকে কলেজে ভর্তি করে দিলো। নতুন কলেজে যাচ্ছি খুব ভাল লাগছে কিন্তু মনটা একটু খারাপ সুমি এ প্লাস পেয়েছে ওর আব্বা স্মার্টফোন কিনে দিয়েছে, আমারও খুব স্মার্টফোনের শখ হচ্ছে।

কিছুদিন পর আব্বা আমাকে ডেকে বলল,মা গো এতো ভাল রেজাল্ট করলে আমি তোমাকে কিছু একটু কিনে দেবো। বলো মা কি লাগবে তোমার? জামা না জুতো? আমি সাহস করে বলে ফেললাম আব্বা সুমির মতো একটা টাচ ফোন কিনে দিবা? mবাড়ি একটা ছাগল ছিলো সেটা বিক্রি করে কয়েকদিনে মধ্যে আব্বা যখন টাচ ফোন কিনে আমার হাতে দিলো মনে হলো আমি হাতে স্বর্গ পেয়েছি আনন্দে কেঁদে দিলাম। সুমির কাছ থেকে ফোনের সবকিছু শিখে নিচ্ছি। ময়না গ্রুপে এড করে দেবো?

সেটা আবার কি? বিভিন্ন গ্রুপ আছে সেখানে যারা সদস্য, তারা গল্প কবিতা এসব লিখে পোস্ট করে। অন্য সদস্যরা পড়ে লাইক কমেন্ট করে, খুব ভাল লাগে আর তুই তো স্কুল ম্যাগাজিনে কবিতা গল্প লিখতিস।দেখিস ভালো লাগবে। আচ্ছা ঠিক আছে এড করে দে আর আমি একটা কবিতা লিখছি পোস্ট কর, দেখি কেমন লাগে।

সাথে সাথে কবিতা লিখে সুমিকে দিলাম সুমি টাইপ করে পোস্ট করে দিলো। একটু পরে এপ্রুভ হলো।একটা করে কমেন্ট আসে সুমি জোরে জোরে পড়ে লাইক হলে সুমি চিৎকার করে বলে তিরিশ টা লাইক হয়েছে।কি যে আনন্দ লাগলো কেমন একটা নেশার মতো হয়ে গেল।সুযোগ পেলেই গল্প কবিতা লিখে পোস্ট করি। পড়াশোনার পাশাপাশি লেখালেখি করি। ভাল ছাত্রী তাই স্যারেদের নজর আমার দিকে,যথেষ্ট ভালোবাসা ও পাচ্ছি কলেজে নতুন কিছু বন্ধু হয়েছে সব মিলিয়ে খুব ভাল সময় পার করছি। হুমায়ুন কবির অপু নামের একটা ছেলে আমার প্রতিটি কবিতা গল্পে সুন্দর সুন্দর কমেন্ট করে।কমেন্টের রিপ্লাই দিতে দিতে মনে হতো অনেক আপনজন। তারপর একদিন দেখি ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছে খুশি হয়ে একসেপ্ট করলাম।ইনবক্সে টুকটাক কথা হয়। আস্তে আস্তে ইনবক্সে কথার পরিমাণ বেড়ে গেল।

প্রতিদিন শুভ সকাল বলে অপুর সাথে ম্যাসেজ দেওয়া শুরু হতো আর সারাদিন কি করছি আমার কি ভালো লাগে অপুর কি ভালো লাগে বিভিন্ন রকমের কথা ম্যাসেজ করি, শুভ রাত্রি দিয়ে ম্যাসেজ করা শেষ হতো।ম্যাসেজ করে জানতে পারলাম অপুদের বাড়ি ময়মনসিংহ, অনার্স পড়ে।আমি ও আমার কথা জানালাম। আমার ফোন নম্বর অপু কে দিয়েছি, অপুর নম্বর ও আমাকে দিয়েছে এক দুবার ফোনে কথা বলেছি কিন্তু ম্যাসেজ করতেই বেশি ভালো লাগে।

অপুর সাথে এতো পরিমাণ ম্যাসেজে জড়িয়ে পরেছিলাম রিপ্লাই দিতে একটু দেরি করলে রাগ হতো কষ্ট হতো।হঠাৎ আবিস্কার করলাম শুধু মাত্র ম্যাসেজ দেয়া নেয়া করতে করতে অপুকে আমি গভীর ভাবে ভালবেসেছি। মনের কথা মনে চেপে রেখেছি। কিছুদিন পর ম্যাসেজ করে অপু জানাল,ময়না আমি তোমাকে ভালবাসি।মনে মনে আমি তোমার নাম দিয়েছি প্রিয়া, তুমি আমার প্রিয়া। ম্যাসেজ পড়ে এতো আনন্দ হলো মনে হচ্ছে পৃথিবীতে আমার মতো সুখী আর কেউ নেই আনন্দে বারবার চোখে পানি আসছে।

আমার পড়াশোনা, গল্প, কবিতা লেখা সব বাদ। সারাক্ষণ মোবাইলে অপুর সাথে ম্যাসেজ।ঘরের দরজা বন্ধ করে রাত জেগে পড়াশোনা বাদ দিয়ে অপুর সাথে ম্যাসেজ করি। আব্বা, মা মনে করে আমি রাত জেগে পড়ি।ক্লাস টেষ্টের রেজাল্ট খুব খারাপ হলো স্যারেরা অবাক হয়ে আমাকে বকা দিলেন।স্যারেদের কথা দিলাম এখন থেকে নিয়মিত পড়াশোনা করবো। কিন্তু পড়াশোনা করতে আমার একদমই ভালো লাগছে না।সামনে এয়ার ফাইনাল পরীক্ষা মন দিয়ে পড়তে হবে কিন্তু কিছুতেই মনোযোগী হতে পারছি না। অপু ম্যাসেজ করেছে আমার সাথে ভিডিও কলে কথা বলতে চায়।

গ্রামে ওয়াইফাই এর সুবিধা নেই এম বি কিনতে হয়।ম্যাসেজ করলাম এমবি কিনে রাখবো রাতে ভিডিও কল দেবো।আমার সারা শরীর রোমাঞ্চিত হচ্ছে বারবার খুশিতে কেঁপে কেঁপে উঠছি, পাঁচ মাস শুধুমাত্র অপুর প্রফাইল পিকচার দেখেছি। অপুও শুধুমাত্র আমার প্রফাইল পিকচার দেখেছে আজ প্রথম ভিডিও কলে একে অন্যকে দেখবো।

রাতে সবাই খাওয়া দাওয়া করে শুয়ে পড়ার পর আমি দরজা বন্ধ করে সুন্দর করে সাজুগুজু করে মাথায় ওড়না দিয়ে অপু কে ভিডিও কল করলাম।পর্দায় অপুর ছবি ভেসে উঠলো,অপু দেখতে মোটামুটি কিন্তু ও তখন আমার কাছে রাজপুত্র। অবাক কন্ঠে বললাম তুমি কি সুন্দর দেখতে! প্রিয়া আমার প্রিয়া, আমার প্রিয়া দেখতে এতো সুন্দর ! তুমি এতোটা সুন্দরী আমি কল্পনা করিনি, তুমি তো হিন্দি ছবির নায়িকাদের থেকেও সুন্দর। মাথায় কাপড় দিয়েছো কেন? ওড়না ফেলে দেও আমার প্রিয়া কে ভালো করে দেখি। আমি কেমন যেন ঘোরের ভিতর চলে গেছি, মাথার থেকে ওড়না ফেলে দিলাম।

অদ্ভুত সুন্দর তুমি! তোমার গলায় কি সুন্দর তিল! ইচ্ছে করছে তোমাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে তিলের উপর একটা চুমু দিই। আমার সতেরো বছরের জীবনে এই ভাবে কেউ কোনদিন বলেনি অন্যরকম মোহময় আবেশে হারিয়ে গেলাম কোন রকমভাবে বললাম শুভ রাত্রি। অদ্ভুত এক ভাললাগা নিয়ে সারারাত জেগে থাকলাম বারবার অপুর কথা কানে বাজছে।

এয়ার ফাইনাল পরীক্ষা শুরু হয়ে গেছে। খুবই খারাপ পরীক্ষা হচ্ছে সারাবছর পড়িনি কোন প্রশ্নের উত্তর দিতে পারছি না। কোনরকম ভাবে একঘন্টা পার করে খাতা জমা দিয়ে হল থেকে বেরিয়েই ম্যাসেজে অপুর সাথে গল্প করি।পরীক্ষা খারাপ হচ্ছে ফেল করবো এ নিয়ে আমার কোন মাথা ব্যাথা নেই। শেষ পরীক্ষার দিন অপু ম্যাসেজ করলো আজ রাতে ভিডিও কল করবে, আমি যেন এমবি কিনে রাখি। খুব সুন্দর একটা জামা পরে সাজুগুজু করে রাতে অপুর সাথে ভিডিও কলে কথা বলছি।

আমার প্রিয়া কে আজকে তো আরও বেশি সুন্দর লাগছে, কিন্তু প্রিয়া এই ভাবে তোমাকে দেখে জান ভরছে না একটু খোলামেলা পোশাকে স্ক্রিনে আসো আর খোলামেলা পোশাকে সেলফি তুলে আমার ইনবক্সে পোস্ট করো। আমি হতবাক হয়ে গেলাম।খোলামেলা বলতে কি বুঝাতে চাইছো অপু? আমি তো তোমার সামনে বোরকা পরে মাথায় ঘোমটা দিয়ে আসিনি যথেষ্ট খোলামেলা ভাবে এসেছি।

এই ভাবে না আরও খোলামেলা, সিনেমার নায়িকাদের মতো ওরকম ড্রেসে। নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছো আমি কি বলতে চাচ্ছি। আমার রাগে শরীর কাঁপতে লাগলো কোনরকম ভাবে বললাম বাই।সারারাত ঘুমাতে পারলাম না অপুর কথাগুলো মাথার ভিতর ঘুরপাক খাচ্ছে। নিশ্চয়ই কোন সমস্যা হয়েছে নাহলে অপু তো এভাবে কথা বলে না, মনে হয় আমাকে অনেক সুন্দর লাগছে এই দেখে ওর মাথা ঠিকমতো কাজ করিনি, সকালে অবশ্যই সরি বলবে।

সকালে ফোন হাতে নিয়ে দেখি অপু ম্যাসেজ করেছে,তোমার মতো ব্যাকডেটেড গেঁয়ো খ্যাত মেয়ের পেছনে আমি অনেক সময় নষ্ট করেছি আর না। তোমার মতো একটা গেঁয়ো ছেলে বেছে নিয়ে প্রেম করো। গুড বাই ময়না। ফোন হাতে হতভম্ব হয়ে বসে থাকলাম আমি বিশ্বাস করতে পারছি না অপু আমাকে ব্লক দিয়েছে! ফোবাইলে ফোন দিলাম সেখানও সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। অপু আমার সাথে ছলনা করেছে!এতো মিষ্টি মিষ্টি কথা প্রিয়া বলে ডাকা সবটাই অভিনয়?কিন্তু আমি তো সত্যিই অপুকে ভালবেসেছি।

আমার বুকের ভেতর টা দুমড়ে মুচড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে। সারাদিন গোসল খাওয়া বাদ দিয়ে ফোন হাতে বসে থাকলাম, হয়ত অপু ভুল বুঝতে পেরে ব্লক খুলে সরি বলবে।অপুর সাথে ম্যাসেজ করতে পারছি না আমার পৃথিবী সমস্ত রূপ ,রস, গন্ধ, আলো হারিয়ে অন্ধকার হয়ে আছে। সাত দিন অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে অপুর ম্যাসেজের অপেক্ষা করলাম।যখন বুঝলাম অপু আর যোগাযোগ করবে না তখন মনে হলো ফোনটা ছুড়ে ফেলে দিই। ভার্চুয়াল জগৎএর উপর ঘৃণা ধরে গেল।এই জগৎ থেকে আমাকে মুক্তি নিতেই হবে।এই জগৎ আমার কাছ থেকে মূল্যবান এক বছর কেড়ে নিয়েছে ,তার চেয়েও মূল্যবান আমার সত্যিকারের ভালবাসার সাথে প্রতারণা করেছে।

চোখের পানি মুছে বারান্দায় আব্বা বসেছিল আব্বার হাতে ফোনটা দিয়ে বললাম,আব্বা টাচ ফোন বিক্রি করে আমার বাটন ফোন কিনে দেও।ফোন না কিনে দিলেও সমস্যা নেই এই টাকা তুমি অন্য কাজে খরচ করো। আব্বা অবাক হয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললো, মা গো কি হয়েছে? এই ফোন তো তোমার অনেক শখের। শখের ছিলো আব্বা এখন আর নেই। সিদ্ধান্ত নিলাম ভার্চুয়াল জগৎ থেকে মুক্ত হয়ে মন দিয়ে পড়াশোনা করবো। সত্যিই কি মুক্ত হতে পারবো?

চুল আঁচড়ানোর জন্য আয়নার সামনে যেয়ে দাঁড়ালাম নিজের অজান্তে চোখদুটো গলার তিলের উপর যেয়ে আটকে গেল । কল্পনায় দেখি অপু পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে তিলের উপর চুমু দিচ্ছে, ঘৃণায় নাক মুখ কুঁচকে উঠল। মনে হচ্ছে একটা ধারালো ছুরি দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তিলটা তুলে ফেলি। মানুষের মন বড়ই বিচিত্র! এতো কিছুর পরও ঐ দৃশ্য কল্পনা করে প্রচন্ড ঘৃণার পাশাপাশি অদ্ভুত এক ভাললাগায় কোথায় যেন হারিয়ে গেলাম অসহ্য কষ্টে বুকের ভেতরটা নিষ্পেষিত হতে থাকে , এই কষ্ট থেকে আমার মুক্তি নেই।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত