৩১. চোরা স্রোত
যুদ্ধের গতিপথ একটু একটু করে পাল্টাচ্ছে। প্রাথমিক হতচকিত ভাবটি ইতোমধ্যে কাটিয়ে উঠেছে বাঙালিরা। যেমন চিলমারীতে তেমনি দেশের নানা প্রান্তে তার রুখে দিচ্ছে পাকবাহিনীকে। বাংলাদেশের পাশে আছে ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়ন। এতে উদ্বিগ্নতা বাড়ছে পাকিস্তানিদের। সাথে সাথে উদ্বিগ্নতা বাড়ছে তাদের মদদ দাতা আমেরিকারও। পাকিস্তানকে কিছুতেই দ্বিখণ্ডিত হতে দিতে চায় তারা। তারা জানে এতে করে ভারত এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন নিয়ে নেবে এ অঞ্চলের কর্তৃত্ব। সেটা হবে তাদের ভূ-রাজনীতির চরম পরাজয়। ফলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে আমেরিকা তাদের তৎপরতা বাড়িয়ে দেয় বহুগুণ। এ ব্যাপারে নাটাই ঘোড়ান আমেরিকার নাটের গুরু পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার। পাকিস্তানকে অস্ত্র সাহায্যের গতি বাড়িয়ে দেন তিনি। জাহাজে, বিমানে আমেরিকা থেকে অবিরাম অস্ত্র আসতে থাকে পাকবাহিনীর হতে। পাশাপাশি তিনি শুরু করেন কূটনৈতিক তৎপরতাও। দাবার চাল চালেন তিনি। কৌশল হিসেবে তিনি আঁতাত শুরু করেন সোভিয়েতের শত্রু চীনের সঙ্গে। আর রাজনীতির অংকের হিসেব মতে সোভিয়েত যেহেতু দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশের পাশে চীন ইতোমধ্যেই নিয়েছে পাকিস্তানের পক্ষ। আলোচনা করে এই সমঝোতা পোক্ত করবার লক্ষে গোপনে পাকিস্তান হয়ে কিসিঞ্জার চলে যান চীন।
আরও একটি তৎপরতা চালান কিসিঞ্জার। তিনি খুঁজে পেতে চেষ্টা করেন, ঘরের শত্রু বিভীষণকে, যাকে দিয়ে বাংলাদেশের ভেতরেও একটা বিভক্তি তৈরি করা যায়। পেয়ে যান একজনকে, খন্দকার মোশতাক, যিনি টুপি এবং আচকান পরে থাকেন, যিনি প্রধানমন্ত্রী হতে পারেননি বলে মক্কায় চলে যেতে চেয়েছিলেন। কিসিঞ্জারের প্রতিনিধিরা কলকাতায় বেশ কয়বার গোপনে খন্দকার মোশতাকের সঙ্গে দেখা করেন। আরও দুজন তখন খন্দকার মোশতাকের সঙ্গী, মাহবুবুল আলম চাষী এবং তাহের উদ্দীন ঠাকুর। লোকে বলে মোশতাকত্রয়ী। মাহবুবুল আলম পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উচ্চপদস্ত আমলা ছিলেন, দীর্ঘদিন কাটিয়েছেন আমেরিকায় পাকিস্তান দূতাবাসে। তখন থেকেই আমেরিকার রাষ্ট্রযন্ত্রের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ। পরে চাকরি ছেড়ে দিয়ে চট্টগ্রামে পটিয়ায় তার নিজের গ্রামে চলে যান। গ্রাম উন্নয়ন করবেন বলে চাষী পদবি নেন। তাহের উদ্দীন ঠাকুর, কেউ কেউ ঠাট্টা করে যাকে ডাকেন মুসলমান ঠাকুর, তখন তথ্য মন্ত্রণালয়ে নিযুক্ত। কিসিঞ্জারের প্রতিনিধিরা চোরাগোপ্তা এই তিনজনের সঙ্গে আলোচনা করেন যুদ্ধ থামিয়ে দিয়ে কনফেডারেশন জাতীয় কিছু একটা করে অখণ্ড পাকিস্তানের অধীনে একটা রাজনৈতিক সমঝোতা করার সম্ভাবনা নিয়ে।
কলকাতায় প্রবাসী সরকারের মন্ত্রিসভার মিটিংয়ে এসময় খন্দকার মোশতাক হঠাৎ নতুন একটি ধুয়া তোলেন। বলেন আমাদের এখন পাকিস্তানে বন্দি শেখ মুজিবের মুক্তির আন্দোলন করতে হবে। তিনি বলেন, হয় স্বাধীনতা নয় মুজিবের মুক্তি কিন্তু দুটো এক সাথে পাওয়া যাবে না। পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে নিউইয়র্কে গিয়ে তিনি এব্যাপারে বিশ্ব নেতৃবৃন্দের সঙ্গে শ্রালোচনা করতে চান। নিউইয়র্কে যাবার জন্য মোশতাকের ব্যগ্রতা, হঠাৎ স্বাধীনতার বদলে মুজিবের মুক্তি নিয়ে উদ্বিগ্নতা এসবের মধ্যে প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন দুরভিসন্ধির ইঙ্গিত পান। খোঁজ নিয়ে তিনি জানতে পারেন গোপনে আমেরিকানদের সঙ্গে মোশতাকের মিটিংয়ের খবর। তাজউদ্দীনের আশঙ্কা হয় যে আমেরিকায় গিয়েই মোশতাক হয়তো বলে বসবেন যে পাকিস্তানের সঙ্গে আপস মীমাংসা করে আমরা আসলে মুজিবের মুক্তি চাই। তাজউদ্দীন মোশতাকের নিউইয়র্ক যাত্রা স্থগিত করে দেন। প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হন মোশতাক। অচিরেই তাজউদ্দীনের বিরুদ্ধে বদলা নেবেন তিনি।
আমেরিকার এইসব গোপন এবং প্রকাশ্য তৎপরতায় ভারতও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে থাকে। ওদিকে ভারতে বাংলাদেশ থেকে শরণার্থীর স্রোত প্রবল থেকে প্রবলতর হচ্ছে। পঞ্চাশ, ষাট, সত্তর লক্ষ ছাড়িয়ে এগিয়ে যাচ্ছে কোটির ঘরে। বাংলাদেশের মাটিতে রাইফেল আর বেয়োনেট উঁচিয়ে যতদিন একটা পাকিস্তানি সৈন্য থাকবে ততদিন কোনো শরণার্থী ফিরে যাবে না সে দেশের মাটিতে এটা স্পষ্ট হয়ে গেছে ইতোমধ্যে এই বিশাল শরণার্থীর দায়িত্ব নেওয়া অসম্ভব হয়ে উঠতে থাকে ভারতের জন্য। পরিস্থিতি মোকাবেলার নানা উপায়ে নিয়ে এগুতে থাকে তারা। নিজেদের অবস্থা দৃঢ় করতে সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক মৈত্রী চুক্তি করে ভারত। মুক্তিযুদ্ধকে আরও সমন্বিত করতে বাংলাদেশের প্রবাসী সরকারকে বিভিন্ন দলের সদস্য নিয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গড়তে অনুরোধ করে। কমিউনিস্ট পার্টির মণি সিংহ, মস্কোপন্থী ন্যাপের মোজাফফর আহমেদ, কংগ্রেসের মনোরঞ্জন ধর, ন্যাপের ভাসানী প্রমুখদের নিয়ে গঠন করা হয় জাতীয় উপদেষ্টা কমিটি।
পৃথিবীর অন্যন্য জায়গাতেও তখন জনমত গড়ে উঠেছে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে। চলচ্চিত্র নির্মাতা জহির রায়হান রণাঙ্গন ঘুরে ঘুরে ছবি তুলে ঐ যুদ্ধের ডামাডোলের মধ্যেই নির্মাণ করেছেন অসাধারণ ছবি স্টপ জেনোসাইড। সে ছবি সারা বিশ্বে ছড়ায় বাংলাদেশর যুদ্ধের বীভৎসভার কথা, বাঙালিদের প্রতিরোধের কথাও। সে সময়ের দুনিয়া কাঁপানো পপ স্টার জর্জ হ্যারিসন আর সেতার শিল্পীর রবিশংকর আয়োজন করেন বাংলাদেশ কনসার্ট। বিশ্বব্যাপী মানুষ প্রতিবাদ জানায় বাংলাদেশের গণহত্যার। আর দখলদার বাহিনীকে হতোদ্যম এবং যুদ্ধ পরিশ্রান্ত করবার কাজ অবিরাম করে যায় মুক্তিযোদ্ধারা। মুক্তিযুদ্ধ বাঁক নিতে থাকে।
৩২. হি ইজ এ ভলকানো
যে আশঙ্কা আশরাফুন্নেসা করেছিলেন অনেক আগেই ঠিক তাই ঘটে একদিন। একই দিনে পাকিস্তান আর্মি হানা দেয় ঈশ্বরগঞ্জে লুৎফার বাবা, মার বাড়ি আর কাজলায় তাহেরের বাবা, মার বাড়ি। পাকবাহিনীর সঙ্গে কয়জন রাজাকার দোসর।
বাবা খুরসেদুদ্দিনকে লুৎফার ছবি দেখিয়ে তারা বলে : ইয়ে তাসভির কেয়া আপকি লাড়কি কি হ্যায়?
খুরসেদুদ্দিন : হ্যাঁ।
আর্মির এক সিপাই : উও কেয়া মেজর তাহের কা বিবি হ্যায়?
খুরসেদুদ্দিন : হ্যাঁ।
সিপাই : তো বাতাও আপকা লাড়কি কাহা হ্যায়?
খুরসেদুদ্দিন বলেন : আমার সাথে যোগাযোগ নাই। শুনেছি ঢাকায় আছে। কোথায় আছে তাও জানি না।
এক রাজাকার কমান্ডার পাক সিপাইকে অনুবাদ করে দেয় লুৎফার বাবার উত্তরগুলো।
লুৎফার বাবা মা ছোট বোনকে ধরে নিয়ে যায় আর্মি। বন্দি করে রাখে ময়মনসিংহ সার্কিট হাউজে।
একইভাবে কাজলায় পাকবাহিনীর একদল সৈন্য ঘিরে ফেলে তাহেরদের বাড়ি। তাদের সঙ্গেও রাজাকার সদস্য, যারা তাহেবের বাড়ি চিনিয়ে নিয়ে এসেছে। বাড়িতে তাহেরের বাবা মা এবং বড় ভাই আরিফ, তার স্ত্রী আর ছেলে নিয়ে আছেন।
সৈন্যরা বাড়ি ঘেরাও করে রুক্ষ, ক্ষুব্ধভাবে জানতে চায় : কাহা হ্যায় মেজর তাহের অউর উসকো বিবি?
তাহেরের মা আশরাফুন্নেসা একটুও বিচলিত হন না। বরং উল্টো সৈন্যদের ওপর ক্ষেপে গিয়ে বাংলা উর্দু মিশিয়ে বলতে থাকেন : আমার ছেলে, ছেলের বউ কাঁহা হ্যায় সেটা আমাকে জিজ্ঞাসা করছো কেন? আমি তোমাদের কাছে জানতে চাই তারা কোথায়? আমার ছেলে গভর্নমেন্টের নোকরী করে, গভর্নমেন্টের দায়িত্ব আমাকে জানানো তারা কোথায় আছে। আমি তোমাদের বড় অফিসারের কাছে চিঠি লিখব, তার কাছে জানতে চাইবো আমার ছেলে কাহা হ্যায়।
এক পাক সেনা বলেন : আগার নেহি বলিয়েগা তো আপলোগোকে আরেস্ট কারেঙ্গা।
আশরাফুন্নেসা বলেন : করো এরেস্ট, কোনো অসুবিধা নাই।
আর্মি অফিসার তাহেরের বাবা মা, বড় ভাই আরিফ আর তার পরিবারকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায় ময়মনসিংহের সেই একই সার্কিট হাউজে, যেখানে ইতোমধ্যেই বন্দি করে আনা হয়েছে লুৎফার বাবা মাকে। দুই পরিবারকে রাখা হয় সার্কিট হাউজের ভিন্ন দুই তালায়। এক পরিবার জানেন না আরেক পরিবারের খবর। ময়মনসিংহ সার্কিট হাউজের ভিন্ন ভিন্ন কক্ষে মৃত্যুর প্রহর গোনে নাজুক দুই পরিবার। মৃত্যু তখন নেহাতই তুচ্ছ একটি ব্যাপার।
সে সময় ময়মনসিংহের শার্শাল ল অ্যাডমিনসট্রেটর বেলুচ রেজিমেন্টের জেনারেল কাদের খান। একদিন জেনারেল কাদের খান তাহেরের বড় ভাই আরিফকে ডেকে পাঠান। সন্ত্রস্ত্র আরিফ ঢোকেন মার্শাল ল অ্যাডমিনিসটেটর ঘরে! আরিফকে অবাক করে দিয়ে কাদের খান বেশ শান্ত কণ্ঠে বলেন, বয়ঠিয়ে।
তারপর জেনারেল বলাতে থাকেন : মিস্টার আরিফ, তাহের আমার আন্ডারে ট্রেনিং করেছে, তাহেরকে আমি খুব ভালো জানি, সে অত্যন্ত মেধাবী একজন অফিসার। হি ইজ এ ভলকানো, এ হান্ড্রেড পারসেন্ট প্রফেশনাল। তাহের যে পালিয়ে এসেছে এবং নিজেদের দেশ রক্ষার যুদ্ধে যোগ দিয়েছে এতে আমি বিশেষ অপরাধ দেখি না। তাহের যা করেছে আমিও হয়ত তাই করতাম ওর জায়গায় থাকলে। আপনাকে একটা সত্য কথা বলি, আপনাদের পরিবার এবং তাহেরের শ্বশুরের পরিবার সবাইকে মেরে ফেলার ওর্ডার আছে আমার কাছে। কিন্তু আমি সেটা করছি না। কিন্ত্র এর বদলে আপনাকে দুটো কাজ করেতে হবে। আপনাকে ইমিডিয়েটলি করাচিতে আপনার কাজের ক্ষেত্রে চলে যেতে হবে আর আপনার বাবা মা এবং তাহেরের শ্বশুর-শাশুড়িকে বলতে হবে যে তারা যেন কোনোভাবেই তাহেরের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ না রাখে। তা না হলে আমাকে খুবই আনপ্লিজেন্ট একটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
অবধারিত মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে যায় দুটি পরিবার। তাহেরের বাবা মাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় কাজলায়, আর লুৎফার বাবা মাকে ঈশ্বরগঞ্জে। আরিফকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বিশেষ ব্যবস্থায় বিমানে তুলে পাঠিয়ে দেয় পশ্চিম পাকিস্তানের করাচিতে।
৩৩. ঘাঁটি কামালপুর
তাহের এসবের কিছুই জানেন না। তিনি তখন তার সেক্টরের সবচাইতে জটিল অপারেশনটির পরিকল্পনায় ব্যস্ত। কামালপুর অপারেশন। জামালপুর জেলার সীমান্তবর্তী গ্রাম কামালপুর। পাশেই ধানুয়া কামালপুর, উঠানিপাড়া, হাসিরগাও, পশ্চিম কামালপুর, পালবাড়ি, ব্রাহ্মণপাড়া, মাঝিরচর আর বালুগ্রাম। সেখানেই ঘাঁটি করেছে পাক সেনা। ভারত সীমান্ত থেকে বাংলাদেশের দেড় মাইল ভেতরে সেই ঘাঁটি। থানা সদর বক্সিগঞ্জ থেকে কামালপুরের দুরত্ব চার কিলোমিটারের মতো। সীমান্ত থেকে শেরপুর ময়মনসিংহ সড়কটি এই আঁটির কাছ দিয়েই অতিক্রম করেছে। অতি গুরুত্বপূর্ণ এই ঘাঁটিটি পাকিস্তানিরা বানিয়েছে অত্যন্ত সুদৃঢ়ভাবে? বাঙ্কারগুলোর দেওয়াল পর্যায়ক্রমে মাটি, টিন, লোহার বিম, সিমেন্ট ইত্যাদি দিয়ে শক্তভাবে তৈরি। প্রতিটি বাঙ্কার দৃঢ় ছাদ দিয়ে ঢাকা। এক বাঙ্কার থেকে অনা বাঙ্কারে চলাচলের জন্য রয়েছে সুড়ঙ্গ। ক্যাম্পের পেছনের অংশ হাড়া বাকি তিন দিকে কাঁটা তারের বেড়া। বেড়ার বাইরেই পাতা আছে মাইন। কামালপুরের বিপরীতে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের মহেদ্রগঞ্জ। সেখানেই তাহেরের ১১ নম্বর সেক্টর কমান্ডারের সদর দপ্তর।
মুক্তিযোদ্ধারা বেশ কয়েকবার এই কামালপুর ঘাঁটি আক্রমণ করেও ব্যর্থ হয়েছেন দখল করতে। সবচেয়ে বড় আক্রমণটি চালানো হয় জুলাই মাসের শেষের দিকে মেজর জিয়ার নেতৃত্বে। তাহের তখনও এই সেক্টরের দায়িত্ব নেননি। মেজর জিয়া তেল ঢালা যাওয়ার কিছু আগে এই অপারেশন চালান। তার সঙ্গে ছিলেন মেজর মইনুল হোসেন চৌধুরী, ক্যাপ্টেন হাফিজ আর ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন। ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন কৌতূহলোদ্দীপক এক যোদ্ধা। যুদ্ধের শুরুতে পাকিস্তানের পক্ষ হয়ে পড়ছিলেন তিনি, মাঝপথে পক্ষ ত্যাগ করে যোগ দেন মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে ছিলেন অসম সাহসী। কামালপুর যুদ্ধের রেকি করতে গিয়ে তিনি চলে গিয়েছিলেন একেবারে পাকিস্তান আর্মির বাঙ্কারের ভেতরে এবং সেখানে গিয়ে রীতিমতো মল্ল যুদ্ধে নেমে পড়েছিলেন দুজন সৈনিকের সঙ্গে। তার সহমুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে পাক সেনা দুজনকে হত্যা করে তাদের অস্ত্র ছিনিয়ে নিয়েছিলেন।
তাহের আসবার আগে জুলাইয়ের ৩১ তারিখ মেজর জিয়ার নেতৃত্ব শুরু হয় কামালপুর আক্রমণের প্রথম প্রচেষ্টা। অনেকগুলো কোম্পানির এক বিশাল মুক্তিযোদ্ধা বাহিনী যোগ দেয় সে অপারেশনে। কথা ছিল ক্যাপ্টেন হাফিজ এবং ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিনের বাহিনীটি সবার সামনে থাকবেএবং তাদের সহযোগিতায় থাকবে অন্য কোম্পানিগুলো এবং সবার পেছন থেকে কাভার দেবে ভারতীয় আর্টিলারি বাহিনী। সেদিন প্রচণ্ড ঝড় বাদল। ভোর রাতে ঝড়ের মধ্যে অন্ধকারে শুরু হয় অপারেশন। কিন্তু কিছু তরুণ মুক্তিযোদ্ধার অভিজ্ঞতা, অন্ধকার ঝড়ো রাত আর বিভিন্ন কোম্পানি এবং ভারতীয় ডিফেন্সয়ের সঙ্গে যোগাযোগের ভুল বোঝাবুঝির জন্য এক পর্যায়ে অপারেশনটি ভীষণ একটি বিশৃঙ্খলায় পর্যবেশিত হয়। অপারেশন শুরু হবার কিছুক্ষণ পর ভুল করে ভারতীয় কাভারের ডিফেন্স আর্টিলারি গোলাবর্ষণ করলে সেটি গিয়ে পড়ে মুক্তিযোদ্ধাদের উপরই। বেশ অনেক মুক্তিযোদ্ধা নিহত হন। পরস্পরের মধ্যে যোগাযোগ বিছিন্ন হয়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়েন সবাই। কিন্তু ক্যাপ্টেন হাফিজ এবং সালাউদ্দিন দৃঢ় মনবল নিয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যান। এক পর্যায়ে ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন একেবারে শত্রু পক্ষের বেস্টনির মধ্যে চলে যান। সেই ঝড় বাদলের রাতে অন্ধকারের মধ্যে তার হ্যান্ড মাইক দিয়ে ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন চিৎকার করে উর্দুতে পাকিস্তানি সেনাদের আত্মসমর্পণ করতে বলতে থাকেন। খুব ভালো উর্দু জানতেন সালাউদ্দিন। চারপাশে তখন চলছে মেশিনগানের তুমুল গুলিবর্ষণ। হঠাৎ একটি গুলি বিদ্ধ করে সালাউদ্দিনকে। মাইক হাতেই অন্ধকারে ঢলে পড়েন সালাউদ্দিন। তার লাশ পাকিস্তানি সেনা বাঙ্কারের এত কাছে পড়ে থাকে যে তার সহযোদ্ধারা সেটি আনতে চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। পাকসেনারা সালাউদ্দিনের লাশ টেনে নিয়ে যায় তাদের ক্যাম্পের ভেতরে। নানা বিশৃঙ্খলায় ব্যর্থ হয় সেই কামালপুর অপারেশন। জেনারেল ওসমানী ক্ষুব্ধ হন জিয়াউর রাহমানের ওপর। তাকে তেলঢালায় সরিয়ে ফেলার এও এক কারণ।
তাহের ১১ নম্বর সেক্টরের দায়িত্ব নেওয়ার পর ঐ কামালপুর হয়ে দাঁড়ায় তার অন্যতম টার্গেট। ইতোমধ্যে চিলমারী অপারেশনের সাফল্য আত্মবিশ্বাস দিয়েছে তাকে। ছোটখাটো অন্যান্য অপারেশন চালিয়ে গেলেও তাহেরের মাথায় তখন কামালপুর। কামালপুর ঘাঁটিকে দখল করবার নানা পরিকল্পনা করতে থাকেন তিনি। কামালপুরের আগের অপারেশনগুলো পর্যালোচনা করে তাহের দেখেন যখনই কামালপুর আঁটি আক্রমণ করা হয় এবং কামালপুর কিছুটা দুর্বল অবস্থায় পড়ে তখনই কাছের বক্সিগঞ্জ থানা থেকে ১২০ মিলিমিটার মার্টারের গোলাবর্ষণ হতে থাকে। মুক্তিযোদ্ধারা পাক বাঙ্কারের খুব কাছে চলে গেলেও ঘাঁটিটি দখল করতে পারেননি কারণ সেই মর্টারের শেলগুলো এসে পড়েছে তাদের উপরে। এদিকে বাঙ্কারগুলো অত্যন্ত মজবুতভাবে ঢাকা থাকার কারণে পাকিস্তানিরা থাকে নিরাপদ।
তাহের বুঝতে পারেন যে, পাকিস্তানিদের শক্তিশালী ঘাঁটি আক্রমণ করে বিশেষ সুবিধা হবে না বরং শত্রুকে কৌশলে প্রলুদ্ধ করে তার ঘাঁটি থেকে বের করে আনতে হবে নির্ধারিত স্থানে এবং তারপর নিঃশেস করতে হবে তাদের। কামালপুর শক্ত ঘাঁটি থেকে ৫০০ গজ পশ্চিমে ধানুয়া কামালপুর গ্রাম, দক্ষিণ পশ্চিমে এবং দক্ষিণে হাসির গ্রাম এবং উঠানের পাড়া। ধানুয়া কামালপুর, হাসির গ্রাম আর উঠানের পাড়া এই গ্রামের সারি এবং কামালপুরের মাঝে বিস্তৃর্ণ এক খোলা জলা মাঠ। তাহের ভাবেন কোনভাবে শত্রুকে এই জলা মাঠে বের করে আনতে পারলে উদ্দেশ্য সফল হবে। এই জলামাঠই হবে তাদের মরণ ফাঁদ! সেই পরিকল্পনাতেই তাহের ধানুয়া কামালপুর আর হাসির গ্রামে তৈরি করেন নকুল ট্রেঞ্চ। যেহেতু কামালপুর আক্রান্ত হলে বক্সিগঞ্জ থেকে পাকিস্তানি সেনারা। কামালপুরকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে সে কারণে কামালপুর বক্সিগঞ্জের রাস্ত টিতে এ্যান্টি ট্যাঙ্ক মাইন বসানোর ব্যবস্থা করা হয়।
তার নিজের সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধা, অফিসার, আশপাশের গ্রামবাসী আর পাশাপাশি জিয়াউর রহমানের ব্রিগেড থেকে একটি কোম্পানি মহেন্দ্রগঞ্জে নিয়ে এসে আগস্ট মাসের শুরুর দিকে তাহের এক আক্রমণ চালান কামালপুরে। প্রাথমিক পর্যায়ে মাইনের আঘাতে পাকিস্তানি সেনাবহনকারী গাড়ি এবং তাদের কিছু সৈন্যকে হত্যা করতে সক্ষম হলেও কিছুক্ষণের মধ্যেই কামালপুর এবং বক্সিগঞ্জ দুই জায়গা থেকেই পাক সেনাদের অত্যন্ত শক্তিশালী আক্রমণ শুরু হয়ে যায়। পিছু হঠতে বাধ্য হন তাহের এবং তার দল। তাহেরের নেতৃত্বে কামালপুর দখলের প্রথম উদ্যোগ ব্যর্থ হয়।
একরকম জেদ চেপে যায় তাহেরের দখল করতেই হবে কামালপুরকে। তাহের চূড়ান্তভাবে কামালপুর ঘটিকে ধ্বংস করার মানসিকতা নিয়ে ব্যাপক পরিকল্পনা করতে থাকেন। তার সেক্টরের বিভিন্ন কোম্পানি গুলোকে প্রস্তুত করেন তিনি, বিশেষভাবে প্রস্তুত করেন শুধু কৃষকদের নিয়ে তৈরি কোম্পানিটিকে। সিন্ধান্ত নেন এবার ভারতীয় বাহিনীর কাছ থেকেও ব্যাপক সহযোগিতা নেবেন। ভারতীয় ব্রিগেডিয়ার ক্লেয়ারের সঙ্গে এনিয়ে দীর্ঘ বৈঠক করেন তিনি। সিদ্ধান্ত হয় যে ভারতীয় গুর্থ রেজিমেন্ট, মারাঠা রেজিমেন্ট এবং গার্ড রেজিমেন্ট এই তিন রেজিমেন্ট থেকে সহযোগিতা দেওয়া হবে তাহেরকে। তাহের থাকবেন কামালপুর অপারেশনের মূল দায়িত্বে আর ভারতীয়রা থাকবে তার কাভারে। অপারেশনের দিন ঠিক করা হয় ১৪ নভেম্বর। ঐদিন তাহোরের জন্ম দিন। সহযোদ্ধারা শপথ করেন তাহেরের জন্মদিন তারা উদযাপন করবেন কামালপুরে।
চুড়ান্ত আক্রমণের সব রকম প্রস্তুতি চলে। কয়েকবার রেকি অ্যাটাক, মক অ্যাটাক করা হয়। তাহের আবারও মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণ করিয়ে দেন, কামালপুর ইজ দি গেটওয়ে টু ঢাকা। সিদ্ধান্ত হয় কামালপুর পতনের পর মুক্তিযোদ্ধারা এগিয়ে যাবে ঢাকার দিকে। আর তাহের ভারতীয় সৈন্যের প্যারাসুট ট্রুপার দলের সঙ্গে প্যারাসুট ড্রপিং করবেন টাঙ্গাইলে। সেখানে মিলিত হবেন কাদের সিদ্দিকীর কাদের বাহিনীর সঙ্গে। ইতোমধ্যে কামালপুর দখল করা ১১ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা এসে মিলিত হবে তাহের এবং কাদের বাহিনী সঙ্গে। তারপর ১১ নং সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধা, কাদের বাহিনী এবং ভারতীয় বাহিনী যৌথভাবে এগিয়ে যাবে ঢাকার দিকে। মুক্তিযোদ্ধাদের ২৫টা কোম্পানি, ভারতীয়দের তিনটা রেজিমেন্ট নিয়ে টোটাল ওফেন্সে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত তাহের।
ওদিকে তুরার পাহাড়ের গায়ে ছোট্ট ঘরটিতে শিশু জয়া আর ননদ জুলিয়াকে নিয়ে দিন কাটান লুৎফা। ডালিয়াসহ তাহেরের বাকি ভাইরা সব যুদ্ধক্ষেত্রে। বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নয়নাভিরাম ঝরনা দেখেন লুৎফা, দেখেন ঝরনার পাশ দিয়ে চলে যাওয়া গৌহাটির রাস্তার দূরপাল্লার বাস, ট্রাক। পথ চেয়ে থাকেন তাহেরের জীপটিকে দেখবার আশায়। মাঝে মাঝে তার ভাই সাব্বির, দেবর সাঈদ রাইফেল কাঁধে এসে দল বেঁধে লুৎফার ঘরে খাওয়া দাওয়া করে যান। সুষ্ণা তুরায় বসেই নিয়মিত খবর পান যুদ্ধের। খর পানি কটা বাঙ্কার দখল হচ্ছে, কজন ছেলে মারা যাচ্ছে। তাহের আর ঘন ঘন আসতে পারেন না তখন। বেড়ে গেছে অপারেশনের মাত্রা।
মাঝে মাঝে তাহের এলে লুকা মহেন্দ্রগঞ্জে মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে যেতে চান। তাহের প্রতিশ্রুতি দেন নিয়ে যাবেন অচিরেই। নভেম্বরের বারো তারিখ তাহের এসে উপস্থিত। লুৎফাকে বলেন : আগামী ১৪ নভেম্বর, আমার জন্মদিনে চূড়ান্ত ভাবে আক্রমণ করব কামালপুরকে। ঐ মুক্ত কামালপুরে তোমাকে নিয়ে যাবো, কামালপুর ঘাঁটিতে তুমি বাংলাদেশের পতাকা উড়াবে।
জয়াকে কোলে নিয়ে আদর করেন তাহের, লুৎক্ষার সঙ্গে বসে ভাত খান। যাবার সময় বলেন, ১৪ তারিখ তোমার জন্য জীপ আসবে, রেডি থেকো, আর এই দেখ লন্ডনে তুমি আমাকে যে আংটিটা কিনে দিয়েছিলে, ওটা পরে নিয়েছি। ওটা আমার গুড লাক সাইন। কামালপুর এবার দখল হবেই।
মুক্ত কামালপুরে তাহেরকে জন্মদিনের উপহার দেবে বলে লুৎফা কাছের বাজার থেকে কেনেন একটি ফুলতোলা রুমাল। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কেনেন অনেকগুলো চকলেট।
শীত পড়েছে চারদিকে। ১৪ নভেম্বরের কুয়াশার রাতে শুরু হবে আক্রমণ।
৩৪. পায়ের চিহ্ন
কামালপুরের পাকিস্তানি ঘাঁটির সীমা বরাবর বান রোড। এই কান রোডই বিভক্ত করেছে পাকবাহিনী আর মুক্তিযোদ্ধাদের। বান রোডের খানিকটা পেছনেই মুক্তিযোদ্ধাদের প্রথম বাঙ্কার। সেখানে সামনের দিকে লে. মান্নান আর সেকেন্ড লে. মিজান আছেন তাদের কোম্পানি নিয়ে। তারাই মুক্তিযোদ্ধাদের অগ্রবর্তী বাহিনী। তার পেছনেই আরেক সারি বাঙ্কার। সেখানে মিডিয়াম গান নিয়ে আরেক দল মুক্তিযোদ্ধা। তাদের আরও পেছনে আছেন হেভি গান নিয়ে আরেক দল। মুক্তিযোদ্ধা। কামালপুরকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলা হয়েছে। আর একদম পেছনে সেক্টর কমান্ডার তাহেরের বাঙ্কার। সেক্টর কমান্ডার তাহেরের পাশের বাঙ্কারে ব্রিগেডিয়ায় ক্লেয়ার। ক্লেয়ার তাহেরকে সহায়তা দানকারী ভারতীয় বাহিনীর প্রধান। সেক্টর কমান্ডারের কমান্ড পোস্টটি একটি আম বাগানের মধ্যে। সবার পেছনে অপেক্ষা করছে ভারতীয় আর্টিলারি বাহিনীর কভারিংয়ের ট্রুপগুলো।
ভোর রাতে শুরু হবে অপারেশন। আগে আগে রাতের খাওয়া খেয়ে নিয়েছেন সবাই। মুজিযোদ্ধারা পরাটায় চিনি দিয়ে রোল বানিয়ে খুঁজে নিয়েছেন লুঙ্গিতে কিংবা প্যান্তের পকেটে। ঠিক করেছেন সকালে এই দিয়েই কামালপুরে নাস্তা করবেন তারা। সেদিনের অপারেশনে যোদ্ধা হিসেবে উপস্থিত তাহেরের প্রায় পুরো পরিবার। বেলাল এবং বাহার, বিশেষ করে বাহার সবসময় সবচাইতে ঝুঁকিপূর্ণ পজিশনগুলোতে থাকতে আগ্রহী। তারা দুই ভাই, তাদের স্কাউট টিম নিয়ে আছেন তাহেরের বাঙ্কারে তার পারসোনাল সিকিউরিটির দায়িত্বে। তাহেরের অন্য ভাই সাঈদ তার কোম্পানি নিয়ে প্রস্তুত আছেন মিডিয়াম রেঞ্জে। বড় ভাই আবু ইউসুফ আছেন তার পেছনে। সেদিন এক বিপত্তি ঘটে আনোয়ারের। সকালের দিকে হঠাৎ ভেঙ্গে যায় তার চশমা। চোখে ভালো দেখতে পারছিলেন না তিনি। ফলে তাহের আনোয়ারকে সরাসরি অপারেশনে অংশগ্রহণ করার অনুমতি দেননি। আনোয়ার এবং বোন ডালিয়া দুজনেই সেক্টর কমান্ডার তাহেরের বাঙ্কারের কাছাকাছি, যুদ্ধক্ষেত্রের খানিকটা বাইরে দুটো ফ্লাস্কে পানি আর চা নিয়ে বসে আছে। তাদের হাতে ওয়াকিটকি। প্রয়োজনমতো সেক্টর কামন্ডারকে চা, পানি সরবরাহ করা তাদের দায়িত্ব।
মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে এমএমজি, এলএমজি, সেলফ লোডিং রাইফেল। কারো কাছে টু ইঞ্চি মর্টার। সবাই পজিশন নিয়েছেন। তাহের প্রতিটি কোম্পানি কামান্ডার আর ভারতীয় অফিসারদের সঙ্গে ওয়াকিটকিতে কথা বলে নেন। তাদের অবস্থান, প্রস্তুতি সব নিশ্চিত হয়ে নেন। সেদিনকার অপারেশনে তাহেরের কোড থাকে কর্তা। সেদিন সবাই তাকে সম্বোধন করেন কর্তা বলে। শীতের গভীর রাতের অন্ধকারে মিশে ছায়ার মতো বসে আছেন মরণকামড় দিতে প্রস্তুত দুর্ধর্ষ মুক্তিযোদ্ধার দল। তাদের নেতা তাহের, সেদিনের কর্তা।
রাত দেড়টার দিকে তাহের ফায়ারের অর্ডার দেন। একসাথে ওপেন হয় ফায়ার। পেছন থেকে চলতে থাকে অবিরাম শেল ড্রেপিং। ১৯টা ফিল্ড গান একসাথে কাজ করে। একই সাথে কাজ করে এমএমজি, হেভি মেশিনগান। তিনটা রেঞ্জ থেকে একই সঙ্গে চলে তুমুল ফায়ার। বিকট শব্দে আর আগুনের হলকায় ছেয়ে যায় কামালপুর, ধানুয়া কামালপুর, উঠানিপাড়া, হাসিরগাঁওয়ের রাতের আকাশ, বাতাস। ওয়াকিটকিতে কেবল শোনা যাচ্ছে কোম্পানি কামান্ডারদের একের পর এক চিৎকার ফায়ার … ফায়ার। এক পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধারা জয় বাংলা বলে ট্রেঞ্চ থেকে বেরিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকেন।
একেবারে সামনে বাঙ্কারের যোদ্ধারা ট্ৰেঞ্চ থেকে বেরিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করে বান বোড় পার হয়ে সামনে এগুতে থাকেন। ওয়াকিটকিতে সে খবর তারা জানান সেক্টর কমান্ডার কর্তাকে। সেকেন্ড লে. মিজানের কোম্পানিটি সবার সামনে। তারা এগুতে এগুতে পাকবাহিনীর প্রথম বাঙ্কারটির খুব কাছে চলে আসেন। মিজান ওয়াকিটকিতে তাহেরকে জানান, কর্তা, আমরা ওদের একটা বাঙ্কারের খুব কাছাকাছি চলে গেছি।
ইতোমধ্যে বাঙ্কার থেকে বেরুনোর পরপরই নিহত হয়েছেন কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা। মিজানের পেছনে পেছনে দ্বিতীয় এবং তৃতীয় বাঙ্কারের কোম্পানি গুলোও এগিয়ে যেতে থাকে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে। প্রবল এবং আচমকা গুলিবর্ষণে হতবিহ্বল পাকিস্তান ঘাঁটির সেনারা। মুক্তিযোদ্ধারা দেখতে পান যে পাক সেনারা কেউ কেউ বাঙ্কার থেকে বেরিয়ে আশপাশের আখক্ষেতে ঢুকে যাচ্ছে। মিজান ওয়াকিটকিতে জানান যে, পাকিস্তানিরা এখন প্রথম বাঙ্কার ছেড়ে চলে গেছে পেছনের বাঙ্কারে। প্রচণ্ড গোলাগুলির শব্দে দূর গ্রামের মানুষেরা সব ঘুম থেকে জেগে বসে আছেন।
গাঢ় অন্ধকারে আশপাশে স্পষ্ট কিছু দেখা যাচ্ছে না বলে তাহের নির্দেশ দেন রেড ফায়ারের। রেড ফায়ার করা করা হলে চকিতে উজ্জ্বল আলোয় ভরে ওঠে চারদিক। খানিকটা সময়ের জন্য আশপাশের সবকিছু হয়ে ওঠে স্পষ্ট দেখা যায় অনেক পাকিস্তানি সেনাই বাঙ্কার থেকে বেরিয়ে আশপাশের ক্ষেতগুলোতে লুকাবার চেষ্টা করছে। মনে হচ্ছে ওদের প্রতিরোধ ব্যবস্থা অনেকটাই ভেঙ্গে পড়েছে। ওয়াকিটকিতে ব্রিগেডিয়ার ক্লেয়ারের সাথে উৎফুল্ল কন্ঠে কথা বলেন : তাহের : ভেরি শর্টলি উই আর গোয়িং টু ক্যাপচার দি পাক ক্যাম্প।
গোলাবর্ষণ চলছে অবিরাম। এ অপারেশনে আছেন সাংবাদিক হারুন হাবীবও। পজিশন নিয়েছেন বেশ কিছুটা পেছনে। তার হাতে স্টেনগান এবং সঙ্গে একটি টেপ রেকর্ডারও। বিভিন্ন রণাঙ্গনে ঘুরেছেন তিনি কিন্তু তার মনে হয় এমন প্রবল গোলাবৃষ্টি তিনি গত কয়েক মাসে দেখেননি। দুপক্ষের অবিশ্রান্ত গোলাবর্ষণকে ছাপিয়ে এক পর্যয়ে উড়ে আসতে পাকে ভারী কামানের গোলা। প্রচণ্ড শব্দে একটার পর একটা গোলা ফাটতে থাকে তাদের ট্রেঞ্চের আশপাশে। হঠাৎ হারুন হাবীবের মনে হয় এই ধ্বংস আর মৃত্যুর আবহ তৈরি করা শব্দরাজির। রেকর্ড করে রাখা যাক। টেপরেকর্ডারটি অন করে মাটিতে রেখে দেন তিনি। রেকর্ড হতে থাকে এক ঐতিহাসিক রণাঙ্গনের শব্দরাজি।
যুদ্ধে, যুদ্ধে রাত পেরিয়ে ভোর হয়ে আসে।
সেকেন্ড লে. মিজান ওয়াকিটকিতে বলেন; কর্তা, আমরা পাক বাঙ্কারের একেবারে কাছে চলে এসেছি। একটু পরেই এখন আমরা বাঙ্কারে সরাসরি চার্জ করতে যাচ্ছি।
এইটুকু বলার পর অনেকক্ষণ মিজানের আর কোনো কথা শোনা যায় না। উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠেন তাহের। ওয়াকিটকিতে বারবার চিৎকার করে : মিজান তুমি কোথায় … কোথায় তুমি?
কিন্তু মিজানের কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যায় না। তাহের খুবই চিন্তিত হয়ে পড়েন। বেশ কিছুক্ষণ চেষ্টা করে মিজানের সাথে যোগাযোগ করতে না পেরে তাহের বলেন : লেটস্ মুভ। আই মাস্ট গো ক্লোজার।
পেছনের কমান্ডিং বাঙ্কার থেকে বেরিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকেন তাহের। ভারী মর্টার আর শেল চারদিকে। ব্রিগেডিয়ার ক্লেয়ার ওয়াকিটকিতে চেঁচিয়ে বলেন : হোয়াট আর ইউ ডুয়িং কর্তা? ইউ ক্যান্ট মুভ ফ্রম ইয়োর প্লেস।
তাহের বলেন; আই মাস্ট ফাইন্ড লে. মিজান, মাই ফ্রন্ট লাইন ফাইটার।
তাহের কমান্ড পোষ্ট ছেড়ে সামনে এগিয়ে যেতে থাকেন। তার পারসোনাল সিকিউরিটিতে থাকা দুই ভাই বেলাল আর বাহারের স্কাউট টিমটিও এগিয়ে চলে সামনে। মিড় রে বরাবর আসেন তাহের। সেখানে ভাই সাঈদ অবস্থান করছেন তার কোম্পানি নিয়ে। সাঈদ বলেন : আপনি আর সামনে যাইয়েন না। মিজান আগেও এরকম কয়েকবার কমিউনিকেশন মিস করছে। সুতরাং ভয়ের কিছু নেই।
কিন্তু তাহের কথা শোনেন না, এগিয়ে যেতে থাকেন ফ্রন্ট লাইনের দিকে। তিনি প্রথম সারির বাঙ্কারগুলো অতিক্রম করে যান, অতিক্রম করেন বানরোড। একটু এগিয়েই পেয়ে যান মিজানকে। তাহের বলেন? তুমি তো চিন্তায় ফেলে দিয়েছিলে।
ওয়াকিটকির যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে যোগাযোগ হারিয়ে ফেলেছিলেন মিজান। তাহের বেলাল বাহারকে বলেন তাদের কোম্পানি নিয়ে সতর্কতার সাথে ধীরে ধীরে সামনে এগিয়ে যেতে। দিগন্তে ভোরের আলো ফুটছে। তাহেরের হাতে কোনো আর্মস নেই। তার হাতে সর্বক্ষণিক সঙ্গী সেই গলফ স্টিক। তার আশে পাশে তার পারসোনাল সিকিউরিটির যোদ্ধাদের কারো কাছ থেকে প্রয়োজনে অস্ত্র নেবেন তাহের ব্যবস্থা তেমনই।
তাহের যখন এগোচ্ছেন পাশের আখক্ষেত থেকে এবং পেছনের বাঙ্কারগুলো থেকে তুমুল গুলিবর্ষণ হচ্ছে তখন। শত্রু সীমানার ভেতর ঢুকে গেছেন তাহের। একটা প্রবল উত্তেজনা তাকে ভর করে। কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে তাহের হঠাৎ তার হাতের গরু স্টিকটি ফেলে দিয়ে পাশে অবস্থান নেওয়া বেলালের কোম্পানির একজন যোদ্ধার কাছ থেকে চাইনিজ এসএমজিটি হাতে তুলে নিয়ে ফায়ার করতে শুরু করেন। বেলাল, বাহারকেও বলেন, তিনি যে রেঞ্জে ফায়ার করছেন ঠিক সে একই রেঞ্জে তারাও যেন ফায়ার করতে থাকে। বেড়ে যায় গোলাগুলির তীব্রতা। তাহেরকে এগিয়ে আসতে দেখে পেছন পেছন ভারতের মেজর এস আর সিংও একটা জীপে ৱিকুয়ারলেস রাইফেল নিয়ে এগিয়ে এসে খানিকটা দূরে অপেক্ষা করতে থাকেন। তাহের ইশারায় বেলালকে বলেন : এস আর সিংকে গিয়ে বলল আরও একটু সামনে এগিয়ে আসতে একটু পরেই আমি পাকিস্তানি বাঙ্কারে হিট করব আর এজন্য আমার রিকুয়ারলেস রাইফেল দরকার।
তাহের জানেন পাকিস্তানি বাঙ্কারের যে কংক্রিট সেগুলো শুধু রিকুয়ারলেস রাইফেল দিয়ে আঘাত করলেই ভেদ করা সম্ভব। এগিয়ে আসেন মেজর সিং। তাহের তার কাছে থেকে রিকুয়ারলেস রাইফেল হাতে নিয়ে এগিয়ে যান এবং সরাসরি বাঙ্কারে গুলিবর্ষণ করতে থাকেন। পেছনের কমান্ডিং পজিশন ছেড়ে সেক্টর কমান্ডার তখন যুদ্ধের মধ্যবিন্দুতে। বেলাল, বাহার খানিকটা পেছনে একটা আম গাছের আড়ালে। তারা দেখতে পান পাকিস্তানিরা সামনের বাঙ্কার থেকে বেরিয়ে চলে যাচ্ছে পেছনের বাঙ্কারে। অনেকে ঢুকে যাচেই পাশের আখক্ষেতে। বোঝা যাচ্ছে নিশ্চিতভাবে পিছু হটছে তারা। বেলাল, বাহার এবং তাহের এগোতে এগোতে পাকিস্তানি বাহিনীদের প্রথম বাঙ্কারটি দখল করে ফেলেন। উত্তেজিত বাহার ওয়াকিটকিতে সবাইকে জানিয়ে দেন তাদের প্রথম বাঙ্কার দখলের খবর। পাকিস্তান বাহিনীরা রিইনফোর্সমেন্টের জন্য ওদিকে বন্সিগঞ্জ থেকে সৈন্য পাঠায়। কিন্তু তাদের ঠেকিয়ে দেয় বক্সিবাজার সড়কে পজিশান নিয়ে থাকা মারাঠা রেজিমেন্টের অ্যামবুশ। যোগাযোগের পথ ধ্বংস হয়ে যাওয়াতে কামালপুর বক্সিবাজার থেকে বিছিন্ন হয়ে পড়ে। ফলে সেখান থেকে সাহায্য পাওয়ার পথ বন্ধ হয়ে যায় পাকিস্তানিদের।
সকাল প্রায় সাতটা তখন। কামালপুরের অনেকটা ভেতরে ঢুকে গেছে মুক্তিবাহিনী। তারা এগোচ্ছেন প্রচুর পাকবাহিনী এমনকি মুক্তিযোদ্ধার মৃতদেহ ডিঙিয়ে। ভয়াবহ গোলাগুলির মধ্যে পড়ে একই সাথে পাকবাহিনী এবং মুক্তিযোদ্ধা উভয়ই নিহত হচ্ছে একের পর এক। দখল করে নেওয়া বাঙ্কারের সামনে উঁচু একটা ঢিবির মতো জায়গা দেখা যায়। টিপিটা বানানো হয়েছে বাঙ্কারের প্রতিরক্ষার জন্য। সেই উঁচু জায়গায় গিয়ে বসেন তাহের। উত্তেজনা, আত্মবিশ্বাস তার মধ্যে। আবার তিনি হাতে তুলে নিয়েছেন তার সেই গলাফ স্টিক। এক মুক্তিযোদ্ধা হঠাৎ দৌড়ে এসে পাকিস্তানিদের বাঙ্কার থেকে দখল করা একটি মেশিনগানের গুলির চেইন মালার মতো করে পরিয়ে দেয় তাহেরকে, বলে—জন্মদিন কর্তা।
সেদিন ১৪ই নভেম্বরের ভোর। তাহের মুচকি হেসে বলেন : জলদি পজিশনে ফিরে যাও।
পাকিস্তানিরা পাশের আখ ক্ষেতে লুকিয়ে অবিরাম ফায়ার করছে। তাহের উঁচু চিবিতে বসে তার গলফ স্টিক দিয়ে মিজান, বেলাল, বাহারের কোম্পানিকে নির্দেশনা দেন কোনো কোনো দিকে ফায়ার করতে হবে। খুবই ঝুঁকিপূর্ণ একটি জায়গায় তখন বসে আছেন তাহের। সামনে আরও ৭/৮টি বাঙ্কার। সে বাঙ্কার গুলোও অচিরেই দখল করার পরিকল্পনায় দ্রুত পদক্ষেপ নিতে থাকেন তাহের।
চায়ের ফ্লাস্ক নিয়ে পেছনে আছেন আনোয়ার আর ডালিয়া। ওয়াকিটকিতে তারা শুনছেন একের পর এক বাঙ্কার দখলের খবর। উত্তেজনায় কাঁপেন তারা। হঠাৎ বিকট একটা আওয়াজ শুনতে পান আনোয়ার, ডালিয়া। আনোয়ারের মনে হয় হয়তো কোনো শেল ড্রপ হয়েছে কিংবা বাস্ট হয়েছে এন্টিপারসোনাল মাইন। চায়ের ফ্লাস্ক ফেলে দুজনই দৌড় দেন সামনের দিকে।
উঁচু টিপিতে বসে থাকা তাহের নামতে উদ্যত হবার মুহূর্তেই সেখানে বস্তুত একটি শেল ড্রপ হয়। তাহেরের সবচেয়ে কাছে ছিলেন বেলাল আর বাহার। তারা তখন তার পারসোনাল সিকিউরিটির দায়িত্বে। তারা হঠাৎ দেখেন উঁচু ঢিপি থেকে ঢলে পড়ছেন তাহের। ওয়াকিটকিতে ধরা পড়ে পাশের আখক্ষেতে পাকিস্তানি সেনারা উল্লাস করে বলছে ইয়া আলি। কমান্ডার ধরনের কাউকে ঘায়েল করা গেছে বুঝতে পেরেছে তারা, তাতেই তাদের উল্লাস।
তাহেরকে ঢলে পড়তে দেখে দৌড়ে ছুটে যান বেলাল! ভালোমতো লক্ষ করে দেখতে পান তাহেরের একটা পা থেতলে দুভাগ হয়ে ঝুলছে। মুহূর্তের জন্য কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন তিনি। উত্তেজনায় ওয়াকিটকিতে হঠাৎ বলে বসেনঃ কর্তা মারা গেছেন, কমান্ডার হেজ বিন কিলড।
একথা ওয়াকিটকিতে প্রচার হওয়ার সাথে সাথে হঠাৎ করে মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষ থেকে সব ফায়ার বন্ধ হয়ে যায়। ধুন্ধুমার রণাঙ্গনের মধ্যে সহসা নেমে আসে গাঢ় নিস্তব্ধতা। সবাই হতভম্ব, স্তম্ভিত। কি করবে বুঝে উঠতে পারে না কেউ।
কয়েক মুহূর্ত এভাবে কাটবার পর বাহার তার এলএমজ্জি থেকে আখক্ষেত লক্ষ করে আবার শুরু করেন ফায়ার। বেলালকে বলেন, তাড়াতাড়ি কর্তাকে পেছনে নিয়ে যাও। ইতোমধ্যে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা রাইফেল ফেলে দৌড়ে গিয়ে পাশের একটি বাড়ির বাঁশের তৈরি বেড়ার দরজা খুলে নিয়ে আসেন। বেড়াটিকে স্টোর বানিয়ে তার উপর তাহেরকে শুইয়ে দৌড়ে তাকে নিয়ে যেতে থাকেন ভারতীয় সীমান্তের ভেতরে। তাহেরের পা থেকে রক্তক্ষরণ হচ্ছে প্রচণ্ড। একজন মুক্তিযোদ্ধা তার শার্ট খুলে দুভাগ হয়ে যাওয়া তাহেরের পাটিকে বেঁধে দেন।
বেশ খানিকটা দুরে তাদের হেডকোয়ার্টার। বেলাল ঐ বেড়ার স্ট্রেচারের এক প্রান্ত ধরে দৌড়াতে দৌড়াতে ভাবে, যে কোনো সময় হয়তো ভেঙ্গে পড়তে পারে বেড়াটি। হঠাৎ তার মনে হয় এস আর সিং এর জীপটির কথা। অনেকটা পেছনে আছেন সিং। আরেক সহযোদ্ধার হাতে স্টেচারটি দিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে তিনি ছুটে যান জীপটির কাছে। প্রতিটি মুহূর্ত মূলান। ওদিকে পেছনে অখাক্ষেত লক্ষ করে ফায়ার করে চলেছেন বাহার।
ওয়াকিটকিতে শুনে পেছন থেকে ছুটে এসেছেন আনোয়ার আর ডলি। বেড়ার স্ট্রেচারে বহন করে নেওয়া তাহেরের পাশে পাশে দৌড়াতে থাকেন তারা। আতংকে তাকিয়ে থাকেন ছিন্ন ভিন্ন বাম পাটির দিকে। পা পেঁচিয়ে রাখা শার্টটি ভিজে রক্ত চুঁইয়ে পড়ছে মাটিতে। স্ট্রেচার বহন করা প্রতিটি যোদ্ধার চোখে পানি। আনোয়ারকে দেখে পানি খেতে চান তাহের। আনোয়ার তার কাঁধে রাখা ব্যাগ থেকে বোতল বের করে তার মুখের সামনে ধরলে তাহের বোতলটি নিজের হাতে তুলে নিয়ে বলেন : আমার হাত দুটা তো এমনও ঠিক আছে।
ওয়াকিটকিতে খবর পেয়ে টেপরেকর্ডার বন্ধ করে ছুটে আসে সাংবাদিক হারুন হাবীব। তিনিও হাত লাগান স্টেচারে। জ্ঞান হারাননি তাহের, রক্তে মাটি ভিজে যাচ্ছে। ঐ অবস্থায় মুখটা ঘুরিয়ে সামান্য হেসে হারুন হাবীবকে বলেন : জার্নালিস্ট আমি বলিনি ওরা কখনো আমার মাথায় আঘাত করতে পারবে না। এই দেখো পায়ে লাগিয়েছে। মাই হেড ইজ স্টিল হাই, গো ফাইট দি এনিমি, ওকুপাই কামালপুর বিওপি।
ইতোমধ্যে বেলাল এস আর সিং এর জীপটি নিয়ে আসেন। দ্রুত জীপে উঠানো হয় তাহেরকে। জীপে উঠেই তাহের বেলালকে বলেন, ওয়াকিটকিটা আমার মুখের সামনে ধরা। বেলাল ওয়াকিটকিটা মুখের সামনে ধরলে রক্তাক্ত, শায়িত তাহের মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দেশে বলতে থাকেন–আমার কিছুই হয়নি, তোমরা ফ্রন্টে ফিরে যাও, যুদ্ধ চালিয়ে যাও … কামালপুর মুক্ত করতে হবে মনে রেখে আমি মরব না, খুব দ্রুত চলে আসছি তোমাদের কাছে। পাকিস্তানিদেরকে তোমাদের হারাতেই হবে। আমি যেন ফিরে এসে দেখি কামালপুর দখল হয়েছে আর ঢাকার রাস্তা পরিষ্কার।
ওয়াকিটকি রেখে আনোয়ারকে বলেন : তাড়াতাড়ি হেলিকপ্টারের ব্যবস্থা করো।
ইতোমধ্যে আরও ভারতীয় অফিসাররা ছুটে আসেন। ছুটে আসেন সেদিনের অপারেশনের মেডিকেল টিমের প্রধান ডা. দীপঙ্কর রায়। জীপে উঠেই তিনি দ্রুত তাহেরের ফাস্ট এইড এর ব্যবস্থা করেন। সর্বোচ্চ তৎপরতায় দ্রুততম সময়ে ভারতীয় ব্রিগেডিয়ার ক্লেয়ার হেলিকপ্টারের ব্যবস্থা করেন। কিন্তু হেলিকপ্টার আসবে তুরায়। কামালপুর থেকে তুরায় যেতে হবে আগে, দূরত্ব প্রায় ১৮ মাইল। জীপ ছুটে চলে তুরার দিকে। পাহাড়ি পথ, তাহেরের রক্তক্ষরণ হচ্ছে প্রচণ্ড। কিন্ত শক্ত মনোবল তাহেরের। জীপের ভেতরে অনবরত কথা বলে চলেন তিনি।
ওদিকে তাহেরের আহত হওয়ার সংবাদে কামালপুর যুদ্ধক্ষেত্রে একটা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়ে যায়। কমান্ডার নেই যুদ্ধক্ষেত্রে, মনোল হারিয়ে ফেলেন সবাই। অনেকেই অস্ত্র ফেলে পিছু হঠতে থাকেন। পাকবাহিনীর এলোপাতাড়ি গুলিতে বেশ কিছু মুক্তিযোদ্ধা মারা যান এর মধ্যে। কিছু মুক্তিযোদ্ধা তখনও ফায়ার চালিয়ে যান। নেতৃত্বের অভাবে পুরো অপারেশনটিতে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। কয়েকজন ভারতীয় অফিসার এসে যুদ্ধের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু যুদ্ধ ততক্ষণে চলে গেছে পাকিস্তানিদের নিয়ন্ত্রণে। পাক সেনার গুলিতে নিহত হন তিন জন ভারতীয় অফিসার। তার পরেও মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকেন। শেষে ব্রিগেডিয়ার ক্লেয়ার এসে বলেনঃ মুক্তিযোদ্ধারা হয়তো আরও কিছুক্ষণ ফাইট দিতে পারবে কিন্তু সেক্টর কমান্ডারের অনুপস্থিতিতে এই অপারেশন চালিয়ে যাওয়া হবে বোকামি।
একটা নিশ্চিত বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে এসে ব্যর্থতার গ্লানি নিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটতে বাধ্য হয় কামালপুর থেকে থেকে।
৩৫. প্রিয় মুক্তিযোদ্ধারা
লুৎফা তখনও চকলেট আর রুমাল নিয়ে অপেক্ষা করছেন তুরায়। অপেক্ষা করছেন কখন জীপ আসবে তাকে নিতে, তিনি যাবেন কামালপুরে পতাকা উড়াতে। আর সবাই মিলে হৈ চৈ করে পালন করবেন তাহেরের জন্মদিন। কিন্তু সকাল পেরিয়ে দুপুর হয়ে যায় তবুও কোনো খবর আসে না। সারাদিন কিছু মুখে দেননি তিনি। জুলিয়াকে নিয়ে খেতে বসেন। খাওয়া শেষ করে উঠতেই দেখেন তার সঙ্গে দেখা করতে আসছেন ভারতীয় বি এস এফ তুরার অধিনায়ক কর্নেল রঙ্গলাল এবং ক্যাপ্টেন মুরালি। আগেও মাঝে সাঝে এসে দেখা করেছেন তারা কিন্তু এই অসময় তাদেরকে দেখে খানিকটা অবাক হন লুৎফা। কর্নেল রঙ্গলাল এসে বিছানায় বসেন এবং লুৎকাকেও বসতে বলেন।
রঙ্গলাল বলেন : আপনি তো জানেন যে যুদ্ধের সময় কত কিছু হয়, মানুষ আহত হয়, মানুষ মারা যায়। যুদ্ধ ব্যাপারটাই এরকম।
লুৎফা বলেন; আমার হাজবেন্ড আর্মি অফিসার আমি জানি যুদ্ধে কি হয়, আমাকে বলেন কি হয়েছে।
লুৎফা একটা দুঃসংবাদ শুনবার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করেন। ক্যাপ্টেন মুরালি বলেন : মেজর তাহেরের পায়ে একটা গুলি লেগেছে, তেমন কিছু না।
লুৎফা আরও ভয়ংকর কোনো সংবাদ শুনবেন ভেবেছিলেন। মৃত্যু তখন প্রতিদিনের আটপৌরে ব্যাপার। জিজ্ঞাসা করেন; কোথায় এখন তাহের?
ক্যাপ্টেন মুরালি বলেন : তাকে জীপে করে কামালপুর থেকে আনা হচ্ছে, এখান থেকে হেলিকপ্টারে নিয়ে যাওয়া হবে গৌহাটিতে।
কিছুক্ষণ পর আকাশ কাঁপিয়ে একটা হেলিকপ্টার নামে। তার কিছু পর চলে আসে তাহেরের জীপ। তাহেরকে সরাসরি ওঠানো হয় হেলিকপ্টারে। কর্নেল রঙ্গলাল এসে লুৎফাকে বলেন : হেলিকপ্টার এখনই রওনা দেবে গৌহাটির উদ্দেশে, আপনি এক নজর তাকে দেখে যেতে পারেন। আপনাকে আমরা পরে পাঠানোর ব্যবস্থা করছি।
লুৎফা গিয়ে ওঠেন হেলিকপ্টারে। হেলিকপ্টারের পাখার শব্দে চারদিকে প্রকম্পিত। ভেতরে গিয়ে দেখেন, বুক পর্যন্ত চাদর দিয়ে চাকা তাহেরের। একটা স্যালাইন চলছে। চোখ বন্ধ।
ডাঙার দীপঙ্কর বলেন : ঊনাকে ইনজেকশন দেওয়া হয়েছে। এখন ঘুমাচ্ছেন।
স্তব্ধ হয়ে থাকেন লুৎফা। তিনি তখনও জানেন না আঘাতের মাত্রাটা কতটুকু। জানেন না অনেক বছর পর আরেকবার তাকে এমনি চড়তে হবে হেলিকপ্টারে। সেদিনও এভাবে হেলিকপ্টারে ভেতর শুয়ে থাকবেন তাহের। প্রাণহীন।
গৌহাটি সামরিক হাসপাতালে জেনারেলদের জন্য সংরক্ষিত সবচেয়ে ভালো কেবিনটিতে রাখা হয় তাহেরকে। ভারতীয় ডাক্তাররা অত্যন্ত দ্রুততায় তার চিকিৎসার শুরু করে দেন।
পরদিন আনোয়ার একটি জীপ নিয়ে ক্ষাকে সহ তুরা থেকে রওনা দেন গৌহাটি সামরিক হাসপাতালের দিকে। শিশু জয়া, ডালিয়া, জুলিয়া তুরাতে থাকে ডা. হাই-এর স্ত্রীর হেফাজতে। সেই ডাক্তার হাই চট্টগ্রামে যার ঘরে হয়েছিল তাহের এবং সিরাজ শিকদারের বৈঠক, বিপ্লবের পরিকল্পনা, প্রশিক্ষণ। ডাক্তার হাই তখন মেজর জিয়ার জেড ফোর্স এর চিফ মেডিকেল অফিসার হিসাবে কাজ করছেন।
কর্নেল রঙ্গলাল আনোয়ারকে বলেন, আপনি মিসেস তাহেরকে পুরো ব্যাপারটি ভালোভাবে বলে রাখুন। ডাক্তাররা বলেছেন, মেজর তাহেরের পা কিছুতেই রাখা যাবে না, এমনকি তার মৃত্যুও ঘটতে পারে। উনাকে মানসিকভাবে তৈরি রাখা দরকার।
তুরা থেকে গৌহাটি প্রায় আড়াই শ মাইলের পথ। ভোরে রওনা দেন লুৎফা এবং আনোয়ার। লম্বা পথে মনে মনে আনোয়ার অনেকবার লুৎফাকে বলতে চেষ্টা করেন তাহেরের পুরো ব্যাপারটি কিন্তু কিছুতেই সাহস করে উঠতে পারেন না। দুজনে একরকম চুপচাপ পাড়ি দেন পুরো পথ। সন্ধ্যায় গিয়ে তারা পৌঁছান গৌহাটিতে। হাসপাতালে পৌঁছে আনোয়ার জানতে পারেন যে, তাহেরকে এমারজেন্সিতে রাখা হয়েছে এবং ইতোমধ্যে তার বাম পাটি হাঁটুর কাছ থেকে কেটে ফেলা হয়েছে।
আনোয়ার লুৎফাকে তাহেরের কেবিনে ঢুকবার আগে বলেন : ভাবী খুব সাহসী থাকতে হবে। একদম কোনোরকম চিৎকার, কান্নাকাটি করবেন না।
লুৎফা আনোয়ারকে বলেন : তুমি এভাবে বলছ কেন?
আনোয়ার যে কথাটি তুরা থেকে গৌহাটির এই আড়াই শ মাইল পথ বলতে পারেনি, কেবিনে ঢুকবার ঠিক আগ মুহূর্তে সেটি তিনি বলেন লুৎফাকে : ভাবী, ভাইজানের অবস্থা খুব সিরিয়াস। তার একটা পা কেটে ফেলা হয়েছে। আবারও বলছি কোনো রকম চিৎকার কান্নাকাটি করবেন না।
লুৎফা ঠিক কি করবেন, বলবেন বুঝে উঠতে পারেন না। ভুতগ্রস্থের মতো কেবিনে ঢোকেন। লুৎফাকে দেখে তাহের খুব উদ্দীপ্ত হয়ে বলতে থাকেন : ডক্টর আমার উয়াইফ এসেছে, ভাই এসেছে। ওরা সারাদিন জার্নি করেছে, ওদের একটু এন্টারটেইন করেন, একটু খাওয়ার ব্যাবস্থা করেন।
লুৎফা তাহেরের বিছানার কাছে গিয়ে বসেন। বেশ কাবু হয়ে পড়েছেন তাহের। তিনি লুৎফার হাতটা জড়িয়ে ধরেন। লুৎফা লক্ষ্য করে তাহেরের হাতে লন্ডন থেকে কিনে দেওয়া সেই আংটিটি। এক হাতে লুৎফার হাত ধরে আরেক হাতে তাহের তার শরীর ঢেকে রাখা চাদরটিকে সরিয়ে ফেলে। বলে : দেখো, দেখো আমার কি হয়েছে, আমার একটা পা নাই।
লুৎফা কিছু বলবার আগে তাহের নিজেই তাকে সান্ত্বনা দিতে থাকেন : চিন্তা করো না। নকল পা লাগিয়ে আমি ঠিকই হাঁটতে পারব।
লুৎফা প্রাণপণে সংযত করবার চেষ্টা করেন নিজেকে আনোয়ারের কথাগুলো মানে বাজে তার : কান্নাকাটি, চিৎকার করা যাবে না। কেমন যেন ঘোরের ভেতর বলতে থাকেন; অসুবিধা কি তোমার আরেকটা পা তো আছে, তোমার লাইফটা তো আছে …।
লুৎফা কি বলছে নিজেই যেন তা ঠিক বুঝে উঠতে পারেন না। একজন ডাক্তার এসে বলেন : রোগীর কাছে তো বেশিক্ষণ থাকা যাবে না। এখনও তার ইনটেনসিভ পিরিয়ড চলছে আপনারা কেবিন থেকে বাইরে যান।
তাহেরের মুঠোতে তখনও লুৎফার হাত। হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বাইরে যান লুৎফা। কেবিন থেকে বেরিয়েই লুৎফা নিজেকে আর ধরে রাখতে পারে না। বুক ফেটে কান্না আসে তার। করিডোরের একটি চেয়ারে ধুপ করে বসে পড়ে হু হু করে কাঁদতে থাকেন তিনি।
গৌহাটি সামরিক হাসপাতালে ডাক্তারদের একটি কোয়ার্টারে লুৎফা এবং আনোয়ারের থাকার ব্যবস্থা করা হয়। সকালে আনোয়ার এবং লুৎফা চলে যান হাসপাতালে। প্রচুর রক্ত দিতে হয় তাহেরকে, ব্যাগের পর ব্যাগ। দুদিন পর পর ড্রেসিং করেন নার্সরা। পায়ের হাড় বেরিয়ে গেছে, সেগুলোকে নানাভাবে সাইজ করা হয়। ড্রেসিংয়ের সময় আশপাশের অন্য রোগীরা ব্যাথায় চিৎকার করে, কিন্তু তাহের মুখে টু শব্দটি নেই। বরং তাকিয়ে তাকিয়ে নিজের ড্রেসিং দেখেন তিনি। লুৎফা তাহেরকে হুইলচেয়ারে বসিয়ে বিভিন্ন বেডে, ওয়ার্ডে ঘুরিয়ে বেড়ান। বিভিন্ন রোগীদের কুশল জিজ্ঞাসা করেন তাহের, তাদের সাহস যোগান।
নিজের কাটা পার দিকে তাকিয়ে লুৎফাকে বলেন : আমার পা দুটোর চূড়ান্ত ব্যবহার হয়েছে, কি বলো? দূরন্ত বেগে ছুটে চলা এক অশ্বারোহী থমকে গেছেন হঠাৎ। আকস্মিক এই গতিহীনতার সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা করছেন তিনি।
আনোয়ারের কাছ থেকে নিয়মিত সেক্টরের খোঁজ নেন তাহের। যুদ্ধের কোথায় কি হচ্ছে উদগ্রীব হয়ে জানতে চান। একদিন আনোয়ারকে ডেকে বলেন, কাগজ কলম নিয়ে আস, চিঠি লিখব মুক্তিযোদ্ধাদের। গৌহাটি হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে তাহের বলেন আর আনোয়ার লিখেন সেই চিঠি :
প্রিয় মুক্তিযোদ্ধারা,
‘বর্তমানে আমি অনেক ভালো। সম্পূর্ণ সুস্থ হতে আরও বেশ সময় লাগবে। কামালপুরে কিছুক্ষণের জন্যে যা দেখেছি তা অপূর্ব। তোমরা সম্মুখযুদ্ধে যে রণকৌশলের পরিচয় দিয়েছ তা যুদ্ধের ইতিহাসে বিরল। কামালপুরের যুদ্ধ মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্ব ও রনকৌশলের স্বাক্ষর। তোমরা নিয়মিত বাহিনীকেও হারিয়ে দিয়েছে। যতদিন না আবার আমি তোমাদের মাঝে ফিরে আসি, আশা করি সংগ্রাম চালিয়ে যাবে সাফল্যের পথে’।
এরপর তাহের শক্ত চিহ্নিত করা, গুপ্তঘাঁটি গড়ে তোলা বিষয়ে নানা কৌশলের পরামর্শ দেন মুক্তিযোদ্ধাদের। জানান নানা গেরিলা যুদ্ধের নীতির কথা। চিঠিতে তিনি আবার সব মুক্তিযোদ্ধাকে স্মরণ করিয়ে দেন সাধারণ জনগণকে যুদ্ধে সম্পৃক্ত করা এবং তাদের সঙ্গে শ্রদ্ধা, ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে তোলার গুরুত্বের কথা। তাদের জানান যুদ্ধে দলীয় এবং ব্যক্তিগত শৃঙ্খলা বজ্জায় রাখার গুরুত্বের কথা।
লেখেন, ‘ভুলে যেও না, তোমরা একটা পবিত্র ইচ্ছা নিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন করতে নেমেছ। বাংলাদেশ তোমাদের জন্যে গর্বিত, মনে রাখবে বাংলাদেশ গড়ার দায়িত্ব তোমাদের।
জয় বাংলা
মেজর আবু তাহের’
৩৬. মাটিলেপা মাইক্রোবাস
যদিও কামালপুর যুদ্ধে হারতে হারতেও জিতে গেছে পাকবাহিনী, কিন্তু দেশের অন্যান্য অঞ্চলে নভেম্বর থেকেই পাকিস্তান সেনারা ক্লান্ত। এক হাজার মাইল দূরের এক দেশে এসে যুদ্ধে নেমেছে তারা। এদেশের আবহাওয়া চেনে না, মানুষ চেনে না, পথঘাট চেনে না। উপরন্তু কোনো নির্দিষ্ট সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে নয় তারা যুদ্ধে নেমেছে পুরো একটা জাতির বিরুদ্ধে যেখানে সবাই এক একজন সৈনিক। কাকে রেখে কর দিকে বন্দুক তাক করবে তারা? পাকবাহিনীর ভেতরে ইতোমধ্যে দানা বেধেছে বিভ্রান্তি, অবসাদ।
এসময় পশ্চিমা নানা পত্র পত্রিকা পাকিস্তান আর্মিকে নেহাতই শক্তিহীন, জড়বুদ্ধি, অর্বাচীন হিসেবে অভিহিত করতে থাকে। পাকিস্তানে বসে ভুট্টো চাপ সৃষ্টি করতে থাকেন ইয়াহিয়ার ওপর। ইয়াহিয়াকে বলেন, দ্রুত কোনো কড়া ব্যবস্থা না নিলে জনগণ আপনাকে ফাঁসিতে ঝোলাবে।
নানারকম চাপে পড়ে এক পর্যায়ে ইয়াহিয়া খান পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে নির্দেশ দেন জম্মু-কাশ্মীরের আশপাশে একযোগে ভারতের সাতটি বিমানক্ষেত্রে বোমা নিক্ষেপ করতে। ৩রা ডিসেম্বর, সুর্যাস্তের কিছু আগে আক্রমণটি চালায় পাকবাহিনী। পূর্বাঞ্চলে ভারত পাকিস্তানি সেনার ওপর আঘাত হেনেছে আক্রমণের এই তাদের অজুহাত। তাদের হিসাবটা এমন যে একটা চূড়ান্ত কিছু বাঁধিয়ে দেওয়া যাক, তাতে করে নিশ্চয় মিত্র চীন আর আমেরিকা এগিয়ে আসবে সাহায্য নিয়ে, এ সুযোগে জম্মু কাশীরের কিছু অংশ দখল করেও নেওয়া যাবে, পৃথিবীর দৃষ্টি ফেরানো যাবে পূর্ব থেকে পশ্চিমে, আর মুক্তিযোদ্ধদের কাছে পরাজয়ের গ্লানিও থাকবে না।
এই আক্রমণ যখন চলছে ইন্দিরা গান্ধী তখন কলকাতায় একটি সভায় বক্তৃতা দিচ্ছেন। খবর পেয়েই সভা ছেড়ে তিনি চলে যান দিল্লি। জরুরি সভা ডাকেন তার মন্ত্রী পরামর্শদাতাদের সঙ্গে। বাংলাদেশকে এতদিন তার পেছন থেকে সবরকম সহায়তা দিয়ে আসছিলেন। পাকিস্তানের এই সরাসরি আক্রমণের প্রেক্ষিতে এবার সব দ্বিধা ঝেড়ে তারা মঞ্চের সামনে চলে আসবার সিদ্ধান্ত নেন।
এবার প্রকাশ্যে বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি ঘোষণা করে দেয় ভারত। তৈরি হয় ভারত বাংলাদেশ যৌথ কমান্ড! নেতৃত্বে থাকেন ভারতীয় জেনারেল মানেক শ। যৌথভাবে সাঁড়াশি আক্রমণ চালাতে থাকেন ভারতীয় সেনাবাহিনী এবং বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা।
বন্ধু হেনরি কিসিঞ্জার এগিয়ে আসেন পাকিস্তানকে সাহায্য করতে। তিনি আমেরিকার প্রশাসনকে এই যুদ্ধে আরও সক্রিয় ভূমিকা রাখবার জন্য উদ্বুদ্ধ করবার চেষ্টা করেন। কিন্তু এরকম একটা যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে গড়িমসি করেন আমেরিকার কংগ্রেসের অধিকাংশ সদস্য। চীনারাও বিশেষ এগিয়ে আসে না। তারা তখন তাদের অভ্যন্তরীণ এক অভ্যুত্থান সমস্যা নিয়ে ব্যস্ত। ৭১-এর সেপ্টেম্বরের দিকে চীনের ভাইস চেয়ারম্যান এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রী মাও সে তুং এর বিরুদ্ধে কু করবার ব্যর্থ চেষ্টা করেন। তারা পালাতে গেলে বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হন। এসব জটিলতায় পাকিস্তানের দিকে নজর দেবার সময় নেই তাদের। তাছাড়া চীনা নেতৃত্ব পাকিস্তানিদের উপর খানিকটা ক্ষেপেও আছেন তখন কারণ তার খোঁজ পেয়েছেন পাকিস্তানিরা বাংলাদেশের চীনাপন্থী কিছু নেতাদেরও হত্যা করেছে। ফলে পাকিস্তানের হিসাব মেলে না। ভারতকে আক্রমণ করার পর আমেরিকা এবং চীনের কাছে পাকিস্তান যে সহযোগিতা আশা করছিল সেটা তাৎখনিকভাবে তারা পায় না। সেই সাথে পরিশ্রান্ত পাকিস্তানি সেনারা বৈরী পরিবেশ আর অতর্কিত আক্রমণে তখন পর্যন্ত। তারা পিছু হটতে শুরু করে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলে আসে আন্তর্জাতিক আলোচনার কেন্দ্রে। ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে জাতিসংঘের অধিবেশন ডাকেন মহাসচিব বার্মার উথান্ট। অধিবেশনে আমেরিকা এই যুদ্ধের জন্য ভারতকে দায়ী করে, সোভিয়েত দায়ী করে পাকিস্তানকে। আমেরিকা যুদ্ধ বিরতির প্রস্তাব দিলে সোভিয়েত তাতে ভেটো দেয়। আবার সোভিয়েত রাজনৈতিক সমাধানের প্রস্তাব দিলে চীন তাতে দেয় ভেটো। এই পাল্টাপালি ভেটো চলতে থাকে জাতিসংঘ অধিবেশনে। ভুট্টো ক্ষেপে গিয়ে সবার সামনে অধিবেশনের কাগজপত্র ছিঁড়ে ওয়াক আউট করেন। জন্ম হয় নাটকীয় এক পরিস্থিতির।
জাতিসংঘে যখন বিতর্ক চলছে বাংলাদেশে ভারতীয় বাহিনী আর মুক্তিবাহিনীর আক্রমণ তখন হয়ে উঠেছে তীব্র থেকে তীব্রতর। ঢাকার আকাশ জুড়ে উড়তে শুরু করেছে ভারতীয় বিমান। পাকিস্তানের পক্ষে শুধু তার নিজের শক্তিতে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া হয়ে পড়ে দুরূহ। সীমান্ত অঞ্চলগুলো থেকে পিছু হটে তারা রওনা দেউ ঢাকার দিকে।
কিসিঞ্জার অবশ্য গোপনে বাংলাদেশে সামরিক হস্তক্ষেপের ব্যাপারে অব্যহত রাখেন তার পাঁয়তারা। সপ্তম নৌবহরকে বঙ্গোপসাগরে যাত্রার জন্য প্রস্তুত রাখেন তিনি, যাতে প্রয়োজনে সেখান থেকে বিমান আক্রমণ করা যেতে পারে। পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে সোভিয়েত ইউনিয়নও তাদের যুদ্ধজাহাজ তৈরি রাখে ভারত সাগরে। একটা প্রলয়ংকরী যুদ্ধের আভাস। আমেরিকা, রাশিয়া, চীন যার যার স্বার্থ মোতাবেক অবস্থান নিয়েছে বাংলাদেশের যুদ্ধ বিষয়ে একটা আশঙ্কা চারদিকে, বাংলাদেশকে ঘিরে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বেধে যাবে কি?
কিন্তু পাকিস্তানি বাহিনী যুদ্ধের উপর ক্রমশ হারাতে থাকে তাদের নিয়ন্ত্রণ। এক পর্যায়ে যশোর ক্যান্টনমেন্ট দখল করে নেয় ভারত বাংলাদেশ যৌথবাহিনী। পতন ঘটে সিলেট শহরেরও। যে কোনো বিদেশি সাহায্য আসবার আগে ভারত বাংলাদেশ যৌথবাহিনী সর্বাত্মক হামলা চালিয়ে মনোবল ভেঙ্গে দিতে চায় পাকিস্তানিদের। ঢাকা শহরের প্রায় সব এলাকায় তীব্র হয়ে ওঠে গেরিলা আক্রমণ। এই ডামাডোলের মধ্যে ইয়াহিয়া খান বাংলাদেশে একটা বেসামরিক সরকার প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালান। ভা, মালেককে তিনি নিযুক্ত করেন বাংলাদেশের গভর্নর। দায়িত্ব পেয়ে ড, মালেক ঢাকার গভর্নর হাউজে যেদিন মিটিংয়ে বসেন সেদিন ঐ মিটিংয়ের মাঝখানে গভর্নর হাউজে বোমাবর্ষণ করে ভারতীয় বিমান মিগ-২১। ভীত মালেক গভর্নর হাউজে বসেই পদত্যাগপত্র লেখেন এবং পালিয়ে হোটেল ইন্টারকনে আশ্রয় নেন। বুঝতে আর কারো বাকি থাকে না যে যুদ্ধ পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। এক পর্যায়ে জেনারেল রাও ফরমান আলী আত্মসমর্পণের প্রস্তাব পাঠান ইয়াহিয়াকে। ইয়াহিয়া প্রত্যাখ্যান করেন সে প্রস্তাব। বলেন যুদ্ধ চালিয়ে যেতে। তার বিশ্বাস যুদ্ধে তিনি জিতবেন। তিনি রাও ফরমান আলীকে ভরসা দেন যে আমেরিকার সপ্তম নৌবহর আসছে এবং অচিরেই চীনের সাহায্যও চলে আসবে।
কিন্তু বাংলাদেশকে ঘিরে একটা যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বার ঝুঁকি নিতে আমেরিকা, চীন কেউই আর উদ্যোগী হয় না। এপর্যায়ে ভারতীয় বিমান ঢাকা এয়ারপোর্ট, চিটাগাং এবং মংলা সমুদ্রবন্দরও ধ্বংস করে দেয় যাতে পাকিস্তানি সেনারা পালিয়ে যেতে না পারে। নয় মাসের যুদ্ধের শেষ অঙ্ক অভিনীত হচ্ছে তখন।
উটপাখির মতো বালুতে মাথা গুজে থাকবার দিন ফুরায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর। যুদ্ধে জিতবার যে আর কোন সম্ভাবনা নেই তা ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে ওঠে তাদের কাছে। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকেই এক এক করে শত্রুমুক্ত হতে থাকে বাংলাদেশের নানা অঞ্চল। এক পর্যায়ে ইয়াহিয়া আত্মসমর্পণকে অনুমোদন করেন। দিন ঠিক হয় ১৬ ডিসেম্বর। পাক সেনারা দেশের নানা অঞ্চলে ছড়িয়ে থাকা তাদের ক্যাম্প ছেড়ে জড়ো হতে থাকে ঢাকায়। সময় ফুরিয়ে আসছে দ্রুত। পাকবাহিনী তাদের শেষ তৎপরতা চালায়। তড়িঘড়ি মেরামত করে এয়ারপোর্ট এবং সম্ভাব্য সবকিছু ঢাকা থেকে চালান করতে শুরু করে পশ্চিম পাকিস্তানে। চালান করে বিপুল মালামাল, অস্ত্র, যুদ্ধ বিমান সবকিছু। পুড়িয়ে দেয় বাংলাদেশের স্টেট ব্যাংকের সবকটি টাকা।
আর ডিসেম্বরের ১৪ তারিখ মাটি দিয়ে লেপা কিম্ভূত কয়েকটি মাইক্রোবাস বের হয় ঢাকার পথে। মাইক্রোবাসগুলো বেছে বেছে গিয়ে দাঁড়ায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয়ের কিছু শিক্ষক, কয়েকজন ডাক্তার, কিছু বুদ্ধিজীবীর বাসায়। একটি গাড়ি এসে দাঁড়ায় চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডা. আলীমের বাসার সামনে। গাড়ি থেকে কিছু ছেলে নামে এবং ডা. আলীমকে তাদের মাইক্রোবাসে আসতে বলে। তার স্ত্রী শ্যামলী নাসরীনকে বলে–কাজ হলেই ডাক্তার সাহেবকে ফেরত পাঠানো হবে। ডা. আলীমের নিচতলায় আশ্রয় নিয়েছেন পাকিস্তানিদের দোসর মাওলানা মান্নান। শ্যামলী ছুটে যান তার কাছে। মাওলানা বলেন, চিন্তা নাই ওরা আমার পরিচিত। শ্যামলী দেখেন ডা. আলীমকে নিয়ে মাটি লেপা মাইক্রোবাসটি চলে যাচ্ছে তাদের বাড়ির গেট ছেড়ে। এভাবেই ডিসেম্বরের ১৪ তারিখ সেই মাটিলেপা মাইক্রোবাস আরও কয়জন বুদ্ধিজীবীকে তাদের ঘর থেকে উঠিয়ে নিয়ে রওনা দেয় অজানায়।
যেমন হিসাব করেছিল তাহের ঠিক তেমনটিই ঘটে। ১১ নং সেক্টরের ভারতীয় ৯৫ মাউন্টেন ব্রিগেডের ব্রিগেডিয়ার ক্লেয়ারই জামালপুর, টাঙ্গাইল হয়ে তার সঙ্গী সাথী নিয়ে ঢাকায় ঢোকেন প্রথম। যেমনটি পরিকল্পনা হয়েছিল ঠিক সেভাবেই ভারতীয় প্যারাট্রুপার টাঙ্গাইলের মধুপুরে প্যারাসুট ড্রপ করে। তাদের সঙ্গে যোগ দেয় স্থানীয় যুদ্ধবীর কাদের সিদ্দিকী। সবই হচ্ছে যা হবার কথা ছিল, কেবল নেই তাহের। গৌহাটির হাসপাতালে দিন গুনছেন তিনি। তাহের নেই কিন্তু ক্লেয়ারের সঙ্গে আছে তার ভাই সহযোদ্ধা আবু ইউসুফ।
১৬ ডিসেম্বর। ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে তখন আত্মসমর্পণের আয়োজন চলছে। এর আগে মাউন্টেন ব্রিগেডের কয়েকজন অফিসারের সাথে আৰু ইউসুফ গেছেন পাকিস্তান বাহিনীর ১৪তম ডিভিশনের হেডকোয়ার্টারে, নিয়াজীর সদর দপ্তরে। বাইরে রাখা নিয়াজীর স্টাফ কার। আবু ইউসুফ হঠাৎ গভীর এক ক্ষোভ থেকে খুলে নেন নিয়াজীর গাড়ির পতাকা। যে পতাকা এতদিন দর্পভরে উড়ত পাকবাহিনী প্রধান নিয়াজীর গাড়িতে তখন তা ইউসুফের হাতের মুঠোয়। একটা ঐতিহাসিক দলিলের মতো সেটি আজীবন আগলে রাখেন ইউসুফ।
তাহেরের অন্য যোদ্ধা ভাইরাও ততক্ষণে রওনা দিয়েছেন স্বাধীন দেশের মাটি স্পর্শ করতে। বেলাল, বাহার সীমান্ত পাড়ি দিয়ে রওনা দেন কাজলার দিকে। সাঈদ চড়ে বসেন সাংবাদিক হারুন হাবীবের মোটরসাইকেলে পেছনে। তাদের মোটরসাইকেল সাঁই সাঁই করে জামালপুর হয়ে রওনা দেন ঢাকার পথে, বুকে তাদের বিজয়ের অদ্ভুত অনুভব। আনোয়ার তখন তাহেরর সঙ্গে গৌহাটির হাসপাতালে।
পাকবাহিনী অধিনায়ক লে. জেনারেল নিয়াজী রেসকোর্স মাঠের মাঝখানে রাখা টেবিলটির সাময়ের চেয়ারে বসেন, বসেন যৌথ কমান্ডের পূর্বাঞ্চলীয় অধিনায়ক লে. জেনারেল অরোরাও। মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক ওসমানী তখন সিলেটে। তাকে খবর পাঠনো নিয়ে নানা জটিলতা দেখা দেয়। তাছাড়া ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রধান মানেক শ নেই, সেখানে বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনী প্রধান ওসমানী থাকা প্রোটকলসম্মত কিনা সে প্রশ্নও ওঠে। আর তাদের কাছে পাকিস্তান বাহিনীর আত্মসমর্পণের এই ঐতিহাসিক সুযোগটিও বা ভারতীয় বাহিনী হাতছাড়া করবে কেন? ফলে ওসমানী ১৬ ডিসেম্বরের রেসকোর্সে অনুপস্থিত। বদলে কলকাতা থেকে হেলিকপ্টারে আসেন মুক্তিবাহিনীর সহ অধিনায়ক এ কে খন্দকার।
আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করে জেনারেল নিয়াজী তার কোমরে রাখা রিভলবারটি অরোরার হাতে সমর্পণ করেন। শীতের বিকেল। সন্ধ্যা নামছে। শেষ হয়ে আসছে একটি জনপদের ইতিহাসের বীভৎস অধ্যায়। উন্মুক্ত হচ্ছে নতুন দৃশ্যপট। টেবিলের কাছে দাঁড়ানো ভাগ্যবানরা দেখেন সেই ক্রান্তির মুহূর্তটি।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে এম আর আখতার মুকুল পড়েন তার শেষ চরমপত্র।
কি পোলারে বাঘে খাইলো? শ্যাষ। আইজ থাইকা বঙ্গাল মুলুকে মছুয়গো রাজত্ব শেষ।… আট হাজার আস্টশ চুরাশি দিন আগে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট তারিখে মুছলমান মুছলমান ভাই ভাই কইয়া করাচি লাহুর পিন্ডির মছুয়া মহারাজরা বঙ্গাল মূলুকে যে রাজত্ব কায়েম করছিল আইজ তার খতমে তারাবি হইয়া গেল।
ঢাকার পথে পথে উৎফুল্ল মানুষ জড়িয়ে ধরেন ভারতীয় বাহিনী, মুক্তিযোদ্ধা বিজয়ীদের। শরণার্থী শিবিরে শিবিরে মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়েন রেডিওর সামনে। শুধু শ্যামলী চৌধুরী ভিড়ের মধ্যে খোঁজেন তার প্রিয় মুখ ডা, আলীমকে। মাত্র দুদিন আগে সেই মাটি লেপা মাইক্রোবাস সেই যে তাকে নিয়ে গেছে, ফেরেননি তিনি আর। বিজয়ের এই আশ্চর্য মুহূর্ত স্বামীর সঙ্গে ভাগ করে নেবেন বলে হন্যে হয়ে খুঁজতে থাকেন তাকে। ডা. আলীমকে অচিরেই পাওয়া যাবে হাত, চোখ বাঁধা অবস্থায় রায়ের বাজার বধ্যভূমির কাদায় গুলিবিদ্ধ পড়ে আছেন আরও অগণিত স্বনামধন্য শিক্ষক, সাংবাদিক, পেশাজীবীদের লাশের পাশে। চূড়ান্ত পরাজয়ের আগে মাটিলেপা মাইক্রোবাস এক এক করে দেশের মেধাবী মানুষকে চোখ বেঁধে এনে দাঁড় করিয়েছে এই বধ্যভূমিতে।
সেদিন রাতে সবচেয়ে আনন্দ আর সবচেয়ে বেদনার এক অভূতপূর্ব মিশ্র অনুভুতি নিয়ে ঘুমাতে যায় একটি বিহ্বল জাতি।
৩৭. বিষণ্ণ বিজয়
দেশ যখন স্বাধীন হচ্ছে তাহের তখন গৌহাটির হাসপাতালে। সাথে লুৎফা আর আনোয়ার। হাসপাতালের বিছানায় শুয়েই ১৬ ডিসেম্বর রেডিওতে নিয়াজীর আত্মসমর্পণের বিবরণী শোনেন তাহের। রেডিওতে মানুষের উল্লাসধ্বনি। কিন্তু তাহেরকে দেখায় বিষণ্ণ।
লুৎফা বলেন : তুমি আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে থাকতে পারলে না বলে মন খারাপ করছো?
তাহের বলেন; তা না। মন খারাপ অন্য কারণে। যুদ্ধটা আসলে হাতছাড়া হয়ে গেল। ঠিক স্বাভাবিক বিজয় হলো না আমাদের। একটা নতুন দেশের জন্ম হলো ঠিকই কিন্তু হলো অনেকটা ফোরসেপ ডেলিভারির মতো, অন্যের সাহায্য নিয়ে।
আনোয়ারকে বলেন তাহের : আমাদের কাজ কিন্তু অসম্পূর্ণ রয়ে গেল আনোয়ার। ভেবেছিলাম যুদ্ধটা আরেকটু প্রলম্বিত হবে, ভিয়েতনামের মতো আমরা কমিউনিস্ট ওয়ারের দিকে যাবো। সেটা হলো না। জানি না, স্বাধীন দেশ কোনো দিকে যাবে। আমাদের যুদ্ধ কি শেষ হলো না আনোয়ার।
৩৮. শূন্য সিংহাসন
ব্রিটিশরা এশিয়া আফ্রিকার কত কত দেশ শাসন করেছে এবং যাবার আগে তৈরি করে দিয়ে গেছে নিজেদের মতো মানচিত্র। একই কাজ তারা করেছে ভারতেও। কিন্তু ইতিহাসে এই প্রথম একটি দেশ তাদের বেধে দেওয়া মানচিত্রকে অস্বীকার করল। খটকার মানচিত্র ছিঁড়ে দেখা দিল নতুন নামে দেশ, বাংলাদেশ।
নতুন দেশ হলো কিন্তু তখনও সে দেশের কোনো অভিভাবক নেই, প্রশাসন নেই। কিছু ভারতীয় উপদেষ্টা এবং কয়েকজন বাংলাদেশী আমলা মিলে ১৬ ডিসেম্বরের পর এই নতুন দেশের প্রশাসন চালু করবার প্রাথমিক কাজগুলো গুরু করলেন। তাজউদ্দীনের নেতৃত্বে প্রবাসী সরকার কলকাতা থেকে ঢাকায় আসেন আরও কিছুদিন পর, ২২ ডিসেম্বর। প্রথম যেদিন একটা নতুন দেশের দাপ্তরিক কাজকর্ম শুরু হলো সেদিন রোববার। তখনকার হিসাব মতো সেটা ছুটির দিন। কিন্তু এত দাম দিয়ে কেনা একটা দেশ একটু নাড়া চাড়া করে দেখবার জন্য ছুটির দিন আর কাজের দিনের হিসাব করলে কি আর চলে? তাজউদ্দীন তার পরিষদ নিয়ে শুরু করলেন এই নতুন রাষ্ট্র পরিচালনার যাত্রা। নানা আসনে বসল বটে কিন্তু সিংহাসনটা রইল বালি। সিংহাসনের মানুষটি তখনও বন্দি। সবাই অপেক্ষা করছেন তার জন্য।
২৫ মার্চ গ্রেফতারের পর শেখ মুজিবকে নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে। পাক সামরিক ওয়ারলেসে খবর আসে পাখি এখন আঁচায়। এরপর তাকে নিয়ে যাওয়া হয় পশ্চিম পাকিস্তানে রাওয়ালপিন্ডি থেকে এক শ পঞ্চাশ মাইল দক্ষিণে লায়ালপুর জেলে, সেখান থেকে মিয়ানওয়ালী জেলে। বাইরের জগত থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন রাখা হয় তাকে। কোনো পত্র, পত্রিকা পড়বার, রেডিও শুনবার, টেলিভিশন দেখবার সুযোগ দেওয়া হয় না তাকে। কারাগারের কক্ষের ছোট্ট ভেন্টিলেটরের গরাদে আকাশ দেখে কাটে তার দিন আর রাত। বিচার হয় শেখ মুজিবের। মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় তাকে। কারাগারের ভেতর কবর খুড়তে দেখেন তিনি। কিন্তু পাকিস্তানের আত্মসমর্পণে উল্টে যায় সব হিসাব। ১৬ ডিসেম্বরের শীতের রাতে ঘুমাতে যাবার জন্য মিয়ানওয়ালী জেলের কম্বলে শেখ মুজিব যখন জড়াচ্ছেন তার শরীর তখনও তিনি জানেন তার নামে যুদ্ধ করে একটি নতুন দেশের জন্ম দিয়েছে তারই দেশের মানুষ। আরও সপ্তাহখানেক পর জানানো হয় তাকে। জেল থেকে মুক্তি পান তিনি। নয় মাস বন্দি জীবন কাটিয়ে পাকিস্তান থেকে লন্ডন, দিল্লি হয়ে ঢাকার পথে রওনা দেন শেখ মুজিব।
একটি রুপালি কমেট বিমানে ১০ জানুয়ারি দুপুর শেখ মুজিব অবতরণ করেন ঢাকায়। বিমানবন্দরের চারদিকে টান টান উত্তেজনা সেদিন। বিমান রানওয়েতে নামলে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের গার্ড দলকে পেরিয়ে হাজার হাজার মানুষ ঘিরে ফেলে বিমানটিকে। বিমানের দরজা খুলে দাঁড়ান শেখ মুজিব। রোগা হয়েছেন তিনি, তার ব্যাকব্রাশ করা চুল অবিন্যস্ত। দশ মিনিটের মতো চেষ্টা করেও বিমান থেকে নামতে পারছিলেন না তিনি। প্লেনের সিঁড়ি থেকে নামবার আগেই তাকে মালা পড়ার প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। মানুষের ভিড় ঠেলে বিমানবন্দর থেকে রেসকোর্স মাঠে আসতে আড়াই ঘণ্টার মতো সময় লেগে যায় তার। মঞ্চে দাঁড়িয়ে তিনি বলেন, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, সাত কোটি বাঙালিরে হে মুগ্ধ জননী রেখেছ বাঙালি করে মানুষ করোনি। কবিগুরুও কথা মিথ্যা প্রমাণ হয়ে গেছে। … আমার বাংলাদেশ আজ স্বাধীন হয়েছে, আমার জীবনের সাধ আজ পূর্ণ হয়েছে, আমার বাংলার মানুষ আজ মুক্ত হয়েছে। আবেগাপুত হয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন মুজিব।
বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষ তাকিয়ে আছে এই একটি মানুষের দিকে। কিন্তু শেখ মুজিব তখন নয় মাসের ঘুম থেকে ওঠা এক রিপভ্যান উইংকেল যিনি জানেন না তার ঘুমন্ত অবস্থায় বদলে গেছে তার দেশ।
৩৯. রিপভ্যান উইংক্যাল
শেখ মুজিব যথন জেলের চার দেয়ালে বন্দি তখন একভূতপূর্ব অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেছে পুরো বাংলাদেশ। এমন আশ্চর্য সময় আর কখনো আসেনি এদেশের মানুষের জীবনে। যে আকাশ পথে তিনি বিমানে চড়ে দেশে ফিরলেন, সে আকাশ পথেই তখন এক এক ফিরে যাচ্ছে অগণিত শকুন। বাংলাদেশের আকাশ গত নয় মাস ধরে ছেয়ে রেখেছিল এইসব শকুন। তারা লোলুপ চোখে চেয়ে থেকেছে নদীতে ভেসে যাওয়া কিংবা বাড়ির উঠানে স্তৃপকৃত হয়ে থাকা লাশের দিকে। এই নরহত্যার উৎসবের সাক্ষী হয়ে এখন তারা ধীরে ধীরে চলে যাচ্ছে অন্য আকাশ।
ওদিকে মাটিতে বেঁচে থাকা, পালিয়ে বেড়ানো লক্ষ মানুষ ফিরছে তাদের বাস্তু ভিটায়। বিরান বাস্তু ভিটায় তারা খুঁজে পাচ্ছে মানুষের কংকাল। খেলনা ভেবে মাথার খুলিকে হাতে তুলে নিচ্ছে শিশু।
একটা রণক্লান্ত জাতি, বিধ্বস্ত দেশ আর নিঃস্ব সরকারের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিলেন শেখ মুজিব। লন্ডনে যাত্রা বিরতির সময় তার পূর্ব পরিচিত বাংলাদেশের পক্ষাবলম্বী পাকিস্তানি সাংবাদিক এ্যান্থনী ম্যাসকার্নহেসকে মুজিব বলেন, দেশে ফিরে আমি আগে সবকটা জেলা ঘুরতে চাই। বাংলাদেশের সবকটা মানুষের মুখ আমি দেখতে চাই আগে।
যদি পারতেন তাহলে হয়তো পুষিয়ে নিতে পারতেন তার নয় মাসের সুপ্তিকাল। কিন্তু সে সুযোগ তার আর হয়নি। তার সামনে সমস্যার পাহাড়। উঁচু পাহাড়ের একেবারে পাদদেশে কতিপয় শেরপা অপেক্ষা করছে পাহাড় ডিঙ্গানোর জন্য, তিনি তাদের নেতা। তাকে সেই ফুরসত কেউ দেয়নি আর।
দেশের হাজার হাজার মাইলের প্রায় সব রাস্তা-ঘাট, ব্রিজ, কালভার্ট, রেল লাইন ক্ষত বিক্ষত, কি করে দ্রুত এগুলোকে চালু করা যায়?
চলে যাবার আগে পাকিস্তানিরা হিসাব-নিকাশ, প্রশাসন কিছুই বুঝিয়ে দিয়ে যায়নি। ভেঙ্গে পড়েছে পুরো প্রশাসন ব্যবস্থা, কি করে আবার গড়ে তোলা যাবে একটি নতুন রাষ্ট্রযন্ত্র?
কল কারখানা প্রায় সব বন্ধ, কি করে চালু করা যাবে সেসব?
পাকিস্তানিরা যাবার সময় পুড়িয়ে দিয়ে গেছে সব ব্যাংক। কানাকড়ি বৈদেশিক মুদ্রা নেই, নদী, সমুদ্রবন্দর সব ধ্বংসপ্রাপ্ত, আমদানি-রপ্তানির সুযোগ নেই, কোথা থেকে আসবে দেশ গড়ার অর্থ?
ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল যে প্রায় এক কোটি শরণার্থী তারা সব ফিরে আসছে, তাদের ঘরবাড়ি নিশ্চিহ্ন, কি করে পুনর্বাসন করা যাবে তাদের?
হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধার হাতে অস্ত্র, এমনকি রাজাকার, আল বদরদের হাতে অস্ত্র, কি করে এ অস্ত্র ফিরিয়ে নেওয়া যাবে তাদের কাছ থেকে, কি করে নিশ্চিত করা যাবে যে অস্ত্রধারীরা বিপথগামী হবে না?
যে সব মুক্তিযোদ্ধা বীরত্বের সাথে লড়েছেন, প্রাণ দিয়েছেন, যেসব শিল্পী সাহিত্যিক যুদ্ধ বিক্ষুব্ধ মানুষকে প্রেরণা যুগিয়েছেন তাদেরকে কি করে সঠিক মর্যাদা দেওয়া যাবে, পুরস্কৃত করা যাবে?
যুদ্ধের সময় যে বাঙালিরা পাকিস্তানিদের সহায়তা করেছে, দালালী করেছে তাদের ব্যাপারে কি ব্যবস্থা নেওয়া হবে?
বাংলাদেশে তখনও অনেক ভারতীয় সৈন্য রয়ে গেছে, তাদের সহযোগিতায় দেশ গভীর কৃতজ্ঞ কিন্তু একটা ভিনদেশী সেনাবাহিনী কতদিন দেশের মাটিতে থাকবে?
পাকিস্তানি প্রায় এক লাখ যুদ্ধবন্দি রয়ে গেছে, তাদের ব্যাপারে কি সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে?
যুদ্ধ শুরু হবার পর থেকে ভারতের সঙ্গে সীমান্ত বলে আর কিছু নেই। এই সুযোগে শুরু হয়েছে অবাধ চোরাচালান, কি করে তা বন্ধ করা যাবে?
যুদ্ধের সময় প্রবাসী সরকার পরিচালিত হয়েছে তাজউদ্দীনের নেতৃত্বে, সে নেতৃত্ব মানেননি শীর্ষ কিছু ছাত্র নেতা। স্বাধীনতার পরও অব্যাহত রয়ে গেছে সেই বৈরিতা। কি করে অতিক্রম করা যাবে এই কোন্দল?
পৃথিবীর বহু দেশ তখনও স্বীকৃতি দেয়নি বাংলাদেশকে, কি করে সেই স্বীকৃতি আদায় করা যাবে? পুজিবাদী আমেরিকা আর সমাজতন্ত্রী রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্কের ভারসাম্য রাখা যাবে কি করে?
.
অগণিত প্রশ্ন। এর প্রত্যেকটির উত্তর খুঁজে পেতে হবে শেখ মুজিবকে। একটা নতুন স্বাধীন দেশ, অভূতপূর্ব অনুভুতি মানুষের আর আকাশচুম্বী আশা।
৪০. ক্রাচ হাতে কর্নেল
নতুন দেশ গোছানোর কাজ বন্ধন শুরু হয়েছে তাহের তখনও হাসপাতালের বিছানায়। কাটা পায়ের স্কিন গ্রাফটিং করবার জন্য তাহেরকে গৌহাটি থেকে পুনায় নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। শিশু জয়াকে নিয়ে লুৎত্যাকে ময়মনসিংহে আপাতত চলে যেতে বলেন তাহের। আনোয়ারকে সঙ্গে নিয়ে তাহের যান পুনায়। যুদ্ধাহত স্বামীকে পেছনে রেখে লুৎফা রওনা দেন স্বাধীন দেশে। পুনায় দীর্ঘদিন চলে তাহেরের চিকিৎসা। একজন আহত সেক্টর কমান্ডারকে সম্মান জানাতে একদিন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী চলে আসেন হাসপাতালে, কুশল বিনিময় করেন তাহেরের সঙ্গে। ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠেন তাহের।
৭২-এর এপ্রিলে একটি পাবিহীন তাহের ক্রাচে ভর করে ফেরেন বাংলাদেশে। ছেড়ে গিয়েছিলেন রণাঙ্গন ফেরেন একটি মুক্ত স্বাধীন দেশে জীবিত যোদ্ধাদের জন্য সর্বোচ্চ খেতাব বীরউত্তম এ ভূষিত করা হয় তাঁকে। তাকে পদোন্নতি দিয়ে করা হয় কর্নেল। তাঁকে দেওয়া হয় আর্মির অ্যাডজুটেন্ট জেনারেল পদ। লুৎফাকে নিয়ে তার জন্য বরাদ্দ ক্যান্টনমেন্টের বাসায় গিয়ে উঠেন তাহের।
একজন যুদ্ধাহত মানুষকে নিয়ে শুরু হয় লুৎফার সংসার। বছর আড়াইয়ের সংসার তার কেটেছে ঝড় ঝাপটা আর চড়াই উৎড়াইয়ের মধ্যেই। লন্ডনের সময়টুকু বাদ দিলে একটু স্থির হবার সময় হয়ে উঠেনি তার। এবার কি হবে?
তাহেরের মস্তিষ্কে তখনও কেবলই অসমাপ্ত যুদ্ধের কথা। লুৎফাকে বলেন, স্বাধীনতাটা যেভাবে আসবে ভেবেছিলাম সেভাবে আসেনি কিন্তু তাই বলে তো আর বসে থাকলে চলবে না। নেমে পড়তে হবে কাজে। দেখি গভর্নমেন্ট কিভাবে ফাংশন করে, দেশটা কোনোদিকে যায়।
একদিন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধারা এলেন তাহেরের কাছে, বললেন : স্যার, আমরা যারা যুদ্ধে পঙ্গু হয়েছি, তারা সবাই মিলে একটা সংগঠন করতে চাচ্ছি, আপনি হবেন তার প্রধান।
ক্ষেপে যান তাইের : পঙ্গু? কে পঙ্গু? দুটো পা যার আছে, আমি তার চেয়ে অনেক বেশি কাজ করতে পারব আমি। ওসব পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধার ভেতর আমি নাই।
শেখ মুজিব তাহেরকে ডাকেন একদিন খুবই উৎসাহিত হয়ে উঠেন তাহের। লুৎফাকে বলেন : উনার উপর পুরো দেশ তাকিয়ে আছে। আর্মিকে পুরো ঢেলে সাজানো দরকার। আমার প্ল্যানটা উনাকে বলব। বঙ্গবন্ধু যদি একটু সাপোর্ট দেন। তাতেই অনেক কিছু করে ফেলা যায়।
এমনিতে ক্রাচে ভর দিয়ে হাঁটলেও বিশেষ অনুষ্ঠানে তাহের পড়ে নেন ভারত থেকে আনা একটি কৃত্রিম পা। লুৎফাকে সঙ্গে করে কৃত্রিম পায়ে ভর দিয়ে তাহের। চলে যান শেখ মুজিবের সঙ্গে দেখা করতে। তাহের তার যুদ্ধের নানা অভিজ্ঞতার কথা বলেন শেখ মুজিবকে। বলেন; জনগণ এবং আর্মির লোকেরা মুক্তিযুদ্ধে একসাথে যুদ্ধ করেছে, যুদ্ধ শেষে তাদের বিচ্ছিন্ন করাটা ঠিক হবে না। আমি মনে করি সেনাবাহিনীকে রিফর্ম করা দরকার। সিপাই আর অফিসারদের মধ্যে যে দাসসুলভ সম্পর্ক আছে তার অবসান ঘটানো দরকার। তাছাড়া আমাদের মতো একটা দেশের সেনাবাহিনীর সদস্যরা শুধু শুধু ব্যারাকে বসে থাকবে এটা তো ঠিক না। দেশের এখন কত কাজ, দেশের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজে সেনাবাহিনীর সদস্যদের পুরোপুরি যোগ দেওয়া উচিত। আর্মি নিয়ে আমার নিজস্ব চিন্তা ভাবনা আছে, আমি সেগুলো আপনাকে লিখে জানাতে চাই।
শেখ মুজিব মনোযোগের সঙ্গে শোনেন তাহেরের কথা। বলেন : অবশাই। তুমি লিখে আমাকে পাঠাও। তারপর একদিন সময় নিয়ে আস। এনিয়ে বিস্তারিত কথা হবে তোমার সঙ্গে। আর তোমার পায়েরও তো আরও চিকিৎসা দরকার। আমি যখন বিদেশে যাবে তুমি অবশ্যই আমার সঙ্গে যাবা।
উদ্দীপনা নিয়ে ঘরে ফিরে তাহের বসে পড়ে তার কাঙ্ক্ষিত সেনাবাহিনীর রূপরেখার খসড়া তৈরিতে। মাথায় তখন তার দেশ গড়ার নানা পরিকল্পনা।
একদিন বাড়ির ড্রইং রুমে বসে আছেন তাহের। এক অধীনস্ত অফিসার এসে বলেন : স্যার একটা উপহার এনেছি আপনার জন্য। জানলা দিয়ে দেখেন।
তাহের জানলা দিয়ে দেখে একটি গাড়ি।
অফিসারটি বলেন : মার্সিডিজ স্যার, শিল্পপতি আদমজী ব্যবহার করত। ওটা আমি আপনার জনা রেখে দিয়েছি।
স্তম্ভিত হয়ে যান তাহের : কি বলতে চাও?
অফিসারটি : জী স্যার, কতজন কতকিছু সব নিচ্ছে। আদমজী তো পালিয়ে গেছে।
উত্তেজনায় ক্রাচে ভর দিয়েই দাঁড়িয়ে যান তাহের। প্রচণ্ড ধমক দিয়ে উঠেন : হাউ ডেয়ার ইউ? গেট আউট ফ্রম মাই হাউজ।
মর্মাহত তাহের ঘরে গিয়ে লুৎফাকে বলেন : কেবল স্বাধীন হলো একটা দেশ, কিভাবে লুটপাট শুরু হয়ে গেছে দেখ, এমনকি আর্মির মধ্যেও। আমি এক্সাক্টলি এই কারণেই বলেছিলাম যুদ্ধটা দীর্ঘায়িত হওয়ার দরকার ছিল। এমন একটা স্বাধীনতার জন্য মানুষ তো রেডিই হয়ে ওঠেনি। ভাবটা যেন এমন যে দেশটা যেহেতু এখন আমার, যেহেতু পাকিস্তানিরা এখন আর মাথার উপর ডাকা ঘোরাচ্ছে না, সুতরাং যা যেখানে পাবো তা নিজেদের মধ্যে ভাগ বাটোয়ারা করে নেব। যুদ্ধের ভেতর সব মানুষের মধ্যে যদি রেভুলেশনের স্পিরিটটা তৈরি করা যেত তাহলে এসব হতো না। একটা স্টেটের জন্ম হলো বলেই যে বিজয় হয়ে গেল তা তো না। আমি এই আশঙ্কাটাই করছিলাম।
ক্ষুব্ধ তাহের উধ্বতন সামরিক অফিসারদের মিটিংয়ে লুটপাটের প্রসঙ্গটি তোলেন। বলেন : ক্যান্টনমেন্টের বাইরে কি হচ্ছে সেটাতে আমাদের কন্ট্রোল নাই কি ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে তো আমরা এসব এলাউ করতে পারি না। আডজুটেন্ড জেনারেল হিসেবে আমি জানিয়ে দিতে চাই যে দিস মাস্ট বি স্টপড ইমিডিয়েটলি। আর ইতোমধ্যে যারা এসব অবৈধ সম্পদ নিয়েছেন তাদেরও তা ফেরত দিতে হবে। আমি সবাইকে আর একবার সুযোগ দিতে চাই। সেনাবাহিনীর সামনে অনেক কাজ। এই পাপের বোঝা নিয়ে তারা কি করে দেশ গড়ার কাজ করবে? তাদের আমি আরেকবার পরিশুদ্ধ হবার সুযোগ দিতে চাই।
তাহেরের ডাকে কাজ হয়। প্রচুর লুট করা সম্পদ জড়ো হয় ক্যান্টনমেন্টের মাঠে। জনসমক্ষে তাহের সেই সব লুণ্ঠিত মাল পুড়িয়ে ফেলেন। কিন্তু তাহের একা আর কতটা পাপ পোড়াবেন? দেশের আনাচে কানাচে ইতোমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে ক্ষয়।