রাগিণী এইচ. এস. সি. পরীক্ষার্থী। গত কয়েকদিন ধরে কলেজে যাচ্ছে না। আসলে সে খুব অসুস্থ। চিকেন পক্স হয়েছে। তার সাথে জ্বরও বেশ কাবু করে ফেলেছে তাকে। সারা শরীর যেন পুড়ে ছাই হয়ে যাবে এমন অবস্থা। এ অবস্থায় বাড়ির বাইরে যাবার কথা সে কল্পনাই করতে পারে না। তার নিজের রুমই এখন তার পুরো দুনিয়া। তার বোন শান্তা এবার এস. এস. সি. দেবে।
বাবা ইলিয়াস হোসেন মারা গেছেন প্রায় দু বছর হয়। বাবার রেখে যাওয়া পেনশনের টাকা আর মা লুবনা জাফরিনের স্কুলে শিক্ষকতার টাকায় সংসার কোনওমতে চলে যায়। লুবনার খুব সাধ ওনার মেয়ে দুটোকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলবেন। এর জন্য যত ঝড় ঝাপটা আসে আসুক; তিনি ঢাল হয়ে সব কঠোরভাবে মোকাবেলা করবেন। ওনার মায়ের এই দৃঢ়চেতা মনোভাব মেয়েরাও পেয়েছে। তারাও কোনোকিছুতেই সহজে হাল ছাড়ে না। The Gladiator সিনেমার নায়ক ম্যাক্সিমাসের মতন শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করে যায়। হোক সেটা আবদারের মাধ্যমে মার কাছ থেকে কোনও কিছু আদায় করে নেয়া কিংবা পরীক্ষার খাতায় ভালো নাম্বার অর্জন করা। যাইহোক, নিঃসন্তান কোনও দম্পতিকে যেমন পোষা পাখী কিংবা প্রাণী সঙ্গ দেয়, রাগিণীকে সঙ্গ দিচ্ছে তার মোবাইল ফোন এবং ল্যাপটপ।
সে দিনের প্রায় পুরোটা সময় হয় বান্ধবীদের সাথে ফোনে কথা বলে কাটায় নতুবা ফেইসবুকে চ্যাট করে এবং কানে ইয়ারফোন লাগিয়ে রোম্যান্টিক গান শুনে। সাধারণত রাগিণী অপরিচিত কাউকে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পাঠায়ও আবার গ্রহণও করে না। কারো গতিবিধি সন্দেহজনক দেখলে সাথে সাথে ব্লক মেরে দেয়। শান্তাওফেইসবুক ব্যবহার করে তবে লুকিয়ে।তার বড় বোন খুব কড়া করে তাকে নিষেধ করেছে এখন ফেইসবুক ব্যবহার না করতে। বলেছে এস. এস. সি. পাস করার পর অনুমতি মিললেও মিলতে পারে। নিষিদ্ধ বস্তুর প্রতি আকর্ষণ মানব চরিত্রের একেবারেই সাধারণ একটা দিক। ফেইসবুক ব্যবহার করা নিষিদ্ধ কিছু নয় কিন্তু রাগিণীর এত কড়াকড়ির কারণে শান্তার আকর্ষণ দ্বিগুণ বেড়ে গিয়েছিল।
তাইতো একমাস আগে তার মোবাইলের মাধ্যমে শান্তা ফেইসবুক ব্যবহার করা শুরু করেছিল। শান্তা চালাকি করে প্রোফাইলে নিজের ছবি দেয়নি। লাল গোলাপ হাতে একটি শিশুর ছবি দেয়া। এমনকি সে তার প্রকৃত নাম গোপন রেখে ছদ্মনাম দিয়েছে। কারণ সে বেশ ভালো করেই জানে যে সে যেই কলেজের শিক্ষক, তার বোন সেই কলেজের অধ্যক্ষ! এর মানে হচ্ছে এই যে শাহরুখ খান হয়তো ‘ডন’ ছবিতে সবসময় খুব সহজেই পুলিশের চোখকে ফাঁকি দিতে পারে কিন্তু শান্তার পক্ষে তার বড় বোনের চোখকে ফাঁকি দেয়া অসম্ভব। ইতোমধ্যে ফেইসবুকের মাধ্যমে একটি ছেলের সাথে শান্তার খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। একদমসরল বাক্যে বললে বলতে হয়- প্রেমে পড়েছে।
ছেলেটি নিজেকে আজহার মাহমুদ বলেই পরিচয় দিয়েছে। বলেছে যে বর্তমানে সে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিসংখ্যান বিভাগে স্নাতক তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। এই দুটি প্রাণের মধ্যে যোগাযোগ যা হচ্ছে তা অবশ্য প্রযুক্তির আশীর্বাদের কল্যাণে- ফেইসবুক এবং ফোনালাপ এ দুটি মাধ্যমে। ছেলেটি অবশ্য বারবার বাইরে কোথাও দেখা করার কথা শান্তাকে বলেছে কিন্তু শান্তা এতে কখনই রাজি হয়নি এবং এটা অসম্ভব বলেই তাকে জানিয়ে দিয়েছে। ওদিকে রাগিণীও আজকাল প্রেমের হাওয়ায় ভেসে বেড়াচ্ছে। তার সম্পর্কের শুরুটাও ফেইসবুকেই। যাইহোক, একদিন শান্তা বুকে অনেক সাহস সঞ্চয় করে আজহারের সাথে দেখা করার জন্য প্রস্তুতি নেয়।
ঘর থেকে বের হবার সময় মাকে মিথ্যা কথা বলেছে যে সে তার বান্ধবীর বাসায় যাচ্ছে; এক ঘণ্টার মধ্যেই চলে আসবে। মা তাকে বলেছে খুব সাবধানে যেতে। দিনকাল ভালো না। কখন কি হয়ে যাই। শান্তার পরনে আকাশী নীল রঙের একটি জামা। নীল তার সবসময়ই প্রিয়। সে এমনিতেই পরীর মত সুন্দরী। তাই তাকে খুব একটা সাজগোজ না করলেও সুন্দর দেখায়। খুব কালো কাজলের মত তার কালো চুল সে আজছেড়ে দিয়েছে। পদ্মফুলের মত গোলাপি ঠোঁটে ছুঁয়ে দিয়েছে হালকা গোলাপি লিপস্টিক। আজহার শান্তাকে বলেছে পার্শ্ববর্তী পার্কে আসতে। সেখান থেকে ওদের রিক্সায় ঘুরে বেড়াবে, এই হচ্ছে প্ল্যান। যথারীতি শান্তা সময়মত পৌঁছে যায়। যাবার সময় যদিও তার বেশ চিন্তা হচ্ছিল জ্যামের কথা ভেবে।
আজহারের চোখে কালো সানগ্লাস, একটি নীল রঙের জিন্স, গায়ে কালো টিশার্ট এবং বাম হাতে একটি সুদৃশ্য ঘড়ি পরা। শান্তাকে দেখা মাত্রই সে তার হাতে ধরা জ্বলন্ত সিগারেট ফেলে দিয়েছে। মুখ দিয়ে এখনও ধোঁয়া বের হচ্ছে। সিগারেট এবং এর ধোঁয়া শান্তার দু চোখের বিষ। শান্তা কিছুটা বিরক্তি নিয়েই আজহারের দিকে তাকিয়ে আছে। সে ভেবেছে যে পার্কে কিছুক্ষণ বসবে, ছেলেটির সাথে কথা বলবে। সে কিছু বলার আগেই আজহার রিক্সায় উঠে বসে। রিক্সা চলছে। শান্তা লজ্জায় নিজের নখ কামড়াচ্ছে। সে যে কি করবে বা কি বলবে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। জীবনে এই প্রথম সে কোনও অপরিচিত মানুষের এত কাছে শান্তা বসেছে। অপরিচিত এই অর্থে যে আজহার তার কোনও আত্মীয় নয়। আজহারের বাম হাত শান্তার ডান হাতের সাথে ঘেঁষে আছে। আজহার বলে,
– কেমন আছো?
– ভালো।
– আমাকে জিজ্ঞেস করবে না কেমন আছি?
– কেমন আছেন?
– ভালো ছিলাম।
– ভালো ছিলাম মানে কি? আমার সাথে দেখা হবার পর কি মন খারাপ হয়ে গেল নাকি? আমি কি সুন্দর নই?
– আরে না, না। তেমন কিছুই না। তুমি খুবই সুন্দর।
– তাহলে?
– ভালো ছিলাম, তোমার সাথে দেখা হবার পর আরও ভালো বোধ করছি, হা, হা, হা।
– আমাকে বোকা বানানো হচ্ছে না?
– কিছু মনে কর না। একটু দুষ্টামি করলাম।
– ঠিক আছে। আচ্ছা, আমরা কোথায় যাচ্ছি?
– নির্দিষ্ট কোনও গন্তব্য নেই, অনেকক্ষণ তোমার সাথে রিক্সায় ঘুরব।
– রিক্সায় ঘুরতে আমার ভালোই লাগে তবে আপনার ঐ অনেকক্ষণ শব্দটায় আমার ঘোর আপত্তি আছে।
– কেন? কি সমস্যা?
– আম্মুকে বলেছি এক ঘণ্টার মধ্যেই বাসায় ফিরব। যদি তা না হয়, মা এবং বোন খুব দুশ্চিন্তা করবে। অনবরত ফোন করতে থাকবে।
– তোমাকে এতদিন অনুরোধ করার পর আজ দেখা হল তাও মাত্র এক ঘণ্টার জন্যে? তুমি আসতে আসতেই তো আধা ঘণ্টা শেষ হয়ে গেছে!
– প্লিজ বুঝতে চেষ্টা করেন, আজ না হয় তাড়াতাড়ি চলে যাই; কথা দিচ্ছি আরেকদিন অনেক সময় নিয়ে দেখা করব।
– মনটা খুব খারাপ হয়ে গেছে।
– আপনার মন খারাপ হলে আমারও মন খারাপ হবে। প্লিজ এমন করে বলবেন না।
সেই মুহূর্তেই রিক্সা ছেড়ে দিয়ে আজহার শান্তাকে নিয়ে একটি রেস্তোরাঁয় গিয়ে বসে। শান্তার মোটেও ইচ্ছে ছিল না কিন্তু আজহারের বিমর্ষ চেহারা দেখে সে রাজি হয়। হালকা খাবার এবং কোমল পানীয় অর্ডার করা হয়। খাবার খেতে খেতে চোখে চোখে কত যে কথা হয় তা ভাষায় ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়।
চোখের ভাষার শক্তি কখনও কখনও মুখের ভাষার শক্তিকেও ছাড়িয়ে যায়। শান্তা আজহারের মনের অবস্থা জানে না সত্যি কিন্তু তার মন নামক ঘরটিতে এতদিন প্রেম প্রবেশ করতে পারেনি। এখন প্রেমের হাতে সে যেন পুরো জিম্মি হয়ে গেছে। তার মনে হয় যেন ভালোবাসার চেয়ে সুন্দর, ভালোবাসার চেয়ে নান্দনিক আর কিছু হতে পারে না। কোমল পানীয়তে চুমুক দিতে দিতে শান্তা খেয়ালই করেনি কখন যে তার বড় বোন রাগিণী আজহারের পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। আজহার তাকে দেখতে পাচ্ছে না। শান্তা তাকে দেখে এমন ভাব করে যেন সে যমদূতকে দেখছে। বোনের কাছে হাতেনাতে ধরা! এবার সে পালাবে কোথায়?
শান্তা চেয়ার ছেড়ে বিদ্যুতের গতিতে উঠে দাঁড়ায়। সে ইতস্তত বোধ করছে। রাগিণী আজহারের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। আজহারকে দেখার সাথে সাথে রাগিণীর দু চোখ বড় হয়ে গেছে। যেন তার সারা শরীর বজ্রের আঘাতে অবশ হয়ে গেছে। রাগিণী টেবিলে রাখা কোমল পানীয়ের গ্লাসটি নিয়ে আজহারের মুখে ছুঁড়ে মারে। তারপর চোখেমুখে ক্রোধ এবং ঘৃণার অভিব্যক্তি নিয়ে শান্তার হাত ধরে ঝড়ো বাতাসের বেগে সেই স্থান ত্যাগ করে। এই আজহারই হচ্ছে সেই প্রতারক যার সাথে ফেইসবুকে এতদিন রাগিণীরও প্রেম চলছিল!