নতুন জীবন

নতুন জীবন

এক অনাড়ম্বর পরিবেশেই অবশেষে সম্পন্ন হলো আমার বিয়ের কাজ। বরাবরই বিয়ের প্রতি আমার ফোবিয়া কাজ করতো জন্য জীবনের সাতাশটি বসন্ত একাই কাটিয়েছি। কিন্তু এবার আর তা সম্ভব হলোনা। আমার হবু শ্বাশুরিমা’র জন্যই সবকিছু ওত দ্রুত ঘটে গেলো।তিনি নাকি এ পর্যন্ত যত কনে দেখেছেন একমাত্র আমাকেই তার গুণধর পুত্রের বধু রূপে উপযুক্ত মনে করছেন। আমাকে না নিয়ে তিনি কিছুতেই আমার বাবার সামনে থেকে নড়লেন না। মনে প্রচণ্ড ভয় নিয়েই পাড়ি দিলাম শ্বশুরালয়ে। এখানেও তেমন আড়ম্বর নেই। তবে আমার মধ্যবিত্ত বাবার চেয়ে এদের অবস্থা বেশ ভালো বোঝা যাচ্ছে। হুট করেই সবকিছু হবার জন্য বাবা আমাকে তেমন কিছু দিয়েও দিতে পারেননি। সেসব নিয়েও ভয়ে ছিলাম না জানি এ বাড়িতে এসেই কি আনলাম না আনলাম তার হিসেব নিয়ে বসতে হয়!

প্রতিবেশীরা যে দু’চারজন নতুন বউ দেখতে এলেন তারা যখন জানতে চাইলো বউ বাপের বাড়ি থেকে কি নিয়ে এলো রে ইমুর মা? শ্বাশুরিমা কে দেখলাম তৎক্ষণাৎ উত্তর দিতে যেন তিনি উত্তর রেডি করেই রেখেছিলেন। তিনি বললেন,আমার ঘরে কিসের অভাব যে বউকে সব নিয়ে আসতে হবে? আর ও কিছু আনলেও তো আমার বাড়িতেই রাখতো তাতে তোদের কি লাভ হতো শুনি? কথাটা শুনে আমার ভেতরে প্রশান্তির সুবাতাস বয়ে গেলো। শ্বাশুরিমার দিকে তাকালাম তিনি স্নিগ্ধ একটা মুচকি হাসি আমায় উপহার দিলেন। ইমু অর্থাৎ ইমতি আমার বর। পরিবারের বড় ছেলে। ওর ছোট এক ভাই আর একবোন। বোনটা এইবার ভার্সিটিতে ভর্তি হলো। এই ই ওদের পরিবার। পরদিন সকাল বেলা দেখি শ্বাশুরিমা চা নিয়ে আমায় ডাকতে এসেছেন। এত ভরে উঠেও আমি রুম থেকে বেরোয়নি সেজন্য।

আমি উনার সাথে নিচে নেমে এলে তিনি বললেন, থাক আর লজ্জা পেতে হবেনা তোকে। আজকের পর থেকে তো তুই সব করবি আমার তৈরি চা কেমন তুই টেস্ট না করলে বুঝবি কিভাবে আমরা কিরকম পছন্দ করি? আর শোন,গতকাল থেকেই তো তুই আমার মেয়ে হয়ে গেছিস আর ছেলেমেয়েকে আমি তুমিটুমি বলতে পারবো না বুঝছিস? এভাবেই সময় গড়িয়ে চললো। সত্যি বলতে বাবার বাসার চেয়ে এখানেই আমার বেশি ভালো লাগে যদিও বেশি কাজ আমাকেই করতে হয় তবুও আমার দেবর ননদ বা শ্বাশুরি সবসময় আমাকে হেল্প করে এবং আমার পাশে থাকে। বাবার বাসা থেকেই মোটামুটি রান্না পারতাম আর এখানে শ্বাশুরিমা আমাকে সবটাই শিখিয়ে দেন। তিনি কখনোই আমাকে বলেননি এটা কেন করোনি? ওটা করলেনা কেন?

বরং তিনি আমাকে বলতেন, যাহ এখন এই কাজ টা এভাবে করে নিয়ে আয়তো দেখি। ইমতি তো সেই সকালে অফিস চলে যায় সারাক্ষণ তিনিই আমায় সংগ দেন। যেন তিনি শ্বাশুরি নন আমার বন্ধু। তিনি সবসময় আমার সাথে হাসিমুখে কথা বলতেন। আমি মন খারাপ করতে চাইলেও পারতাম না। এখানে আমার সম্পুর্ন স্বাধীনতা ছিল। তবে আমি কখনো তার মিসইউজ করতামনা। যখন যাই ই করতাম শ্বাশুরিমা দেখিয়ে বা জানিয়েই করতাম। একদিন তিনি আমাকে বললেন,পড়াশোনা তো শেষ চাইলে জব ও করতে পারিস তবে আমার কিন্তু কিছুরই অভাব নেই। আমি বললাম, জবের চেয়ে আমি আপনার সংগ টাকেই বেশি উপভোগ করবো। তিনি খুশি হলেন।

—আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারতাম না এসব কি সুখের আভাস নাকি দুঃখের পূর্বাভাস? শ্বাশুরিমা কিভাবে যেন আমাকে পড়ে ফেললেন আর বললেন,শোন মেয়ে তুই এতদিন কেন বিয়ে করতে চাইতিস না তা তোর মায়ের থেকে সব শুনেছি আমি। তোকে কিছু কথা বলি শোন, আমাদের সমাজে শ্বাশুরি,ননদ,পুত্রবধূসবাই নিজস্ব ক্ষমতা দেখানো টাকে একটা ট্রেন্ড বানিয়ে ফেলেছে। ছেলেমেয়ে যতদিন মায়ের কাছে ততদিন তারা ভীন্ন এক জগতে থাকে। বিয়ের পর প্রত্যেকেরই আলাদা একটা জগত হয়ে যায়। সেক্ষেত্রে আমি তোর আর তুই আমার জগতে অনধিকার প্রবেশ করতে চাইলেই ঝামেলা টা বেধে যায়।

—তোকে নিয়ে যখন তোর মা এসব বিষয়ে তোর ভয়ের কথা বলছিল তখনি সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে কোন মূল্যেই হোক এই মেয়ে আমার চাই ই চাই।

এই যেমন ধর,আমার ছেলে এখন তোর বর। আমি যদি আমার ছেলেকে এখনো আমার ছেলে হিসেবেই চলতে শেখাই তোর বর হিসেবে দায়িত্ব না শিখতে দেই সেক্ষেত্রে আমার শ্বাশুরিত্ব টা হয়তো খুব বজায় থাকতো কিন্তু তোর? তুইও তখন নিজের বউ হবার ক্ষমতাটা আমার উপর দেখাতে চেষ্টা করতিস। উভয়ের মাঝে যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা কাজ করতো তা সংসারে কখনোই সুখ বয়ে আনতোনা। অথচ এখানে দেখ আমি তোকে ভালোবাসি বিনিময়ে তুইও আমাকে ভালোবাসতে বাধ্য হোস,বাধ্য হোস বললাম জন্য মন খারাপ করিসনা আবার। একারনেই বললাম যে তোর ভেতরে যে ভয়টা কাজ করেছে এতকাল তা কিন্তু খুব সহজে যাবার নয়। আমি কখনোই শ্বাশুরি হতে চাইনি তোর মা হয়েই থাকতে চেয়েছি। আশা করি তুই আমাকে বুঝতে পেরেছিস। শ্বাশুরিমার গলা জড়িয়ে বললাম,মা আমিও জীবনে শ্বাশুরি চাইনি বা বউ হতে চাইনি বরাবরই মেয়ে হয়ে থাকতে চেয়েছি আর সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে খুব ভালোভাবে জীবন কাটাতে চেয়েছি।

ঠিক এমন সময় পেছন থেকে ইমতি বলে উঠলো, বাহ বাহ এই মা আর মেয়ে দেখছি আমাদের কে ভুলে নিজেদের গল্পেই বিভোর হয়ে উঠলো। বাবা তুমি কি এদেরকে কিছু বলবে? ভেতর থেকে শ্বশুর আব্বা বলে উঠলেন,ইমতি কিন্তু কোথাও ঘুরতে নিয়ে যাসনা তাই বলবো নেক্সট উইক নরওয়ে ট্যুর এ যাবো সবাই রেডি থাকিস। আমার ঘোর যেন কাটতেই চায়না সত্যিই আমি স্বপ্ন জগতে বাস করছি মনে হচ্ছে। তবে একটা জিনিষ খুব ভালোভাবে উপলব্ধি করলাম, প্রতিটি মানুষেরই নিজস্ব সম্পর্কটাকে সম্মান দেয়া উচিৎ। লোভে পড়ে মাথার উপর বেশী বোঝা নিতে গেলে কোনকিছুই সঠিকভাবে সম্পন্ন হয়না বরং সংসারে অশান্তি নেমে আসে।

এখন আমার ননদ দেবর দুজনই বাসায় এসে আমার সাথে রাজ্যের গল্প জুড়ে দেয়। সবাই যেন এক অন্তপ্রাণ হয়েই বাঁচতে এসেছি আমরা। বিয়ের একবছর পর ইমতি কে জানালাম ঘরে নতুন অতিথি আসার খবর টা। ওকে জানাতে দেরি হলেও ওর মারফত বাসার সবার জানতে বিন্দুমাত্র দেরি হলোনা। সবাই তো আমায় তখন প্রায় মাথায় তুলে রাখে। আমার যতটুকু সাধ্যে কুলোয় সংসারের ততটুকু কাজ ই আমি করি অবশ্য তা নিয়ে ওদের কারো বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই। শ্বশুর আব্বা আর শ্বাশুরিমার চেয়ে ইমতি আর ওর দু’ভাইবোন আমার দিকে সারাক্ষণ খেয়াল রাখে। ছেলে হবে না মেয়ে হবে। নাম রাখা নিয়ে তিন ভাইবোনের তো খুনসুটি তো লেগেই থাকে। তারপর এলো সেই অপেক্ষার পালা শেষ করে সেই দিন। আমি ওটি তে ঢোকার আগ মুহুর্তে ওদের সবার সে কি কান্না! যেন আমার চেয়ে ওদেরই কষ্ট হচ্ছে বেশি।

হাসপাতালের ডাক্তার রাও কনফিউজড হয়ে গেছেন কোন টা আমার বাবার বাড়ির লোক আর কোনটা আমার শ্বশুর বাড়ির লোক। অবশেষে সুস্থ ভাবেই আমার মেয়ে এলো দুনিয়ায়। দু’বাড়ির সবাই মেয়েকে নিয়ে মেতে উঠলো আর এদিকে ইমতি ভেতরে এসে আমার পাশে বসে কপালে হাত রাখলো। আমার মনে হতে লাগলো বৃথাই এতদিন ভয় পেয়েছি। অথচ এদের ভালোবাসায় আমার কাছে শারীরিক কষ্ট টা খুবই সামান্য মনে হচ্ছে।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত