স্বপ্নের হিমু

স্বপ্নের হিমু

আম্মা সোজা আমার কান টেনে ধরলেন । আমি উহ বলার আগেই দেখি আমার ডায়েরি আম্মার হাতে। কি বিপদ!

– এই হিমুটা কে শুনি ?

– আছে, খুব বিখ্যাত একজন।

– বিখ্যাত তো বুঝলাম। এর সাথে তোমার সম্পর্ক কি?

– আমি উনাকে খুব পছন্দ করি। আর হ্যা কানটা ছাড়ো, বড্ড লাগছে।

– ছাড়ছি, তার আগে বলো এই ছেলের বাড়ি কোথায়, থাকে কই,কোন পর্যন্ত পড়াশোনা? জব করে নাকি ঢেঁড়স হয়ে আছে।

ভাইবোন কতজন? বাবা কি করে, মায়ের বংশ কেমন? একনাগাড়ে বলে আম্মা হাঁপাতে থাকেন। আব্বু ততক্ষণে বাইরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাসছেন। আমি আব্বুকে দেখে আহ্লাদে গলে গিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলি। তোমার বৌ নির্ঘাত জে এম বির সদস্য। নইলে আমাকে এতো নিষ্ঠুর ভাবে মারলো কি করে! আমার শ্রদ্ধেয় নানাজান যে অতি অবশ্যই একজন রাজাকার ছিলো, সে কথাও বলি । আব্বা তখন গন জাগরণ মঞ্চের ডাঃ ইমরান এইচ সরকারের মতো, মিষ্টি হাসির সাথে দুঃখ মেশানো স্বরে বললেন। ‘এই বংশের বৌদের এই বংশের মেয়েদের গায়ে হাত তোলা নিষেধ আছে। ‘ আম্মা রেগে বললেন ‘কে করেছে এই আইন ! ‘ আব্বু তখন মুখটা ফেলুদার মতো রহস্যময় বানিয়ে বল্লেন ‘ছোট মা তার মানে আমার দাদি।

আম্মা রেগে বললেন ‘তোমার ভাই যে পাশের বাড়ির স্বাগতাকে, বনলতা ডেকে চিঠি দিয়েছিলো ! তখন তাল পাখার বাড়ি গুলো কোথায় পড়েছিলো শুনি?’ এই সময় ছোট চাচার আসলেন। ‘ হ্যা সব মনে আছে। তখন তোমরা সবাই মিলে আমাকে কোরবানি ঈদে গরু কোরবানি না দিয়ে ঈদের আগেই আমাকে সালমা নামি পল্লী বালিকার কাছে কোরবানি দিয়ে দিয়েছিলে। তোমাদের মধ্যে কি মায়া দয়া বলতে কোনো জিনিস নেই ভাবি ?

আম্মা হাসি লুকিয়ে বললেন আর আপনিও যে কোরবানির পশু হওয়ার জন্য গলাটা যে বাড়িয়ে ছিলেন, সে কথা কি আর আমরা জানিনা? হাটে হাঁড়ি ভেঙ্গোনা ভাবি হাটে হাঁড়ি ভেঙ্গোনা। শুনেছি বউরা বরের ঠেঙ্গানি খায়, সেই বিয়ের রাত থেকে আমিই তো কিল ধাক্কা আর বকাঝকা খেয়ে আসছি। আব্বুর মুচকি মুচকি হাসি দেখে চাচা বললেন ভাইয়া, তুমি না বলেছিলে তোমার বাইরে কি জরুরি কাজ আছে?

হ্যা আছে, একটু পরে যাবো। তারপর একটু কেশে আমার দিকে আড় চোখে তাকিয়ে বললেন। ‘আদৃতাকে এবার বিয়ে দেবো তোরা সবাই একটা ভালো ছেলে দেখ।’ আমি মাথায় তিন তিনটা বাজ পড়লেও এতো অবাক হতাম না। আমার এতো আদরের আব্বু কিনা আমাকে পর করে দেয়ার কথা ভাবছেন! রাগে দুঃখে আমি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসি। একটু পরে ছোট চাচা এলেন, ‘ কিরে আম্মি কেমন ছেলে পছন্দ তোর? সালমান নাকি রানভীর র টাইপ ! আমি চোখ মুছে বললাম ‘বিয়ে করবো না। আর যদিও করি হিমু টাইপ ছেলেকে বিয়ে করবো।

‘সেকি মা আমি যে শুনলাম হিমু’রা কারো প্রেমে পড়েনা। প্রেমিকাকে নীল শাড়ি পড়তে বলে নিজেই লাপাত্তা হয়ে যায়।’ বলে আরো দ্বিগুণ উৎসাহে হাসতে লাগলেন। ‘তুই মা আমার বাবা বেঁচে থাকলে তাকে বিয়ে করতে পারতিস। আমার বাপ হিমুর জমজ ভাই ছিলো মনে হয়। জিন্দেগিতে তাকে এক পাঞ্জাবি ছাড়া দ্বিতীয় পাঞ্জাবিতে দেখিনি। পাঞ্জাবিতে মনে হয় পকেট ছিলোনা। কারণ টাকা চাইলেই বলতেন নেই। আমাদের হাত খরচা বাবদ কখনো চারআনাও দেননি। তোর দাদির জন্য চীরকাল তাঁতের নীল শাড়ি গুলোই কিনে আনতেন । এই একটু ঘুরে আসছি, বলে চলে যেতেন খুলনা নয় চিটাগাং। তোর দাদি নীল শাড়ি পড়ে কি অপেক্ষাই না করতো! আব্বা মাঝরাতে এলেও গরম ভাত খেতে দিতো। কতোদিন ঘুম ভেঙ্গে দেখেছি মাঝরাতে মেঝেতে মাদুর বিছিয়ে আব্বা গরম ভাত খাচ্ছেন। আম্মা পাশে বসে ফুঁ দিয়ে ভাত ঠাণ্ডা করে দিচ্ছেন। আসল হিমু রুপা যদি দেখতে হয়। আমার মা বাবার ছবির দিকে আধঘণ্টা তাকিয়ে দেখ।

আমার প্রিয় চরিত্রর এহেন হাল দেখে,আমার কি দুর্দশা। আমি বিছানায় শুয়ে স্বপ্নের জগতে চলে যাই।
যেনো কোথাও না কোথাও একজন হিমু আমার জন্য ঠিকই আছে। নয় পিচঢালা রাস্তায় খালি পায়ে হাঁটছে।
নয়তো ময়ূরাক্ষীর তীরে চুপচাপ বসে আছে। নদীর দুষ্টু হাওয়া এসে তার এলোমেলো চুল আরো এলোমেলো করে দিচ্ছে। একসময় সে হাঁটতে হাঁটতে তরঙ্গিণী স্টোরে বা ফার্মেসিতে আসবে। তারপর কোন এক কলাকৌশলে ম্যানেজারের কাছ থেকে ল্যাণ্ড ফোনের চাবি আদায় করে আমায় ফোন দেবে।

– কেমন আছো রুপা, ভালোতো! আচ্ছা তোমার নীল শাড়ি আছে! তুমি একটু নীল শাড়ি পড়ে বারান্দায় দাঁড়াও প্লিজ আমি আধঘণ্টার মধ্যে আসছি।

– আচ্ছা দাঁড়াবো। আর কিছু?

– আমি আজ রাতে তোমার সাথে ভাত খাবো। কোন অসুবিধে নেই তো!

– না নেই। কী দিয়ে ভাত খাবে! স্পেশাল কিছু!

– না থাক, গরম ভাতে তুমি কড়া করে একটা ডিম ভেজে দেবে। একটা শুকনো মরিচ পুড়িয়ে দিতে পারো। সাথে এক চামচ গাওয়া ঘি।

– আচ্ছা, সব তৈড়ি থাকবে তুমি আসো।

– একটা জরুরি কথা, তোমার কী কাজল আছে! নীল টিপ! গাঢ় করে একটু কাজল দিওতো!

আমি ফোন নামিয়ে রাখি। আমি জানি সে আসবে না। তবুও নীল শাড়ি পড়ে চোখে গাঢ় কাজল দিতে ভালো লাগে আমার। কী মনে করে কয়েকটা রেশমি চুড়িও হাতে পড়ি।

কল্পনার মানুষ কখনো সামনে আসে না। তবে বাস্তবেও এমন মানুষ আছে। যারা মাঝরাতে ফোন দিয়ে কোন তরুনীকে বলে, তোমার কাছে দু’হাজার টাকা হবে! আমার বন্ধুর খুব দরকার। টাকা ধার দেয়া মেয়েটি তখন যুবকের মাথায় থাকেনা। যুবকের মাথায় ঘোরে একটি ভালো চাকরি তার খুব জরুরি দরকার। তার জন্য। রুপার জন্য। অথবা তার বন্ধুর জন্য। যে বন্ধুটির জন্যেও হয়তো অপেক্ষা করছে কেউ। এটা জীবন চক্র। এই চক্র খুব কম মানুষ ভাঙতে পেরেছে। তাই আমি ভেবে রেখেছি। হিমু’কে বিয়ে করার আগে, একটা চাকরি পেতে হবে আমার। ভদ্রস্থ কোন একটা চাকরি । তারপর নীল শাড়ি পড়ে প্রতিদিন হিমুকে ভাত রেঁধে খাওয়াবো। টাকাও ধার দেবো। আমার স্বপ্নের হিমু’কে দিয়ে আর যাই হোক চাকরি কখনো করাবো না !

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত