সারাদিনের কর্মব্যাস্ততার ক্লান্তির ছাপ আবিরের চোখমুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। অফিস থেকে ফিরে ব্যাগটা সোফার উপর রেখে, ক্লান্ত শরীরটাকে যেই মাত্র এলিয়ে দিয়েছে বিছানাতে, ওমনি আবিরের স্ত্রী নেহা এসেই শুরু করে দিয়েছে,
-ঘরে তো চাল, ডাল, তেল নুন কিছুই নাই। কি করবো আমি?? মানষের বাড়ি থেকে কি চুরি করে আনব?? আবির একরাশ বিরক্তভরা মুখে নেহার দিকে তাকিয়ে বলল, প্লিজ, আজকে অন্তত ছেড়ে দাও। ভাল্লাগছে না।
—আচ্ছা ছেড়ে দিলাম। কিন্তু খেতে আসবা না বলে দিলাম। কথাটা বলেই নেহা রান্না ঘরে চলে গেল। প্রতিদিনের রুটিন আবিরের এটাই। অফিসে স্যারের বকা খেতে খেতে যাবে ওর সময়। আবার বাসায় এসেও নেহার বকবকানি। পুরো জীবনটাই তেজপাতা হয়ে গিয়েছে। অফিসের ড্রেসটা চেঞ্জ করে বেলকুনিতে গিয়ে, পকেট থেকে সিগারেটটা বের করে, মুখে পুরে নিলো আবির। মুখ থেকে ধোঁয়া বের করে সামনে ছড়িয়ে দিলো। মানুষ তো বলে সিগারেটের ধোঁয়ার সাথে সাথে নাকি কষ্টটাকে দূরে রাখা যায়। কিন্তু আবিরের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা পুরো উলটো। সিগারেট মুখে পুড়লেই আবিরের সামনে অতীতের সকল স্মৃতি ভেসে ওঠে আজও তার অন্যথা হলো না,
—তুই এসব ছাইপাঁশ খাওয়া বাদ দিবি না আবির??তুলি রাগ করে বলল। আবির তুলির দিকে চেয়ে সিগারেটের ধোঁয়াটুকু তুলির মুখের সামনে ছেড়ে বলল, আহ, কত শান্তি জানিস এটাতে?? তুলি আবিরের কলার ধরে বলল, কুত্তা,শান্তি?? শান্তি করস তখন, যখন আমি থাকব না। আবির হাতের সিগারেটটা ফেলে দিয়ে তুলির দিকে তাকিয়ে বলল, কই যাবি তুই?? তুলি মুখ বাঁকা করে, মনে হচ্ছে সারাজীবন তোর পাশে এই শং সেঁজে বসে থাকব ?? আবির অন্য দিকে তাকিয়ে, পারলে তাই করবি।
তুলি একগাল হেসে বলল, কাম পাইলাম না, হুম। আবির মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। এই লেভেলটা এমন যে, অতিরিক্ত আসা করা যাবে না আবার অতিরিক্ত আসা না করেও থাকা যায় না। মন চায় এটা করি ওটা করি কিন্তু মধ্যবিত্ত লেভেলটা বুঝিয়ে দেয় নাহ, তোর সেই সামর্থ্য নেই। আবিরের অবস্থাটাও ঠিক সেই রকম ছিল। তুলি আর আবির সেই ছোট থেকে একই সাথে পড়ছে। একই স্কুল, একই কলেজ আবার ভালো ইউনিভার্সিটিতে চান্স পেয়েও আবির সেখানে ভর্তি না হয়ে এই অজঁপাড়াগায়ে ডিগ্রিতে ভর্তি হয়েছে একমাত্র তুলির জন্য। আবিরের ব্রেন ভালো ছিল বলে ওর বাবার স্বপ্ন ছিল আবির কোন সরকারি চাকরিতে অফিসার পদে চাকরি করবে। বাবার স্বপ্ন পূরণ তো দূরের কথা বাবাকে শেষ খাওয়ানোটাই নিজের টাকা দিয়ে খাইয়েছিল না আবির। বাবা বেঁচে থাকতে একটা কথা আবিরের মা কে বার বার বলতো,
— আমার আর হয়তো তোমার ছেলের পয়সা খাওয়া হবে না আবিরের আম্মা।
ঠিক তাই, আবির যখন ডিগ্রি ফাইনাল ইয়ারের এক্সাম দিচ্ছিল ঠিক তখনি ওর বাবাটা চলে গেল। আবিরের ঘাড়ে পড়ে গেল ১ বোন আর মায়ের দায়িত্ব। যেই ছেলেটা নিজেই নিজের হাত খরচের টাকা বাবার থেকে নিতো বাবার মৃত্যুর পর সেই ছেলেকেই সংসারের হাল ধরতে হলো। আবির ডিগ্রি পাস করে নানান জায়গায় ধরনা দিয়েও কোন জব পাচ্ছিল না। কারণ যেখানে অনার্স, মাস্টার্স কমপ্লিট করেই মানুষ চাকরি পায় না সেখানে ডিগ্রির মুল্য তো এদেশে আরোই নেই। তবে ভাগ্যক্রমে মাথা কয়েকটা টিউশনি পায় আবির। বাসায় বাসায় টিউশনি করিয়ে নিজের আর পরিবার কে চালানো চেষ্টা করল আবির। তবে প্রতি রাতে আবিরের, বাবার কথা মনে পড়ত। আর বাবার কথা মনে পড়তেই নিশঃব্দে আবিরের বুকের ভেতরটা হু হু করে উঠতো।
যেই মানুষটার জন্য ইউনিভার্সিটি ত্যাগ করে ন্যাশনালে এসে উঠেছিল সেই মানুষটাকে অর্থাৎ তুলিকে যখন আবির পেল না তখন ওর মনে হচ্ছিল জীবনের শেষ ট্রাজেডির সুখ ও হয়তো পেয়ে গিয়েছে। কিন্তু নাহ, ট্রাজেডির বাকিটুকু তিলে তিলে পাচ্ছে নেহাকে বিয়ে করে। গ্রাম ছেড়ে এক আত্মীয়র মাধ্যমে এই শহরে এসে উঠেছিল আবির। প্রথমে একটা ফ্যাক্টরিতে পার্ট টাইম কাজ করার পাশাপাশি টিউশনি করিয়ে যেইটুকু আয় করত তার কিছুটা নিজের জন্য রেখে বাকি টাকাটা বাসায় দিয়ে দিত। কয়েক বছর এভাবেই চলল। এর কয়েক দিন পরে আবির জানতে পারল, ওর বোন তিশা কোন এক ছেলের হাত ধরে চলে গিয়েছে।। আবিরের খারাপ লাগেনি। মানুষ কি ভাববে বা ভাবছে সেটাও ও মনে করেনি কারণ বাস্তবতাটা এই যে, ছোট বোন টাকে বিয়ের জন্য যেই টাকাটুকু লাগতো সেই টাকাটা আবিরের কাছে ছিল না।
বোনের বিয়ে দেয়ার চিন্তায় প্রতিরাত নির্ঘুমও কেটাতে হয়েছে আবিরকে। সেদিক বিবেচনা করলে এক বিপদ থেকে বেঁচে গিয়েছে বলে মনে মনে শান্তি পেয়েছিল। আর থাকলো মা। মায়ের দেখাশোনা আবির ভালোভাবেই নেবে। প্রতিবেশী একজন বলেছিল তোর বোন তোরসম্মানটা একেবারে ডুবিয়ে দিলো রে। আবির বলেছিল, লজ্জা, মান, সম্মান টাও টাকা দিয়ে কিনতে পারা যায়। তাই এগুলো বলে লাভ নেই। আর মধ্যবিত্তদের কোন লজ্জা থাকতে নেই। এখানে পেটের দ্বায় বড় লজ্জা। অন্যান্য স্টুডেন্টের মতো নেহাও আবিরের ছাত্রী ছিল। আবিরকে প্রথম যেদিন বলেছিল যে আবির ভাইয়া আপনাকে আমার ভালো লাগে, আমি আপনাকে ভালোবা, বলার আগেই আবির পড়ানো বাদ রেখে উঠে, নেহার বাসা থেকে চলে এসেছিল। এরপরের কয়েক দিন আবির আর নেহার বাড়িতে যায় নি। কারণ ও চায় নি এসব ঝামেলায় জড়াতে।
আর নেহা ছোট তাই আবেগে টইটম্বুর হয়ে আছে, কয়েকদিন গ্যাপ দিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে ভেবেছিল আবির। কিন্তু একদিন সকালে নেহার বাবার ফোন কল পেয়েই আবিরকে নেহাদের বাড়িতে ছুটে যেতে হয়েছিল। কারণ নেহা সুইসাইডের পরিকল্পনা করছিল যেটা ওর মা দেখতে পেয়েছিল, নেহার থেকে সব কিছু শুনে আবিরকে ওনারা গ্রহণ করতে রাজি হয়ে যান। নেহার বাবা আবিরের প্রায় পায়ে অবধি পড়েছিল কারণ নেহা ছিল ওনাদের একমাত্র মেয়ে। নিজের মেয়ের ক্ষতি কোন পিতামাতায় করতে চায়বে না। তাই নেহার বাবাকে আবির আর ফেরাতে পেরেছিল না। নেহার সাথে আবিরের বিয়ের বয়স আজ ৩ বছর। এই ৩ বছরের একটা দিন ও নেই যেই দিনটা নেহা আবিরের সাথে খারাপ ব্যাবহার করে নি। কিন্তু সেটা স্বল্প সময়ের জন্য কারণ, সিগারেটের আগুন আংগুলে লাগলে আবির অতীত থেকে বর্তমানে ফিরে আসে। আবিরের পুড়ে যাওয়া আংগুলটা মুখে পুড়ে, চুষতে থাকে।
–ওই ছাইপাঁশ খেলেই কি পেট ভরে যাবে?? নেহা পিছন থেকে বলে উঠল। আবির পেছন দিকে তাকিয়ে দেখে, খাবার হাতে নেহা দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটাকে আবির আজ অবধি বুঝতে পারল না। এই এক রুপ তো কিছুসময় বাদেই আরেক,
–কি হলো??? এসে খেয়ে আমায় উদ্ধার করুন। আবির আর রাগ বা অভিমান করে থাকতে পারল না কারণ ওর প্রচন্ড খুদা লেগেছে। রাত্রে, ঘুমানোর সময়, আবির চুপ করে কিছু একটা ভাবছিল, কিন্তু হঠাৎ পাশ থেকে ফুঁফানো কান্নার আওয়াজে আবির নেহার কাধে হাত রেখে,
—নেহা? নেহা আবিরের পাশ হয়ে কেঁদে দেয়।
—এ৷ একি করছো পাগলী??
–আমায় ক্ষমা করো আবির। আমি ওগুলো মন থেকে বলি না তোমায়, কিন্তু আমি আর পারছি না।
আবির মনে মনে ভাবতে থাকে, নেহা পারবে কি করে?? সারাজীবন বাবার ধন সম্পদের ভেতরে থেকে এখন এই অভাব নামক জাহান্নামে এসে পড়েছে। নেহার বাবা চেয়েছিল আবিরকে কিছু একটা করে দিতে কিন্তু নেহা চায় নি। ওর এক কথা আবিরকেই আবিরের অবস্থা পরিবর্তন করতে হবে। আবির নেহার কপালে চুমু দিয়ে, আর তোমায় কষ্ট করতে হবে না পাগলী, আমি আমার সর্ব্বোচ্চটুকু দিয়ে চেষ্টা করব। নেহা মুচকি হেসে দেয়। আবির নেহাকে জড়িয়ে নেয় পরম ভালোবাসায়। এই মিথ্যা আসা, আবির একা না। এমন হাজারটা আবির নামক মধ্যবিত্ত অভিভাবক চরিত্রের মানুষ গুলো তাদের প্রিয় মানুষদেরকে হারানোর ভয়ে দিয়ে আসে।