শাড়ি পরে সুন্দর করে দুজন ক্যামেরাম্যান কে দিয়ে তোলা ছবি গুলো আমি দেখছিলাম। সাথে বান্ধবীর ফ্রি বকবক শুনছিলাম। তাদের মানে আমার বান্ধবী আর ওর প্রেমিকের ছবি গুলো কত ভাবে তোলা হয়েছে। নিজেদের জন্য আলাদা একটা দিন ঘুরাঘুরি এসবের বর্ণনা শুনে ই যাচ্ছি। একজন আরেকজনের জন্য কতটা আলাদা ভাবে কতকিছু লুকিয়ে লুকিয়ে করা সাথে কত আয়োজন। ভালো ই লাগছে ওদের দেখে।
এসব শুনতে শুনতে আমি আমার গন্তব্যস্থলে পৌছলাম। তাই গাড়ি থেকে নেমে ওর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিলাম।
সাথে সাথে ভাবীর ফোন। ফোন ধরতে ই বললেন আসার সময় ফার্মেসি থেকে কি কি জানি ঔষধ আনতে হবে। আমি সেগুলো নিয়ে বাসায় পৌছতে ই দরজার পাস থেকে শুনতে পেলাম ভাইয়ার চিল্লাচিল্লি। ঘরে ঢুকতে ই জানতে পারলাম উনার শার্ট ইস্ত্রী করা হয়নি বলে এত বকা। ভাবী কিছু না বলে চুপচাপ দাড়িয়ে আছে।
ভাইয়া বকা দিতে দিতে এমন এক পর্যায়ে চলে যাচ্ছে সেখানে ভাইয়ার কথা ধরলাম আমি। আমি উনার মাঝখানে কথা ধরায় আমাকেও কিছু সময় বকাবকি করলেন। আমি আর কিছু না বলে নিজের রুমে চলে গেলাম। তবে একটা বিষয় নিয়ে খুব অবাক লাগছিল আমি একটু বকা খেয়ে আমার খুব মন খারাপ লাগছিল কিন্তু আমি তখনো দেখছিলাম ভাবী শান্ত চেহারা নিয়ে নিজের মত কাজ করে যাচ্ছে। ভাইয়া আমার থেকে বয়সে অনেক বড়। আমাদের ভাইবোনের বয়সের পার্থক্যটা অনেক। তবে ভাবীর সাথে ভাইয়ার ৪ বছরের ব্যবধান। তাদের এই ১২ বছরের সংসার। আমার ভাইটা কিছু খিটখিটে মেজাজের।
রুমের মধ্যে হঠাৎ মনে পড়ল ভাবীর ঔষুধ গুলোর কথা। ব্যাগ থেকে বের করে ভাবীর কাছে গেলাম। গিয়ে প্রথমে ই বললাম, আচ্ছা তোমাকে যে ভাইয়া মাঝে মাঝে এত বকাবকি করে তুমি রাগ কর না..? শাস্তি দাও না? খারাপ লাগে না তোমার ? ভাবী তখনি হেসে বলল, হ্যা দেই তো। তবে সাথে সাথে না। সময় সুযোগ বুঝে দেই। আচ্ছা ভাবী তোমার ইচ্ছে করে ভাইয়ার সাথে ঘুরতে যেতে। ছবি তুলতে একসাথে অনেক সময় গল্প করতে? ভাবী তখন আবার হেসে দিল বলল,
– ননদিনী সময় হলে বুঝবে। সময়ে ভালোবাসার রঙ পাল্টায়।
ঠিক তখনি ইফান মানে ভাইয়ার ছেলে আসল। সাথে আবার ভাইয়া রেগেমেগে আগুন। হাতে মার্কশীট গণিতে কম নাম্বার। আর কত সময় এসব নিয়ে তুলোধুনো করে গেলেন। ঠিক তখনি আবার খেয়াল করলাম ভাবী শান্ত চেহারা কোনোকিছুতে ভ্রুক্ষেপ নেই। আমার দিকে তাকাতে ই মুচকি হাসলেন। অদ্ভুত..!
তখনি আবার বান্ধবির ফোন। ফোন ধরতেই এক প্রকার চিৎকার করে করে সব অভিযোগ না সেটা আমার নামে নয় ওর উনার নামে। যেহেতু আমি ওর খুব ক্লোজ তাই ওর সব কথা আমাকে ই বলে। আর আমি সম্মতি দিয়ে দিয়ে যাই। ওর সাথে কথা বলতে বলতে আমি আমার রুমে চলে আসলাম। কথা বলা শেষ করতে ই পিছন ফিরে দেখি ভাবী। আমার কাছ থেকে ঔষুধ গুলো নিতে এসেছেন। আমি দিয়ে বললাম এগুলো কার জন্য। ভাবী বললেন এগুলো ভাইয়ার ঔষুধ। আমি কিছুটা অবাক হলাম। এত বকা খাওয়ার পর এরকম। জানতে চাইলে বললেন,
একটু পরে বাজারের ব্যাগ দেখতে এসো। ঠিক ৬:৩০ মিনিটে ভাইয়া বাজার করে আসলেন। ব্যাগ খুলতে ই দেখি শিং মাছ, মটরশুটি,সীম, ইলিশ আর গরম গরম আলুর চপ। ভাবী কিছুটা হেসে আমার দিকে তাকালেন। আর ভাইয়া বললেন, এখন যেন ইলিশটা রান্না করা হয়। আমি কিছু ই বুঝতে পারছি না। ভাবীর খুব পছন্দের মাছ হল ইলিশ আর শিং। ভাইয়া চলে যেতে ই ভাবি পিছন থেকে বলে উঠলেন, সকালেও ঔষুধ খাওয়া হয়নি মনে আছে। বিকেলের ঔষুধ টা টেবিলে রাখা আছে খেয়ে নাও। ভাইয়া পিছন দিকে একটু তাকিয়ে মুখে একটু হাসির রেখা টেনে আবার চলে গেলেন। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি। ভাবছি এসব কি..! ভাবী এখন বললেন। কি বুঝেছ..?
ভাবী বললেন, গতকাল একটা ফাইল মিসিং হওয়ায় অফিসে কিছু ঝামেলা হয়। যদিও এসব ভাবীকে ভাইয়া বলেনি। ভাইয়ার এক কলিগের মেসেজ দেখে ভাবী বুঝতে পারে। তাই শার্ট শুধু অহেতুক বাহানা রাগ মেটানো বা মন খারাপের প্রভাব। যার জন্য ভাইয়ার যে রেগুলার ঔষুধ খায় সেটাও আনতে ভুলে যায়। আর এরকম করলে ভাবী নিশ্চিত বুঝে যায় এর পিছনে অন্য কারণ। তাই কোনো কিছু না বলে শান্ত ভাবে পরিস্থিতি সামলে নিয়ে যায়। হয়ত এই জিনিষটার নাম ই কেয়ার। আচ্ছা, তোমার খারাপ লাগে না।। যখন বকা দেও তখন একটুও মন খারাপ হয় না।
ভাবি আবারো হেসে উত্তর দেয়। হ্যা হয়তো। কিন্তু যখন এর পিছনে এই যে আমার প্রিয় ইলিশওয়ালা মানুষটাকে দেখতে পাই তখন আর মন খারাপ থাকে না। অনেক সময় ধরে অনেক গভীর থেকে চেনা মানুষ গুলো ই এমন হয়। বাজারের ব্যাগ দেখে বুঝতে পারনি এখনো.! আসলে ই তো আমি আমার ভাইয়াকে এতটা চিনি না। বয়সের অনেকটা পার্থক্য হওয়ায় ওতটা ফ্রি না ভয় ভয় কাজ করত সবসময়।
গতকাল থেকে ঔষুধ না খেয়ে আরো এমনটা হয়েছে। তাইত ঐ সময় বললেও আনবে না তোমাকে দিয়ে আনালাম। ( ভাবি) এতদিন এসব লক্ষ্য ই করিনি। কিভাবে একজন আরেকজনের মনে মনে ই সব জেনে তাদের একান্ত আপন হয়ে উঠে তা আমি ভাবছিলাম। মাসে একবার ঘুরতে না গেলে কি হবে। এই যে তাদের রাগ – অভিমান, যত্ন, একজন আরেকজনকে বুঝে উঠা এগুলো তেই তো তাদের সব এক হয়ে যায়। তাদের দুজনের এক পৃথিবী তাদের ছেলেটা যত বিবাদ থাক এইখানে দুজনের মেলবন্ধন হয়ে যায়। এই যে ভালোবাসার আরেকটা জায়গা সেটা অন্যকেউ উপলব্ধি করতে পারে না।
সত্যি ভালোবাসাটা এক এক বয়সে একএক রঙে ধরা দেয়। ঐ যে বান্ধবীটা একরকম। আর এই ভালোবাসাটা অন্যরকম। তবে এই ভাবি ভাইয়ার ভালোবাসার গভীরতাটা অনেক কারণ মানুষগুলো একে অন্যকে খুব নিখুঁত ভাবে চিনেছে। মন থেকে বুঝেছে সব পরিস্থিতিতে ভালো মন্দকে সাথে নিয়ে চলতে শিখেছে। এটাই কিন্তু একটা সম্পর্কের জন্য প্রধান। রাতে ভাইয়া ভাবীর ইলিশ মাছ খেয়ে শুয়ে পরলাম। সকালে ঘুম থেকে উঠে শুনতে পেলাম ভাবীকে বাপের বাড়ি যেতে হবে উনার মা অসুস্থ তাই আমাকে ডেকে সব বুঝিয়ে দিয়ে দিলেন কয়েকটা দিনের জন্য। আমিও মাথা নেড়ে নেড়ে সব দেখছি।
হঠাৎ ভাইয়া এসে চায়ের জন্য বললেন সাথে ধমক এক কাপ চা দিতে এত দেরী লাগে। ভাবী তড়িঘরি করে নিয়ে গেল। টেবিলে চা রেখে ফিরে আসতে ই ফ্লোরে পানি ছিল তাতে ভাবি পা পিছলে পরে যায়। কিছুটা ব্যথা পান। সোফায় বসে আছে ভাবী। আমি মলম লাগিয়ে দিচ্ছি। এই সময় ভাইয়া বলল, এসব তো বাহানা। যাও বাবার গিয়ে আর ফিরে এসো না বললাম। ২ দিনের জায়গায় চারদিন থাকার বাহানা মাত্র।
আমার এখন আর বুঝতে বাকি রইল না। কোনোটা রাগ কোনটা অভিমান আর কোনটা ভালোবাসা।আমি হাসছিলাম এসব বুঝে। ভাইয়ার আমার কাছে রাগী খিটখিটে মেজাজের মানুষ হলে ভাবীর কাছে ভাইয়া ঠিক ই তার ভালোবাসার মানুষ আর ভাইয়ার কাছে ভাবীও তেমন। সত্যি ভালোবাসা একেক সময়ে এক এক রকম। একেক বয়সে একএক রকম। ভালোবাসার রঙ পাল্টায় ঠিক তবে ভালোবাসা বদলায় না। ভিন্ন রঙে ভিন্ন অনুভূতিতে এসে ধরা দেয়।