আলো আলোকিত মানুষ হবে

আলো আলোকিত মানুষ হবে

দুজন। একজন যুবক, অপর জন যুবতী। প্রথম দর্শনেই যে কেউ বলে দিবে নতুন দম্পতি তারা। হেটে যাচ্ছে পাশাপাশি। একে অপরের হাত ধরে ব্যস্ত রাস্তার ফুটপাটে। সময়টা বিকেল। যুবতীর দিকে তাকালে, যুবতীর মুখাবয়ব দেখে যে কোন প্রকৃতি পূজারি দেবী ভেবে ভূল করবে! সেই মুখে নাকের উপর অবস্থান নিয়েছে একটা স্বর্নের নাকফুল।

যেভাবে ভোমর ভুলের মধু আহরনের সময় অবস্থান নেয়। স্বর্নের নাকফুলটা যুবতীর সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেছে। নাক ফুলটা দেখলেই বোঝা যায় বেশিদিন হয় নি স্বর্নকারের দোকান হতে তার নাকে অবস্থান নিতে। এর পর কাপরে ঢাকা সমস্ত শরীরের উন্মুক্ত যে অংশটি দেখা যাবে তা হলে যুবতির হাত। যুবকের হাত যে হাত দিয়ে ধরে রেখেছে, সে হাতে মেহেদির রঙ স্পষ্ট, এখনো ফ্যাকাসে হয় নি। তাই বুঝতে অসুবিধা হয় না নতুন দম্পতি তারা। ফুটপাত ধরে ধীর পদক্ষেপে হাটছে দুজন। মাঝে মধ্যে দুজন দুজনের দিকে তাকাচ্ছে, দৃষ্টিতেই আদান প্রদান হচ্ছে নানান কথা, মনের ভাব। রাস্তা দিয়ে অনেকেই যাচ্ছে। তাদের কেউ কেউ তাকাচ্ছে আড়চোখে। দেখছে দুজন কে।

রাস্তার পাশে একটা গাছের শুকনো ডালে বসে ছিল একটা কাক, দুজনকে নিচ দিয়ে হেটে যেতে দেখে ডেকে উঠলো কা কা শব্দে। যুবতি থমকে দাড়িয়ে তাকালো উপরের দিকে। হঠাৎ কাকের ডাক মানে দুঃসংবাদ। অবশ্য এসবে তার বিশ্বাস নেই। তবুও! চোখ জোড়া খুজলো কাকটিকে। কয়েক সেকেন্ড লাগলো, কাকটিকে খুজে পেতে ।

হঠাৎ স্ত্রীকে দাড়িয়ে উপরের দিকে মুখ তুলতে দেখে কিছুই বুঝলো না যুবক। সেও দাড়ালো। পাশ দিয়ে ছুটে গেলো একটা ট্রাক। বাতাসের ঝাপটা লাগলো শরীরে, সেই সাথে ধূলোবালি। সে সব উপেক্ষা করে সে বললো, ” উপরে তাকিয়ে কি দেখো? ভূত না কি পিচাশ! ”

” না, একটা কাক ” জবাব দিলে যুবতী । স্বামী যে মজা করার জন্য কথাটা বলেছে সেটা সে বুঝলেও তা প্রকাশ পেল না তার মাঝে ।

” কাক? তো কি?”

“তুমি কাক ডাকতে শোনো নি? ”

” অনেক শুনেছি। কেন? ”

” হঠাৎ কাক ডাকাটা না কি দুঃসংবাদ! ”

” তুমি বিশ্বাস করো? ”

” না। তবু কেন যেন মনে হচ্ছে! ”

” হ্যা একটা অবশ্য খারাপ ঘটনা ঘটেছে। তোমার কাছে সেটা দুঃসংবাদই! ” বেশ কিছু সময় বিরতি নিয়ে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে মুখে গাম্ভীর্য এনে বললো যুবক। ” কি হয়েছে? ” যুবতীর কন্ঠস্বরে ভয়ের আভাস। ” তোমার মাথায় কাকে পায়খানা করে দিয়েছে। সেই সুখেই কাকটা কা কা ডেকে উঠেছে ” স্ত্রীর মাথার দিকে আঙুল দিয়ে নির্দেশ করে বললো যুবক। তার পর হেঁসে উঠলো। যুবতী একটু মনোযোগী হলেই বুঝতো সে হাঁসি দুষ্টমির হাঁসি।

” আমার মাথায়? ” যুবতীর গলার স্বরটা বেশ জোরেই হয়েছিল, ভয় পেয়ে গাছের ডাল হতে কাকটা উড়ে অন্য গাছের ডালে গেল। যুবতী স্বামীর হাত ছেড়ে দিয়েছে এতক্ষনে। ভ্যানিটিব্যাগ হতে টিস্যু পেপার বের করে স্বামীর হাতে দিলো। ” ফেলে মুছে দাও প্লিজ।” পারবো না। তুমিই করো। ” বললো যুবক।মুখে এখনো হাঁসি।

যুবতি স্বামীর মুখে তাকালো বিষ্ময়ে। চোখে নগ্নদৃষ্টি। তার স্বামী যে এভাবে বলবে সে কল্পনাও করে নি। তার চেয়ে এভাবে বলার পরেও হাঁসতে দেখে রেগে গেল সে। অভিমান হলো। কথা না বলেই নিজেই হাতে টিস্যু পেপার নিয়ে মাথার উপরের স্কার্ফ এর উপরে বার কয়েক ঝাড়া দিল। তার পর প্রশ্নবোধক দৃষ্টিকে তাকালো স্বামীর দিকে। ব্যাচারা তখনো হাঁসছে।

” মজা করছিলাম ” এবার হাঁসি মুখেই জবাব দিলো যুবক। ” তোমার মাথায় কিছুই নেই। মিথ্যে বলেছিলাম। ” ” তুমি না একটা….” বলা শেষ করলে না সে। বুঝতে পেরেছে ঘটনা কি! তার পর সেও স্বামীর হাঁসিতে যোগ দিলো। তবে সে হাঁসিটা যে স্বতঃস্ফূর্ত নয়, তা যে কেউ বলে দিবে। ” চলো ” বললে যুবক। তার পর স্ত্রীর হাতটা নিজের হাতের নিয়ে চলা শুরু করলো। ” তুমি এমন কেন? সব সময় মজা করো কিভাবে? ” বেশ কিছুদুর হেটে যাওয়ার পর স্বামীকে জিজ্ঞেস করলো যুবতী।

“আমি..ই…” পিচঢালা পথের ফুটপাতে একটা অর্ধেক ইটের টুকরো ছিল। দুজনের কেউই দেখে নি সেটা। সেটাতেই যুবক হোছট খেয়ে ছিটকে পড়লো রাস্তায়। স্ত্রীর হাত ধরে রেখেছিল, স্বামীর পড়ে যাওয়াতে সে পড়লো, তবে ফুটপাতে। একই সময়ে ছুটে এলো একটা ট্রাক। চালক কিছু বোঝার পূর্বেই ট্রাকের চাকা পিষ্ট করলো যুবকের মাথা। একটা করুন আর্তনাদ ভেসে গেল বাতাসে। তবে ট্রাকের শব্দে তা অস্পষ্ট শোনালো।

যুবতি ততক্ষনে উঠে দাড়িয়েছে। স্বামীর দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠলো। ছুটে গেল স্বামীর দিকে। ভয়ংকর দৃশ্য। মস্তিষ্ক পিষ্ট হয়ে মিশে আছে পিচঢালা পথে। যুবতীর মাথা দুলে উঠলো । হঠাৎ করেই অচেতন হয়ে লুটিয়ে পড়লো স্বামীর পাশেই। আলো। আট বছর বয়স। তৃতীয় শ্রেনীতে পড়ছে। মেয়েটার চঞ্চলতা দেখে যে কেউ বলবে সে দুরন্তপনায় অন্য সব মেয়ে হতে আলাদা। পড়ালেখাতেও সে তার শ্রেনীতে সবার সেরা। মেয়েটা বড় হলে বেশ নাম করবে – ওর মেধাশক্তি বুঝতে পেরে শিক্ষকেরা মন্তব্য করে।

এখন মেয়েটা স্কুল হতে ফিরছে। একা। সাথী সঙ্গীরা স্কুল ছুটির পর, মাঠে খেলছে। সেও খেলতে পারতো। কিন্তু দুপুরের তপ্ত রোদে খেলাটা সমীচীন মনে হয় নি ওর। বরং বাসায় গিয়ে গোসল দিয়ে দুমুঠো ভাত মুখে দিয়ে পড়তে বসবে। সকালে বড় ভাইয়ের কাছে টাকা চেয়ে নিতে গিয়ে, তার পড়ার টেবিলে একটা ম্যাগাজিন দেখেছে। ম্যাগাজিন টা কিশোরদের। সেটা ভাইয়ের অগোচরে এনে পড়তে চায় সে। ভাইয়াটা খুব খারাপ, বুঝতেই চায় না, পড়তে শিখে গেছে সে। বড় বড় বইও পড়তে পারে সে এখন। বানান করে পড়তে হয় না।

এর আগেও দুটো ম্যাগাজিন পড়েছে সে। কি সুন্দর সুন্দর গল্প বইটাতে। কত সুন্দর সুন্দর কথা। ভাবতে ভাবতে ফুটপাত দিয়ে এগিয়ে চলছে সে বাড়ির দিকে। পিচ ঢালা পথে যাওয়া আসা করছে বাস ট্রাক, রিকশা। এসবে কোন মনোযোগ নেই মেয়েটার। বেশ কিছুদুর এগিয়ে গিয়েছে, হঠাৎ কি যেন মনে হলো ওর। পেছন ফিরলো। মাথা কাত করে ঘাড়ের উপর দিয়ে পেছনে দেখার অভ্যাস নেই ওর। ওর মা বলে ওভাবে না কি শয়তান দেখে। পেছনের কিছু দেখতে চাইলে তুমি তোমার শরীরের সম্মুখ দিকটা পেছনে ফেরাও। তারপর দেখো।

দেখলো পেরিয়ে আসা ফুটপাতে পড়ে আছে একটা আধা ভাঙা ইট। দাড়িয়ে রইলো। তখনই মনে পড়লো ভাইয়ের টেবিল হতে দ্বিতীয় বইটা নিয়ে যখন পড়ছিল, তাতে একটা লেখা ছিল। রাস্তার প্রতি পথিকের দায়িত্ব বা পথিকের প্রতি পথিকের দায়িত্ববোধ সম্পর্কিত। সেখানে সাতটা দায়িত্বের কথা লেখা ছিল। তার একটা ” পথ হতে কষ্ট দায়ক জিনিস সরিয়ে ফেলা “। ভাবলো আলো, ফুটপাতে পড়ে আছে ইটের টুকরোটা। কেউ যদি হোছট খেয়ে পড়ে যায় ব্যাথা পাবে। এটা অবশ্যই কষ্ট দায়ক। চলে এলো টুকরোটির কাছে। হাতে তুলে নিয়ে রাস্তার পাশে ফেলে দিলো। কাজটা করতে পেরে যেন মজা পেল সে। খুশি হয়ে উঠলো মন। সত্যিই মজার, বইয়ের কথা অনুযায়ী একটা ভালো কাজ করেছে সে। মাকে গিয়ে বলবে সেটা। আবার হাটা শুরু করলো বাড়ির পথে। সময়টা দুপুর।

গাছের ডালে বসে ছিল কাকটা । সেখান হতেই দেখছিল একটা মেয়েকে একটা ভালো কাজ করে খুশি হতে। সময়টা বিকেল। ” তুমি এমন কেন? সব সময় মজা করো কিভাবে? ” বেশ কিছুদুর হেটে যাওয়ার পর স্বামীকে জিজ্ঞেস করলো যুবতী। “আমি এমনই। তোমার মাঝে যখন বোকা বোকা ভাবটা আসে তখন তোমাকে খুব সুন্দর লাগে। আর রাগলে আরো বেশি সুন্দর। সেজন্যই ইচ্ছে করে অমন করি ” বললে যুবক তার স্ত্রীকে। দুপুরে ফুটপাতের যে স্থান হতে আলো নামের মেয়াটা ভাঙা ইটের টুকরোটা সরিয়েছিল সে স্থান পেরিয়ে গেল স্বামী স্ত্রী দুজনই।

তখনই পাশ দিয়ে ছুটে গেল একটা ট্রাক। বেশ দ্রুত গতিতে। ট্রাক পেরিয়ে যেতেই বাতাস আর ধূলোবালি’র ঝাপটা লাগলো স্বামী স্ত্রী দুজনেরই শরীরে। তারা এগিয়ে চললো গন্তব্যে। যেতে যেতে যুবতী বললো, ” বাড়িতে গিয়ে বোঝাবো, রাগলে কতটা সুন্দর দেখায় আমায়? বুঝেছো চাঁদ? ”

এমন হতে পারতো, ইটের টুকরোটা থাকলে হোছট খেয়ে যুবকটা ট্রাকের নিচে পড়তো! বিধবা হতো যুবতী! দুরের গাছের ডালে বসে থাকা কাকটা ভাবলো। আজ সে দুপুর হতে সব পথিককে কা কা শব্দে বলতে চাচ্ছে, আলো নামের একটি মেয়ের কথা। যে, একটা ভালো কাজ করে খুশি হয়েছিল তারই সম্মুখে। আজকাল ভালো মানুষকে, ভালো কাজ করে আনন্দ পেতে, খুৃশি হতে দেখে না কাকটি।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত