পাগলী বোন

পাগলী বোন

আমাদের বাড়ি থেকে একটু দূরে রহিম চাচার চায়ের দোকান। সেখানে সব বন্ধুরা মিলে আড্ডা দিচ্ছিলাম। অনেক বন্ধুরা একসাথে হলে যা হয় আরকি। আমি ছাড়া মোটামুটি সবাই সিগারেট খায়। মাঝেমধ্যে বন্ধুদের জোরাজুরিতে দুই এক টান দেই। তাছাড়া আর খাওয়া হয় না। কারণ আম্মুর কড়া নিষেধ আছে। যদি কোনোদিন আমাকে সিগারেট খেতে দেখে বা শুনে তাহলে বাড়ি থেকে বের করে দিবে।

আজকে বন্ধুদের অনেক জোরাজুরিতে আর আমারও একটু শখ হলো তাই একটা টান দিলাম। অনেকদিন পর সিগারেট ফুঁকছি তো মাথাটা কেমন জানি চক্কর মারলো। আড্ডা বেশ জমছিলো কিন্তু হঠাৎ দেখতে পেলাম মেঘলা আমার দিকে তাকিয়ে আছে। মেঘলা আর কেউ না। মেঘলা আমার একমাত্র বোন। অনেক ছোট কিন্তু কথা বলে বড়দের মত। আমি মেঘলাকে দেখে সিগারেট মাটিতে ফেলে পা দিয়ে পিষে দেই। মেঘলার লক্ষণ দেখে মনে হচ্ছে আম্মুকে সব কথা বলে দিবে। তাই আড্ডা থেকে উঠে এসে মেঘলার কাছে গেলাম। বললামঃ-

___মেঘলা আম্মুকে প্লিজ বলিস না। তোর পায়ে পরি। মেঘলা আমার কথা শুনে মনে হচ্ছে ভাজা মাছ উলটে খেতে জানে না। বললোঃ-

___ভাইয়া তুই কি বলছিস আমি কিছুই বুঝতেছি না। আবার পায়েও ধারছিস। কাহিনী কি বল? মনেমনে ভাবলাম মেঘলা তাহলে কিছুই দেখেনি। ভিতরে আমি খুশিতে আত্মহারা। মন চাইতাছে একটা নাগিন ড্যান্স দিতে। আমার ভাবাভাবি দেখে মেঘলা বললোঃ-

___ কি হলো ভাইয়া বলিস না কেন? আমি আমতা আমতা করে বললামঃ-
___কই কিছু না তো। চল দুই ভাইবোন মিলে বাড়িতে যাই। আমি তো খুশিতে পুরাই আত্মহারা। যা ভেবেছিলাম তা হয়নি। যাইহোক তারপর দুই ভাইবোন বাড়িতে আসলাম। রুমে বসে আরাম করে টিভি দেখছি হঠাৎ আমার রুমে মেঘলা এসে উপস্থিত। নরম স্বরে বললামঃ- মেঘলা বোন এইভাবে তাকিয়ে কি দেখছিস? টিভি দেখ ভালো লাগবে। তারপর মেঘলা আমার হাত থেকে রিমুট নিয়ে টিভিটা অফ করে দিলো। কারণ জানতে জিজ্ঞেস করলাম

____টিভি বন্ধ করলি কেন? মেঘলা বললোঃ-
____ভাইয়া এক হাজার টাকা দে। তাড়াতাড়ি দে এই টাকা দিয়ে প্রতিদিন ফুসকা খাবো। আমি হে হে হে করে হেসে দিয়ে বললামঃ-

____টাকা কি গাছে ধরে? যে গাছে উঠলাম আর পেরে তোকে ইচ্ছেমত দিয়ে দিলাম?
____ভালোভাবে বলছি তো তাই দিবি না। তাহলে আজকে রহিম চাচার দোকানে সিগারেট খেলি ঐটা কি আম্মুর কাছে বলে দিবো? মনেমনে ভাবছি এই সারছে। তাহলে ঐ সময় বললো না কেন?
____কি হলো কোথায় হারিয়ে গেলি? টাকা ছাড়া আমি এখান থেকে এক পা ও নড়বো না। আমি কাঁদোকাঁদো গলায় বললামঃ ভাইয়ের সাথে এমন করে না লক্ষী বোন আমার।

____আচ্ছা ভাই তুই এত কিপটে কেন?
____ভাইকে কিপটে বলতে নেই। তুই আমাকে একটা কথা সত্যি করে বল। সকালে তাহলে এমন ভাব ধরলি কেন?? তোর ভাবসাব দেখে মনে হইছিলো কিছুই দেখিসনি।

____ভাই তুই আসলেই বোকা ঐ সময় বললে তুই আমার হাতেপায়ে ধরে একশত টাকা ধরিয়ে দিতি। তাই বাসায় এসে বললাম টাকাও বেশি পাবো আর এখন তো পালিয়ে যেতে পারবি না আম্মু বাড়িতে আছে।
____বোন তোর বুদ্ধিকে স্যালুট জানাই। বিয়ের পর তোর জামাইয়ের কাছ থেকেও এমন করবি নাকি?
____হুম,, করতেও পারি যদি তোর মত কিপটে হয়।

এখন তাড়াতাড়ি মানিব্যাগ বের কর আর এক হাজার টাকার একটা নোট দে। এক হাজার টাকার নোট না থাকলে পাঁচশত টাকার নোট দে। তারপর মানিব্যাগ বের করে দেখলাম এক হাজার টাকার নোট নেই। পাঁচশত টাকার নোট আছে। মেঘলা আমার হাত থেকে দুইটা নোট নিয়ে চলে গেলো। আমি মাথায় হাত দিয়ে বসে রইলাম। এমন পাগলী বোন থাকলে মাঝেমধ্যে মাথায় হাত দিতে হয়। যাওয়ার সময় বলে দিলাম আজ থেকে আর সিগারেট খাবো না। একটুপর মেঘলা ফুসকা নিয়ে আমার রুমে আসলো। ওর উদ্দেশ্য আমাকে দেখিয়ে দেখিয়ে খাবে। আমি চোখ বন্ধ করে রাখলাম আর ওর কথা শুনে গেলাম। খাওয়া শেষে বললোঃ-

___ভাইয়া ফুসকাটা অস্থির হইছে। আরেকটা আছে দাঁড়াও নিয়ে আসি। আমি বললামঃ-
___দয়া করে তোর রুমে বসে যতক্ষণ মন চায় ততক্ষণ খা তবুও এখানে আসিস না।

মেঘলা তারপর মুখটা ভেংচি দিয়ে রুম থেক চলে গেলো। পরেরদিন সকালবেলা উঠতেই দেখি তুলির ফোন। ইনি আমার ইয়ে হয়। রিসিভ করতেই বললো দেখা করতে। জায়গাটার নাম বলে ফোনটা রেখে দিলো। একবারও জানতে চাইলো না সেখানে আমি যেতে পারবো কি না। যেতে পারবো কিন্তু মেঘলার স্কুলের পাশে দেখা করতে বলছে। কি আর করবো উনার কথামত গেলাম।

এদিক ওদিক তাকিয়ে আছি। ভিতরে ভয় ভয় কাজ করছে না জানি কখন মেঘলা দেখে ফেলে। তুলির কোনোকথা না শুনে আমি মেঘলা আশেপাশে আছে কি না সেটা দেখছি। যদি কোনোক্রমে আমাকে তুলির সাথে দেখে তাহলে আম্মুর কাছে বিচার মিস নাই। তাই আগে থেকেই সাবধানে আছি। এদিকে তুলি মেয়েটা গাল ফুলিয়ে বসে আছে। কারণ এতক্ষণ উনার কোনোকথার উত্তর দেইনি বলে। নারী জাতিকে বুঝানো অনেক কঠিন।পারলাম না তুলিকে বুঝাতে। আমাকে রেখেই চলে গেলো। সেদিন মন খারাপ নিয়ে আমিও বাড়ি ফিরলাম। পরেরদিন অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে তুলিকে আবার সেই জায়গাতে আনলাম। দশটা ছেলেকে বুঝাতে যে সময় লাগে সেই সময় একটা মেয়েকে বুঝাতে হয়। দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বললামঃ- বিয়ে হওয়া দরকার। পাশ থেকে তুলি বাংলালিংক এর মত জ্বলে উঠলো।

____ কার বিয়ে হওয়া দরকার?
____তোমার।
____এবার আরো জ্বলে উঠলো পাশ থেকে উঠে আমার সামনে এসে দাঁড়ালো। আমি বললামঃ-
____তোমার না আমার বোনের বিয়ে। মেয়েটা আমাকে জ্বালিয়ে, পুড়িয়ে শেষ করে দিবে।
____অহ, আমাকে ছাড়া আর কাউকে বিয়ে করলে মেরে ঠ্যাঙ ঠুঙ ভেঙে ফেলবো।
____আচ্ছা ঠিক আছে। আমি কি বলি আর উনি কি বলে।
____ঠিক আছে মানে !! (রাগীকন্ঠে)
____আচ্ছা বাবা তোমাকেই বিয়ে করবো এখন একটু হাসো।
____হি হি হি। খুশি??
____রাখো তোমার খুশি সামনে চেয়ে দেখো কে আসতেছে।
____কই কে আসতেছে?
____আমার বোন মেঘলা আসছে। আমি গেলাম তুমি থাকো।

তারপর সেখান থেকে এক দৌড়ে পালিয়ে আসলাম। হাপিয়ে রহিম চাচার দোকানে এসে এক গ্লাস পানি খেলাম। আর হাপাতে লাগলাম। রহিম চাচা বললো দৌড়ে কোথা থেকে আসলাম। মিথ্যে করে বললামঃ- এইতো বন্ধুদের সাথে ফাজলামো করে দৌড় দিলাম। বাসায় এসে আস্তে করে রুমের দরজাটা লাগিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। হঠাৎ কে জানি দরজায় নক করলো জিজ্ঞেস করলাম কে? ওপাশ থেকে নরম গলায় আস্তে করে বললো আমি মেঘলা।

____কি চাস…?
____আম্মু ডাকে।
____কেন ডাকে?
____গিয়ে দেখো।
____আম্মুরে কি কি বলছিস?
____বলি নাই তবে
____কথার মধ্যে এত ডেশ মারিস কেন?
____তবে বলবো না যদি টাকা দাও।
____দুইদিন আগে না একহাজার টাকা দিলাম।
____বান্ধবীর জন্মদিনে গিফট দিলাম টাকা কি আর থাকে।
____এক কাজ করেন আমারে বিক্রি কইরা দেন অনেক টাকা পাবেন।
____ভাইয়া এতকিছু জানি না দিবি কি না বল।
____টাকার পরিমাণ কত?
____কমই পাঁচশত টাকা দিলেই হবে।
____পাঁচশত টাকা তোর কাছে কম। কেমন মেয়েরে বাবা। এই নে টাকা আর আম্মুর কাছে তুলির বিষয়ে কিচ্ছু বলবি না।

____ভাইয়া ভাবি কিন্তু আমারে অনেক চকলেট কিনে দিছে।
____কিহ !! শেষ পর্যন্ত তুলির কাছ থেকেও। তুই জীবনেও মানুষ হবি না। দাড়া তোর বিয়ে নিয়ে আম্মুর সাথে কথা বলতেছি। বিয়ের কথা শুনে মেঘলা হাসতে হাসতে চলে গেলো। তারপর আম্মুর কাছে গেলাম।

_____আম্মু ডাকছিলে কেন?
_____তোকে না জানিয়ে আমরা একটা কাজ করে ফেলছি। আমি হেসে দিয়ে বললামঃ-
_____তোমরা আমার অভিভাবক তোমাদের সিদ্ধান্তই আমার সিদ্ধান্ত। আমার কথা শুনে আম্মু অনেক খুশি হলো। তারপর বললোঃ-

_____তোকে নিয়ে আমার অনেক গর্ব হয়। ভালো কথা শোন তোর বিয়ে ঠিক করে ফেলছি। বিয়ের কথা শুনে একহাজার ভোল্টের শক খেলাম। কার সাথে বিয়ে? কেমন মেয়ে কিছুই জানানোর প্রয়োজন মনে করলো না। মন খারাপ করে বসে রইলাম। একটু ভেবে বললামঃ-

_____এত তাড়াতাড়ি আমার বিয়ে ঠিক করে ফেললে।
_____তোর বাবার বন্ধুর মেয়ে। ভালো পড়ালেখা জানা মেয়ে।

দেখতে মাশাল্লা অনেক সুন্দর। এই নে ছবি দেখ। তারপর আমি আর ছবি না দেখে সেখান থেকে আবার রুমে এসে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে তুলির কথা ভাবতেছি। ভাবনার জগতে চলে গেলাম। একটুপর মেঘলা এসে উপস্থিত।

_____ভাইয়া একটা সারপ্রাইজ আছে।
_____রাখ তোর সারপ্রাইজ এদিকে আমার বিয়ে ঠিক করে ফেলছে।
_____আগে এই ছবিটা দেখ।
_____দেখলাম তুলির ছবি তো কি হইছে?
_____বোকা ভাইয়া এর সাথেই তোমার বিয়ে।

কথাটা শোনার পর খুশিতে মেঘলাকে আরো পাঁচশত টাকা দিয়ে দিলাম। আজ আমার বিয়ে। ধুমধাম করে বিয়েটা সম্পন্ন হলো। আস্তে আস্তে সংসারের চাপ আমার কাঁধে আসলো। এদিকে দেখতে দেখতে মেঘলাও অনেক বড় হয়ে গেছে। সবেমাত্র কলেজে ভর্তি হইছে। কিন্ত মেঘলা সেই আগের মতই রয়ে গেছে। মাঝেমধ্যে আমাকে ব্ল্যাকমেইল করে টাকা নেয়। কিছু বলতে গেলেই তুলির কাছে সব বলে দিবে। বিয়ের আগে একটু পরপর আমার রুমে আসতো কিন্তু বিয়ের পর খুব কম আসে।

বোনটা বড় হইছে সে বুঝে গেছে যে এখন ভাইয়ের একটা সংসার আছে আর সব থেকে বড় কথা হলো এখন আমি নিজে মেঘলাকে টাকা দেই। মেঘলা বলে ভাইয়া তোর এখন একটা সংসার আছে আমাকে টাকা না দিয়ে সংসারের কাজে লাগা। সেদিন মেঘলার কথাটা শুনে চোখ দিয়ে অঝর পানি ঝরছিলো। এমন বোন কয়জনে পায়। সবার কপালে বোন থাকে না। অনেকেরই দুইতিনটা ভাই আছে কিন্তু বোন নাই। সেদিন খুব কাঁদলেও সবচাইতে খুশি সেদিনই হইছিলাম। পৃথিবীতে সবচাইতে মিষ্টি ভালোবাসা হলো ভাইবোনের ভালোবাসা।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত