জন্মদিন

জন্মদিন

“বুয়া, আজ আমার মেয়ের জন্মদিন বুঝলা, ভালো রান্নাবান্না আছে তুমি আজকে আর কোথাও যেও না।” কথাটা আমিনা বেগম তাদের বাসায় কাজ করা রহিমা বুয়াকে বলল। রহিমা বুয়া কাজ করতে করতে বলল,”জি আফা থাকব নে সমস্যা নাই।” আমিনা বেগম খুশি হয়ে রান্নাঘরের বাইরে চলে গেলেন। পাশ থেকে ৬ বছরের একটা মেয়ে বলে উঠলো, “মা আজ তো আমারও জন্মদিন। আমাদের বাসায় ভালো রান্নাবান্না হববে না??” রহিমা বুয়া মেয়ের মুখে এমন কথা শুনে যেন থমকে যায়। মেয়েকে এখন কি বলবে বুঝতে পারছে না।

রহিমা বুয়া খুব দরিদ্র একজন মা। বিভিন্ন বাসায় কাজ করে পেট চালান। তার একটা মেয়ে আছে। নাম তার তুলি। তুলির বাবা ওদের ছেড়ে সেই কবেই চলে গিয়েছে। তার নাকি তুলির মা মানে রহিমা বুয়ার উপর থেকে মন উঠে গিয়েছে। তাই অন্যত্র চলে গিয়েছে। কি নিষ্ঠুর আমরা তাই-না?? রহিমা বুয়া তুলিকে নিয়েই কষ্ট করে জীবন যুদ্ধে এগিয়ে যাচ্ছেন। মেয়েটা দিন দিন বড় হচ্ছে। অনেক কিছু না খুব অল্প আবদারই করে তুলি। কিন্তু সে আবদারটুকুও পূরণ করার মতো ক্ষমতা রহিমা বুয়ার নেই। যেমন আজ তুলির জন্মদিন। সেও বাকিদের মতো চায় তার বাসায় আজ ভালো রান্নাবান্না হোক। কিন্তু তা তো আর সম্ভব নয়। মেয়েটা মলিন নয়নে একদৃষ্টিতে মায়ের মুখের পানে তাকিয়ে আছে উত্তরের অপেক্ষায়।

রহিমা বুয়া আস্তে করে বলল,”মারে গরীবের কোন জন্মদিন নাই। আমাদের জন্মদিন একবারই, মৃত্যুদিনও একবারই।” তুলি অস্থির হয়ে বলে,”তাহলে আমাদের বাসায় ভালো রান্না হবে না??” রহিমা বুয়া কান্নাসিক্ত কণ্ঠে বলে, “নাহ।” তুলি আর কোন কথা বলে নি। চুপ করে মায়ের পাশে মন খারাপ করে বসে রইল।

টাকার অভাবে মেয়েটা স্কুলেও যায় না। সারাদিন মায়ের সাথে বিভিন্ন বাসায় কাজে যায়। রহিমা বুয়া জানে বর্তমান জামানাটা কত খারাপ। ফলে মেয়েকে বাসায় একা রেখে আসবে তার প্রশ্নই উঠে না। তাই মেয়েকে সাথে নিয়েই এই জীবন যুদ্ধে লড়াই করে যাচ্ছেন। এই অভাবের সংসারে বরাবরি তুলির ছোট বড় ইচ্ছা গুলো মাটি চাপা পরে যাচ্ছে। মায়ের মন সবসময় কাঁদে মেয়েকে একটু খুশী করতে পারে না বলে। আজ তো আরো তুলির জন্মদিন। সেও অন্যদের মতো চায় তার বাসায় তার জন্য একটু ভালো রান্না হোক। কিন্তু তা তো আর সম্ভব নয়। রহিমা বুয়া কাজ করছে আর চোখের জল ফেলছে আড়ালে। হঠাৎই ছোট খুকিটা উঠে এসে মায়ের চোখের জল মুছে দিয়ে বলে,”ও মা কাঁদো কেন?? কি হইছে??” রহিমা বুয়া নিজেকে সামলে বলে,” কিছু না মা, দেখিস আল্লাহ একদিন তোর সব ইচ্ছা পূরণ করবে। সবসময় আল্লাহ এর উপর ভরসা রাখবি।” বলেই মেয়েকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দেয় রহিমা বুয়া।

এরপর মেয়েকে পাশে বসিয়ে আমিনা বেগমের দেওয়া সকল কাজ শেষ করে রহিমা বুয়া। কাজ শেষ করতে করতে প্রায় দুপুর হয়ে যায়। আমিনা বেগম একটা বাটি রহিমা বুয়ার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলেন,”বুয়া এখানে তোমার আর এই পিচ্চিটার জন্য খাবার আছে। এত কষ্ট করলে সারাদিন তার সামনে এটা সামান্য। নেও।” রহিমা বুয়ার চোখে অজান্তেই অশ্রু এসে ভীড় জমিয়েছে। রহিমা বুয়া খুব খুশী হয়ে বাটিটা হাতে নিয়ে একটা হাসি দিয়ে আমিনা বেগমকে বলেন,”আফা আপনে অনেক ভালা। আপনার মাইয়া সবসময় ভালো আর খুশী থাক সেই দোয়াই করি।” আমিনা বেগম অনেক খুশী হন রহিমা বুয়ার কথা শুনে। তারপর তিনি বলেন,”সন্ধ্যায় কেক কাটবে। তুমি ওকে নিয়ে এসে পইরো।” রহিমা বুয়া বলেন,” না আফা আপনারা বড় মানুষ করেন, আমরা ছোট মানুষ এহানে আইসা কি করমু??” আমিনা বেগম কিঞ্চিৎ হেসে বলেন, “আচ্ছা তোমাদের জন্য কেক রেখে দিব নে। সমস্যা নেই।”

এরপর আমিনা বেগমের সেই বাটিটা নিয়ে রহিমা বুয়া আর তুলি তাদের ছোট বাসাটায় চলে আসে। তুলি বাসায় এসে সুন্দর করে গোসল করে বিছানায় চুপ করে লক্ষ্মী মেয়ের মতো বসে আছে। অনেক ক্ষুধা লেগেছে ওর। কিন্তু তাও মাকে বলছে না। রহিমা বুয়া সবটা বুঝতে পেরেছে। রহিমা বুয়াও তাড়াতাড়ি গোসল সেরে বাটিটা খুলে দেখে বিরিয়ানি। সেই বিরিয়ানি প্লেটে বেরে চামচ দিয়ে চেপে চেপে গোল আকার করে রহিমা বুয়া। পাশ থেকে একটা মোম নিল। মোমটার সামান্য কিছু অংশ বাকি এমন একটা মোম।

মোম টা জ্বালিয়ে প্লেটের সামনে রেখে পুরনো ছুরিটা প্লেটের পাশে রেখে তুলিকে ডাক দেয় রহিমা বুয়া। তুলি মায়ের ডাক শুনে দ্রুত মায়ের কাছে ছোট্ট ভাঙা টেবিলটা কাছে এগিয়ে আসে। শুধু একটা টেবিল এতে কোন চেয়ার নেই। তুলি এসে দেখে, প্লেটে গোল আকার করে বিরিয়ানি বেরে রাখা হয়েছে। সামনে ছোট মোমটা জ্বলছে আর পাশে ছুরি। তুলি মুখ তুলে প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকায়। রহিমা বুয়া একটা হাসি দিয়ে ছলছল নয়নে বলে, ” নে কেকটা কাট ফু দিয়ে।” তুলি এবার বুঝল।

তুলিও একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে অনেক খুশী হয়ে মোম বাঁতিতে ফু দিয়ে ছুরি দিয়ে প্লেটে বারা বিরিয়ানি কাটলো। রহিমা বুয়া সেখান থেকে বিরিয়ানি হাতে নিয়ে তুলিকে খাইয়ে দিল। তুলির চোখে মুখে অনেক খুশী। খুব মজা লাগছে বিরিয়ানিটা। অন্যদিকে ছোট মেয়েটাকে একটু খুশী করতে পেরে মায়ের মনটা খুশীতে কেঁদে দেয়। তুলি রহিমা বুয়ার চোখ মুছে তাকেও এক লোকমা খাইয়ে দেয় তার ছোট্ট হাত দিয়ে। রহিমা বুয়া তার পরী মেয়েকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে কান্নাসিক্ত কণ্ঠে বললেন,

– “শুভ জন্মদিন মা আমার।”

–> আমরা ধনী কিংবা মধ্যবিত্ত। আমরা চাইলেই আমাদের ইচ্ছাগুলো খুব সহজেই পূরণ করতে পারি। কিন্তু এই মানুষ গুলো তাদের সামান্য ছোট্ট ইচ্ছাগুলোও কখনো পূরণ করতে পারে না। দারিদ্রতার চাপে তাদের ছোট ছোট ইচ্ছাগুলো সবসময় মাটি চাপা পরে যায়৷ তুলির মতো মেয়েদের আর জন্মদিন উৎযাপন করা হয় না। জন্মদিন উপলক্ষে বাসায় একটু ভালো খাবার রান্না হয় না। আজ আমার তরফ থেকে এদের সবাইকে জানাই শুভ জন্মদিন।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত