মাথায় টোপড়, গলায় মালা, গায়ে শেরওয়ানী পড়ে নিজের বাসার সামনে দাড়িয়ে আছি। আমি একা না। আমার তিন বন্ধু আর একটা মেয়ে। মেয়েটা আর কেউ নয় আমারই সদ্য বিবাহিত বউ। কি থেকে কি হয়ে গেলো সেটা ভাবতেই পারছিনা। ঘন্টা দুয়েক আগেও আমি সিঙ্গেল ছিলাম। আর এখন আমি অ-সিঙ্গেল, মানে বিবাহিত। ঘটনাটা অনেকটা এরকম
—কই তুই?
—এইসময় প্রতিদিন কোথায় থাকি?
—অফিসে?
—হুম।
—তাড়াতাড়ি কালীবাড়ি কাজী অফিসের সামনে আয়।
—আজকে আবার কোন বাপের বুক খালি করতে যাচ্ছিস?
—কি বলতে চাস?
—প্রতিবারই তো তুই কোন না কোন পালিয়ে আসা জোড়ার বিয়ে দিস। তাতে তাদের বাবা মায়ের কতটা ফাটে একবার ভেবে দেখেছিস? আবার আমাকেও সেই বিয়ের সাক্ষী বানাস।
—তো কি হইছে? আমি যা করি বুঝেশুনেই করি।
—তোর যা ইচ্ছা হয় তুই কর। আমি আসতে পারবোনা। আমার কাজ আছে।
—ঐ তুই আসবি? নাকি আমিই তোরে নিতে আসবো।
—থাক বাবা তোর আসার দরকার নাই। আমিই আসছি।
—এইতো গুড বয়। আর শোন..
—আবার কি? এবার কিন্তু কোন গিফট টিফট নিয়ে আসতে পারবো না। মাসের শেষ, হাত একদম ফাকা।
—গিফটের দরকার নাই। তুই তাড়াতাড়ি আয়। আর আসার সময় অফিস থেকে এক সপ্তাহের ছুটি নিয়ে আসিস।
—বিয়ে করবে ওরা আর ছুটি নেব আমি? কেমতে কি?
—আমি বলছি তাই নিবি। বিশ মিনিটের মধ্যে এসে পৌছাবি না হলে….
—না হলে কি?
—টুট….টুট….টুট….
যাব্বাবাহ! কিছু না বলেই কেটে দিলো। এতক্ষন কথা বলছিলাম অবন্তিকা আন্টির সাথে। আন্টি বলছি বলে ভাববেন না যে ও আমার মায়ের অথবা বাবার বোন। আসলে আজকাল সব বন্ধুরাই তো মামা। তাই আমি আমার বান্ধবীগুলারেও আন্টি বলে ডাকি। এই জন্য প্রায়ই ওদের রোষানলে পরতে হয় আমাকে। কিন্তু আমি কাজী নজরুলের ভক্ত। নজরুলের নারী কবিতায় পড়েছিলাম সাম্যের গান গাই, আমার চক্ষে পুরুষ রমনী কোন ভেদাভেদ নাই।
তাই ছেলে বন্ধুদেরকে যেহেতু মামা বলে সম্বোধন করা হয়, সেহেতু মেয়ে বন্ধুরাও আন্টি ডাকের দাবীদার। কিন্তু এটা সবার মাথায় ঢুকে না। বিশেষ করে এই মেয়েটার মাথায় তো একদমই না। যাই হোক আন্টি থুক্কু অবন্তিকা কেন ফোন করেছিলো সেটাই বলি। ও আসলে একটা চাকরী করে। বিনা বেতনে চাকরী। ওর পোস্টের নাম হচ্ছে লাভ মেশিন। আপনারা হয়তো ভাবছেন যে টাইম মেশিন শুনছি কিন্তু লাভ মেশিনটা আবার কি? চলুন বুঝিয়ে বলি ওর কাজ হচ্ছে বিয়ে দেয়া। তার মানে এই নয় যে ও কাজী (যদিও মহিলা কাজী হয় কিনা আমার জানা নাই)। কাজী না হয়েও ও বিয়ে দেয়। অত্র এলাকার যত প্রেমিক-প্রেমিকা আছে সবাই তার কাছেহ এসে ধন্না দেয়।
কারন একটাই, এই পর্যন্ত আমাদের এলাকায় যতগুলো প্রেমবিবাহ (আই মিন লাভ ম্যারেজ) হয়েছে তার সবগুলোই অবন্তিকার হাত ধরে। এক জোড়া প্রেমিক-প্রেমিকা পালিয়েছে শুনলেই ওর মাথায় যেন ভুত চেপে যায় তাদের বিয়ে দেয়ার জন্য। তাদের বিয়ে দিয়ে তারপর তার শান্তি। তুই বিয়ে দিবি ভালো কথা তার মধ্যে আবার আমাকে টানিস ক্যান? হ্যা। ওর প্রায় প্রতিটা প্রেমবিবাহেই আমাকে উপস্থিত থাকতে হয় সাক্ষী হিসেবে। তাই মাঝে মধ্যেই আমার ডাক পড়ে বিভিন্ন কাজী অফিসে। যখন অন্যের বিয়েতে যাই তখন খুব খারাপ লাগে। এতগুলান বিয়া খাইলাম-দিলাম কিন্তু আজ পর্যন্ত নিজে একটাও বিয়া করতে পারলাম না। বউ তো দুরের কথা আজ পর্যন্ত একটা গার্লফ্রেন্ড ও জোটাতে পারলাম না।
এটাও ওই মাইয়ার দোষ। কি ভাবছেন? মেয়ে আমার পেছনে ইট পেতে রেখেছে? একদম না। বরং উল্টোটা। আমিই তার পেছনে ইট পেতেছি। চার বছর আগে ওকে দেখার পর আর কোন মেয়ের দিকে তাকাতেই ইচ্ছে করে না। সবসময় শুধু ওর কথাই ভাবি। কিন্তু আজপর্যন্ত ওকে কথাটা জানানোর সাহস পাইনি। ওকে প্রায় প্রতি রাতেই চিঠি থুক্কু ইমেইল লিখি। কিন্তু সেটা ড্রাফটবক্সেই জমা থাকে। কোনদিনই ভুলেও সেন্ড বাটনে চাপ দেয়ার সাহস হয় নাই।
আমার ফেক আইডির সব পোস্টই ওকে নিয়ে। তাই ওরে ঐখানে ব্লক দিয়া রাখছি। যাইহোক আজকেও হয়তো কোন বিয়ে আছে। তাই আমাকে যেতে বলেছে। কিন্তু ছুটি নেয়ার কথা বললো কেন? এটা কিছুতেই মাথায় ঢুকছে না। কিচ্ছু করার নাই। আমাকে ছুটি নিতেই হবে। নাহলে এই মেয়ে এখানে চলে আসবে। আর তখন বস আমাকে চিরদিনের জন্য ছুটি দিয়ে দিবেন। তার চাইতে এক সপ্তাহের ছুটিই ভালো। যাইহোক এসে পড়েছি কাজী অফিসের সামনে…..
—কিরে কার বিয়ে?
—তোর বাপের।
—কস কি? আমার তাইলে দুইটা মামার বাড়ি হইবো। আর অনেকগুলা মামাতো বোন। আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে…
—চুপ শালা। ছুটি আনছস?
—হুম। কিন্তু এক সপ্তাহের দেয়নি। পাচ দিনের দিছে।
—আচ্ছা চলবে।
—চলবে মানে? কার বিয়ে, আর কে ছুটি নেয়।
—যার বিয়ে সেই ছুটি নেয়।
—ধ্যাত্তেরি! আমায় ছুটি নিতে বললি ক্যান?
—বিয়ের পরের দিনই কি তুই অফিসে যাবি?
—কতই তো বিয়ের পরের দিন অফিসে গেলাম, তাতে কি হইছে?
—কতই তো মানে? বিয়ে কয়টা করছস?
—ছাপ্পান্নটা! ক্যান তুই জানস না?
—আরে হালা আমি তোর বিয়ের কথা বলছি।
—ওয়েট ওয়েট ওয়েট। আমার বিয়ে মানে? কার সাথে?
—ক্যান? আমাকে পছন্দ হয় না?
—পছন্দ? আর তোকে? বেসম্ভব, এক কথায় বেসম্ভব।
—তাইলে রোজ রাতে একটা করে ইমেইল লিখতি কেন আমাকে? ফেসবুকে রোজ আমাকে নিয়ে পোস্ট দিতি কেন?
ইমেইলের কথাটা শুনে বুকটা ধড়ফর করে উঠলো। এই মেয়ে ইমেইলের কাহিনি জানলো কেমনে? কোনভাবে এই গল্পটা আগে পড়ে ফেলেনিতো? তবুও বুকে কিছু সাহস লোড করে বললাম……
—কিসের ইমেইল? আমি কখনো তোকে এমন কোন ইমেইল পাঠাইছি? আর স্ট্যাটাসের কথা বলছিস? আমার টাইমলানে এরকম কোন পোস্টই নাই।
—এত কিছু বলে বোঝাতে পারবো না। শুধু এইটুকু বলতে পারি যে তোর তিনটা ইমেইল অ্যাকাউন্ট। একটা ইয়াহু আর দুইটা জিমেইল। ইয়াহু ইমেইলটা হচ্ছে ****@yahoo.com। আর জিমেইল দুইটা হচ্ছে ****@gmail.com এবং ***88@gmail.com । আর তিনটা ইমেইলের পাসওয়ার্ড একই, আমার নামে। আর সেটা হচ্ছে oBoTiKa88 ।
বালিকার মুখ নিঃস্বৃত বানী শুনে আমার মুখের বানী আটকাইয়া গেলো। এই মেয়ে বলছে কি এইসব!! আমি কিছু বলার আগে অবন্তিকা আবারো বলতে লাগলো……
—আর স্ট্যাটাসের কথা বলছিলি না? সেটা সম্পর্কে একটু বলি। তোর দুইটা আইডি। একটাতে আমি এবং সব বন্ধুবান্ধবরা অ্যাড আছি। আরেকটা ফেইক। ফেইক আইডির নাম হচ্ছে “অসীম আকাশ”। আর আইডি দুইটার বর্তমান পাসওয়ার্ড হুচ্ছে যথাক্রমে obontikash88 এবং obonTika88 । এখন সব ক্লিয়ার??? আবার জিগায়? ক্লিয়ার মানে? এক্কেরে ভ্যাকুয়াম ক্লিনারের মতো ক্লিয়ার। আমার ইমেইল আর ফেসবুক আইডির সব পাসওয়ার্ড যেহেতু মেয়ের জানা হয়ে গেছে, সেহেতু ওকে নিয়ে লেখা আমার সব ইমেইল ও পড়ে ফেলেছে। আর ফেক আইডি, যেটাতে ওরে ব্লক দেয়া। সেটার সব পোস্টও দেখে ফেলেছে। যার সবগুলোই ওকে নিয়ে লেখা। এখন কি করি? ভাবছিলাম কোনদিন যদি মেয়েকে পটাতে পারি তাহলে সারপ্রাইজ দেব। কিন্তু এই মেয়ে তো আমাকেই সারপ্রাইজের বস্তা খুলে দিয়েছে।
আমার আগেই বোঝা উচিৎ ছিলো যে অবন্তিকাও আমার মতোই কম্পিউটার সাইন্সের ছাত্রী। ফলে আমার পাসওয়ার্ড হ্যাক করাটা কোন বেসম্ভব ব্যাপার না। এতদিন আমি অন্য বন্ধুদের আইডি হ্যাক করে তাদের সাথে মজা করতাম। এই মেয়ে তো দেখছি আমার চেয়েও বড় হ্যাকার। আমার রাস্তায় আমাকেই আটকে দিয়েছে। ধরা পড়ে গেছি। কিচ্ছু করার নাই। তাই মাথা নিচু করে বললাম…..
—না ইয়ে… মানে…। হুম।
—কিসের না ইয়ে মানে? ভালোবাসিস আমায়?
—ইয়ে… মানে… না।
—না? আচ্ছা চল বিয়ে করতে হবে না। আমি বরং মোশারফকেই বিয়ে করবো।
—আরে না না। আমি কি না করেছি নাকি?
—নাকি করিসনি। কিন্তু হ্যা ও তো বলিসনি।
—আমার ইমেইল আর পোস্টগুলা পড়েও কি তোর কিছু মনে হয় নাই।
—হইছে তো।
—কি মনে হইছে?
—মনে হইলো যে, এই পাগলাটা আমাকে একটুও ভালোবাসে না।
—কি বলিস? এত্তগুলা ইমেইল পইড়াও তোর এইটা মনে হইলো?
—হুম্ম হইলো। ভালোই যদি বাসতি তাহলে ইমেইলগুলা ড্রাফটবক্সে না থাইকা সেন্ট বক্সে থাকতো। আর আমাকেও এত কষ্ট করে হ্যাকিং করতে হতো না।
—স্যরি।
—স্যরিতে কাজ হবে না।
—তো কি করতে হবে?
—বিয়ে করতে হবে। এই মুহুর্তে আমাকে বিয়ে করতে হবে।
—বিয়ে? এখনই?
—ক্যান? কোন সমস্যা?
—না মানে কাউকে জানিয়ে বিয়ে করলে কেমন দেখায় না? আর তাছাড়া আমিতো তৈরী হয়ে আসিনি।
—তৈরি হওয়ার দরকার নাই। আমরা আছি না। হঠাতই বর বেশে দেখা গেলো ইয়াসিনকে। সাথে কাউসার আর মামুনও আছে।
—কিরে তুই বর সাজলি ক্যান?
—আরে মামা জ্বইলো না জ্বইলো না। এইগুলা তোমার জন্যই আনা হইছে। বললো কাউসার।
—তার মানে তোরা সব জানতি?
—না। আজকেই জানলাম। অবন্তিকা বললো। তুই তো শালা জিবনেও জানাতি না। এবার মামুন।
—না মানে?
—কিসের না মানে?
—চলো এখনই বিয়ে হবে। এই প্রথম অবন্তিকা আমাকে তুমি করে বললো ।
—কিন্তু আব্বা আম্মা।
—যেই মেয়ে তোর ইমেইল অ্যাকাউন্ট, ফেসবুক অ্যাকাউন্ট হ্যাক করতে পারে, সে তোর বাবা মাকেও হ্যাক করে নিবে, ইনশাআল্লাহ।(কাউসার)
—কিন্তু তবুও……
—আর কোন কিন্তু নাই। বিয়ে করলে এখনই চলো। নয়তো কখনো নয়।
কখনো নয় কথাটা শুনে বুকের বাম পাশটায় কেমন যেন করে উঠলো। যেই মেয়ের জন্য এই চার বছরে কোন মেয়েকে ভালো লাগেনি। যার কথা ভেবে আমার দিন শুরু হয়। যার কথা ভাবতে ভাবতেই আবার ঘুমিয়ে যাই আমি, সেই অবন্তিকাই আজ আমাকে বিয়ের কথা বলছে। কনে, বরের পোষাক, সাক্ষী, কাজী অফিসসহ সব কিছু ঠিক ঠাক। এখন যদি আমি সংকোচে না বলে দেই। তাহলে হয়তো আর কোন দিনই অবন্তিকাকে নিজের করে পাবো না। মেয়েটা যে জেদী উলটা পালটা কিছুও করে বসতে পারে। তাছাড়া বাসায় না মানারও কথা না। আমি এখন যথেষ্ট ভালো একটা চাকরী করি। কদিন ধরে আম্মাই বিয়ের কথা বলছিলো। অবন্তিকাকে বউ হিসেবে পেলে তিনিও খুশি হবেন। আব্বা একটু ঝামেলা করতে পারে। তবে আম্মা আর অবন্তিকা মিলে সামলে নেবে সেটা।)
তাই সাত-পাচ না ভেবে। বিয়েটা করেই ফেললাম। অবন্তিকা এখন আমার বউ। হ্যাকার বউ। আমার অ্যাকাউন্টের মতো জীবনটাও হ্যাক করে নিয়েছে ও। ওকে নিয়েই আপাতত নিজের বাসার সামনে দাড়িয়ে আছি। সাথে বান্দর তিনটাও আছে। কলিং বেলে চাপ দিলো অবন্তিকা কিছুক্ষন পরেই দরজা খুললেন চিফ অফ দ্যা হাউজ মানে আমার আম্মাজান। আমাকে দেখে উনি যতটা অবাক হলেন তার চেয়ে বেশি আমি উনাকে দেখে হলাম। উনাকে দেখে মনে হচ্ছে উনি বধুবরনের জন্য সেই কখন থেকে অপেক্ষা করছেন। ঘরটাও সাজানো হয়েছে। আমার আর বুঝতে বাকী রইলো না যে হ্যাকার মাইয়া আমার অ্যাকাউন্টের সাথে সাথে ইতিমধ্যেই আমার পরিবারও হ্যাক করে ফেলেছে।