১০১. মুক্ত সেনাপ্রধান:
জেনারেল জিয়াকে মুক্ত করবার দায়িত্ব ছিল হাবিলদার হাইয়ের। তিনি ২০/৩০ জন সিপাই নিয়ে জিয়ার বাসভবনে যান। তারা স্লোগান দিতে দিতে আসেন কর্নেল তাহের লাল সালাম, জেনারেল জিয়া লাল সালাম ক্যান্টনমেন্টের পরিস্থিতি এমন যে কে কখন কাকে আক্রমণ করবে, হত্যা করবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। খালেদ মোশারফের নির্দেশে যে ক্যাপ্টেন হাফিজুল্লাহ জিয়াকে বন্দি করে রেখেছিলেন, এতগুলো সৈনিককে শ্লোগান দিতে দিতে আসতে দেখে ভয় পেয়ে যান তিনি। দ্রুত সরে পড়েন সেখান থেকে। জিয়াকে বন্দি করে রাখা গার্ড দলের মধ্যেও তখন আছে সৈনিক সংস্থার লোক। ফলে বিনা বাধায় হাবিলদার হাই পৌঁছে যান জিয়ার বাসভবনে। ঘরের ভেতরে সাদা পায়জামা, পাঞ্জাবি পড়ে বসে আছেন জিয়া। হাবিলদার হাই তাকে বলেন : কোনো চিন্তা করবেন না স্যার, কর্নেল তাহের আমাদেরকে পাঠিয়েছেন আপনাকে তার কাছে নিয়ে যাবার জন্য। সৈনিক সংস্থা এবং জাসদের পক্ষ থেকে আমরা আপনাকে মুক্ত করতে এসেছি।
গভীর রাতে টেলিফোনের মাধ্যমে নিজের জীবন রক্ষার অনুরোধের প্রেক্ষিতে তাহের যে বাস্তবিকই তাকে মুক্ত করার উদ্যোগ নিয়েছেন তা দেখে উৎফুল্ল হয়ে উঠেন জেনারেল জিয়া। তিনি হাবিলদার হাইকে আলিঙ্গন করে বলেন : তাহের কোথায়?
হাই বলেন; কার্নেল তাহের এলিফ্যান্ট রোডে তার ভাইয়ের বাড়িতে অপেক্ষা করছেন। আপনাকে তার কাছে নিয়ে যেতে বলেছেন আমাদের। আপনি আমাদের সঙ্গে চলেন।
খানিকটা দ্বিধান্বিত হয়ে পড়েন জিয়া। কিন্তু চারপাশে তাকে ঘিরে আছে সিপাইরা, স্লোগান দিচ্ছে জেনারেল জিয়ী লাল সালাম, কর্নেল তাহের লাল সালাম। তিনি বেশিক্ষণ দোদুলামান থাকবার সুযোগ পান না। উঠে পড়েন সৈনিকদের আনা গাড়িতে। গাড়ি কিছুদূর এগোতেই সামনে প্রচণ্ড গোলাগুলির আওয়াজ পান তারা। সৈনিকরা ঠিক বুঝে উঠতে পারে না এটি তাদের পক্ষের না বিপক্ষের গোলাগুলি? তখন গোলমেলে সময়। এসময় ফারুক, রশীদের এক
সহযোগী মেজর মহিউদ্দীন এসে জিয়াকে বহনকারী গাড়িটিকে থামান। তিনি বলেন খালেদ মোশারফের দলের সৈন্যরা আক্রমণ করবার জন্য এগিয়ে আসছে,এখন ক্যান্টনমেন্টের বাইরে যাওয়া মোটেও নিরাপদ না। জিয়াকে টু ফিল্ড আর্টিলারিতে নিয়ে যাবার ব্যাপারে মেজর মহিউদ্দীন খুব তৎপর হয়ে উঠেন। সিপাইরা খানিকটা বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন। নিরাপত্তার কথা ভেবে শেষে তারা তাকে টু ফিল্ড আর্টিলারিতেই নিয়ে আসেন। সেখানে আতঙ্কিত বসে আছেন আরও অফিসার। জিয়াকে টু ফিল্ড আর্টিলারিতে দেখে অফিসারদের মধ্যে একটা স্বস্তি নেমে আসে। জিয়াও সেখানে গিয়ে আত্মবিশ্বাস ফিরে পান। এতজন সৈনিক পরিবেষ্টিত হয়ে এতক্ষণ ঠিক নিরাপদ বোধ করছিলেন না তিনি। স্পষ্ট বুঝতে পারছিলেন না তিনি সত্যিই মুক্ত কিনা। মেজর মহিউদ্দীন এবার গিয়ে দাঁড়ান জিয়ার পাশে। বলেন : আপনার স্যার এখন ক্যান্টনমেন্টের বাইরে যাওয়ার কোনো দরকার নাই। সে মুহুর্তে বোঝা না গেলেও পরবর্তীতে অনেকেই সন্দেহ করেন জেনারেল জিয়াকে ক্যান্টনমেন্টের বাইরে বের হতে না দেওয়ার ব্যবস্থা করতে মেজর মহিউদ্দীনই রাস্তায় গোলাগুলির ঐ নাটক সাজিয়েছিলেন।
জিয়াও ততক্ষণে ধাতস্থ হয়েছেন তার মুক্ত অবস্থার সাথে। তিনিও আর ক্যান্টনমেন্টের বাইরের কোনো অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে নিজেকে নিয়ে যেতে চাইলেন না। সৈনিকদের তিনি নাম ধরে কয়েকজন সিনিয়র অফিসারদের ডেকে আনতে বলেন। সৈনিকরা গিয়ে দ্রুত ডেকে আনেন মীর শওকত আলী, আবদুর রহমান, নুরুদ্দিন প্রমুখ কর্ণেল এবং ব্রিগেডিয়ার পর্যায়ের অফিসারদের। সিনিয়র অফিসারদের মধ্যে বসে জিয়া বেশ স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে উঠেন। জেনারেল জিয়া এবং অন্যান্য সিনিয়র অফিসারদের দেখে এতক্ষণ সিপাই, হাবিলদার পরিবেষ্টিত, আতঙ্কিত অফিসাররাও ক্রমশ আত্মবিশ্বাস ফিরে পেতে থাকেন। রাত দুটো বাজে তখন, ক্যান্টনমেন্ট সরগরম। জিয়া বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সদস্যদের বলেন : তোমরা বরং কর্নেল তাহেরকে এখানে নিয়ে আস। তাহের আমার প্রাণ বাঁচিয়েছে, সে আমার ভাই। আমি এখানেই তার সঙ্গে মিলিত হতে চাই।
বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার লোকেরা। তারা জানেন যে তাহের এবং জিয়া পরস্পর বন্ধু। তারা এতক্ষণ তাহের, জিয়া দুজনের নামেই শ্লোগান দিয়ে এসেছে। ফলে জিয়া যখন তাহেরকে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে আসতে বললেন তখন তারা ব্যাপারটিকে একটি স্বাভাবিক নির্দেশ হিসেবেই বিবেচনা করেন। তাদের সঙ্গে কোনো অফিসার নেই। তাহের শুরু থেকেই কোনো অফিসারদের অভ্যুত্থানের যুক্ত করেননি। তাদের একমাত্র অফিসার শুভাকাক্ষী মেজর জিয়াউদ্দীন দুর্ভাগ্যজনকভাবে অফিসের কাজে তখন ছিলেন ঢাকার বাইরে। ফলে শুধু সিপাইদের পক্ষে তা তারা যত বিপ্লবীই হোন না কেন, বহু বছরের অভ্যস্থতায় কোনো অফিসারের নির্দেশ অমান্য করা হয়ে ওঠে অসম্ভব আর সে নির্দেশ যদি আসে চিফ অব আর্মি থেকে তাহলে তো কথাই নেই।
জিয়ার নির্দেশ পেয়ে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সদস্য নায়েক সিদ্দিকুর রহমান তিন ট্রাক সৈন্য নিয়ে চলে যান এলিফ্যান্ট রোডে তাহেরকে নিয়ে আসবার জন্য। আর্মি হেডকোয়ার্টার নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনার পর সুবেদার মাহবুব ইতোমধ্যে রেডিও স্টেশন দখল করেছেন। জিয়াকে মুক্ত করার দায়িত্ব পালন করে হাবিলদার হাইও গেছেন রেডিও অফিসের পরিস্থিতি বুঝতে।
অন্যদিকে সৈনিক সংস্থার আরেকটি দল চলে যান ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে। তারা বন্দি সব জাসদ নেতাদের বেরিয়ে আসতে বলেন। ট্রাক বোঝাই অসংখ্য সৈন্যদের দেখে জোলের নিরাপত্তাকর্মীরাও বিনা বাধায় খুলে দেয় জেলের গেট। কিন্তু জাসদ নেতারা বিভ্রান্ত। তারা এধরনের কোনো অভ্যুত্থানের খবর আগে পাননি। তারা ঠিক নিশ্চিত হতে পারছিলেন না এটি কোনো ষড়যন্ত্রের অংশ কিনা। কিছুদিন আগেই জেলে বীভৎসভাবে নিহত হওয়া চার নেতার স্মৃতি তখনও তাদের মনে উজ্জ্বল। জেল থেকে জাসদ নেতাদের মধ্যে এম এ আউয়াল, মোহাম্মদ শাহাজাহান এবং মির্জা সুলতান রাজা বেরিয়ে আসেন। মোহাম্মদ শাহাজাহান এবং মির্জা সুলতান রাজা এলিফ্যান্ট রোডে তাহেরের সঙ্গে দেখা করতে রওনা দিলেও, এম এ আউয়াল ফিরে যান তার বাড়িতে।
১০২. চোরাগোপ্তা তৎপরতা
মাঝরাতে বিপ্লবের প্রথম ফায়ার ওপেন হবার পর ঘণ্টা দুয়েক কেটেছে। সৈনিকরা প্রাথমিক সাফল্য অর্জন করেছেন। সেনাবাহিনী তখন কার্যত তাদের দখলে। খালেদ মোশারফ পলাতক। বন্দি জিয়া মুক্ত। বিপ্লবের নেতা কর্নেল তাহের কিছুক্ষণের মধ্যেই আবির্ভূত হবেন দৃশ্যপটে। এই স্বল্পসময়ের মধ্যে তৎপর হয়ে উঠেন একজন। ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে সাময়িক জয়ী এবং সাম্প্রতিক পরাজিত খন্দকার মোশতাক।
এ ধরনের বিদ্রোহের একটা আভাস সবসময় বাতাসে ছিল এবং সিপাই অভ্যুত্থান ঘটবার স্বল্প সময়ের ব্যবধানে এর খবর পেয়ে যান মোশতাক। নিশ্চিত পরাজিতের দলেই অন্তর্ভুক্ত হতে চলেছেন জেনে এই ঘোলাটে অবস্থার সুযোগ নেবার জন্য তিনি আবারও তার পুরনো পথই ধরেন, ষড়যন্ত্রের পথ। ষড়যন্ত্রে পেশাদারী দক্ষতা রয়েছে তার।
এসময় তিনটি কাজ করেন তিনি। এক, সিপাইদের মধ্যে ফারুক, রশীদ অধীনস্ত, প্রকারান্তরে মোশতাকের অনুগত যে দলটি সাময়িকভাবে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থায় যোগ দিয়েছিল তাদের একটি অংশকে তিনি চোরাগোপ্তা ব্যবহার শুরু করেন। একটি দলকে মোশতাক পাঠান জেলে তার অনুগত মন্ত্রী ওবায়দুর রহমান, শাহ মোয়াজ্জেম, তাহের উদ্দীন ঠাকুর, যাদের খালেদ মোশারফ বন্দি করেছিল তাদের মুক্ত করে আনতে। জাসদের নেতারা বেরিয়ে না এলেও বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার ছদ্মবেশে মোশতাকের লোক জেল থেকে বের করে নিয়ে আসেন তাদের দলীয় নেতাদের। দুই, দ্রুত তার অনুগত লোকজন দিয়ে তিনি আশপাশের মাদ্রাসা থেকে কিছু ছাত্র যোগাড় করেন। পাশাপাশি বাংলাদেশের সরকারি অফিসগুলোতে তখনও অনেক জায়গায় সদ্য বিদায়ী প্রেসিডেন্ট মোশতাকের ছবি, সেরকম কিছু ছবি সংগ্রহ করেন। মোশতাকের ছবিসহ ঐ মাদ্রাসার ছাত্রদের তিনি উঠিয়ে দেন তার অনুগত সৈনিকদের ট্রাকে। সৈনিকদের ট্রাকে টুপি পড়া কিছু বালক মোশতাকের ছবি হাতে নিয়ে স্লোগান দেয়, নারায়ে তাকবীর, আল্লাহ আকবার। তিন, তিনি নিজে রওনা দেন রেডিও স্টেশনের দিকে, সেখানে একটি ভাষণ দিয়ে ঘটনা নিজের অনুকুলে আনবার পায়তারায়।
১০৩. ব্লান্ডার
ওদিকে এলিফ্যান্ট রোডে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন তাহের, ইউসুফ, ইনু কখন সৈন্যরা সেখানে নিয়ে আসবেন জেনারেল জিয়াকে। এরপর তারা শুরু করবেন অভ্যুত্থানের পরবর্তী পর্ব। কিছুক্ষণ পর হাবিলদার সিদ্দীক ট্র্যাক বোঝাই সিপাইদের নিয়ে হাজির হন এলিফেন্ট রোডের বাসায়। উদগ্রীব তাহের ক্রাচে ভর দিয়ে দ্রুত এগিয়ে এসে তাদের জিজ্ঞাসা করেন : জিয়া কোথায়?
হাবিলদার সিদ্দীক বলেনঃ উনি আপনাকে টু ফিল্ডে যেতে বলেছেন।
ভীষণ ক্ষেপে যান তাহের: তার মানে কি? তোমাদের না স্ট্রিক্টলি ইন্সট্রাকশন দিলাম জিয়াকে যেভাবে হোক এখানে আনতে হবে।
হাবিলদার সিদ্দীক বলেন : আমরা স্যার ভাবলাম, উনি তো আপনারই মানুষ, উনি যখন বললেন তখন আমাদের তাই করা উচিত।
তাহের মুখ ঘুরিয়ে ক্রাচে শব্দ তুলে পায়চারী করেন কতক্ষণ। ইনুকে বলেন, এরা একটা রিয়েল রাস্তার করে ফেলল। আমি চেয়েছিলাম আমাদের বিপ্লবের কেন্দ্রটাকে ক্যান্টনমেন্টের বাইরে নিয়ে আসতে। এখন জিয়া যদি ক্যান্টনমেন্টে থাকে তাহলে তো সে তার পুরো এনফ্লুয়েন্সটা ওখানে কাজে লাগাবে। আমাদের এখনই ক্যান্টনমেন্টে যাওয়া দরকার।
জেনারেল জিয়ার ক্যান্টনমেন্ট থেকে বাইরে না আসার ঘটনার এই ছোট্ট মোড় বস্তুত বদলে দেয় বাংলাদেশের পরবর্তী ইতিহাস।
ইউসুফ তার নিজস্ব ভক্সওয়াগন গাড়িটি বের করেন। পা নেই বলে তাহের গাড়ি ড্রাইভ করতে পারেন না। বাইরে কোথাও যাবার প্রয়োজন হলেই ইউসুফ তার গাড়িতে তাকে নিয়ে যান বিভিন্ন জায়গায়। তাহের, ইনু, ইউসুফ রওনা দেন ক্যান্টনমেন্টের দিকে।
বেলাল, বাহার, মোশতাক তাহেরের অফিসের জীপাটি নিয়ে বেরিয়ে পড়েছেন মাইকিংয়ে। এর আগে তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ গণবাহিনীর ইউনিটগুলোকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলেছেন।
ক্যান্টনমেন্টে যাওয়ার পথে তাহের মাইকে শুনতে পান বাহারের কণ্ঠ। রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে শোনা যায় : আজ মধ্যরাতে দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী, বিডিআর, পুলিশ, বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা, বিপ্লবী গণবাহিনী ও ছাত্র যুবক শ্রমিক সম্মিলিতভাবে দেশে ষড়যন্ত্রকারীদের উৎখাত করে বিপ্লবী অধ্যান সংঘটিত করেছে। সর্বস্তরের জনগণের প্রতি আহ্বান, এই অধ্যানী শক্তির সাথে রাজপথে সংগঠিতভাবে বেরিয়ে এসে একাত্মতা ঘোষণা করুন। আজ সকালে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনীর সকল সৈনিকদের উপস্থিত হওয়ার জন্য অনুরোধ জানানো হচ্ছে। এখানে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান এবং কর্নেল তাহের বক্তৃতা করবেন। পাশাপাশি ছাত্র ও জনসাধারণকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সমবেত হওয়ার অনুরোধ জানানো হচ্ছে। সেখানে মেজর জলিল, আবদুর রবসহ সকল রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ভাষণ দেবেন …।
তারা কর্নেল তাহেরের নামে শ্লোগান দেয়। তাহের সে মুহূর্তে জিয়ার অবস্থান নিয়ে উৎকণ্ঠিত।
১০৪. জান মঞ্জিল
বাচ্চাদের ঘুম পাড়িয়ে নারায়নগঞ্জের জান মঞ্জিলে টেলিফোনের পাশে উৎকণ্ঠায় বসে তন্দ্রায় ঢুলছিলেন লুৎফা। ফোন বেজে ওঠে হঠাৎ। চমকে উঠে রিসিভার তোলেন লুৎফা। এক পরিচিত আত্মীয়ের কণ্ঠ, তিনি লুৎফাকে জিজ্ঞাসা করেন : চারদিক থেকে গোলাগুলির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে আর কর্নেল তাহেরের নামে শ্লোগান হচ্ছে, কী ব্যাপার?
লুৎফা বলেন, আমিও তো ঠিক বুঝতে পারছি না।
আত্মীয় জিজ্ঞাসা করেন : তাহের ভাই কোথায়।
হঠাৎ কি বলবে লুৎফা বুঝতে পারেন না। আমতা আমতা করে বলেন : তাহের তো অসুস্থ, ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়েছে।
কিছুক্ষণ পর আবার টেলিফোন। এবার বাহারের গলা : ভাবী বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা, গণবাহিনী আর জাসদ, তাহের ভাইয়ের নেতৃত্বে ক্ষমতা দখল করেছে। এতক্ষণ শহরে মাইকিং করেছি আমি। বেলাল এখনও করছে। আনোয়ার ভাই গেছেন রেডিও স্টেশনে ঘোষণা দিতে। তাহের ভাই, ইউসুফ ভাই, ইনু ভাইকে নিয়ে গেছেন ক্যান্টনমেন্ট। আজ ভোরেই তাহের ভাই আর জেনারেল জিয়া জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন।
লুৎফা জানে সেই কবে থেকে এই মুহূর্তটির জন্য অপেক্ষা করছে তাহের। কত বছর ধরে নিজেকে প্রস্তুত করছে সে। এ মুহূর্তে নিশ্চয়ই বুকভরা আনন্দ তাহেরের। তার এই চরম আনন্দের সময়টিতে লুৎফা তার কাছে নেই ভেবে বিষণ্ণ বোধ করে সে। কিন্ত একটা অজানা আতঙ্কও ঘিরে থাকে তাকে। এত বড় একটা ঘটনা শেষ পর্যন্ত সামাল দিতে পারবে তো? কোথায় গিয়ে ঠেকবে ঘটনা?
লুৎফা আবারও অবাক হয়ে ভাবেন তাহেরের সবকটা ভাই এমন জটিল মুহূর্তে কেমন আগলে আছে তাকে। যেন সব ভাইরা মিলেই বদলে দিচ্ছে ইতিহাস।
১০৫. ফসকে যাওয়া মাছ
ইউসুফের ভক্সওয়াগনে ক্যান্টনমেন্টের দিকে রওনা দিয়েছেন তাহের, ইনু। পথে পথে তারা দেখতে পান যত্রতত্র ঘুরে বেড়ানো সিপাইদের ট্রাক। শ্লোগান দিচ্ছেন তারা, গুলি ছুড়ছেন আকাশে। ঢাকায় এক অস্বাভাবিক রাত। হঠাৎ সামনের একটা ট্রাক আচমকা ব্রেক করায় তাদের গাড়িটির সঙ্গে সংঘর্ষ হয়। গাড়িটি একরকম অকেজোই হয়ে পড়ে। তারা তাড়াতাড়ি সৈনিকদের একটি ট্রাকে উঠে পড়েন তারা। ক্রাচ নিয়ে ট্রাকে উঠতে সমস্যা হচ্ছিল তাহেরের। সিপাইরা তাকে কোলে করে ট্রাকে তোলেন।
টু ফিল্ড আর্টিলারিতে পৌঁছালে সৈনিক সংস্থার লোকরা তাহেরকে কোলে করে ট্রাক থেকে নামান। তাহেরের ক্রাচ ছিটকে পড়ে অন্যদিকে। তারা স্লোগান দেন কর্নেল তাহের জিন্দাবাদ, জেনারেল জিয়া জিন্দাবাদ। কাঁধে করে তাহেরকে তারা নিয়ে আসেন জিয়ার সামনে। এক সিপাই পেছনে ফেলে আসা ক্ৰাচটি হাতে তুলে দেন তাহেরের। জিয়া সেখানে বসে আছেন অন্যান্য সিনিয়র অফিসার পরিবেষ্টিত হয়ে? তাহের ত্যর ক্ৰাচটি ভর করে দাঁড়ালে চেয়ার থেকে উঠে এগিয়ে আসেন জিয়া। কোলাকুলি করেন তাহেরের সঙ্গে, বলেন : তাহের ইউ সেভড় মাই লাইফ, থ্যাঙ্ক ইউ। থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ।
উপস্থিত সবাই এই নাটকীয় দৃশ্য দেখেন।
তাহের বলেন : আমি কিছুই করিনি, করেছে এই সিপাইরা। অল ক্রেডিট গোজ টু দেম।
জিয়া : লেট মী নো হোয়াট নিডস টুবি ডান। তোমরা যেভাবে বলবে সেভাবেই সবকিছু হবে।
তাহেরের সঙ্গে তার ভাই ইউসুফ এবং ইনু। পুরো প্রেক্ষাপটে এরাই শুধু বেসামরিক ব্যক্তি। উপস্থিত অফিসাররা কেউ কেউ তাহেরকে কনগ্রাচুলেট করলেও তারা ঠিক বুঝতে পারেন না তাহেরের মতো একজন অবসর প্রাপ্ত কর্নেল কেন এই মাঝরাতে হাজির হয়েছেন ক্যান্টনমেন্ট, কেনই বা জিয়া তাকে ধন্যবাদ দিচ্ছেন, এতটা গুরুত্ব দিচ্ছেন।
জিয়া যতই তাকে ধন্যবাদ জানান, তার পরিকল্পনামতো জিয়া বাইরে না যাওয়াতে তাহের খানিকটা বিরক্ত। জিয়ার সঙ্গে একান্তে আলাপ করতে চান তাহের। টু ফিল্ডের সিওর অফিসের পাশের ছোট্ট একটি রুমে গিয়ে বসেন জিয়া, তাহের, ইনু। ইউসুফ বাইরে অপেক্ষা করেন।
ঐমুহূর্তে বঙ্গভবনে আটকে থাকা খালেদ মোশারফের প্রধান সহকারী ব্রিগেডিয়ার শাফায়াত ফোন করেন জিয়াকে। সৈনিক সংস্থার লোকেরা তখন বঙ্গভবন দখল করে নিয়েছে। শাফায়াত জিয়াকে ফোন করে উত্তেজিত হয়ে বলেন, তিনি সিপাইদের কাছে সারেন্ডার করবেন না। শাফায়াত মনে করেছেন, জিয়াই পুরো ঘটনা ঘটাচ্ছেন। শাফায়াত জিয়াকে টেলিফোনে বলেন : আপনি কিছু করবেন স্যার তো অফিসারদের নিয়ে করেন, এসব জোয়ানদের নিয়ে করতে গেলেন কেন?
জিয়া তাকে শান্ত হতে বলেন এবং সেখানে উপস্থিত তাহেরের সঙ্গে কথা বলতে বলেন। অন্য অনেক অফিসারদের মতো শাফায়াত জামিলও এ দৃশ্যপটে তাহেরের উপস্থিতিতে অবাক। এই অভ্যুত্থানের সঙ্গে তাহেরের সম্পর্ক, বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার ভূমিকা ইত্যাদি নিয়ে স্পষ্ট কোনো ধারণা ছিল না তার।
তাহের ফোন ধরে শাফায়াতকে বলেন: জাস্ট কোয়ায়েটলি সারেন্ডার। ভয় পাওয়ার কিছু নেই। এভরিথিং ইজ আন্ডার কন্ট্রোল।
শাফায়াত আত্মসমর্পণ করতে অস্বীকার করেন এবং সৈনিক সংস্থার লোকেরা বঙ্গভবন ঘিরে ফেললে, তিনি বঙ্গভবনের দেয়াল টপকে পালাতে গিয়ে তার পা ভেঙ্গে ফেলেন। ঐ আহত অবস্থাতেই রাতের অন্ধকারে আত্মগোপন করেন দোসরা নভেম্বরের অভ্যুত্থানের অন্যতম কুশীলব শাফায়েত জামিল। শেখ মুজিবের অন্যায় হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদকারী রাগী সামরিক অফিসার শাফায়াত জামিল সেনাবাহিনীর এই নতুন পটপরিবর্তনের প্রেক্ষাপট অনুধাবনে ব্যর্থ হন। নতুন পরিস্থিতিতে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠেন তিনি। আর তার কমান্ডার খালেদ মোশারফ দৃশ্যপট ছেড়ে তখনও আশ্রয় নিয়ে আছেন দশম বেঙ্গলে। ঘটনা স্পষ্টতই হাতছাড়া হয়ে গেছে তাদের।
কিন্তু নতুন অভ্যুত্থান কি পুরোপুরি এসেছে এর অগ্রগামী বাহিনী সিপাইদের হাতে? কিম্বা তাদের নেতা তাহেরের হাতে? তখনও তা প্রশ্নসাপেক্ষ।
তাহের বসেন জিয়ার সঙ্গে আলাপে! ইনুকে পরিচয় করিয়ে দেন তাহের। তারা দুই তারিখ রাতে খালেদ মোশারফ ক্ষমতা দখল করার পর থেকে কি কি ঘটেছে এবং কিভাবে তারা এই বিপ্লবটি সংঘঠিত করেছেন তা জিয়াকে বিস্তারিত জানান।
তাহের বলেন, একটা ব্যাপার আমাদের ক্লিয়ার থাকতে হবে যে পুরো বিপ্লবটা করেছে সিপাইরা, এখানে কোনো একক পাওয়ার টেকওভারের ব্যাপার নাই। আমরা এ মুহূর্তে জাসদের সরকার গঠন করতে চাচ্ছি না, আমরা জাতীয় সরকার করতে চাই। একটা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার করতে চাই। আপাতত একটা যৌথ উদ্যোগ দরকার। খুব তাড়াতড়ি একটা সাধারণ নির্বাচন দরকার, রাজবন্দিদের মুক্তি দেওয়া দরকার, সৈনিকদের দাবি-দাওয়াগুলো নিয়ে কথা বলা প্রয়োজন। আমাদের ইন্টারন্যাশনাল লিঙ্কেজের ব্যাপারেও ভিসিশন নিতে হবে। আপনি এখানে একটা ক্রসিয়াল রোল প্লে করবেন। এসব নিয়ে আমাদের ডিটেইলে বসতে হবে।
জিয়া চুপচাপ মাথা নাড়িয়ে শুনতে থাকেন। বাইরে অপেক্ষা করছেন শ্ৰগণিত অফিসার, শত শত সিপাই। তাহের বলতে থাকেন : তবে যেহেতু রাতের অন্ধকারে সিপাইরা বিদ্রোহ করেছে, দেশের সাধারণ মানুষ পুরো ব্যাপারটি নিয়ে অন্ধকারে থাকবে। কাজেই আমরা ঠিক করেছি আগামীকাল আমাদের প্রথম কাজ হবে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে একটা সমাবেশ করা। সেখানে জাসদকর্মীসহ অন্যরাও থাকবে। সেখানে বক্তৃতার মাধ্যমে জনগণকে অভ্যুত্থানের ব্যাপারে স্পষ্ট ধারণা দিতে হবে। সেখানে আমি এবং আপনি বক্তৃতা দেবো।
এতক্ষণ চুপচাপ শুনলেও বক্তৃতার কথা শুতেই জিয়া বেঁকে বসে। তিনি বলেন : দেখো তাহের, আমি তো পলিশিয়ান না, আমি জনসভায় ভাষণ দিতে পারব না। বক্তৃতা তুমি দাও, তোমার যা ভালো মনে করো সেটা করে। আমাকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে টানাটানি করো না।
তাহের বলেন : না, না,আমি একা বক্তৃতা দিলে তো হবে না। আপনিও তো পুরো ঘটনাটার একটা ইম্পর্টেন্ট পার্ট। দেশ একটা সংকট এবং বিভ্রান্তির মধ্যে আছে এ মুহূর্তে জনগণকে সুসংহত করা জরুরি।
জিয়া : তাহের তুমি এখন সিভিলিয়ান তুমি গিয়ে বক্তৃতা দিতে পার। আই এম নট গোয়িং আউট অব দিস ক্যান্টনমেন্ট।
তাহের : তাহলে কি আপনি আপনার কমিটমেন্ট ভঙ্গ করছেন। আপনি বলেছেন আমরা যেভাবে বলব সেভাবেই আপনি কাজ করবেন।
জিয়া। কিন্তু সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আমি যাবো না।
কিছুক্ষণ পর টু ফিল্ড আর্টিলারির হলরুমে উপস্থিত অফিসাররা দেখতে পান তাহের তার ক্রাচে ঠক ঠক শব্দ তুলে অত্যন্ত রাগান্বিত এবং ক্ষুব্ধ হয়ে ইনুকে নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছেন ঘর থেকে। বাইরে সিপাইদের এলোপাথারি আনাগোনা। সিপাই এবং অফিসারদের মধ্যে তখনও একটা অমীমাংসিত উত্তেজনা।
কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে তাহের জিয়াকে বলেন : আপনি সমাবেশে বক্তৃতা করতে না চাইলে অন্তত রেডিওতে একটা বক্তব্য রাখেন। আপনি আমাদের সঙ্গে চলেন রেডিও স্টেশনে এবং একটা বক্তব্য রেকর্ড করে চলে আসবেন।
এর মধ্যে জিয়াকে ঘিরে ফেলেছেন সিনিয়র অফিসাররা। জিয়া আবারও বলেন তিনি এখন ক্যান্টনমেন্টের বাইরে যাবেন না। তার পাশ থেকে ব্রিগেডিয়ার মীর শওকত এবং আমিনুল হকও বলেন, না স্যারকে এখন বাইরে নেওয়া ঠিক হবে না। দরকার হলে বক্তৃতা এখানেই রেকর্ড করা হবে।
তাহের টের পান মাছ ফসকে গেছে তাদের হাত থেকে।
১০৬. ইতিহাসের সুতো
ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরিয়ে তাহের, ইউসুফ, ইনু আবার রওনা দেন এলিফ্যান্ট রোডের দিকে। গাড়িতে ফিরতে ফিরতে ইনু বলেন : জিয়া তো কোনো কথা রাখবেন বলে মনে হয়
তাহের : আমি আগেই বলেছিলাম জিয়াকে ক্যান্টনমেন্টের বাইরে আনতে না পারাটা একটা ব্লান্ডার হয়েছে। বিপ্লবের পুরো সেন্টারটা যাতে বাইরে থাকে সেজন্য আমি অভ্যুত্থানের সময় ক্যান্টনমেন্টে গেলাম না। আমি চাচ্ছিলাম অভ্যুত্থানটার একটা সিভিল ডাইমেনশন তৈরি করতে। কিন্তু এখন তো দেখছি ঘটনা ঘুরে যাচ্ছে। অফিসাররা ঘিরে ফেলেছে তাকে। তাকে আর তারা ক্যান্টনমেন্টেন বাইরে আসতে দেবে না। দ্রুত কোনো ব্যবস্থা নিতে না পারলে পুরো ব্যাপারটাই আমাদের কন্ট্রোলের বাইরে চলে যাবে। সোহওয়ার্দী উদ্যানে মিটিং না হলেও শহীদ মিনারের মিটিংটা আমাদের কনটিনিউ করে যেতে হবে।
এলিফ্যান্ট রোডে পৌঁছালে রেডিও স্টেশন থেকে ফোন আসে হাবিলদার হাইয়ের। হাই তাহেরেকে ফোনে বলেন, তিনি রেডিও স্টেশনে খন্দকার মোশতাককে দেখতে পাচ্ছেন এবং তিনি একটা কোনো বক্তৃতা দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। অত্যন্ত বিরক্ত এবং ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেন তাহের : কি শুরু করেছে সব এরা। ঐ কালপ্রিটটা ওখানে কি করে। আমাকে এখনই যেতে হবে রেডিও স্টেশনে। উই মাস্ট স্টপ ইট।
আবার ক্রাফটা হাতে উঠিয়ে নেন তাহের। ইনু এবং ইফসুফকে বলেন। এলিফ্যান্ট রোডের বাসায় থাকতে, ক্যান্টনমেন্ট থেকে কোনো খবর আসে কিনা তা লক্ষ রাখতে। রেডিও স্টেশনে তিনি নিয়ে যান বেলালকে। এবার তার ড্রেজার সংস্থার গাড়িতে। গাড়ি দ্রুত চালাতে বলেন তাহের। তখন দিনের আলো একটু একটু করে ফুটছে।
তাহের রেডিও স্টেশনে পৌঁছেই হুঙ্কার দেন : মোশতাককে কে এনেছে এখানে? সিপাইদের সিংহভাগ তখনও তাহেরেই নির্দেশে চলছেন। রেডিও স্টেশন তখন বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার দখলে। এক সৈনিক বলেন, বেঙ্গল ল্যান্সারের কিছু সিপাইদের সঙ্গে করে তিনি এখানে এসেছেন।
ক্রাচে ঠক ঠক শব্দ তুলে তাহের ঢুকে যান রেডিও স্টেশনে। দেখেন মোশতাক শান্তভাবে কাগজে কিছু লিখছেন, পাশে তাহের উদ্দীন ঠাকুর। তাহেরের সাথে আসা বেলাল মোশতাকের কাছ থেকে কাগজটা এক টানে কেড়ে নিয়ে দেন তাহেরের হাতে। তাহের দেখেন লেখা কন্টিনিউশন অব প্রেসিডেন্সি। তাহের এক টানে কাগজটা ছিঁড়ে ফেলেন এবং মোশতাককে বলেন : কন্সপিরেন্সির দিন শেষ। ইউ হ্যাভ ক্রিয়েটেড এনাফ ট্রাবল ফর দিস নেশন। নাউ গেট আউট ফ্রম দিস রেডিও স্টেশন ইমিডিয়েটলি। তা না হলে আপনার জিহ্বা আমি টেনে ছিঁড়ে ফেলব।
পাশ থেকে তাহের উদ্দীন ঠাকুর কিছু একটা বলতে নিলে, তাহের বলেন, ইউ শাট আপ।
রাগে কাঁপতে থাকেন তাহের। হাবিলদার হাইকে বলেন : এখনই বের করা এ দুজনকে।
হাবিলদার হাই একরকম টেনে মোশতাক এবং তাহের উদ্দীনকে বাইরে নিয়ে যান। মোশতাক কোনো উচ্চবাচ্য করেন না। মোশতাক যখন রেডিও স্টেশন থেকে বেরুচ্ছেন তখন জেল থেকে ছাড়া পাওয়া মোশতাকের দুই সঙ্গী, ওবায়দুর রহমান এবং শাহ মোয়াজ্জেম ঢুকবার চেষ্টা করছিলেন রেডিও স্টেশনে। ঐ দুজনকেও হাবিলদার হাই এবং সৈনিক সংস্থার অন্য সদস্যরা ধাক্কাতে ধাক্কাতে রেডিও স্টেশনের গেট থেকে বের করে দেন।
১০৭. সিপাই জনতা ভাই ভাই
ভোরের আলো ফুটতে ঢাকার মানুষ রাস্তায় বেরিয়ে পড়েন। সারারাত তারা গোলাগুলির আওয়াজ শুনেছেন, রেডিওতে অনেকেই শুনেছেন সিপাইদের অভ্যুত্থানের খবর। ক্যান্টনমেন্টেই রেকর্ড করা জিয়ার একটি বক্তৃতা প্রচার করা হয়েছে রেডিওতে। সেখানে জিয়া নিজেকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে ঘোষণা করেছেন। সিপাইদের অভ্যুত্থানের কথা বললেও বক্তৃতায় জিয়া কোথাও অভুত্থানের পেছনে জাসদ কিম্বা কর্নেল তাহেরের কথা উল্লেখ করেননি।
কৌতূহলী মানুষ দেখেন চাকার রাস্তায় রাস্তায় ট্রাক, ট্যাঙ্ক বোঝাই সিপাই। যেন ক্যান্টনমেন্টের ঘেরাট ভেঙ্গে সৈনিকেরা ধেয়ে আসছে মানুষের দিকে। সাধারণ মানুষও গত চার, পাঁচ দিন ধরে ছিল এক গুমোট অনিশ্চয়তা আর অন্ধকারের ঘেরাটোপে। নভেম্বরের সাত তারিখ ভোরে তারাও যেন বেরিয়ে এসেছে সে ঘেরাটোপ ভেঙ্গে। বিভ্রান্ত সৈনিক এবং জনতা পরস্পরের সাথে সেদিন মিলিত হয় ঢাকার রাজপথে। এ যেন দুজনেরই বিজয়। সাধারণ মানুষ উঠে পড়ে সৈনিকদের ট্রাকে, কেউ গিয়ে ফুলের মালা পড়িয়ে দেয় কামানের নলের গলায়, কেউ উঠে পড়ে ট্যাঙ্কে। সিপাই জনতার মিলনমেলার এক অভূতপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা হয় সেদিনের ঢাকার রাজপথে। সিপাই সিপাই ভাই ভাই ছেড়ে এবার স্লোগান ওঠে সিপাই জনতা ভাই ভাই।
সাধারণ মানুষ তখনও স্পষ্ট জানেন না ক্যান্টনমেন্টে ঠিক কি ঘটেছে আগের রাতে। শুধু টের পান একটা কোনো বড় পরিবর্তন ঘটেছে। দেশে যে স্থবিরতা দেখা দিয়েছিল তা কেটে যাবার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। মানুষের বিভ্রান্তি তবু কাটে না। কোনো কোনো সিপাইদের ট্রাক থেকে শোনা যায় স্লোগান কর্নেল তাহের জিন্দাবাদ, কোন ট্রাকে জেনারেল জিয়া জিন্দাবাদ আবার কোনো কোনো ট্রাক থেকে ভেসে আসছে ধ্বনি নারায়ে তাকবীর, খন্দকার মোশতাক জিন্দাবাদ। সাধারণ মানুষ বুঝে উঠতে পারেন না কে ঘটালো অধ্যান, তাহের, জিয়া না মোশতাক?
৭ নভেম্বর সকাল থেকেই জাসদের গণবাহিনী শহরের নানা স্থানের নিয়ন্ত্রণ নেবার তৎপরতা শুরু করে এবং শহীদ মিনারে জনসমাবেশের আয়োজন করতে থাকে। সায়েন্স এনেক্স বিল্ডিংয়ের একটা কক্ষে ঢাকা নগর গণবাহিনীর কন্ট্রোলরুম বসানো হয়। সকাল থেকে গণবাহিনীর সদস্যরা মোহাম্মদপুর থানাসহ শহরের কয়েকটি থানা দখল করে। পুলিশ তাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে। অন্যদিকে শহীদ মিনারে গণবাহিনীর সদস্য আবুল হাসিব খান মাইকে ঘোষণা দিতে থাকেন-একটু পরেই শুরু হবে এক ঐতিহাসিক লং মার্চ। লং মার্চে নেতৃত্ব দেবেন কমরেড আবু তাহের, কমরেড জিয়াউর রহমান…।
মাঝরাতে অভ্যুত্থান শুরু হয়ে ভোর হয়েছে। কিন্তু বাতাসের বেগে এগিয়ে যাচ্ছে ঘটনা প্রবাহ। অভ্যুত্থানের প্রথম পর্বের সামরিক মিশনটি, যার দায়িত্বে ছিলেন তাহের সফহ হলেও তৈরি হচ্ছে নানা বিভ্রান্তির বীজ। আর এর দ্বিতীয় অংশ বেসামরিক মিশনটি, যার দায়িত্বে ছিলেন জাসদের অন্যান্য নেতারা, দানা বেঁধে উঠেনি তখনও। শহীদ মিনারে গণবাহিনীর বেশ কিছু সদস্য জড়ো হলেও আশানুরূপ ছাত্র, শ্রমিক জমায়েত হয়ে উঠেনি। সিরাজুল আলম খান তখনও অজ্ঞাত স্থানে আত্মগোপন করে টেলিফোনে যোগাযোগ রেখে চলেছেন! ড. আখলাক আছেন পীরের দরবারে। জাসদ নেতা মোহাম্মদ শাহজাহান, মির্জা সুলতান রাজা পোস্তগোলা থেকে শ্রমিকদের সংগঠিত করে শহীদ মিনারে আনবার চেষ্টা করছেন কিন্তু সেদিন রাতেই জেল থেকে বেরিয়েছেন তারা, ফলে তাদের যথেষ্ট বেগ পেতে হচ্ছে শ্রমিকদের সংগঠিত করতে। অন্যান্য জাসদ নেতারাও খানিকটা অপ্রস্তুত। এতবড় ঘটনায় পুরোপুরি ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্যোগী হচ্ছেন না তারা।
এ সময় শহীদ মিনারে এক আকস্মিক ঘটনা ঘটে। হঠাৎ বেশ কয়েকটি ট্রাক শহীদ মিনারে উপস্থিত হয়। সেখানে সৈনিকদের পাশাপাশি খন্দকার মোশতাকের ছবিসহ টুপি পড়া মাদ্রাসার ছেলেরা। তারা স্লোগান দেয়, নারায়ে তাকবীর, আল্লাহু আকবার, খন্দকার মোশতাক জিন্দাবাদ। উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে সমাবেশে। সৈনিক সংস্থার কয়জন সদস্য ট্রাক থেকে মোশতাকের ছবি নিয়ে তা ছিঁড়ে ফেলেন। এ সময় ট্রাক থেকে মোশতাকপন্থী সৈন্যরা সমাবেশের উপর এলোপাথাড়ি গুলি চালায়। এতে কেউ হতাহত না হলেও সমাবেশ পণ্ড হয়ে যায়।
উপমহাদেশের ইতিহাসে দ্বিতীয় এই সিপাই অভ্যুত্থান ঘটবার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সেটিকে বানচাল করে দেবার জন্য তৎপর হয়ে ওঠে দুটি শক্তি, একদিকে জেনারেল জিয়া, আরেক দিকে খন্দকার মোশতাক। খানিকটা নিরাপদ দূরত্বে থেকে তাহেরকে নীরব সমর্থন দিলেও এভাবে সেনাবাহিনীর খোল নালচে পাল্টে, সিপাই অফিসারদের ভেদাভেদ ঘুচিয়ে বৈপ্লবিক কোনো ঘটনা ঘটিয়ে ফেলার মানুষ জিয়া নন। তার মুক্তির জন্য তাহেরের সঙ্গে সুসম্পর্কটি ব্যবহার করেছেন তিনি। এখন তার বিশ্বস্ত অফিসারদের বেষ্টনীতে ঘটনার সোড় ফেরাবার চেষ্টায় আছেন তিনি। আর দেশ যখন একটা সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের একেবারে দ্বারপ্রান্তে তখন এর মোড় পুঁজিবাদী এবং ইসলামপন্থীদের দিকে ফেরাবার জন্য শেষ মরিয়া চেষ্টা চালাতে শুরু করেছেন মোশতাক।
আর এই বিপরীতমুখী স্রোতের তোড়ে উজান ঠেলে একজন পঙ্গু মানুষ তখন ক্রাচে ভর দিয়ে উদভ্রান্তের মতো এক জায়গা থেকে ছুটে বেড়াচ্ছেন আরেক জায়গায়।
১০৮. ক্যান্টনমেন্টে আবার
রেডিও স্টেশনে খন্দকার মোশতাককে সামাল দিয়ে তাহের আবার ছুটে যান ক্যান্টনমেন্টে টু ফিল্ড আর্টিলরিতে। সেখানে গিয়ে দেখেন মিটিং শুরু হয়েছে। জাসদের অন্যকোনো নেতারও এখন ক্যান্টনমেন্টের আলোচনায় থাকা উচিত বলে মনে করেন তাহের। সিনিয়র নেতারা অধিকাংশই জেলে। সিরাজুল আলম খান এধরনের প্রকাশ্য মিটিংয়ে উপস্থিত থাকেন না, তিনি তার রহস্য নিয়ে তখনও গোপন স্থানে। তাহের ইনুকে বলেন ড. আখলাককে নিয়ে আসতে।
তাহেরকে মিটিংয়ে ডাকা হয়নি। তবু তিনি তার সশব্দ ক্রাচ নিয়ে ঢুকে পড়েন মিটিংয়ে। দেখেন সেখানে উপস্থিত আছেন মেজর জেনারেল জিয়া, মেজর জেনারেল খলিলুর রহমান, এয়ার ভাইস মার্শাল তোয়াব, রিয়ার এডমিরাল এম এইচ খান, জেনারেল ওসমানী, মাহবুবুল আলম চাষী। নানা কৌশলে তাহেরকে পাশ কাটানোর চেষ্টা করলেও উপস্থিত সকলেই জানেন তাহেরকে উপেক্ষা করবার শক্তি তাদের নেই। ওসমানী উঠে গিয়ে স্বাগত জানান তাহেরকে। বলেনঃ কাম অন তাহের হ্যাভ এ সিট।
তাহের ভেতরে ভেতরে ক্ষুব্ধ হয়ে আছেন। গম্ভীর মুখে ক্রাচটা পাশে রেখে চেয়ারে বসেন। মাহবুবুল আলম চাষী বলেন : কর্নেল তাহের, উই হ্যাভ ডিসাইডেড টু কন্টিনিউ দি গভর্নমেন্ট উইথ মোশতাক অ্যাজ দি প্রেসিডেন্ট।
তাহের সাথে সাথে আবার তার ক্রাচটি হাতে তুলে নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলেন : ওয়েল ইফ ইউ হ্যাভ অলরেডি ডিসাইডেড ইট, দ্যান আই হ্যাভ নো বিজনেস টু স্টে হেয়ার।
ওসমানী উঠে এসে তাহেরকে হাতে ধরে চেয়ারে বসান : প্লিজ তাহের স্টে অন। টেল আস হোয়াট প্ল্যানস ডু ইউ হ্যাভ।
মিটিংয়ের সবাই জানেন এ মুহূর্তে তাহেরকে ক্ষেপিয়ে কোনো লাভ হবে না। ঘটনার মোড় যেদিকেই তারা নিতে চান না কেন তাহেরকে ছাড়া কোনো দিকে যাবার উপায় তাদের নেই। সারা শহর তখন দাপিয়ে বেড়াচ্ছে তাহেরের বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সৈন্যরা। তাহের বলেন : উই ক্যান নট এলাউ দিস নুইসেন্স টু গো অন ফর এভার। আই ওয়ান্ট খন্দকার মোশতাক টু বি কমপ্লিটলি আউট অব দি সীন।
ওসমানী বলেন : হুম ডু ইউ হ্যাভ ইন ইওর মাইন্ড?
তাহের : প্রথমত আমাদের একটা বিপ্লবী পরিষদ করতে হবে, গঠন করতে হবে সর্বদলীয় জাতীয় সরকার। সে সরকারের কাজ হবে যত দ্রুত সম্ভব একটা ফ্রি অ্যান্ড ফেয়ার ইলেকশন দেওয়া। আর সব পলিটিক্যাল পিজনার্সদের ইমিডিয়েটলি মুক্ত করা। এছাড়া অন্য কোনোদিকে ঘটনা টার্ন করাবার চেষ্টা করবেন না আপনারা, তার পরিণতি অত্যন্ত খারাপ হবে। আর এই ইন্টেরিম পিরিয়ডে কাকে চার্জে রাখা যায় সে ব্যাপারে আপনারা প্রপোজ করতে পারেন।
তাহেরের দৃঢ় উচ্চারণ চুপচাপ শোনেন তারা। কেউ কেউ অন্তর্বর্তীকালীন রাষ্ট্রপতি হিসেবে বিচারপতি সায়েমের নাম প্রস্তাব করেন। তাহের সমর্থন করেন এবং বলেন : জাস্টিজ সায়েম আপতত হেড অব দি স্টেট থাকতে পারেন। জেনারেল জিয়া আর্মি চিফ থাকবেন। উই মাস্ট মুভ কুইকলি।
ক্যান্টনমেন্ট এবং রাজপথের দেয়াল উঠে গেছে তখন। সিপাইরা অবাধে চলে যাচ্ছেন বাইরে। ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে তখনও যে সিপাইরা ঘুরছেন তারা এক পর্যায়ে মুখোমুখি হন তাহের এবং জিয়ার। তাহের ভেতরে ভেতরে ক্ষুব্ধ আছেন। তাহের ভেবেছিলেন জিয়াকে ব্যবহার করে পরিস্থিতি তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখবেন এখন উল্টো জিয়া তাহেরকে ব্যবহারের চেষ্টা করছেন। অভ্যুত্থানের আদর্শকে যেন জিয়া বিপথগামী করতে না পারেন সেজন্য তাহের চেষ্টা চালিয়ে যান জিয়াকে যতটা সম্ভব তার নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আনতে। সিপাইদের মুখোমুখি হলে, তাহের জিয়াকে বলেন : আপনি জোয়ানদের উদ্দেশে কিছু বলেন।
জিয়া খুব সংক্ষেপে বলেন; আমি রাজনীতি বুঝি না; ধৈর্য ধরেন। নিজের ইউনিটের শৃঙ্খলা বজায় রাখেন। আপনাদের দাবিগুলো লিখিত দেন।
জিয়া যে ক্রমশ তার হাত থেকে পিছলে যাচ্ছেন তা বেশ টের পান তাহের।
তাহের তার পরিকল্পনা অনুযায়ী জিয়াকে সামনে রেখে কাজ এগিয়ে নিয়ে যাবার চেষ্টা চালিয়ে যান। তার মূল লক্ষ্য যত তাড়াতাড়ি সম্ভব জাসদের সব বন্দিদের মুক্ত করা। প্রত্যাশিত বাধা মোশতাককে প্রতিহত করতে সক্ষম হলেও অপ্রত্যাশিত বাধা জিয়া যে ক্রমশ তার নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছেন তা বেশ টের পাচ্ছেন তাহের! টু ফিল্ডে গিয়ে তাহের জানতে পারেন খালেদ মোশারফকে হত্যা করা হয়েছে। চিন্তিত হয়ে পড়েন তাহের। উপস্থিত কয়জন সিপাইদের জিজ্ঞাসা করেন এই হত্যার সাথে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার কেউ জড়িত আছে কিনা। তাহের জানতে পারেন, বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার কেউ এতে জড়িত নয়। টেনথ বেঙ্গলের হেডকোয়ার্টারের সিও নওয়াজিসের কাছে আশ্রয় নেবার পর তার ইউনিটেরই আসাদ এবং জলিল নামে দুই মেজর খালেদ মোশারফ, কর্নেল হুদা ও হায়দারকে প্রকাশ্যে গুলি করেছেন। পরিস্থিতি ঘোলাটে হয়ে উঠছে। টু-ফিল্ডে মিটিং সেরে তাহের আবার রওনা দেন এলিফ্যান্ট রোডে জাসদ নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করতে। এত দ্রুত ঘটনার পট পরিবর্তন হচ্ছে যে এর সঙ্গে তাল রাখা হয়ে উঠছে দুষ্কর।
১০৯. বারো দফা
এলিফ্যান্ট রোডের ৩৩৬ বাড়িটির আর বিশ্রাম নেই। সেখান থেকেই মুহূর্তে মুহূর্তে জন্ম নিচ্ছে ইতিহাস। সেখানে মিলিত হন জাসদ এবং সৈনিক সংস্থার নেতৃবৃন্দরা। গোপন আস্তানা থেকে বেরিয়ে আসেন সিরাজুল আলম খান, আসেন ড. আখলাকও। মিটিং শুরু হবার আগে ইউসুফ তাহেরের কাছে অভ্যুত্থানের সময় সিরাজুল আলম খান এবং আখলাকের নিষ্ক্রিয় ভূমিকা জন্য উষ্মা প্রকাশ করেন। তাহের বলেন এসব কথা বাদ দিলেই ভালো। উনি তো বরাবরই ওরকম। কিন্তু উনার পলিটিক্যাল অ্যাডভাইসটা আমাদের দরকার।
পরিবর্তিত পরিস্থিতি নিয়ে আলাপ করতে বসেন তারা। ব্যাপারটা সবাই অনুধাবন করেন যে হিসাবে গণ্ডগোল হয়ে যাচ্ছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ হচ্ছে না। এক রাত আগেও বিপ্লবী সৈনিক সংস্থাকে অমিত শক্তিধর মনে হলেও রাত পোহাতেই দ্রুত যেন তার শক্তি ফুরিয়ে আসছে। মোশতাক, ফারুক, রশীদের অনুসারী সিপাইরা সৈনিক সংস্থার পেছনে দাঁড়িয়েছিলো, কারণ খালেদ মোশারফের অভ্যুত্থানের পাল্টা কোনো ব্যবস্থা নেবার অবস্থা তাদের ছিল না। বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার উদ্যোগ তাদের সদ্ভাবনার দ্বার খুলে দেয়। ফলে অভ্যুত্থান হয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে তারা তাদের মুখোশ সরিয়ে মোশতাকের প্ররোচনায় নেমে পড়েছে ঘটনা নিজেদের দিকে টেনে নেবার ষড়যন্ত্রে। ওদিকে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার তুরুপের তাস জিয়া স্বয়ং চলে গেছেন তাদের হাতের মুঠোর বাইরে। জিয়াকে ক্যান্টনমেন্ট থেকে বাইরে নিয়ে যেতে ব্যর্থ হওয়াতে অভ্যুত্থানের কেন্দ্র রয়ে গেছে ক্যান্টনমেন্টে। রাজপথে সিপাই আর জনতা মিছিল করলেও সেখানে পরিকল্পনা মতো জাসদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তাদের জনসভা ভণ্ডুল হয়ে গেছে, তাদের কর্মীবাহিনীকে যথাযথভাবে তারা মাঠে নামাতে পারেননি, নেতারাও জেল থেকে বেরিয়ে আসেননি। সব মিলিয়ে জাসদের নেতৃবৃন্দ টের পান যে অভ্যুত্থানের ওপর তাদের কর্তৃত্ব শিথিল হয়ে পড়েছে।
তাহের বলেন : আমাদের সময় খুব কম। হাল ছেড়ে দেওয়া যাবে না। জিয়াকে আমাদের গ্রিপে আনতে হবে। জিয়া বলেছেন লিখিত আকারে সৈনিকদের দাৰি দেয়াগুলো তাকে দিতে। এখন আমাদের প্রথম কাজ হবে সৈনিকদের দাবি দাওয়াগুলো লিখে ফেলা এবং তার পর সেগুলো তার কাছ থেকে সই করে নেওয়া। আজকের মধ্যেই তার সই নিতে হবে এবং তারপর তাকে বাধ্য করা হবে ঐ দাবিগুলো মানতে। সিরাজ ভাই আপনি কি বলেন?
সিরাজুল আলম খান তাহেরের প্রস্তাবকে সমর্থন করেন এলিফ্যান্ট রোডে উপস্থিত সৈনিকরা খানিকটা উদভ্রান্ত, ক্ষুব্ধ, বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন তখন। তাহের তাদের বলেন : যেহেতু তোমাদেরই দাবি এগুলো, দাবিনামাটা তোমরা তৈরি করো। সিপাইদের তৈরি করা দাবি নামা সিরাজুল আলম খান, তাহের, ইনু মিলে খানিকটা পরিমার্জনা করে দেন।
দাবিগুলো দাঁড়ায় এইরকমঃ
এক, আমাদের বিপ্লব নেতা বদলের জন্য নয়, বিপ্লব হয়েছে সাধারণ মানুষের স্বার্থের জন্য। এতদিন আমরা ছিলাম ধনীদের বাহিনী, ধনীরা তাদের স্বার্থে আমাদের ব্যবহার করেছে। পনেরই আগস্ট তার প্রমাণ। তাই এবার আমরা ধনীর দ্বারা বা ধনীদের স্বার্থে অভ্যুত্থান করিনি, আমরা বিপ্লব করেছি জনগণের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে। আমরা জনতার সঙ্গেই থাকতে চাই, আজ থেকে বাংলাদেশের সেনাবাহিনী হবে গরিব শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষাকারী গণবাহিনী।
দুই, অবিলম্বে রাজবন্দিদের মুক্তি দিতে হবে।
তিন, রাজনৈতিক নেতাদের সাথে আলোচনা না করে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না।
চার, অফিসার এবং জওয়ানদের ভেদাভেদ দূর করতে হবে। অফিসারদের আলাদাভাবে নিযুক্ত না করে, সামরিক শিক্ষা এবং যোগ্যতা অনুযায়ী সামরিক বাহিনী থেকেই পদ মর্যাদা নির্ণয় করতে হয়।
পাঁচ, অফিসার এবং জওয়ানদের এক রেশন এবং একই রকম থাকার ব্যবস্থা করতে হবে।
ছয়, অফিসারদের জন্য আর্মির কোনো জওয়ানকে ব্যাটম্যান হিসাবে নিযুক্ত করা যাবে না।
সাত, মুক্তিযুদ্ধ, গণঅভ্যুত্থান এবং আজকের বিপ্লবে যারা শহীদ তাদের পরিবারের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
আট, ব্রিটিশ আমলের আইনকানুন বদলাতে হবে।
নয়, দুর্নীতিবাজদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করণ ও বিদেশে যারা টাকা জমিয়েছে সেই টাকা ফেরত আনতে হবে।
দশ, যে সমস্ত সামরিক অফিসার এবং জওয়ানদের বিদেশে পাঠানো হয়েছে, তাদের দেশে ফেরত আনতে হবে।
এগারো, জওয়ানদের বেতন সপ্তম গ্রেড হবে, ফ্যামিলি অ্যাকোমডেশন ফ্রি দিতে হবে।
বারো, পাকিস্তান ফেরত সামরিক বাহিনীর লোকদের আঠারো মাসের বেতন দিতে হবে।
বিকাল পাঁচটায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর আমূল পালটে ফেলার দাবিগুলো নিয়ে তাহের, ইনু এবং সৈনিক সংস্থার কয়জন নেতা চলে যান রেডিও স্টেশনে। বিচারপতি সায়েমকে রাষ্ট্রপতি নিয়োগ করা হয়েছে। তাহের জানেন বিকালে সায়েম আসবেন নতুন রাষ্ট্রপতি হিসেবে রেডিওতে ভাষণ দিতে, সঙ্গে বিদায়ী রাষ্ট্রপতি মোশতাক এবং জিয়াও থাকবেন। অন্যস্থানে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার নিয়ন্ত্রণ শিথিল হয়ে গেলেও রেডিও স্টেশন তখনও ছিল পুরো তাদের দখলে। সন্ধ্যার দিকে জিয়া রেডিও স্টেশনে গেলে সৈনিকরা তাকে ঘিরে ধরেন এবং দাবি দেওয়া গুলো পেশ করেন। সৈনিকরা তখন উদ্ধত। তারা বলেন এই দাবি দেওয়া না মানা হলে জিয়াকে তাড়া রেডিওতে ঢুকতে দেবেন না, এমনকি রাষ্ট্রপতিকেও না।
সৈনিক সংস্থার সদস্যদের দ্বারা ঘেরাও হলেও তেমন বিচলিত নন জিয়া, তিনি জানেন তার অবস্থান এখন মোটেও নাজুক নয়। হাবিলদার হাইয়ের কাঁধে হাত দিয়ে বেশ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে তিনি দাবি দেওয়াগুলো শোনেন। জিয়া বলেন : রাজবন্দিদের তো মুক্তি দিতেই হবে। মেজর জলিল আমার ইয়ার। জলিল, রবকে আজই জেল থেকে মুক্তি দেবার ব্যবস্থা করব। আর সিপাইদের বেতন অত তো বাড়ানো যাবে না, তিন শ টাকা দেওয়া যেতে পারে, তা না হলে দেশের অন্য লোক খাবে কি? আর হ্যাঁ, ঠিকই বলেছ ব্যাটম্যান প্রথাও তো বাতিল হাতে হবে।
এভাবে অন্য দাবিগুলোর ব্যাপারেও নানা টুকরো মন্তব্য করে তিনি সেগুলো মেনে নেবার একটা ঝাপসা প্রতিশ্রুতি দেন। পাশে দাঁড়িয়ে ফুঁসছেন তাহের। তিনি দৃঢ়কণ্ঠে বলেন : আপনি মুখে না বলে এই দাবি নামার কপিগুলোতে সই করেন।
জিয়া বেশ স্বতঃস্ফূর্তভাবে বলেন : অফ কোর্স, দেখি কপি গুলো, কলম আছে কারো কাছে?
একজন সিপাই একটা কলম এগিয়ে দেন এবং জিয়া বারো দফা দাবির তিন কপিতে সই করেন। এক কপি নিজের কাছে রাখেন, এক কপি রাখে সৈনিক সংস্থা এবং তাহের বলেন আরেক কপি রেডিও এবং পত্র পত্রিকায় পাঠাতে প্রচারের জন্য।
জিয়া তাহেরের সঙ্গে আর কোনো কথা না বলে সোজা ঢুকে যান রেডিও স্টেশনে। সন্ধ্যায় নতুন রাষ্ট্রপতি হিসেবে ভাষণ দেন বিচারপতি সায়েম। কিন্তু তাহের নিশ্চিত হতে পারেন না কতটা প্রতিশ্রুতি জিয়া রাখবেন।
পদে পদে আশা, সন্দেহ, ক্ষোভ, বিভ্রান্তির এক কুয়াশার মধ্য দিয়ে দ্রুত এগুতে থাকে ঘটনা।
১১০. অফিসারের রক্ত চাই
অভ্যুত্থানের প্রাথমিক উত্তেজনায় বিবিধ স্লোগানের মধ্যে কোনো কোনো সিপাই শ্লোগান দিয়েছিলেন সিপাই সিপাই ভাই ভাই অফিসারের রক্ত চাই। অফিসারদের উপর চরম ক্ষুব্ধ তখন সিপাইরা। অভ্যুত্থানপূর্ব মিটিংয়ে কেউ কেউ জিয়া এবং অন্য অফিসারদের হত্যা করার ইচ্ছাও পোষণ করেছিলেন। কিন্তু তাহেরের স্পষ্ট নির্দেশ ছিল কোনোভাবে হত্যায় জড়িয়ে পড়া যাবে না। কয়েক ঘণ্টা ধরে বক্তৃতা দিয়ে তাহের সিপাইদের উগ্রতা প্রশমিত করার চেষ্টা করেছেন। তাদের বার বার বুঝিয়েছেন হত্যাকাণ্ডই বিপ্লব নয়। তার বক্তৃতা অভ্যুত্থানের তুঙ্গ মুহূর্তে কাজ দিয়েছে। তা না হলে জিয়াকে যখন মুক্ত করা হয় তখন তার চারপাশে সব সশস্ত্র সৈনিক, যে কারো পক্ষে তাকে তখন হত্যা করা খুবই সহজ। হত্যা তখন আটপৌড়ে ব্যাপার। একইভাবে সাত তারিখ ভোর রাতে মেস এবং বাসা থেকে অসংখ্য অফিসারদের ধরে এনে সৈনিকরা লক আপ করে রেখেছেন টু ফিল্ড আর্টিলারিতে। ঘুমের পোশাক পড়া, নিরস্ত্র সেইসব অফিসারদের সদলবলে ব্রাশফায়ার করে রক্তগঙ্গা বইয়ে দিতে পারত সৈনিকরা। তাহেরের বারংবার সাবধানী নির্দেশ তাদের সে কাজ থেকে বিরত রেখেছে প্রাথমিকভাবে।
কিন্তু সাত তারিখ সারাদিন ধরে পরিস্থিতি কেবল ঘোলাটে হয়ে যাচ্ছে। সৈনিকরা বেরিয়ে এসেছেন রাজপথে। কথা ছিল তারা জনতার হাতে অস্ত্র তুলে দিয়ে সম্মিলিতভাবে ডাক দেবেন বিপ্লবের। কথা ছিল জিয়া আর তাহের এসে উন্মুক্ত জনসভায় বক্তৃতা দেবেন। কিছুই ঘটেনি। জিয়া রয়ে গেছেন ক্যান্টনমেন্টে, তাহের তার ক্রাচে ভর করে ছোটাছুটি করছে ক্যান্টনমেন্ট, এলিফ্যন্ট রোড়, রেডিও স্টেশন। এর মাঝে আবার হঠাৎ নারায়ে তাকবীর ধ্বনি তুলে মাটি ফুড়ে বেরিয়েছে মোশতাকের দল। সৈনিকেরা তখনও শহরময় ঘোরাঘুরি করছেন। তারা ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরিয়ে এসেছেন মাঝ রাতে, এরপর তারা কি খাবেন, কোথায় থাকবেন ঠিক নাই। জাসদ নেতৃবৃন্দও স্পষ্ট কোনো নির্দেশনা দিতে পারছেন না। তাহের তার নাগালের বাইরে চলে যাওয়া পরিস্থিতি সামাল দিতে চেষ্টা করছেন আপ্রাণ। স্পষ্ট হয়ে উঠছে তাহের এবং জিয়ার দূরত্ব। রাতের অন্ধকারে অস্ত্রাগার ভেঙ্গে, হাতে হাতে অস্ত্র নিয়ে সিপাইরা রাজপথে বেরিয়ে এসেছিল যুগান্তকারী এক সেনাবাহিনী গড়ে তুলবার স্বপ্ন নিয়ে। কিন্তু স্বপ্ন যেন দিন না ফুরাতেই ধূলিসাৎ হতে বসেছে। সৈনিকদের মধ্যে জন্ম নিতে থাকে দ্বিধাদ্বন্দ, সন্দেহ, অনিশ্চয়তা। তাদের চেপে থাকা ক্ষোভ উসকে ওঠতে থাকে আবার।
সন্ধ্যারাতে এক সৈনিক হঠাৎ আর্মির এক লেডি ডাক্তারকে সামনে পেয়ে গুলি করে দেন। কিছুদিন আগে এই সিপাই তার গর্ভবতী স্ত্রীকে নিয়ে এই মহিলা ডাক্তারের কাছে গেলে অফিসার ডাক্তারটি তার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছিলেন। এই ঘোলাটে অবস্থার সুযোগে সৈনিকটি তার প্রতিশোধ নেন। এক ক্যাপ্টেন জনসমক্ষে সৈনিকদের নিয়ে টিটকারী করলে সোজা তার বুক লক্ষ করে গুলি ছোড়ে এক সিপাই। ব্যক্তিগত আক্রোশ, হঠাৎ উস্কানী ইত্যাদি মিলিয়ে সিপাইদের হাতে বিচ্ছিন্ন কয়েকটি হত্যাকাণ্ড ঘটে যায় ক্যান্টনমেন্টে। রাতে কিছু ক্ষুব্ধ সৈনিক নানা অফিসারের বাসায় হামলা চালান। কোনো কোনো অফিসারকে লাঞ্চিত করেন। অফিসারদের মধ্যে আতংক ছড়িয়ে পড়ে দ্রুত। তারা রাতের অন্ধকারে পালিয়ে যেতে শুরু করেন ক্যান্টনমেন্ট থেকে।
রাত পোহায়। থমথমে হয়ে ওঠে ক্যান্টনমেন্ট। সৈনিকরা খোঁজ পেয়েছেন তাদের যে কারো দফা পত্রিকা এবং রেডিওতে প্রচারিত হবার কথা ছিল তা বন্ধ করে দিয়েছেন জেনারেল জিয়া। সৈনিকদের সুপ্ত আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখে ধোয়া উঠতে থাকে আবার। অসংখ্য সৈনিক তখনও ক্যান্টনমেন্টের বাইরে ঢাকা শহরের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে, ক্যান্টনমেন্টের ভেতর যারা আছেন তারা অস্ত্র হাতে ক্ষুব্ধ ঘুরে বেড়াচ্ছেন যত্রতত্র। অফিসাররা সম্ভস্ত্র। অফিসে যাওয়ার পথে এক ক্যাপ্টেনের কাঁধের র্যাঙ্কের পিপগুলো ছিঁড়ে ফেলেন বিক্ষুব্ধ কিছু সৈনিক। অফিসাররা কোনো র্যাঙ্ক না লাগিয়ে যাতায়াত শুরু করেন অফিসে। এয়ারপোর্টে, ক্যান্টনমেন্টের কয়েকটি জায়গায় কিছু অফিসার হত্যার খবর পাওয়া যায়। জিয়া ফোন করেন তাহেরকে : তাহের, তোমার লোকেরা আমার অফিসারদের হত্যা করছে।
তাহের বলেন : আমি এখনি আসছি ক্যান্টনমেন্টে।
জিয়া : তোমার আসার কোনো দরকার নাই। ক্যান্টনমেন্টের বাইরের সোলজারদের তুমি ভেতরে পাঠাও।
তাহের ইনু এবং বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার নেতাদের রাগান্বিত হয়ে বলেন : আমার ক্লিয়ার ইনস্ট্রাকশন ছিল কোনো রকম কিলিংয়ে না যাওয়া, তারপরও কেন এসব কিলিং হলো?
ইনু : তাহের ভাই, আমারও স্পষ্ট নির্দেশ আছে কোনো হত্যাকাণ্ড না ঘটাতে। আপনি জানেন যে খালেদ মোশারফ মারা গেছেন তারই ইউনিটের মেজর আসাদ আর জলিলের গুলিতে, বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার কেউ সেখানে জড়িত ছিল না। আসলে মোশতাকের তৈরি একটা খুনী চক্র অফিসার হত্যার আওয়াজ তুলে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে দোষ চাপাচ্ছে সিপাইদের ওপর। জিয়ারও কোনো ইশারা এখানে থাকতে পারে। আর আমাদের পক্ষ থেকে যদি অফিসার হত্যার কোনো নির্দেশ থাকত তাহলে এতক্ষণে ক্যান্টনমেন্টে কয়েকশত অফিসারের লাশ পড়ে থাকত। চাইলে পুরো ক্যান্টনমেন্ট সাফ করে দিতে পারত আমাদের সৈনিকরা। বিচ্ছিন্নভাবে দশ, বারোজন অফিসার এই দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন।
হাবিলদার হাই বলেন : খালেদ মোশারফের খুব কাছের মানুষ কর্ণেল গাফফারকে স্যার আমিই সাত তারিখ রাতে নিরাপদ হেফাজতে রেখে আসছি। এয়ার ফোর্সের কয়জন কিছু আর্মি অফিসারদের মেরে ফেলার চেষ্টা করছিল। আমি তাদের সবাইকে বাঁচাইছি। কিন্তু সৈনিকদের সামাল দেওয়া মুস্কিল হচ্ছে স্যার। ঘটনা কোনো দিকে যাচ্ছে তারা বুঝতে পারছে না। ক্ষেপে গিয়ে যাকে তাকে মারছে।
তাহের : ঘটনা আমাদের প্ল্যান মতো হচ্ছে না। সৈনিকদের বারো দফা পেপারে, রেডিওতে যায়নি। রবকে এখনও মুক্তি দেওয়া হয়নি। কিন্তু সাবধানে মুভ করতে হবে। এধরনের হত্যাকাণ্ড কিছুতেই চালানো যাবে না।
আলোচনা ওঠে সৈনিক সংস্থার যারা শহরের বাইরে আছেন তাদের ক্যান্টনমেন্টে ফেরত যেতে বলা হবে কিনা। সৈনিক সংস্থার সদস্যরা বলেন : ক্যান্টনমেন্টে একবার ঢুকে গেলে তারা পুরোপুরি জিয়ার নিয়ন্ত্রণে চলে যাবেন, তাদের আর কোনো শক্তিই থাকবে না। তারা বলেন বারো দফা না মানা পর্যন্ত তারা অস্ত্র জমা দেবে না, ক্যান্টনমেন্টে ফেরত যাবে না। যেমন একাত্তরের রণাঙ্গনে তেমনি যেন আবার সৈনিক আর জনতা মিলেছে শহরের রাস্তায়। সৈনিকরা আর সাধারণ মানুষের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে চাইছিলেন না।
তাহেরও এই অসমাপ্ত মুক্তিযুদ্ধের কথাই বলে আসছেন অবিরাম, বলছেন সিপাই আর জনতার মিলনের কথা। সিপাইরা যত জনতার সঙ্গে মিলিত থাকবে তত বাড়বে তাদের শক্তি। তাহেরও বলেন : আমি তোমাদের সাথে একমত। এখন ক্যান্টনমেন্টে ফিরে যাওয়া নোকামী হবে। তবে যে উদ্দেশে আমরা অভ্যুত্থান করেছি তা রক্ষা এবং বাস্তবায়নের জন্য সিপাইদের ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। বাইরে থেকেই জিয়া ও নতুন সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করব আমরা। তবে আমাদের যারা ক্যান্টনমেন্টে আছে, তাদের স্পষ্ট করে বলে দিতে হবে, কোনো কিলিং যেন এখন না হয়।
হাইজ্যাক হয়ে যাওয়া বিপ্লবকে পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করেন তারা। প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে আবার অসংখ্য লিফলেট ছাপিয়ে সারা শহরে বিলি করা হয়। লিফলেটে বিরাট অক্ষরে লেখা হয় : সিপাই বিপ্লবকে এগিয়ে নিন।
বিকালে জাসদ এবং গণবাহিনীর উদ্যোগে বায়তুল মোকাররমে জনসভার সিদ্ধান্ত হয়। জিয়া প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন রব এবং জলিলকে মুক্তি দেওয়া হবে। জাসদ প্রত্যাশা করেছিল মুক্ত হয়ে জলিল এবং রব এই জনসভায় বক্তৃতা দেবেন এবং অভ্যুত্থানের পেছনে জাসদের ভূমিকাকে স্পষ্ট করকে অভ্যুত্থানের সময় আত্মগোপন করলেও সিরাজুল আলম খান জনসভা জগঠনে নেমে পড়েন। বিকালে বায়তুল মোকাররমে বিশাল জনসমাগম হও ভকে বিলম্বে জলিল এবং রবকে মুক্তির দেওয়ার কারণে তারা সে সভায় মা দিতে পারেননি। পুলিশ হামলা করে সে জনসভায়। জাসদ ছাত্রলীনতা মাহবুবুল হক পুলিশের গুলিবর্ষণে আহত হন।
এ ঘটনায় আবারও উত্তপ্ত হচ্ছে উঠে ক্যান্টনমেন্টে অবস্থানকারী বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সদস্যরা। শৃঙ্খলার দুর্বলতার সুযোগে অনেক সশস্ত্র গণবাহিনীর সদস্যও তখন ঢুকে পড়েছে ক্যান্টনমেন্টে। বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সদস্য, গণবাহিনীর সদস্যরা আওয়াজ তোলেন যে জেনারেল জিয়া ১২ দফা মানবার কথা দিয়ে কথা রাখেনি, ওয়াদা খেলাপ করেছেন, প্রতারণা করেছেন তাদের সঙ্গে। সে রাতে আরও কয়জন অফিসার নিহত হন। অফিসাররা পারিবার পরিজন নিয়ে পালিয়ে যেতে থাকেন ক্যান্টনমেন্টে থেকে। কোন কোনো অফিসার রাতের অন্ধকারে বোরখা পড়েও গা ঢাকা দেন।
নয় নভেম্বর জাসদের নেতারা আবার মিটিংয়ে বসেন। মিটিংয়ের নিয়মিত সদস্যের বাইরেও এবার যোগ দেন জলিল এবং রব, যারা জেল থেকে মুক্ত হয়ে এসেছেন সদ্য। ঢাকার বাইরে থেকে এসে যোগ দেন শরীফ নুরুল আম্বিয়া। আর্মি অফিসারদের মধ্যে জাসদের অন্যতম এবং একমাত্র সক্রিয় সদস্য মেজর জিয়াউদ্দীন যিনি অভ্যুত্থানের সময় ছিলেন খুলনায়, তিনিও ফিরে এসে যোগ দেন মিটিংয়ে।
তাহের বলেন : এটা স্পষ্ট যে মূলত দুটো কারণে হাতের মুঠোয় সাফল্য পেয়েও আমরা তা ধরে রাখতে পারিনি। প্রথমত জিয়াউর রহমানের বিশ্বাসঘাতকতা, দ্বিতীয়ত আমাদের গণজমায়েত করার ব্যর্থতা। আমাদের বিপ্লবের মিলিটারি ডায়মেশনটা সাকসেসফুল হলেও সিভিল ডায়মেশনে আমরা ফেইল করে গেছি। জাসদের যে শক্তির কথা আপনারা বলেছিলেন আমি বিশ্বাস করেছিলাম কিন্তু তার প্রতিফলন রাস্তায় ঘটেনি। আমাদের প্রধান বাধা এখন একটাই, জিয়াউর রহমান। তাকে আমরা কিভাবে ট্যাকল করব সেটাই প্রশ্ন।
ড. আখলাক বলেন : আমি তো আগেই বলেছিলাম আমরা এখন রেডি না। এই মুহূর্তে জিয়ার সাথে আবার কনফ্রন্তেশনে যাওয়া কি ঠিক হবে?
তাহের : জিয়া যদি বিশ্বাসঘাতকতা না করতেন, ডেফিনিটলি অবস্থা আমাদের কন্ট্রোলে আনতে পারতাম। জিয়ার সাথে আপস করার তো প্রশ্নই ওঠে না।
জলিল, রব সকলেই তাহেরকে সমর্থন করেন। সিদ্ধান্ত হয় সৈনিকদের দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত জিয়ার ওপর চাপ প্রয়োগ অব্যাহত রাখতে হবে। ঠিক হয় যে সৈনিকরা ক্যান্টনমেন্টের বাইরে চলে এসেছেন, তারা অস্ত্র জমা দেবেন না। পাশাপাশি জলিল, রব যেহেতু মুক্ত হয়েছেন তারা জাসদের গণসংগঠনগুলোকে সক্রিয় করে তুলবেন। সিপাই বিদ্রোহের লক্ষ্য ব্যাখ্যা করে জনগণের মধ্যে লিফলেট বিলি অব্যাহত রাখতে হবে। সিদ্ধান্ত হয় ঢাকায় যেহেতু নিয়ন্ত্রণ শিথিল হয়ে গেছে সুতরাং ঢাকার বাইরে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালাতে হবে। তারপর সেখান থেকে চাপ সৃষ্টি করতে হবে ঢাকার ওপর। ঢাকার বাইরের ক্যান্টনমেন্টগুলোতে বিপ্লবী সৈহিক সংস্থার কর্মকাণ্ড সীমিত মাত্রায় ছিল তাকে বেগবান করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, রংপুর অন্যান্য ক্যান্টনমেন্টের সৈনিকদেরও সংগঠিত করবার জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয় নির্দিষ্ট সৈনিকদের। মেজর জিয়াউদ্দীনকে বলা হয় সুন্দরবন গিয়ে তার পুরনো এলাকার দখল নিতে। শরীফ নুরুল আম্বিয়া দায়িত্ব নেন ঢাকার বাইরের গণবাহিনীর কর্মকাণ্ড সমন্বয় করার।
তাহের যখন জিয়াকে মোকাবেলার নানা পথ বের করছেন, জিয়া তখন ধরেছেন অন্য পথ। তিনি একের পর এক সিপাইদের সাথে মিটিং করে চলেন, ফাস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে মাঠে, গ্যারিসন হল অডিটরিয়ামে, গলফ পার্কের কাছে। নানা নাটকীয়তা করেন তিনি সেসব মিটিংয়ে। তিনি সিপাইদের বলেন : আমি সৈনিক, রাজনীতি বুঝি না। ব্যারাকেই থাকব। আপনারা শৃঙ্খলা বজায় রাখেন। এরপর তিনি একটি কুরআন শরীফ আনতে বলেন, সবার সামনে কুরআন ছুঁয়ে বলেন, আমি নব্বই দিনের মধ্যে নির্বাচন দেব। আরেক সভায় বক্তৃতা করতে গেলে অনেক সৈনিকই বারো দফার দাবি তোলেন। হৈ হট্টোগোল তৈরি হয় সভায়। সেই সভায় উত্তেজনাবশত এক সিপাইয়ের অন্ত্র থেকে ভুলক্রমে গুলি বেরিয়ে গেলে সেখানেই দুজন সিপাই নিহত হন। ইরম এক অরাজক অবস্থা। জিয়া হঠাৎ তার ইউনিফর্মের বেল্ট খুলে রেখে বলেন, আপনারা আমার কথা শুনছেন না, আমি আর আপনাদের চিফ থাকব না।
সেনাপ্রধানের এ আচরণ দেখে হতবিহ্বল হয়ে পড়ে সিপাইরা। তারাই আবার দ্রুত গিয়ে তার বেল্ট ফিরিয়ে দিয়ে বলেন, কি করেন স্যার, কি করেন স্যার। বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন সিপাইরা। বহু বছরের নির্দেশ পালনের অভ্যস্থতায় তারা কোন দিকে যাবেন বুঝে উঠতে পারে না। ক্যান্টনমেন্টের বাইরে থেকে তাদের নির্দেশ দিচ্ছেন অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল তাহের আর ভেতরে নির্দেশ দিচ্ছেন সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়া। দোদুল্যমান সিপাইদের কাছে ক্রমশ ক্যান্টনমেন্টের ভেতরের নির্দেশই শক্তিশালী হতে থাকে। দুর্বল হতে থাকে তাহেরের অবস্থান।
ঘনিষ্ঠ অফিসারদের জিয়া জড়ো করেন তার চারপাশে। তাকে ঘিরে আছেন মীর শওকত আলী, আমিনুল হক, কর্নেল হামিদ, নুরুদ্দীন প্রমুখরা। দিল্লিতে কোর্স করছিলেন ব্রিগেডিয়ার হুসাইন মোহাম্মদ এরশাদ, তাকে ঢাকায় এনে পদোন্নতি দিয়ে ডিপুটি চিফ অফ স্টাফ করেন তিনি। তাদের সঙ্গে মিটিংয়ে বসেন জিয়া। তারা এই পরিস্থিতিতে দৃঢ় অবস্থান নেওয়ার জন্য জিয়ার ওপর চাপ দেন। তারা বলেন : সেনাবাহিনীতে চেইন অব কমান্ড তো গত কয়েক মাস ধরে ভেঙ্গেই পড়েছে, যতটুকু অবশিষ্ট ছিল তাকে ধূলিসাৎ করে দিয়েছে তাহেরের এই অভ্যুত্থান। একে আর কোনো রকম প্রশ্রয় দেওয়া চলবে না। নানা মন্তব্য চলতে থাকে মিটিংয়ে;
–অফিসার, সিপাই সমান সমান এসব স্টুপিড কথা শুঙ বি স্টপ ইমিডিয়েটলি।
–কি ঠেকা পড়েছে যে সিপাইদের এত তোষামোদ করে চলতে হবে আমাদের?
–বহু অপমান সহ্য করা হয়েছে, আর না। এবার ওদের শায়েস্তা করতে হবে।
–ঐ ল্যাংড়া তাহেরই সব নষ্টের মূল। তাকে টাইট দিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।
তারা জিয়াকে এও বলেন যে, গুজব উঠেছে তাহের জিয়াকে হত্যা করে এবার ক্ষমতা দখল করার প্ল্যান করছে।
জিয়া বলেন : আপনারা ধৈর্য ধরেন। আমাদের এ অবস্থাটা ফেস করতে হবে। আমি ওদের দাবি দেওয়া মিটায়ে দেব।
জিয়া যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে স্পেশাল কমান্ডো ইউনিটকে ঢাকায় এনে ঘিরে ফেলেন ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট। কিছু কিছু ইউনিটকে তিনি বদলি করেন ঢাকার বাইরের ক্যান্টনমেন্টে। কয়জন রাজনৈতিক নেতার সঙ্গেও গোপনে মিটিং করেন হতিনি। জিয়ার ঘনিষ্ঠ অফিসাররা এদিকে নিয়মিত সৈনিকদের সঙ্গে মিটিং করে। তাদেরকে বারো দফার অসারতা বুঝাতে থাকেন। বুঝান, হাতের পাঁচ আঙ্গুল এক না, চাইলেই সিপাই আর অফিসার এক হয়ে যায় না। তাদের বলেন, তোমাদের বিপ্লব শেষ, এখন ঠিকমতো কাজে আস।
যেমন আর্মির সিনিয়র অফিসাররা তেমনি বিপ্লব বিরোধী বুদ্ধিজীবীরাও তখন এসে দাঁড়িয়েছেন জিয়ার পাশে। ডানপন্থী পত্রিকা ইত্তেফাকের কলামিস্ট এই অভ্যুত্থান বিষয়ে লিখতে গিয়ে মন্তব্য করেন : অন্ধকার গহ্বর হইতে সার্পেন্টাইনরা বাহির হইয়াছে। গোড়াতে ইহাদের আন্ডাবাচ্চাসহ নির্মুল করিতে হইবে। মার্ক টাইম করিবার সময় নাই।
চীনাপন্থী বাম নেতারা তাহেরের এই তৎপরতাকে বলেন ভারতীয় উস্কানী। তারা বলেন, অফিসারদের হত্যা করে বাংলাদেশের সেনাবাহিনীকে দুর্বল করে জাসদ আসলে ভারতের পক্ষে কাজ করছে। কেউ কেউ বলেন, এই অভ্যুত্থান পেটি বুর্জুয়া হঠকারিতা, রোমান্টিকতা।
১১১. চকিত সঙ্গ
রোমান্টিক বিপ্লবের নেতার অবশ্য কোনো ক্লান্তি নেই। দোসরা নভেম্বর অসুস্থ শরীরে গাড়ির পেছনে লুৎফার বানিয়ে দেওয়া বিছানায় শুয়ে সেই যে নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকায় এসেছে তাহের এর আর লুৎফার সঙ্গে কোনো দেখা নেই। ফোনে বার কয়েক কথা হয়েছে মাত্র। সাতই নভেম্বরের তোলপাড়ের বেশ কয়দিন পর লুৎফা নারায়ণগঞ্জ থেকে এলিফ্যান্ট রোডে আসেন। তুমুল ব্যস্ত তখন তাহের। একের পর এক মিটিং করে চলেছেন। ছুটে বেড়াচ্ছেন এ জায়গা থেকে সে জায়গায়। লুৎফাকে দেখে মিটিং থেকে ছুটে আসেন তাহের : ভয় পাওনি তো?
লুৎফা : ভয় পাবো না মানে? তোমার একটুও চিন্তা হলো না? এতবড় একটা অ্যাকশন করলে, আমি নারায়ণগঞ্জে আছি কি হয় না হয়।
হো হো করে হেসে ওঠে তাহের : আরে তোমাকে কিছু করার সাহস এ দুনিয়ায় কারো আছে নাকি?
অভিমান করেন লুৎফা: থাক আর বাহাদুরি ফলাতে হবে না। তুমি তো জনগণের নেতা, আমাকে সময় দেবার ফুসরত আছে নাকি তোমার?
তাহেরঃ একটু ধৈর্য ধরো প্লিজ। প্রচণ্ড একটা ক্রাইসিসের মধ্যে আছি। সব কিছু এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।
লুৎফা: তোমার আলসারের ব্যাথাটা কেমন?
আলসারের চিন চিন ব্যাথাটি তাহেরের সর্বক্ষণিক সঙ্গী, কিন্তু তিনি তখন ইতিহাস রচনায় ব্যস্ত।
তাহের বলেন : ঐ ব্যথার কথা তো ভুলেই গেছি।
লুৎফার গালে হালকা স্পর্শ করে বলেন, পরে কথা হবে। তাহের আবার ঢুকে যান মিটিংয়ে।
পেছন থেকে দেখে লুৎফা। সেই চেনা মূর্তি। হাফ প্যান্ট পড়া। একটি পায়ে হাঁটুর নিচ থেকে শূন্যতা। সেখানে কাঠের পায়ের ঠক ঠক। ঐ শব্দ তুলেই তিনি যেন কেবল এগিয়ে যাচ্ছেন সামনে, তার নিয়তির দিকে।
১১২. বন্দি
তাহের জাসদ নেতৃবৃন্দের সাথে অলোচনা করে আরেকটি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন। সিদ্ধান্ত নেন এবার জিয়াকে উৎখাত করবেন। জিয়ার বিশ্বাসঘাতকতার প্রতিশোধ নেবেন তারা। জিয়ার মাধ্যমে রাষ্ট্রচালনার পরিকল্পনা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। এবার আর কারো মাধ্যমে নয় নিজেরাই রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করবেন। জাসদের কোনো কোনো নেতৃবৃন্দের দোদুল্যমানতা থাকলেও তাহের দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, এবার জিয়ার বিরুদ্ধেই আরেকটি অভ্যুত্থান সংগঠিত করবেন তিনি। সেনাবাহিনীর জোয়ান, কৃষক, শ্রমিক এবং বুদ্ধিজীবীদের সমন্বয়ে অবিলম্বে বিপ্লবী কাউন্সিল গঠন করার আহ্বান জানিয়ে ১৫ নভেম্বর জাসদের পক্ষ থেকে একটি লিফলেট ছাড়া হয় শহরে।
জিয়া নিজেকে নিয়ে গেছেন শক্ত অবস্থানে। তিনিও তার বিপদ আঁচ করতে থাকেন, জানেন তাহের সহজে হাল ছাড়বেন না। কিন্তু পরিস্থিতি এখন অনেকটাই তার দখলে। জিয়া, জাসদ এবং বিপ্লবী সৈনিক সংস্থাকে দমন করতে কঠোর ব্যবস্থা নিতে শুরু করেন। শুরু হয় ব্যাপক গ্রেফতার। আদমজী থেকে জাসদ নেতা ফজলে এলাহী বিরাট শ্রমিক মিছিল নিয়ে ঢাকায় রওনা দিলে সেনাবাহিনীর লোকেরা পিটিয়ে মিছিল ভেঙ্গে দেয় এবং ফজলেকে গ্রেফতার করা হয়। বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার শুন্যতম নেতা হাবিলদার হাই ফজলেকে উদ্ধার করতে গেলে গ্রেফতার করা হয় তাকেও। গোয়েন্দা বিভাগকে কাজে লাগিয়ে ক্যান্টনমেন্টে সৈনিক সংস্থার সদস্যদের চিহ্নিত করে এক এক করে গ্রেফতার করা শুরু হয়। অভিযান চলে সারাদেশে। গ্রেফতার করা হয় হাজার হাজার জাসদের গণবাহিনী কর্মী।
কানাঘুষা শোনা যায় তাহেরকে গুপ্ত ঘাতক দিয়ে মেরে ফেলা হবে। ইউসুফ বলেন : তোমার আর এলিফ্যান্ট রোডের বাসায় থাকার দরকার নেই। ইউসুফ গাড়ি ড্রাইভ করে একেকদিন একেক জায়গায় রেখে আসেন তাহেরকে। এলিফ্যান্ট রোডে জাসদের মিটিং করা বন্ধ করে দেওয়া হয়। মিটিং হয় একেক দিন একেক গোপন জায়গায়। ইউসুফই গাড়ি চালিয়ে বিভিন্ন গন্তব্য থেকে নিয়ে আসেন তাহেরকে। ইউসুফ ছাড়া কেউ জানেন না তাহেরের অবস্থান।
৭ নভেম্বরের পর বেশ কিছুদিন নারায়ণগঞ্জে তাহেরের বাসা পুলিশ পাহারা দেয়। ২১ নভেম্বর লুৎফা হঠাৎ লক্ষ করে পুলিশ পেট্রোল সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। তাহের তখন ঢাকায় আত্মগোপন করে আছেন। তাহের ফোন করলে তাকে এখবর জানান লুৎফা! তাহের বলেন : সাবধান থেকো।
ঐদিন রাতে ইউসুফ আর তার স্ত্রী নারায়ণগঞ্জে গিয়ে লুৎফার সঙ্গে থাকেন। পরদিন সকালে তারা চলে যান ঢাকায়। ঘণ্টাখানেক পর ইউসুফের ফোন পান লুৎফা : জেলখানা থেকে বলছি।
লুৎফা : কি ব্যাপার?
ইউসুফ : তোমার ওখান থেকে ফিরে বাসায় গিয়ে দেখি আর্মি, পুলিশ ঘিরে রেখেছে চারদিক। আমাকে ধরে গাড়িতে করে নিয়ে এলো।
লুৎফা জিজ্ঞাসা করেন। তাহের কোথায়?
ইউসুফ : ফোনে বলতে পাচ্ছি না কিন্তু নিরাপদ আছে।
লুৎফা শাহাজাহান সিরাজের বাসায় ফোন করল। কে একজন তাকে জানায় : একটু আগেই এখান থেকে জলিল, রব, ইনুসহ সবাইকে ধরে নিয়ে গেছে পুলিশ।
ভয় পেয়ে যান লুৎফা। নিশ্চয় ওরা তাহেরকে হণ্যে হয়ে খুঁজছে?
সন্ধ্যায় অজ্ঞাত স্থান থেকে ফোন করেন তাহের : ইউসুফ ভাই তো জেলে।
লুৎফা বলেন : আমি অমি। তুমি কিন্তু সাবধানে থাকো।
ক্রোধ, আক্ৰোশ আর খানিকটা অসহায়তা ঘিরে ধরে যেন তাহেরকে। টের পান পরিস্থিতি তার জন্য কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে উঠছে। জানেন সম্ভাবনা নেই বললেই চলে তবু তাহের একবার চেষ্টা করেন জেনারেল জিয়ার সঙ্গে যোগাযোগের। যে লোকটির সঙ্গে তেলাঢালার মুক্তিযুদ্ধ ক্যাম্পে বহুদিন চা খেতে খেতে গল্প করেছেন একসাথে, বাড়ির লনে বসে দেশের ভবিষ্যতের কথা বলেছেন, মাঝরাতে ফোন করে যে লোকটি তার কাছে জীবনরক্ষার অনুরোধ জানিয়েছে, বন্দি দশা থেকে মুক্ত যে লোকটি তাকে জড়িয়ে ধরে বলেছেন ধন্যবাদ, তার সঙ্গে একবার সরাসরি কথা বলতে চান তাহের। টেলিফোন করেন বহুবার কিন্তু বারবার তাকে বলা হয় তিনি ব্যস্ত আছেন, ফোন ধরতে পারবেন না। জেনারেল জিয়া তখন তাহেরের ধরাছোঁয়ার বাইরে। তাহের বেশ টের পান জিয়া তখন আর কোনো ব্যক্তি নন, জিয়া তখন একটি রাষ্ট্র। যেন তখন তিনি রক্তকরবীর বাঞ্জা, অদৃশ্য কিন্তু ক্ষমতাধর। জিয়া তখন তার বিখ্যাত সানগ্লাস দিয়ে অদৃশ্য করে রাখেন তার চোখ। জানবার উপায় নেই তার চোখে কি খেলা করছে তখন।
একদিন শুধু তাহের ফোনে পান উপ সেনাপ্রধান এইচ এম এরশাদকে। তাহের ক্ষুব্ধ হয়ে এরশাদকে বলেন : জিয়াকে বলবেন সে একটা বিশ্বাসঘাতক এবং আমি কখনই আপস করব না। সৈনিকদের ১২ দফা দাবির ব্যাপারে কোনো ছাড় দেব না। জাসদ লিডার আর আমার ভাই ইউসুফকে এরেস্ট করার পরিণাম ভালো হবে না। তাকে বলবেন বিশ্বাসঘাতকতার পরিণাম তাকে ভোগ করতেই হবে।
এরশাদ বলেন : আমি তো কেবল ইন্ডিয়া থেকে আসলাম। আমি এসবের কিছুই জানি না।
বাংলাদেশের এই নাটকীয় পরিস্থিতিটি কাছ থেকে দেখবার জন্য এসময়ে আসেন সেই মার্কিন সাংবাদিক লরেন্স লিফশুলৎজ, যার সঙ্গে অনেকদিন আগে তাহেরের কথা হয়েছিল বাংলাদেশের নদী আর বন্যা নিয়ে। তিনি জেনে বিস্মিত হয়েছিলেন যে এই নদী প্রেমিকই বস্তুত সিপাই বিপ্লবের নেতা। আত্মগোপনে থাকা তাহেরের সঙ্গে লুকিয়ে দেখা করেন লিফশুলৎজ। যতই তিনি আত্মবিশ্বাস দেখান না কেন, ভেতরে ভেতরে বুঝতে পারেন অবস্থা নাজুক।
লিফশুলৎজের সঙ্গে পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলেন তাহের। বলেন : আসলে ঘটনার গতিধারা আমাদের অ্যাকশনে যেতে বাধ্য করেছে। সময়ের আগেই আমাদের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। ঘটনার আকস্মিক এত দ্রুত, উত্থান, পতন আর উত্তেজনাকর পরিস্থিতির স্রোতে আমরা ভেসে যেতে বাধ্য হয়েছি। তবে সিপাইরা কিন্তু খুব সফুলভাবেই অভ্যুত্থানটা সংগঠিত করেছে। ব্যাপারটা বানচাল করে দিয়েছে অফিসাররা, যার আশঙ্কা আমি করেছিলাম। আর এখন এই স্বার্থান্বেষী অফিসারদের প্রতিনিধি হয়ে উঠেছে জিয়া। আর জাসদের গণ সংগঠনগুলো থেকে যে সাড়া আশা করেছিলাম সেটা তারা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। ঢাকার বিভিন্ন এলাকার গণসংগঠনের যে ধারণা আমাকে দেওয়া হয়েছিল তার পুরোটা হয়তো ঠিক না। আর আমার নিজের তো মোবিলিটির একটা রেস্ট্রিকশন আছে, নিজে সরেজমিনে গিয়ে পরিস্থিতি দেখবার সুযোগ আমার ছিল না। আমাকে বিশ্বাস করতে হয়েছে। তবু আমি হাল ছাড়ব না।
ফার ইস্টার্ন ইকোনমিক রিভিউ পত্রিকায় তাহেরের ছবিসহ অভ্যুত্থানের খবর ছাপেন লিফশুলৎজ। তাহেরের ছবির নিচে লেখেন, নভেম্বর বিপ্লবের স্থপতি। লিফশুলৎজ তাহেরের পরবর্তী পদক্ষেপ দেবার জন্য ঢাকায় অপেক্ষা করেন। বহুবছর পর তিনিই প্রথম তাহেরকে নিয়ে গ্রন্থ রচনা করে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন এই ব্যতিক্রমী মানুষটির দিকে।
তার ভাই এবং অন্যতম সহকর্মীরা বন্দি হয়ে গেলেও গোপনে তৎপরতা চালিয়ে যান তাহের। গণবাহিনী এবং বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার যতটুকু অবশিষ্ট শক্তি আছে তাকে কাজে লাগিয়ে আঘাত হানার পরিকল্পনা করেন তিনি। আনোয়ার তখনও আছেন তাঁর সঙ্গে।
২৩ নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয়ে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার একটি পূর্বনির্ধারিত গোপন মিটিংয়ে অংশ নেন তাহের, সঙ্গে আনোয়ার। সে মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয় ২৪ নভেম্বর সৈনিক সংস্থার বিভিন্ন ইউনিট সংগঠকদের প্রতিনিধিত্বমূলক সভা হবে। আনোয়ারের বন্ধু এস এম হলের আবাসিক শিক্ষকের বাসায় এই মিটিং হবে ঠিক করা হয়। তাহের রিকশায় আনোয়ারসহ মোহাম্মদপুরে বড় ভাই আরিফের বাসায় যান। ইউসুফের স্ত্রী ছিলেন সেখানে। তাহের ঠাট্টা করেন তার সঙ্গে; ভাবী চিন্তা করবেন না, ইউসুফ ভাই জেলে গিয়ে তো বিখ্যাত হয়ে গেছে।
সেদিন তাহের এবং আনোয়ার সোবহানবাগে তাদের ফুকুর বাসায় থাকেন। সকালে বেরিয়ে যান আনোয়ার। ফিরে আসেন দুপুরের একটু পরে। তাদের মিটিং বিকাল পাঁচটায়। ভেবেছিলেন তাহেরকে নিয়ে একসঙ্গে যাবেন। আনোয়ার এসে শোনেন তাহের এস এম হলে রওনা হয়ে গেছেন। একটি বেবিট্যাক্সি নিয়ে রওনা দেন আনোয়ার। হল গেটের কাছে পৌঁছেই দেখেন কয়েক ট্রাক পুলিশ হল থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। আনোয়ার দ্রুত সরে পড়েন। জানতে পারেন তাহেরসহ মিটিংয়ে উপস্থিত সবাইকে ধরে নিয়ে গেছে পুলিশ। বুঝতে পারলাম আগের দিনের মিটিংয়ে উপস্থিত কোনো সদস্যই ধরিয়ে দিয়েছে তাহেরকে। তাহেরকে ধরিয়ে দেবার জন্য নানা কৌশল, ফাঁদ, পুরস্কারের ব্যবস্থা করেছে তখন সেনাবাহিনী।
ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে আসেন আনোয়ার। হতবিহ্বল হয়ে পড়েন। তাহেরের গ্রেফতারে চরম হতাশা নেমে আসে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা এবং জাসদের মধ্যে। তাদের মনে হয় তাহের বন্দি হওয়াতে যেন শেষ আশাটিও নির্বাপিত হলো।
জেল থেকে লুৎফাকে ফোন করেন তাহের; এরেস্ট হয়ে গেলাম। সাহস রাখো, চিন্তা করো না।
পরদিন জেল গেটে লুৎফা আর তাহেরের বড় ভাই আরিফ শীতের হাওয়ায় শুকনো পাতার উড়াউড়ি দেখতে দেখতে বসে থাকেন। তাদের কাছে তাহোরের জন্য কয়েকটি জামা-কাপড় আর তার নকল পাটি। জেল প্রহরী জিনিসগুলো তাদের কাছ থেকে বুঝে নিয়ে বিদায় করে দেন তাদের। তাহেরের সঙ্গে দেখা করার অনুমতি মেলে না।
১১৩. জীবন মৃত্য, পায়ের ভৃত্য
বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা আর গণবাহিনীর সদস্যদের মনে হয় অনেকদিন ধরে গড়ে তোলা একটা স্বপ্নের পাহাড় যেন তাদের চোখের সামনে ধসে পড়ছে। এই মরিয়া মুহূর্তে এক মারাত্মক সিদ্ধান্ত নিয়ে বসে গণবাহিনীর আগে থেকে তৈরি করে রাখা সুইসাইড স্কোয়াড। এই স্কোয়াডের নেতা বাহার। তাহেরেরই দুর্ধর্ষ সাহসী, সুদর্শন ভাই। সদস্য তার ভাই বেলালও। তাদের সঙ্গে আছেন চার তরুণ সবুজ, বাজু, মাসুদ এবং হারুন। তারা সিদ্ধান্ত নেয় সুইসাইড স্কোয়াডের মাধ্যমে কোনো একজন রাষ্ট্রদূতকে জিম্মি করে জিয়া সরকারকে বাধ্য করা হবে তাহেরসহ অন্যান্য বন্দি জাসদ নেতাদের মুক্তি এবং সৈনিকদের দাবি মানতে বাধ্য করতে। এ প্রসঙ্গে তারা আলাপ করে নেন ঢাকা শহরের গণবাহিনীর প্রধান আনোয়ারের সঙ্গেও। প্রয়োজনে দূতাবাসের কাউকে জিম্মি করার এমন পরিকল্পনা সুইসাইড স্কোয়াডের আগেই ছিল। বাহারের নেতৃত্বে প্রস্তুত হয় আত্মঘাতী ছয় জনের ঐ দল। সিদ্ধান্ত নেন নিজের জীবনের বিনিময়ে মুক্ত করবেন তার ভাই, তার সহযোদ্ধাদের।
আগেই নানা দূতাবাসের কিছু তথ্য সংগ্রহ করা ছিল তাদের। বিশেষত তারা প্রস্তুতি নিয়েছিলেন কখনো যদি কোনো রাষ্ট্রদুতকে জিম্মি করার প্রয়োজন হয় তাহলে তারা মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে জিম্মি করবেন। তখন বাংলাদেশে মার্কিন রাষ্ট্রদূত বোস্টার। তার ব্যাপারে এই স্কোয়াড অনেক তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন। বোস্টারের সব কর্মকাণ্ড তারা রেকি করে রেখেছিলেন। বোস্টারের বাসা ছিল ধানমণ্ডি মাঠের উল্টোদিকে। তারা লক্ষ করেছেন যে, প্রতিদিন ভোর পাঁচটায় ঘুম থেকে উঠেন বোস্টার। একঘণ্টা জগিং করেন। তারপর নাস্তা করে বের হন সকাল আটটায়। চলে আসেন আদমজী কোর্ট বিল্ডিং-এর অফিসে। বোস্টার কোনোদিন লিফট ব্যবহার করেন না। পুরো পাঁচতলা সিঁড়ি বেয়ে ওঠেন দ্রুত আমেরিকার রাষ্ট্রদূতকে জিম্মি করা অত্যন্ত সহজ ব্যাপার তাদের জন্য কারণ তার যাবতীয় গতিবিধি দেয় নখদর্পণে। কিন্তু শেষ মুহূর্তে সিদ্ধান্ত পাল্টান তারা। জাসদের ব্যাপার তখন একটি মহলের ব্যাপক প্রচারণা ছিল যে, তারা ভারতীয় এজেন্ট। এ ধারণা খণ্ডাবার জন্য তারা সিদ্ধান্ত নেন ভারতীয় রাষ্ট্রদূতকেই তারা জিম্মি করবেন।
তাহের গ্রেফতার হয়েছেন ২৪ নভেম্বর, তারা সিদ্ধান্ত নেন ২৬ নভেম্বরই অপারেশনে যাবেন। দেরি করবার সুযোগ তাদের নেই। মাঝখানের একটি দিন তারা রাখেন ভারতীয় রাষ্ট্রদূতের ব্যাপারে রেকি করতে। রেকির জন্য মোটেও তা পর্যাপ্ত সময় নয়। রেকিংয়ের নিয়ম অনুযায়ী প্রথমে দলের সদস্যদের ইন্ডিভিজুয়াল রেকি, তারপর টোটাল রেকি এবং শেষে সামিং আপ হবার কথা। কিন্তু হাতে যথেষ্ট সময় নেই তাদের। ভারতীয় রাষ্ট্রদূত তখন সমর সেন। তার বিষয়ে ভালো তথ্য ছিল না তাদের কাছে। দলের মধ্যে শুধু বাচ্চুর কিছুটা ধারণা ছিল ভারতীয় দূতাবাস এবং রাষ্ট্রদূত সম্পর্কে। এছাড়াও ২৫ তারিখ বেলাল এবং বাহার দুজনই সাধারণ সাক্ষাতপ্রার্থী হিসেবে ঘুরে আসেন ভারতীয় দূতাবাস। দূতাবাসের রিসেপশনে বাহার বলেন কজন বন্ধু মিলে পায়ে হেঁটে ভারত হয়ে বিশ্বভ্রমণে বের হতে চান তারা, এবিষয়ে সংশ্লিষ্ট কারো সঙ্গে কথা বলবার জন্য পরদিন সকাল দশটায় একটি অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেন। এ সুযোগে দূতাবাসের বিভিন্ন অবস্থান এবং সমর সেনের গতিবিধিও পরীক্ষা করে নেন তারা।
নিজেদের দেখা এবং অন্যান্য কয়েকটি সূত্র থেকে যে তথ্য তারা পেয়েছেন তাতে তারা জেনেছেন সমর সেনের সঙ্গে নিয়মিত ৪ জন সিকিউরিটি থাকে। ঐ চারজন একটা জীপে সবসময় তার গাড়ির পেছন পেছন স্কর্ট করে আসে। সমর সেন মাঝে মাঝে তার গুলশানের বাসা থেকে মেয়েকে নিয়ে বের হন এবং তাকে ড্রপ করে গাড়ি মেয়েকে নিয়ে স্কুলে চলে যায়। এই চারজন বিশেষ নিরাপত্তা পুলিশ ছাড়াও ভারতীয় দূতাবাসের গেটের বাইরে পাহারায় থাকে বাংলাদেশের পুলিশ এবং ভেতরে ভারতীয় পুলিশ। সবুজ বলেন অফিসে আসার পথেই তাকে কিডন্যাপ করলে বোধহয় ভালো হবে। বাহার বলেন, কিন্তু জিম্মি করার পর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ইন্ডিয়ান গভর্নমেন্টকে জানানো প্রয়োজন যে, তাদের হাইকমিশনার কিডন্যাপড হয়েছে। তাতে সাথে সাথেই তারা বাংলাদেশ গভর্নমেন্টকে প্রেসারাইজ করতে শুরু করবে। সুতরাং অফিসে কিডন্যাপ করলে তাড়াতাড়ি কমিউনিকেট করা যাবে, ইন্ডিয়ান আর বাংলাদেশ দুই গভর্নমেন্টের সাথেই। তাছাড়া রাস্তা থেকে কিডন্যাপ করে কোনো বাড়িতে নিয়ে উঠালে গভর্নমেন্ট কি করবে জানো? রেসকিউয়ের নামে পুরা বাড়ি ঘেরাও করে সমর সেন সুদ্ধ আমাদের সবাইরে মেরে ফেলবে। তারপর বলবে কিডনাপাররাই হাইকমিশনারকে মারছে। আমাদের কোনো অবজেকটিভই ফুলফিল হবে না।
সুতরাং দূতাবাস আক্রমণ করাই সবদিক থেকে ঠিক হবে বলে তারা সিদ্ধান্তু নেন। জিম্মি করার পর যে দাবিনামা তারা পেশ করবেন সেটিও চূড়ান্ত করে নেন :
এক, তাহেরসহ জাসদের সব বন্দিদের অবিলম্বে মুক্তি। তারা মুক্ত হয়ে নিরাপদ স্থানে যাবার পরই ধরে নেওয়া হবে দাবি মানা হয়েছে।
দুই, পর্যায়ক্রমে সৈনিকদের ১২ দফা মানার অঙ্গীকার।
তিন, অন্য সব রাজবন্দির মুক্তি।
চার, নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা।
পাঁচ, বাংলাদেশের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপকারী আমেরিকা এবং ভারতের দূতাবাস সাময়িক বন্ধ ঘোষণা।
আর এই জিম্মির অজুহাতে ভারত কোনো রকম হস্তক্ষেপ করার চেষ্টা করলে তৎক্ষণাত সমর সেনকে হত্যা করা হবে।
২৬ নভেম্বর সকাল সাড়ে নটায় ছয় জনের দলটি পৌঁছান ধানমণ্ডি ভারতীয় দূতাবাসে। স্কোয়াডের কমান্ডার বাহার। দুটো দলে তারা ভাগ করেন নিজেদের। এক দলে বেলাল, বাহার আর সবুজ অন্য দলে আসাদ, বাচ্চু ও মাসুদ। জার্মান কালচারাল সেন্টারের কাছে প্রথম দলটি আর অন্য দলটি ভিসা অফিসের সামনে। তাদের সবার কাছে লুকানো রিভলভার, মাস্ক, কর্ড নাইলন রোপ আর ছুড়ি। আর দাবি দাওয়াসহ রেডিওতে প্রচারের জন্য একটি ভাষণের কপি। দুর্ধর্ষ এক অভিযানের দ্বারপ্রান্তে তারা, হয় জয়, নয়তো মৃত্যু। বাংলাদেশের ইতিহাসে অভূতপূর্ব এই সুইসাইড অপারেশনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাহেরের সবচেয়ে ছোট ভাই, অকুতো ভয় বাহার। অন্যতম সহযোগী আরেক ভাই বেলাল। সঙ্গে মরণের নেশায় পাওয়া চার টগবগে তরুণ।
সকাল পৌনে দশটার দিকে তারা দেখতে পান সমর সেনের গাড়িটি আসছে। সমর সেনের গাড়িটি ঢুকবার আগেই বেলাল, বাহার আর সবুজের প্রথম দলটি ঢুকে যান দূতাবাস চত্বরের ভেতরে। সবাই পরিপাটি পোশাক পরা। রিসেপশন রুমের সামনে গিয়ে দাঁড়ান তিনজন। সমর সেনের গাড়ি এসে পোর্টিকোতে দাঁড়ায়। পেছনের জীপটিও আসে। জীপ থেকে চার জন সিকিউরিটি নামে। সমর সেনের গাড়ি এবং জীপের পেছন পেছন সুইসাইড স্কোয়াডের দ্বিতীয় দল আসাদ, বাচ্চু ও মাসুদ ঢোকে। সমর সেন গাড়ি থেকে নামেন। তার পেছনে গিয়ে দাঁড়ায় সিকিউরিটি চার জন। তাদের কাঁধে ইন্ডিয়ান এসএমজি আর দুটো করে ম্যাগাজিন। সমর সেন দু ধাপ সিঁড়িতে উঠেন। ঠিক এইসময় আচমকা বেলাল গিয়ে জাপটে ধরেন সমর সেনকে এবং তার অস্ত্র বের করেন। বেলাল চিৎকার করে বলেন: মি. সেন টেল ইওর যেন নট টু ফায়ার, আদারওয়াইজ, আই শ্যাল কিল ইউ। ইউ আর আওয়ার হস্টেজ। বেলাল কথাগুলো প্রথমে ইংরেজিতে, তারপর হিন্দিতে এবং সবশেষে বাংলায় বলেন।
বাহার অস্ত্র বের করে সমর সেনের চার জন বডিগার্ডকে আত্মসমর্পণ করতে বলেন। স্কোয়াডের বাকিরাও তাদের সঙ্গে অস্ত্র বের করেন। সমর সেনের বডিগার্ডরা বিনা প্রতিরোধে আত্মসমর্পণ করে। এসময় সবুজ এসে সমর সেনের একটি হাত ধরেন, অন্য হাত ধরেন বেলাল। বাহার রিভলভার হাতে সমর সেনের পেছনে গিয়ে দাঁড়ান। এ অবস্থায় সমর সেনকে ধরে তারা দোতলায় তার অফিসরুমের দিকে যাবার জন্য সিঁড়ি দিয়ে উঠতে থাকেন। সিঁড়ির মাঝামাঝি পর্যায়ে এসে উপরে উঠবার জন্য তারা একটি বাঁক নিতে যাবেন এসময় হঠাৎ ভেতরের প্যাসেজ থেকে শুরু হয় ফায়ার। এটি ছিল হাইকমিশনারের নিরাপত্তারক্ষাকারী গোপন অতিরিক্ত দল। এর খবর সুইসাইড স্কোয়াডের কারো জানা ছিল না।
প্রথম গুলিটি লাগে বাহারের। গুলি খেয়ে সিঁড়ি দিয়ে গড়িয়ে পড়তে থাকেন বাহার। পড়তে পড়তেই তিনি চিৎকার করে দলের সদস্যদের বলেন : সময় সেনরে গুলি কইরোনা কিন্তু।
তারা আগেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন একেবারে অপরাগ না হলে সমর সেনকে সহজে গুলি করবেন না তারা। এতে করে ভারতীয় বাহিনী বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের একটি অজুহাত পেয়ে যেতে পারে। সিঁড়ির উপরই নিথর হয়ে যায় বাহারের দেহ। আচমকা লাগাতার গুলিবর্ষণে বাহারসহ ঘটনাস্থলে প্রাণ হারান হারুন, মাসুদ, বাচ্চু। গুলি লাগে সমর সেনের এবং সুইসাইড স্কোয়াডের বাকি দুই সদস্য বেলাল আর সবুজেরও।
এসময় দুজন ভারতীয় নিরাপত্তাকর্মীকে জড়িয়ে ধরে তাদের ঢাল হিসেব ব্যবহার করেন বেলাল এবং সবুজ। এরপর তারা আত্মসমর্পণ করেন বাংলাদেশ পুলিশের কাছে। কিছুক্ষণের মধ্যে সেখানে এসে পৌঁছান ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের সিজিএস ব্রিগেডিয়ার মঞ্জুর। যে মঞ্জুর তাহেরের সঙ্গে পালিয়ে এসেছিলেন পাকিস্তান থেকে। বেলালকে চিনতে পারেন তিনি। বেলালু এবং সবুজকে নিয়ে যাওয়া হয় সিএমএইচে চিকিৎসার জন্য এবং সেখান থেকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় জেলে। করুণ পরিসমাপ্তি ঘটে এদেশের ইতিহাসে অনন্য এক দুঃসাহসিক অভিযানের।
সুইসাইড স্কোয়াডের মৃত চার সদস্যদের নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা মেডিকেলের মর্গে। দ্রুতই ঘটনার খবর পেয়ে যান আনোয়ার। তার ভাই আর মৃত সহযোদ্ধাদের দেখবার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠেন তিনি। মর্গের দিকে রওনা দেন। কিন্তু গোয়েন্দা তখন তাকে খুঁজছে। আনোয়ার রাতে মেডিকেল কলেজের কিছু ছাত্রের সহায়তায় এ্যাপ্রোন পরে মেডিকেল ছাত্র সেজে চলে যান মর্গে। ডোম একটি ঘর খুলে দিলে আনোয়ার দেখতে পান মেঝেতে পড়ে আছে তার চার অকুতভয় শহীদ সাথী। তাদের মধ্যে একজন তার ভাই বাহার। যে বাহার যুদ্ধের সময় বাড়িতে আশ্রয় নেওয়া তরুণীদের মুগ্ধ চোখের সামনে দিয়ে রাইফেল কাঁধে নিয়ে চলে যেত অপারেশনে। সাতই নভেম্বর ঢাকার রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে মাইকে ভেসে উঠেছিল যার কণ্ঠ … ষড়যন্ত্রকারীদের উৎখাত করে বিপ্লবী অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছে… আনোয়ার দেখে মর্গে নিষ্পাপ মুখে শুয়ে আছে সে, যেন ঘুমিয়েছে কেবল।
এর কদিন পরই বিপ্লবী সৈনিক সংস্থারই এক সদস্য, বিমানবাহিনীর কর্পোরাল ফখরুল আলম, যিনি গোয়েন্দাদের চর হয়ে ঢুকেছিলেন সংস্থায় এক প্রতারণার ফাঁদ পেতে পুলিশের হাতে ধরিয়ে দেন আনোয়ারকে, তার সাথে বন্দি হন গণবাহিনীর স্পেশাল স্কোয়াডের সদস্য মুশতাক আর গিয়াস। এই কর্পোরাল ফখরুল আলমই পরে হন মামলার রাজসাক্ষী।
১১৪. লৌহকপাট
তাহের এবং তার সবকটি ভাই একে একে গ্রেফতার হয়ে নিক্ষিপ্ত হন কারাগারে। একই পরিধিতে তারা একে অপরের কাছাকাছি। যেমন তারা সবাই ৭ নভেম্বরের সিপাই বিপ্লবের কর্মকাণ্ডে ছিলেন একই পরিধিতে, কাছাকাছি। যেমন তারা সবাই ১১ নম্বর সেক্টরের রণাঙ্গনেও ছিলেন একই পরিধিতে, কাছাকাছি। সহোদরদের এ এক বিরল যৌথ জীবন।
বন্দি করার পর তাহের, ইনু, ইউসুফকে কিছুদিন এক সঙ্গে রাখা হয় ঢাকা কারাগারের ৮ নং সেলে। এটি কনডেম সেল নামে বিখ্যাত, যা ফাঁসির আসামিদের জন্য নির্ধারিত। সেখানেই তারা ভারতীয় দূতাবাসের ট্র্যাজিডির কথা শুনতে পান। বাহারের আত্মহুতি আবেগাক্রান্ত করে তোলে তাহেরকে। নিজের ভাইয়ের জন্য, বিপ্লবী সহযোদ্ধাদের জন্য এতটা ভালোবাসা, এতটা সাহস মজুদ রেখেছিল তার এই দুরন্ত ভাইটি ভেবে বিষণ্ণ হয়ে পড়েন তাহের। বলেন : আমাদের কঠিন দুঃসময় এখন। প্রতিটি জীবন আমাদের সম্পদ। ভেবেচিন্তে এগুতে হবে আমাদের। এই অপারেশনের সিদ্ধান্তটা বোধ হয় ঠিক হয়নি।
কিছুদিন পর বন্দি জাসদ নেতাদের একেকজনকে একেক জেলে স্থানান্তর করা হয়। হেলিকপ্টারে করে তাহেরকে পাঠানো হয় রাজশাহী জেলে। ইমুকে সিলেটে। তাহেরের অন্য ভাইদেরও বিভিন্ন জেলে। কেবল সাঈদ তখনও ফেরারি হয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।
লুৎফার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই তাহেরের। পরিবারজুড়ে আতঙ্ক, অনিশ্চিয়তা। লুৎফা দিনের পর দিন কারা কর্তৃপক্ষের কাছে ধর্ণা দেন, খোঁজ চান তাহেরের, দেখা করতে চান তার সঙ্গে। কিন্তু জেল কর্তৃপক্ষ কিছুই জানান না।
দূরে দেখা আলোর শিখার দিকে একটা ঘোর লাগা পতঙ্গের মতো ছুটে চলছিলেন তাহের। স্থির হবার সময় ছিল না এক মুহূর্ত। একটার পর একটা লক্ষ্য ডিঙ্গিয়ে তাহের ছুটে চলেছিলেন তার চূড়ান্ত লক্ষ্যের দিকে। কিন্তু এই জেল জীবন যেন হঠাৎ স্তব্ধ করে দেয় তাকে। থামিয়ে দেয় তার চলার পথ। সমস্ত পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে, তাকে যেন দাঁড় করিয়ে দেয় তার নিজের মুখোমুখি। এমন নিরবচ্ছিন্ন, কর্মহীন জীবন কখনো ছিল না তার। জেলের ছোট্ট সেলে শুয়ে, বসে, পায়চারী করে নিজের সঙ্গে বোঝাঁপড়া করেন তাহের। সময় কাটাতে জেলের লাইব্রেরী থেকে বই এনে পড়েন। আর বসে বসে চিঠি লেখেন সবাইকে। প্রতিটি চিঠি জেল কর্তৃপক্ষ পরীক্ষা করে সিল দেন Cencored and Passed, তারপরই কেবল সেই চিঠি যায় জেলের বাইরে। কখনো কখনো চিঠির কিছু অংশ কালি দিয়ে ঢেকে দেন কর্তৃপক্ষ। নিরীহ, আটপৌড়ে কথাই লিখতে হয় তাকে। লুৎফাকে লেখেন …এখানে বন্দি হয়ে থাকা ছাড়া আর কোনো সমস্যা নাই। একেবারে অলস দিন কাটচ্ছি। কারো সাথে কথা বলবার নেই, কিছু করবার নেই। এখানকার লাইব্রেরীটা বাজে। বই সব প্রায় পড়ে শেষ করে ফেলেছি। তোমাকে যদি আমার সঙ্গে দেখা করতে দেয় তাহলে অবশই প্রচুর বই আনবে। এখানকার আবহাওয়া অদ্ভুত। সকালে খুব শীত তো দুপুরে প্রচণ্ড গরম।
মাকে লেখেন …আমি ভালো আছি, চিন্তা করবেন না। আর গুজবে কান দেবেন না …। তাহেরকে নিয়ে অনেক সত্য-মিথ্যা কথা হয়তো কানে আসছে তার মায়ের, তাই আশ্বস্ত করছেন তাকে।
রাজশাহী জেল থেকে পাওয়া চিঠির মাধ্যমেই লুৎফা প্রথম খোঁজ পান তাহেরের। মনে খানিকটা স্বস্তি এলেও দুশ্চিন্তা যায় না লুৎফার। তাহেরের সঙ্গে দেখা করবার অনুমতির জন্য হন্যে হয়ে ঘোরেন নানা জনের কাছে। অনুমতি মেলে না।
সব ভাইরা যখন জেলে বন্দি, সাঈদ কেবল নানা প্রান্তে ঘুরে বেড়ান ফেরারি হয়ে। তার নেতা ভাই তাহেরের জন্য মন ভেঙ্গে আসে তার। আত্মগোপনে থেকে বন্ধুকে বলেন : তাহের ভাই খালি কয় মানুষরে বিশ্বাস করো, বিশ্বাস করো, ঐ বিশ্বাসই তার কাল হইলো। জিয়ারে বিশ্বাস করল উনি, সিরাজুল আলম খানরে বিশ্বাস করল। আমি তারে সাবধান করছিলাম বারবার। এঙ্গেলসের একটা কথা পড়ছিলাম বহু আগে-যুদ্ধের মতো অভ্যুত্থানও একটা আর্ট, অভ্যুত্থান নিয়া খেলা কইরো না।
১১৫. গোপন বিচার
১৯৭৬-এর জুনে দেশের নানা জেলে ছড়িয়ে থাকা জাসদ এবং সৈনিক সংস্থার বন্দিদের একে একে আবার আনা হয় ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে। এসময় পত্রিকায় খবর বেরোয়, বিশেষ সামরিক আইন ট্রাইবুনাল গঠিত হয়েছে এবং এই ট্রাইবুনালকে সাধারণ আইনের বিরুদ্ধে অপরাধ, সশস্ত্র বাহিনীর বিরুদ্ধে অপরাধ, সামরিক আইনের বিরুদ্ধ অপরাধ সব ক্ষেত্রেরই বিচারের এক্তিয়ার দেওয়া হয়েছে। বন্দিরা টের পান একটা বিচারের মুখোমুখি করবার জনাই তাদেরকে জড়ো করা হচ্ছে।
বিশেষ সামরিক আইন ট্রাইবুনালের প্রধান নিয়োগে জটিলতা দেখা দেয় কারণ কোনো মুক্তিযোদ্ধা সামরিক অফিসার এই ট্রাইবুনালের প্রধান হতে অস্বীকৃতি জানান। শেষে ট্রাইবুনালের চেয়ারম্যান করা হয় কর্নেল ইউসুফ হায়দারকে। যিনি বাঙালি হলেও মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হয়ে চাকরি করেছেন। এই ট্রাইবুনালের সদস্য করা হয় দুজন সামরিক অফিসার এবং দুজন প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেটকে। প্রচলিত রীতিতে মার্শাল ল কোর্টে বিচার বিভাগ থেকে সেশন জজ, অতিরিক্ত সেশন জজ প্রমুখদের বিচারক হিসেবে নেওয়া হলেও এই ট্রাইবুনালে তেমন কোনো নিশানা দেখা যায় না। সেই সঙ্গে জারি করা হয় আশ্চর্য এক অধ্যাদেশ। যে অধ্যাদেশে বলা হয় এই ট্রাইবুনাল যে রায় দেবে তার বিরুদ্ধে কোনো রকম আপিল করা চলবেনা। বলা হয় বিচার চলবে রুদ্ধদ্বার কক্ষে এবং বিচার প্রক্রিয়া সম্পর্কে তথ্য প্রকাশ হবে শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
যেদিন ট্রাইবুনাল গঠনের অধ্যাদেশ পত্রিকায় ছাপা হয়েছে সেদিনই ট্রাইবুনালের চেয়ারম্যান ইউসুফ হায়দার সদলবলে জেল পরিদর্শনে আসেন। ডিআইজির ছোট রুমটিকেই রূপান্তরিত করা হয় একটি আদালতে। লোহার জাল দিয়ে ঘরটাকে দুভাগ করা হয়। অভিযুক্তদের বসার ব্যবস্থা করা হয় সেই লোহার খাঁচার ভিতর আর খাঁচার বাইরে আইনজ্ঞদের বসার স্থান। পাশাপাশি কোর্টের মতো করে ট্রাইবুনাল সদস্যদের বসার ব্যবস্থা। এরপর দিন সেনাবাহিনীর লোকদের জেলখানাকে ঘিরে ফেলতে দেখা যায়। জেলের ভেতরে সেনাবাহিনীর সশস্ত্র সদস্য থাকবার কোনো নিয়ম না থাকলেও জেলখানার গেটে, আশপাশের বাড়ির ছাদে এমনকি জেলের ভেতরেও ভারী মেশিনগান নিয়ে পাহাড়ায় বসে সিপাইরা।
একটা তাড়া, কঠোর গোপনীয়তা আর কড়া নিরাপত্তার তোড়জোড়। তাহের বুঝতে পারেন নিভৃতে, ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে তাদের ধ্বংস করবার পাঁয়তারা শুরু হয়েছে।
১৮ জুন ভোরে একে একে বিভিন্নি সেল থেকে সবাইকে জড়ো করা হয় জেলখানার ভেতরে ডিআইজির রুমে। জাসদ, গণবাহিনী, বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সদস্যরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিলো নানা জেলে, অনেকদিন পর পরস্পর মুখোমুখি হন তারা। ইউসুফ, বেলাল, জলিল, রব, ইনু, ড. আখলাক, মো. শাজাহান, মেজর জিয়াউদ্দীন, মান্না, হাবিলদার হাই প্রমুখেরা একে অন্যের সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন। ঘোষণা করা হয় অভিযুক্তদের নাম। সামরিক, বেসামরিক মিলিয়ে মোট বত্রিশজন অভিযুক্ত। অভিযুক্তরা তখনও স্পষ্টভাবে জানেন না কি অভিযোগ তাদের বিরুদ্ধে।
সবাই তাহেরকে খোঁজেন। তাকে দেখা যায় না। শোনা যায় তাহের এ মামলায় উপস্থিত হতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন।
অভিযুক্তদের পক্ষে মামলা লড়তে আসেন বাংলার এককালীন মুখ্যমন্ত্রী প্রবীণ আইনজীবী আতাউর রহমান খান, আইনজীবী জুলমত আলী খান, আমিনুল হক, আবদুর রউফ, অ্যাডভোকেট গাজীউল হক প্রমুখ।
আতাউর রহমান খান দেখা করেন তাহেরের সঙ্গে। তাহের উত্তেজিত হয়ে বলেন : কিসের মামলা? যে গভর্মেন্টকে আমি পাওয়ারে বসিয়েছি এত বড় সাহস যে তারা আমার বিরুদ্ধে মামলা করে?
আতাউর রহমান খান বলেন : সেটা ঠিক তাহের। কিন্তু এখন একটা প্রসেসের মধ্য দিয়ে যেতে হবে। আপনি আদালতে আসেন।
তাহের শেষে তার ক্রাচে শব্দ তুলে এসে হাজির হন আদালতে। তাহেরকে দেখে উৎফুল্ল হয়ে ওঠেন সবাই। নেতার সঙ্গে বুকে বুক মেলান সকলে। সবাইকে দেখে আনন্দিত হন তাহের। কিন্তু ভেতর ভেতর অত্যন্ত ক্রুব্ধ তিনি। বাকি সবার মনেই অনিশ্চয়তা আর ক্রোধ। বিরক্তি নিয়ে তাহের বসেন আসামিদের জন্য বরাদ্দ লোহার খাঁচার বেস্টনীতে।
আসামিদের বিরুদ্ধে দু ধরনের অভিযোগ আনা হয়, এক, সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্র, দুই সশস্ত্র বাহিনীকে বিদ্রোহে প্ররোচণা দান। মামলার কাগুজে নাম রাষ্ট্র বনাম মেজর জলিল গং। জাসদের সভাপতি হিসেবে মেজর জলিলের নামটিই আগে আসে কিন্তু সবাই জানেন যে মামলার আসল লক্ষ্য কর্নেল তাহের।
বিচারকাজ শুরু হবার আগে আইনজীবীদের শপথ করানো হয় যে ৭ বছর সময়ের মধ্যে এ বিচারের চূড়ান্ত গোপনীয়তা মানতে হবে এবং এ শপথ ভঙ্গ করলে হবে কঠিন শাস্তি।
নিয়মমাফিক প্রথমে এক এক করে আসামিদের হাজিরা। নাম ডাকবার সঙ্গে সঙ্গে এক এক করে উঠে দাঁড়াতে বলা হয়। শুধু ইউসুফের নাম ড্যকার পরও তিনি বসে থাকেন। তিনি বলেন : আমার নাম ঠিকমতো উচ্চারণ করা না হলে আমি উঠব না।
ট্রাইবুনাল সদস্য বলেন আপনার নাম আবু ইউসুফ, তাই তো ডাকা হয়েছে।
ইউসুফ বলেনঃ আমার সঠিক নাম আবু ইউসুফ বীরবিক্রম। যুদ্ধ করে এ খেতাব আমি অর্জন করেছি, কারো দয়ায় নয়, এটা আমার নামের অংশ।
বীরবিক্রম খেতাবসহ তার পুরো নাম ডাকলে ইউসুফ উঠে দাঁড়ান। অভিজাত ভঙ্গিতে একটি প্রতিবাদের দৃশ্যের অবতারণা করেন ইউসুফ।
এরপর রাজসাক্ষীদের আনা হয় আসামি চিহ্নিত করতে প্রধান রাজসাক্ষী কর্পোরাল ফখরুল যিনি আনোয়ারকে ধরিয়ে দিয়েছিলেন, বিপক্ষ দলের চর হিসেবেই বস্তুত তিনি কাজ করছিলেন বিপ্লবী সৈনিক সংস্থায়। এছাড়া হাবিলদার বারি যিনি অভ্যুত্থানের আগে আলোড়ন সৃষ্টিকারী লিফলেটটি লিখেছিলেন এবং সুবেদার মাহবুব যিনি অভূত্থান শুরুর প্রথম ফায়ারটি করেছিলেন। বারী এবং মাহবুব ভয়াবহ নির্যাতনের মুখে রাজসাক্ষী হতে বাধ্য হয়েছিলেন। রাজসাক্ষী হবার বিনিময়ে তারা পেয়েছিলেন মামলা থেকে মুক্তি এবং বিদেশে যাবার সুযোগ। বহু বছর পর জার্মান প্রবাসে গিয়ে একটি বই লেখেন মাহবুব, যে নির্যাতনের রাজসাক্ষী হয়েছিলেন তার রোমহর্ষক বর্ণনা দেন তিনি।
অভিযুক্তদের আইনজীবীরা রাজসাক্ষীদের লিখিত ভাষাগুলো দেখতে চান। কিন্তু রাজসাক্ষীদের সাক্ষ্য সরবরাহ করতে অস্বীকার করে কোর্ট। সরকারি এবং অভিযুক্তদের আইনজীবীদের মধ্যে শুরু হয় উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়। এক পর্যায়ে ক্ষিপ্ত হয়ে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ান তাহের। বলেন : আপনাদের ইচ্ছামতো একটা রায় লিখে দিলেই পারেন, আমাদের এখানে বসিয়ে রাখার তো প্রয়োজন নেই। আই রিফিউজ টু এটেন্ড দিস কোর্ট। এই বলে তাহের লোহার বেষ্টনী থেকে বেরিয়ে ক্রাচে শব্দ তুলে এগিয়ে যেতে থাকেন সামনে। অন্যরাও তখন তার পেছনে পেছনে উঠে গিয়ে স্লোগান দিতে দিতে বেরিয়ে যান আদালত থেকে। যাবার সময় অভিযুক্তদের মধ্যে কে একজন জুতা ছুঁড়ে মারেন ইফসুফ হায়দারের দিকে। ঘটনার আকস্মিকতায় অপ্রস্তুত হয়ে পড়েন বিচারকরা। আদালত মুলতবী ঘোষণা করা হয়।
প্রথম দিন অভিযোগ উত্থাপনের পর মামলা মুলতবী রাখা হয় আট দিন। যদিও সরকার কয়েক মাস ধরে এ মামলা সাজিয়েছে, কিন্তু আসামিদের মামলার কাগজপত্র সাজানো এবং আত্মপক্ষ সমর্থনের সময় দেওয়া হয় এই আট দিনই। আট দিন পর আবার অভিযুক্তদের আনা হয় আদালতে। এবার তাদের আনা হয় খালি পায়ে এবং হাতে হাত কড়া পরিয়ে, যাতে জুতা ছোঁড়ার মতো কোনো ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে। এমনকি প্রথমবারের মতো কোনো নাটকীয়তা যাতে তৈরি না হয় সেজন্য আসামিদের লোহার খাঁচার ভেতর বসিয়ে তালা দিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয় এবার। যেন ক্ষিপ্র কতকগুলো জন্তুকে আটকে রাখবার চেষ্টা চলছে।
সাংবাদিক লিফশুলৎজ তখনও ঢাকায়। তাহের এবং তার সঙ্গীদের যেদিন দ্বিতীয় দফা বিচার কাজ শুরু হয় সেদিন এই ট্রাইবুনালের সদস্যদের সাথে কথা বলবার ইচ্ছা নিয়ে লিফশুলৎজ ঢাকা সেন্ট্রাল জেলের গেটে গিয়ে দাঁড়ান। অনেক উঁচু, রংচটা, হলুদ বিবর্ণ দেয়ালের ভেতর তখন এ অঞ্চলের ইতিহাসে বিরল এক বিচারের প্রস্তুতি চলছে। মামলার পোশাক পড়া আইনজীবীরা জেল গেট দিয়ে ঢোকেন আর বন্ধ হয়ে যায় ভারী গেট। লিফশুলৎজ ইউসুফ হায়দারসহ দু একজন ট্রাইবুনাল সদস্যদের ছবি তোলেন। পুলিশ এসে বাধা দেন ছবি তুলতে। বলেন : এ মামলার কাজ রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তার অন্তর্ভুক্ত আপনি ছবি তুলতে পারবেন না।
লিফশুলৎজ বলেন : আমি এক বছর ধরে বাংলাদেশে সাংবাদিকতা করছি কখনো তো এমন নিয়মের কথা শুনিনি। আমাকে তথ্য মন্ত্রণালয়ের লিখিত নির্দেশ না দেখালে আমি এখান থেকে সরছি না। এটা সাংবাদিক হিসেব আমার দায়িত্ব।
এরপর লিফশুলৎজকে পুলিশ গ্রেফতার করে জেলের ভেতরে নিয়ে যান। পুলিশ তার কাছ থেকে ছবিগুলো চান কিন্তু লিফশুলৎজ দিতে অস্বীকার করেন। পুলিশ কর্মকর্তা তখন এনএসআই এবং আর্মি হেডকোয়ার্টারে ফোন করেন।
কিছুক্ষণ পরই আর্মি হেডকোয়ার্টার থেকে কয়েকজন অফিসার এসে জেরা শুরু করেন লিফশুলৎজকে। তারা জিজ্ঞাসা করেন : এ মামলা নিয়ে আপনার এত আগ্রহ কেন?
লিফশুলৎজ বলেন : গোপন রাজনৈতিক বিচার সেটা স্ট্যালিন, ফ্রাঙ্কো, জিয়া যেই করুন না কেন আমি সমানভাবে আগ্রহী।
একজন আর্মি অফিসার তখন তার ক্যামেরাটি কেড়ে নেন, ফিল্মগুলো খুলে ফেলেন। লিফশুলৎজকে কিছুদিন নজরবন্দি করে রাখার পর দেশ থেকে বহিস্কার করা হয়।
মামলা শুরু হলে অভিযুক্তদের আইনজীবীরা ট্রাইবুনালের অভিযোগগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে এক এক করে খণ্ডন করতে শুরু করেন।
আসামিদের বিরুদ্ধে প্রথম অভিযোগ বৈধ সরকারকে উৎখাতের অপচেষ্টা। তারা প্রশ্ন তোলেন কোন বৈধ সরকারের কথা বলা হচ্ছে এখানে? প্রথমত বৈধ সরকার ছিল শেখ মুজিবের, তাকে উচ্ছেদ করেছেন মোশতাক সরকার, দ্বিতীয়ত, মোশতাক সরকারকে উচ্ছেদ করেছেন খালেদ মোশারফ। কিন্তু খালেদ মোশারফ তো কোনো সরকারই গঠন করেননি। তিনি নিজে তো কোনো সরকার প্রধান ছিলেন না। তারা প্রশ্ন তোলেন ১৯৭৫ সালে ৩ নভেম্বরর থেকে ৭ নভেম্বর পর্যন্ত দেশে কি কার্যত কোনো সরকার ছিল? যদি থাকে তাহলে কে ছিলেন সে সরকার প্রধান? দেশের প্রেসিডেন্ট তখন বিচারপতি সায়েম, যাকে নিয়োগ দিয়েছিলেন খালেদ মোশারফ। জেনারেল জিয়া এবং কর্নেল তাহের উভয়েই সিপাই অভ্যুত্থানের পর বিচারপতি সায়েমকেই প্রেসিডেন্ট হিসেবে বহাল রাখলেন। তাহলে উৎখাত হলো কে? আর এটি যদি অবৈধ সরকারই হয় তাহলে জিয়া ৭ নভেম্বরের এই দিনটিকে বিপ্লব দিবস হিসেবেই বা পালন করছেন কেন? অভিযোগের এই অসংখ্য স্ববিরোধিতা তুলে ধরলেও সরকার পক্ষ থাকেন নীরব।
দ্বিতীয় অভিযোগটি গোলমেলে। অভিযোগ করা হয়েছে সেনাবাহিনীতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির। অভিযুক্তদের আইনজীবী আদালতকে স্মরণ করিয়ে দেন, ভুলে যাবেন না তাহেরের নেতৃত্বে সাতই নভেম্বরের অভ্যুত্থানের মাধ্যমেই বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয়েছিলেন জিয়া এবং জেনারেল জিয়াই তাহেরকে এরকম একটি উদ্যোগ দিতে অনুরোধ করেছিলেন। সর্বোপরি এও ভুলে গেলে চলবে না যে এই অভ্যুত্থানের, তথাকথিত বিশৃঙ্খলার সম্পূর্ণ বেনিফিসিয়ারি জেনারেল জিয়া এবং আমাদের স্মরণ রাখতে হবে জেনারেল জিয়াই এই দিনটিকে ঘোষণা করেছেন সংহতি দিবস হিসেবে। বলেছেন এই দিনে সেনাবাহিনী এবং জনগণ দেশের সার্বভৌমত্ব সংহত করেছে। তাহলে প্রশ্ন জাগে একই দিনে বিশৃঙ্খলা আর সংহতি হয় কি করে? এ বড় অদ্ভুত, অসাড় অভিযোগ।
আইনজীবীরা প্রশ্ন তোলেন সাতই নভেম্বর যদি সেনাবাহিনীতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির বিচারযোগ্য উদাহরণ হয়ে থাকে তাহলে ১৫ আগস্টে ফারুক, রশীদ প্রমুখেরা সেনাবাহিনীতে চূড়ান্ত বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে বিচারের সম্মুখীন না হয়ে কি করেই বা বিদেশে উচ্চপদের কূটনৈতিক চাকরি করছেন?
এই মামলার এমনি সব অসংখ্য স্ববিরোধিতা আর অযৌক্তিকতা তুলে ধরলেও আদালত সেগুলো গ্রাহ্য করে না। আদালতে দাঁড়িয়ে রাজসাক্ষীরাও নানা গোজামিল বক্তব্য দিতে থাকেন। কর্পোরাল ফখরুল এক পর্যায়ে বলেন যে তিনি কর্নেল তাহেরকে দেখেছেন ড. আখলাকের বাসা থেকে ভাতীয় সেনা কর্মকর্তা ভোরার সাথে ফোনে কথা বলতে। অথচ ড. আখলাক জানান তার বাসায় কোনোদিন কোনো ফোনই ছিল না। রাজসাক্ষীদের বক্তব্যের সত্যতা যাচাই করার জন্য নিয়মমাফিক নিরপেক্ষ প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্য গ্রহণের দাবি জানান অভিযুক্তের আইনজীবীরা। কিন্তু সে নিয়মও পালন করা হয় না।
এটি যে নেহাত একটি প্রহসনের বিচার আসামিদের তা আর বুঝতে বাকি থাকে না। ফলে এক পর্যায়ে বন্দিরা সবাই মিলে আদালতকে নানাভাবে অসহযোগিতা করার সিদ্ধান্ত নেন। বিচার কাজ চলার সময় তারা নিজেদের মধ্যে আলাপ চালিয়ে যান। কেউ কেউ বিচারকদের দিকে পা তুলে বসে থাকেন। আ স ম আবদুর রব একদিন বিচারকদের উদ্দেশে বলেন : মনে রাখবেন আপনারা মরলেও কবর থেকে তুলে আপনাদের চাবকানো হবে।
বাতিস্তা সরকার ঠিক এমনিভাবে একসময় যখন কিউবার বিপ্লবের নেতা ফিদেল ক্যাস্ট্রোর গোপন বিচার করছিল তখন কাস্ট্রো তার বিচারকদের আহ্বান জানিয়েছিলেন এই ষড়যন্ত্র থেকে বেরিয়ে এসে জনগণের পক্ষে দাঁড়াতে। তাহেরও একদিন তাদের ট্রাইবুনালের বিচারকদেরও বাতিস্তার সেই বিচারের কথা স্মরণ করিয়ে দেন। বলেন : চাকরির দায়ে ষড়যন্ত্রের তাবেদারী করছেন, এখনও সময় আছে সত্যের পক্ষে এসে দাঁড়ান। নইলে ইতিহাস আপনাদের ক্ষমা করবে না।
বলাবাহুল্য, তাতে কোনো কাজ হয় না। তাহের এক পর্যায়ে ক্ষিপ্ত হয়ে বলেন : মামলা যদি করতেই চান, তাহলে আমি জেনারেল জিয়া আর জেনারেল ওসমানীকে এই আদালতে দেখতে চাই। তারাই সাক্ষী দিক ঘটনার। তারা এসে দাঁড়াক আমাদের মুখোমুখি।
যথারীতি গ্রাহ্য করা হয় না এই প্রস্তাবও।
এক সাথে এতজন টগবগে, দুর্ধর্ষ বিপ্লবী ফাঁদে আটকা পড়ে তড়পাতে থাকেন। সুন্দরবনের বীরযোদ্ধা মেজর জিয়াউদ্দীন গলা ছেড়ে গাইতে থাকেন, শিকল পড়ার ছল মোদের এই শিকল পড়ার ছল। সবাই গলা মেলান তার সঙ্গে। আনোয়ার কোর্ট শেষে তার উদাত্তকণ্ঠে শুরু করে সুকান্তের কবিতার আবৃত্তি। তার কবিতা শোনার জন্য পুলিশ আর আর্মির লোকেরাও ভিড় জমায়। একমাত্র মহিলা আসামি জাসদকর্মী সালেহা নানা ঠাট্টা, কৌতুক করে বিব্রত করে রাখেন কোর্টকে। আর মনের চাপা পড়া আবেগ মুক্ত করতে প্রায় সবাই লিখতে শুরু করেন কবিতা, পড়ে শোনান একে অন্যকে। কোর্টরুমের ঐ ছোট্ট বদ্ধ ঘরে প্রতিদিন যেন জন্ম নিতে থাকে অনেক সুকান্ত আর নজরুল।
১১৬. তেলাপিয়া মাছ
কারাগারের রুদ্ধ দেয়ালের ভেতর কি ঘটছে কিছুই জানে না বাইরের মানুষ। এ সংক্রান্ত কোনোরকম সংবাদ পরিবেশন নিষিদ্ধ। আসামিদের সঙ্গে বাইরের কারো দেখা সাক্ষাত, চিঠি পত্র আদান প্রদানও নিষিদ্ধ। তবু গোপনে আইনজীবীদের মাধ্যমে লুৎফাকে কখনো চিরকুট, কখনো ছোট চিঠি পাচার করতে সক্ষম হন তাহের।
একটি চিঠিতে লেখেন : কোর্ট শুরু হবার পর থেকে আমরা সবাই সারাদিন একসঙ্গে থাকতে পারি এটাই বর্তমানে বড় লাভ। এ কোর্টের বৃত্তান্ত যদি খবরের কাগজে বের হতো তাহলে আমাদেরকে এখন পর্যন্ত কেউ জেলে আটকে রাখতে পারত না। … এ কোর্টটি একটি আজব ব্যাপার। একে কোর্ট কোনো অর্থেই বলা চলে না। চেয়ারম্যানের আচরণ ও ব্যবহার থানার দারোগার মতো। আমরাও তার সঙ্গে সে রকম ব্যবহার করি। তারা তাদের কাজ করে আমরা আমাদের আলোচনা নিয়ে থাকি।… সাতই নভেম্বর আমি রক্তপাত ছাড়া যে পরিবর্তন আনতে চেয়েছিলাম, ধনিক শ্রেণী তা ব্যাহত করে তাদের জন্য একটি বৃহৎ রক্তপাতের ক্ষেত্র প্রস্তুত করছে।
লুৎফা তাহেরের চিঠির মাধ্যমে তাহেরের প্রতিদিনকার জেল জীবনের একটা চিত্রও পান। তাহের লেখেন :
ভোর চারটায় উঠে তোমাকে লিখছি, এতে তুমি নিশ্চয়ই খুব অবাক হয়ে যাবে। জেলখানায় এসে এটা একটা বড় পরিবর্তন। ভোর চারটায় ঘুম ভেঙ্গে যায়। শুয়ে থাকতে ভালো লাগে না। এ সময় লেখার কাজগুলো শেষ করি। চারটা থেকে সাতটা পর্যন্ত। তুমি তো জানো গ্রেফতারের পর থেকে আমাকে একলা রাখা হয়। ঢাকা জেলেও সে অবস্থা। নানাকাজে সাহায্য করার জন্য চার জন কয়েদি দেওয়া হয়েছে। জেলখানায় এরাই এখন আমার অনুগত অনুসারী। আমার প্রতি এদের যত্নের বাড়াবাড়ি অনেক সময় উপদ্রপ হয়ে ওঠে। ব্যক্তিগত কাজগুলি করে হালিম } ১৮ বছরের ছেলে। রাজনৈতিক দলের সদস্য। অস্ত্র আইনে দেড় বছরের সাজা হয়েছে। আমার বিছানা ছাড়ার সাথে সাথে সে উঠে বসবে। ৭টা পর্যন্ত তিন কাপ চা খাওয়া হয়ে যায়। ভোরের এই সময়টা ভালোই লাগে। ঢাকা জেলে কাক ছাড়া আর কোনো পাখি নেই! কাক ডাকা শুরু হয় ভোর পাঁচটা থেকে। জেল গেটের পাশেই উঁচু দেয়াল দিয়ে ঘিরে একটি বেশ বড় জায়গায় আমাকে রাখা হয়েছে। দুটো বড় বড় কামরা। বাথরুম কমোড় রয়েছে। ভাববে না। বেড়াবার জায়গাও আছে। বাগান রয়েছে। ঘরের বাইরের পানির ট্যাঙ্কে অনেক তেলাপিয়া মাছ ছেড়েছি। এদের জন্ম, জীবন, প্রেম ভালোবাসা, বংশবৃদ্ধি ও জীবন সংঘাত সম্বন্ধে বেশ বিজ্ঞ হয়ে উঠেছি।
জেলের চার দেয়ালের ভেতর নিঃসঙ্গ পঙ্গু যে মানুষটি তেলাপিয়া মাছের জীবনবৃত্তান্ত লক্ষ করছেন তাকে বরাবর একজন নিঃসঙ্গ অভিযাত্রী বলেই মনে হয়। একটি খেয়াল পোক যেন ভেতর থেকে তাকে ঠেলছে অবিরাম। কখনো একা, কখনো দলে সবার সামনে থেকে তিনি এগিয়ে গেছেন অরণ্যের সবচেয়ে অজানা, সবচেয়ে বিপদসংকুল পথটিতে। সেই পোকা তাকে ঠেলে দিচ্ছে ডাকাতের সামনে, হাজার মাইল পথ ঠেলে তাকে হাজির করছে রণাঙ্গনে, ঠেলে তাকে নিয়ে যাচ্ছে শত্ৰু বুহ্যের বিপজ্জনক গণ্ডির মধ্যে, ঠেলে দিচ্ছে এক বৃত্ত থেকে আরেক বৃত্তে, ঠেলে দিচ্ছে নিয়ম পাল্টে ফেলার অভিযানে, সে অভিযাত্রায় হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার মতো মোহাবিষ্ট করছেন তার ভাই বোন, স্ত্রী পরিজনকেও, যারা একটি ক্ষুদ্র মিছিলের মতো অরণ্যের বাঁকে বাঁকে অনুসরণ করে গেছেন তাকে। একটা স্থির লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে গেছেন, ঝুঁকি নিয়েছেন, বিশ্বাস করেছেন। পথে পথে সঙ্গী পেয়েছেন কিন্তু বার বার রয়ে গেছেন একাই। সেই খেয়াল পোকা তাকে ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে এসেছে এমন এক প্রান্তে যেখানে তিনি হয়ে উঠেছেন নিঃসঙ্গ থেকে নিঃসঙ্গতর। সেই একাকী অভিযাত্রী এখন গভীর মনোযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করছেন তেলাপিয়া মাছের জন্ম, জীবন, প্রেম ভালোবাসা, বংশবৃদ্ধি আর জীবন সংঘাত।
বন্দিরা ক্রমশ টের পান তাদের আবেদন, প্রতিবাদ কারাগারের চার দেয়ালের মধ্যেই প্রতিধ্বনি হচ্ছে শুধু। টের পান এক বিশাল চক্রান্তের ঘেরাটপে পড়ে গেছেন তারা। বুঝতে পারেন তাদের মুক্তির সম্ভাবনা ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হচ্ছে। কিন্তু তারা কি বেঁচে থাকবেন? স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র সজ্জিত বুটধারী প্রহরীরা খট খট শব্দ তুলে রাতের আলো আঁধারীতে বন্দিদের সেলগুলোর সামনে সেন্ট্রি ডিউটি দেয়। ঘুম আসে না কারো। একটা অজানা আশঙ্কায় স্তব্ধ হয়ে থাকেন সবাই।
একদিন জেল থেকে চিঠিতে লুৎফাকে লেখেন তাহের।
… মেজর জলিল আধ্যত্মিক জ্ঞান সমৃদ্ধ হচ্ছে। কয়দিন ধরে সে নাকি স্বপ্ন দেখছে–চারদিকে হাজার হাজার উৎসাহ সৈনিকের মাঝে সাদা হাতিতে চড়ে খাচ্ছি আমি। কিন্তু সাদা হাতি ব্ৰক্ষদেশ ছাড়া আর কোথাও তো পাওয়া যায় না। বিকল্প ব্যবস্থা অনুযায়ী হাতির গায়ে হয়তো সাদা কাপড় ব্যবহার করা যেতে পারে।
সাদা কাপড়ের অনুষঙ্গে বুকটা কেমন ছলকে ওঠে লুৎফার।
১১৭. জবানবন্দি
আসামিদের জেরা, সাক্ষ্য শেষ হয় এক পর্যায়ে। রায়ের আগে অভিযুক্তরা আদালতে তাদের জবানবন্দি দিতে চান। মঞ্জুর করা হয় আবেদন। কদিন ধরে এক এক করে জবানবন্দি দেন আনোয়ার, ইউসুফ, জলিল, ইনু, মান্না। তারা তাদের রাজনৈতিক আদর্শ, অভ্যুত্থানের তাদের ভূমিকা এবং এই ষড়যন্ত্রের মামলার ব্যাপারে তাদের ঘৃণার কথা জানান। সব শেষে জবানবন্দি দিতে উঠেন তাহের। সবচেয়ে দীর্ঘ জবানবন্দি দেন তিনি। ক্রাচ হাতে উঠে দাঁড়িয়ে তাহের বলতে শুরু করে—
আপনাদের সামনে দাঁড়ানো এই মানুষটি, যে মানুষটি আজ আদালতে অভিযুক্ত, সে একই মানুষ যে এই দেশের মুক্তি ও স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনার জন্য রক্ত দিয়েছিল, শরীরের ঘাম ঝরিয়েছিল, এমনকি নিজের জীবন পর্যন্ত পন করেছিল। সেসব আজ ইতিহাসের অধ্যায়। ইতিহাস সেই মানুষটির কর্মকাণ্ড আর কীর্তির মূল্যায়ন অতি অবশ্যই করবে। আমার সব কাজে, সমস্ত চিন্তায় আর স্বপ্নে এ দেশের কথা যেভাবে অনুভব করেছি সে কথা এখন এখানে দাঁড়িয়ে বোঝনো সম্ভব নয়।
অথচ ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস। যে সরকারকে আমিই ক্ষমতায় বসিয়েছি, যে ব্যক্তিটিকে আমিই জীবন দান করেছি তারাই আজ এই ট্রাইবুনালের মাধ্যমে আমার সামনে এসে হাজির হয়েছে। এদের ধৃষ্টতা এত বড় যে তারা রাষ্ট্রদ্রোহিতার মতো অনেক বানানো অভিযোগ নিয়ে আমার বিরুদ্ধে বিচারের ব্যবস্থা করেছে। আমার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে তার সবই বিদ্বেষপ্রসূত, ভিত্তিহীন, ষড়যন্ত্রমূলক, সম্পূর্ণ মিথ্যা। আমি সম্পূর্ণ নিরাপরাধ।
রেকর্ডকৃত দলিলপত্রে স্পষ্টতই দেখা যায় যে ১৯৭৫-এর ৬ ও ৭ নভেম্বর ঢাকা সেনানিবাসে আমার নেতৃত্বে সিপাই অভ্যুত্থান হয়। সেদিন এভাবেই একদল বিভ্রান্তকারীর ঘৃণ্য যড়যন্ত্র নির্মূল করা হয়। মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান বন্দিদশা থেকে মুক্তি পান আর দেশের সার্বভৌমত্ব থাকে অটুট। এই যদি হয় দেশদ্রোহিতার অর্থ তাহলে হাঁ, আমি দোষী। আমার দোষ আমি এদেশে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনেছি। এদেশের স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্ব রক্ষা করেছি। সেনাবাহিনী প্রধানকে বন্দি অবস্থা থেকে মুক্ত করেছি। সর্বোপরি বাংলাদেশের অস্তিত্বের প্রশ্নে মানুষের আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে এনেছি। সে দোষে আমি অবশ্যই দোষী।
এরপর তাহের তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলো খণ্ডন করার আগে দেশের রাজনৈতিক অতীত এবং তার ব্যক্তি জীবনের দীর্ঘ বর্ণনা দেন। তাহের তার আর্মিতে ঢোকার প্রেক্ষাপট বর্ণনা করেন, আর্মিতে কৃতিত্ব, পাকিস্তানি শাসক, বিশেষত আর্মিরা বাঙালিদের প্রতি যে চরম বৈষম্যমূলক আচরণ করত তার নানা উদাহরণ তুলে ধরেন। বলেন দীর্ঘদিন ধরে একটি স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্নে নিজেকে প্রস্তুত করার কথা। তাহের মুক্তিযুদ্ধের শুরুর দিনগুলোতে পাকিস্তানে তার বন্দিদশার কথা বর্ণনা করে। বলেন, পাকিস্তানের সিনিয়র বাঙালি অফিসাররা কিভাবে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার বদলে পাকিস্ত নিদের তাবেদারীতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। যাদের কেউ কেউ তখন ঐ কোর্ট কক্ষেও উপস্থিত।
ভাষণের এই পর্যায়ে ট্রাইবুনালের চেয়ারম্যান ইফসুফ হায়দার তাহেরকে বাধা দিয়ে বলেন, এখানে এ ধরনের কথা বলা যাবে না।
বলাবাহুল্য, ইউসুফ হায়দার পাকিস্তানিদের তাবেদারী করবার দলেরই একজন।
তাহের বলেন; আমার বক্তব্য রাখার সুযোগ না দিলে আমি বরং চুপ থাকাটাই ভালো মনে করব। এমন নিম্নমানের ট্রাইবুনালের সামনে আত্মপক্ষ সমর্থন করছি যে নিজের উপরই ঘৃণা হচ্ছে।
তাহেরের আইনজীবীদের সঙ্গে এ নিয়ে তখন ট্রাইবুনাল সদস্যদের বাকবিতণ্ডা শুরু হয়। এক পর্যায়ে তাহেরকে আবার বলতে সুযোগ দেওয়া হয়। এরপর তাহের পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে তার মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার প্রেক্ষাপট বর্ণনা করেন। তারপর মুক্তিযুদ্ধের প্রচলিত ধারার সঙ্গে তার বিরোধ, ১১ নং সেক্টরে তার নিজস্ব ধারার গেরিলা যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে দীর্ঘ বর্ণনা করে তাহের। তাহের স্বতঃস্ফূর্ত এবং স্থানীয় যুদ্ধ নায়কদের বর্ণনা করতে গিয়ে রৌমারীর সুবেদার আফতাবের কথা তোলেন। তাহের জানান কি করে আঠারো মাইল পথ হেঁটে তিনি কোদালকাঠিতে দেখা করতে গেছেন সুবেদার আফতাবের সঙ্গে। এখানে ট্রাইবুনালের চেয়ারম্যান ইউসুফ হায়দার আবার তাহেরকে থামিয়ে দিয়ে বলেন, এসব কথা এখানে প্রাসঙ্গিক নয়।
তাহের ক্ষুব্ধ হয়ে বলেন : এ কথাগুলো খুবই প্রাসঙ্গিক। আপনি তো যুদ্ধে ছিলেন না, মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে আপনার তো কোনো ধারণা থাকবার কথা নয়।
এই বলে তাহের আবার তার বক্তব্য শুরু করেন। তাহের যুদ্ধে তার রৌমারী, চিলমারী, কামালপুর আক্রমণের ঘটনা বর্ণনা করেন, বর্ণনা করেন যুদ্ধে তার পা হারানোর কথাও। তাহের তার সহঅভিযুক্ত সেক্টর কমান্ডার মেজর জলিলের বীরত্বের কথা বলেন, বলেন আসম আবদুর রবের কথাও। তাহের মুক্তিযুদ্ধে তার সবকটি ভাইবোন যে যোগ দিয়েছেন, যুদ্ধে কৃতিত্বের জন্য যে বীরত্বসূচক খেতাব পেয়েছেন সে কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেন। এই মামলায় তার অন্য ভাইদের অভিযুক্ত করা, মর্মান্তিক রাজনৈতিক দুর্ঘটনায় তার ভাই বাহারের মৃত্যুর কথা উল্লেখ করে তাহের বলেন, মনে হচ্ছে আমাদের পুরো পরিবারটিকে ধ্বংস করে দেবার ষড়যন্ত্র চলছে। এরপর তাহের স্বাধীনতার পরবর্তী প্রেক্ষাপটটি বর্ণনা করেন। মানুষের আশাভঙ্গ হওয়া, কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে তার ভিন্নধর্মী জনমুখী সেনাবাহিনী তৈরি, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে তার বিরোধের প্রেক্ষিতে সেনাবাহিনী থেকে পদত্যাগ এবং ড্রেজার সংস্থার চাকরিতে যোগ দেওয়ার ঘটনাবলি ব্যাখ্যা করেন।
এসময় ট্রাইবুনালের চেয়ারম্যান তাহেরকে বলেন, আপনার বক্তব্য অনেক দীর্ঘ হয়ে যাচ্ছে।
তাহের বলেন : জনাব চেয়ারম্যার এবং মামলার সম্মানিত সদস্যবৃন্দ, আমাকে সবকিছু বলতেই হবে।
এরপর বাংলাদেশের রাজনীতিতে শেখ মুজিবের শক্তি এবং ব্যর্থতার কথা তুলে ধরেন তাহের। খন্দকার মোশতাকের ষড়যন্ত্র এবং ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের প্রেক্ষাপট বর্ণনা করেন। মুজিব হত্যার পরবর্তী সময়টিকে একটি প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের হাত থেকে রক্ষা করার তার বিবিধ তৎপরতার কথা বর্ণনা করেন, বর্ণনা করেন সেনাবাহিনীতে উদ্ভূত বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির কথা এবং সেই সূত্রে ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থান আর তারই ধারাবাহিকতায় সিপাইদের বিপ্লবের প্রেক্ষিতটি।
ট্রাইবুনালের চেয়ারম্যান তাহেরকে আবার বলেন, আপনার বক্তব্য সংক্ষিপ্ত করুন।
তাহের বলেন : আমার যা বলা দরকার তা আপনাদের শুনতেই হবে। নয়তো আমি কোনো কথাই বলব না। এখনি ফাঁসি দেন না কেন, আমি ভয় পাই না। কিন্তু আমাকে বিরক্ত করবেন না। তাহের আবার বলতে শুরু করে।
৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থান, জিয়ার মুক্তি, তার পরবর্তী ঘটনাবলি এবং তাদের গ্রেফতারের প্রক্রিয়ার বিস্তারিত বর্ণনা দেন তাহের।
তাহের বলেন, জিয়া শুধু আমার সঙ্গেই নয়, বিপ্লবী সেনাদের সঙ্গে, সাত নভেম্বরের পবিত্র অঙ্গীকারের সঙ্গে, এক কথায় গোটা জাতির সঙ্গে বিশ্বাস ঘাতকতা করেছে। … আমাদের জাতির ইতিহাসে আর একটাই মাত্র এরকম বিশ্বাসঘাতকতার নজির রয়েছে, তা হচ্ছে মীর জাফরের।…
তাহেরকে এ পর্যায়ে আবার বাধা দেয়া হয়। তাকে বলা হয়, বক্তব্য সংক্ষেপ করার আশ্বাস না দিলে তাকে আর বক্তব্য পেশ করতেই দেওয়া হবে না। এই নিয়ে আবার কোর্টে বিতন্ত্র শুরু হয়ে যায়। তাহেরের পক্ষের আইনজীবী বলেন : অনুগ্রহ করে তাকে বক্তব্য দেওয়ার অনুমতি দিন। এই ট্রাইবুনালের অবশ্যই অধিকার আছে তাকে সেই সুযোগ না দেওয়ার কিন্তু তিনি প্রধান বিবাদি, যত বড়ই হোক না কেন বক্তব্য উপস্থাপন করে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ তাকে দিতেই হবে।
এরপর তাহের এক এক করে এই মামলার অযৌক্তিকতা এবং অসারতা তুলে ধরেন। তার বিরুদ্ধে আনা প্রতিটি অভিযোগ খণ্ডন করেন। তাহের আবারও মেজর জেনারেল : জিয়াউর রহমান, রিয়ার এডমিরাল এম এইচ খান, এয়ার ভাইস মার্শাল এ জি তোয়ব, জেনারেল ওসমানী, বিচারপতি সায়েমকে সাক্ষী হিসেবে কোর্টে আনতে অনুরোধ করেন। তাহের বলেন তিনি দেখতে চান এই মিথ্যা, বানোয়াট অভিযোগগুলোর সমর্থনে তারা একটি কথা বলার সাহস পান কিনা।
তাহের বলেন : আমি একজন অনুগত নাগরিক নই বলে অভিযোগ করা হয়েছে। একজন মানুষ যে তার রক্ত ঝরিয়েছে, নিজের দেহের একটা অঙ্গ পর্যন্ত হারিয়েছে মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য তার কাছ থেকে আর কি আনুগত্য আপনারা চান? আর কোনোভাবে আমি এদেশের প্রতি আমার আনুগত্য প্রকাশ করতে পারি?
তাহের তার বক্তব্যের শেষে বলেন :
‘বাংলাদেশ বীরের জাতি। সাত নভেম্বর অভ্যুত্থান থেকে তারা যে শিক্ষা এবং দিকনির্দেশনা পেয়েছে তা ভবিষ্যতে তাদের সব কাজে পথ দেখাবে। জাতি আজ এক অদম্য প্রেরণার উদ্ভাসিত। যা করে থাকি না কেন তার জন্য আমি গর্বিত। আমি ভীত নই। জনাব চেয়ারম্যান, শেষে শুধু বলব, আমি আমার দেশ ও জাতিকে ভালোবাসি। এ জাতির প্রানে আমি মিশে আছি। কার সাহস আছে আমাদের আলাদা করবে? নিশঙ্ক চিত্তের চেয়ে জীবনে আর কোনো বড় সম্পদ নেই। আমি তার অধিকারী। আমি আমার জাতিকে তা অর্জন করতে ডাক দিয়ে যাই।
বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক। দীর্ঘজীবী হোক স্বদেশ।
ক্রাচে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে দীর্ঘ ছয় ঘণ্টার বক্তব্য শেষ করেন তাহের। আদালতের সবাই এমনকি প্রহরীরাও সম্মোহিতের মতো তার জবানবন্দি শোনেন।
১১৮. অশান্ত মন
জবানবন্দি দেবার পর ক্লান্তি নেমে আসে তাহেরের শরীরে, মনে। অন্তহীন ঝড় ঝাঁপটায় অশান্ত তিনি। মনের গভীরতম বেদনার কথা বলতে ইচ্ছা হয় কাউকে। সে রাতেই চিঠি লিখতে বসেন লুৎফাকে-আমাদের জীবনে নানা আঘাত, দুঃখ এসেছে তীব্রভাবে। প্রকাশের অবকাশও নেই। ভয় হয় যদি সে প্রকাশ কোনো সহকর্মীকে দুর্বল করে তোলে, ভয় হয় যদি কেউ আমাকে সমবেদনা জানাতে আসে, আমাকে, আমার জাতিকে ছোট করে। তাই মাঝে মাঝে মন ব্যাকুল হয়। তোমাকে পেতে চাই নিবিড়ভাবে। তোমার স্পর্শ, তোমার মৃদু পরশ, আমাকে শান্ত করুক।
কিন্তু তাহের কিংবা লুৎফা কেউ জানেন না পরস্পরকে স্পর্শ করে নিজেদেরকে শান্ত করবার সেই সুযোগ আর তাদের জীবনে আসবে না কোনোদিন।
১১৯. টালমাটাল নৌকা
উত্তাল ঢেউয়ের উপর টালমাটাল এক নৌকার মতো তখন দুলছে বাংলাদেশ। সে কোনোদিকে যাবে? ঠাণ্ডা লড়াইয়ের পৃথিবী তখন স্পষ্ট ভাগ হয়ে আছে পুঁজিবাদ আর সমাজতান্ত্রিক বিশ্বে। পৃথিবীর প্রতিটি ভূখণ্ডে তখন চলছে এই দড়ি টানাটানি। কে কাকে কোন শিবিরে টানবেন। ছোট্ট এই বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। একে নিয়েও ভেতরে বাইরে চলছে গভীর টানাপোড়েন। বাংলাদেশ নৌকার বিহ্বল মাঝি শেখ মুজিব নানা দোদুল্যমানতার শেষে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন পালে লাগাবেন সমাজতন্ত্রের হাওয়া। কিন্তু রক্তাক্ত দেহ নদীতে ছুঁড়ে ফেলে নৌকাকে পুঁজিবাদী স্রোতে টেনে নিতে উদ্যত হয়েছিলেন খন্দকার মোশতাক। দৃশ্যপটে মাঝে আবির্ভূত হয়েছিলেন খালেদ মোশারফ। নৌকা, পুঁজিবাদ না সমাজতন্ত্রের দিকে যাবে তা নিয়ে মাথা ব্যথা ছিল না তার, তিনি চাইছিলেন সেনাবাহিনীর ছোট্ট একটি দ্বীপের শৃঙ্খলা আর তার একটি পদ। দৃশ্যপট থেকে সরে গেছেন তিনি। আবির্ভাব ঘটেছে তাহের নামের এই স্বপ্নবাজ কর্নেলের। হাল ঘুরিয়ে নৌকাকে আবার তিনি নিতে চাইছেন সমাজতন্ত্রের দিকে, ধোয়াচ্ছন্ন কোনো সমাজতন্ত্র নয়, কায়েম করতে চাইছেন বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র। দেশে আরও যারা সমাজতন্ত্রের কথা বলেছেন তাদের মধ্যে কেউ এর আগে রাষ্ট্রকে এতটা তীব্রভাবে আঘাত করে ক্ষমতার এতটা কাছাকাছি আসতে পারেননি।
ফলে এই কর্নেলকে মোকাবেলার জন্য এবার দেশের বাইরের, ভেতরের যাবতীয় সেইসব শক্তি একত্রিত হয়েছেন যারা চিরতরে সমাজতন্ত্রের নাম বাংলাদেশ থেকে মুছে ফেলতে চান। সেইসব শক্তি এবার ভর করেছে এই বিপরীতমুখী স্রোতের অনিশ্চিত সাতারু জেনারেল জিয়ার ওপর। যার বিশেষ কোনো স্রোতের ব্যাপারে পক্ষপাতিত্ব নেই, যিনি, যখন ফলাফল অস্পষ্ট তখন খানিকটা নিরাপদ দূরত্বে থেকে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সব রকম পথ খোলা রাখেন। যেমন মুক্তিযুদ্ধের সময় শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আজ্ঞা পালন করলেও চূড়ান্ত ক্ষণে তিনি ঘুরে দাঁড়িয়েছিলেন বাঙালির দিকে। কারণ তিনি টের পেয়েছিলেন ভবিষাত ঐদিকেই। তেমনি দীর্ঘকাল নিরন্তর তাহেরের দিকে দরজা খুলে রাখলেও শেষ মুহূর্তে বন্ধ করে দিয়েছেন সে দরজা কারণ তাকে তখন ঘিরে রেখেছে আরও পরাক্রমশালী নানা শক্তি এবং তিনি টের পেয়েছেন ভবিষ্যৎ সেদিকেই। জিয়া আর তখন কোনো একক ব্যক্তি নন, একটি সম্মিলিত শক্তির প্রতিভূ। কারাগারে যখন গোপন বিচার চলছে জিয়া তখন সেনাবাহিনীর ভেতরে বাইরে, দেশের ভেতরে বাইরে নানা শক্তির সঙ্গে সেরে নিচ্ছেন বোঝাপড়া।
নানা কাকতালীয় যোগাযোগ, সুযোগ আর সৌভাগ্য মিলিয়ে মাত্র পাঁচ বছরে জিয়াউর রহমান একজন সাধারণ মেজর থেকে হয়ে উঠেছেন রাষ্ট্রের প্রধান কুশীলব। দৃশ্যপট থেকে অদৃশ্যই হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়েছিলেন, অবসর জীবন যাপনের পায়তারা করছিলেন। একটা ডুবে যাওয়া জাহাজ থেকে উদ্ধার পেয়ে পাকচক্রে জিয়া নিজেকে হঠাৎ আবিষ্কার করেছেন কর্নধারের ভূমিকায়। রাষ্ট্রের শীর্ষ আসনটি তখন তার নাগালের মধ্যে। কিন্তু ঐ আসনে যাবার পথে এ জগৎসংসারে তার একমাত্র বাধা তখন ক্রাচ হাতে ঐ কর্নেল, যে কিনা ঘটনাচক্রে তার উদ্ধারকারীও বটে। এই বিপজ্জনক কর্নেল সেনাবাহিনীর ভেতরে শ্রেণী সংগ্রাম শুরু করতে চান, তিনি বুর্জয়া রাষ্ট্রের সবচেয়ে সংগঠিত প্রতিষ্ঠানকে পাল্টে ফেলতে চান। এই কর্নেলকে প্রতিহত করতে পারলে লাভ বহুমুখী। সে মুহূর্তে বিপরীত শিবিরের শক্তি কেন্দ্র ঐ কর্নেল, বাকিরা ছায়া মাত্র। এই কর্নেলকে রাবারের মতো ঘষে দৃশ্যপট থেকে মুছে ফেলতে পারলে বুর্জুয়া রাষ্ট্রের প্রতিপক্ষের কফিনটিতে শেষ পেরেকটি ঠোকা যায়। বাংলাদেশে সমাজতন্ত্রের দরজাটিতে তালা ঝুলিয়ে চাবিটিকে ফেলে দেওয়া যায় সমুদ্রে। পাশাপাশি খুলে দেওয়া যায় বিপরীত দরজাটি যেদিক দিয়ে ঢুকবে ধনতন্ত্র আর ধর্মের হাওয়া, যে হাওয়াই তখন প্রবল। জিয়ার উত্থানের অন্যতম সাক্ষী তাহের। এই সাক্ষীকে নিশ্চিহ্ন করতে পারলে ইতিহাস তার হাতের মুঠোয়। নানাদিক থেকে বিপজ্জনক এই জ্বিনকে যখন বোতলে পোড়া গেছে, তখন তাকে আর বোতলের বাইরে আনবার বোকামী কেন? বোতল থেকে বেরুলে হয় জ্বিন থাকবে নয়তো জিয়া।
জিয়া ইতিহাসকে হাতের মুঠোয় নিয়েছিলেন বটে কিন্তু তারও পরিসমাপ্তি ঘটেছে বীভৎস রক্তগঙ্গায়। সে কাহিনী জমা রইল ভবিষ্যতের জন্য।
১২০. রায়
১৭ জুলাই শনিবার। সব অভিযুক্তদের কাঠগড়ায় আনা হয়। সেদিন রায় ঘোষণা করা হবে। ট্রাইবুনালের চেয়ারম্যান কর্নেল ইউসুফ হায়দার এসে বসলেন চেয়ারে। রায় ঘোষণা করলেন তিনি। বললেন, সরকার উৎখাত ও সশস্ত্র বাহিনীকে বিনাশ করার চেষ্টা চালানোর দায়ে বাংলাদেশে ফৌজদারী দণ্ডবিধি ১২১ (ক) ধারা এবং ১৯৭৫ সালের ১নং রেগুলেশনের ১৩নং সামরিক আইন বিধি বলে তথাকথিত গণবাহিনী ও অধুনালুপ্ত জাসদের কয়েকজন নেতা সম্পর্কে বিশেষ সামরিক ট্রাইবুনাল নিম্নোক্ত সিদ্ধান্ত দিয়েছেন :
ড. আখলাক, বি এম মাহমুদ, মো শাহাজাহান, শরীফ নুরুল অম্বিয়াসহ ১৫ জনকে মামলা থেকে বেকসুর খালাস। হাবিলদার হাইসহ বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার কয়জন সদস্যকে এক থেকে সাত বছরের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড। সিরাজুল আলম খানকে ৭ বছর সশ্রম কারাদণ্ড এবং দশ হাজার টাকা জরিমানা। আ স ম আবদুর রব, হাসানুল হক ইনু, আনোয়ার হোসেনকে দশ বছর সশ্রম কারাদণ্ড এবং দশ হাজার টাকা জরিমানা। মেজর জিয়াউদ্দীনকে বারো বছর সশ্রম কারাদণ্ড এবং বিশ হাজার টাকা জরিমানা। অবসরপ্রাপ্ত মেজর এম এ জলিল এবং আবু ইউসুফের ব্যাপারে বলা হয় এদের জন্য নির্ধারিত শাস্তি হচ্ছে মৃত্যুদণ্ড। তবে স্বাধীনতাযুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্য তাদের মৃত্যুদণ্ড থেকে অব্যহতি দেওয়া হচ্ছে। এদের জন্য নির্ধারিত শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত।
ঐ ছোট্ট অস্থায়ী আদালতে তখন পিনপতন নিস্তব্ধতা। শুধু একজনের রায় ঘোষণা বাকি। স্বাধীনতাযুদ্ধে অবদানের জন্য সর্বোচ্চ বীরউত্তম খেতাবধারী, পঙ্গু এই মানুষটির জন্য কি শাস্তি নির্দিষ্ট করা আছে? বিচারক ঘোষণা করলেন, অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল আবু তাহেরকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলো এবং তা ফাঁসিতে ঝুলিয়ে কার্যকর করা হবে। বিচারকের গলা খানিকটা কাঁপল যেন। রায় ঘোষণা করেই সব বিচারকরা দ্রুত আদালত থেকে বেরিয়ে গেলো।
স্তম্ভিত হয়ে পড়লেন সবাই। তাকালেন তাহেরের দিকে। তাহের হাসছেন। রায় শুনে বিচারে খালাস পাওয়া সাংবাদিক এ বি এম মাহমুদ কেঁদে ওঠেন হু হু করে। সাতই নভেম্বরের বিপ্লবের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের মিটিংটি তার বাসাতেই হয়েছিল। তাহের তার পিঠে হাত রেখে বলেন : কাঁদছেন কেন মাহমুদ ভাই?
মাহমুদ বলেন : আমি এজন্য কাঁদছি যে একজন বাঙালি কর্নেল তাহেরের মৃত্যুদণ্ড রায় ঘোষণা করতে পারল। মামলায় সাজাপ্রাপ্ত একমাত্র নারী সালেহা কাঁদতে কাঁদতে আদালত থেকে বেরিয়ে যেতে নিলে তাহের তাকে ডেকে বলেন : তোমার কাছ থেকে এ দুর্বলতা কখনই আশা করি না বোন।
সালেহা বলেন : আমি তো কাঁদছি না ভাই, হাসছি।
তাহেরের ভাই ইউসুফ আর আনোয়ার বিচারককে লক্ষ করে চিৎকার করে বলতে থাকে। আমাদের কেন মৃত্যুদণ্ড দিলেন না, আমাদেরও ফাঁসি দিন।
এসময় হঠাৎ ছাত্রনেতা মান্না স্লোগান তোলেন, তাহের ভাই লাল সালাম। বিহ্বল অভিযুক্তরা সবাই যোগ দেন সেই স্লোগানে। কেঁপে ওঠে ঐ ছোট্ট কোর্ট রুম। সে আওয়াজ ছড়িয়ে যায় পুরো জেল খানায়।
মেজর জিয়াউদ্দীন শুরু করেন সদ্য লেখা তার কবিতাটির আবৃত্তি—’জন্মেছি, সারা দেশটাকে কাঁপিয়ে তুলতে, কাঁপিয়ে গেলাম…’।
তাহের বেশ স্বাভাবিক কণ্ঠে বলেন, দারুণ হয়েছে তোমার কবিতা, কবিতাটা দাও আমাকে।
কাগজের টুকরোটি পকেটে পোড়েন তাহের।
তাহেরের পক্ষের আইনজীবীরা এগিয়ে আসেন তার কাছে। তারা হতবাক। বলেন : যদিও নিয়ম করা হয়েছে এই ট্রাইবুনালের বিরুদ্ধে কোনো আপিল করা যাবে না, তবু আমরা সুপ্রিমকোর্টে রীট করব। সম্পূর্ণ বেআইনীভাবে এ মামলা চালিয়েছে আদালত। আমরা রাষ্ট্রপতির কাছেও আবেদন করব।
তাহের বলেন : না, রাষ্ট্রপতির কাছে কোনো আবেদন করবেন না। এই রাষ্ট্রপতিকে আমিই রাষ্ট্রপতির আসনে বসিয়েছি। এই দেশদ্রোহীর কাছে আমি প্রাণ ভিক্ষা চাইতে পারি না।
পুলিশ এসময় সবাইকে যার যার সেলে যাবার তাগাদা দেয়। সবাই ঘিরে ধরেন জাহেরকে। তাহের বলেন : আমি যখন একা থাকি তখন ভয়, লোভ-লালসা আমাকে চারদিক থেকে এসে আক্রমণ করে। আমি যখন আপনাদের মধ্যে থাকি তখন সমস্ত ভয়, লোভ দূরে চলে যায়। আমি সাহসী হই। এমন একটা অপরাজেয় শক্তি আমার ভেতর ঢোকে যে মনে হয় সব বাধা বিপত্তি অতিক্রম করতে পারব।
তাহের যখন কথা বলছেন তখন সবার চোখে পানি। পুলিশ আবার তাগাদা দেয় যার যার সেলে যেতে। এক এক করে তাহেরকে দৃঢ় আলিঙ্গনে জড়ান সবাই, জলিল, রব, জিয়াউদ্দীন। আসেন আনোয়ার, ইউসুফ, বেলাল।
ফাঁসির আসামির জন্য নির্ধারিত ৮ নং সেলে নিয়ে যাওয়া হয় তাহেরকে।
১২১. মঞ্চ প্রস্তুত
অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে মামলার রায়ের দাপ্তরিক সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়। রায় ঘোষণার মাত্র পাঁচ ঘন্টার মধ্যে তাড়াহুড়া করে ট্রাইবুনাল চেয়ারম্যান মামলার সমস্ত কাগজপত্র নিয়ে চলে যান বঙ্গভবনে। রাত আটটার দিকে সেখানে প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের নিয়ে বৈঠক করেন তিনি। আইন ও বিচার মন্ত্রণালয় সচিবকে রায়ের ওপর প্রতিবেদন তৈরি করতে আদেশ দেন। প্রতিবেদন জমা দেওয়ার সময় বেঁধে দেওয়া হয় পরদিন ১৮ জুলাই ৭৬-এর সকাল বেলা পর্যন্ত। কিন্তু পরদিন রোববার, ছুটির দিন। তাড়াহুড়া করে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেন সচিব। তিনি সুপারিশ করেন সাতই নভেম্বরের নায়ক হিসাবে এবং উত্থাপিত অভিযোগগুলোর আলোকেই কর্নেল তাহেরের শাস্তি কমিয়ে দেওয়া হউক। কিন্তু পরদিন সরকারের উচ্চপর্যায়ের আরেকটি মিটিং এ এই সুপারিশ নাকচ করা হয়। ১৮ জুলাই রাষ্ট্রপতি সায়েম, তাহেরের মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল রেখে কাগজে সই করেন। অথচ বছর কয়েক আগেই মামলায় বিবাদীর অধিকার পুরোপুরি রক্ষা না হওয়ার পূর্ণচন্দ্র মণ্ডল নামের জনৈক ব্যক্তির উপরে আরোপিত মৃত্যুদণ্ডাদেশ খারিজ করে দিয়েছিলেন বিচারপতি সায়েম। অখ্যাত পূর্ণচন্দ্র মণ্ডলের ব্যাপারে যে আইনী উদারতা দেখাতে পেরেছিলেন বিচারপতি, এই বিপজ্জনক সময়ে তাহেরের মতো একজন আসামির ব্যপারে সে উদারতা দেখানো তার পক্ষে হয়ে ওঠে অসম্ভব। তিনিও তখন এক বিশাল শক্তির ক্রীড়ানক।
ব্যাপারটি হাস্যকর হয়ে ওঠে যখন মামলায় বলা হয় স্বাধীনতাযুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্য জলিল এবং ইউসুফকে মৃত্যুদণ্ড থেকে অব্যাহতি দেওয়া হচ্ছে। অথচ তাহের মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য তাদের দুজনের চেয়েও উচ্চতর খেতাবের অধিকারী আর একটি পা বিসর্জন দিয়ে যুদ্ধে তার অবদানের চিহ্ন তিনি তার শরীরেই বহন করে চলেছেন অবিরাম। অথচ অন্যেরা পেলেও তাহের এর জন্য শাস্তি থেকে অব্যাহতি পেতে পারেন না।
বিস্ময়ের ষোলকলা পূর্ণ হয় যখন এ সত্যটিও আবিষ্কার হয়, যে অপরাধের জন্য তাহেরকে অভিযুক্ত করা হয়েছে সে অপরাধে মৃত্যুদণ্ড দেবার মতো কোনো আইনই নেই। রায় ঘোষণার দশদিন পর একত্রিশ এ জুলাই ১৯৭৬ আইন মন্ত্রণালয় সামরিক আইনের বিশতম সংশোধনী জারি করেন। তাতে প্রথমবারের মতো বলা হয়, সশস্ত্র বাহিনীর অভ্যন্তরে রাজনৈতিক মতবাদের প্রচার নিষিদ্ধ ও বেআইনী এবং সেক্ষেত্রে অভিযুক্ত ব্যক্তির জন্য সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড।
তাহেরের পক্ষের প্রবীণ আইনজীবী আতাউর রহমান খান বিষণ্ণ হয়ে শুধু বলেন : দিস ইজ এ স্যাড কেস অব জুডিসিয়াল মার্ডার।
পরদিন সংবাদ পত্রে শিরোনাম হয় ‘তাহের টু ডাই’।
১২২. শেষ চেষ্টা
বিচার শুরু হবার পর থেকে লুৎফা নিরন্তর ভেবে এসেছেন কি হতে পারে শাস্তি? কারাদণ্ড? কতবছর? যাবজ্জীবন? মনের গভীর কোনে দু-একবার উঁকি দিয়েছে, তাকে কি মৃত্যুদণ্ড দিয়ে দিতে পারে? মাঝরাতে ঘুম ভেঙ্গে গেছে তার। মনে হয়েছে তা অসম্ভব। কিন্তু রায় ঘোষণা হবার পর অদ্ভুত অসার এক অনুভূতিতে আক্রান্ত হয়ে ওঠেন তিনি। সাত মাস আগে গ্রেফতার হয়েছেন তাহের, এর মধ্যে তাদের দেখা সাক্ষাত হয়নি একবারও। শুধু দূর থেকে একবার দেখেছিলেন কোর্টে যাওয়ার পথে, গরাদের ওপারে। হাত নেড়ে তাহের শুধু বলেছিলেন, ভালো থেকো। মাঝে মাঝে পাওয়া টুকরো টুকরো চিঠি আর চিরকুটেই চলেছে তাদের যোগাযোগ। রায় ঘোষণা হবার পর লুৎফা তাহেরের সঙ্গে দেখা করার অনুমতির চান, অনুমতি দেয়া হয় না তাকে।
তাহেরের মৃত্যুদণ্ড স্থগিতের নানা তৎপরতা চালান তারা। আইনজীবি সুপ্রিমকোর্টে রিট করার সিদ্ধান্ত নেন। ফাঁসির আদেশ স্থগিত করার জন্য প্রেসিডেন্টের কাছে ক্ষমার জন্য আবেদন করার পরিকল্পনা করেন। আবেদনে তাহেরের স্বাক্ষর প্রয়োজন। কিন্তু তাহের আবারও দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন কোনো অবস্থাতেই তিনি তার প্রাণভিক্ষার আবেদন করবেন না। আইনজীবীরা তখন তাহেরকে না জানিয়ে লুৎফার সই সহ ফাঁসির আদেশ স্থগিত করার আবেদন পাঠান রাষ্ট্রপতির কাছে।
লুৎফা ওদিকে ছুটে যান টাঙ্গাইলের সন্তোষে বর্ষীয়ান নেতা ভাসানীর কাছে। ভাসানী তাহেরের মৃত্যুদণ্ড খারিজ করার অনুরোধ জানিয়ে টেলিগ্রাম লেখেন রাষ্ট্রপতি সায়েমকে।
অ্যামন্যাস্টি ইন্টারন্যাশনালের প্রধান কার্যালয় থেকে তাহেরকে ক্ষমা করে দেওয়ার জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে আসে জরুরি আপিল। আপিলে লেখা হয় : সামরিক আইনের আওতায় জেলের ভিতরে গোপনে অনুষ্ঠিত একটি বিচার জাতিসংঘ ঘোষিত সার্বজনীন মানবাধিকারের আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত মানের পর্যায়ে পড়ে না। সর্বোচ্চ আইনগত কর্তৃপক্ষের কাছে আপিল করার অধিকারসহ ফৌজদারী আদালতে আইনের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় অভিযুক্তের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ প্রমাণ করা যেতে পারে।
লুৎফার ভাই রাফি, যার বাসায় কেটেছে তাহের প্রায় লুৎফার মধুচন্দ্রিমা, তার কিছু সঙ্গী নিয়ে লন্ডনে বাংলাদেশ দূতাবাসের সামনে তাহেরের ফাঁসির আদেশের প্রতিবাদে বিক্ষোভ অনশন শুরু করেন।
প্রাগৈতিহাসিক নীরবতায় ডুবে থাকে সরকার পক্ষ। শুরু হয় বহু বছর ধরে অকার্যকর, অব্যবহৃত ঢাকা জেলের ফাঁসীর মঞ্চ সংস্কারের কাজ।
১২৩. ছোট্ট, পরিষ্কার সেল
ফাঁসির আসামিদের জন্য নির্ধারিত ৮ নং সেল থেকে তাহের ১৮ জুলাই লেখেন তার শেষ চিঠি। এবার শুধু লুৎফাকে নয়, বাবা, মা ভাই বোন সবাইকে উদ্দেশ্য করে। মামলার রায় ঘোষণা এবং সে সময় আদালতের দৃশ্যপট বর্ণনা করেন তাহের। ক্ষোভ প্রকাশ করেন পত্রিকায় প্রকাশিত মামলা বিষয়ে সরকারি মিথ্যাচার নিয়ে। লেখেন তার কনডেম সেলে আসার অভিজ্ঞতা—
–‘ছোট্ট সেলটি ভালোই, বেশ পরিষ্কার। মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যখন জীবনের দিকে তাকাই তখন তাতে লজ্জার কিছু দেখি না। আমার জীবনের নানা ঘটনা আমাকে আমার জাতির সাথে দৃঢ় বন্ধনে আবদ্ধ করেছে। এর মতো বড় সুখ আর বড় আনন্দ আর কি হতে পারে। … নীতু, যীশু, মিশুর কথা, সবার কথা মনে পড়ে। তাদের জন্য অর্থ সম্পদ কিছুই রেখে যাইনি। কিন্ত আমার সমগ্র জাতি রয়েছে তাদের জন্য। … আমাকে কেউ হত্যা করতে পারে না। আমি আমার সমগ্র জাতির মধ্যে প্রকাশিত। আমাকে হত্যা করতে হলে পুরো জাতিকে হত্যা করতে হবে। কোন শক্তি কি তা করতে পারে?…
১২৪. দেখা হবে আবার
বার বার আবেদন করেও তাহেরের সঙ্গে দেখা করবার অনুমতি পাচ্ছিলেন না লুৎফা কিন্তু হঠাৎ জুলাইয়ের ১৯ তারিখ প্রেসিডেন্টের দফতর থেকে খবর এলো পুরো পরিবারকে তাহোরের সঙ্গে দেখা করতে যেতে হবে। বলা হলে যেতে হবে এক্ষুনি। এত ঘটা করে দেখা করবার আয়োজনে খটকা লাগে সবার। দুপুরের খাওয়ার আয়োজন হচ্ছিল। না খেয়েই সবাই রওনা দেয় জেলের দিকে। লুৎফা নীতু আর যীশুকে সঙ্গে নেন, মিশু ছিল নানা বাড়িতে তাকে নেওয়া হয় না। তাহেরের বাবা, মা, বোনরা আসেন। আসেন আরিফ, একমাত্র ভাই যিনি জেলের বাইরে, আসেন ইউসুফের স্ত্রী ফাতেমা। সাঈদ তখনও ফেরারি।
পরিবারের সবাইকে ফাঁসির আসামিদের কনডেম সেলের পাশে নিয়ে যাওয়া হয়। লুৎফা মিশুর একটা ছবি নিয়েছিলেন সঙ্গে কি জেল কর্তৃপক্ষ তা ভেতরে নিতে দেয় না। তখন আমের মৌসুম। লুৎফা যাওয়ার পথে কয়েকটা ফজলি আম কিনে নেন। আমগুলো নেওয়ার অনুমতি দেয় জেল কর্তৃপক্ষ।
সেলের কাছে যাওয়া মাত্রই তাহের হইচই বাঁধিয়ে দেন : জেলার সাহেব আমার স্ত্রী, মা, ভাই এসেছে এদের জন্য একটু চেয়ারের ব্যবস্থা করেন। প্রাণবন্ত তিনি। জয়াকে দেখে বলে উঠেন : আরে আমার মেয়েটার পা খালি কেন? তাড়াহুড়ায় আসতে গিয়ে জয়াকে জুতা পরাতে পারেনি লুৎফা। জয়ার ছোট্ট খালি পায়ে হাত বোলায় তাহের। বাবাকে জিজ্ঞাসা করে : আপনার শরীর কেমন, কাজলায় ফসল কেমন হলো? এমনভাবে আলাপ করছেন তাহের যেন পৃথিবীর কোথাও কিছু ঘটেনি। যেন এটি আটপৌরে কোনো এক দিন। একফাঁকে তাহের বলেন : কালকে যে চিঠি আপনাদের সবাইকে লিখলাম সেটা পড়ে শোনাই। ডেথ সেলে লেখা তার শেষ চিঠিটি জোরে জোরে পড়তে শুরু করেন তাহের : শ্রদ্ধেয় আব্বা, আম্মা, প্রিয় লুৎফা, ভাইজান আমার ভাই ও বোনেরা, গতকাল বিকাল বেলা ট্রাইবুনালের রায় দেওয়া হলো, আমার জন্য মৃত্যুদণ্ড…।
দীর্ঘ চিঠিটি পড়ে শোনান তাহের। তার চারপাশে স্তব্ধ হয়ে শোনে নানা বয়সের গুটিকয় মানুষ। তাদের চোখে অশ্রু।
তাদের কিছুতেই বিশ্বাস হয় না একজন মৃত্যুপথ যাত্রী মানুষের সাথে কথা বলছেন তারা। বিশ্বাস হয় না এটিই তাহেরের সঙ্গে তাদের শেষ দেখা।
চিঠির শেষ কটা লাইন পড়েন তাহের… আমি সমগ্র জাতির মধ্যে প্রকাশিত–
আশরাফুন্নেসা তাহেরের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন। তার চোখে কোনো অশ্রু নেই। একটি প্রতিষ্ঠানের মত দশ সন্তানের পরিবারটিকে গড়ে তুলেছেন তিনি। প্রতিটি সন্তানের মুখ তিনি ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন মাটির দিকে, সাধারণ মানুষের দিকে। অজানা পথে পা বাড়াবার সাহস দিয়েছিলেন সবসময়। তার সবকটি সন্তান সংসারের চেনা পথ ছেড়ে পা রেখেছেন অচেনা বিপদসংকুল পথে। তারা সবাই আশরাফুন্নেসার গর্ভজাত সন্তান শুধু নয়, তারা তারই সৃষ্টি। অসম্ভবের পায়ে মাথা কুটবার যে মন্ত তিনি সবার মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন, সে মন্ত্র সবচেয়ে দূরে নিয়ে গেছে তার তৃতীয় সন্তান নান্টুকে। আমাদের কর্নেল। গরাদের ওপারে দাঁড়িয়ে আছেন না। যে সন্তান আগামীকাল মৃত্যুবরণ করবে তার সামনে দাঁড়িয়ে কি বলতে পারেন মা? এই অস্বাভাবিক মুহূর্তে শুধুমাত্র একটি ভাষাই সম্ভবত যোগাযোগ ঘটাতে পারে পরস্পরের, সেটি নীরবতা। আশরাফুন্নেসা একটি কথাও আর বলেন না। শুধু তাহেরের মাথায়, পিঠে হাত বোলান।
সবার নীরবতায় একটু যেন অপ্রস্তুত তাহের। যতই তিনি স্বাভাবিক থাকবার চেষ্টা করুন না কেন, খুব ভেতরে বন্ধ কোনো একটা কুঠুরিতে তখন চাপা কম্পন। একটি দীর্ঘশ্বাস নেন তিনি। তিনি জানেন তার জন্য বরাদ্দকৃত শ্বাসের সংখ্যা কমে আসছে প্রতি পলে।
নীরবতা ভাঙ্গেন তাহের। বোন জলিকে বলেনঃ একি আপনার চোখে পানি কেন? আমি তো মরব না, আমাকে কেউ মারতে পারে না।
সবার মনে হয় তাহেরের কথাই সত্য। কিছুতেই তাহেরের মৃত্যু হতে পারে না। একটা কিছু অলৌকিক নিশ্চয়ই ঘটবে আর বেঁচে যাবেন তাহের।
একসময় আরিফ বলেন : দণ্ড মওকুফের একটা আবেদন কি তুমি করতে পারো না নান্টু?
তাহের বলেন : বড় ভাইজান আপনি বলেন, আমার জীবনের মূল্য কি জিয়া কিংবা সায়েমের জীবনের চাইতে কম? আমি তো ওদের কাছে ক্ষমা চাইতে পারি না।
পাহারারত পুলিশ বলেন : আপনাদের সময় শেষ।
তাহের বলেন : আমার আমার স্ত্রীর সঙ্গে একটু একা থাকতে দিন কিছুটা সময়।
এক এক করে সবাই বুকে জড়িয়ে ধরেন তাহেরকে, বিদায় নেন। কেউ ভেবে পান না একজন ফাঁসির আসামিকে বিদায়ের সময় কি কথা বলা যেতে পারে? তাকে তো বলা চলে না আবার দেখা হবে, কিংবা ভালো থেকো।
সবাই চলে যাবার পর থেকে যান লুৎফা। তাহের লুৎফার একটি হাত চেপে ধরেন। লুৎফার সমস্ত শরীর হাতে এসে ভর করে যেন। কেমন অবশ বোধ হয় তার।
তাহের বলেন, তুমি এমন মন খারাপ করলে চলবে? আমি তো মৃত্যুকে ভয় পাই না। দেখো আমার এই মৃত্যুর জন্য একসময় তুমি গর্ববোধ করবে। সবাই তো আছে। আমি সবার মধ্যে বেঁচে থাকব দেখো।
লুৎফা কোনো কথা বলতে পারেন না। শুধু শক্ত করে চেপে ধরে থাকেন তাহেরের হাত।
তাহের বলেন : জানো ক্ষুদিরামের পর আমিই প্রথম এভাবে মরতে যাচ্ছি?
পাহারারত পুলিশ বলে : আপনাদের শেষ করতে হবে, টাইম নাই।
লুৎফার বুক ভেঙ্গে আসে একটা কিছু বলবার জন্য। কিছুই মনে আসে না তার, মুখে আসে না তার।
পুলিশ বলে : টাইম শেষ।
চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ান তাহের। লুৎফা তার পাশ থেকে এগিয়ে দেন ক্ৰাচটি। তাহের বলেন আমাদের দেখা হবে আবার।
লুৎফা বুঝতে পারেন না, কি অর্থ করবেন এই কথার। একটি কথাও বলতে না পেরে কান্না চেপে চলে আসেন সেলের বাইরে।
তাহের গরাদের ওপাশ থেকে হাত নেড়ে বিদায় জানান।
১২৫. ৪টা ১ মিনিট
পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে দেখা হলেও রায় ঘোষণার পর জেলে বন্দি ইউসুফ, আনোয়ার, বেলালের সঙ্গে তখনও দেখা হয়নি তাহেরের। ২০ জুলাই বন্দি তিন ভাইকে বলা হয় তাহেরের সঙ্গে কনডেম সেলে দেখা করতে। তারা একে একে তাহেরের সেলে যান। গরাদের ওপাশে একটা চেয়ারে বসেন তাহের, পাশে শুইয়ে রাখেন সঙ্গী ক্রাচটি। এপাশে এক এক করে তার ভাইরা এসে বসেন। প্রথমে আসেন ইউসুফ। যথারীতি বেশ কিছুক্ষণ কেউ কোনো কথা বলতে পারেন না। মুখ খোলেন তাহেরই : আপনার মনে আছে ভাইজান আমি একটা লেখা লিখেছিলাম, সোনার বাংলা গড়তে হলে।
ইউসুফ : হ্যাঁ, খুব মনে আছে।
তাহের : লিখেছিলাম আমি এমন একটা বাংলাদেশের কল্পনা করি যার নদীর দুপাশে উঁচু বাঁধ। সে বাঁধের উপর দিয়ে চলে গেছে সোজা পাকা রাস্তা, চলে গেছে রেল লাইন, ইলেকট্রিসিটি, গ্যাস, টেলিফোন, টেলিগ্রাফ লাইন। বাঁধের দুই পাশে ছড়ানো গ্রাম। সেখানে নির্দিষ্ট দূরত্বে সুন্দর নকশার অনেক বাড়ি নিয়ে এক একটা জনপদ। প্রতিটা বাড়ির সামনে একটা সবুজ ঘাসে ঢাকা বাগান, সেখানে ফুল। একদিকে খোলা মাঠ। বিকেল বেলা বুড়োর এই মাঠের চারপাশে বসে গল্প করে। ছেলে মেয়েরা মেতে উঠে নানা খেলায়। সকালবেলা সামনের সোজা রাস্তা দিয়ে বাসের হর্ন শোনা যায়। হৈ চৈ করে ছেলে মেয়েরা যায় স্কুলে। এই দৃশ্যটা আজকে ভাবছিলাম। আমার বিশ্বাস ভাইজান এমন একটা দেশ একদিন হবে।
ইউসুফ : নিশ্চয়ই হবে নান্টু, আমরা লড়াই করে যাব।
তাহের : মৃত্যুর জন্য আমি প্রস্তুত ভাইজান। বহুবার আমি মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছি। মৃত্যু আমাকে পরাজিত করতে পারেনি।
নীরব থাকেন ইউসুফ। সময় ফুরিয়ে আসলে উঠে পড়েন। কেন যেন তাহের এবারও বলেন; আবার দেখা হবে।
স্নান হাসেন ইউসুফ।
আসেন বেলাল। তাহেরের সঙ্গে বয়সের অনেক পার্থক্য তার। তাহেরের সেলের পাশে বসে কিছু বলতে পারেন না তিনি। তাহের বলেন : মন খারাপ করবে না। আমরা যে মিশন নিয়ে শুরু করেছি তাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে, পারবে না?
মাথা নেড়ে সম্মতি জানান বেলাল। বিদায় নেন তিনিও।
আনোয়ার যখন দেখা করবার জন্য তাহেরের সেলের দিকে যাচ্ছেন, তখন পাশের দালানের দোতালার সেল থেকে মেজর জলিল চিৎকার করে বলেন, আনোয়ার, তাহের ভাইকে বলো তার মরে গেলে চলবে না। তিনি যেন ক্ষমার এপ্লিকেশনে সই করেন। আনোয়ার বলেন : আমি এটা তাকে বলতে পারব না জলিল ভাই, এটা বলা ঠিক হবে না।
তাহেরের সঙ্গে দেখা হলে আনোয়ার মেজর জলিলের সঙ্গে তার কথোপকথনের কথা জানান। তাহের বলেনঃ তোমার কাছে এমন উত্তরই আমি আশা করি আনোয়ার। প্রহরীকে চা দিতে বলেন তাহের। চা খেতে খেতে কথা বলেন তাহের, এক এক করে জাসদ, বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার পরিচিত সাখীদের কথা জিজ্ঞাসা করেন। সাবলীল, স্বাভাবিক। আনোয়ারের একবারও মনে হয় না এটিই তাদের শেষ দেখা। আনোয়ার ভাবেন, হয়তো সহসাই একটা কিছু ঘটবে, জাদুকরী কিছু, অসম্ভব কিছু, হয়তো মৃত্যুদণ্ড আর কার্যকরী হবে না। আনোয়ারও বিদায় নেন তাহেরের কাছ থেকে।
সন্ধ্যা নামে। জেলের একমাত্র পাখি কাকেরা ধীরে ধীরে থামায় তাদের কলরব। চৌবাচ্চায় তাহেরের ছেড়ে দেওয়া তেলাপিয়া মাছগুলো নিশ্চিন্তে ছোটাছুটি করে এপাশ থেকে ওপাশ।
রাত নামলে জেল কর্তৃপক্ষের দুজন দূত সেলের কাছে এসে তাহেরকে বলেন, আগামীকাল ভোর চারটায় আপনার ফাঁসি কার্যকর করা হবে।
তাহের ভালো করে তাকান তাদের দিকে। বুক ভরে নিঃশ্বাস নেন আবার! যেন নিজেকে প্রস্তুত করেন। বলেন : আপনাদের অনেক ধন্যবাদ।
তারপর নিঃশব্দে তার সামনে বেড়ে রাখা রাতের খাবার খান।
একটু দূরে বিশ নং সেলে মাহমুদুর রহমান মান্না, হাবিলদার হাই, সার্জেন্ট রফিক রাতের খাবারের আয়োজন করছিলেন। তাদের পাশের ঘরে মেজর জলিল। সিপাইদের ডিউটি বদল হয়ে সেখানে এসেছেন তাদের প্রিয় চরিত্র রসিক বৃদ্ধ সিপাই নানা। হাবিলদার হাই ডাকেন : কি নানা, নানীর খবর কি?
ধমক দেন বৃদ্ধ কথা কইয়েন না। মন বালা নাই আইজ।
হাই বলেন : ক্যান নানীর লগে ঝগড়া হইছেনি।
বৃদ্ধ সিপাই গরাদের শিক ধরে গম্ভীর মুখে বলেন : না, আইজ বুঝি মানুষটা যায়। ঐ যে দেখেন না বাত্তি জ্বলতাছে?
সবাই চমকে তাকিয়ে দেখেন খানিকটা দূরে যেখানে ফাঁসির মঞ্চ সেখানে কখন যেন হাজার পাওয়ারের বাতি জ্বলে উঠেছে। উজ্জ্বল আলোকিত হয়ে গেছে চারদিক। সার্জন্ট রফিকের হাত থেকে ভাতের প্লেট পড়ে যায়। পাশের রুম থেকে মেজর জলিল বলেন : মান্না খবর শুনেছো, আজকে কর্নেল তাহোরের ফাঁসি।
স্তব্ধ হয়ে পড়েন সবাই। ভাতের প্লেট পড়ে থাকে সামনে। কারো খাওয়া হয় না আর। তাহের যে আট সেলে আছেন সেখানে লোকজনের আনাগোনার ছায়া দেখতে পান তারা।
আট সেলে একজন মৌলভী আসেন। তাহেরকে বলেন, আপনাকে তওবা পড়াবার জন্য এসেছি। তাহের শান্তকণ্ঠে বলে আমি তওবা পড়ব কেন? আমি তো কোনো পাপ করিনি। আপনাদের সমাজের কোনো কালিমা তো আমাকে স্পর্শ করেনি। আমি সম্পূর্ণ শুদ্ধ। আপনি যান আমি এখন ঘুমাবো। তাহের বিছানায় শুয়ে নির্বিঘ্নে ঘুমিয়ে পড়ে।
এদিকে পুরো জেলে খবর পৌঁছে গেছে যে আজ রাতে তাহেরের ফাঁসি। ঢাকা জেলের শত শত কয়েদি সেদিন কেউ আর রাতের খাবার স্পর্শ করেন না। তারা জেগে বসে থাকে সবাই। ফাঁসির মঞ্চের উপর ফেলা হাজার পাওয়ারের ফ্লাশলাইট আলোকিত করে রেখেছে জেলখানার আকাশ। যার যার সেল থেকে সে আলোর দিকে তাকিয়ে বসে আছেন ইউসুফ, আনোয়ার, বেলাল। ফাঁসির মঞ্চে মহড়া হচ্ছে। শেষবারের মতো পরীক্ষা করা হচ্ছে নির্ধারিত দড়ি, যমটুপি। ঢাকা জেলের কোনো জল্লাদ রাজি হননি তাহেরর ফাঁসিতে যোগ দিতে। জল্লাদ আনা হয়েছে অন্য এক জেল থেকে প্রস্তুত হন জেলার, জেলের ডাক্তার। মেয়েদের জেল, জেনানা ফটকে মামলার একমাত্র মহিলা আসামি সালেহা ফুঁপিয়ে কাঁদছেন। তাকে ঘিরে জাসদ নেত্রী শিরিন আখতারসহ অনারা। একটি মেয়ে ডুকরে কেঁদে ওঠে–পঙ্গু মানুষটাকে এভাবে..
রাত তিনটার সময় প্রহরীরা সেলের কাছে গিয়ে দেখেন ফাঁসির আসামি তাহের গভীর ঘুমে মগ্ন। তারা তাহেরকে ডেকে তোলেন। ঘুম থেকে উঠে তাহের জানতে চান কতক্ষণ সময় আছে। প্রহরীরা বলেন, এক ঘণ্টা! তাহের এরপর দাঁত মাজেন, শেভ করেন, গোসল করে নেন। হাতের কাঁচটি দেয়ালে হেলান দিয়ে রেখে নিজে নিজে তার নকল পা’টি পরতে শুরু করেন। বিশেষ দিনগুলোতেই তাহের ক্রাচ ছেড়ে নকল পা’টি পরে থাকেন। আজ তার বিশেষ দিন। এসময় কারা রক্ষীরা তাকে সাহায্য করতে গেলে তাহের বলেন : কেউ আমাকে স্পর্শ করবেন না। আমার শরীর নিষ্পাপ। আমি চাই না এ শরীরে আপনাদের কারো স্পর্শ লাগুক।
তাহের একা তার কৃত্রিম পা’টি পরেন। পাশে দাঁড়িয়ে থাকেন কারা রক্ষীরা। তাদের সবার চোখ ভেজা।
নকল পা’টি লাগিয়ে তাহের জুতা আর প্যান্ট পরেন, একটা ভালো ইস্ত্রি করা শার্ট গায়ে দেন। হাত ঘড়িটা পরে নেন। চুলগুলো ভালোভাবে আচড়ান। যেন প্রস্তুত হচ্ছেন কোথাও বেড়াতে যাবার জন্য। তারপর বলেন : আমার স্ত্রী কিছু আম এনেছিল, সেগুলো কি খেতে পারি।
কারারক্ষীরা লুৎফার আনা ফজলি আম কেটে দেন। কাটা আম কারা রক্ষীদের দিকে এগিয়ে দেন তাহের : আপনারাও খান আমার সঙ্গে।
উপস্থিত কারা রক্ষীরা অশ্রুসজল চোখে আমের টুকরো হাতে নেন।
তাহের বলেন : একটু চা খাওয়া যায় আর সিগারেট?
তাহেরকে চা আর সিগারেট দেয়া হয়। চায়ে চুমুক দিতে দিতে তাহের সবার দিকে তাকিয়ে বলেন, আপনারা এমন মন খারাপ করে আছেন কেন? একটু হাসেন। আমি তো মানুষের মুখে হাসিই দেখতে চেয়েছিলাম। কারারক্ষীরা বলেন : সময় শেষ হয়ে আসছে, আপনাকে মঞ্চের দিকে যেতে হবে। তাহের উঠে দাঁড়ান। এসময় কারা কর্তৃপক্ষের একজন প্রতিনিধি তাহেরের কাছে জানতে চান; আপনার কোনো শেষ ইচ্ছা কি? তাহের একটু থামেন। মুখে মৃদুহাসি ফুটে ওঠে তার। বলেন : ইচ্ছসা তো একটাই। আমার মৃত্যুর বিনিময়ে এ দেশের সাধারণ মানুষের জীবনে শান্তি আসুক।
তাহের হেঁটে যান মঞ্চের দিকে। বরাবরের মতো তিনি তার লক্ষ্যের দিকে স্থির। লক্ষ্য তখন তার স্বাসির মঞ্চ। সার্চ লাইটের তীব্র আলোতে উজ্জ্বল হয়ে আছে মঞ্চ। মঞ্চের কাছে পৌঁছে তাহের জিজ্ঞাসা করেন : আর একটু সময় কি আছে?
কারা কর্তৃপক্ষ বলেন, আছে।
তাহের বলেন, তাহলে আমি একটি কবিতা পড়তে চাই।
তাকে অনুমতি দেওয়া হয়। তাহের পকেট থেকে একটি ছোট কাগজে জেলে বসে সহযোদ্ধা মেজর জিয়াউদ্দীনের লেখা কবিতাটি বের করে আবৃত্তি করেন। শ্রোতা জল্লাদ, জেলার, ডাক্তার আর কয়েকজন কারারক্ষী। তাহের পড়েন :
জন্মেছি সারা দেশটাকে কাঁপিয়ে তুলতে
কাঁপিয়েই গেলাম।
জন্মেছি তাদের বুকে পদচিহ্ন আঁকব বলে
এঁকেই গেলাম।
জন্মেছি মৃত্যুকে পরাজিত করব বলে
করেই গেলাম।
জন্ম আর মৃত্যুর দুটো বিশাল পাথর
রেখে গেলাম।
সেই পাথরের নিচে শোষক আর শাসকের
কবর দিলাম।
পৃথিবী অবশেষে এবারের মতো বিদায় নিলাম।
এরপর তাহের বলেন, অলরাইট গো এহেড, ডু ইউর ডিউটি, আই এম রেডি।
তিনি নিজে ফাঁসির দড়ি তুলে নেন। যপটুপি পরানোর আগে তাহের বলেন, বিদায় বাংলাদেশ। বিদায় দেশবাসী।
স্তব্ধ চারদিক। পরিচিত কাক ডেকে উঠে একটা দুটো। রুদ্ধশ্বাসে রাত জেগে বসে আছে কারাগারের শত শত কয়েদি। যাদের সেল ফাঁসির মঞ্চের কাছাকাছি তারা হঠাৎ ধরাস করে ফাঁসি কাঠের ডালা পড়ার শব্দ পান। ধড়মড়িয়ে উঠে ঘড়ি দেখেন বিশ সেলের মান্না, রাত তখন ৪টা ১ মিনিট।
১২৬. একটি মলিন চাদর
সারারাত তন্দ্রার মধ্যে কাটে লুৎফার। সারাক্ষণ ভাবেন একটা নাটকীয়, জাদুকরী কিছু ঘটবে। তিনি আবার ফিরে যাবেন তাহেরের কাছে, তাহের শক্ত করে ধরে রাখবে তার হাত। ভোরে ফোন করেন জেনারেল মঞ্জুরকে। মঞ্জুর তাহেরের সঙ্গে অন্ধকারে পাড়ি দিয়েছেন শিয়ালকোটের ধানক্ষেত। লুৎফার ফোন পেয়ে মঞ্জুর বলেন : দেখি এখনও যদি তাহের বেঁচে থাকে তাহলে চেষ্টা করে দেখব।
মঞ্জুরকে ফোন সেরে লুৎফা ছুটে যান তাহেরের বড় ভাই আরিফের বাসায়। সেখান থেকে গাড়ি করে কয়েক জায়গায় তাহেরের ব্যাপারে কথা বলতে যাবেন বলে যখন রওনা দিতে যাচ্ছেন তখন অ্যাডভোকেট জিনাত আলী এবং গণবাহিনীর নেতা মুশতাকসহ জাসদের কয়জন নেতাকর্মী হন্তদন্ত হয়ে আসেন। তারা বলেন : ভাবী আর কোথায় যাওয়ার প্রয়োজন নাই।
লুৎফা বসে পড়েন বিছানায়। তাকে আর কেউ কিছু বলে না। নিজেদের মধ্যেও কেউ কোনো কথা বলে না। একটা নিরালম্ব নীরবতা ঝুলে থাকে চারদিকে। বুঝতে দেরি হয় না লুৎফার।
ঢাকা জেলে সকাল বেলা আনোয়ার, ইউসূফ, বেলালকে কর্তৃপক্ষ জানান শেষবারের মতো তাহেরের মৃতদেহ দেখে আসতে। বেলাল গিয়ে দেখেন তাহেরকে শুইয়ে রাখা হয়েছে স্ট্রেচারে। তার পাস্ট মোর্টেম হয়ে গেছে। মুখে কোনো বিকৃতি নেই। মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে দু চলে আসেন বেলাল। আনোয়ার যাবার সময় জেলের বাগান থেকে কয়েকটা গাদা ফুল নিয়ে যান। তাহেরের লাশের পাশে নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন কিছুক্ষণ। ফুলগুলো বুকের ওপর ছড়িয়ে দেন। তারপর কি মনে করে সামরিক কায়দায় মৃত ভাইটিকে একটি স্যালুট দেন। আসেন ইউসুফ। একদৃষ্টে তাহেরের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন। মাথা থেকে পা পর্যন্ত চোখ বোলান। হঠাৎ দেখেন তাহেরের পায়ের কাছে কয়েক ফেঁটা রক্ত লেগে আছে। ইউসুফ তার গায়ের পাঞ্জাবিটি খুলে ঐ রটুকু মুছে নেন। সেলে ফিরে গেলে পাঞ্জাবির ঐ রক্ত ছুঁয়ে দেখেন সহযোদ্ধারা।
খবর পেয়ে আরিফ, লুৎফা এবং তাহেরের মা দুপুর বেলা জেল গেটে যান লাশ আনতে। তাদের বলা হয় লাশ তাদের দেওয়া হবে না। সরকার নিজের দায়িত্বে লাশ তাদের গ্রামের বাড়ি কাজলায় দিয়ে আসবে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে দেখা করেন আরিফ। অনুরোধ করেন তাহেরকে ঢাকায় কবর দিতে। রাজি হয় না তারা। বলেনঃ ঢাকায় কবর দেওয়া আমরা রিস্কি মনে করি। তাহেরকে কবর দিতে হবে তার গ্রামের বাড়িতেই।
ক্ষেপে যান আরিফ : আপনারাই তাহেরকে মারছেন, আপনারাই ঠিক করছেন কোথায় কবর দেবেন। তার চেয়ে তাকে বুড়িগঙ্গায় ফেলে দিলেই পারেন।
টাঙ্গাইল ঘুরে, ময়মনসিংহ হয়ে তারপর কাজলায় যাবার রাস্তা। অনেক লম্বা সে পথ। তাহেরের পুরো পরিবার নিয়ে দাফন করবার জন্য কাজলায় যাওয়া বিরাট ঝামেলা। তবু তারা অনড়, তাহেরকে ঢাকায় কিছুতেই কবর দেওয়া যাবে না। তারা বলেন : এখানে লাশ ছিনতাই হতে পারে।
শেষ চেষ্টা হিসেবে আরিফ বলেনঃ লাশ রাস্তা দিয়ে নিয়ে যাবার সময় যদি ছিনতাই হয় তাহলে কি হবে?
স্বরাষ্ট্র সচিবের সাথে কথা বলছিলেন আরিফ। আরিফের কথায় সচিব একটু যেন বিচলিত হন। নানা জায়গায় ফোন করতে শুরু করেন তিনি। তারপর এক পর্যায়ে আরিফকে জানান তাহেরের লাশ হেলিকপ্টারে কাজলা যাবে।
সরকারি আনুষ্ঠানিকতা সেরে বেলা আড়াইটায় তাহেরের লাশ পুলিশ অ্যাম্বুলেন্সে করে জেল থেকে বের করা হয়। জেল গেটে লুৎফাসহ অন্যরা সবাই। লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্সের আগে পেছনে চার পাঁচ ট্রাক সৈন্য। সঙ্গে গোয়েন্দাবাহিনীর প্রচুর সাদা পোশাকধারী। পরিবারের কেউ তখনও লাশ দেখেননি। অন্য একটা গাড়িতে উঠানো হয় পরিবারের লোকদের। গাড়ির বহর এসে থামে তেজগা বিমানবন্দরে হেলিকপ্টারে উঠানো হয় লাশ। হেলিকপ্টারে একে এক ওঠেন জেলের বাইরে থাকা পরিবারের সদস্যরা। আরিফ, লুৎফা, ফাতেমা, ডলি, জলি আর তাদের শুভানুধ্যায়ী অ্যাডভোকেট জিনাত আলী। বিকট শব্দে ঘুরছে হেলিকপ্টারের পাখা ধুলা উড়ছে চারদিকে। হেলিকপ্টারকে ঘিরে আছে অসংখ্য সৈন্যদল। ভীতিকর এক পরিবেশ যেন।
এই প্রথম তাহেরের লাশ দেখেন লুৎফা। শুয়ে আছেন স্টেচারে। জেলের একটা মলিন চাদর গায়ের উপর দেওয়া। কপালটা একটু বেরিয়ে আছে, পা দেখা যাচ্ছে খানিকটা। আশরাফুন্নেসা হঠাৎ হৈ চৈ করতে থাকেন : এটা কেমন একটা চাদর দিয়েছেন আপনারা ছেলেটার গায়ে, আমার ছেলে কি একটা ভালো চাদরও পেতে পারে না?
বিকট শব্দে ঘুরছে হেলিকপ্টারের পাখা। আশরাফুন্নেসার কণ্ঠ পৌঁছায় না কারো কাছে। ধূলো উড়িয়ে আকাশে উঠে যায় হেলিকপ্টার। কিশোরী জুলিয়া জড়োসড়ো হয়ে বসে থাকে হেলিকপ্টারে। তার মনে হয়, সাথে যদি একটা দেশলাই থাকত তাহলে তখনই সে আগুন ধরিয়ে দিত ঐ হেলিকপ্টারে, সবাই মরে যেত একসাথে।
শ্যামগঞ্জ বাজারে নামে হেলিকপ্টার। তখন সন্ধ্যা। আগেই ময়মনসিংহ থেকে প্রচুর সৈনিক জড়ো করা হয়েছে সেখানে। হেলিকপ্টার নামার সঙ্গে সঙ্গে কমান্ডো স্টাইলে হেলিকপ্টারকে ঘিরে ফেলে তারা। ভয় এই বুঝি ছিনতাই হয়ে যায় লাশ। খবর পেয়ে অগণিত মানুষ ছুটে আসতে থাকে লাশের দিকে। আর্মি সামাল দেয় সে ভিড়। শ্যামগঞ্জ বাজারের কাছে তাহেরের এক চাচার বাসায় গোসল করানো হয় তাহেরকে, কাফনের কাপড় পড়ানো হয়। স্থানীয় ঈদগা ময়দানে জানাজা হয়। সশস্ত্র প্রহরায় তাহেরের লাশ কাঁধে নিয়ে সিপাইরা হেঁটে রওনা দেন। কালায়। পেছন পেছন পরিবারের সবাই। কাজলায় পৌঁছাতে পৌঁছতে রাত হয়ে যায়। হ্যাজাক জ্বালিয়ে সিপাইরাই পারিবারিক গোরস্তানে কবর খোড়ে। পারিবারের সদস্যরা দর্শক মাত্র। মহিলাদের শেষ বারের মতো লাশের মুখ দেখতে দেওয়া হয়।
খবর পেয়ে ছুটে আসেন সাঈদ। তিনি তখনও এক মিথ্যা মামলার ফেরারি আসামি। ভাইয়ের মুখটা শেষ বারের মতো দেখতে সাধ হয় সাঈদের। কিন্তু চারদিকে তখন পুলিশ আর সেনাবাহিনীর পাহারা। একজন ফেরারি আসামির কি করে ঐ বেষ্টনীর ভেতর যাবে? এক আত্মীয়া একটি শাড়ি এনে সাঈদকে দিয়ে বলেন, ওটা পড়ে লাশের কাছে চলে যাও। সাঈদ, যিনি নানা প্রশ্নবাণে সারাক্ষণ ব্যতিব্যস্ত রাখতেন তাহেরকে তিনি শাড়ি পড়ে একজন নারীর বেশে তার ভাইকে শেষবারের মতো দেখতে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। কিন্তু ইতোমধ্যে সৈন্যরা তাহেরকে নামিয়ে ফেলেছে কবরে। কোদাল দিয়ে মাটি ফেলতে শুরু করে তারা। পাশের বাউসা বিল থেকে ঠাণ্ডা বাতাস আসে হু হু? বুঝি ঝড় আসবে।
১২৭. বর্ষার দিন
কবর দেওয়ার পর সেনাবাহিনীর সদস্যরা কবরের পাশে ক্যাম্প করে পজিশন নেয়। রাইফেল আর বেয়োনেট উঁচিয়ে কবরটিকে পাহাড়া দেয় তারা। এক সপ্তাহ যায়, দুসপ্তাহ যায় সেনা পাহাড়া তবু সরে না। পারিবারের একান্ত ঘনিষ্ঠজন ছাড়া আর কাউকে তার ভিড়তে দেয় না কবরের কাছে। দিন যায়। কাজলায় ভিড় করা পরিবারের সদস্যরা এক এক করে চলে যেতে থাকেন সংসারের টানে। থেকে যান শুধু লুৎফা। প্রতিদিন একবার বাড়ি থেকে হেঁটে কবরটার কাছে যান। কবর ঘিরে সশস্ত্র সেন্ট্রি। লুৎফা তার মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকেন নির্বাক। তুমুল বৃষ্টি নামে একদিন। কি মনে হয় লুৎফার, ছাতা মাথায়, কাদা পথ হেঁটে হেঁটে কবরের কাছে চলে যান তিনি। বাতাসের ঝাপটায় ভিজে যায় তার শাড়ি। ঘন বৃষ্টিতে আবছা দেখা যায় অস্ত্র হাতে রেইনকোট পরা সিপাইরা দাঁড়িয়ে আছে এদিক ওদিক। বৃষ্টিতে ঝুম ভিজছে কবরটি। পানি চুঁইয়ে চুঁইয়ে ঢুকছে কবরের অনেক ভেতরে। সেখানে শুয়ে আছেন একজন অমীমাংসিত মানুষ। লুৎফা ভাবেন : মানুষটা ভিজছে।