উপসংহার

উপসংহার

ফারিহার মাথায় হাত রাখতে গিয়েও রাখলেন না আতাহার সাহেব। মেয়েটা বড্ড শান্তিতে ঘুমোচ্ছে;ঘুম ভাঙ্গানোর মানে হয় না। কালকে বরপক্ষ দেখতে আসবে তাকে। যদি পছন্দ হয়ে যায় তাহলে কয়েকদিন পর হয়ত বিয়ে হয়ে যাবে।ফারিহা চলে যাবে এ বাড়ি ছেড়ে। তখন কী আতাহার সাহেব দেখতে পারবেন তার মেয়ের মায়াবী চেহারা?একথা মনে হতেই শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেলো তার।

তিনি বারান্দায় চলে এলেন। ভেতরের রুমে তার স্ত্রী জেগে আছেন,পরের দিনের সব প্ল্যান মাথায় সাজিয়ে নিচ্ছেন। তার একমাত্র মেয়েটাকে ভালো দেখে একটা ছেলের হাতে তুলে দিতে পারলেই নিশ্চিন্ত। দক্ষিণ পাশের রুমে আতাহার সাহেবের ছেলে ঘুমিয়ে আছে। ছেলেটা অনেক দায়িত্ব নিতে শিখেছে। পুরো পরিবারটা নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে। আতাহার সাহেবের সবসময় ইচ্ছা হয় তার ছেলেকে সাহায্য করতে ;কিন্তু তার পক্ষে সেটা সম্ভব হয় না।সব সময় মানুষ যা ইচ্ছা করে তা করতে পারে না।এই ক্ষমতাটা সৃষ্টিকর্তা মানুষকে না দিয়ে নিজের কাছে রেখে দিয়েছেন।

বারান্দায় দাঁড়িয়ে জোছনা দেখতে দেখতে অন্যমনস্ক হয়ে গেলেন আতাহার সাহেব। তিনি কোথায় আছেন সেটা বুঝতে পারলেন না;মন্ত্রমুগ্ধের মত দাঁড়িয়ে রইলেন। এই সমস্যাটা তার মাঝে মাঝেই হয়,উনার তখন মনে হয় সময় ঘনিয়ে আসছে। কিসের সময়?অন্ধকার সময় নাকি আলোকিত সময়? সেটা উনি বুঝে উঠতে পারেন না। আতাহার সাহেব বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইলেন সূর্য উঠার আগ পর্যন্ত। অনেকদিন ধরে তিনি রাতে ঘুমান না। আশ্চর্যজনকভাবে পরিবারের কেউ এটা নিয়ে মাথা ঘামায় না।তার অবশ্য এজন্য কখনো খারাপ লাগে না। তিনি জানেন এটাই জগতের নিয়ম।

দুপুর ১২ টার দিকে ফারিহাকে দেখতে ছেলেপক্ষ আসলো।বিকাল ৪ টায় বিয়ের পাকা কথাবার্তা বলে চলে গেলো। কিন্তু কেউ আতাহার সাহেবের মত চাইলো না। এটা নিয়েও তিনি মন খারাপ করলেন না,কারণ তিনি জানেন এটাই জগতের নিয়ম। মেয়ের জন্য খুশিতে তার চোখে জল চলে আসলো। তিনি সৃষ্টিকর্তার কাছে শুকরিয়া আদায় করলেন। আগামীকাল ফারিহার বিয়ে। তাই আজকে গায়ে হলুদ দেওয়া হবে। এতে নাকি শরীরের ঔজ্জ্বল্য বেড়ে যায়। কিন্তু আতাহার সাহেবের মনে হলো এগুলা করার কোনো দরকারই ছিলো না। তার মেয়ে এম্নিতেই পরীর মত। তবুও পরিবারের বাকি সবাই সমাজের রীতিনীতি মানতে গিয়ে যথেষ্ট ধুমধাম করেই অনুষ্ঠান আয়োজন করেছে।

হালকা সবুজ শাড়িতে ফারিহাকে ভালোই মানিয়েছে। তার চেহারায় নিষ্পাপ একটা ভাব ফুটে উঠেছে। তার সারা মুখে,হাতে কাচা হলুদ মাখা। মেহেদী দেওয়ার কাজ শেষ হয়েছে কিছুক্ষণ আগে। এখন ফটো তুলা হবে। একে একে সব আত্মীয় স্বজন দল বেধে ফটো তুললেন। সবার শেষে ফারিহার একপাশে তার মা ও অন্য পাশে তার ভাই এসে দাড়ালেন ফটো তুলার জন্য। আতাহার সাহেবকে কেউ ডাক দিলো না। তবুও তিনি নির্লজ্জের মত তার স্ত্রীর পাশে এসে দাড়ালেন। বিয়েতে প্রায় হাজারের কাছাকাছি মানুষের খাবারের আয়োজন করা হয়েছে। মানুষজন তৃপ্তি নিয়ে খাচ্ছে।আতাহার সাহেব ঘুরে ঘুরে দেখছেন ;তার বড্ড ভালো লাগছে। কিছুক্ষণ পর মেয়ে তাকে ছেড়ে চলে যাবে সেই বেদনা তাকে এখনো গ্রাস করেনি মনে হচ্ছে। তিনি ঘুরে বেড়াচ্ছেন লক্ষ্যহীনভাবে।

তার মেয়েকে জামাইয়ের হাতে তুলে দেওয়ার সময়ও তিনি পাশে থাকলেন না।তিনি দাঁড়িয়ে রইলেন কমিউনিটি সেন্টারের ছাদে। সেখান থেকে রাস্তার সব গাড়ি দেখা যাচ্ছে। সেন্টারের সাম্নের ফুল দিয়ে সাজানো গাড়িটাতে ফারিহাকে উঠতে দেখে আতাহার সাহেব নিচে নেমে এলেন। তিনি নিচে নামতে নামতে গাড়ি রওয়ানা হয়ে গেছে।সেন্টারের সামনে উনার স্ত্রী ভেজা চোখে দাঁড়িয়ে আছেন;উনার ছেলে দাঁড়িয়ে আছে মায়ের হাত ধরে।

আতাহার সাহেব বরের গাড়ির পেছনে রওয়ানা হলেন।তিনি স্পষ্ট ফারিহাকে দেখতে পাচ্ছেন। মেয়েটা নিঃশব্দে কাঁদছে;তার স্বামী টিস্যু তুলে দিচ্ছে হাতে।সে টিস্যু হাতে নিচ্ছে ঠিকই কিন্তু চোখ মুছছে না। কিছুটা রাস্তা যাওয়ার পর ফারিহাদের গাড়ি রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে পড়লো। গাড়ি থেকে ফারিহা বেরিয়ে এলো সবার আগে,পেছনে তার স্বামী। ভারী লোহার গেট ধাক্কা দিয়ে ঢুকে পড়লো বাউন্ডারি ঘেরা এলাকায়। আতাহার সাহেব ভালোমতো তাকিয়ে বুঝলেন এটা কবরস্থান। তিনি ফারিহাদের পেছন পেছন গেলেন। কিছুদূর গিয়েই ফারিহা দাঁড়িয়ে পড়লো। সাম্নেই তার বাবার কবর। তার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়তে লাগলো।

ফারিহা অবিরত কাঁদছে। এখন শব্দ করেই কাঁদছে ;তার স্বামী কান্না থামানোর ব্যর্থ চেষ্টা করছে।আতাহার সাহেবের ভালো লাগছে না,এই আনন্দের দিনে পাগলী মেয়েটা কাঁদছে কেনো?উনি তো সারাক্ষণ তার পাশেই ছিলেন,এখনো আছেন। আতাহার সাহেব ফারিহার মাথায় হাত রাখলেন;হালকা বাতাসে ফারিহার মাথার অংশের শাড়িটা দুলে উঠলো। তার কান্নার গতি কমে আসছে।কিন্তু আতাহার সাহেবের চোখ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। উনার মনে হচ্ছে সময় চলে এসেছে,এখনই তিনি অচেনা জগতে আজীবনের জন্য চলে যাবেন।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত