৭১. মাছের শেষ আহার
১৫ আগস্ট শেখ মুজিবের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার কথা। স্বাধীনতার পর প্রথম শেখ মুজিব যাচ্ছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সমাবর্তন অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি তিনি। উপাচার্য মতিন চৌধুরী আমন্ত্রণ জানিয়েছেন তাঁকে। সাজানো হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে। আগের দিন বিশ্ববিদ্যালয়ে শেখ মুজিবের জন্য তৈরি বক্তৃতা মঞ্চের কাছে একটি বোমা বিস্ফোরিত হয়েছে। সে ঘটনা নিয়ে সেনাবাহিনীর নিরাপত্তা দল সেদিন ব্যস্ত।
আগের দিন শেখ মুজিব যথারীতি অফিস করেছেন গণভবনে। বিকালে অভ্যাসমাফিক গণভবনের লেকের মাছগুলোকে আধার খাইয়েছেন তিনি। লেকের পারে বসেই পরদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে কি কি অনুষ্ঠান হবে, তিনি বক্তৃতায় কি কি বলবেন এই নিয়ে সংশিষ্টদের সঙ্গে কথা বলেছেন। বেশ রাতে ফিরে গেছেন তার ৩২ নম্বরের বাসায়। রাতে শেখ মণি এসে মুজিবকে দিয়ে গেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বশেষ অবস্থার খবর। পরদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখা হবে বলে চলে গেছেন। রাতে এসেছেন সেরানয়াবতও। সেদিন তার মার মৃত্যুবার্ষিকী। তার বাড়িতে আত্মীয়স্বজন। রাতে খাওয়ার পর বৈঠক ঘরে বসে শেখ মুজিব সেরনিয়াবতের কাছে দেশের বন্যা পরিস্থিতির খবর জানতে চান। সেরনিয়াবত তখন বন্যা নিয়ন্ত্রণ মন্ত্রী। পাইপে ধোয়া ছেড়ে মুজিব গল্প করেন : ছোটবেলায় ড্রেজার কোম্পানির যে ব্রিটিশরা ছিল ওদের সাথে নদীর পাড়ে ফুটবল খেলতাম। সেকেন্ড ওয়ার্ল্ড ওয়ারের সময় ড্রেজারের বার্তাগুলো সব বার্মাতে নিয়ে গেল, আর ওগুলো আসল না। আমি যেখানে ফুটবল খেলতাম ওখানে এখন আর নদীর নিশানা নাই, খালি চর। বাকশাল হলে আবার এই ড্রেজারের কাজ শুরু করব।
সেরনিয়াবত অনেক রাতে বিদায় নেন। বেশ রাত করে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার নিরাপত্তার সব খবরা খবর নিয়ে ফেরেন শেখ কামাল। অনেক রাত পর্যন্ত পাশের বাড়ির এক বন্ধুর সঙ্গে ক্যারাম খেলে বাড়ি ফেরে শেখ জামাল। শেখ কামাল, শেখ জামাল দুজনের ঘরেই সদ্য বিবাহিত স্ত্রী। মাস খানেক আগেই বিয়ে হয়েছে তাদের। বাড়ির বৌ রোজী আর সুলতানার হাতে তখনও মেহেদীর দাগ। ঘরে বিয়ের উপহারের প্যাকেট তখনও খোলা হয়নি সব। সেদিন বিকেলে গণভবনের লেকে সাঁতার শিখতে নেমেছিল রাসেল। সে ক্লান্ত। ঘুমিয়ে পড়ে তাড়াতাড়ি। কাজের সূত্রে সেদিন খুলনা থেকে ঢাকায় এসেছেন শেখ মুজিবের ভাই শেখ নাসের। খেয়ে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছেন তিনিও। ঘরে নেই মেয়ে হাসিনা আর রেহানা। শেখ হাসিনা তখন তার স্বামীর সঙ্গে জার্মানিতে, সঙ্গে শেখ রেহানা। মাঝ রাতের পর ঘুমাতে যান শেখ মুজিব। রান্নাঘর সামলে অনেক রাতে শুতে আসেন স্ত্রী ফজিলাতুন্নেসা। রোজকার মতো বেডরুমের দরজার সামনে করিডোরে ঘুমিয়ে পড়ে গৃহভৃত্য রমা আর সেলিম।
তারা কেউ জানেন না একটি অতি সাধারণ রাত আর কিছুক্ষণ পরেই পরিণত হবে একটি বিভীষিকায়।
৭২. ৩২ নম্বর
ভোরের অস্ফুট আলোয় নির্জন ধানমন্ডি ৩২ নম্বর রোড। সামনের লেকে কে একজন গোসল করতে নেমেছে। লেকের পাড়ের এক গাছ চুপিসারে ডেকে নিয়ে যাচ্ছে আরেক গাছের পাখিকে। একটা আটপৌড়ে দিন। ৩২ নম্বরে শেখ মুজিবের বিখ্যাত বাড়িটির চারপাশে এসময় হঠাৎ ঘিরে দাঁড়ায় অনেকগুলো সৈন্য বোঝাই ট্রাক, জীপ। বাড়িকে তাক করে চারপাশে পজিশন নেয় ভারী কয়েকটি কামান। অতর্কিতে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র আর কামান থেকে শুরু হয়ে যায় তুমুল গুলিবর্ষণ। ঘটনার আকস্মিকতায় বাড়ির নিরাপত্তায় থাকা পুলিশ বিহ্বল হয়ে পড়ে। কোনো প্রতিরোধ ছাড়াই অস্ত্র হাতে বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়ে ঘাতক দল।
প্রচণ্ড গুলির শব্দে ঘুম ভেঙ্গে যায় বাড়ির সবার। ধড়ফড়িয়ে উঠেন সবাই। অপ্রস্তুত, কিংকর্তব্যবিমূঢ় প্রত্যেকে। ঘরের ভেতর শুরু হয়ে যায় ছুটোছুটি। শেখ মুজিব সিঁড়ি বেয়ে দোতলা থেকে নেমে আসেন নিচে। টেলিফোন করবার চেষ্টা করেন বিভিন্ন জায়গায়। লাইন পেতে সমস্যা হয় তার। তিনি সেনাপ্রধান শফিউল্লাহ এবং তার নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত কর্নেল জামিলকে ফোন করতে সক্ষম হন। তিনি দ্রুত ফোর্স পাঠিয়ে আক্রমণকারীদের প্রতিহত করবার অনুরোধ করেন। ফোন সেরে উঠে যান দোতলায়। সিঁড়িতে গৃহভৃত্য রমা তাকে তার পাঞ্জাবি এবং পাইপটি হাতে দেয়, শেখ মুজিব পাঞ্জাবিটি পরে নেন।
শেখ মুজিবের টেলিফোন পাওয়া সত্ত্বেও অপ্রস্তুত, বিমূঢ় সেনাপ্রধান শফিউল্লাহ ত্বরিত কোনো ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হন। দ্রুত সময় গড়ায়।
ইতোমধ্যে ঘাতক দল ঢুকে পড়েছে বাড়ির ভেতরে। নিচতলায় তারা হত্যা করে শেখ কামালকে। শেখ মুজিব ছুটে আসবার চেষ্টা করেন নিচে। সিঁড়ির উপর তাকে ঘিরে ধরে ঘাতক দল। উত্তেজিত শেখ মুজিব হুঙ্কার দেন : তোরা কি চাস? পাকিস্তান আর্মি আমাকে কিছু করতে পারেনি, তোরা কি করবি…।
কিন্তু পাকিস্তান আর্মি যা করতে পারেনি বাংলাদেশ আর্মির কতিপয় তরুণ অফিসার তাই করে। শেখ মুজিবকে লক্ষ্য করে ব্রাশফায়ার করে তারা। সিঁড়ির উপর লুটিয়ে পড়েন তিনি। রক্তাক্ত হয়ে যায় সাদা পাঞ্জাবি। হাত থেকে পড়ে যায় তার পাইপটি। যে তর্জনি উঁচিয়ে তিনি ভাষণ দিতেন বিখ্যাত সেই তর্জনিটি গুলির আঘাতে ছিটকে পড়ে তার দেহ থেকে দূরে।
এরপর ঘাতকেরা ৩২ নম্বর বাড়ির উপর তলা, নিচ তলার বিভিন্ন ঘরে, বারান্দায়, টয়লেটে আশ্রয় নেওয়া পরিবারের সদস্যদের একে একে গুলি করে হত্যা করতে থাকে। বাড়ির নানা প্রান্তে পড়ে থাকে রক্তাক্ত লাশ-বেগম ফজিলাতুন্নেসার, শেখ কামালের, শেখ জামালের, সুলতানা কামাল আর রোজী জামালের, শেখ রাসেল আর শেখ নাসেরের।
শুধু শেখ মুজিব নন, পুরো পরিবারকে বাংলাদেশের দৃশ্যপট থেকে সরিয়ে দেওয়ার কাজটি নিশ্চিত করে তারা।
কর্নেল জামিল শেখ মুজিবের ফোন পেয়ে বিছানার পোশাকে, পায়জামার উপরই ড্রেসিং গাউন পড়ে তার লাল ভক্সওয়াগন গাড়িটি চালিয়ে ৩২ নম্বরে ছুটে আসলে তাকেও গুলি করা হয়। দৃশ্যপটে যুক্ত হয় আরও একটি মৃতদেহ।
সমান্তরাল সময়ে অতর্কিতে আক্রমণ করা হয় শেখ মণি এবং আবদুর রব সেরনিয়াবতের বাড়ি। নিহত হন শেখ মণি এবং তার স্ত্রী, আবদুর রব সেরনিয়াবত এবং তার দুই সন্তান। সেখানে দ্রুত অপারেশন সেরে মেজর ডালিম এবং রিসালদার মোসলেউদ্দীন চলে আসেন নাটকের মূল মঞ্চ ৩২ নম্বরের বাড়িতে।
সম্ভাব্য প্রতি আক্রমণ ঠেকানোর জন্য মেজর ফারুক তার ট্রাঙ্ক বহর নিয়ে শেরে বাংলাস্থ রক্ষীবাহিনীর সদর দফতর ঘিরে ফেলে ভড়কে দেন তাদের। রক্ষীবাহিনীকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করে মেজর ফারুকও চলে আসেন ৩২ নম্বরে। সফল অভিযানের জন্য সবাইকে অভিনন্দন জানান তিনি।
শেখ মুজিবের বাড়ির আশপাশের দালানগুলোর আতঙ্কিত অধিবাসীরা সন্তর্পনে জানালার পর্দার আড়াল থেকে দেখেন মুজিবের বাড়ির চারপাশে কালো পোশাক পড়া অস্ত্রধারীদের এলোমেলো পদচারণা, গেটের সমানে ট্রাক, লরী।
একটি জীবকে এসময় আমেরিকার ফ্ল্যাগ উড়িয়ে টহল দিতে দেখা যায়।
১৫ আগস্ট বাংলাদেশের নানা প্রান্তের মানুষের ঘুম ভাঙ্গে রেডিওর ঘোষণায় :
আমি মেজর ডালিম বলছি। স্বৈরাচারী শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে। জননেতা খন্দকার মোশতাক আহমদের নেতৃত্বে বাংলাদেশ সেনানাবাহিনী ক্ষমতা দখল করেছে। দেশে সামরিক আইন জারি করা হয়েছে এবং সারাদেশে কারফিউ জারি করা হয়েছে। বাংলাদেশ এখন থেকে ইসলামী প্রজাতন্ত্র হবে…
দেশজুড়ে এক গাঢ় নিস্তব্ধতা নেমে আসে।
৭৩.. নতুন কুশীলব
মেজর ফারুক তার দায়িত্ব শেষ করবার পর শুরু হয় মেজর রশীদের ভূমিকা। কথামতো খন্দকার মোশতাককে এবার নিয়ে আসতে হবে দৃশ্যপটে। একটি সেনা জীপে উঠে বসেন মেজর রশীদ, পেছনে ল্যান্সারের একটি ট্যাঙ্ক এবং এক ট্রাক বোঝাই সৈন্য। রশীদ রওনা দেন আগামসি লেনের দিকে। যাবার আগে তিনি দেখা করেন ৪৬ ব্রিগেডের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার শাফায়াত জামিলের সঙ্গে। শাফায়াতে জামিলের সরাসরি অধীনস্ত অফিসার রশীদ। তার অধীনস্ত অফিসার এত কাণ্ড ঘটালেও শাফায়াত জামিল এ ব্যাপারে তখনও সম্পূর্ণ অন্ধকারে। রশীদ যাবার পথে শাফায়াত জামিলকে ঘুম থেকে উঠিয়ে বলেন : উই হ্যাভ কি শেখ মুজিব। উই হ্যাভ টেকেন ওভার দি কন্ট্রোল অফ দি গভর্নমেন্ট আন্ডার দি লিভারশিপ অফ খন্দকার মোশতাক।… আপনি এই মুহূর্তে আমাদের বিরুদ্ধে কোনো অ্যাকশনে যাবেন না। কোনো পাল্টা ব্যবস্থা নিলে গৃহযুদ্ধ বাধবে।
সৈন্য আর ট্যাঙ্ক নিয়ে এরপর মেজর রীদ হজির হন খন্দকার মোশতাকের আগামসি লেনের বাড়িতে। ভোরবেলা পাড়ার ভেতর ট্যাঙ্ক দেখে হচকচিয়ে যায় মহল্লার মানুষ। তারা জানে না যে তারা ইতিহাসের পটপরিবর্তনের প্রত্যক্ষ সাক্ষী হচ্ছেন। কিন্তু মোশতাক তা ভালো জানেন। তিনি ঘুম থেকে উঠেছেন আগেই। রশীদ মোশতাককে সকালের অপারেশনের সাফল্যের কথা জানান, শেখ মুজিবের নিহত হবার খবর জানান। পরিকল্পনামতো এবার রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব নেবেন খন্দকার মোশতাক আহমদ। তাকে এখন যেতে হবে রেডিও স্টেশনে এবং নতুন রাষ্ট্রপতি হিসেবে ভাষণ দিতে হবে জাতির উদ্দেশে। মোশতাক ঘরের ভেতর যান, তার পরিচিত আচকানটি পরে নেন, পরে নেন তার বিখ্যাত টুপি। পুরনো পোশাক তার কিছু নাটকে এবার তার চরিত্র ভিন্ন। সৈন্য আর ট্যাঙ্ক পরিবেষ্টিত হয়ে এরপর মোশক রওনা দেন রেডিও স্টেশনের দিকে। প্রায় জনশূন্য ঢাকা শহরের ভোর। থমথমে ভাব চারদিকে। কোনো কোনো মোড়ের দোকানে ছোট জটলা, মানুষ রেডিওতে শুনছে মেজর ডালিমের ঘোষণা-স্বৈরাচার শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে…
৭৪. প্রেসিডেন্ট ইজ ডেড সো হোয়াট?
মেজর রশীদের কাছে শেখ মুজিবের মৃত্যুর খবর পেয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় ব্রিগেডিয়ার শাফায়াত ভোর বেলা দ্রুত পায়ে হেঁটে রওনা দেন কাছাকাছি উপ সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানের বাসায়। উত্তেজিত হয়ে দরজা ধাক্কান তিনি। বেরিয়ে আসেন জেনারেল জিয়াউর রহমান। তার গায়ে স্লিপিং ড্রেসের পায়জামা এবং সান্ডো গেঞ্জি। একগালে শেভিং ক্রিম লাগানো। শাফায়াত উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলেন : প্রেসিডেন্ট ইজ কিল্ড।
জিয়াকে মোটেও বিচলিত মনে হয় না। তিনি শান্তকণ্ঠে বলেন : প্রেসিডেন্ট ইজ ডেড সো হোয়াট? ভাইস প্রেসিডেন্ট ইজ দেয়ার। গেট ইওর ট্রুপস রেডি। আপহোল্ড দি কন্সটিটিউশন।
কৌতূহলোদ্দীপক জেনারেল জিয়ার প্রতিক্রিয়া। শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যু যেন নেহাত একটি দাপ্তরিক ব্যাপার। প্রেসিডেন্ট মারা গেলে ভাইস প্রেসিডেন্ট দায়িত্ব নেবেন, এটাই নিয়ম। সুতরাং এতে বিচলিত হবার কিছু নেই।
বাংলাদেশের ইতিহাসের মোড় ফেরানো ঐ দিনটিতে জেনারেল জিয়াকে আরও কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করা যাক।
হতবিহ্বল সেনাপ্রধান শফিউল্লাহ পরিস্থিতি পর্যালোচনার জন্য সেদিন সকালে চিফ অব জেনারেল স্টাফ খালেদ মোশারফ এবং উপ সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানকে সেনা সদরে ডাকেন। খালেদ মোশারফ নিজে তার ব্যক্তিগত গাড়ি চালিয়ে চলে আসেন তৎক্ষণাৎ, তার পরনে রাতের পায়জামা, শার্ট, মুখে ধোয়া খোঁচা দাড়ি। তার কিছুক্ষণ পর আসেন জিয়াউর রহমান, ড্রাইভারচালিত অফিসিয়াল গাড়িতে, ক্লিন শেভড এবং মেজর জেনারেলের পূর্ণাঙ্গ ইউনিফর্মে।
ভোর বেলা ঘটে যাওয়া নারকীয় ঘটনার কোনো অভিঘাত ঘটবার চিহ্ন জিয়াউর রহমানের মধ্যে নেই।
৭৫. সেনা সদর
সেদিন সকালে বিভ্রান্ত সিনিয়র আর্মি অফিসাররা সেনা সদরে বসে এই অপ্রত্যাশিত ঘটনায় তাদের করণীয় নিয়ে আলাপ করতে বসেন। তারা বুঝতে পারেন যে, পুরো সেনাবাহিনী তো নয়ই, বরং সেনাবাহিনীর ক্ষুদ্র দুটি ইউনিটের জুনিয়র কিছু সদস্য এই ঘটনা ঘটিয়েছে এবং গোয়েন্দা সংস্থা ব্যর্থ হয়েছে এর আগাম কোনো খবর পেতে। তারা আলাপ করে দেখতে পান যে এখন তাদের জন্য দুটো পথ খোলা আছে।
এক, অন্যান্য ট্রুপস দিয়ে বিদ্রোহী এই ইউনিট দুটোকে আঘাত করা এবং মুখোমুখি সংঘর্ষে চলে যাওয়া।
দুই, পরিবর্তিত অবস্থাটিকে মেনে নেয়া।
প্রশ্ন ওঠে এই মুহূর্তে প্রতিঘাত বা সংঘর্ষ ঘটিয়ে কি বা ফল পাওয়া যাবে? যাকে রক্ষার জন্য তা করা যেতে পারত তিনিই তো বেঁচে নেই। শেখ মুজিবই যখন মারা গেছেন তখন আর নতুন করে রক্তপাতের পথে যেয়ে কি লাভ? সবাই তাই এই মত দেন যে, পরিবর্তিত পরিস্থিতিকেই মেনে নিয়ে কি করে এগিয়ে যাওয়া যায় সে চেষ্টা করবেন।
কিছুক্ষণ পর সেনাসদরে স্টেনগান উঁচিয়ে হাজির হন সকালের নাটকের অন্যতম এক কুশীলব, মেজর ডালিম। রেডিও মারফত তখন তার নাম পৌঁছে গেছে সমগ্র দেশে। তার উপস্থিতিতে সেনা সদরের আশপাশে একটি চাঞ্চল্য দেখা দেয়। ডালিম সোজা সভাকক্ষে ঢুকে স্টেনগান উচিয়ে ধরেন শফিউল্লাহর দিকে। বলেন, তাকে এবং অন্য দুই বাহিনীর প্রধানকে নতুন প্রেসিডেন্ট খন্দকার মোশতাক রেডিও স্টেশনে যেতে বলেছেন। শফিউল্লাহ সামান্য বাদানুবাদ করবার চেষ্টা করেন। কিন্ত মাত্র ঘণ্টাখানেক আগেই মেজর ডালিম রক্তে রঞ্জিত করে এসেছেন তার হাত। একটা ভীতি ঘিরে থাকে সবাইকে। সেনাপ্রধান শফিউল্লাহ, নৌ বাহিনীপ্রধান এম এইচ খান এবং বিমান বাহিনীপ্রধান এয়ার মার্শাল এ কে খন্দকার ডালিমের সঙ্গে অস্ত্রধারী সৈন্য পরিবেষ্টিত হয়ে রওনা দেন রেডিও স্টেশনে।
৭৬. ডেঞ্জারাস গেম
১৫ আগস্ট ভোর বেলা ঢাকা রেডিও স্টেশন থেকে কেউ একজন ফোন করে তাহেরকে জানায়, শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে। সে এও বলে তাহের যেন রেডিও স্টেশনে চলে আসেন। আনোয়ার সেদিন নারায়ণগঞ্জে। ঘুম থেকে আনোয়ারকে ডেকে তোলেন তাহের। উত্তেজিত হয়ে বলেন : রেডিওটা ছাড়ো তো। বঙ্গবন্ধুকে নাকি মেরে ফেলেছে!
রেডিওতে তারা ডালিমের ঘোষণা শোনেন। তাহের ফোন করেন ইনুকে।
তাহের : তুমি শুনেছো মুজিব ইজ কিলড?
ইনু : না তো।
তাহের : কারা মেরেছে ঠিক বুঝতে পারছি না। ডালিমের নাম শোনা যাচ্ছে, মোশতাকের নামও শুনলাম। একটা চেঞ্জ ওভার হচ্ছে কিন্তু খুব খারাপ চেঞ্জ। পুরো আর্মি ইনভলব না, হলে আমরা জানতাম। সাম অফ দেম। আমি রেডিও স্টেশনে যাচ্ছি। মেইন অ্যাকটররা সব ওখানে। আই নো মোস্ট অব দেম? উই মাস্ট অ্যাক্ট বিফোর ইট ইজ টু লেট। তুমি শাহবাগ মোড়ে থাকো আমি তুলে নেব।
নারায়ণগঞ্জে তাহেরের বাসার পাশে সেনাবাহিনীর একটি ক্যাম্প। তাহের তার অধিনায়ককে বলেন একটি জীপ যোগাড় করে দিতে। ক্ৰাচটি তুলে নেন আর হাতে স্টিক।
খবর শুনে স্তম্ভিত হয়ে পড়েন লুৎফা। বলেন : এই সময় ওখানে যাওয়া কি ঠিক হচ্ছে? কত রকম বিপদ হতে পারে।
তাহের : লুৎফা তুমি আমার বিপদের কথা বলছ? দেশে একটা ভীষণ বিপদ নেমে আসছে। প্রতিটা মিনিট জরুরি। আমার ওখানে যাওয়া দরকার।
তাহের জীপে রওনা দেন রেডিও স্টেশনের দিকে। আনোয়ারকে বলেন : তুমিও চলো।
ঘটনার এই নাটকীয়, অপ্রত্যাশিত মোড়ে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন তাহের। এমন একটি পরিস্থিতির জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলেন না তিনি। এই ঘটনায় মুহূর্তে যেন ধূলিসাৎ হয়ে যায় তার এতদিনের প্রস্তুতি, ভবিষ্যত পরিকল্পনা। কিন্তু ঘটনার গতিপ্রকৃতি বুঝবার জন্য তিনি মূল দৃশাপটে উপস্থিত হতে চান।
শাহবাগে ইনুকে তুলে নিয়ে তারা রেডিও স্টেশনে যান। গেটে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার এক পরিচিত সৈনিক তাদের জানান যে, মেজর ফারুক এবং মেজর রশীদ এই ঘটনা ঘটিয়েছে। ক্রাচে ভর দিয়ে বড় বড় পা ফেলে তাহের দ্রুত ঢোকেন রেডিও স্টেশনে। ভেতরে ঢুকতে মেজর রশীদ এগিয়ে আসেন। রশীদ তাহেরকে পুরো ঘটনা বিস্তারিত বলতে উদ্যত হলে তাহের তাকে থামিয়ে দিয়ে বলেন : হু ইজ ইওর লিভার?
রশীদ : খন্দকার মোশতাক। উনি ভেতরে আছেন। উনিই আপনাকে ফোন করে খবর দিতে বলেছেন।
ইনু আর আনোয়ারকে বাইরে রেখে ভেতরের একটি ঘরে ঢোকেন তাহের এবং রশীদ। তাহের সেখানে খন্দকার মোশতাকের সঙ্গে তাহের উদ্দীন ঠাকুর এবং মাহবুবুল আলম চাষীকে দেখতে পান। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ের মোশতাক ত্রয়ী। তারা তখন খন্দকার মোস্তাকের বেতার ভাষণ প্রস্তুতে ব্যস্ত। তাহেরের সেই কৈশোরে পরিচয় হওয়া তাহের উদ্দীন ঠাকুরের সঙ্গে ইতিহাসের এই নাটকীয় মুহূর্তে দেখা আবার। তাদের দুজনের পথ তখন ভিন্ন।
জীবিত শেখ মুজিবের সবচাইতে শক্তিশালী প্রতিপক্ষ ছিল জাসদ। শেখ মুজিব সরকারের উচ্ছেদই ছিল জাসদের আন্দোলনের মূল লক্ষ্য। জাসদের রয়েছে ব্যাপক গণসমর্থন। মোশতাক ভাবেন মুজিববিহীন এই নতুন পরিস্থিতিতে জাসদের খুশি হবার কথা। তিনি যদি জাসদকে তার সঙ্গে পান তবে শুরুতেই তার একটি বড় রাজনৈতিক ভিত্তি হয়ে যায়। তাতে এই নতুন পরিস্থিতি সামাল দেওয়া তার জন্য অনেক সহজ হয়ে যায়। সে সময় দ্রুত বিকাশমান গণবাহিনী আর বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার অধিনায়কত্বের সুবাদে তাহের তখন জাসদের অন্যতম প্রধান নেতৃত্বের আসনে। ইতিহাসের মোড় ঘুরার ঐ ঊষালগ্নেই মোশতাক তাই প্রথম স্মরণ করেন তাহেরকে।
মোস্তাক তাহেরকে বলে : আমরা নতুন একটা গভর্নমেন্ট ফর্ম করতে যাচ্ছি। আপনাকে আমরা এই গভর্নমেন্টে চাই।
রশীদ বলে : স্যার আপনি আমাদের সাথে থাকলে আর কোনো প্রবলেমই থাকে না।
তাহের উদ্দীন ঠাকুর তার পুরনো অভিভাবকসুলভ কণ্ঠে বলে : যা হবার হয়ে গেছে। এখন তুমি এসে কন্ট্রিবিউট করো টু টেক দি নেশন ফরোয়ার্ড।
তাহের চুপচাপ শোনেন সবার কথা। তার চোয়াল শক্ত হয়ে আসে। তারপর ক্ৰাচটি হাতে নিয়ে উঠে পড়েন তিনি চেয়ার থেকে। তিনজনের দিকে চোখ বুলিয়ে বলেন : নো ওয়ে। আমি আপনাদের সাথে থাকতে পারি না। দিস ইজ নট দি গভর্নমেন্ট উই ওয়ান্টেড। নো কোশ্চেন। আপনারা শেখ মুজিবকে হত্যা করে উৎখাত করেছেন কিন্তু আপনাদের সে রাইট নাই। জনগণ মুজিবকে নির্বাচিত করেছে, জনগণেরই অধিকার আছে তাকে উৎখাত করার। বাট ইট ইজ টু লেট নাউ। এখন অ্যাজ সুন অ্যাজ পসিবল একটা জেনারেল ইলেকশন দেন এবং সব পার্টির অংশগ্রহণ এনশিওর করেন। আর কোনো কন্সপিরেন্সি করবার চেষ্টা করবেন না।
এই বলে ক্রাচে ঠক ঠক শব্দ তুঙ্গে বেরিয়ে যান তাহের। ইনু আর আনোয়ারকে নিয়ে উঠে বসেন জীপে। যেতে যেতে বলেন : একটা ভেঞ্জারাস গেম শুরু হয়েছে। এখানে আমাদের এক মুহূর্তও থাকা ঠিক না। এই মোশতাক, চাষী, ঠাকুর মিলে সেভেন্টি ওয়ানে আমেরিকার সাথে মিলে পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশন করার চেষ্টা করেছিল। ওরা তিনটা মিলেছে আবার। একটা ডিপ কন্সপিরেন্সি হচ্ছে। আমি মোশতাককে বলেছি ইমিডিয়েটলি ইলেকশন দিতে। কিন্তু এ লোক তো ধুরন্ধর, মনে হয় না দেবে।
ইনু : শুনলাম মুজিবের পুরো ফ্যামিলিকে মেরে ফেলা হয়েছে।
তাহের : দিস ইজ আনএকসেপ্টবল। আমাদের একটা কিছু করা দরকার। চলো আগে ইউসুফ ভাইয়ের ওখানে যাই।
জীপ রওনা দেয় আবু ইউসুফের এলিফ্যান্ট রোডের বাসার দিকে।
৭৭. বাংলাদেশ জিন্দাবাদ
তাহের চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর তিন বাহিনীর প্রধান রেডিও স্টেশনে আসেন। ফারুক রশীদের ট্যাঙ্ক আর আটিলারি সৈন্য ঘেরাও করে রেখেছে রেডিও স্টেশন, চারদিকে অস্ত্রের আওয়াজ। মোশতাক তিন প্রধানকে স্বাগত জানান। তাদেরকে বলা হয় মোস্তাকের কাছে আনুগত্য প্রকাশ করতে।
তিন প্রধান সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পরিস্থিতিকে অনুসরণ করতে থাকেন। তারা এক এক করে ফারুক রশীদ মনোনীত রাষ্ট্রপতি মোশতাকের কাছে আনুগত্য প্রকাশ করেন। তাদের আনুগত্য প্রকাশের বক্তব্য রেকর্ড করা হয় সে বক্তব্য প্রচারিত হয় রেডিওতে। দেশজুড়ে যে নিরালম্ব একটা অনিশ্চয়তা ঝুলছিল, বাহিনী প্রধানদের আত্মসমর্পণের মাধ্যমে তার অবসান হয়। লোকে বোঝে দেশ এখন পুরোপুরি মোশতাক এবং তার সহযোগীদের দখলে।
মোস্তাক একটি পতাকাবাহী গাড়িতে রেডিও স্টেশন থেকে বের হন। আগে পিছে দুটি করে চারটি ট্যাঙ্ক, কয়েকটি সামরিক ট্রাক, জীপ, অনেকগুলো প্রাইভেট কার নিয়ে রেডিও স্টেশন থেকে প্রেসক্লাবের সামনে দিয়ে মোশতাক চলে যান বঙ্গভবনে। সেখানে রাষ্ট্রপতি হিসেবে আনুষ্ঠানিক শপথ গ্রহণ করেন তিনি। সেদিন শুক্রবার বঙ্গভবনেই জুম্মা নামাজ আদায় করেন মোশতাক।
সন্ধ্যায় তিনি জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন :
প্রিয় দেশবাসী ভাই ও বোনেরা, এক ঐতিহাসিক প্রয়োজনে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের সত্যিকার ও সঠিক আকাঙক্ষাকে বাস্তবে রূপদানের পুত দায়িত্ব সামগ্রিক এবং সমষ্টিগতভাবে সম্পাদনের জন্য পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা ও বাংলাদেশের গণমানুষের দোয়ার ওপর ভরসা করে রাষ্ট্রপতি হিসেবে সরকারের দায়িত্ব আমার উপর অর্পিত হয়েছে। …
অভ্যুত্থানকারী মেজরদের তিনি সূর্য সন্তান আখ্যায়িত করেন। যে কোনো বক্তৃতার শেষে এ যাবত ব্যবহৃত জয় বাংলার পরিবর্তে তিনি বললেন, বাংলাদেশ জিন্দাবাদ।
স্বাধীনতার পর এই প্রথম মানুষ কোনো রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে জয় বাংলার বদলে বাংলাদেশ জিন্দাবাদ শুনল। বোঝা গেল দিন বদলে গেছে।
এদিকে যখন এতকিছু ঘটছে শেখ মুজিবের লাশ তখনও পড়ে আছে তার ৩২ নম্বরের বাড়ির সিঁড়িতে।
৭৮. মোমের আলোয় লাশ
ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের স্টেশন কমান্ডার কর্নেল হামিদকে দায়িত্ব দেওয়া হয় শেখ মুজিবের বাসা থেকে সব লাশ নিয়ে রাতের মধ্যেই দাফনের ব্যবস্থা করতে। তাকে নির্দেশ দেওয়া হয় শুধু শেখ মুজিব ছাড়া বাকি সবাইকে বনানী গোরস্তানে দাফন করার। ইতোমধ্যে সিপাইরা বৈঠক ঘরের টেলিফোনের পাশ থেকে শেখ কামাল, সিঁড়ির উপর থেকে শেখ মুজিব, করিডোর থেকে বেগম ফজিলাতুন্নেসা, শোবার ঘরের মেঝে থেকে শেখ জামাল এবং কামালের স্ত্রী, শেখ রাসেল, টয়লেট থেকে শেখ নাসেরের লাশ নিয়ে এক এক করে ভরেছেন কফিনে। রাতের অন্ধকারে কর্নেল হামিদ এসে পৌঁছান ৩২ নম্বরের বাড়িতে।
সব কফিন ট্রাকে উঠিয়ে একটি কফিন আলাদা করে রেখে দেওয়া হয় গাড়ি বারান্দায়। কর্তব্যরত সুবেদার কর্নেল হামিদকে জানান :এটি শেখ সাহেবের লাশ স্যার।
সিদ্ধান্ত অনুযায়ী দাফনের জন্য ট্রাকের কফিনগুলো যাবে বনানী কবরস্থানে আর শেখ মুজিবের কফিন হেলিকপ্টারে যাবে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায়। শেষ বারের মতো শেখ মুজিবের মুখটি একবার দেখবার ইচ্ছে হয় কর্নেল হামিদের। তিনি সুবেদারকে বলেন : কফিনটা খোলেন তো একবার।
হাতুড়ি বাটাল দিয়ে কফিনটিকে খোলা হয়। কর্নেল হামিদ চমকে উঠে দেখেন লাশটি শেখ মুজিবের নয়, তাঁর ভাই শেখ নাসেরের। দুজনের চেহারায় বিস্তর মিল। ভুল করে ফেলেছে সিপাইরা। ক্ষিপ্ত হন কর্নেল হামিদ। কিন্তু কোথায় শেখ মুজিবের লাশ? ট্রাকের উপর রাখা সারি সারি বাধা কফিনের কোনো একটিতে নিশ্চয়? তখন মাঝরাত। ট্রাকের উপর অন্ধকার। দেশলাইয়ের কাঠি জ্বালিয়ে এক এক করে সব কফিনের ঢাকনা খুলে চিনে নেওয়ার চেষ্টা করেন কর্নেল হামিদ। একটির ঢাকনা খুলতেই বরফের স্তূপের ভেতর থেকে দেশলাইয়ের আধো আলোয় দেখা যায় শেখ মুজিবের হিম শীতল পরিচিত মুখ।
বাংলাদেশের ব্যাপারে একধরনের অধিকারসুলভ ভালোবাসা ছিল এই মানুষটির। এ ধরনের ভালোবাসা বিপজ্জনক। তিনি তার প্রমাণ রেখেছেন। বাংলাদেশের আকাশে এই আশ্চর্য নক্ষত্রটির উত্থান এবং পতনের গাঁথা একদিন রচিত হবে নিশ্চয়।
পেরেক ঠুকে কফিনটি বন্ধ করা হয় আবার। ট্রাক থেকে নামিয়ে রাখা হয় গাড়ি বারান্দায়। একটা উদ্ভট ঐতিহাসিক ভুল শুধরে নেওয়া হয় এই ফাঁকে।
৭৯. একটি সভা
বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিব নিহত হওয়াতে সারাদেশের মানুষ অপ্রস্তুত। এ মৃত্যু সংবাদে না শোক, না প্রতিবাদ, না আনন্দ, এক নিরালম্ব বোধে তাড়িত হয়ে হতবিহ্বল পুরো জাতি। ভবিষ্যত নিয়ে এক অজানা উৎকণ্ঠা চারদিকে। কারও কাছে ঠিক পুরোপুরি স্পষ্ট হয়ে উঠছে না ঘটনা। যাবতীয় ঘটনা কেন্দ্রীভূত হয়েছে ক্যান্টনমেন্টে। এমনকি ক্যান্টনমেন্টের সেনা অফিসারদের কাছেও সবকিছু অস্পষ্ট, ঝাপসা।
এসময় সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল শফিউল্লাহ সেনা সদরে একটি মিটিং ডাকেন সব সিনিয়র আর্মি অফিসারদের নিয়ে। সেখানে উপস্থিত অভ্যুত্থানের মূল হোতা মেজর ফারুক এবং রশীদ।
শফিউল্লাহ বললেন, প্রেসিডেন্ট মোশতাকের নির্দেশে কারুক এবং রশীদ এখন সিনিয়র অফিসারদের অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপট বর্ণনা করবেন।
শেখ মুজিবের দুঃশাসনের প্রেক্ষাপটে কি করে তারা এই অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা করেছেন মেজর রশীদ তা ব্যাখ্যা করতে শুরু করেন। রশীদ দাবি করেন অভ্যুত্থানের আগে সেনাবাহিনীর সিনিয়র অফিসারদের সঙ্গে এ ব্যাপারে আলাপ করেছেন। সবাই চুপচাপ শুনছিলেন রশীদের বক্তব্য।
হঠাৎ ক্ষেপে যান ৪৬ ব্রিগেড কমান্ডার শাফায়াত জামিল। তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে বলেন : ইউ আর অল লায়ার্স, মিউটিনার্স অ্যান্ড ডেজার্টার্স। তোমরা সব খুনি। তোমাদের মোশতাক একটা ষড়যন্ত্রকারী। সে তোমাদের প্রেসিডেন্ট হতে পারে কিন্তু জেনে রেখ আমি সুযোগ পেলেই তাকে শেষ করে দেব। আর তোমরা যা করেছ এজন্য তোমাদের সবার বিচার হবে।
থেমে যান রশীদ। সবাই উৎকন্ঠার সঙ্গে একে অন্যের দিকে তাকান। তাকান অভ্যুত্থানকারী দুই মেজরের দিকে। তারা কি আবার কোনো বিভীষিকার জন্ম দেবে? একটা অস্বাভাবিক পরিবেশের জন্ম হয়। সভা ভেঙ্গে দেন শফিউল্লাহ।
৮০. উল্টো স্রোত
বঙ্গভবনে বসেছেন নতুন প্রেসিডেন্ট খন্দকার মোশতাক। ভবনের বাইরে ভারী কামান, ট্যাঙ্ক। ভবনের ভেতর তাঁকে ঘিরে আছেন অভূত্থানকারী সশস্ত্র আর্মি অফিসাররা। অস্ত্রের ঝনঝনানির বেস্টনীর ভেতর তিনি শুরু করেছেন নতুন সরকার। অস্ত্রই খন্দকার মোশতাকের প্রধান শক্তি তখন।
বাতাসে তখনও অনিশ্চয়তা, ভয়, উদ্বিগ্নতার আভাস। খন্দকার মোশতাক টের পান যত দ্রুত সম্ভব নিজের অবস্থানকে তার নিরাপদ করা প্রয়োজন। মোশতাক প্রথমেই শেখ মুজিব নির্বাচিত সেনাপ্রধান শফিউল্লাহকে সরিয়ে ফেলেন, তাকে পাঠিয়ে দেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। নতুন সেনাপ্রধান হিসেবে তিনি নির্বাচিত করেন জেনারেল জিয়াকে। জিয়া পেশাদার অফিসার, শেখ মুজিবের মৃত্যুতে যার বিন্দুমাত্র ভাবান্তর ঘটেনি, প্রতিদিনের মতো ক্লিন শেভড়, কেতাদুরস্তভাবে এসেছেন অফিস করতে। উপ সেনাপ্রধান থেকে সেনাপ্রধান হলেন তিনি। মূল মঞ্চে এক ধাপ অগ্রসর হলেন জেনারেল জিয়া। স্বল্পবাক জিয়া কিন্তু এই পদোন্নতির চিঠি হাতে পেয়ে তাকে সহসা খুবই উহ্ল হতে দেখা যায়। যেন অভিমানী বালক হাতে পেয়েছেন শখের লাঠি লজেন্স। পদোন্নতির চিঠিটা হাতে পেয়ে জিয়া তার ব্যাচমেট এবং বন্ধু কর্নেল হামিদকে তার রুমে ডেকে পাঠান। কর্নেল হামিদ তখনও জানেন না সে খবর। হামিদ তার ঘরে ঢুকতে গেলে দুষ্টুমি ভরা মৃদু মৃদু হাসিমুখ নিয়ে জেনারেল জিয়া বলেন, স্যালুট প্রপারলি ইউ গুফি। ইউ আর এস্টারিং চিফ অব স্টাফস অফিস।
কিন্ত খন্দকার মোশতাক ঝানু রাজনীতিবিদ। তিনি জিয়াকেও নিয়ন্ত্রণের ভেতর রাখেন। তিনি সেনাপ্রধানেরও উপরে দুটো নতুন পদ সৃষ্টি করেন। একটি পদ চিফ অব ডিফেন্স স্টাফের, যে পদে তিনি বসান তার আস্থাভাজন মেজর জেনারেল খলিলুর রহমানকে। অন্য পদটি মিলিটারি সেক্রেটারির, সে পদে বসান অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল ওসমানীকে। মোশতাক শেখ মুজিবের আরেকজন আস্থাভাজন বিমান বাহিনীপ্রধান এ কে খন্দকারকেও সেনাবাহিনী থেকে সরিয়ে পাঠিয়ে দেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। তার জায়গায় আনেন এম এ জি তোয়াবকে। ভদ্রলোক একসময় বিমান বাহিনীতে ছিলেন। ছিলেন গ্রুপ ক্যাপ্টেন। অবসর নিয়ে ব্যবসা করছিলেন জার্মানিতে। মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারে কোনো আগ্রহ ছিল না তার। যুদ্ধে যোগ দিতে বলা হয়েছিল তাকে, অস্বীকার করেছিলেন তিনি। জার্মানি থেকে তাকে অনেকটা ধরে এনে এয়ার ভাইস মার্শাল পদে উন্নীত করে দেওয়া হয় বিমান বাহিনী প্রধানের দায়িত্ব। মোশতাক ন্যাশনাল সিকিউরিটি ইন্টেলিজেন্সের মহাপরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেন এ বি এস সফদারকে। সফদার সেইসব বাঙালি কথিত ভাগ্যবান পুলিশ অফিসারদের অন্যতম যাকে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান আমেরিকার ইন্টারন্যাশনাল পুলিশ একাডেমী, আইপিএতে পাঠিয়েছিলেন প্রশিক্ষণের জন্য। যে একাডেমীটি আমেরিকা প্রতিষ্ঠিত করেছিল বিশ্বব্যাপী কমিউনিস্ট দমনের মহাপরিকল্পনার অংশ হিসেবে। মোশতাক রক্ষীবাহিনীও বিলুপ্ত করে তাদের সেনাবাহিনীতে আত্তীকরণ করার নির্দেশ দেন।
পুরস্কৃত করা হয় অভ্যুত্থানের নায়কদেরও। মেজর ফারুক ও রশীদকে তাদের কৃতকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ উন্নীত করা হয় লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদে। বহিস্কৃত মেজর ডালিমকে সেনাবাহিনীতে পুনর্বহাল করা হয়। তাকেও দেওয়া হয় লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদ।
সর্বপরি খন্দকার মোশতাক যিনি একজন বেসামরিক রাজনীতিবিদ স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো জারি করেন সামরিক শাসন। সেই সঙ্গে তিনি এই মর্মেও ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করেন যে, ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের কোনো বিচার করা চলবে না এবং এর জন্য কোনো শাস্তিও দেওয়া যাবে না।
বিশ্বস্ত কর্নেল, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, পুলিশ আর সেইসঙ্গে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশের প্রাচীর দিয়ে খন্দকার মোশতাক নিজের জন্য গড়ে তোলেন দুর্গ।
আওয়ামী লীগে তার পুরনো সতীর্থদের অধিকাংশই নতুন পরিস্থিতির হতবিহ্বলতায়, অস্ত্রের ভয়ে কিংবা সুযোগের সন্ধানে আনুগত্য দেখান তার প্রতি। যারা তার সঙ্গে আসতে অস্বীকার করেন তাদের সবাইকে মোশতাক ঠেলে দেন জেলে। তাঁদের মধ্যে অন্যতম শেখ মুজিবের চার সহযোগী সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, মনসুর আলী এবং কামরুজ্জামান।
এরপর তিনি শুরু করবেন তার স্বপ্নের ছোট পাকিস্তান, বাঙালিদের পাকিস্তান গড়ার যাত্রা। ঘর সামলেছেন তিনি, এবার তার দরকার বাইরের সুনজর। সপ্তাহ না যেতেই এক কাপ চা হাতে নিয়ে হাসি হাসি মুখে মোশতাক বঙ্গভবনের সবাইকে জানান যে তাকে অভিনন্দন এবং স্বীকৃতি জানিয়েছে আমেরিকা, সৌদি আরব এবং চীন। তিনটি দেশ যারা সরাসরি বিরোধিতা করেছিল মুক্তিযুদ্ধের। যারা স্পষ্ট চেয়েছিল পাকিস্তান থাকুক অটুট। পর পরই আসে পাকিস্তানেরও অভিনন্দন।
শুভেচ্ছার বাণী আর পণ্য নিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম পাকিস্তানি জাহাজ সফিনা এ ইসলাম ভেড়ে চট্টগ্রাম বন্দরে। ঈদ উপলক্ষে সৌদি আরব থেকে আসে রাশি রাশি খোরমা।
ধীরে ধীরে উল্টো দিকে ঘুরতে শুরু করে ইতিহাসের চাকা।
৮১. মোড় ফেরাবার উদ্যোগ
সেনাবাহিনীতে যে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছিলেন তাহের, তাতে তিনি লিখেছিলেন যে, এক ভয়ঙ্কর বিপদ নেমে আসছে বাংলাদেশের মানুষের ওপর। একটা বিপদের আশঙ্কা তাহের করছিলেন অনেকদিন থেকেই। ১৫ আগস্ট ভোর বেলায় খবর পেয়েই তাহের ছুটে গেছেন বিপদের সত্যিকার চেহারাটি দেখতে। স্পষ্ট বুঝেছেন, যে বিপদের ভয় তিনি করছিলেন সেটিই অবশেষে স্বমূর্তিতে উপস্থিত।
জাসদের নেতৃবৃন্দ মিটিংয়ে বসেন পরিস্থিতি পর্যালোচনা করতে। যথারীতি মিটিং বসেছে আবু ইউসুফের এলিফ্যান্ট রোডের বাসায়। জাসদের যাবতীয় সংগ্রাম ছিল শেখ মুজিব এবং আওয়ামী লীগকে ঘিরে। নিয়মতান্ত্রিকভাবে সংগ্রাম করছিলেন তারা। শ্রমিক, কৃষক, ছাত্র, জনতা এবং সৈনিকদের সমন্বয়ে আওয়ামী লীগের শাসনের বিরুদ্ধে একটি গণজাগরণ সৃষ্টি করবার চেষ্টা করছিলেন। হিসেব করেছিলেন ছিয়াত্তরের শেষ নাগাদ পটপরিবর্তনের। কিন্তু আকস্মিকভাবে শেখ মুজিবের এই মৃত্যুতে তাদের হিসাব এলোমেলো হয়ে গেছে।
তাহের বলেন : আমরা একটা চেঞ্জ চাচ্ছিলাম কিন্তু তা এমন ষড়যন্ত্রের মধ্য দিয়ে তো না। খন্দকার মোশতাকের এই টেকওভার আমরা কোনোভাবেই এক্সেপ্ট করতে পারি না।
সিরাজুল আলম খান বলেন : আমাদের লক্ষ করতে হবে নতুন এই ক্ষমতা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ কিন্তু রুশ-ভারতের বলয় থেকে এখন গিয়ে ঢুকছে পাক-মার্কিন বলয়ে। যেটা আগের চেয়েও ক্ষতিকর।
ড. আখলাক বলেন : বাকশালের বিরোধিতা আমরা করেছি ঠিক কিন্তু বাকশালের বিকল্প তো মার্শাল ল না।
একই রকম মন্তব্য করেন উপস্থিত অন্য নেতারাও। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে ঠিক কি হবে তাদের পদক্ষেপ এই নিয়ে খানিকটা বিভ্রান্তিতে পড়েন তারা।
সিরাজুল আলম খান বলেন : আমি মনে করি আমাদের আন্দোলন যে পথে চলছিল সে পথেই চলবে, শুধু প্রতিপক্ষ বদলাবে।
তাহের : এগজাক্টলি! আমরা যে সোসালিস্ট এজেন্ডা নিয়ে আর্মস স্ট্রাগলের দিকে যাচ্ছিলাম, মোশতাকের এই প্রো-আমেরিকান গভর্নমেন্টের সময় সেটা তো আরও জাস্টিফাইড। আপনাদের তো বলেছি যে, সেদিন সকালেই মোশতাক আমাকে দলে ভেড়াতে চেয়েছিল। সে ভেবেছিল আমরা যেহেতু অ্যান্টি মুজিব ফলে আমরা তার সঙ্গে গিয়ে ভিড়ব। আর জাসদকে সাথে পেলে তো তাদের একটা বিরাট সিভিল বেজ হয়ে যায়। এনি ওয়ে সআমি আউটরাইট রিজেক্ট করে দিয়েছি।
ড. আখলাক : এখন পুরো পলিটিক্স তো কনসেন্ট্রেটেড হয়েছে ক্যান্টনমেন্টে। কর্নেল তাহের, ক্যান্টনমেন্ট তো আপনার চেনা জায়গা। এখন আপনার রোল আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
ক্রাচটা দেয়ালে হেলান দিয়ে কোণার এক চেয়ারে বসেছেন তাহের। চোয়াল শক্ত হয়ে আছে তার। বলেনঃ বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার মাধ্যমে আমি তো অলরেডি ক্যান্টনমেন্টে কাজ শুরু করেছি। গণবাহিনীর একটিভিটি বাড়িয়ে দিলেও এখন ফোকাস করতে হবে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থাকেই। আসলে ক্যান্টনমেন্টের শুধুমাত্র বেঙ্গল ল্যান্সার আর টু ফিল্ড আর্টিলারি এই দুই ইউনিট শুধু ক্যুটা ঘটিয়েছে। ক্যান্টনমেন্টে আরও অনেক ইউনিট আছে লগ এরিয়া, সিগনাল, সাপ্লাই, ইঞ্জিনিয়ারিং এরা কেউ কিন্তু এই কু্যর সাথে নাই। মোশতাক অফিসারদের যতই তার চারপাশে ভেড়াক না কেন, সোলজারদের সে তার সাথে পাবে না। বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা তো দূরের কথা, সাধারণ কোনো মুক্তিযোদ্ধা জোয়ান তার সঙ্গে ভিড়বে না।
ইনু : কিন্তু ফারুক রশীদের ইউনিটের সোলজাররা তাদের নির্দেশেই চলছে।
তাহের : সেটা ঠিক, কিন্তু তারা মাইনরিটি। ক্যান্টনমেন্ট কিন্তু এখন দুইভাগে বিভক্ত। একদিকে যারা সরাসরি কুর সাথে ছিল আর অন্যদিকে যারা ছিল না। আর যারা এর সঙ্গে জড়িত ছিল না তারা কিন্তু বেশ ভয়ে আছে।
সিরাজুল আলম খান এই যে আমি ডিভাইডেড হয়ে আছে এর সুযোগটা কিন্তু আমাদের নিতে হবে।
ডা. আখলাক : মোশতাক কামান আর ট্যাঙ্কের উপর দাঁড়িয়ে দেশ শাসন করতে চাচ্ছে। সেটা তো এত সোজা হবে না।
তাহের : আমি মনে করি, বিপ্লবী সৈনিক সংস্থাকে মূল অ্যাকশনে নিয়ে আসতে হবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। মোশতাক তো জেনেছে যে আমরা তার সাথে নাই! দ্রুত অ্যাকশন শুরু না করলে এই গভর্নমেন্ট আমাদের নিশ্চিহ্ন করার ষড়যন্ত্রে নামবে। ইন্দোনেশিয়ায় যেমন কমিউনিস্ট জেনোসাইড ঘটানো হয়েছে।
শেখ মুজিবের মৃত্যুর আগেই জাসদ সশস্ত্র অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা করলে দলের ভেতর তাহেরের গুরুত্ব বেড়ে যায়। ঘটনার পটপরিবর্তনে রাজনীতি ক্যান্টনমেন্টকেন্দ্রিক হয়ে উঠলে দল আরও বেশি নির্ভরশীল হয়ে ওঠে তাহেরের ওপর। তাহেরের ভূমিকা হয়ে ওঠে মুখ্য।
তাহের ইনুকে সঙ্গে নিয়ে বাড়িয়ে দেন বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার কাজের গতি।
যেহেতু তারা ক্যু ঘটিয়েছে সেহেতু ক্যান্টনমেন্টে বেঙ্গল ল্যান্সার আর টু ফিল্ড আর্টিলারির সৈনিকদের দাপট। বাকি ইউনিটের সৈন্যরা সন্ত্রস্ত কখন তাদের ওপর কোন বিপদ নেমে আসে এই ভয়ে। ফলে অনেকটা নিরাপত্তার স্বার্থে, একধরনের আশ্রয়ের আশায় অনেক সিপাই তখন যোগ দিতে থাকে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থায়। শক্তি বাড়তে থাকে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার।
রাতে লুৎফা জিজ্ঞাসা করেন তাহেরকেঃ কি করতে চাচ্ছ তোমরা এই বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার মধ্য দিয়ে?
তাহের : মোশতাকের কাছ থেকে পাওয়ার সেন্টারটা সরাতে হবে। আমরাই পাওয়ার নিয়ে নিতে পারি। জেনারেল জিয়া চিফ হওয়াতেও আমাদের সুবিধা হয়েছে।
লুৎফা : কিন্তু মোশতাকই তো জিয়াকে চিফ বানিয়েছেন?
তাহের : তাতে কি? এখন জিয়া মোশতাকের সঙ্গে আছেন ঠিকই, আমরা কিছু একটা করতে পারলে উনি আমাদের সঙ্গেই চলে আসবেন। তার চিফ হওয়ার স্বপ্ন ছিল, সেটা পূরণ হয়েছে কিন্তু উনি খুব ভালো মতোই জানেন যে, ব্যাপারটা কোনো স্বাভাবিক পরিস্থিতির মধ্যে হয়নি। উনি তো বুদ্ধিমান মানুষ, ভালো মতোই জানেন ঘটনা কখন কোন দিকে মোড় নেয় সেটা বলা যায় না।
তাহের এবং ইনুর সঙ্গে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার যোগাযোগ বেড়ে যায় বহু মাত্রায়। গোপনে গাণিতিকহারে বাড়তে থাকে সৈনিক সংস্থার সদস্য সংখ্যা।
তাহের সৈনিকদের বলেন : দেশের ভেতর একটা গভীর ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে, আমাদের অ্যাকশনে যেতে হতে পারে, তোমরা প্রস্তুত থাকবে।
অক্টোবর মাসের শুরুতে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা ক্যান্টনমেন্টে একটি লিফলেট বিলি করে। খন্দকার মোশতাকের প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে সৈনিকদের সতর্ক থাকতে বলা হয় সে লিফলেটে।
তাহের সেদিন অফিস থেকে ফিরে লুক্তাকে বলেন : জানো আজকে জেনারেল জিয়া ফোন করেছিলেন।
লুৎফা : কি বললেন?
তাহের : বললেন তাহের, তোমার লোকেরা আমার টেবিলেও লিফলেট রেখে গেছে।
লুৎফা : তারপর? রেগে গেলেন নাকি?
তাহের : আরে না। উনি তো সবসময় কম কথা বলেন। আমাকে আর করলেন যে আমাদের কাজকর্মের ব্যাপারে উনি আওয়ার আছেন। আর আমি যে ব্যাপারটা লিড করছি সেটাও তিনি বুঝতে পারছেন। এটা আমাদের জন্য ভালো। তার সাথে যোগাযোগ থাকাটা দরকার। সময়মতো আমাদের কাজে লাগবে।
লুৎফা : আমার কিন্তু কেমন ভয় হচ্ছে।
তাহের : পরিস্থিতির একটা ড্রামাটিক টার্ন নিতে পারে যে কোনো সময়। তুমি প্রিপেয়ার্ড থেকো। আমাকে আরও ঘন ঘন ঢাকায় যেতে হবে।
৮২. একটি টুপি
খন্দকার মোশতাক সরকারের মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠক। ইতিহাসের এক নাটকীয় পটপরিবর্তনের পর দেশের প্রথম নীতি নির্ধারণী বৈঠক। সে বৈঠকের আশ্চর্য এক আলোচ্য বিষয়, টুপি। বৈঠকে সভাপতিত্ব করছেন খন্দকার মোশতাক, টেবিলের চারপাশে নয়া মন্ত্রিপরিষদের সদস্যবৃন্দ। মোশতাক হঠাৎ তার মাথার টুপিটি খুলে টেবিলের উপর রাখেন। তারপর বলেন : আমাদের জাতীয় পোশাক আছে তবে পোশাকটা কমপ্লিত না। আমাদের মাথায় কোনো টুপি নাই। এই টুপিটা যদি এপ্রুভ করেন তাহলে এই টুপি আমাদের ন্যাশনাল ড্রেসের পার্ট হয়ে যায়।
টেবিলের উপর একটি কালো টুপি, তার দিকে তাকিয়ে আছেন দেশের তাবৎ রাজনীতিবিদরা। কেউ তেমন কোনো মন্তব্য করছেন না।
শেখ মুজিব সরকারের শেষ অর্থমন্ত্রী এ আর মল্লিকও আছেন ঐ মিটিংয়ে। তাকে এক রকম জোর করে ধরে আনা হয়েছে সভায়। তার চোখে ভেসে ওঠে মাত্র মাসকয়েক আগে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা। ১৯৭৫-এর জানুয়ারি মাসে শেখ মুজিব গেছেন দিল্লি। এ আর মল্লিক তখন সেখানে বাংলাদেশের হাই কমিশনার। তার বাসায় ডিনারের দাওয়াত। খন্দকার মোশতাক সারাক্ষণ শেখ মুজিবের পাশে পাশে আছেন। এক পর্যায়ে শেখ মুজিব মল্লিককে বলেন, চলেন আপনার বাসাটা ঘুরে দেখি। মুজিব উঠলে সাথে সাথে মোশতাকও উঠেন। মুজিব ঘুরে এসে আবার বসেন। তারপর বলেন, চলেন আপনার লনটা দেখি। মোশতাকও চলেন পাশাপাশি। এক ফাঁকে মোশাকের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হলে শেখ মুজিব মল্লিককে বলেন : আপনার সঙ্গে কিছু কথা ছিল কিন্তু মোশতাক তো সঙ্গে সঙ্গে লেগে থাকছে।
মল্লিক বলেন : উনাকে বললেই তো হয়।
মুজিব : না, ইট ঢাজ নট লুক নাইস।
তারা আবার ঘরে ফিরে এসে বসলে শেখ মুজিব হঠাৎ শীর্ণ দেহের মোশতাকের মাথায় সর্বক্ষণ শোভা পাওয়া লম্বাটে টুপিটি মাথা থেকে খুলে নিয়ে টেবিলের উপর রাখেন। এ আর মল্লিককে উদ্দেশ্য করে বলেন : ড. সাহেব আপনি বিদ্বান মানুষ। এই টুপিটা সম্পর্কে আপনার মন্তব্য কি?
একটু ইতস্তত করেন এ আর মল্লিক। বলেন : এ টুপি মোশতাক ভাইকে মানায়। তার শরীরের গঠন, আকার উচ্চতা সব মিলিয়ে এ টুপি মোশতাক ভাইকে মানাবে। কিন্তু এই টুণি আপনাকে মানাবে না। আপনি শূম, বড় সড় মানুষ আপনি টুপি পরলে সেটা হতে হবে উঁচু, বড়। মুজিব মোশতাককে বলেন : শুনলেন তে বিদ্বান লোকের কথা?
খন্দকার মোশতাকের সেই টুপিটি তখন বৈঠকের টেবিলের উপর, যদিও অবশ্য শেখ মুজিব ঐ মুহূর্তে তার গুলিবিদ্ধ শরীর নিয়ে কবরে শায়িত। এ আর মল্লিক টুপিটিকে জাতীয় পোশাক করার ব্যাপারে আপত্তি করলেও বাকিরা সমর্থন করেন। টুপিটিকে জাতীয় পোশাকের অংশ করবার প্রস্তাব পাশ হয়ে যায়। টুপি বিষয়ক সিদ্ধান্তের পরই শেষ হয়ে যায় মন্ত্রী সভার প্রথম বৈঠক।
৮৩. পরাবাস্তব
দেশের একটা ঘোর ক্রান্তিকালে যখন একটি টুপি হয়ে ওঠে সবচেয়ে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তখন অবস্থাটি আর ঠিক বাস্তব থাকে না, কেমন যেন রহস্যময়, রূপকথার পরাবাস্তব এক জগতে পরিণত হয়।
ধানমন্ডি বত্রিশ নম্বরের যে বাড়িটি সরগরম ছিল অহর্নিশ, সেখানে একটি নিঃসঙ্গ হুলো বিড়াল শব্দহীন পায়ে এঘর ওঘর করে। গ্রামের মুদির দোকানের একটি সস্তা সাবান দিয়ে গোসল করিয়ে ইতোমধ্যে টুঙ্গিপাড়ায় কবর দেওয়া হয়েছে শেখ মুজিবকে। যে মানুষটির সভায় লোক সমাগম হয়েছিল দশ লক্ষ, তার জানাজায় দেখা যায় গোটা দশ ভীত সন্ত্রস্ত মানুষ।
ফারুক যিনি একজন মেজর, প্রেসিডেন্টের জন্য নির্ধারিত রাজহাঁসের মতো ধবধবে সাদা মার্সিডিজ বেঞ্চ গাড়িটি নিয়ে চারদিকে ঘোরেন, সৈনিকদের নির্দেশ দেন। মেজর জেনারেল, ব্রিগেডিয়ার প্রমুখেরা নোকা বোকা চোখে তা দেখেন। সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমান বিশেষ একটি সানগ্লাস পরেন আজকাল। সানগ্লাসে ঢেকে রাখা যায় চোখের অপমান।
ভারতের সঙ্গে মৈত্রী চুক্তি করেছিলেন শেখ মুজিব। সেই সূত্র ধরে ভারত কি পাল্টা কোনো ব্যবস্থা নেবে? চাপা সেই উৎকণ্ঠাকে ম্লান করে দিয়ে একদিন ভারতীয় রাষ্ট্রদূত সমর সেন দেখা করেন মোশতাকের সঙ্গে। শেখ মুজিব যেখানে নেই কাকে নিয়ে আর বাজি ধরা যাবে?
কেবল কাউবয় টুপি পরা টাঙ্গাইলের যুদ্ধসম্রাট কাদের সিদ্দীকি গোপন আস্তানায় গিয়ে প্রতিরোধের প্রস্তুতি নেন। তাকে অবশ্য সেনাবাহিনীর সাঁড়াশী আক্রমণে ঝেটিয়ে বিদায় করা হয় ভারতে।
আওয়ামী লীগের বন্দি প্রধান চার নেতা তাজউদ্দীন, নজরুল ইসলাম, কামরুজ্জামান ও মনসুর আলী জেলের ভেতর নিজেদের ভয়, গ্লানি তাড়াবার জন্য ফুলের বাগান করেন। এদেরকে মুক্ত করবার জন্য কোথাও কেউ কি গোপনে কোনো আয়োজন করছে?
রেড মাওলানা ভাসানী অভিনন্দন জানিয়েছেন মোশতাককে। তাকে সমর্থন করেছে চীনা বামপন্থী দলরাও।
কেবল বাগে আসছে না জাসদ। তারা দাঁড়িয়েছে পুরো পরিস্থিতির বিপক্ষে। সারাদেশে মোশতাক বিরোধী মিছিল করছে জাসদ। বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা তো বটেই, পাশাপাশি তারা গণবাহিনীকেও চাঙ্গা করে তুলছে। জাসদ কর্মীদের গ্রেফতারের ব্যাপারে বিশেষ নির্দেশ দেন মোশতাক। সারাদেশে গণহারে গ্রেফতার করা হতে থাকে হাজার হাজার জাসদ কর্মীদের।
মোশতাক ভালোভাবেই জানেন এ সবকিছুর পেছনে আছেন কর্নেল তাহের। নানাভাবে তাকে কাজে হেনস্থা করা শুরু হয়। একদিন তাহেরকে ডেকে পাঠান মোশতাক। বলেন ড্রেজার কোম্পানি নিয়ে অভিযোগ আছে। মুজিবের ছেলের বিয়েতে নাকি নৌ বিহারের জন্য ড্রেজার কোম্পানি থেকে জাহাজ দেওয়া হয়েছিল। এসব তদন্ত হবে।
তাহের ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেন প্রচণ্ড। বলেন : এজন্যই ডেকেছেন আমাকে? গো এহেড উইথ ইউর ইনভেস্টিগেশন। এসব করে আমাকে কাবু করতে পারবেন বলে ভেবে থাকলে ভুল করেছেন।
তারপর তাঁর হাতের লাঠিটি উঁচিয়ে মোশতকের দিকে তাক করে বলেন : বাই দা ওয়ে মুজিব মুজিব করবেন না, বলেন বঙ্গবন্ধু। বেঁচে থাকতে তো উঠতে বসতে বঙ্গবন্ধু বঙ্গবন্ধু করতেন।
ক্রাচে শব্দ করে বেরিয়ে যান তাহের।
বঙ্গভবনে পায়চারী করেন মোশতাক। স্বস্তি নেই তার মনে। ভাবেন দেশে অনেক অস্ত্রের ঝনঝনানি হলো, রক্তপাত হলো, এবার একটু আনন্দ ফুর্তি হোক। মোশতাক সরকার আয়োজন করলেন এক আন্তর্জাতিক ফুটবল টুর্নামেন্ট, আগা খান গোল্ড কাপ? নানা দেশ থেকে ফুটবল দল আসতে লাগল ঢাকায়।
তখন শীত আসছে বাংলাদেশে। হালকা ঠাণ্ডা হাওয়া চারদিকে। স্টেডিয়ামে যতই ফুটবল খেলা হোক না কেন সবার মনে একটা চাপা আতঙ্ক। পথে পথে আর্মি। মানুষের সতর্ক চলাচল। শীতের হাওয়ায় ঢাকার পথে উড়াউড়ি করে শুকনো পাতা।
৮৪. গুমোট চা চক্র
সেনাবাহিনীর রক্তপ্রবাহের মূল যে চালিকা শক্তি, চেইন অব কমান্ড, তার আর কোনো অস্তিত্ব নেই ক্যান্টনমেন্টে। কে সিনিয়র, কে জুনিয়র, কে কাকে নির্দেশ দিচ্ছে, তার আর কোনো নিশানা নেই কোনো দিকে। নানা দলে উপদলে বিভক্ত হয়ে আছে ক্যান্টনমেন্ট। মোশতাক প্রেসিডেন্ট হলেও প্রকারান্তরে দেশ চালাচ্ছে অভ্যুত্থানকারী মেজররা।
ভেতর ভেতর অফিসারদের মধ্যে জমছে প্রবল ক্ষোভ আর অসন্তোষ। ক্ষোভের কথা স্পষ্ট করে বলে উঠতে পারছেন না কেউ। ৩২ নম্বরের রক্ত ভয় পাইয়ে দিচ্ছে তাদের। কয়েকজন মেজর উদ্ধত বালকের মতো ছোটাছুটি করছে বটে কিন্তু তাদের সুতো নাড়াচ্ছে আরও দূরের, আরও শক্তিশালী কোনো শক্তি, সেটি টের পাচ্ছেন তারা। কোনো প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বিপদ ডেকে আনতে চাচ্ছেন না কেউ।
খন্দকার মোশতাক ক্যান্টনমেন্টের এই অস্বাভাবিক হাওয়া একটু হালকা করবার জন্য একটি চা চক্রের আয়োজন করেন। সিনিয়র অফিসাররা বললেন ফারুক এবং রশীদ যদি সেই চা চক্র থাকে তাহলে তারা সেখানে যাবেন না। মোশতাক সে চা চক্ৰ থেকে ফারুক এবং রশীদকে বাদ দিলেন। অফিসাররা এলেন চা চক্রে। খন্দকার মোশতাক খোশ মেজাজে, হল রুমের এ প্রান্তে সে প্রান্তে ঘুরে সবার সঙ্গে আলাপ করবার চেষ্টা করলেন কিন্তু সবাই গম্ভীর। কেউই মোশতাকের সঙ্গে বিশেষ কোনো কথা বললেন না। নিজেদের মধ্যেও কেউ কোনো আলাপ করলেন না তেমন। নিঃশব্দে চায়ের কাপ নিয়ে সবাই এ সোফায় সে সোফায় বসলেন, বিস্কুটে কামড় দিলেন এবং চায়ের কাপ শেষ করে দ্রুত উঠে গেলেন। ঐ চা চক্র পরিণত হলো অস্বাভাবিক প্রমোট এক সামাজিক অনুষ্ঠানে। যেন একটা বিস্ফোরণ ঘটবার আগের মুহূর্তের গাঢ় নিস্তব্ধতা।
৮৫. চেইন অব কমান্ড
একটি স্রোত ধারার মতো ইতিহাসের দীর্ঘ পথ পরিক্রমণ করে দেশটি যেদিকে ধাবিত হচ্ছিল, খন্দকার মোশতাক থামিয়ে দিয়েছেন সে স্রোত। তিনি বদলে ফেলতে চাইছেন সেই স্রোতের গতিপথ। জন্ম দিয়েছেন এক প্রমোট, উৎকেন্দ্রিক, নাটুকে পরিস্থিতির। তাহের এবং জাসদ যখন এই স্রোত উল্টে ফেলবার সুচারু রাজনৈতিক আয়োজন করছেন, তখন ক্যান্টনমেন্ট কেন্দ্রিক, বৃহত্তর কোনো রাজনৈতিক মাত্রা বিবর্জিত ভিন্ন আরেক উত্তেজনা অকস্মাৎ আরো একবার পাল্টে দেয় ঘটনার গতি।
ক্যান্টনমেন্টের দেয়ালে দেয়ালে তখন গুঞ্জন। নানা পাল্টা ষড়যন্ত্রের উদ্যোগ। ক্যান্টনমেন্টের ভেতর চেইন অব কমান্ড ভেঙ্গে পড়ায় অফিসারদের মধ্যে জমাট ক্ষোভের কথা যিনি প্রকাশ্যে অকপটে বলেছিলেন সেই ব্রিগেডিয়ার শাফায়াত জামিল সক্রিয় হয়ে ওঠেন এক পর্যায়ে। একদিন জেনারেল জিয়াকে গিয়ে শাফায়াত বলেন : স্যার, আপনি চিফ, আপনি অর্ডার করলে আই ক্যান ট্রাই টু রেস্টর চেইন অব কমান্ড বাই ফোর্স।
জিয়া আদিম সন্তের মতো এবারও উচ্চারণ করেন তার পুরনো মন্ত্র; লেট আস ওয়েট এ্যান্ড সি।
পদ বিন্যাসে মেজর জেনারেল জিয়ার পরেই রয়েছেন মেজর জেনারেল খালেদ মোশারফ। তিনি চিফ অব জেনারেল স্টাফ। মুক্তিযুদ্ধের কে ফোর্সের অধিনায়ক। শেখ মুজিবের মৃত্যুতে মর্মাহত হয়েছিলেন তিনি। রাতের পোশাকে, নিজেই গাড়ি চালিয়ে ভোর বেলা হাজির হয়েছিলেন অফিসে। এ মুহূর্তে তিনি মাঠের বাইরে দাঁড়ানো খেলোয়াড়। সেনাবাহিনীতে যেখানে সেনা প্রধানেরই কোনো ভূমিকা নেই সেখানে তিনি তো নেহাতই বাহুল্য। শাফায়েত জামিল কথা বলেন খালেদ মোশাররফের সঙ্গেও। তাকে উদ্বুদ্ধ করেন একটা কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য। খালেদ মোশাররফও ক্ষুব্ধ। তিনি একমত হন শাফায়াতের সঙ্গে। বলেন : উই মাস্ট ব্রিং দোজ মেজরস আর চেইন অব কমান্ড। উই ক্যানোট এলাও দিস টু গো অন লাইক দিস ফর এভার।
খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে পরিকল্পনায় বসেন দুজন। তারা সিদ্ধান্ত নেন যেহেতু সেনাবাহিনীর প্রধান হিসেবে জিয়াউর রহমান চেইন অব কমান্ড ফিরিয়ে আনতে ব্যর্থ হয়েছেন ফলে তাকে তারা বন্দি করবেন এবং তারপর মোশতাক এবং তার সহযোগীদের আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করবেন। এ নিয়ে গোপনে ক্যান্টনমেন্টের ভেতর নানাজনের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করেন তারা। অনেকেই এগিয়ে আসেন তাদের সহযোগিতা করবার প্রতিশ্রুতি নিয়ে। এগিয়ে আসেন রক্ষীবাহিনীর প্রধান কর্নেল নুরুজ্জামান। রক্ষীবাহিনী বিলুপ্ত হবার পর সেনাবাহিনীতে তিনি এবং রক্ষীবাহিনী সদস্যরা নেহাতই দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক। রক্ষীবাহিনী শেখ মুজিবের হত্যা প্রতিহত করতে পারেনি, এ ব্যর্থতার গ্লানি আছে নুরুজ্জামানের। আর পরাজিত দলের সদস্য হয়ে চোখের সামনে কনিষ্ঠ অফিসারদের ঔদ্ধত্য দেখতে তারও অসহ্য ঠেকছে। তিনি প্রতিশ্রুতি দেন তার রক্ষীবাহিনীর প্রাক্তন সদস্যদের নিয়ে খালেদ মোশাররফের পাশে দাঁড়াবেন। বেশ কজন জুনিয়র অফিসার এসে ভেড়ে তাদের সাথে; মোগ দেয় বিমান বাহিনীর কিছু অফিসারও। বঙ্গভবনের নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত মেজর ইকবালও আনুগত্য প্রকাশ করেন খালেদ এবং শাফায়াতের প্রতি। এছাড়া ক্যান্টনমেন্টে তাদের অধীনস্থ আর্টিলারি এবং ইনফেন্ট্রির সিপাইরা তো আছেনই।
ক্যান্টনমেন্টের ছায়ায় ছায়ায়, দেয়ালের আড়ালে আড়ালে তৈরি হয়ে যায়। দ্বিতীয় একটি অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা। তবে খালেদ মোশারফ স্পষ্ট বলেন। সবাইকে যে এই অ্যুশ্বান হবে সম্পূর্ণ রক্তপাতহীন, এর কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নেই, তার মূল লক্ষ হচ্ছে সেনাবাহিনীর ভেতর চেইন অব কমান্ড পুনপ্ৰতিষ্ঠা করা।
ইতিহাসের একটি নাটকীয়তার ঘোর না কাটতেই শুরু হয় আরেকটি নাটক।
৮৬. দেশের ভেতর দেশ
২ নভেম্বর ১৯৭৫, রাত। কনকনে শীত বাইরে। মেজর ইকবালের অধীনস্ত ১ বেঙ্গলের একটি কোম্পানি পাহারা দিচ্ছে বঙ্গভবন। ভেতরে অনেক রাত পর্যন্ত মিটিং করছেন খন্দকার মোশতাক, জেনারেল খলিল আর মেজর রশীদ। সেনাবাহিনীর ভেতরের অস্থিরতা নিয়েই কথা বলছিলেন তারা। সম্ভাব্য যেসব অফিসার সমস্যা তৈরি করতে পারেন তাদের কাউকে চাকরি থেকে অব্যাহতি, অন্যান্যদের বিভিন্ন জায়গায় বদলির কথাবার্তা হচ্ছিল। বঙ্গভবনের চারপাশে ফুলের বাগান। কিন্তু ফুল বাগান শোভিত নিরীহ ঐ ভবনটি তখন দেখাচ্ছিল মিলিটারি ক্যান্টনমেন্টের মতো। মাঝরাত পেরিয়ে গেলে বঙ্গভবন পাহারারত মেজর ইকবালের কোম্পানিটি হঠাৎ তাদের কামান, মেশিনগানসহ অন্ধকারে, অত্যন্ত চুপিসারে বঙ্গভবন ছেড়ে রওনা দেয় ক্যান্টনমেন্টের দিকে। ভেতরে মিটিংরত মোশতাক এবং তার সঙ্গীরা তখনও তা জানেন না।
এক পুলিশ হন্তদন্ত হয়ে মিটিংয়ে এসে বলেন : স্যার বঙ্গভবন থেকে আর্মির লোক সব চলে গেছে।
বিচলিত হয়ে পড়ে রশীদ। বাইরে গিয়ে দেখেন সত্যিই বঙ্গভবনের পাহারায় কেউ নেই। বঙ্গবন সম্পূর্ণ অরক্ষিত। এতক্ষণ কামান, মেশিনগানের যে নিরাপত্তাবেষ্টনীতে বসে তারা মিটিং করছিলেন সে বেষ্টনী এখন উধাও। টের পান, যে আশঙ্কা তারা করছিলেন তাই ঘটতে যাচ্ছে। একটা পাল্টা অভ্যুত্থানের সূচনা হয়েছে। সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন তারা। বঙ্গভবনেই ঘুমাচ্ছিলেন মেজর ফারুক। তাকে ডেকে তোলেন রশীদ। মোশতাক, খলিল, ফারুক, রশীদ দ্রুত জরুরি আলোচনায় বসে যান। সম্ভাব্য কারা এই অভ্যুত্থান ঘটাচ্ছে এবং তাদের করণীয় ঠিক করতে চেষ্টা করেন।
ফারুক দ্রুত বঙ্গভবনে, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এবং ক্যান্টনমেন্টে তার অধীনস্ত টাঙ্কগুলো সচল করে তোলেন। রশীদের অধীনস্ত কামানগুলোও তখন কিছু সোহরোয়ার্দী উদ্যানে কিছু ক্যান্টনমেন্টে। যার যার স্থানে আক্রমণাত্মক পজিশনে তৈরি থাকে তারা। খন্দকার মোশতাক তার সামরিক উপদেষ্টা ওসমানীকে সেই মুহূর্তে বঙ্গ ভবনে চলে আসতে অনুরোধ করেন। গভীর রাতে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে হঠাৎ এতগুলো ট্যাঙ্ক সচল হওয়ার শব্দে গাছে গাছে ঘুমিয়ে থাকা পাখিগুলোর ঘুম ভেঙ্গে যায়। খুব কিচির মিচির করতে থাকে তারা। তাদের তো বুঝবার কথা নয় ইতিহাসের চাকা ঘুরতে শুরু করেছে আবার।
মেজর ইকবালের নেতৃত্বে বঙ্গভবনের নিরাপত্তা প্রত্যাহারের মধ্য দিয়ে শুরু হয় পাল্টা অভ্যুত্থান। পাশপাশি তরুণ ক্যাপ্টেন হাফিজুল্লাহর নেতৃত্বে একটি দল যায় সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানকে বন্দি করতে। রাত একটায় ক্যাপ্টেন হাফিজুল্লাহ তার প্লাটুন নিয়ে ঘিরে ফেলেন জিয়ার বাড়ি। ঘটনার আকস্মিকতায় জিয়ার বাড়ির নিরাপত্তা রক্ষীরা আত্মসমর্পণ করেন। জিয়া বেরিয়ে আসেন তার ড্রয়িং রুমে, রাতের পায়জামা, পাঞ্জাবি পরা। হাফিজুল্লাহ বলেন : স্যার আপনি চিফ অব জেনারেল স্টাফ খালেদ মোশাররফের নির্দেশে বন্দি।
জিয়া কোনো উত্তেজনা দেখান না। কোন উচ্চবাচ্য করেন না। শান্ত কণ্ঠে বলেন, অল রাইট।
হাফিজুল্লাহর নির্দেশে তার দলের সিপাইরা ড্রইংরুমের টেলিফোনের লাইনটি বিচ্ছিন্ন করে দেয়। বেডরুম থেকে বেরিয়ে আসেন খালেদা জিয়া। হাফিজুল্লাহ তাকেও বলেন : ম্যাডাম আপনারা হাউজ এ্যারেস্ট। পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত কেউ ঘর থেকে বেরুতে পারবেন না। ভয়ে ঘুম থেকে উঠে যায় দুই ছেলে তারেক এবং আরাফাত। খালেদা তাদের সামলাতে যান। জিয়া বসে থকেন ড্রইং রুমের সোফায়। ড্রইংরুমের টেলিফোন লাইন বিচ্ছিন্ন করলেও হাফিজুল্লাহ ভুলে যান বেডরুমেও একটি টেলিফোন রয়েছে। তরুণ ক্যাপ্টেন জানেন না ঐ ভুলে যাওয়া টেলিফোনের তার দিয়েই ঘটনা অচিরেই মোড় নেবে আরেক নাটকীয় স্রোতে।
দুই তারিখ মধ্য রাত থেকে খালেদ মোশারফ ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসারের রুমে বসে অভ্যুখান পরিচালনা করছেন। তার সঙ্গে শাফায়াত জামিল। রাতের মধ্যেই রংপুর থেকে কর্নেল হুদা এসে যোগ দেন খালেদ মোশাররফের সঙ্গে। বগুড়া থেকে চলে আসে দশ বেঙ্গল। খালেদ মোশাররফের পক্ষলম্বনকারী বিমান বাহিনীর এক অফিসার কাকডাকা ভোরে একটি ফাইটার মিগ বিমান নিয়ে চক্কর দিতে থাকেন বঙ্গভবনের উপর দিয়ে। একজন একটি হেলিকপ্টার নিয়ে সশব্দে উড়তে থাকেন ক্যান্টনমেন্টের উপর। বঙ্গভবন এবং ক্যান্টনমেন্ট যেন দুটি পৃথক দেশ। দেশের ভেতর দেশ, যুদ্ধংদেহী রূপে দাঁড়িয়েছে পরস্পরের মুখোমুখি।
৮৭. টেলিফোন যুদ্ধ
অভ্যুত্থানের প্রাথমিক দৃশ্যপট রচিত হয়ে যায় নভেম্বর ৩ তারিখ সকাল বেলাতেই। একটা গৃহযুদ্ধ বেধে যাবার আশঙ্কা দেয়। কিন্তু খালেদ মোশারফ রক্তপাত এড়াতে চান। অভ্যুত্থানের এক বিচিত্র পথ ধরেন খালেদ। তিনি অপর পক্ষের সঙ্গে শুরু করেন টেলিফোন আলাপ। ক্যান্টনমেন্ট আর বঙ্গভবন, আপাত এই দুই দেশের প্রতিনিধিদের মধ্যে শুরু হয় টেলিফোনে কথা চালাচালি। খালেদ মোশারফ টেলিফোনে বঙ্গভবনের মেজরদের আত্মসমর্পণ করতে প্রস্তাব দেন। মেজররা প্রত্যাখ্যান করেন সে প্রস্তাব। বঙ্গভবনে অবস্থানরত ওসমানীর সঙ্গে বাদানুবাদ করেন খালেদ।
খালেদ যখন টেলিফোন যুদ্ধ চালাচ্ছেন তখন বন্দি জিয়া পরিস্থিতির বিপদ বিবেচনা করে দ্রুত পুরো দৃশ্যপট থেকে নিজেকে সরিয়ে নেবার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি সেনাবাহিনী থেকে পদত্যাগ করেন। পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর করে তিনি পাশাপাশি আবেদন করেন তাকে যেন অন্তত অবসর কালীন পেনশন এবং ভাতাটুকু দেওয়া হয়। অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল পায়জামা পাঞ্জাবি পরে বসে থাকেন তার ড্রইংরুমে। তবে পদত্যাগ করলেও জিয়াউর রহমান তার স্বভাব সুলভ ভঙ্গিতে বরাবরের মতো ঘটনার শেষ দেখবার আগ পর্যন্ত একটি বিকল্প পথও খুলে রাখেন, যার পরিচয় আমরা পাবো অচিরেই।
বিদ্যুৎ গতিতে এগুতে থাকে ঘটনা। জিয়ার পদত্যাগে উদ্দীপনা বেড়ে যায় খালেদের। বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্ট থেকে অভিনন্দন বার্তা আসতে থাকে তার কাছে। খালেদ আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেন। তিনি ক্যান্টনমেন্ট থেকে তার প্রতিনিধিদের লিখিত দাবি নিয়ে পাঠান বঙ্গভবনে। তিনি আবারও ফারুক, রশীদকে আত্মসমর্পণ করে ক্যান্টনমেন্টে আসতে বলেন এবং বঙ্গভবন থেকে সব ট্যাঙ্ক, কামানকে ক্যান্টনমেন্টে ফেরত পাঠানোর নির্দেশ দেন। ফারুক, রশীদ আবারও এ দাবি প্রত্যাখ্যান করে।
বঙ্গভবনের উপরের আকাশে তখনও বৃত্তাকারে ঘুরছে মিগ বিমান। খালেদ খন্দকার মোশতাককে বলেন : আমি কিন্তু সত্যি ব্লড শেড এভয়েট করতে চাচ্ছি। কিন্তু আপনারা যদি সহযোগিতা না করেন তাহলে আমি বঙ্গভবনের উপর বোধ ড্রপ করতে বাধ্য হব আর কিছুক্ষনের মধ্যেই।
ক্যান্টনমেন্টের ভেতরেও চূড়ান্ত উত্তেজনা তখন। ল্যান্সারের বিরুদ্ধে বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্য মোতায়েন করেছেন খালেদ। এক ইউনিট অন্য ইউনিটের বিরুদ্ধে অস্ত্র তাক করে আছে। ক্যান্টনমেন্টের ভেতরের যাতায়োতও নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। ইনফেন্টির অফিসাররা যাচ্ছেন না টু ফিল্ড আটিলারির সামনে দিয়ে।
ইতোমধ্যে খালেদ অনুগত একটি ট্রপস রেডিও স্টেশন দখল করে নিয়েছে। রেডিওতে সব রকম সম্প্রচার বন্ধ রয়েছে তখন। মেজাজ হালকা করবার জন্য এক উপস্থিত রেডিও কমীকে তারা বলেন গান চালিয়ে দিতে। রেডিও কর্মী হতের। কাছে পান রুনা লায়লার গানের টেপ। আকাশে যুদ্ধ বিমান, পথে পথে কামান, চলছে টেলিফোন যুদ্ধ আর দেশের মানুষ রেডিওতে শোনে রুনা লায়লা অবিরাম গেয়ে চলেছেন : গানের খাতায় স্বরলিপি লিখে বল কি হবে…। পরিস্থিতি আরও রহস্যময় হয়ে ওঠে সাধারণ মানুষের কাছে।
৮৮. এস ও এস
জিয়া সকালে সেনাবাহিনী থেকে পদত্যাগ করলেও এর আগে গভীর রাতে গোপনে একটি কাজ সেরে রাখেন। গৃহবন্দি অবস্থায় তখন তাকে ঘিরে আছেন খালেদ মোশারফের অনুগত অফিসার এবং সিপাইরা। ক্যাপ্টেন হাফিজুল্লাহ তার ড্রইং রুমের টেলিফোনটি বিচ্ছিন্ন করলেও জিয়া জানেন তার শোবার ঘরে ফোনটির লাইন খোলা আছে। এক উছিলায় শোবার ঘরে গিয়ে সন্তর্পনে জিয়া ডায়াল করেন একটি নম্বরে। নম্বরটি কর্নেল তাহেরের নারায়নগঞ্জের বাড়ির। রাত তখন চারটা। ফোন ধরে ঘুম জড়ানো গলায় লুৎফা বলেন, হ্যালো।
জিয়া : আমি জিয়া বলছি, তাহেরকে দেন তাড়াতাড়ি।
কদিন ধরে গ্যাস্টিকের ব্যথায় ভুগছেন তাহের। ঘুম হচ্ছিল না ভালো। টেলিফোনের শব্দে জেগে ওঠেন তিনিও। তাহের হ্যালো বলতেই জিয়া নিচুস্বরে বলেন : তাহের লিসেন কেয়ারফুলি, আই এম ইন ডেঞ্জার, সেভ মাই লাইফ।
লাইনটা কেটে যায়।
তাহের মুহূর্তে টের পেয়ে যান আরও একটি ক্যু ঘটে গেছে। এমন একটা সম্ভাবনার কথা সৈনিক সংস্থার লোকেরা জানিয়েছিল তাকে।
ব্যাপারটি কৌতূহলোদ্দীপক যে জিয়া ঐ সংকটাপন্ন অবস্থায় তার ত্রিসীমানায় চেনা জানা অসংখ্য ফোন নম্বরের মাঝ থেকে রাত চারটার সময় ফোন করলেন নারায়ণগঞ্জে তাহেরের বেসামরিক বাসার ঐ নম্বরে।
ব্যাপারটির গণিত জটিল কিছু নয়। জিয়া এই বন্দি দশা থেকে মুক্ত হতে চান। কে এখন এগিয়ে আসবে তাকে সাহায্য করতে? মেজর ফারুক, রশীদ, মোশতাক, ওসমানী? তারা সবাই ঐ মুহূর্তে অত্যন্ত নাজুক অবস্থায় ব্যস্ত আছেন নিজেদের প্রাণ বাঁচানোর চেষ্টায়। বন্দি জিয়াকে নিয়ে ভাববার কোনো সময় বা স্বার্থ তাদের নেই। সেনাবাহিনীতে এদের পরে যিনি শক্তিশালী অবস্থানে আছেন তিনি হচ্ছেন খালেদ মোশারফ। কিন্তু অভ্যুত্থান ঘটিয়ে খালেদ মোশারফই বন্দি করেছেন জিয়াকে। সুতরাং সামরিক বাহিনীর ভেতর কে এমন আছেন, যে ঐ মুহূর্তে বন্দি অবস্থা থেকে জিয়াকে মুক্ত করবেন? জিয়া টের পান, কেউ নেই।
কি আর কেউ না জানলেও জিয়া জানেন যে ক্যান্টনমেন্টের ভেতর সবার অগোচরে রয়েছে অত্যন্ত শক্তিশালী আরও একটি দল, সেটি বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার। জিয়াকে গৃহবন্দি অবস্থায় পাহারায় রেখেছেন সে সিপাইরা তাদের মধ্যেও অনেকেই বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সদস্য। ক্যান্টনমেন্ট থেকে তাকে যদি এ মুহূর্তে কেউ মুক্ত করতে পারে তবে তা কেবল বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সিপাইরাই। আর জিয়া বেশ ভালোই জানেন যে, এই সংস্থা চলছে একজন মানুষেরই নির্দেশে, তিনি কর্নেল তাহের। রণাঙ্গনে পরিচয় হয়েছে যার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশে। জিয়া বরাবর একধরনের অনিশ্চিত দূরত্ব থেকে সমর্থন দিয়ে গেছেন তাহেরকে। সুতরাং হিসাব জিয়ার কাছে পরিষ্কার যে ঐ মহাবিপদের মুহূর্তে এই বিশ্ব সংসারে একজন মাত্র মানুষই আছেন যিনি রক্ষা করতে পারেন তাকে, তিনি হচ্ছেন কর্নেল তাহের। জিয়া তার শেষ বাজির তাসটি খেলেন। ঝুঁকি নিয়ে ভোররাতে ফোন করেন তাহেরকে যেখানে তার অনুরোধ সংক্ষিপ্ত এবং স্পষ্ট-সেভ মাই লাইফ।
৮৯. রক্তাক্ত কারাগার
বঙ্গভবনে যারা আছেন, মোশতাক, ওসমানী, খলিল, ফারুক, রশীদসহ তাদের সহযোগী মেজর, সবার ভেতরেই একটি গভীর আতঙ্ক, অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। তাদের দখলে যে ট্যাঙ্ক, কামান, অস্ত্রগুলো আছে তাই দিয়ে তারা খালেদ মোশাররফের এই পাল্টা অভ্যুত্থানকে প্রতিহত করবেন কিনা সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। বঙ্গভবনে বসে তারা ঠিক বুঝে উঠতে পারেন না পাল্টা অভ্যুত্থানকারীদের শক্তি কতটা। জানেন না সেনাবাহিনীর কোন কোন অংশ আছে তাদের সাথে। তারা খোঁজ পেয়েছেন যে বিমানবাহিনী প্রধান এম এ জি তোয়াব, যাকে মোশতাকই জার্মান থেকে নিয়ে এসে করেছিলেন বিমান বাহিনীপ্রধান, তিনি পক্ষ ত্যাগ করে যোগ দিয়েছেন খালেদের সঙ্গে। এমনকি খালেদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন নৌবাহিনী প্রধানও। আর তাদের বানানো সেনাবাহিনীপ্রধান জিয়া তো বন্দিই হয়ে আছেন। মোশতাক টের পান যে খেলা আর তার হাতে নেই।
এই অভ্যুত্থানকারীদের সাথে কি ভারতের যোগসাজশ আছে? বন্দি আওয়ামী নেতাদের যোগসাজশ আছে? তারা জানেন না তাও। বঙ্গভবনে বসে তারা আশঙ্কা করেন হয়তো ভারত খালেদ মোশাররফের মাধ্যমে অভ্যুত্থান ঘটিয়ে জেলে বন্দি চার প্রধান আওয়ামী লীগ নেতাকে মুক্ত করে আবার বাকশাল সরকারকে ক্ষমতা আনতে চাইছে। তাদের মাথার উপর তখনও উড়ছে বোমারু বিমান। খালেদ মোশারফ বলেছেন বঙ্গভবনের উপর বোমা ফেলবেন যে কোনো মুহূর্তে।
মোশতাক তখন ফারুক, রশীদসহ অভ্যুত্থানকারী মেজরদের বলেন : দেখেন আমার মনে হয়, উই আর ফাঁইটিং এ লুজিং গেম। আর চেষ্টা করে লাভ নাই। আপনারা ক্যান্টনমেন্টে ফিরে যান তারপর দেখা যাক কি করা যায়।
রশীদ বলেন : ইম্পসিবল! আমরা ক্যান্টনমেন্ট গেলে আমাদের একজনকেও আস্ত রাখবে মনে করেছেন?
ফারুকও এ মতে সায় দেন। অভুত্থানকারী কোনো অফিসারই আর ক্যান্টনমেন্টে ফিরতে চান না। তারা প্রস্তাব করেন এই পাল্টা অভূখানাকে যদি আর কোনোভাবেই ঠেকানো না যায় তাহলে ক্যান্টনমেন্ট কেন, বাংলাদেশের কোনো জায়গা আর তাদের জন্য নিরাপদ নয়। তারা মোশতাক এবং ওসমানীকে বলেন, তাদের বরং দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হোক।
ওসমানী টেলিফোনে খালেদকে মেজরদের দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেবার প্রস্তাব করেন। বলেন, অফিসিয়ালী মেজর ডালিম এবং মেজর নুর এই প্রস্তাব নিয়ে খালেদের কাছে যাবেন।
বিদ্রোহীদের কাবু হতে দেখে স্বস্তি পান খালেদ। ওসমানীকে বলেন, এ ব্যাপারে পরে সিদ্ধান্ত জানানো হবে।
ফারুক, রশীদসহ মোশতাকও নতুন পরিস্থিতিতে বেশ নাজুক হয়ে পড়েন। মেজররা দেশের বাইরে চলে গেলে তার নিজের কি পরিণতি হবে এই ভেবে দুশ্চিন্তায় পড়ে যান তিনি। এদিকে তাদের আদৌ দেশের বাইরে চলে যাবার অনুমতি দেওয়া হবে কিনা, সে ব্যাপারে খালেদ কোনো সিদ্ধান্ত দেননি তখন পর্যন্ত।
বঙ্গভবনে তখন বন্দি হয়ে পরাজয়ের দ্বারপ্রান্তে একটি নৃশংস, রক্তাক্ত নাটকের প্রধান অভিনেতারা। তার নিশ্চিত, সন্ত্রস্ত, ভীতও বটে। তারা তাদের পরাজয় ঠেকানোর সব রকম ব্যবস্থা করবার চেষ্টা করতে থাকেন। এর আগে তারা সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছিলেন যে যদি হুমকি আসে তাহলে আওয়ামী লীগ এবং এর নেতৃত্বকে আর কিছুতেই মাথা তুলে দাঁড়াতে দেবেন না তারা। এই পাল্টা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ভারত এবং বন্দি চার নেতার সূত্রে আওয়ামী লীগের পুনরুত্থানের একটা সম্ভাবনা তারা আঁচ করেন। এই রকম একটি সম্ভাবনাকে সমূলে উৎপাটন করবার জন্য বঙ্গভবন গোষ্ঠী জেল খানায় বন্দি আওয়ামী লীগের প্রধান চারনেতাকে হত্যা করবার সিদ্ধান্ত নেন। হত্যায় ইতোমধ্যেই সিদ্ধহস্ত হয়েছেন তারা। তাদের শেষ কামড় হিসেবে সে রাতেই তারা ঘটান তাদের দ্বিতীয় রক্তকাণ্ড।
মেজর ফারুকের বিশ্বস্তু রিসালদার মোসলেমউদ্দীন, যিনি সাফল্যের সঙ্গে হত্যা করেছেন শেখ মণিকে, তারই নেতৃত্বে একটি দলকে তারা পাঠান ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে। মোসলেউদ্দীন তার দলবল নিয়ে গভীর রাতে জেলে পৌঁছে আওয়ামী লীগ নেতাদের হত্যা করতে চাইলে হতভম্ব হয়ে পড়েন জেলের আইজি, ডিআইজি এবং জেলার। জেলে এসময় ফোন আসে বঙ্গভবন থেকে। মেজর রশীদ এর আগেই আইজি প্রিজন নুরুজ্জামানকে জানিয়েছিলেন মোসলেমউদ্দীনের জেলে আসবার কথা। ফোন করে মেজর রশীদ জিজ্ঞাসা করেন : মোসলেমউদ্দীন কি পৌঁছেছে?
নুরুজ্জামান বলেন, জী পৌঁছেছেন কিম্ভ আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।
রশীদঃ আপনি প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কথা বলেন।
খন্দকার মোশতাক ফোন ধরলে নুরুজ্জামান বলেন : স্যার মোসলেউদ্দীন সাহেব তো বন্দিদের গুলি করবার কথা বলছেন।
মোশতাক বলেন, সে যা বলছে তাই হবে।
ফোন রেখে দেন মোশতাক।
বিমূঢ় হয়ে পড়েন আইজি প্রিজন নুরুজ্জামানসহ উপস্থিত জেলার এবং ডিআইজি। উদভ্রান্তের মতো মোসলেউদ্দীন তার দল নিয়ে হুড়মুড় করে ঢুকে পড়েন জেলে। জেলের পাগলা ঘণ্টা বেজে ওঠে। তারা বন্দুকের মুখে উপস্থিত কর্মকর্তাদের বন্দিদের কাছে নিয়ে যেতে বলেন। হতভম্ব, আইজি, ডিআইজি, জেলার বন্দুকের মুখে প্রাণ ভয়ে তাদের নিয়ে যান বন্দিদের সেলের দিকে। ১নং সেলে ছিলেন তাজউদ্দীন এবং সৈয়দ নজরুল, পাশের সেলে মনসুর আলী আর কামরুজ্জামান। পাগলা ঘণ্টার শব্দে আগেই ঘুম থেকে উঠে গেছেন তারা।
চারজনকেই আনা হয় ১নং সেলে। সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করানো হয় তাদের। খুব কাছ থেকে অতি অল্প সময়ে এই চার নেতার উপর গুলি চালান মোসলেমউদ্দীন। সৈয়দ নজরুল, মনসুর আলী, কামরুজ্জামান তৎক্ষণাৎ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। তাজউদ্দীন তখনও বেঁচে আছেন। তাজউদ্দীন অস্ফুটস্বরে বলেন, পানি, পানি। ঘাতক দলের একজন আবার ফিরে এসে বেয়োনেট চার্জ করে তার মৃত্যু নিশ্চিত করেন। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায়, কারাগারের ভেতর নিরস্ত্র বন্দিদের হত্যা করার এক বিরল নজির স্থাপন করে চলে যায় ঘাতকেরা।
শেখ মুজিবের পাশে সবসময় ফাইল হাতে দাঁড়িয়ে থাকা নটোরিয়াস লোকটি, যিনি দেশের সীমান্ত বরাবর একটি ছোট্ট ডাকোটা বিমানে উড়ে উড়ে তৈরি করছিলেন এদেশের প্রথম সরকার, নয় মাসের যুদ্ধের যে গল্প তিনি শেখ মুজিবকে শোনাবেন বলে বুকের মধ্যে নিয়ে ঘুরে বেড়ালেন তিনি সে গল্প বুকে নিয়েই মুখ থুবড়ে পড়ে রইলেন অন্ধকার জেলের রক্তাক্ত মেঝেতে। খসে পড়ে আরও একটি নক্ষত্র। একটি জনপদের রক্তের ঋণের বোঝা বাড়ে আরও এক ধাপ।
৯০. বন্দুকের পেছনের হাত
ঘটনা, দুর্ঘটনা,অতি ঘটনার এক আশ্চর্য সময় পার করছে তখন বাংলাদেশ। মুহূর্ত, ঘণ্টা, দিনের মধ্যে বদলে যাচ্ছে দৃশ্যপট। যেন প্রতিদিন জন্ম নিচ্ছে নতুন এক একটি ইতিহাস।
গভীর রাতে জেনারেল জিয়ার টেলিফোন পাবার পর আর বিছানায় যাননি তাহের। ঘুম থেকে উঠে গেছেন লুৎফাও। তাহের বলেন : চা করো এক কাপ।
লুৎফা বলেন; তোমার তো আলসারের ব্যথা।
তাহেরঃ এক কাপে কিছু হবে না।
রাতে রান্নাঘরে বাতি জ্বালিয়ে চা করতে বসেন লুৎফা। বাচ্চারা ঘুমাচ্ছে তখনও।
গভীর উদ্বিগ্নতায় চিন্তামগ্ন বসে থাকেন তাহের। লুৎফা চা নিয়ে এলে কাপটা হাতে নিয়ে বলেন : কু, কাউন্টার কু করে দেশটাকে ধ্বংস করে দেবে এরা। এবার আমাকে একটা অ্যাকশনে যেতেই হবে।
তাহের তখনও জেল হত্যার খবর জানেন না।
পরদিন খুব ভোর বেলাতেই বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার বেশ অনেক সদস্য এসে ভিড় করেন তাহেরের নারায়ণগঞ্জের বাড়ি জান মঞ্জিলে। উত্তেজিত তারা। তাহেরকে তারা ক্যান্টনমেন্টের চরম অস্বাভাবিক পরিস্থিতি বর্ণনা করেন। অফিসারদের এই ক্ষমতার কাড়াকড়ি নিয়ে তারা জানান তাদের প্রচণ্ড ক্ষোভ।
ক্ষুব্ধ হাবিলদার বলেন : এটা স্যার কোন ধরনের আর্মি? কে চিফ হবে, কে প্রেসিডেন্ট হবে এইসব ঝগড়া ঝাটিতে আমরা সিপাইরা মরব কেন?
এক কর্পোরাল বলেন : অফিসারদের দিন শেষ স্যার, আপনি অর্ডার দেন এবার স্যার আমরাই ক্ষমতা দখল করব।
সিপাইদের সংগঠিত করার জন্য সাম্প্রতিক সময়গুলোতে বিশেষভাবে তৎপর ছিলেন তাহের। ঢাকা ক্যান্টনমেনসহ দেশের নানা ক্যান্টনমেন্টে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থাকে জোরদার করছিলেন একটা অভ্যুত্থানের লক্ষ্যেই। ঘটনার এই অপ্রত্যাশিত মোড় আবারও একটা ক্রান্তির মধ্যে ফেলে দেয় তাকে। সিপাইরা ছুটে এসেছেন তাহেরের কাছেই। তারা এই অস্বাভাবিক অবস্থার পরিত্রাণ চান, নেতৃত্ব চান তাহেরের।
১৫ আগস্টের পর থেকে ক্যান্টনমেন্ট বস্তুত দুই ভাগে ভাগ হয়ে আছে। মুজিব হত্যার অপারেশনে যুক্ত ছিল সশস্ত্রবাহিনীর কোর, যার মধ্যে আছে টু ফিল্ড আর্টিলারি, ফাস্ট বেঙ্গল ল্যান্সার, ফাস্ট ইঞ্জিনিয়ার বিভাগ আর তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে ইনফেন্ট্রির অধীনে ৪৬ বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ফাস্ট বেঙ্গল, ফোর্থ বেঙ্গল এইসব বিভাগ। খালেদ মোশারফ ফাস্ট বেঙ্গল, ফোর্থ বেঙ্গল নিয়ে অভ্যুত্থান করেছেন এবং তাদের বসিয়ে দিয়েছেন কোরের মুখোমুখি। একে অপরের দিকে অস্ত্র তাক করে রেখেছে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, ক্যান্টনমেন্টের ভেতর ইনফেন্ট্রির অফিসার, সৈন্যরা কোরের কোনো অফিসার বা সিপাইয়ের সামনে দিয়ে পর্যন্ত হাঁটছে না। কিন্তু এই পুরো ঘটনা, পাল্টা ঘটনায় এ যাবত সিপাইরা। কোনো বিশৃঙ্খলা ঘটাননি। সিপাইরা অনুগতভাবে অফিসারদের আদেশ পালন করে গেছেন শুধু।
১৪ আগস্ট কুর্মিটোলা এয়ারপোর্টের অন্ধকারে যে সিপাইরা ফারুক আর রশীদের পেছনে এসে দাঁড়িয়েছিলেন তাদের অধিকাংশই জানতেন না কোন অভিযানে যুক্ত হচ্ছেন তারা, তারা শুধু অফিসারের আদেশ মেনে গেছেন। সেভাবেই তারা পৌঁছে গেছেন ধানমণ্ডি ৩২ নম্বর। মেজর ইকবালের নেতৃত্বে যে সিপাইরা বঙ্গভবনের নিরাপত্তায় নিয়োজিত ছিলেন কিছুদিন পর তাদেরই বলা হলো বঙ্গভবনের দিকে বন্দুক তাক করতে। খালেদ মোশারফের নির্দেশে তার অধীনস্ত সিপাইরা মুখোমুখি দাঁড়িয়েছেন অন্যান্য ইউনিটের তাদেরই সতীর্থ সিপাইদের বিরুদ্ধে। অফিসারদের নির্দেশ মেনে সিপাইরা একে অন্যের দিকে অস্ত্র তাক করে আছেন। সকালে পূর্বে তো বিকালে তাদের বলা হচ্ছে পশ্চিমে বন্দুক ঘোরাতে।
অফিসাররা হুকুম করবেন, সিপাইরা নতমুখে হুকুম তামিল করবে, সেনাবাহিনীর এই তো রেওয়াজ। কিন্তু এটি ভাববারও যেন কারো ফুসরত নেই, যে হাত অস্ত্রগুলো ধরে আছে সেগুলো কিছু রক্ত মাংসের মানুষের। যাদের আছে বোধ, বিবেচনা, অহং। সেই মানুষেরা নড়েচড়ে ওঠে এবার। অভ্যাসের ঘোরে এতকাল যন্ত্রের মতো অফিসারদের নির্দেশ মেনে গেলেও এবার সহ্যের শেষ প্রান্তে এসে পৌঁছেছেন তারা। অফিসাররা যার যার প্রমোশন নিয়ে ব্যস্ত থাকবেন আর সিপাইদের বসিয়ে রাখা হবে একদল আরেক দলের দিকে বন্দুক তাক করে, এ অবস্থা আর তারা মেনে নিতে রাজি নন। বিশেষ করে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সৈনিক যারা মুক্তিযুদ্ধের গাঢ় অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেছেন, তাদের আছে স্বপ্নভঙ্গের বেদনা, আছে বঞ্চনা আর অসহায়ত্বের বোধ। সেইসঙ্গে তাহের তাদের দেখিয়েছেন নতুন এক জগগণতান্ত্রিক সেনাবাহিনীর স্বপ্ন। অফিসারদের কুটিল প্রাসাদ ষড়যন্ত্রে আবারও ধূলিসাৎ হতে বসেছে সেই স্বপ্ন। এবার এ ষড়যন্ত্র রুখে দিতে চান তারা। রাত পোহাতেই সেনাবাহিনীর নিয়ম উপেক্ষা করে, দিনের প্রথম আলোয় তাই তারা ছুটে এসেছেন তাহেরের কাছে। তারা নির্দেশ চান তাদের নেতার কাছে। ক্ষুব্ধ, উত্তেজিত সিপাইরা ঘিরে রেখেছেন নারায়ণগঞ্জের জান মঞ্জিল।
গভীর রাতে ঘুম থেকে জেগে তাহেরও এই নতুন পরিস্থিতির জন্য নিজেকে প্রস্তুত করছেন। মনে মনে তিনিও সিদ্ধান্ত নিয়েছেন একটা চূড়ান্ত পদক্ষেপ নেওয়ার। কিন্তু ঐ মুহূর্তে উত্তেজিত সৈন্যদের আস্বস্থ করেন তিনি। আমি তোমাদের সাথে একমত। এ অবস্থা চলতে দেওয়া যায় না। কিন্তু ভুলে যাবে না বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা একটা রাজনৈতিক দল। কোনো সংকীর্ণ স্বার্থে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া যাবে না। শুধু ক্ষমতা দখল করলেই তো হবে না। ভেবেচিন্তে অগ্রসর হতে হবে। কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে আমাদের পাটি লিভারদের সাথে বসতে হবে। তোমরা রেডি থাকো। আজকেই আমরা মিটিং করে ঠিক করব পরবর্তীতে আমাদের কর্মসূচি কি হবে। আমি ঢাকায় রওনা দিচ্ছি এখনই।
যদিও বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা জাসদের একটি অঙ্গ সংগঠন, কিন্তু সে মুহূর্তে জাসদের মূল কর্মকাণ্ড আবর্তিত হচ্ছে তাদেরকে ঘিরেই। ফলে জাসদকে তখন নিয়ন্ত্রণ করছে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থাই। আর বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার নেতৃত্বে আছেন তাহের। ফলে ঘটনা প্রবাহের গতি নির্ভর করছে তাহেরের সিদ্ধান্তের উপর। কিন্তু তাহের বরাবরই সিদ্ধান্ত নেবার ব্যাপারে রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে পরামর্শ করা জরুরি মনে করেন। ফলে তিনি দ্রুত নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকায় রওনা দেবার সিদ্ধান্ত নেন।
তাহের লুৎফাকে বলেন : আমি ঢাকায় চললাম, কখন ফিরবো ঠিক নাই। জরুরি মিটিংয়ে বসতে হবে।
বিয়ের পর থেকে লুৎফা যেন ক্রমাগত এক জরুরি অবস্থার মধ্যেই চলছেন। লুৎফা বলেন : এতোদূর জার্নি করবে, গাড়ির ঝাঁকুনিতে তোমার আলসারের ব্যথাটা বাড়তে পারে। আমি বরং গাড়ির পেছনে একটা বিছানা পেতে দেই, ওটাতে শুয়ে যাও।
গাড়ির পেছনের সীটে লুৎফার পাতা বিছানায় উঠে তাহের নারায়ণগঞ্জ থেকে রওনা দেন ঢাকার এলিফ্যান্ট রোডে আবু ইউসুফের বাসায়। এবার চূড়ান্ত এক অধ্যায়ের সূচনা করতে।