রেজাউলকে চিনেন? ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি একটা মেয়ে প্রশ্ন করছে আরেকটা মাঝ বয়সী মহিলাকে। মেয়েটার বয়স খুব বেশি হলে ২২-২৩। বেশ ভূষা দেখে বোঝাই যাচ্ছে সমাজের নিম্নশ্রেণীরর সদস্য। অবশ্য যারা রেজাউলের খোঁজ করে তারা সবাই যে সমাজের উঁচু স্তরের বিত্তশালী লোক তা নয়। আর কিছুদিন ধরে বেশ কিছু মানুষ রেজাউলের খোঁজ করছে। তাদের বেশভূষায় তাদেরকে চেনা সহজ নয়। মহিলাটি রেজাউলের নাম শুনে আমার দিকে তাকালো। আমি মাথায় না বোধক ইশারা করলাম। মহিলাটি চেনে না বলে চলে গেল।
আমি মেয়েটাকে বাজিয়ে দেখতে চাচ্ছি। আসলে সে কে? কি দরকারে এসেছে রেজাউলের কাছে। আর রেজাউল আর কেউ নয়। স্বয়ং আমিই। দেশে বর্তমানে আমার ছোট খাটো রাজত্ব গড়ে উঠছে। আর তাই অন্ধকার জগত আর আইন মহলে আমার কদর বাড়ছে। অপরাধ জগতে ধীরে ধীরে গজিয়ে উঠছে আমার আধিপত্য। দেখলাম মেয়েটা এবার আমার দিকে এগিয়ে আসছে। কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো, ভাই রেজাউলকে চিনেন?
– কোন রেজাউল?
– এই যে ভাঙ্গারির দোকানদার। সোনাকান্দার রেজাউল।
সোনাকান্দা নামটা শুনেই চোখের সামনে পুরনো স্মৃতিগুলো ভেসে উঠতে লাগলো। আমার বয়স তখন খুব বেশি না। এই ১৩ কি ১৪। মা মারা যাওয়ার পর বাবা আবার দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন। সৎমায়ের দু চোখের বিষে পরিণত হই আমি। সকাল বিকাল হাজারটা জিনিস নিয়ে খোটা আর চুন থেকে পান খসলেই বাবার কাছে ইনিয়ে বিনিয়ে কথা লাগানো অতিষ্ঠ করে তুলছিলো আমায়। আর বাবার কাছে মিথ্যে বলে মার খাওয়ানো,দিনের পর দিন না খাইয়ে রাখা তো ছিলই। সবকিছু সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যায়। পালিয়ে যাই বাড়ি থেকে। আসার সময় বাড়ি থেকে মায়ের গহনা আর বাবার জমানো টাকা থেকে বেশ কিছু টাকা নিয়ে আসি। সোনাকান্দা এসে কিছুদিন হোটেলে কাজ করেছি।মজুরগিরি করেছি,বাজারের কুলিগিরিও করেছি। কিন্তু টাকা আর গহনাতে হাত দেই নি। শেষ যে হোটেলে কাজ করেছিলাম তার ম্যানেজারটা বেশ ভালো ছিল। সেই এই ভাঙ্গারির দোকানটা ভাড়া নেওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলো। আজ প্রায় পনের বছর পর সেই পুরনো ভাঙ্গারির দোকানদার সোনাকান্দার রেজাউলের খোঁজ করছে এই মেয়েটা।
– ভাই আপনি চিনেন রেজাউলকে? মেয়েটার কথায় বাস্তবে ফিরে এলাম।
– হ্যা, চিনি। আপনি রেজাউলের কি হোন?
– রেজাউলের দোকানের মালিকের মেয়ে।
একটা ধাক্কা খেলাম। বিথী! কিন্তু বিথী এখানে কি করে আসতে পারে! ও আমার ঠিকানাই বা পেল কোথায়! সোনাকান্দা ছেড়ে এসেছি আজ ১০বছরের উপর হতে চললো। তাছাড়া সেই রেজাউল আর এই রেজাউলের মধ্যে পার্থক্য বিস্তর। সোনাকান্দার সেই রেজাউল ছিল ঘরছাড়া এক কিশোর। যে কোনো মূল্যে যে সৎপথে নিজের জীবনটাকে সামনে এগিয়ে নিতে বদ্ধপরিকর ছিল।আর আজকের এই রেজাউলের বিচরণ কালো জগতের অন্ধকার গলিতে। কেন যেন একটা খটকা লাগতে লাগলো।এ কিছুতেই বিথী হতে পারে না। কিন্তু আবার মনে হচ্ছে না ও সত্যিই বিথী।১০-১৫ বছরের ব্যবধানে মানুষের চেহারা ছবি সম্পূর্ণই পাল্টে যায়। আর ছোট বেলার চেহারা তো বড় হওয়ার সাথে সাথেই পরিবর্তন হয়। দু’টোনায় পড়ে গেলাম। খটকা দূর করার জন্য জিজ্ঞেস করলাম,
– রেজাউলের কাছে কি জন্যে? আর আমার জানা মতে তো ও সোনাকান্দা ছেড়ে এসেছে অনেক বছর আগে। ভাঙ্গারির ব্যবসাও তো ছেড়ে দিয়েছে।
– কি বলেন ভাই! এখন কি করে রেজাউল?
– অন্য ব্যবসায় নামছে। অনেক বড় ব্যবসা।
হাটতে হাটতে কথা বলছিলাম বিথীর সাথে। প্রায় নির্জন একটা জায়গায় চলে এসেছি। আশেপাশে কেউ নেই। মোজার ভেতর থেকে বন্ধুকটা বের করেই সোজা মেয়েটার কপাল বরাবর একটা গুলি করলাম।সাইলেন্সার লাগানো ছিল। সামান্য একটা খুক করে শব্দ ছাড়া আর কিছুই হয় নি। মেয়েটার কপালে দুচোখের ঠিক মাঝখানে একটা গহ্বরের সৃষ্টি হলো। যেন ত্রিনয়ন। চিত হয়ে পড়ে আছে মেয়েটা রাস্তায়। আস্তে করে চলে আসলাম এখান থেকে।
মেয়েটা ছিল পুলিশের গোয়েন্দা শাখার এসআই। আমায় শুট আউট করতে এসেছিল। বেশ ভালোই তথ্য জোগাড় করেছিল। আমার আর বিথীর একটা সুস্পর্কের সুযোগ মেয়েটা নিতে চেয়েছিল। কিন্তু ও একটা তথ্য জানতে ভুল করে ফেলেছিল। বিথী অনেক আগেই এই দুনিয়া ছেড়ে চলে গিয়েছে।বিথীর মৃত্যুর কারণেই সোনাকান্দা ছেড়ে চলে এসেছিলাম আমি। বিথীর মৃত্যুটা আমি মেনে নিতে পারি নি। বার বার আমার চোখের সামনে ভেসে উঠতো বিথীর ওই সসহাস্যমুখটা। সামান্য জ্বর কেড়ে নিয়েছিল আমার বিথীকে। যে বিথী আমায় ছেড়ে পাড়ি জমিয়েছে ওপারে সে কি করে আমার খোঁজে আসতে পারে এখানে!
পুলিশের যেমন সোর্স আছে। আমারও তেমনি কিছু সোর্স আছে। তারাই আমায় জানিয়ে দিয়েছিলো গোয়েন্দা শাখার এসআই সুহাসিনী মন্ডল আজ আমায় এনকাউন্টার করার মিশন নিয়েই রাস্তায় নেমেছে। সুহাসিনী মন্ডলের পরিকল্পনা ঠিক পথেই এগোচ্ছিলো। যদি না ও বিথীর নাম না নিত তবে সত্যি ওর জায়গায় রাস্তায় পড়ে থাকতো আমার লাশ। কাল পত্রিকায় ওর বদলে শিরোনাম হতাম আমি।