গত তিন দিন ধরেই একটা অদ্ভুদ জিনিস লক্ষ করছি। মাটিতে আমার ছায়া পড়ছে না। কথাটা যখন প্রথম আমার বন্ধু হাবুলকে বললাম, হাবুল চোখ দুটো ফুটবুলের মত বড় বড় করে তাকালো একবার। আর তারপরই দৌড়। এই দৌড় না সেই দৌড়, মনে হচ্ছে ম্যারাথনে নাম লেখাতে যাচ্ছে। বুঝতে পারলাম না হাবুলের এই অদ্ভুদ অাচরণ কেন করলো। আর সেটা জানার জন্য আমিও ওর পিছু পিছু দৌড় দিলাম। যেই না দেখেছে আমিও ওর পিছু পিছু দৌড়াচ্ছি, সেইটা দেখে দৌড়ের গতি আরও বাড়িয়ে দিলো। আর বিপত্তিটা ঘটলো তখনি। একটা গাছের গুড়ির সাথে ধাক্কা লেগে তিন উলোট দিয়েই চিৎ পটাং। হাত ধরে তুলতে যাবো তখন দেখি জ্ঞান নেই। আচ্ছা এক মুশকিলে পড়া গেল তো। এমনি সময় দেখলাম মতি চাচা কাঁধে তেলের ঝোলা নিয়ে হাঁটে যাচ্ছে।
– চাচা ও চাচা, এই দিকে আসো তো। গলা বাড়িয়ে ডাকলাম। আমার ডাক শুনে আমার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বললো,
– কী রে নীল কি হইছে। একি হাবুল এখানে পড়ে আছে কেন?
প্রথম কথাটা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলতে বলতে হুট করেই নিচের দিকে তাকিয়ে ভয়ে আঁতকে উঠে পরের কথাটা বললো।
– আরে আমি কিছু করিনি। কি হইছে সেটা দেখাল জন্যই তো তোমাকে ডাকলাম।
– উহু, কিছু তো হইছেই। না হলে ওর এমন অবস্থা হলো কেন? দেখ নীল সত্যি করে বল বলছি। নয়তো মতি চাচার কথায় ভয়ই পেয়ে গেলাম। বলা তো যায় না পরে আবার গ্রামের দশজনকে ডেকে কি না কি বলবে। আচ্ছা এক ঝামেলায় পড়া গেল তো।
– আরে চাচা আমি কিছু করিনি। শুধু বললাম মাটিতে আমার ছায়া পড়ে না আর তাই….
কথাটা পুরো শেষ করতে পারলাম না। তার আগেই দেখি তেলের ঝোলাটা মাটিতে পড়ে আছে আর মতি চাচা লুঙ্গিটা হাটুর উপর তুলে দক্ষিন দিকে দৌড়াচ্ছে। একবার হোচট খেয়ে পড়ে তো আবার উঠে দৌড়ায়। ব্যাপার খানা হলো কী? যাস শালা, এও দেখি দৌড় মারলো। আচ্ছা কাহিনীটা কী? কিছুই তো মাথায় আসছে না। দাড়িয়ে দাড়িয়ে মাথা চুলকোচ্ছি আর ভাবছি তখনি কানে আসলো, “ও মা গো” পিছনে তাকিয়ে দেখি হাবুল চোখ মুখ উপর দিকে তুলে দৌড়াচ্ছে। এবার আর হাবুলের পিছু নিলাম না। সোজা বাড়ি চলে আসলাম। বেলা প্রায় পড়ে আসতে শুরু করেছে। দেরি করে বাড়ি গেলে মা আবার ঠেঙ্গাবে।
রাতের বেলা মায়ের মুখে শুনলাম হাবুলের নাকি খুব জ্বর। ঘোরের মধ্যে কি সব আবাল তাবল বকছে। জ্বরের কথাটা এরই মধ্যে পুরো গ্রামে ছড়িয়ে গেছে। কিন্তু জ্বরের কারণটা সবারই অজানা। কারণ হাবুল তো কথাই বলতে পারছে না। একবার ভাবলাম গিয়ে দেখে আসি, পরে আবার ভাবলাম না থাক সকালে একটা বার ঘুরে আসা যাবে। পরের দিন সকালে রাস্তার ধারে বসে আছি। ডাক্তার বাবুকে আসতে দেখলাম। মনে হয় হাবুলের বাবা ডেকে পাঠিয়েছিলো। হাবুলের একটা খোজ নেওয়া দরকার।
– ডাক্তার বাবু একটু থামেন। হাত বাড়িয়ে সাইকেলটা থামালাম। ডাক্তার বাবু আমাকে দেখে হাসি মুখে বললেন,
– কী তোর এক সঙ্গী তো বিছানায়। তোর আবার কী হলো?
– আরে আমার আবার কী হবে। হাবুল এখন কেমন আছে বলুন তো।
– ভালোই তবে ঘুমের ঔষুধ দিয়ে আসলাম। তিন চার দিনের মধ্যে ঠিক হয়ে যাবে।
-আচ্ছা ডাক্তার বাবু একটা কথা বলবো?
– বল
– মাটিতে যদি কারও ছায়া না পড়ে এটা শুনে ভয় পাওয়ার কী আছে? কথাটা শুনেই ডাক্তারের হাসিখুশি মুখটা নিমিষেই চুপসে গেল। ভয় ভয় কণ্ঠে বললো,,
– কেন? কি হইছে?
– আর বলবেন না, গাধা হাবুলটাকে বললাম মাটিতে আমার ছায়া পড়ছে না। আর একটা শুনেই তো কথাটা শেষ না করেই পিছনে তাকালাম। তাকিয়ে দেখি সাইকেল মাটিতে পড়ে আছে আর ডাক্তার বাবু উল্টো দিকে দৌড়াচ্ছে। পিছন থেকে হাক ছাড়লাম,
– আরে আপনার আবার কী হলো? আজব তো এই সাইকেলটা তো নিয়ে যান।
কী অদ্ভুদ মানুষ রে বাবা। দিলো তো সকাল সকাল মেজাজটা খারাপ করে। এই সাইকেল নিয়ে এখন কে যাবে? আরও দুইটা হাক দিলাম। কিন্তু কে শোনে কার কথা। এমন ভাব যেন ছেড়ে দে মা কান্দে বাঁচি। আজব মানুষ তো মশাই। রাগে শরীরটা গজগজ করতে লাগলো। আমি ছোট মানুষ, এই সাইকেল চালানো কী আমার সাধ্য নাকি? কিন্তু কি আর করার, সাইকেলটা ঠেলতে ঠেলতে ডাক্তার বাবুর বাড়ির দিকে যেতে লাগলাম।
– আরে নীল, কী দাদু ভাই এত সকালে কোথায় যাওয়া হচ্ছে? আর সাইকেলটা ডাক্তারের না?
– হ্যাঁ, ফেলে গেছে।
-ফেলে গেছে ! কেন ফেলে গেল কেন? নিশ্চয় তুমি কোনো বাদরামি করছো তাই না?
এমনিতেই মেজাজ গরম তার উপর এই বুড়ো এসে আরও মেজাজ গরম করে দিলো। ইচ্ছে করছে একটা মারি আছাড়। কাজ কাম নেই তো আমার আমি ধুর।
– আমি কেন উনাকে কিছু বলবো? শুধু বলেছি মাটিতে আমার ছায়া পড়ছে না। আর তাতেই তিনি….
এই কথাটাও শেষ না করতেই দেখি বুড়ো থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে ধপাস করে মাটিতে পড়ে গেল। এ আবার নতুন আপদ উদয় হলো কোথা থেকে? কেউ দৌড় দেয় কেউ আবার…. ধুর আরও মেজাজ গরম হয়ে গেল। অনেকক্ষণ ডাকা ডাকির পর বুড়ো চোখ খুললো। আর চোখ খুলতেই ভুত ভুত করে চিৎকার করতে করতে দৌড়।
ভুত? এই দিন দুপুরে ভুত পেল কোথায়? আশেপাশে একবার তাকালাম। ভুত তো দুরের কথা একটা কুকুরও নেই আশেপাশে।
রাতের বেলা বসে বসে স্কুলের পড়া পড়ছিলাম। হঠাৎ করেই ভুতের কথা মনে হলো। ভুতের সম্পর্কে একটু পড়লে ভালো হয়। তাই একটা ভুতের গল্প পড়লাম। আর পড়েই বুঝলাম ভুতের নাকি ছায়া পড়ে না। কথাটা শুনেই শরীরের রক্ত হিম হয়ে গেল। আমারও তো ছায়া পড়ে না। তার মানে কী আমিও ভুত? কথাটা ভাবতেই শরীরের রক্ত চঞ্চল হয়ে উঠলো। আমি তাহলে ভুত? বেশ ভালো তো। স্কুলের অংক মাষ্টারকে জব্দ করা যাবে। খুব জ্বালিয়েছে এত দিন। এবার বুঝতে জাদু, কত ধানে কত চাল।
– কি রে স্কুলের পড়া বাদ দিয়ে কী পড়ছিস এইসব হু?
বাবা যে কখন আমার ঘরে এসেছে বুঝতেই পারিনি। এমনিতে বাবাকে খুব ভয় পাই কিন্তু আজ আর ভয় পেলাম না। ভুতের আবার ভয় কিসের? বরং আমাকেই সবাই ভয় পাবে সবাই। ভাবতেই একটা ভালো লাগা কাজ করতে লাগলো।
– কী হলো কানে কথা যায় না নাকি?
– বাবা সাবধান, আমি আর তোমাকে ভয় পাই না। কারণ আমি ভুত। কথাটা শুনেই বাবা ভ্রু কুচকে আমার দিকে তাকালো।
– ভুত? তা কেন মনে হলো এমনটা?
– কারণ তিন দিন থেকে মাটিতে আমার ছায়া পড়ছে না। আর ভুতেদেরও ছায়া পড়ে না। কথাটা শেষ করতেই বুঝলাম কানের উপর দুইখানা চড় পড়লো। আরও তিনটা।
– এক সপ্তাহ ধরে রোদ উঠে না, ছায়া পড়বে কী করে? বলেই আবার উত্তম মাধ্যম।তার মানে আমি ভুত না? কিন্তু এবার তো মনে হচ্ছে আমি সত্যি সত্যিই ভুত হয়ে যাবো।