অচিনপুর

অচিনপুর

বাড়ী থেকে এক প্রকার জোর করেই বের করে দিলো। সৎ মায়ের সংসার।মা মারা যায় ১৪ বছর বয়সে। ছোট একটা ভাই আছে। ওকে পৃথিবীতে আনতেই মা চলে গেলো আমাদের ছেড়ে। তাই বাবা আরেকটা বিয়ে করলো। আমরা পেলাম নতুন মা। শুভর বয়স যখন ৪ বছর তখন তখন আমার আরেকটা ভাই হলো। ওকে আমাকে সৎ ভাই বলে মনেই হতো না। mবদলে যেতে থাকলো দিন। আমার ছোট ভাই আর আমাকে নানা ভাবে মানসিক নির্যাতন করতো। বাবা মাকে কিছু বলতো না।

ভাতের তুনলা টা দিলো। বাসা থেকে বের হয়ে যেতে বললো। চলে আসলাম। সাথে ৭বছরের ভাইটাকে নিয়ে। চলে আসার সময় বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম অনেকবার। বাবা কি যেন বলতে চেয়েও বলতে পারে নি। মাথাটা নামিয়ে নিয়েছিলো। বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় নিজের অজান্তেই দুইফোটা পানি পড়েছিলো চোখ দিয়ে। উদ্দেশ্যহীন পথ চলা। কোথায় যাবো????? পকেটে মাএ ৫৬৩টাকা। কলেজের টাকা জমিয়ে রাখতাম। ব্যস্তবটা বড় কঠিন এখানে আবেগের কোন স্থান নেই। বয়স মাএ ১৮ এর গন্ডি পেড়িয়ে। শুভ বার বার আমার মুখের দিকে তাকাচ্ছে।

-ভাইয়ারে আমরা কোথায় যাবো? (শুভ)
-তুই তো বলতি ভাইয়া অচিনপুরে নিয়ে যাবি? তাই আজকে তোকে সেখানে নিয়ে যাবো! আমার কথা শুনে শুভ অানন্দে লাফাতে শুরু করলো।
-ভাইয়া ভাইয়া তুমি না খুব ভালো!

বলেই আমার গালে একটা চুমু দিলো। শুভর চোখের আড়ালেই পানিটা মুছে নিলাম আমার বেহায়া চোখের। mকাজের খোজে ব্যস্ত শহরে। কিন্তু কাজের কোন নাম গন্ধ নেই। কেউ দিলো না একটা কাজ। আমার খুদা সহ্য করার ক্ষমতা আছে কিন্তু ৭ বছরের ভাইয়াটা কি করে সহ্য করবে? নিজে খাই না শুভকে খাওয়াই।

রাতে ৫ টাকা টাকা দিয়ে ফুতফাতে জায়গাটা হয়ে যায়।শুভকে কোলে করে ঘুমাই! কোন কাজ নেই। বাধ্য হলাম মামা হতে। ভাড়ায় রিকশা নিলাম। কিন্তু অসুবিধে হলো শুভকে নিয়ে। শুভকে কোথায় রাখবো? ওতো ছোট মানুষ তাই সাথেই রাখলাম। লেখাপড়াটা বাদ দিলাম। অনেক ইচ্ছা ছিলো ওকালতি করবো। তাই শখ করে আইন বিভাগে ভর্তি হয়েছিলাম। সারাদিন রিকশা চালাতাম। ভাড়া বেশি হতো না রিকসায় ছোট বাচ্চা দেখে কেউ উঠতে চাইতো না। প্রচন্ড রোদএ যখন চোখ মুখ ঘেমে একাকার হয়ে যেতো তখন ছোট ভাইটা গামছা দিয়ে মুখে দিতো ঘাম।। মাঝে মাঝে প্রশ্ন করে ভাইয়া আমাকে অচিনপুরে নিয়ে যাবা না? মুচকি হেসে বলি যাবে রে পাগলা। মিথ্যা সান্তনা দিতাম।

আসলে আমার নিজেও জানা নেই এই অচিনপুর কোথায়? আচ্ছা আদতেও কি এই নামে কোন জায়গা আছে? একটা বড় সাহেবের সাথে খুুব ভালো পরিচয় আমার।প্রতিদিন আমার রিকশায় অফিসে যায়। অনেক বড় অফিসের মালিক সে। তবুও কেন জানি আমার রিকাশায় করে যায়। নিজের জীবন নষ্ট হয়ে গেছে কিন্তু শুভকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে লাগলাম।একটা নামীদামি স্কুলে ভর্তি করাতে গেলাম। তারা বলে দিলো আমার মত রিকশা ওয়ালার ভাইকে নিবে না। মন খারাপ করেই রিকশা চালাচ্ছি। ভাইটাকে ভালো স্কুলে ভর্তি করতে পারলাম না। পিছনের সিটে বসে সাহেব আর শুভ হেসে হেসে কথা বলছে। সাহেবটা খুব ভালো।

-কি সজীব আজকে কি মন খারাপ? সাহেব কথায় পিছনে তাকালাম। কিছু বলতে যাবো তখনি শুভ বললো,, ওই যে একটা লোক ভাইয়াকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিলো তাই ভাইয়ার মন খারাপ।

-কি হইছে সজীব? কেন তোমাকে বের করে দিলো? (সাহেব)
-বাদ দেন সাহেব ওরা বড়লোক তাই এমন করেছে।
-আরে বলোই না কি হইছে।
-ভাইয়াকে ভর্তি করাতে গেছিলাম! তারা বললো আমার মত রিকশাওয়ালার ভাইকে নিবে না! তাই অনেক অনুরোধ করাতে! সাহেব শুভকে নিজের সন্তানের পরিচয়ে ভর্তি করে দিলো। সাহেবের পা ধরে কেদেছিলাম।

-আচছা সজীব তুমি তো অনেক লেখাপড়া করেছো তাই না? তাইলে কোন চাকরি কেন করো না?
-কি বলেন সাহেব চাকরি কে দিবে?

সাহেব আমার কথায় চুপ করে থাকলো! তারপর বললো তুমি কালকে আমার সাথে আমার অফিসে যাবা!
আর তুমি থাকো কোথায়?

-সব খানেই সাহেব।
-মানে?
-মানে ওই ৫ টাকা দিয়ে ফুতফাতে ফফজায়গা পেয়ে যাই।
-তুমি ফুতফাতে থাকো?
-কি করবো সাহেব? বাচেলর তো তাই কেউ ঘর দিতে চায় না। আর সেই শক্তিও আমার নেই।
-আমার একটা খালি ঘর আছে তুমি থাকবে?
-না না সাহেব কি বলেন আপনার বাসায় কেন থাকবো?
-আরে বাবা প্রতিদিন তো তোমার রিকশা করেই অফিস যাই। এখন থেকে না হয় বাসা থেকেই আনবে। কি আনবে তো?

চোখে পানি চলে আসলো। একটা ঘর পেয়ে গেলাম সাথে একটা ভালো চাকরি। প্রতিদিন সাহেবকে নিয়ে যাই অফিসে রিকশা করে। যদিও চাকরি করি তবুও। প্রথম মাসের বেতনের টাকা দিয়ে রিকশাটা কিনে নিলাম করিম চাচার কাছ থেকে। স্যার আপনার ভাই তো ফোন দিয়েই চলছে। সফিক সাহেবের কথায় ব্যস্তবে ফিরে আসলাম। আজ আমি এই কোম্পানির এমডি পথে। আগের সজীব আর এখনকার সজীবের পার্থক্য অনেক। চিনক চাকন রোগা সোগা সেই সজীব নেই। গায়ে মাংশ লেগেছে অনেকটাই।

-স্যার আপনার ভাই তো সেই কখন থেকে ফোন দিচ্ছে (সফিক সাহেব) শুভর ফোন টা রিসিভ করলাম।
-ভাই কই তুমি? (শুভ)
-কেন রে অফিসে।
-আজকেও থাকতে হবে ভাইয়া আমাকে নিয়ে অচিনপুরে যাবা না?
-হা হা হা হা যাবো রে এখনি বের হচ্ছি।

শুভর পরিক্ষার ফল বের হইছে। খুব ভালো রেজাল্ট। আজকে ওকে নিয়ে যাবো অচিনপুরে। যদিও জানি না এটা কোথায়। তবে কোন নামিদামি গাড়িতে না সেই করিম চাচার রিকশায়। খুব যন্তে রেখে দিয়েছি। আমার আর শুভর মধ্যে ৩য় কাউকে আনি নি। না হয় কাটিয়ে দিবো ওকে নিয়েই বাকিটা জীবন। বাসায় গিয়ে দেখি শুভ রিকশার সিটে বসে আছে।

-কি রে তুই ওখানে কেন?(আমি)
-তুমি তো অনেক চালালে ভাইয়া এবার না হয় আমিই চালাই?

কথাটা শুনেই চোখে পানি খেলা করতে লাগলো। শুভ চালাচ্ছে আপন মনে। গন্তব্য অচিনপুর। পাবো কি সেই অচিনপুরের সন্ধান? জানা নেই তবুও চলছি দুই ভাই আপন মনে। চলুক না এই ভাবেই দুইটি জীবন।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত