কোনো এক শুক্রবারের গল্প

কোনো এক শুক্রবারের গল্প

আজ এমন একটা শাড়ি পড়েছি যেটা নির্দ্বিধায় হাজার হাজার পুরুষজাতিকে তাক লাগিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। পাতলা, চিনচিনে, স্বচ্ছ শাড়ি। হালকা কালার বরাবরই পছন্দসই পিহুর। আজকে যে শাড়িটা পড়লো এটা আসমানী কালারের, লেপ্টে আছে একদম গায়ে।

শাড়িটা কিনতে অনেকবার নিষেধ করেছিলো ইয়াস। কারন নিজের বৌ এমন ধরণের পাতলা শাড়ি পড়ে কোথাও যাক, তা সে চায়না। ওর পছন্দ ও হয়নি শাড়িটা। কিন্তু আমার বেশ লেগেছে। হালকা কালারের মধ্যে সাদা পুঁতি বসানো নিঁখুত সুতার কাজ শাড়িটায়। পিহু ছাড়েনি, শাড়িটা কিনে নিয়ে এসেছেই। শাড়িটা পড়লেই ভালো লাগবে ওর। হলিডে হিসেবে তাকে একটা উপহার দিবো বলে আগে আগেই প্ল্যান করে রেখেছিলাম! ইয়াস ঘুম থেকে উঠে এখন নাস্তা করতেছে। ওর প্রিয় ভূনা খিঁচুড়ি আর নারকেল- চিংড়ীর ভর্তা আজকের মেনু করেছি। আশা করি এই খুশিতে আমাকেও “ভালোবাসি” বলে খুশি করে দিবে। শাড়ি পড়ে আসলাম, দাঁড়িয়ে রইলাম, বসলাম পাশের চেয়ারটা টান দিয়ে। কিন্তু ও যে তাকাচ্ছেই না! হায়, কি কপাল করে পেয়েছিলাম একটা বর…নাহ্, ও কিছু বলবেনা, আমাকেই শুরু করতে হবে। গলা পরিষ্কার করে জিজ্ঞেস করলাম, ” ইয়াস! দেখোতো শাড়িটা.. কেমন লাগতেছে আমায়? ”

— খুব বাজে। আসমানী, নীল এই দুটো কালার আমার বিরক্ত লাগে, টোল্ড ইয়্যু। ” আমি পড়লেও বিরক্ত লাগে? ”
— হ্যাঁ। শুধু বিরক্ত না, উদ্ভট ও লাগে। তার উপর এত পাতলা, চিনচিনে শাড়ি। লজ্জ্বা করে না তোমার? যাও, এক্ষুনি গিয়ে চেইঞ্জ করে আসো। কোথায় আজ একটু ভালো মাইন্ড নিয়ে ফ্রেশ থাকবো, সব মাটি করে দিলো। শুক্রবার দিনটাও শান্তি নাই। ” আশ্চর্য! লজ্জ্বা পাবো কেন? এখানে তুমি,আমি ছাড়া আর কে আছে? ”

— হোয়াটএভার। এরকম বেশভূষা নিয়ে আমার সামনে আর কখনো আসবেনা। মাইন্ড ইট। ” তো আর কার সামনে যাবো? “হাতের সামনের পানির গ্লাসটা ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলো পিহু। গড় গড় করে পানি চলে যাচ্ছে এপার ওপার। ইয়াসের প্লেটের নিচেও গড়ালো। উঠে পড়লো পিহু। রাগে গচগচ করতে করতে বললো,” উফ! ইচ্ছা করতেছে গলাটা টিপে দিয়ে আসি। কিন্তু কি করে। স্বামী মহাশয় যে.. হুহ্! ”  রাগ সামলাতে পারলোনা, রুমে গিয়ে ধপাস করে বসলো। ইয়াস কাজের বুয়াকে বলতেছে,

— খালা,টেবিলটা পরিষ্কার করে দিয়ে যাও।

সে তার খাবার নিয়ে সোফায় গিয়ে বসলো। আরামচে খাওয়া-দাওয়া হচ্ছে। ” কি সুন্দর! বউ ছাড়তে রাজি, খাবার নয়। অথচ ঐ খাবার ও আমার তৈরী। ” চিৎকার করে ইয়াসকে শুনিয়ে শুনিয়ে বললো। অন্য এক হলিডে ওরফে শুক্রবারের কথা, পিহু চিন্তা করতেছে, দুদিন পর আমার সবচেয়ে প্রিয়, ধনী বান্ধবী আসবে বাসায়। সামনের শুক্রবারেই। ও অনেক বড়লোক, উচ্চবিলাসী। তাই যে করেই হোক ঘরের গেট আপ চেইঞ্জ করে নিতে হবে, কোনোভাবেই যেন সে আমার দুর্নাম না করতে পারে। আমিও কোনো অংশে কম নই। তা ওকে বুঝিয়ে দেওয়ার এইতো নির্মম সুযোগ!

উম.. সোফা সেটটা আর ড্রেসিংটেবিলটাই পুরোনো হয়ে গেছে বেশি। অতএব, এগুলার ব্যবস্থাই করা যাক এট ফার্স্ট।
বাবার দেওয়া টাকা দিয়ে কিনে নিয়ে এলাম! পরদিন ঘুম থেকে উঠে দেখলাম, ইয়াস সেই দোকান থেকে লোক আনিয়ে ফার্নিচারগুলো পাঠিয়ে দিতে চাইতেছে। নিতে রাজি না হওয়ায় এবার সে একটা দামী খাটসহ এগুলো ওদের বাড়িতে পাঠানোর ব্যবস্থা করতেছে। আমার কোনো মূল্যই নেই! আমার অস্তিত্ব কি আদৌ আছে এই বাড়িতে? ফার্নিচারগুলো আমি আনলাম, আমাকে একবার জিজ্ঞেস করার ও প্রয়োজন মনে করেনাই! গলা ফাঁটিয়ে বললাম, ” এগুলো কি হচ্ছে, ইয়াস? কি হইছে তোমার? ”

— দেখতেই পাচ্ছো কি হচ্ছে। আমিও দেখে গিয়েছি এতদিন এবার তুমিও দেখো। ” মানে! ”
— (উত্তর দিলো না ইয়াস)

পিহু গলা উঁচিয়ে বললো, ” তুমি জানো ফার্নিচারগুলো আমি কিনে নিয়ে আসছি। আমার অনুমতি ছাড়া আমারি আনা এত এক্সপেন্সিভ ফার্নিচারগুলো ফিরিয়ে দিচ্ছো? ”

— না। না। মোটেও ফিরিয়ে দিচ্ছিনা। বাড়িতে পাঠাচ্ছি।চোখ বড় বড় করে পিহু বললো, ” বাড়িতে পাঠাচ্ছো মানে? আমি কি এই এক্সপেন্সিভ, নিউ কালেকশন তোমার বাড়ির জন্য কিনেছি নাকি? ”

— মানেটা খুব সহজ।

• প্রথমত, ঐ এক্সপেন্সিভ ফার্নিচারগুলোর কোনো প্রয়োজন ছিলো না আমাদের, কারন অলরেডি ওগুলো বাসার জন্য আমি কিনেছিলাম।

• দ্বিতীয়ত, মায়ের জন্য কিনিনাই, তোমার জন্য কিনেছি। তোমার জন্য কিনে লাভ হয়নাই, তোমার আরো ভালো, এক্সপেন্সিভ দরকার। অথচ এই কম ভালো জিনিসটাও আমি আমার মায়ের জন্য কিনিনি। শুধু নিজের প্ল্যাট,বাসা সাজিয়ে গিয়েছি। তৃতীয়ত, এখন যেহেতু দুই সেট হয়েই গেছে সেহেতু আমার মায়ের জন্য এক সেট যাবেই। পিহু তৎক্ষণাৎ উত্তর দিলো, ” তাহলে পুরোনোগুলোই পাঠাও? আর বাসায় এমনিতেও ওগুলো রাখার জায়গা হবেনা। ” ইয়াস এবার পিহুর সামনে এসে খুব তীক্ষ্ণ প্রশ্ন নিক্ষেপ করলো তীব্র জানার আগ্রহ নিয়ে,

— বাহ্ পিহু! খুব ভালো বললে তো! তোমার বাসায় যেগুলোর জায়গা হবেনা ওগুলোর জায়াগা আমার মায়ের বাড়িতে হবে! এই, এটা তুমি ভাবলে কি করে? বরং তোমার বাসায় যেটার জায়গা হবে ওটাই স্যুট করবে আমার মায়ের বাড়িতেও।ক্লিয়ার? ” কি! ইয়াস তুমি এটা করতে পারো না। আফিয়া আসবে ২ দিন পর। ”

— আর আমি বাড়িতে যাবো ২ দিন পর।

আমার ও চিন্তাভাবনা ছিলো কিছু ফার্নিচার কিনে দিয়ে আসবো মাকে। বাড়িতে এই ফার্নিচারগুলো না নিয়ে যেতে পারলে কষ্ট লাগবে আমার। বুঝলে? কষ্ট পাবে আমার মায়ের আত্বা, আমি। এখন বলো, কে বেশি মূল্যবান তোমার কাছে? আফিয়া না আমি? পিহু আমতা আমতা করে বললো, ” না… মানে.. ইয়ে মানে.. নিয়ে যাবে যাও.. তবে ওগুলোতো আমার বাবার টাকায় কেনা..” ইয়াস হেসেই উত্তরটা দিলো,

— ওহ্! তুমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছো এই ফ্ল্যাটটা ও তো আমার কেনা, আমারিতো সব। তাহলে? হাল ছেড়ে দিয়েই এবার বললো ইয়াস,

— কত টাকা বলো? আমি টাকা দিয়ে দিচ্ছি। তবে আর যাই হোক, এই ফার্নিচারগুলো বাসায় রাখা যাবেনা; এগুলো বাড়িতে যাবে। দ্যট’স ফাইনাল। তুমি থাকার হলে থাকো, আর নয়তো টাকা নিয়ে চলে যাও। পিহু কেঁদে কেঁদে বললো, ” তুমি আমায় সামান্য এইটুকুর জন্য এতবড় কথা শুনালে? ” ইয়াস নিন্দা হাসি মুখে রেখে বললো,

— হাহ হা। তুমি কি মনে করেছো আমি খেয়াল করিনা সব?

• মা বিয়ের পর প্রথম যেদিন বাসায় এসেছিলো সেদিনই তুমি মাকে বলেছিলে ” মা, আপনি কতদিন থাকবেন? কালকে চলে যাবেন?” আমি শুনেছিলাম সব। মায়ের জন্য পান নিয়ে আসতেছিলাম তখন। ব্যস শুনে নিলাম!

• আরেকদিন অফিস থেকে আসার পর তুমি তোমার ঈদের শপিং দেখাচ্ছিলে। তোমার শাড়ি ১০হাজার টাকা, তোমার মায়েরটা ৫হাজার টাকার, আমার পাঞ্জাবি সাড়ে আট হাজার, আর আমার মায়ের শাড়ির দাম মাত্র ৬৫০টাকা। শাড়ি কি, সস্তা একটা কাপড় ছিলো ওটা। আমি ওটা মাকে আর দেইনি। মায়ের জন্য আমার পছন্দসই একটা শাড়ি কিনে নিয়ে গিয়েছিলাম ঐবার। তুমি কম করোনি পিহু।

• ভাইয়ের পিচ্চি মেয়ের থেকে শুনেছি মা চা খেতে চেয়েছিলো, তুমি করে দাওনি। বিকেলের নাস্তা দিয়েছিলে শুকনো চিড়ে,মুড়ি আর রং চা। কেন আমার কি টাকার অভাব পড়েছে? না ছানি পড়েছে তোমার চোখে?
তুমি কি ভাবো? আমি খেয়াল রাখিনা এসবের?
আর আমার বাবা?

• বাবা সেদিন টিভি দেখতেছিলো, তুমি হঠাৎ এসে রিমোট দিয়ে চ্যানেল চেইঞ্জ করে দিলে। আমার বুড়ো বাবা লজ্জায় চলে গেলেন নিজ রুমে। পরদিন আমি তোমার টিভির চেয়েও ৩গুণ বড় টিভি কিনে দিয়েছিলাম আমার বাবাকে।

• বাবার অজুর পানি লাগবে, দাওনি গরম করে। তুমি ব্যস্ত তোমার রুপচর্চা নিয়ে।
• মায়ের পায়ে ব্যাথা, যাওনি ঔষধ নিয়ে।

এইজন্য আমি তোমাকে নিয়ে চলে আসছি। তোমাকে বিয়ে করে ঠেকেছি আমি, যা সহ্য করার আমি করবো। আমার মা বাবা কোন দু:খে সহ্য করবে? কেন করবে? পিহু ইয়াসের কাছে এসে বললো, ” সরি। ” ইয়াস উত্তর দিলো,

— অনেক হইছে আর না। চলে যাও তুমি। আমি আমার মায়ের কাছে চলে যাবো। পিহু বার বার করে বুঝালো কিন্তু ইয়াস বুঝার ছেলে নয়। যা একবার বলবে, ওটাই শেষ কথা। ইয়াস বাসা ছেড়ে দিয়ে মায়ের কাছে চলে গেলো। পিহু চলে গেলো তার বড়লোক বাবার বাসায়। একদিন হঠাৎ অফিস থেকে এসে দেখে পিহু মায়ের পাশে বসে আছে। তোয়াক্কা না করে সোজা চলে গেলো নিজের রুমে। গোসল শেষে খেতে এসে দেখে মা নেই খাবার টেবিলে। মায়ের ঘরে গিয়ে দেখে মাকে খাইয়ে দিচ্ছে পিহু।

ইয়াস কিছু বলার আগেই তার মা বললো, ” বাবা, বৌমা ঠিক হয়ে গিয়েছে। ক্ষমা চেয়েছে তোর বাবার কাছে, আমার কাছে। ও আর কোনোদিন এমন করবেনা বাবা। আর মুখ ফিরিয়ে রাখিস না মেয়েটার প্রতি। আজকে সব রান্নাবান্না ও-ই করেছে। ইয়াস কিছু না বলে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে চলে যেতে যেতে বললো, ” খাবার দিতে বলো। খেতে আসো সবাই। পরদিন কাপড় চোপড় গুছাচ্ছিলো পিহু। এমন সময় দেখলো ইয়াস আসলো। এই অসময়ে কি মনে করে এসেছে জিজ্ঞেস করতেও ভয় পাচ্ছে পিহু। গুছানোর জন্য হাতে কাপড় নিবে এমন সময় একটা নতুন শাড়ি এসে পড়লো তার গায়ের উপর।

ইয়াস শাড়িটা পিহুর গায়ে জড়িয়ে নিয়ে বললো, ” আমার পছন্দের কালারের শাড়ি। পড়ে আসো এখনি। মুভি দেখতে যাবো। ” পিহু এত খুশি আর কখনো হয়নি জীবনে। চোখে জল এসে গেলো। শাড়িটার দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষন, হালকা সবুজ কালারের শাড়ি। পড়ে এসে দুজন মুভি দেখতে চলে গেলো। একদিন শপিং করতে গিয়ে ইয়াস বলে উঠে, ” আকাশী কালারের মধ্যে সাদা সুতার কাজওয়ালা ঐ শাড়িটা বের করেন তো! ” পিহু তাকিয়ে আছে অবাক দৃষ্টি নিয়ে সেদিনটাও ছিলো শুক্রবার।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত