-স্যার! স্যার! স্যার আপনি কি শুনতে পাচ্ছেন? (ডুবে ছিলাম এক কল্পনার জগতে)
-হ্যা বলো!
-স্যার ফাইল গুলোতে সাক্ষর লাগবে..
-হুম! দাও…
-স্যার, একটা প্রশ্ন করবো আপনাকে যদি কিছু মনে না করেন..
-আচ্ছা করবোনা! বলো, কি বলবে..
-স্যার! আমি আপনার মধ্যে একটা জিনিস লক্ষ্য করেছি,আপনি এতো উদাসীন থাকেন। কি যেন ভাবেন সারাক্ষণ। অনেক মন মরা থাকেন।স্যার আপনি এভাবে থাকেন কেন?
-আরে কই না এমনিতেই…
-স্যার আপনি আমার কাছে কিছু লুকাতে চাচ্ছেন। স্যার বলেন আমি শুনবো আপনার অপ্রকাশিত কথা গুলো।
-শুনতে চাও আমার উদাসীনতার কারন?
-স্যার! যদি আপনি বলেন তাইলে অবশ্যই আমি শুনবো।
আমার জীবনে ছিল এক কল্পনাবিলাসী বালিকা যে স্বপ্ন সাজাতে ভালোবাসতো,কল্পনাকে সে নিপুণ ভাবে গড়তো।
সে ছিল তিথি। আমরা তখন কিশোর বয়সের। একই স্কুলে পড়তাম,এমনকি একই ক্লাসে ছিলাম আমরা দুজন। তিথিকে আমি খুব ভালোবাসতাম সেও তার ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু সে ছিল লজ্জাবতী পাতার মতো। কখনো আমি তিথির কাছে গেলে সে লজ্জাবতী পাতার মতো চুপসে যেত। সে কখনো আমার দিকে তাকাতে পারতো না। এক এক ধাপ করে ক্লাস এগুতো লাগলাম। যতই এগুচ্ছি ততই দুজনের মনের ভেতর ভয়টা কাজ করতে লাগলো। সে ভয়টা ছিল দুরত্বের। কারন আমাদের এস,এস,সি পরিক্ষা প্রায় খুব কাছে চলে আসছে বছর ঘুরিয়ে ফ্রেব্রুয়ারী মাসের প্রথম দিকেই পরিক্ষা। এক মাসে পরিক্ষা কমপ্লিট হলো।
পরিক্ষা শেষে কয়েকদিন তিথির সাথে যোগাযোগ ছিল। প্রায় এক সপ্তাহ যোগাযোগ থাকার পর তার সাথে আর কোন যোগাযোগ থাকলো না। বিষণ্ণতা আমাকে আকরে ধরেছিল,কিছুতেই কোন কিছু ভালো লাগছিল না,ঠিক মতো খাওয়া দাওয়া নেই ঘুম নেই,চুপচাপ থাকতাম। আর শুধু আমার কল্পনাবিলাসী কে নিয়ে ভাবতাম। পরে ভাবলাম এভাবে আমি হয়তো বাচঁবোনা। তখন আমি এইসব ভুলে থাকার জন্য পরিক্ষার পরে দুই মাস নিজেকে কোন উপায়ে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করলাম। রেজাল্টের পর ইন্টারমিডিয়েট পড়ার জন্য কলেজ ভর্তি হলাম।
মাঝ দিয়ে চলে গেলো পুরো ২বছরএভাবে ইন্টারমিডিয়েট পরিক্ষাও শেষ করলাম। কিন্তু আজো আমার তিথির সাথে একটিবারের জন্য দেখা হয়নি,কোন প্রকার যোগাযোগ হয়নি। কিন্তু আমার মনে হচ্ছিল সে আমার জীবনে ফিরে আসবে,তাই আমি তার জন্য প্রতিটা সময় অপেক্ষায় থাকতাম। রাত হলে তাকিয়ে থাকতাম চাঁদের দিকে,তিথি একদিন আমায় বলেছিলো,যখন আমায় মনে পড়বে তুমি চাদের দিকে তাকাবে আমাকে দেখতে পাবে!আমি প্রতিরাতে চেয়ে থাকতাম আকাশ পানে। কিন্তু সে ফিরে আসেনা!! নতুন করে ভার্সিটি যাচ্ছি। একদিন অচেনা এক নাম্বার থেকে আমায় কেউ কল দিল। কিন্তু আমি কলটা ধরি নাই প্রথমদিকে। কয়েকবার কল দেওয়ার পর অবশেষে কলটা ধরলাম,, ওপাশ থেকে একটা মেয়ে বলছে….
-কেমন আছো? আমার মনটা কেমন জানি করতে লাগলো…
-ভালো,কে বলছেন?
-চিনতে পারনি আমাকে,আমি তোমার তিথি!!!
-তিথি,,তুমি আমার তিথি,,তুমি কোথায় ছিলে?
-তোমার থেকে অনেক দূরে…..
সেদিন তার সাথে অনেক কথা হলো,আর সে আমাকে জানালো তার পরিবারে অনেক চাপ থাকার কারনে সে কোন কিছুতেই আমার সাথে যোগাযোগ রাখতে পারেনি। আর এখন ভার্সিটিতে পড়ে বলে তাকে মোবাইল কিনে দিয়েছে,আমার সাথে তার এখন থেকে প্রতিদিন যোগাযোগ হবে।
আমার কাছে সেই মুহুর্তটাকে জীবনের সবচেয়ে আনন্দের মুহুর্ত মনে হলো।। এখন থেকে প্রতিদিন তিথির সাথে আমার যোগাযোগ হচ্ছে,বেশ ভালো আছি আমরা। এভাবে আমরা অনার্সের ৩টি বছর কাটিয়ে দিলাম। হঠাৎ একদিন তিথি আমাকে জানালো তার বিয়ের কথা হচ্ছে পরিবারে। ভালো চাকুরীজীবী ছেলে পেলে বিয়ে দিয়ে দিবে। সে আমাকে কিছু একটা করতে বললো কিন্তু আমি এখন কি করবো এখনো অনার্স কমপ্লিট করতে পারিনি,আমি কি করে এখন চাকুরী পাবো। আমি অনেক খুঁজাখুঁজি করেও একটা চাকুরী জুটাইতে পারলাম না কপালে। তবে আমি তিথিকে বলেছি,প্লিজ আমি একটা সার্টিফিকেট অর্জন করি তাইলে আমি নিজে একটা চাকুরী করবো নিজেকে তখন প্রতিষ্ঠিত করতে পারবো। তখন আমি কিছু করতে পারবো।
সেদিন তিথি আমাকে কিছুই বললো না। তার কয়েকদিন পর একটা বাতাস আসে কানে যা শোনার জন্য একবারেই প্রস্তুত ছিলাম না “আমার তিথির আজ গায়ে হলুদ”!! আমি কি করবো বুঝতে পারছি না। আমার যে কিছুই করার নেই। আমি জানি আমার মতো বেকার একটা ছেলের হাতে তাকে তার পরিবার তুলে দিবে না আর আমার পরিবারও মেনে নিবে না তা। সেদিন সারারাত ইচ্ছে মতো সিগারেট খাই প্রায় ২টা প্যাকেট। যার সাথে সেই শৈশব থেকেই একসাথে পথ চলা সে চলে যাবে বধু বেসে অন্যের ঘরে,মেনে নিতে পারছি না!!
সারারাত সেই আগের মতই চাঁদ দেখছিলাম একটুও ঘুমাইনাই। ফজরের “আসসালাতু খইরুম মিনান-নায়ুম” ভেসে আসছে কানে। অযু করে রওয়ানা দিলাম মসজিদের দিকে। নামাজ পরে দুটি হাত তুলে আল্লাহ্র দরবারে প্রান খুলে দোয়া করলাম আমার তিথির জন্য। সে তার স্বামীর সংসারে যেন সুখী হয়। মসজিদ থেকে বের হতেই তিথির বাড়ির আমার এক বন্ধু আমাকে ফোন করে বললো “দোস্ত তিথি তো আর নেই”নেই মানে!!?? কি হয়েছে তিথির? তিথি আজ রাতে আত্মহত্যা করেছে!!
কথাটা শুনে আমার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। আমি সেখান থেকে দৌড়ে একটা গাড়িতে উঠলাম এবং তিথির বাড়ি চলে গেলাম। দেখলাম আমার তিথি কি সুন্দর করে গায়ে হলুদের কাপর পড়ে শুয়ে আছে মাটির উপড়ে। অঝর ধারায় চোখ থেকে অশ্রু নামছে। এ কেমন বাস্তবতা! এ কেমন পরিস্থিতি! আজ হয়তো তিথির বিয়ে এভাবেই দেখার কথা ছিল আমার।সেদিন তিথিকে নিজের হাতে কবর খুঁড়ে মাটি দিয়ে একা করে রেখে দিলাম মাটির ঘরে। সে দিন তাকে কবর দেয়া হয়েছিল রাতে,কি নিঝুম রাত গো তিথি আমি তোমাকে একা ছেড়ে কিভাবে যাবো এখান থেকে। সবাই চলে যাবার পর সেখানে আমি আর তিথির বাড়ির সেই বন্ধু ২টা পর্যন্ত ছিলাম,বন্ধু আমাকে টেনে নিয়ে আসছে তিথির কাছ থেকে।
তিথি তুমি আমাকে কিছু না বলে এভাবে কেন হারিয়ে গেলে আমার জীবন থেকে। আমি যে বিষণ ভালোবাসি তোমায়। সে রাতে হেটে হেটেই বাড়ি চলে আসি। মনে হচ্ছিল তিথি আমাকে বার বার দেখা দিচ্ছে,সে অনেক হাসছে,মাঝে মাঝে খুব কাঁদছে সে। আমি স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে যাই তাকে খুঁজে বেড়াই আমার চারপাশে কিন্তু দেখি না আমি। সেই দিন থেকে আমি হয়ে যাই অন্যজগতের এক বাসিন্দা। আমি আজও প্রতি সপ্তাহে আমি আমার তিথিকে দেখে আসি। একটা একটা ফুল নিয়ে আমি তাকে দিয়ে আসি। কারন সে যে আমার তিথি। ফিরে আসলাম সে কল্পনা থেকে…..
–আরে আপনারা এতজন এখানে যে কখন আসলেন? কি বেপার আপনাদের চোখে পানি কেন?
–স্যার আমরা আসছি অনেক আগেই, স্যার এতদিনে আমরা বুঝতে পেরেছি আপনি কেন এতো চুপচাপ থাকেন। আপনার বাস্তবতা আপনাকে চুপ করিয়ে দিয়েছে। স্যার বিষন কষ্ট হচ্ছে তাই চোখের বাধ ভেঙ্গে অশ্রু বেয়ে পড়ছে।
–আচ্ছা স্যার এই রকম একটা চাকুরীর জন্যই তো আপনার জীবনে এমন কিছু ঘটলো। আপনি কিভাবে চাকুরীতে জয়েন করলেন?
–অনার্সটা কমপ্লিট করলাম এবং মাষ্টার্স কমপ্লিট করে একটা সার্টিফিকেট অর্জন করলাম। তারপর এই চাকুরীটার অফার পাই,তখন থেকেই জয়েন করি এই চাকুরীতে।
-স্যার আপনি আবার কবে যাবেন আপনার তিথির কবরে?
-এইতো কাল যাবো অফিস শুরু করার আগেই।
-স্যার আমরাও যেতে চাই আপনার তিথির কবরের পাশে।
-আচ্ছা ঠিক আছে তারপরের দিন আবার গেলাম আমার তিথির কাছে। ওখানে গেলে আমার প্রানটা ফিরে আসে। (চলে গেছে তিথি রয়ে রয়ে গেছে স্মৃতি)