আঁচড়

আঁচড়

সাজুর ময়নাতদন্তের রিপোর্ট দেখে চোখ কপালে উঠে গেল আমার । এটা কী করে সম্ভব !! হৃদপিন্ডে নখের আঁচড় !! সাত পাঁচ ভেবে লাশটা ভ্যানে তুলে সদর হাসপাতাল থেকে সোজা কুট্টিপুর চলে আসলাম । থানায় এসে দেখি একজন সাংবাদিক বসে আছেন। সাজুর মৃত্যুর ব্যাপারে জানতে চান তিনি ।

আমি কেশে গলা পরিষ্কার করে বললাম,’আমি তানজির শাহরিন । কুট্টিপুর গ্রামের বর্তমান ওসি। আজ সকাল ৬টা নাগাদ খবর পাই যে সাজু মারা গেছে। মৃতদেহ দেখে ভেবেছিলাম হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছে । কিন্তু ময়নাতদন্তের রিপোর্টে জানতে পারি তাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে । তবে সবচেয়ে ভয়ংকর তথ্যটা হল ওর হৃদপিন্ডে নখের আঁচড় পাওয়া গেছে। আমরা বিষয়টা নিয়ে দ্রুতই তদন্ত শুরু করবো।তদন্তে নতুন কিছু জানতে পারলে আপনাদের জানাবো।’

আমার কথা শেষ হলে সাংবাদিক চলে গেলেন।আমিও থানা থেকে বের হলাম। বান্দরবানের অত্যন্ত দুর্গম গ্রাম কুট্টিপুর। সবমিলিয়ে ষাট সত্তর জন মানুষের বাস এখানে। কোনো হাসপাতাল বা স্কুল নেই।পাঁচ কি.মি দূরে সদরে যেতে হয় গ্রামবাসীদের । এখানে টিনের তৈরী সেমিপাকা ছোট একটা থানা আছে । এমন গ্রামে থানার ওসি হওয়া দূর্ভাগ্যই বটে। যাই হোক, থানা থেকে বেরিয়ে সাজুর বাড়িতে লাশটা নিয়ে আসলাম।ওর আত্মীয়স্বজন সবাই কান্না করছে। আমি ওর ভাইকে জিজ্ঞাসা করলাম,’ সাজুর ঘরের দরজা কি ভাঙ্গা বা খোলা ছিল?’ ওর ভাই কেঁদে কেঁদে বলল,’না স্যার । সকালে অনেক ডাকাডাকি করার পরও ভাই উঠছিলো না।পরে দরজা ভেঙ্গে ভিতরে ঢুকে দেখি…’কথা শেষ করার আগেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো ও।

ওর কথা শুনে একটু চিন্তায় পড়ে গেলাম। দরজা ভেতর থেকে আটকানো থাকলে সাজুকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করলো কে? আর নখের আঁচড়ের কথাটা এখনও ভাবতেই পারছি না।হঠাৎ কে যেন পেছন থেকে শার্ট ধরে টানলো। তাকিয়ে দেখি ছোট একটা ছেলে আমার শার্ট ধরে টানছে।আমি জিজ্ঞাসা করলাম,’কী হয়েছে?’ তখনই ওর মা ছুটে এসে বলল,’স্যার, ও প্রতিবন্ধী । কথা বলতে পারে না ।দয়া করে কিছু মনে করবেন না ।’ বলেই ছেলেটাকে কোলে নিয়ে চলে গেল। আমিও থানায় ফিরে আসলাম । দুই দিন কেটে গেল। তদন্তে কোনো অগ্রগতিই হয় নি। এমন অদ্ভুত বিষয়ের সম্মুখীন এই প্রথমবারের মত হলাম । সন্ধ্যা বেলা । ঘড়িতে তখন ৭টা বাজে ।

আমি থানায় বসে ভাবছি সাজুর মৃত্যুর ব্যাপারে ।হঠাৎ খুটখুট শব্দ শুনে বাহিরে তাকিয়ে দেখি সেই ছোট ছেলেটা খালি গায়ে থানার সামনে দাঁড়িয়ে আছে । আমি ওর কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম,’কিছু বলবে তুমি ?’ ও আমার হাত ধরে টানতে লাগলো । আমি ওর পিছু পিছু গেলাম । ও হিরুর বাড়ির সামনে গিয়ে ইশারায় বার বার বাড়িটা দেখাতে লাগলো । আমি কিছুই বুঝলাম না । এদিকে ছেলেটা কথাও বলতে পারে না । কিছুক্ষণ ভেবে ছেলেটকে নিয়ে ওর বাড়ি আসলাম ।

ওর মা আমাকে দেখে বলল,’স্যার, আপনি ?’ আমি বললাম,’হ্যাঁ, আমি । আপনার ছেলে মনে হয় কিছু বলতে চায় । আপনি কী জানেন ও কী বলতে চায় ?’ ওর মা শুকনো হাসি হেসে বলল,’ও পিচ্চি ছেলে; প্রতিবন্ধী । ও কী বলবে !! আপনি শুধু শুধুই ওর কথায় কান দিচ্ছেন।’ আমি কিছু বলতে যাবো তখনই ছেলেটা আমার হাত ধরে আবার টেনে কোথাও নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলো। আমি ওর পিছন পিছন হাঁটতে লাগলাম ।ওর মা ওকে যেতে বাধা দিল । আমি বললাম,’ওকে বাধা দিবেন না। ওকে যেতে দেন ।’

ছেলেটা সরু রাস্তা ধরে হাঁটছে । ওর পিছনে আমি আর ওর মা হাঁটছি । চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার । আমি টর্চ জ্বালালাম । হাঁটতে হাঁটতে আমরা থানার পিছনের জঙ্গলে চলে আসলাম । একটু গভীর জঙ্গলে গিয়ে ছেলেটা থামলো। একটা ঝোঁপ দেখালো ইশারায় । আমি টর্চ নিয়ে ঝোঁপটা সরাতেই দেখলাম সাদা একটা বস্তা । বস্তাটা হাতে নিয়ে থানায় ফিরে আসলাম । বস্তার মুখের বাঁধনটা খুলতেই বিদঘুটে একটা গন্ধ নাকে এসে লাগলো। নাক চেপে ধরে দেখলাম বস্তার ভেতর একটা ছোট মেয়ের জামা আর বিকৃত একটা লাশ । আমি ওর মাকে জিজ্ঞাসা করলাম,’ আপনি এই লাশ সম্পর্কে কিছু জানেন ?’ মহিলাটা আমতা আমতা করে বলল,’না স্যার ।’ আমি ধমক দিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম,’সত্যি করে বলুন ।’ মহিলটা থতমত খেয়ে বলল,’জানি স্যার । তবে আমার কথা কাউকে বলবেন না দয়া করে ।’ আমি শান্তকণ্ঠে বললাম,’আপনি নির্ভয়ে বলুন ‘

মহিলাটা বলল,’২-৩ মাস আগের কথা ।তখন আপনি এই থানার ওসি ছিলেন না ।সেদিন বিকালে আমার ছেলেটা খেলতে খেলতে জঙ্গলের ভেতর চলে গিয়েছিলো । আমি ওর পিছন পিছন গিয়ে শুনি কারা যেন ফিসফিস করে কথা বলছে । আমি একট গাছের আড়াল থেকে উঁকি দিয়ে দেখি হিরু আর সাজু ছোট একটা মেয়ের মুখ চেপে ধরে ধর্ষণ করছে । মেয়েটা হাত পা ছুড়ছে কিন্তু কিছু বলতে পারছে না । ধর্ষণের পর গলা টিপে মেয়েটকে হত্যা করে বস্তায় ভরে ঝোঁপে লুকিয়ে রাখে । ওরা দুজন এই এলাকার প্রভাবশালী মাস্তান । আমাদের দেখলে আমাদেরও মেরে ফেলতে পারে এই ভয়ে লুকিয়ে রইলাম । কিন্তু দূর্ভাগ্যক্রমে যাওয়ার সময় আমাদের দেখে ফেলল ওরা ।দেখেই ছুরি হাতে মারতে আসলো আমাদের ; ওদের পা জড়িয়ে ধরে বললাম,আমি কাউকে কিছু বলবো না, দয়া করে আমাদের মেরো না । ওরা আমাদের ছেড়ে দিল কিন্তু হুমকি দিল যদি কখনও মুখ খুলি তাহলে পরিবারের সবাইকে মেরে ফেলবে । ওরা টাকা দিয়ে তখনকার ওসিকেও হাত করে নিয়েছিলো । তাই ভয়ে আমি এতদিন কাউকে কিছু বলি নি ।’

আমি দ্বীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম,’ছিঃ একটা বাচ্চা মেয়েকে ধর্ষণ !! কতটা বিকৃত মনমানসিকতা ওদের । আচ্ছা আপনি যান । আপনার কোনো ভয় নেই । আমি কাল হিরুর সাথে কথা বলবো । আর সাজু তো মারাই গেছে ।’ মহিলাটা তার ছেলেকে নিয়ে চলে গেল । আমি ফাইল উল্টিয়ে দুই তিন মাস আগের কেসগুলো খুঁজতে লাগলাম । সেখানে দেখলাম প্রায় আড়াই মাস আগে পাশের গ্রামের আট বছরের এক মেয়ে তিথিরের নিখোঁজ হওয়ার বিষয়ে সাধারণ ডায়েরী করা হয়েছিলো ।

পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই একটা মৃত্যুসংবাদ শুনে অবাক হলাম খুব ; হিরু মারা গেছে । ওর লাশটা দেখে মনে হল হার্ট অ্যাটাকেই মারা গেছে । দ্রুত ময়নাতদন্তের জন্য লাশটাকে সদর হাসপাতালে পাঠালাম । অন্যদিকে তিথিরের বাবা মাকেও খবর দিলাম । ওরা আসতেই জিজ্ঞাসাবাদ করে জানতে পারলাম আড়াই মাস আগে এক বিকালে তিথির তার বিড়ালের সাথে খেলতে গিয়ে হারিয়ে যায় । অনেক খুঁজেও আর কোনো হদিস পাওয়া যায় নি ওর।

আমি বস্তার লাশ আর জামাটা তাদের দেখালাম । জামা দেখে ওরা সনাক্ত করলো এটা ওদের মেয়ে তিথিরেরই লাশ । লাশটা তাদের হাতে হস্তান্তর করে আমি সদর হাসপাতালে ছুটলাম । ময়নাতদন্তের রিপোর্ট শুনে অজানা আতঙ্কে আমার বুক কেঁপে উঠলো । । সাজুর মতই শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে হিরুকে ; ওর হৃদপিন্ডেও পাওয়া গেছে নখের আঁচড় । ডাক্তাররা আঁচড়গুলো ভালো করে পরীক্ষা করে বলল, এগুলো চিকন নখের আঁচড়, বিড়াল বা কুকুরের আঁচড়ের মত ।’ পুরোটা শুনে আমি আঁৎকে উঠলাম । হিরুর লাশ নিয়ে কুট্টিপুর যেতে যেতে ভাবলাম ক্ষমতার দাপটে পুলিশের হাত থেকে বাঁচলেও তিথিরের হাত থেকে বাঁচে নি ওরা ।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত