পরন্ত বিকেলে মাঠের কাজ সেরে গামছা হাতে কপালের ঘামটা মুছতে মুছতে বাড়ি ফিরছে হাশেম আলী। মুখে তার এক চিলতে হাসি। সে হাসির গভীরতা অনেক। মাঠে যে এবার প্রচুর ফসল হয়েছে। মহান আল্লাহ তা’আলা তার দিকে মুখ তুলে তাকিয়েছেন। হার ভাঙা খাটাখাটুনির ফল তার সেই মাঠের ফসল। ফসলগুলো যেন তার সন্তানের সমতুল্য। রাতদিন পরিশ্রমের পর তিলে তিলে গড়ে উঠেছে তার সেই ফসল।
মাঠ থেকে ফেরার সময় ক্লান্তি জড়ানো চোখে হাশেম আলী একবার তার মাঠের সোনার ফসলের দিকে চোখ বুলিয়ে নেয়। বাতাসের তালে তালে ফসলের দোল খাওয়া দেখে তার মনের সকল ক্লান্তি নিমিষেই দূর হয়ে যায়। মুখে এক চিলতে হাসি নিয়ে সে বাড়ির দিকে রওনা দেয়। বাড়ি ফিরে হাশেম আলী রাসেদের মাকে এক গ্লাস পানি দিতে বলে। রাসেদের মা তার স্বামীর জন্য ঘর থেকে গুড়, মুড়ি আর এক ঘরা পানি নিয়ে হাশেম আলীর সামনে দেয়। হাশেম আলী এক মুঠো মুড়ি আর খানিক গুড় মুখে দিয়ে মমতা বানুকে বলে
– ও গো শুনছো রাসেদের মা! মমতা বানু তখন রাতের রান্নার জন্য শাকপাতা কাটছিলো। কাটতে কাটতে সে বললো
– কী হয়েছে রাসেদের বাপ?
– একটু এদিকে আসো। মমতা শাকের ঝুড়িটা পাশে রেখে হাশেম আলীর কাছে গেলো।
– বলো কী বলবে?
– জানো রাসেদের মা, এবার আমাদের জমিতে প্রচুর ফসল ফলেছে।
– সত্যি? (খুশিতে জিজ্ঞেস করে মমতা বানু।) হাশেম আলী একটু পানি খেয়ে বলে
– হ্যাঁ গো হ্যাঁ। এবার ফসল ঘরে এলে খাওয়ার জন্য কিছু মজুদ রেখে আমাদের রাসেদকে শহরের একটা কলেজে ভর্তি করবো।
– হ্যাঁ তাই কইরো। আমি সেটাই ভাবছিলাম।
মুড়ি খেতে খেতে হাশেম আলী মমতা বানুকে বললো, ঘরে কি এখন রান্নার জন্য কিছু আছে? মমতা বানু বললো, যা আছে তাতে আজকে রাতের জন্য হয়ে যাবে।
– রাসেদের মা, আমাদের রাসেদ কোথায় গেছে?
– ও তো ঘরে বসে পড়তাছে।
– বাহ। তুমি দেখে রেখো আমাদের রাশেদ একদিন এ গ্রামের একজন মাথা হবে। সেদিন আমাদের অনেক নাম ডাক হবে।
– তাই যেন হয়।
হাশেম আলী একবার ঘরে উঁকি দিয়ে দেখে রাসেদ পড়াতে মগ্ন হয়ে আছে। তাই দেখে হাশেম আলীর মনের ভেতর এক অদৃশ্য প্রশান্তি বয়ে যায়। সে যেন টাকা পয়সার অভাবে পড়ালেখা করতে পারেনি। তাই বলে কী রাসেদও পারবে না? তার যত কষ্টই হোক তবুও সে তার ছেলেকে পড়ালেখা শেখাবে, মানুষের মতো মানুষ করবে।
যাতে গ্রামের লোকে তার ছেলেকে দেখে বলে “ঐটা হাশেম আলীর ছেলে না? দেখেছো হাশেম আলীর ছেলেটা আজ কত বড় হয়েছে।” তখন হাশেম বেশ গর্ব করে বলবে, আমার রাসেদ আজ মানুষের মতো মানুষ হয়েছে। চারিদিকে ফসল কাটার ধুম পড়ে গিয়েছে। হাশেম আলী কাস্তে হাতে নিয়ে মাথায় গামছাটা পেঁচিয়ে বাড়ি থেকে বের হবে ঠিক সেসময় রাসেদ পেছন থেকে তাকে ডাক দিয়ে বললো, বাবা আমিও যাবো তোমার সাথে। হাশেম আলী একটু মুচকি হাসি হেসে বললো, তোর মায়ের থেকে আরেকটা কাস্তে নিয়ে আয়। রাসেদ তার মায়ের কাছ থেকে আরেকটা কাস্তে নিয়ে তার বাবার সাথে মাঠের দিকে রওনা দিলো। মাঠে যেতে যেতে রাশেদ তার বাবাকে বললো
– বাবা এবার তো আমার কলেজে ভর্তি হতে হবে। গ্রামের কলেজেই থাকবো নাকি অন্য কোথাও ভর্তি হবো?
– মাঠের ধানগুলো কেটে নেই। তারপর তোকে শহরে ভর্তি করে দিবো। সেখানে তুই মন দিয়ে লেখাপড়া করে সংসারের হাল ধরবি।
হাশেম আলী মাঠের ধানগুলোর দিকে তাকিয়ে মুখে তৃপ্তিকর হাসি নিয়ে তা কাটতে শুরু করলো। গরীবের সুখ অল্পতেই। তাদের চাহিদা কম, পরিশ্রম বেশি। কখনো তারা কল্পনাতেও অধিক ভোগ বিলাসের কথা চিন্তা করে না। গরীবদের যে এসব ভোগ বিলাস করা সাজে না। তারা রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে, পরিশ্রম করে যা আয় করে তা তাদের পেটের ক্ষুধা নিবারণেই ব্যয় হয়ে যায়। তারা আনন্দ ফূর্তি করার সুযোগই পায় না। বেশ কয়েকটা দিন লেগে গেলো মাঠের ফসলগুলো ঘরে তুলতে। ফসল ঘরে থাকা মানে হাজার কষ্টের মাঝেও একটু সুখ থাকা।
এদিকে রাসেদের কলেজে ভর্তি হওয়ার দিন চলে এলো। হাশেম আলী ঘরে খাওয়ার জন্য কিছু ধান রেখে বাকি সব বিক্রি করে দিলো। ঘরে যা ধান মজুদ আছে তাতে আগামী ছয়মাস তারা আরাম আয়েশ করে খেতে পারবে।
যথাসময়ে হাশেম আলী রাসেদকে কলেজে ভর্তি করিয়ে দিলো। তার স্বপ্ন তার ছেলে যেন অনেক বড় হয়।
রাসেদ এখন শহরের একটা মেসে থাকে। পড়ালেখার খরচ সব তারা বাবা হাশেম আলীই বহন করে। শহরে যেতে খরচ লাগে প্রচুর, তাই হাশেম আলী তাদের গ্রামের চেয়ারম্যানের কাছ থেকে চিঠি লিখে সেটা তার ছেলের কাছে পাঠায়। রাসেদও চিঠি হাতে পেলে চিঠির উত্তর লিখে তার বাবার নিকট পাঠিয়ে দেয়। এভাবে দেখতে দেখতে বছর চারেক কেটে গেলো। সামনে রাসেদের ফাইনাল পরীক্ষা। ফর্ম ফিলাপের জন্য অনেকগুলো টাকার প্রয়োজন। রাসেদ যে বাসাতে টিউশনি করাতো সেখান থেকে যা টাকা পেলো তা অতি নূন্যতম। টিউশনির টাকা হাতে নিয়ে সে তার ছাত্রীর দিকে চেয়ে আছে। তার এভাবে চেয়ে থাকার মানে হলো, আগামী কয়েক মাসের টাকা অগ্রিম দিলে তার জন্য একটু ভালো হতো।
ছাত্রীটাও আবার বেশ চঞ্চল। সে খুব সহজেই বুঝে ফেললো রাসেদের ঐভাবে তাকিয়ে থাকার মানে। রাসেদের সব চাওয়া পাওয়া বুঝার একটা কারণও অবশ্য আছে। সেটা হলো মেয়েটি রাসেদকে পছন্দ করে, ভালোও বাসে। রাসেদ তাকে পড়াতে এলে সে শুধু মুগ্ধ হয়ে চেয়ে থাকে রাসেদের দিকে। মেয়েটি রাসেদের হাতে অনেকগুলো টাকা ধরিয়ে দিলো। রাসেদও কোনো প্রকার সংকোচ না করে টাকাটা নিয়ে নিলো।
বাসায় এসে দেখে গ্রাম থেকে চিঠি এসেছে। চিঠিটা খুলতেই রাসেদ দেখে তাতে অনেক টাকা। কয়েকদিন আগে সে তার বাবাকে জানিয়েছিলো, সামনে তার ফর্ম ফিলাপ। বেশ মোটা অংকের টাকা লাগবে। আর সেজন্যই তার বাবা তাকে টাকাগুলো পাঠিয়ে দিয়েছে। রাসেদ চিন্তা করে তার বাবাতো এখন আর আগের মতো কাজকর্ম করতে পারে না। তাহলে তার বাবা এতগুলো টাকা কোথায় পেলো? রাসেদ পরীক্ষা দেয়। ভালো রেজাল্ট করে। মাস্টার্সে ভর্তি হয়। দিন যায় রাসেদের মধ্যে পরিবর্তন আসতে শুরু করে। সে আর আগের মতো তার বাবার চিঠির উত্তর দেয় না। তার বাবার থেকে পড়ালেখার জন্য টাকা চায় না। সে এখন একটা জব করে, তাতে তার পড়ালেখা, থাকা খাওয়ার খরচ বাদেও বেশ কিছু টাকা উদ্বৃত্ত্ব থাকে। সেই টাকাগুলো সে এখন তার প্রেমিকার পেছনে ব্যয় করে। সে একটিবারের জন্যও এখন আর তার বাবা মায়ের খোঁজ খবর নেয় না।
ওদিকে গ্রামের সেই খেটে খাওয়া মানুষটি তার ছেলের কাছে চিঠি পাঠিয়ে অপেক্ষা করে, কবে তার ছেলে চিঠির উত্তর পাঠাবে। আজ কয়েকটা বছর কেটে গেলো তবুও তার ছেলে একটিবারের জন্যও বাড়িতে আসলো না। খুব দেখতে ইচ্ছে তার ছেলেকে। চিঠির উত্তরও আর আসে না। হাশেম আলীর মনে ভয় জাগে, তার ছেলের কিছু হয়নি তো? মমতা বানু প্রায়শই কান্না করে। কেঁদে কেঁদে বলে, ওগো তুমি আমার ছেলেকে একটু দেখে আসো। তার খোজ নিয়ে আসো। আমাদের সেই ছোট্ট রাসেদ কোথায় কি করছে না করছে , কি খাচ্ছে না খাচ্ছে! তুমি বরং আগামীকাল শহর থেকে একবার ঘুরে আসো। মমতা বানু কান্নায় ভেঙে পড়ে। হাশেম আলী জানে মমতাকে মিথ্যে সান্ত্বনা দিয়ে কোনো লাভ হবে না। সে পণ করে আগামীকালই সে শহরে যাবে।
ঘরে বসে এসব কিছুই ভাবছিলো হাশেম আলী। হঠাৎ বাইরে থেকে কে যেন ডাক দিলো তাকে। হাশেম ঘর থেকে বের হয়ে দেখে চেয়ারম্যান সাহেব দাড়িয়ে আছে। সাথে বেশ কিছু লোকজনও এসেছে। রাসেদের ফর্ম ফিলাপের সময় হাশেম আলী চেয়ারম্যানের কাছ থেকে বেশ মোটা অংকের টাকা ধার নিয়েছিলো। যার জন্য চেয়ারম্যান সাহেব প্রায়ই তাদের বাড়িতে আসে। গতবার এসে বলে গিয়েছে আগামীবার টাকা নিতে আসলে সে নাকি টাকা নিয়েই যাবে। আর যদি হাশেম টাকা না দিতে পারে, তবে অন্য একটা ব্যবস্থা করবে। আর সে কারণেই চেয়ারম্যান আজ আবার এসেছে সেই টাকা নিতে।
– কী গো হাশেম আলী, টাকা পয়সার ব্যবস্থা কী কিছু করেছো? হাশেম আমতা আমতা করে। কিন্তু কিছু বলে না। কারণ সে যে টাকার ব্যবস্থা করতে পারেনি। হাশেমের চুপ থাকা দেখে চেয়ারম্যান বলে
– আমি জানতাম তুমি টাকার ব্যবস্থা করতে পারবে না। আর এই টাকা তুমি কোনো দিনও পরিশোধ করতে পারবে না। তাই আমি ভেবে দেখলাম তোমাকে টাকা পরিশোধ করার ভিন্ন একটা উপায় দিতে হবে। আর সেজন্যই আজ এতো মানুষজন নিয়ে এসেছি।
– চেয়ারম্যান সাহেব আপনের কথা ঠিক বুঝবার পারলাম না।
– হয় টাকা দাও, নয়তো এই দলিলটাতে সাক্ষর করে দাও।
– কিসের দলিল এটা?
– তোমার সব জায়গা জমির।
চেয়ারম্যানের এ কথা শুনে হাশেম আলীর বুঝতে বাকি রইলো না চেয়ারম্যান সাহেব তাকে কী বলতে চাচ্ছে।
হাশেম আলী পেছন ফিরে চেয়ে দেখে মমতা বানুর চোখে জল চিক চিক করছে। এই বুঝি ঝর্ণার মতো ঝড়ে পড়বে সে জল। হাশেম চেয়ারম্যানকে বলে
– চেয়ারম্যান সাহেব আর একটিবার আমাকে সুযোগ দেন। আমি কিছুদিনের মধ্যেই আপনার সব টাকা পরিশোধ করার ব্যবস্থা করবো।
– এতদিন যখন পারোনি, তাহলে এ কয়দিনে কিভাবে পারবে?
– আপনে দয়াকরে আর একটা সুযোগ দেন আমায়। দেখেন আমি ঠিক শোধ কর দেবো।
– ওসব বুঝি না মিয়া, আজ এই মুহূর্তে টাকা দিবা, নয়তো এই দলিলে সাক্ষর করে তোমার সব জায়গা জমি আমায় লিখে দিবা।
হাশেম আলী আরেকবার পেছন ফিরে মমতার বানুর দিকে চেয়ে দেখে সে আঁচলে মুখ লুকিয়ে চোখের জল ঝড়াচ্ছে। পরিস্থিতির শিকার হয়ে হাশেম আলী তার সব জায়গা জমি চেয়ারম্যানের নামে লিখে দিতে বাধ্য হয়। চেয়ারম্যান সাহেব হাশেম আলীর বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় মুখে বিজয়ের একটা হাসি হেসে বলে যায়, আগামীকালের মধ্যে বাড়ি থেকে সব জিনিসপত্র নিয়ে চলে যাবে। এসব কথা শুনে মমতা বানু ঘরের মধ্যে চলে যায়। সে অঝোর ধারায় কেঁদে চলেছে। বাড়ি থেকে সবাই চলে গেলে হাশেম আলী মাথায় হাত দিয়ে বাড়ির উঠোনে বসে পড়ে। আজ নিজের সেই চিরচেনা বাড়িটাকেও কেমন যেন অচেনা মনে হচ্ছে তার। দিনের আলো পর্যাপ্ত পরিমাণে থাকা স্বত্তেও চারিদিকে মনে হচ্ছে আঁধার ঘনিয়ে আসছে। অপরাধীর মতো হাশেম আলী ঘরের ভেতরে ঢুকলো। ঢুকে দেখে মমতা বানু মেঝেতে পড়ে আছে। সে ধীরে ধীরে মমতা বানুর কাছে গিয়ে ডাক দিলো, মমতা ও মমতা। কী হয়েছে তোমার? মেঝেতে শুয়ে আছো কেন? তার ডাকে মমতা বানু কোনো উত্তর দেয় না।
উত্তর না পেয়ে হাশেম আলী দ্রুত তাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে মাথায় পানি ঢালতে থাকে। পুরো দুই ঘন্টা পানি ঢালার পর মমতার জ্ঞান ফিরে আসে। জ্ঞান ফিরতেই হাশেম তাকে জিজ্ঞেস করে “কী হয়েছে তোমার? তুমি মেঝেতে পড়ে ছিলে কেন?” মমতা বানু এবার বেশ শব্দ করে কেঁদে ওঠে। তার কান্না দেখে হাশেম আলীর চোখেও জল চলে আসে। সে মমতাকে নিজের বুকে জড়িয়ে সান্ত্বনা দিতে থাকে। বলতে থাকে, আরে কী এমন হয়েছে যার জন্য তুমি কান্না করছো? আমরা এখন থেকে শহরে থাকবো আমাদের রাসেদের কাছে। তুমি কোনো চিন্তা করো না।
বলতো বলতে হাশেম আলীও এবার শব্দ করে কেঁদে ওঠে। তাদের কান্নাতে চারিদিক কম্পিত হতে থাকে।
আকাশে মেঘ জমেছে প্রচুর, এই বুঝি বৃষ্টি নামবে। কিছুক্ষণ বাদেই হাশেম আলীর ঘরের টিনের চালের উপর বৃষ্টির ফোটা টুপ টুপ করে পড়তে শুরু করলো। এই বৃষ্টির ফোটার কাছে তাদের চোখের জল কিছুই না। তাদের এ কান্না দেখার মতো কেউ নেই। নেই তাদের সান্ত্বনা দেওয়ার মতো কেউ। রাতে হাশেম আলী মমতা বানুকে সব জিনিসপত্র গোছাতে বলে। ভোর হলে তারা তাদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়। যাওয়ার সময় হাশেম আলী একবার তার কষ্টে গড়া বাড়িটার দিকে পেছন ফিরে তাকায়।
আর কখনো যে তারা এই বাড়িতে আসতে পারবে না! মমতা বানুর চোখে এখনো জল টলমল করছে। অন্যদিকে রাসেদ তার পড়ালেখা, চাকরি বাকরি, প্রেমিকা নিয়ে ব্যস্ত। সে এতোটাই ব্যস্ত যে, সে তার বাবা মায়ের একটুখানি খোঁজ নেওয়ারও সময় পায় না। একটিবারের জন্যও তার বুড়ো বাপটার কথা তার মনে পড়ে না। আসলে সুখে থাকলে মানুষ সবকিছু ভুলে যায়। হাশেম আলী আর মমতা বানু বিকেল বেলা শহরে পৌঁছে যায়। সেখানে পৌঁছে হাশেম আলী তার ছেলে রাসেদের মেসে গিয়ে দরজায় টোকা দেয়। একটা ছেলে দরজা খুলে তাদেরকে দেখে বলে
– কাকে চাই? হাশেম আলী নির্লিপ্ত কন্ঠে বলে
– আমার ছেলেকে।
– আপনার ছেলের নাম কি?
– রাসেদ, রাসেদ আমার ছেলের নাম।
– ও, আংকেল আপনি? ভিতরে আসুন, বসুন।
তারা ভেতরে গিয়ে বসলো। মেসের ছেলেটি তাদেরকে নাস্তা করতে দিয়ে বললো, আপনারা নাস্তা করতে থাকুন আমি খাবার নিয়ে আসি। বলেই ছেলেটি খাবার আনতে বাইরে চলে গেলো। হাশেম আলী নাস্তা বাদ দিয়ে এদিক সেদিক উঁকি দিয়ে রাসেদকে খোঁজার চেষ্টা করছে। কিন্তু রাসেদ নেই।
কিছু সময় পর ছেলেটি ফিরে আসলে হাশেম আলী তাকে জিজ্ঞেস করলো, বাবা আমার ছেলে কোথায়? ছেলেটি বললো, আংকেল আপনারা আগে খাবারগুলো খেয়ে নিন তারপর আমি রাসেদের কাছে আপনাদের নিয়ে যাবো। খাবার খাওয়া শেষে হাশেম আলী আবার ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করে, বাবা আমার ছেলে এখন কোথায় থাকে, সে কী এখানে থাকে না? ছেলেটি উত্তর দেয়, না আংকেল রাাসেদ এখন আর এখানে থাকে না। তার চাকরি আর পড়ালেখার জন্য সে এখন অন্য জায়গাতে থাকে। ছেলেটি হাশেম আলী এবং মমতা বাানুকে সঙ্গে নিয়ে রাসেদের মেসে যায়। তার রুমে নক করতেই একটা মেয়ে দরজা খুলে দেয়।
– কাকে চাই? তখন ছেলেটি বললো
– রাসেদ আছে?
– হ্যাঁ আছে, কেন?
– ওকে বলুন যে, গ্রাম থেকে ওর বাবা মা এসেছে।
– আচ্ছা আপনারা এখানেই দাঁড়ান। আমি ওকে ডেকে দিচ্ছি। মেয়েটা রাসেদকে ডাকতে যাওয়ার পর হাশেম আলী তার সাথের ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করলো
– বাবা এই মেয়েটা কে?
– জানি না আংকেল।
– রাসেদ কী বিয়ে করেছে?
– সেটাও বলতে পারি না আংকেল।
মেয়েটি কিছুক্ষণ পর রাসেদকে ডেকে দেয়। রাসেদ এসে দেখে তার বাবা মা দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু রাসেদ তার বাবা মাকে অস্বীকার করে। সে বলে, আপনারা কারা? রাসেদকে দেখে মমতা বানু উৎফুল্ল হয়ে বলে, বাবা আমি তোর মা। রাসেদ এবার তাদেরকে না চেনার ভঙ্গিতে বলে
– আপনাদেরকে তো আমি চিনি না। ছেলের মুখে এমন কথা শুনে হাশেম আলী আর মমতা বানু যেন বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। তারা কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে। পাশে থেকে ছেলেটি বলে উঠলো
– কিরে রাসেদ, তুই তোর বাবা মাকে চিনতে পারছিস না?
– কে আমার বাবা মা? উনাদেরকে আমি চিনি না।
– রাসেদ তুই ঠিক আছিস তো? তুই তোর বাবা মাকে চিনতে পারছিস না?
– শোন শুভ, মেজাজ খারাপ করবি না কিন্তু। আমি উনাদেরকে চিনি না। উনাদের যেতে বল এখান থেকে।
হাশেম আলী তার ছেলের মুখে এমন কথা শুনে নিজেকে বড্ড অসহায় মনে করছে। সে ভাবছে, এটাই কী তাদের সেই ছোট্ট রাসেদ? যাকে কোলেপিঠে করে বড় করে তুলেছিলো! এটাই কি সেই রাসেদ? যাকে নিজে না খেয়ে, না পড়ে, তাকে খেয়ে পড়িয়ে বড় করেছিলো! চোখ দুটো ভিজে আসছে হাশেম আলীর। মমতা বানু কিছুই বলছে না। শুধু পলকহীন নয়নে তাকিয়ে আছে তার ছেলের দিকে। আর চোখের কোণ বেয়ে সমুদ্রের জলরাশির মতো জল গরিয়ে পড়ছে। হাশেম আলী শুভকে উদ্দেশ্য করে বলে
– তুমি চুপ করো বাবা। এটা আমাদের রাসেদ না। আমাদের রাসেদ আমাদের সাথে এমন ব্যবহার কখনো করতে পারবে না। হাশেম আলী শার্টের হাতা দিয়ে তার চোখ দুটো মুছে নিয়ে মমতা বানুকে বলে “চলো আমরা চলে যাই এখান থেকে। আমরা ভুল ঠিকানায় এসে পড়েছি।” বলেই হাশেম আলী মমতা বানুকে সাথে নিয়ে বের হয়ে গেলো সেখান থেকে। তারা চলে গেলে শুভ রাসেদকে বললো
– তুই এটা কী করলি রাসেদ? তুই না শিক্ষিত ছেলে? তাহলে এটাই কী তোর শিক্ষিতর নমুনা? রাসেদ অপরাধীর মতো মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। কোনো কথা বলছে না সে। শুভ তাড়াতাড়ি রাসেদের মেস থেকে বের হয়ে রাসেদের বাবা মাকে খুজতে লাগলো। কিন্তু কোথাও পেলো না। দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা বোঝা বড় দায়। হারালেই বুঝবে, আহা কী হারালাম হায়!
সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। হাশেম আলী মমতা বানুকে সঙ্গে নিয়ে রাস্তার ফুটপাত ধরে হাঁটছে। হঠাৎ তাদের চোখে পড়লো, একটা পথশিশু একজন বৃদ্ধ মহিলাকে গালে তুলে ভাত খাইয়ে দিচ্ছে। এটা দেখে মমতা বানু কান্না আটকিয়ে রাখতে পারলোরনা। সে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। তার কান্না দেখে আশেপাশের সব পথচারী তাকিয়ে রইলো তার দিকে। তারা ভাবছে, হয়তো মহিলাটি পাগল হয়ে গিয়েছে। হ্যাঁ আসলেও মমতা বানু পাগল হয়ে গিয়েছে তার ছেলের অমন ব্যবহার দেখে। তারা আজ বড় অসহায়। তাদের মাথার উপরে আজ কেউ নেই, যে তাদের দেখবে। তারা সামনের দিকে হেঁটে চলেছে কোনো অজানা এক গন্তব্যের পথে।