হঠাৎ দেখা

হঠাৎ দেখা

ট্রেন থেকে কমলাপুর স্টেশনে নামল স্নেহা। রাত অনেক হলো। সম্পূর্ণ নিস্তব্ধ স্টেশন। আশেপাশে হাতেগোনা কয়েকজন লোক ছাড়া আর কেউ নেই। ওরা স্নেহার সাথে ট্রেন থেকেই নেমেছে। নিস্তব্ধ রাতের হালকা বাতাস স্নেহার শরীর জুড়ে স্নেহের পরশ মাখিয়ে দিচ্ছে। মাঝেমাঝেই হিম বাতাস কাঁপিয়ে দিচ্ছে শরীর। পূর্ণিমার রাতের গোল চাঁদ যেন আকাশজুড়ে বিরাজ করছে। স্নেহা সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। কোম্পানীর গুরুত্বপূর্ণ কাজে কমলাপুর গ্রামে আসতে হলো ওকে।

এত রাতে আসা উচিত হয়নি। গ্রাম্য পরিবেশে এত রাতে কোনো সঙ্গী পাওয়াও মুশকিল। তারউপর মেয়েমানুষ। কত আপদ-বিপদ আছে। কিন্তু কমলাপুর স্টেশনের ট্রেন রাতেই আসে। রাত ১০টার দিকে বাড়ি থেকে বের হয় স্নেহা। তার মা-বাবা বাড়িতে থাকে। মা-বাবাকে এই কাজের কথা জানায়নি সে। জানালে নিশ্চিত যেতে দিত না। অবশ্য কাজটা একপ্রকার বাধ্যতামূলক এবং লাভজনক। কাজটা না করলে হয়তো তার চাকরিটাই থাকত না। তাই ১০টা ৩০মিনিটের ট্রেনে রওনা দেয় সে।

হাতের ঘড়িতে তাকাল স্নেহা। রাত ১২টা বেজে ৩৭মিনিট। এত রাত হয়ে যাবে সে আগে থেকেই জানত। আশেপাশে তাকাল সে। কয়েক মুহূর্ত আগে যে লোকগুলো ছিল তারা এখন আর নেই। বলতে গেলে পুরো প্ল্যাটফর্মই ফাঁকা। কোথায় যাবে, কি করবে কিছুই বুঝছে না স্নেহা। অবশ্য যদি সকালের দিকে এইরুটে যাতায়াত ব্যবস্থা থাকত তবে কোনো সমস্যা হতো না। তারউপর কোম্পানীর আর্জেন্ট কল। এখনই নাকি রওনা দিতে হবে। কাল সকালেই একটা ইম্পরটেন্ট মিটিং আছে। তাই রাতেই বেরোতে হলো। নাহলে আবার সকালে উঠে তাড়াহুড়ো করতে হতো। অবশ্য সকালে অন্য রুটে কোনোভাবে এলেই ভালো হতো। এভাবে দিশেহারা হতে হতো না। এখন বড় সমস্যায় পড়েছে স্নেহা। কিছুই করার নেই। রাত কাটানোর আশ্রয় খুঁজতে হবে।

হাঁটতে হাঁটতে প্ল্যাটফর্ম ত্যাগ করে গ্রাম্য পরিবেশে প্রবেশ করল স্নেহা। ঘন অন্ধকারের মাঝে হালকা চাঁদের আলো আর তীব্র ফ্ল্যাশলাইটের আলোয় এগিয়ে চলেছে সে। আশেপাশে বিরাট দৈত্যের মতো গাছপালা, ফাঁকা রাস্তা, নীরব পরিবেশ। মাঝেমাঝেই কিছু পোকামাকড়ের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। হঠাৎ হঠাৎ আসা রাতের হিম হাওয়াগুলো কাঁপন ধরিয়ে দিচ্ছে শরীরে। কিছুদূর যেতেই স্নেহার নজরে পড়ল কয়েকফুট দূরে বাঁশগাছের আড়ালে বেশ বড় এক দোকান। সেখান থেকে বেরিয়ে আসছে আবছা হারিকেনের আলো। স্নেহা তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে দোকানটার সামনে গেল। এতরাতে গ্রাম্য পরিবেশে এমন দোকান পাওয়া মুশকিল।

বেশ বড় একটা চায়ের দোকান। বাইরে কিছু টেবিল রাখা। লোকজন সেখানে বসেই চা নাস্তা করে। কিন্তু এতরাতে দোকান খোলা রাখার মানে কি? এতরাতে কি কেউ চা খাবে? সারা গ্রাম এখন ঘুমের রাজ্যে। আর এই দোকানের মালিক কিনা এখনো জিনিসপত্র গুছিয়ে নিচ্ছেন। অবশ্য ভাগ্য ভালো। এতরাতে একজনকে হলেও তো পাওয়া গেল। দোকানি বয়স্ক ব্যক্তি। জীবনের শেষ পর্যায়ে চলে এসেছেন। কিন্তু তারপরও কি সুন্দর তাড়াতাড়ি নিজের কাজ করে যাচ্ছেন। অলসতা ভাবটা নেই। এই বৃদ্ধ বয়সেও অনেক কর্মঠ তিনি। পরনে একটা গেঞ্জি আর লুঙ্গি। হঠাৎ ঘুরে তাকালেন তিনি। যেন স্নেহার উপস্থিতি টের পেয়েছেন।

:- কিছু কি লাগবে, মা? (মিষ্টি গলায় বললেন তিনি) কথা শুনেই বোঝা গেল- ভদ্রলোক।
:- না, কাকা। তেমন কিছুই না। শুধু একটু থাকার জায়গা পেলে ভালো হতো। (বিনয়ী সুরে বলল স্নেহা)
:- এতরাতে এখানে কেন এলে, মা? কোনো কাজ ছিল? (অবাক হয়ে প্রশ্ন করলেন বৃদ্ধ)
:- হ্যাঁ, কাকা। অনেক বড় একটা কাজ আছে। কাল খুব ভোরেই। অনেক দূর থেকে এসেছি আমি। সকালে যাতায়াতের সুবিধা না থাকায় রাতে আসতে হলো। (স্নেহা)

:- রাতে তো এলে। কিন্তু থাকবে কোথায়? কোনো ব্যবস্থাতো করোনি। এভাবে আসা কি উচিত হলো? কোনো থাকার জায়গা ঠিক না করে হুট করে চলে আসা। তারউপর এতরাতে তুমি একা মেয়েমানুষ। যদি বিপদ হয়ে যেত? (বৃদ্ধ)
:- আসলে কোম্পানী থেকে ফোন আসার সাথে সাথেই বাড়ি থেকে বের হয়ে যায় আমি। অতকিছু আর খেয়াল ছিল না। মাথা কাজ করছিল না। উপরন্তু কোম্পানীর বাধ্যগত কাজ। না এসেও উপায় নেই। (স্নেহা)

:- যাই হোক, এরকম গ্রাম্য পরিবেশে এতরাতে কোনোদিনও এসো না। পারলে একজনকে সাথে নিয়ে এসো। কিন্তু একা কোনোদিনও নয়। (বৃদ্ধ)
:- আচ্ছা, কাকা। (স্নেহা)
:- কিছু খাবে? (বৃদ্ধ)
:- না, কাকা। একদম ক্ষিধে নেই। তবে ভীষণ ঘুম পাচ্ছে। একটু ঘুমোতে পারলে ভালো হতো। (স্নেহা)
:- ঘুমোবে পরে। আগে নাস্তা করবে। আমার দোকানে এলে কেউ না খেয়ে যেতে পারে না। (বৃদ্ধ)
:- আচ্ছা, কাকা। কাল সকালে খাবো। (স্নেহা)
:- না, না। তা হচ্ছে না। এখন এক কাপ চা অন্তত খাও। (বৃদ্ধ)
বৃদ্ধ লোকটার ব্যবহার, চালচলন, কথাবার্তা স্নেহার বেশ ভালো লাগলো। তাই অনুরোধে আর মানা করতে পারেনি।

:- আচ্ছা, কাকা। আপনি যখন বলছেন, তখন এক কাপ চা নাহয় দিয়েই দিন। (শেষমেষ রাজি হলো স্নেহা)
:- বসো। একটু গরম করে দিই। (বৃদ্ধ)
:- আচ্ছা। (এই বলে সামনের একটা টেবিলে বসল স্নেহা) বৃদ্ধ দোকানি চা গরম করতে দিলেন।
:- আচ্ছা মা, তোমার নাম কি? (হঠাৎ প্রশ্ন করে উঠলেন বৃদ্ধ দোকানি)
:- স্নেহা। (জবাব দিল স্নেহা)
:- বাহ! ভারী সুন্দর নাম। ‘স্নেহা’ নামের অর্থ কি জানো? (বৃদ্ধ)
:- নাতো। (স্নেহা)
:- ভাগ্যবান। তবে তুমি কিন্তু ভাগ্যবতী। (বৃদ্ধ)
:- কীভাবে? (স্নেহা)
:- সেটা পরেই বুঝবে। (বৃদ্ধ) স্নেহা কিছুই বুঝল না।

:- আমার রাত এই দোকানেই কাটে। (বৃদ্ধ) এই বলে মেঝেতে কাঁথা রাখলেন তিনি। সুন্দর করে বিছানা তৈরি করে বললেন,
:- মা, আজ রাত তুমি এখানেই ঘুমিয়ে পড়। আমি নাহয় টেবিলেই ঘুমাব।
:- না কাকা, আপনি ওখানেই ঘুমিয়ে পড়ুন। আমি টেবিলে ঘুমোতে পারব। (স্নেহা)
:- পারবে তো? (বৃদ্ধ)
:- হ্যাঁ কাকা। আচ্ছা, আপনার নাম কি? পরের বার এলে আপনার সঙ্গে দেখা করে যাব। (স্নেহা)
:- সবাই আমাকে মতিন কাকা বলেই ডাকে। (বৃদ্ধ)
:- ওহ আচ্ছা। (স্নেহা)
:- চা টা খেয়ে নাও। (চায়ের কাপ এগিয়ে দিয়ে বললেন মতিন কাকা) স্নেহা হাতে তুলে নিল কাপটা।

এদিকে মতিন কাকা চারটা বড় বড় টেবিল সংযুক্ত করে বিছানার মতো করে তৈরি করলেন। তারউপর দিলেন একটা কাঁথা। তারপর বললেন,

:- নাও। তোমার বিছানা তৈরি।
:- ধন্যবাদ কাকা। (চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলল স্নেহা)

ভীষণ ঘুম পাচ্ছে তার। ঘুমে জড়িয়ে আসছে চোখ। তাড়াতাড়ি চায়ের কাপ শেষ করে বিছানায় শুয়ে পড়ল স্নেহা। মতিন কাকাও নিজের জায়গায় শুয়ে পড়লেন। স্নেহা চায়ের কাপটা পাশে রেখে তলিয়ে গেল ঘুমের রাজ্যে।
ভোরে পাখির ডাকে ঘুম ভাঙল তার। চোখ কচলাতে কচলাতে উঠে পড়ল সে। ঘড়িতে তাকিয়ে দেখে এখনো অনেক দেরী। তারপর পাশে তাকায়। আশ্চর্য! তারপাশে শুধুই গাছপালা। আর সে পড়ে ছিল মাটিতে। জঙ্গলে চলে এসেছে স্নেহা। কিন্তু এমনটা হলো কি করে? তারপাশে পড়ে আছে সেই খালি চায়ের কাপ। কিন্তু মতিন কাকা আর তার দোকান কই? স্নেহা তাড়াতাড়ি জঙ্গল থেকে বেরিয়ে গেল। পথে একজন মধ্যবয়স্ক লোকের সাথে তার দেখা হয়।

:- আন্কেল, জঙ্গলের ওখানে যে চায়ের দোকানটা ছিল ওটা কোথায়? (স্নেহা লোকটাকে প্রশ্ন করল)
:- কিসের দোকান? (অবাক হয়ে প্রশ্ন করে লোকটি)
:- চায়ের দোকান। (স্নেহা)
:- চায়ের দোকান? (এবার আরো অবাক হয়ে যায় লোকটি)
:- জ্বি। মতিন কাকার। (স্নেহা)
:- কি বলছো তুমি এসব? তোমার মাথা ঠিক আছে তো? মতিন কাকা তো সেই কবে মারা গেছেন। (লোকটি)
:- কি? কিভাবে? (হঠাৎ মাথা ঘুরে ওঠে স্নেহার)
:- একবার দোকানে আগুন লেগে পুরে ছাড়খাড় হয়ে যান তিনি। তবে তিনি অনেক সৎ ও ভালো মানুষ ছিলেন। গ্রামের পরিবেশ আর তার দোকানের মায়া হয়তো এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেননি। তাই মাঝেমাঝেই লোকজন তার দেখা পায়। তবে যে তার দেখা পায় তার জীবনে সৌভাগ্য ফিরে আসে। তুমি নিশ্চয় পেয়েছ। তাই না? (লোকটি)

:- জ্বি। (স্নেহা)
:- তুমি অনেক সৌভাগ্যবতী। তোমার জীবনে সৌভাগ্য ফিরে আসতে আর দেরী নেই।

তৈরি থেকো। আচ্ছা, আসি তাহলে। (এই বলে লোকটা নিজের গন্তব্যে পা বাড়ালেন) পাথরের মতো স্তব্ধ হয়ে যায় স্নেহা। তার মাথায় যেন বাজের আঘাত পড়ে। সে ভাবছে, এ কি হলো? হঠাৎ কার সাথে দেখা হলো তার? এক অশরীরীর? সৌভাগ্যের কথা তার মাথায় আসছে না। সে শুধু ভাবছে মতিন কাকার কথা। তখনই মনে পড়ল চায়ের কাপের কথা। স্নেহা দৌড়ে আবার জঙ্গলে প্রবেশ করল। গতকাল রাতে যে জায়গায় এসেছিল সে জায়গায় এসে দাঁড়ালো। আর চায়ের কাপটা খুঁজতে লাগলো। কিন্তু সেটা আর পাওয়া যাচ্ছে না। কিছুক্ষণ আগেই তো ছিল। এখন আবার কই গেলো? কি আজব!!

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত