— মামা, এটার দাম কত? (একটা শামুকের ফুল হাতে নিয়ে দোকানিকে জিগ্গেস করলাম)
— একদাম দেড়শো মামা (দোকানি)
— একটু কম হবেনা?
— না মামা, একদাম
শো-পিসটা ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখছিলাম ৷ হটাৎ কেউ ছোঁ মেরে হাত থেকে নিয়ে গেল ওটা ৷ তাঁকিয়ে দেখি একটা মেয়ে৷ একটু রাগি দৃষ্টি দিয়ে দোকানির দিকে তাঁকিয়ে বলল,
— আরে আপনাকে বলে গেলাম এটা আমি নেবো ৷ তাহলে আবার ওনাকে দিচ্ছেন কেন? (মেয়েটা)
— এমন তো অনেকেই বলে যায় আপা, আসে কজন? (দোকানি)
— এইযে ম্যাডাম, আমার হাত থেকে নিলেন কেন ওটা? ওনার সাথে আপনার কি কথা হয়ছে সেটা ওনার সাথে বুঝবেন ৷ মামা, এটা আমি নেবো ৷ দোকানি একটু বিব্রত অবস্থায় পড়ে গেল, কারন এটার এই একটাই আছে ৷ মেয়েটা আমার দিয়ে মুখ কাচুমাচু করে বলল,
— দেখুন, এটা আমি আমার একজন প্রিয় মানুষের জন্য নিচ্ছি ৷ আপনি প্লিজ অন্য একটা নিন ৷
কিছুক্ষণ নিরব থেকে কিছু না বলে একটা মুচকি হাসি দিয়ে চলে আসলাম ৷ হয়তো তার বয়ফ্রেন্ডের জন্য নিচ্ছে ৷ মেলায় ঘুরতে ঘুরতে আরও কয়েকবার চোখাচোখি হলো ৷ প্রতিবারই দুই ঠোট চেপে কেমন যেন চোখ বড় বড় করে তাঁকালো আমার দিকে ৷ এক সপ্তাহ কেটে গেছে ৷ মেয়েটাকে একপ্রকার ভুলেই গেছি ৷ সেদিন ক্লাস শেষ করে বসে বসে ঝালমুড়ি খাচ্ছি ৷ হটাৎ দেখি সেদিনের সেই মেয়েটি তার কিছু বান্ধবীদের সাথে কথা বলতে বলতে যাচ্ছে ৷ আমি ডাক দিলাম,
— এইযে ছোঁ-রাক্ষসী (আমি)
মেয়েগুলো আমার দিকে তাঁকালো ৷ তারপর ছোঁ রাক্ষসী ওদের যেতে বলে আমার দিকে আসতে লাগলো ৷ বিড়ালের মত বড় বড় চোখ করে এমন ভাবে তাঁকিয়ে আছে যেন আমি তরকারীর উপরে ভেসে থাকা কই মাছের পিস, কাটা সমেত খেয়ে ফেলবে ৷ কাছে এসে বলল,
— কি বলে ডাকলেন আপনি? (মেয়েটা)
— কি বলে? (আমি)
— আমি ছোঁ-রাক্ষসী?
— এটা তো আপনার নাম মনে হয়না, তাহলে আপনার কেন মনে হলো যে আমি আপনাকে ডাকছি? তাহলে আপনি কি ছোঁ-রাক্ষসী?
— দেখুন, উল্টা পাল্টা লজিক দেখাবেন না
— হা হা, যাইহোক একটা ধন্যবাদ নেওয়ার জন্য ডাকলাম
— কি!!?? আজব!!
— জী
— কি?
— আমি আজব
— হুহ্, ধন্যবাদ ৷ হইছে? যত্তসব!!
— বয়ফ্রেন্ডের পছন্দ হয়েছিল ওটা?
— এ হ্যালো, ওটা আমার ভাইয়ের জন্য নিয়েছিলাম ৷ পরদিন ওর বার্থডে ছিল ৷ আর আমার কোন বয়ফ্রেন্ড নেই
— গ্রিন সিগনাল
— কি?
— কিছুনা, যান মেয়েটা চলে যেতে যেতে থমকে দাঁড়ালো ৷ বিদ্যুৎ গতিতে আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল,
— গ্রিন সিগনাল মানে? (মেয়েটা)
— কাল সকাল নয়টা, কলেজ ক্যান্টিন, দু-কাপ কফি, ভয় নেই, বিলটা আমিই দেবো (আমি)
— মানে কি?
হুহ্ আমি অন্যমনষ্ক ভাব নিয়ে চলে আসলাম ৷ যাহ, মেয়েটার নামই তো জানা হলো না ৷ কি আর করা, পরেরবার জেনে নেবো ৷ পরদিন যথা সময়ে কলেজ ক্যান্টিনে বসে আছি ৷ একটু পরে মেয়েটা আসলো ৷ দু-কাপ কফি শেষ হলো, কিন্তু কোন কথা হলো না ৷ মেয়েটা চলে যাওয়ার উদ্রেক করতেই বললাম,
— আপনার নামটা জানা হলো না (আমি)
— আমিও তো আপনারটা জানিনা (মেয়েটা)
— উমমম, আজব, আজব সরকার
— আমি ছোঁ-রাক্ষসী মজুমদার
বলেই মুচকি হাসি দিল ৷ আউচ, বুকের বাঁ-পাশটায় চিনচিনে ব্যথা অনুভব করলাম ৷ বেশ কিছুদিনের মধ্যে ভালই বন্ধুত্ব হয়ে গেল মেঘার (মেয়েটার নাম) সাথে ৷ কিন্তু আমি বন্ধুত্ব নিয়ে খুশি থাকতে পারছি না ৷ চিনচিনে ব্যথাটা রোজ বেড়েই চলেছে ৷ কিন্তু ভয়ে চুপ হয়ে আছি, যদি বন্ধুত্বটা নষ্ট হয় ৷ ছাদে দাঁড়িয়ে মেঘার আচরণগুলে মনের মধ্যে রিভাইস দিয়ে আমার প্রতি ওর অনুভূতি বোঝার চেষ্টা করছি ৷ হটাৎ রাহাতের ফোন,
— হ্যালো (আমি)
— দোস্ত খুব ঝামেলায় পড়ে গেছি (আমি)
— কি হয়েছে তোর?
— তোর ওখানে রাতে থাকা যাবে? এসে বলছি সব
— ওকে, আয়
— হুম
ফোনটা কেটে দিয়ে রুমে চলে আসলাম ৷ আধাঘন্টা পরে রাহাত দুইটা ব্যাগ নিয়ে হাজির হলো ৷ মুখ দেখে মনেহলো খুব বড় বিপদে পড়েছে ৷
— কিরে, কি হয়েছে বল এবার (আমি)
— তোকে বলেছিলাম না বাড়িওয়ালার মেয়ের কথা? (আমি)
— হুম, দেখালিই না একবারও
— আমাদের সম্পর্কের কথা ওর বাবা জেনে গেছে ৷ আমায় বাসা থেকে বের করে দিছে, ওরও নাকি বিয়ে দিয়ে দেবে খুব তাড়াতাড়ি ৷ আমি কি করবো বুঝতে পারছি না
— শান্ত হ, ওর সাথে কথা বলেছিস?
— হুম
— পালাতে পারবে তোর সাথে?
— ও সেটাই বলেছে ৷ কিন্তু কিভাবে? আমাকে ওর ধারেকাছেও দেখলে প্রবলেম হবে খুব ৷
— ওকে, আমি ওকে নিয়ে আসবো, তুই স্টেশন অপেক্ষা করবি
— থ্যাঙ্কস দোস্ত
— দোস্ত বলে থ্যাংকস দিচ্ছিস?
— ওকে, দেবোনা
— কিন্তু ওকে পাবো কোথায়, চিনবো কেমনে?
— আমাদের কলেজেই পড়ে, আমি তোকে ওর ছবি দিয়ে দিচ্ছি
— ওকে
রাহাত একটা ছবি দিলো আমার হাতে ৷ ছবিটা দেখেই বুকটা কেঁপে উঠলো, এটা তো মেঘা ৷ রাহাতকে রেস্ট নিতে বলেই ছাদে চলে আসলাম ৷ খুব হাসি পাচ্ছে, কাল আমার ভালবাসাকে তার ভালবাসার হাতে তুলে দিয়ে আসবো ৷ পাঠকদের চোখে হয়তো কত মহৎ হয়ে থাকবো ৷ কিন্তু ভেতরের খবর কেউ রাখবে না ৷ উপরের দিকে একবার তাঁকালাম, কিন্তু কাউকে দেখলাম না ৷ তাই মনের মধ্যে জন্ম নেওয়া প্রশ্নগুলো মনেই রয়ে গেল ৷
পরদিন সকালে কলেজ যাওয়ার পথে মেঘাকে নিয়ে আসলাম ৷ রাহাত আগেই সব বলে রেখেছিল মেঘাকে ৷ স্টেশনে এসে দেখি রাহাত টিকিট টেকে ওয়েট করছে ৷ একটু পরেই ট্রেন আসলো ৷ ওদের ট্রেনে তুলে দিয়েই আমি উল্টো দিকে হাটা শুরু করলাম ৷ পিছন ফিরে ভালবাসা হারিয়ে যাওয়ার দৃশ্য দেখার সাহস হলো না ৷ কাউকে ভালবাসা মানে শুধু তাকে কাছে পাওয়া নয়, বরং তাকে তার সুখের ঠিকানায় পৌছে দেওয়ারও দায়িত্ব নেওয়া ৷ যদি সে অন্য কারো কাছে তার সেই সুখ খুজে পায় তাহলেই আমার ভালবাসা সফল ৷ আর সেই সুখের ঠিকানায় পৌছে দেওয়ার সুযোগ খুব কম প্রেমিকই পায় ৷
রাতে দুইটা ঘুমের ঔষধ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম ৷ পরদিন সন্ধ্যায় ঘুম ভাংলো ৷ ফ্রেশ হয়ে ফোনটা হাতে নিলাম ৷ দেখি বিকাশে ৫০০ টাকা পাঠিয়েছে কেউ, আর বাবার ৪টা মিসকল ৷ টাকা তাহলে বাবাই পাঠিয়েছে ৷ কিন্তু মাসের শেষে টাকা পাঠালো হটাৎ ৷ ভাবতে ভাবতে ফোন দিলাম,
— হ্যালো বাবা, কেমন আছো? (আমি)
— ভাল, ফোন ধরিসনা কেন? (বাবা)
— ঘুমাইছিলাম
— ওহ, টাকা পাঠিয়েছি ৫০০ ৷ সন্ধ্যার গাড়িতে বাড়ি আয়
— ঠিক আছে
আমি নিজেও ভাবছিলাম বাড়ি থেকে ঘুরে আসবো কিছুদিনের জন্য ৷ যাক, সন্ধ্যার গাড়িতে রওনা দিলাম ৷ পৌছাতে পৌছাতে ১২টার বেশি বেজে গেল ৷ বাড়ির মধ্যে ঢুকতেই চমকে উঠলাম! বাবা, মা, রাহাত আর মেঘা বসে গল্প করছে৷ আমি কিছু না বলে আমার রুমে চলে আসলাম ৷ ফ্রেশ হয়ে বিছানায় বসে আছি ৷ একটু পরে মেঘা আর রাহাত আসলো, মেঘার হাতে একটা থালায় ভাত আর কিছু তরকারি ৷ অন্য হাতে একটা জলের মগ ৷
— কিরে, একদিনেই দেবদাস হয়ে গেছিস যে (রাহাত)
— দেবদাস হবো কেন? আমার কি পারু পালাইছে নাকি? (আমি)
— হুম, পালিয়ে তোর বাড়ি এসে উপস্থিত ৷ নে, তোর পার্বতী থাকলো, আমার ঘুম পাচ্ছে, গেলাম ৷ রাহাত চলে গেল, আমি মেঘার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাঁকালাম,
— মাথায় ঢুকলোনা কিছু? (মেঘা)
— (মাথা নাড়ালাম)
— উপর দিয়ে গেছে সব?
— ধুর! কি হয়েছে খুলে বলবা? আর তোমরা বিয়ে করোনি কেন এখনো?
— ওই কুত্তা, বিয়ে করার জন্যেই তোরে আনা হইছে
— মানে? ভাই তোমার পায়ে ধরি, কি হয়েছে একটু খুলে বলো
— হবু বউকে কেউ ভাই বলে?
— মানে?
— ধুর ছাই, তখন থেকে মানে মানে করছে ৷
ওকে শোনো, আমার জন্ম দিয়েই মা মারা যায় ৷ আমার দেখাশোনার জন্য বাবা আত্মীয়দের অনুরোধে আবার বিয়ে করে ৷ সব ঠিকঠাক ছিল ৷ সমস্যা হলো আমার ছোট ভাই হওয়ার পর ৷ বাবাও কেমন পাল্টে গেল ৷ তারপর একসময় বাবাও ছেড়ে চলে গেল ৷ শুরু হলো সৎমায়ের নির্যাতন ৷ অনেক কষ্ট সহ্য করে টিউশনি করে পড়া চালাচ্ছিলাম ৷ তখন তুমি এলে ৷ অল্প কয়েকদিনেই তোমায় কিভাবে ভালবেসে ফেললাম আমি নিজেও জানিনা ৷ তোমার হাবভাবেই বুঝেছিলাম তুমিও আমায় ভালবাস ৷ একদিন রাতে পড়তে বসে কলম দিয়ে হাতে লাভের মধ্যে তোমার নাম লিখি ৷ পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়ি ৷ মা (সৎ মা) এসে লেখাটা দেখে ফেলে ৷ তারপর আমায় অনেক বকাঝকা করে এবং তার ভাইয়ের ছেলের সাথে বিয়ে ঠিক করে ৷ আমি কি করবো বুঝতে পারছিলাম না ৷ অনেক ভেবে রাহাত ভাইয়ের সাথে মিলে এই প্লান করি ৷ তোমার বাবা মাকে রাহাত ভাই সব খুলে বলে, আমার ভাগ্যটা মনেহয় ভাল ছিল, তাই ওনারা সহজেই মেনে নিল সব
— হুম, বুঝলাম ৷ জিনিয়াস!!
— হি হি, থাঙ্কু ৷ খেয়ে নাও এবার
— হাতটা ব্যথা করছে, ব্যাগটা বেশি ভারি ছিল তো তাই
— বুঝি বুঝি
— জিনিয়াস বলে কথা
— নাও হা করো খাওয়া শেষ করে মেঘাকে বললাম,
— শেষ পাতে মিষ্টি… (আমি)
— এই, একদম না (মেঘা)
— একদম হ্যাঁ
মেঘা পিছাতে পিছাতে একেবারে দেওয়ালে গিয়ে ঠেকলো ৷ আমি ওর দুইপাশে দেওয়ালে হাত রাখলাম ৷ মেঘার খুব কাছে চলে আসলাম ৷ ওর নিঃশ্বাস পড়ছে আমার গলায় ৷ ঠোট চেপে চোখ বন্ধ করে আছে ৷ দুজনের ঠোটের মধ্যের দুরত্বটা আবছা আলোয় চোখে পড়লো না ৷ হটাৎ ফোনটা বেজে উঠলো, দিলো মুডটার বারো বাজিয়ে ৷ মেজাজটা চাঁন্দে উঠে গেল যখন দেখলাম রাহাতের ফোন ৷ ফোন ধরতেই,
— ভাত ছাড়া অন্য কিছু খাওয়ার চেষ্টা করোনা বাবু (রাহাত)
— তোর বাবুর ইয়ে করি, শালার রাহু, আসতেছি দাঁড়া মেঘার দিকে তাঁকিয়ে দেখি মিটি মিটি হাসছে ৷ আমি বললাম,
— তুমি এখানে ঘুমাও, আমি রাহাতের সাথে থাকবো আজ (আমি)
— ঠিক আছে (মেঘা)
— গুড নাইট
— গুড নাইট
মুখের উপর জলের ছিটে ঘুম ভাংলো, চোখ খুলেই সকাল সকাল মেজাজ গেল বিগড়ে
— এটা চুল ঝাড়ার জায়গা? (আমি)
— হুম, এটাই আমার ঘুম ভাঙানোর সিস্টেম ৷ কোন সমস্যা? (রেগে কটমট করে বলল মেঘা)
— না না, ঠিক আছে (ভয়ে ভয়েই বললাম)
— হুম, চোখ বন্ধ করো
— কেন?
— করো তো চোখ বন্ধ করলাম, একটু পরেই কপালে মেঘার ঠোটের স্পর্শ পেলাম ৷ চোখ খুলে দেখি মেয়েটা লজ্জায় লাল হয়ে আছে,
— এর জন্য তো আজীবন চোখ বন্ধ করে থাকা যায় (আমি)
— পাগল (মেঘা) মেঘা চলে যাচ্ছিল ৷ আমি হাতটা ধরে টেনে বসালাম,
— কি শক্ত হাত, গন্ডারের মত (মেঘা)
— গন্ডার তোমার হাত ধরেছিল কখনো? (আমি)
— না…..
— তাহলে গন্ডারের হাত কেমন জানলে কিভাবে?
— উফফ, আমার মাথা
— নিয়ে এসো
— কি?
— তোমার মাথা
— কোথায়?
— আমার কাছে
মেঘা কাছে আসতেই কানের কাছে মুখটা নিয়ে বললাম, “সকালের চায়ের কাপটায় তোর প্রতিচ্ছবি দেখতে চাই ৷ ঘুম তাড়াতে চাই তোর ভেজা চুলের ঝটকায় ৷ যখন একমনে রান্না করবি, ভর দুপুরে মন খারাপ করে জানলা দিয়ে আকাশপানে চেয়ে থাকবি, মাঝরাতে যখন দুঃস্বপ্ন দেখে উঠে বসবি, সারা মুখে ভয়ের ছাপ, তখন তখন বাতাসের কানে ফিসফিস করে তোকে বলব- ভালবাসি, ভালবাসি…”
মেঘা একটু কেঁপে উঠলো ৷ টুপ করে একফোঁটা জল এসে পড়লো আমার বুকের উপর ৷ না, তাতে দুঃখের কোন চিহ্ন নেই ৷ আছে জানলা দিয়ে প্রবেশ করা সদ্য কিরণের প্রতিচ্ছবি…