আকাশের লাল আভা আরও গাঢ় হয়ে উঠছে সময়ের সাথে সাথে।নিরবতাটাকে আরও বেশি গভীর করে তুলছে ঝি ঝি পোকাদের ডাক।পুকুরের থৈ থৈ জলে ফুটে উঠছে আকাশের ছবি।ধীরে ধীরে দূর ঝাউ বনের বিশাল অশ্বত্থ গাছের ওপারে নিরবে অস্ত যাচ্ছে রক্তিম সূর্যটা।যেনো সে জানান সবাই দিয়ে দিচ্ছে আরও একটি ব্যস্ত দিনের পরিসমাপ্তির কথা।কয়েকটি বাঁদুর হঠাৎ দলবেঁধে উড়ে গেল আকাশের বুকে আচর কেঁটে।জমিদার বাড়ির ভেতর আজ পিনপতন নিরবতা বিরাজ করছে।অন্য দিনের তুলনায় গোটা বাড়ি হারিয়েছে নিজ প্রানবন্ত ভাব এবং চঞ্চলতা।যেন সাক্ষাৎ মৃত্যু পুরীতে পরিণত হয়েছে সারা বাড়ি।জমিদার মশাই চুরুটে টান দিলেন।তিনি লক্ষ্য করলেন এ মাঘের শীতেও তার শরীর দর দর করে ঘামছে।তার কপালে চিন্তার গাঢ় ভাজ পরেছে।
তিনি অবিরত তার পায়ের বুড়ো আঙ্গুল নাচিয়ে চলছেন।শুধু মাত্র চিন্তিত থাকলে জমিদার মশাই এমনটা করেন, পুরানো অভ্যেস।হঠাৎ তার চোখ আটকে গেল দরজায়। পর্দার ওপাশে কেউ একজন অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছে।তার ছায়া পরছে ঘরের মেঝেতে।জমিদার মশাই খেঁকিয়ে উঠলেন, ওখানে কে!। জ্বে হুজুর আমি। কাঁপা পায় অন্দরে প্রবেশ করলো জমিদারের বৃদ্ধ ভৃত্য নাদের আলী।নাদের আলী বেশ ভয়ে ভয়ে এসে জমিদারের সামনে হাঁটু গেঁড়ে বসে মৃদু স্বরে বলল, আজ্ঞে,হুজুর একটা কথা ছিল। ভনিতা না করে কথাটা বলো। ওইটা বন্দোবস্ত হয় নাই।কাজী নদীর ঐ পাড়ে চইল্লা গেছে।কাইলকা ফিরব। আর বাঁকা?। সে মুখের ওপর না বইলা দিছে।
জমিদার মশাইয়ের চোখ ভরা বিস্ময়।তিনি কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেলেন।নাদের আলীর কানে ভেসে এলো ছোট্ট অথচ দীর্ঘ একটি দীর্ঘশ্বাসের শব্দ।এতদিন যারা তার চাটুকারিতা করতো তাদেরও নতুন করে ঠ্যাং গজিয়েছে।বাঁকা এরুপ একজন।জমিদার মশাই জানেন কাজী ইচ্ছে করেই কোথাও লুকিয়ে আছে।কারণ তারা ভালো করেই জানে তিনি তাদের কাছে আর্থিক সহায়তা চাইবেন।জমিদার চুরুটে টান দিলেন।তিন মাসের খাজনা বাকি পরে গেছে।এবার যেই খরাটা হলো!।কেউ তো কর দিতেই পারলো না।বন্দর থেকে কিছু জোগাড় হলেও কিছু অংশ বাকি পরে গিয়েছে। ওয়াটসন সাহেব কি আর কিছু বলেছিলেন?। না।আর কিছু বলে নাই। কতক্ষণ সময় বাকি আছে?। আরও দুই প্রহর। জমিদার মশাই চোখ বন্ধ করলেন।যদিও উনার চোখে এক ফোঁটাও ঘুম নেই।তবে এতে শ্রান্ত চোখের কিছুটা বিশ্রাম হয়।তাই তিনি মাঝেমধ্যে এমনটা করে থাকেন।
উনার দাদা মশাই বিক্রম সিংহ এমনটা করতেন।তার থেকেই জমিদার মশাই এই অভ্যেসটা আয়ত্ব করেছেন।অবশ্য বাল্যকালেই পিতা মাতা গত হওয়া দাদা মশাই ই ছিলেন তার একমাত্র সঙ্গী,অভিভাবক।জমিদার মশাই মুখে বিরক্তি সূচক শব্দ করলেন।আজ যেন সময় কোনো বাঁধা ধরা মানতে চাইছে না।এক প্রহর দুই প্রহর করে করে সময়টা এখন শেষের পর্যায়ে।আগামীকাল সূর্যের আলো ফুটতেই যে উনার জমিদারী নিলামে উঠবে!।তিনি বিস্মিত হলেন,সময় বড্ড বেশি স্বার্থপর।ওয়াটসন সাহেব গত মাসে সময় বেঁধে দিয়েছিলেন।সেই সময় পূর্ণ হতে আর মাত্র দুই প্রহর বাকি!।তারপরই..অন্দরমহল হতে চাঁপা কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে।জমিদার মশাই তড়িঘড়ি করে অন্দরমহলে ঢুকে পরল।নির্ঘাত আবার রক্তপাত শুরু হয়েছে !।ঘরে প্রবেশ করেই জমিদার মশাই লক্ষ্য করলেন কিছু বিষণ্ণ অশ্রু ভেজা চোখ।সব গুলো চোখের ভেতরেই ছিল একটি আকুতি।খাটেতে দীপা অর্থাৎ উনার সর্বকনিষ্ঠ মেয়ে শুয়ে আছে।তিনি দীপার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।এখন কিছুটা কমেছে।উনার স্ত্রী মনোরমা দেবী ডুকরে কেঁদে উঠলেন।
চুপ!।কাঁদা বন্ধ করো।
এখানে আমার মেয়ের প্রাণ যাই যাই।আর তুমি শাড়ির আচলে মুখটা লুকালেন মনোরমা দেবী।জমিদার সাহেব আনমনে ভাবলেন,ঘরে মৃত্যু পথ যাত্রী যক্ষা আক্রান্ত মেয়ে শেষ প্রহর গুনছে অথচ তিনি জমিদারীটা বাঁচানোর চিন্তায় মগ্ন।পৃথিবীটা আসলেই খুব অদ্ভুত!।তবে তার মা অবশ্য মেয়ে আঁকড়ে ধরে আছে সারাদিন।এমনকি জল খাবারটা পর্যন্ত মুখে তোলে নি,ব্রত পালন করছে।দিন রাতে মাথা ঠুঁকে কেঁদে মরছে ঠাকুরের দ্বারে। অথচ আজ অর্থাভাবে তিনি ঠিকমত মেয়ের চিকিৎসাও করাতে পারছেন না।কাঁশির তোড় আগের চেয়েও আরও বেড়েছে।সাথে ঝরছে লালচে একে রক্ত না বলে মৃত্যুর পূর্ব নিশান বলা চলে।মনোরমা কাঁদছে,দাসীরা কাঁদছে।নির্বাক জমিদার মশাই বারান্দায় চলে এলেন।ভেতরে থেকে হুহু কান্নার শব্দ ভেসে আসছে।হঠাৎ করে চেঁচিয়ে উঠলেন মনোরমা।তার গগনবিদারী চিৎকার জমিদারকে স্পর্শ করতে পারে নি।উনার চোখে ভেসে এল পুরোনো দিন।
একে একে দরিদ্র প্রজা ইশ্বরের দরবারে হাত তুলে বিচার দিয়ে ফিরছে বাড়ি।মেয়ের বিয়ের জন্য ঋণ নিতে গিয়ে কত শত মূর্খ কৃষক যে টিপ সই দিয়ে তার সর্বস্ব হারিয়েছে তা বলার বাইরে।খাজনা না দেয়ার দোষে কতশত চাবুক তিনি মেরেছে গরিবের পিঠে!।আজ তিনি সব কড়ায়গণ্ডায় ফেরত পাচ্ছেন।জমিদার মশাই বাম হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ মুছলেন।অন্দরমহল থেকে ভেসে আসছে মনোরমার আর্তনাদের শব্দ।জমিদার মশাই ছেড়ে দিলেন নিজ দেহের ভার।বাইরে থেকে তক্ষকের ডাক ভেসে আসছে।সূর্যের আলো যতটাই প্রখর হোক দিনশেষে ঠিকই কিন্তু ঘটে রক্তিম সূর্যাস্ত। সময় তার হিসেব নিকেশ মিটিয়ে নিতে জানে!।