হাত ধরে আমি আর মৌরী প্রায় নির্জন ইটের রাস্তায় হাঁটছি। ওর হাত খুবই কোমল। মনের অজান্তের হালকা চাপ দিচ্ছি ওর হাতে, ও অবশ্য তাতে কিছু মনে করছে না। কথা বলছে কিন্তু কী বলছে তা বুঝতে পারছি না। তার মুখের উপর একগাছি চুল উড়ছে, আমি সেদিকে তাকিয়ে রইলাম।
কিছুদূর আসার পর সামনে দুইটা লোক দেখে আমরা দুজনেই থমকে গেলাম। তার মধ্যে একজনকে চিনতে পেরে অনেক বেশি অবাক হলাম আমি আর মৌরী। বলিউডের সালমান খান একটা লোকের ঘাড়ে হাত দিয়ে হাঁটছে। দেখে মনে হচ্ছে সে অসুস্থ। মৌরী আমার দিকে তাকিয়ে হেসে বলল, সালমান খানের সাথে সেলফি তুলব। আমি তাদের কাছে গিয়ে বললাম, ভাইজান, আমার গার্লফ্রেন্ড, আপনার সাথে একটা ছবি তুলতে চাচ্ছে। সালমান খান কিছু বলল না। পাশের লোকটা একটু বিরক্ত ও রাগতস্বরে বলল, দেখতেই পাচ্ছেন যে উনি অসুস্থ, এই অবস্থায় ছবি তুলতে পারবেন না।
আমি মৌরীর দিকে তাকিয়ে দেখলাম, বেচারি মুখটা কালো করে ফেলেছে। হঠাৎ সালমান খান আমাদের সামনেই ভকভক করে বমি করে দিল। গন্ধ পেলাম। বাংলা মদের বিশ্রী গন্ধ। রাস্তার পাশে পুকুরের দিকে সালমান খানকে নিয়ে লোকটা নেমে গেলো। মৌরী মন খারাপ করে মাথা নিচু করে হাঁটছে। আমার খুব খারাপ লাগছে ওর জন্য। আমি রাস্তার এদিকওদিক তাকিয়ে দেখলাম, তেমন কেউ নেই। ওর গালের দুপাশে হাত দিয়ে যেই চুমু খেতে গেলাম, ও ধাক্কা মেরে আমাকে সরিয়ে দিল।
আমি ধড়ফড় করে ঘুম থেকে উঠে পড়লাম। নিজের বুকের দিকে তাকিয়ে দেখি হৃৎপিণ্ডের কম্পন দেখা যাচ্ছে বুকের উপর। বিছানা থেকে নামতে নামতে ভাবছি, এরকম অদ্ভুত স্বপ্ন দেখছি কেন? এর আগে একদিন আহমেদ রুবেলকে স্বপ্নে সেই ঝাড়ি দিলাম। আর স্বপ্নে তো গন্ধ পাওয়ার কথা না। সিগারেট ধরিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়ে স্বপ্নে পাওয়া বাংলা মদের গন্ধের বিষয়ে ভাবছি। স্বপ্নের বিভিন্ন স্তর আছে। গভীর থেকে গভীরে গেলে স্বপ্নের মধ্যে নাকি গন্ধও পাওয়া যায়। এগুলো মনোবিজ্ঞানীদের অনুমানমাত্র। তারা এর কোন প্রমাণ করতে পেরেছে কি না আমার জানা নেই। সালমান খানের ব্যাপারটা মাথা থেকে সরে গেলেও মৌরীর ব্যাপারটা আমার মাথা থেকে যাচ্ছে না। মৌরী, আমার জীবনের এক অন্যতম অধ্যায়। তার কাছ থেকে আমি ভালবাসা শিখেছিলাম, ভালবাসার পবিত্রতা জেনেছিলাম। হ্যাঁ, এখন সে আমার অতীত। কিন্তু বর্তমানের প্রতিটা ক্ষণে সে আমাকে তার অস্তিত্ব বুঝিয়ে দেয়। কখনো স্বপ্নে বা কখনো রবীন্দ্রসংগীতে বা কখনো হিন্দি গজলে। ফোন থেকে তার প্রিয় একটা গজল ছাড়লাম,
চুপকে চুপকে রাতদিন আসু বাহানা ইয়াদ হে হামকো আবতাক আশিকি কা ও জামানা ইয়াদ হে চুপকে চুপকে রাতদিন আসু বাহানা ইয়াদ হে…
বইমেলার উদ্দেশ্যে বের হলাম। মহাখালী থেকে গাড়িতে উঠে নেমে গেলাম শাহবাগ। রাস্তা আজ কোন কারণে বেশ ফাঁকা। বিশ মিনিটের মধ্যে মহাখালী থেকে শাহবাগ-কল্পনায়ও এত দ্রুত আসা যায় না। শাহবাগ নেমে সিগারেট ধরিয়ে হাঁটছি। হঠাৎ হিমাচল পরিবহণের গাড়ি দেখে মাথায় একটা চিন্তা ঢুকে গেল। সেদিন মৌরীকে হিমাচল পরিবহণে উঠিয়ে দিয়েছিলাম আর ওটাই ছিল তার সাথে আমার প্রথম ও শেষ দেখা। আজ মনে হচ্ছে মৌরী বইমেলায় আসবে। এই মনে হওয়ার কোন ভিত্তি নেই, তবুও মনে হচ্ছে। খুব করে মনে হচ্ছে মৌরী আজ মেলায় আসবে। আমার সাথে তার দেখা হবে।
শাহবাগ থেকে হেঁটে টিএসসি, তারপর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বইমেলায়। পরিচিত বেশকিছু ছেলেপিলে আছে, যারা লেখালেখির মাধ্যমে আমার সাথে পরিচিত। তার মধ্যে একজনকে দেখতে পেলাম হঠাৎ করে। তুষার নাম, ঢাকা ভার্সিটিতে পড়ে। আমি তুষারকে ডাক দিলাম। পাশ দিয়ে নীল শাড়ি পরা একটা মেয়ে হেঁটে গেল। কেন যেন মনে হল এইটাই মৌরী। আমি দ্রুত হেঁটে মেয়েটার সামনে গিয়ে দেখলাম সে মৌরী না এমনকি তার মধ্যে মৌরীর ‘ম’ও নেই। নিজেকে কেন যেন বোকা বোকা মনে হচ্ছে। তুষার এসে বলল, ভাইয়া, কেমন আছেন?
-ভাল, তোর খবর কী? লেখাপড়া করছিস নাকি রাজনীতিতে নাম লিখিয়েছিস?
-না ভাইয়া, রাজনীতি আমাদের জন্য না।
-এটা সবাই বলে। পরে বাধ্য হয়ে অনেকেরই এই লাইনে আসতে হয়। বাদ দে ওসব, বই কিনছিস?
-কয়েকটা কিনেছি। আপনারটা তো এলো না। জানেন ভাইয়া, এইটাই আমার প্রথম বইমেলা। খুব শখ ছিল, প্রথম বইমেলা থেকে আপনার বইটা কিনব।
-দ্যাখ, কাটা গায়ে নুনের ছিটা দিস না। গলা শুকিয়ে গেছে, চল, চা খাবো।
-চলেন।
মেলার মধ্যে একপাশে মন্দির আছে। মন্দিরের সামনে দুইটা চায়ের দোকান। বেশ ভিড় লেগে আছে। আমি দোকান পর্যন্ত যাওয়ার সময় প্রায় প্রত্যেকটা মেয়ের দিকে তাকালাম। ভাবলাম, এই বুঝি মৌরী। অনেক সুন্দরী মেয়েদের দেখছি, কিন্তু মৌরীর দেখা নাই। ব্যাপারটা তুষার খেয়াল করে বলল, ভাইয়া আপনার চরিত্রের সাথে যায় না সেরকম একটা আচরণ করছেন যে? আমি ওর কাছে বললাম, অনেক আগে একটা কাঁটা বিঁধেছিল। মাঝেমধ্যে সেই ব্যথাটা আমাকে জানান দেয়। এইজন্য মেয়েদের দেখে ব্যথা কমানোর ব্যর্থ চেষ্টা করি।তুষার অবাক হয়ে বলল, বুঝলাম না।
-একটা মেয়েকে ভালবাসতাম। হয়তো এখনো বাসি। তার সাথে অনেকদিন যোগাযোগ নেই। কিন্তু আজ হঠাৎ করে মনে হচ্ছে সে বইমেলায় এসেছে। জানি ব্যাপারটা পুরোপুরি অসম্ভব। কিন্তু মাথার মধ্যে ব্যাপারটা গেঁথে গেছে।
-উনার সাথে আপনার কোনরকম যোগাযোগ নেই?
-না। ফোনবুক, ফেসবুক সবখানেই আমি তার ব্লক লিস্টে আর সে আমার এই বুকের টপলিস্টে।
তুষার হেসে বলল, তিনি আপনাকে ছেড়ে অনেক ভুল করেছেন। চায়ে শেষ চুমুক দিয়ে আমি বললাম, সে আমাকে ছাড়েনি, আমিই তাকে ধোঁকা দিয়েছি। অনেক বড় অন্যায় করেছি আমি।
-আপনিই সম্ভবত, প্রথম প্রেমিক যে প্রেমিকাকে দোষারোপ না করে নিজেকে দোষ দিচ্ছেন।
তুষারের প্রশংসা শুনতে এখন আর ভাল লাগছে না। চায়ের দাম দিয়ে বের হয়ে এলাম ওখান থেকে। কোন স্টলে গিয়ে বই কেনা, বই দেখা, লেখক কবিদের সাথে সাক্ষাৎ করতে ইচ্ছে করছে না। উদ্দেশ্যহীন বেশকিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে সন্ধ্যার পরপর মেলা থেকে বেরিয়ে এলাম।
সুদূর ময়মনসিংহ থেকে কবি ও গল্পকার সানোয়ার রাসেল ভাই এসেই আমাকে ফোন করল। সবেমাত্র ঘুমের প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। ইদানীং দিনের বেলা ঘুমানো নেশা হয়ে গেছে। সারা রাত জাগি, আর অর্ধদিবস ঘুমাই। নিজের শরীরের সিস্টেম পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। নিজের প্রতি এই অবহেলা কি আমার মধ্যে অপরাধবোধ আর প্রায়শ্চিত্ত? ওসব পরে ভাবা যাবে। পাঞ্জাবির মধ্যে কোনরকম গা ঢুকিয়ে বের হয়ে গেলাম।
আজ মাথার মধ্যে মৌরীর চিন্তা আরও বেশি করে বিঁধে আছে। আজ শুধু মনে হচ্ছে না বরং আমার আত্মবিশ্বাস যে মৌরী আজ মেলায় আসবেই। মাথায় এক ধরণের সূক্ষ্ম যন্ত্রণা হচ্ছে। এই যন্ত্রণার নাম মৌরী। মেলায় পৌঁছে আমি আর রাসেল ভাই ঘুরাঘুরি করছি। তার বই বেরিয়েছে। তার প্রকাশনীর স্টলে থাকা ছেলেটা রাসেল ভাইকে চিনতে পারেনি। সাধারণ পাঠকের মত রাসেল ভাই তার নিজের বইটা চাইলো, ‘ভাঁটফুল ও ভালোবাসার কাব্য’ বইটা দেন তো। আমি প্রচুর কথা বলছি। মাথা থেকে মৌরীকে বের করার জন্য কথা বলছি। প্রাসঙ্গিক, অপ্রাসঙ্গিক সব কথা বলছি। সস্তা রসিকতা করছি, কিন্তু মৌরী মাথা থেকে বের হচ্ছে না। প্রতিটা মেয়ের দিকে তাকাচ্ছি আর মৌরীকে খুঁজছি। নিজের প্রতি নিজেই বিরক্তবোধ করছি।
-রাসেল ভাই, একটা সমস্যার মধ্যে পড়লাম।
-কী সমস্যা?
-মাথার মধ্যে একটা ব্যাপার ঢুকে গেছে।
-কী?
-আমার মনে হচ্ছে তার সাথে আমার মেলায় দেখা হবে। মনে হচ্ছে, সে মেলায় এসেছে। কিন্তু অনেকদিন ধরে তার সাথে আমার যোগাযোগ নেই।
-মানে মিরাকল আশা করছ?
-হুম, সেরকম কিছু। বলেন তো, কী করি?
-কিছুই করার নেই। চল, বাংলা একাডেমি থেকে ঘুরে আসি।
রাসেল ভাইয়ের সাথে বাংলা একাডেমিতে ঢুকলাম। মৌরীর সাথে এই মেলায় আমার দেখা হয়েছিল। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে তার সাথে আমার প্রথম দেখা হয়েছিল। তাকে খুঁজে বের করা কতটা রোমাঞ্চকর ছিল! দেখা হল, কথা হচ্ছিল না। এরপর কথা বলারও সুযোগ পেয় গেছিলাম। তার স্পর্শ পাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। তার হাত ধরে ঘুরে বেড়িয়েছিলাম বিভিন্ন স্টলে। সেই দিনটা আমার জীবনের শ্রেষ্ঠতম দিন ছিল। এখনো চোখ বন্ধ করে সেই দিনটা পুরোপুরি মনে করি। তার সাথে কাটানো প্রত্যেকটা মুহূর্ত, তার বলা প্রত্যেকটা কথা আমার মনে আছে।
রাতে ছাদে খালি গায়ে একা বসে আছি। সিগারেট একটা ঠোঁটে, আরেকটা আঙ্গুলের মধ্যে ঘুরাচ্ছি। মৌরী প্রায়শই আমাকে গান শোনাতো। চোখ বন্ধ করে তার কণ্ঠ অনুভব করার চেষ্টা করছি। খুবই মধুর কণ্ঠ তার। তার কণ্ঠে রবীন্দ্র সংগীত আসলেই খুব সুন্দর লাগতো। তুমি কোন কাননের ফুল কোন গগনের তারা। তোমায় কোথায় দেখেছি যেন কোন্ স্বপনের পারা ॥ তুমি কোন কাননের ফুল কোন গগনের তারা। তুমি কথা কইও না, তুমি চেয়ে চলে যাও। এই চাঁদের আলোতে তুমি হেসে গ’লে যাও। আমি ঘুমের ঘোরে চাঁদের পানে চেয়ে থাকি মধুর প্রাণে, তোমার আঁখির মতন দুটি তারা ঢালুক কিরণধারা।
তুমি কোন কাননের ফুল কোন গগনের তারা। তোমায় কোথায় দেখেছি যেন কোন্ স্বপনের পারা ॥ তুমি কোন কাননের ফুল কোন গগনের তারা। বুকটা থমথম করছে। মোবাইলের ঘড়িতে দেখি, রাত বারোটা দুই, চব্বিশ ফেব্রুয়ারি। আমার জীবনের সুখকর দিনটা ছিল। আজ এই দিনটা হয়তো সবচেয়ে খারাপ লাগার দিন। বিকেলবেলা মেলার উদ্দেশ্যে বের হলাম। আজ নিয়ত করেছি, কারও সাথে দেখা করব না। মৌরীকে খুঁজব। জানি, তাকে পাবো না। তবুও নিজের মনকে আশা দিয়ে জিইয়ে রাখি।
মেলার শেষের দিকে ভিড় ভালই হয়। সেদিনটাও বেশ ভিড় ছিল। হাজার হাজার মানুষের মধ্যে আমরা দুটো মানুষ একে অপরের হাত ধরে হাঁটছিলাম। সেই অনুভূতি ভোলা সম্ভব না। সিনেমায় দেখা যায়, নায়ক এক্সিডেন্টে মাথায় আঘাত পেয়ে স্মৃতিশক্তি হারিয়ে ফেলে তার অতীত ভুলে যায়। ইশ! যদি এরকম হতো তাহলে অন্তত এই সূক্ষ্ম যন্ত্রণাটা বোধ হত না!
মেলার মধ্য দিয়ে ঘুরছি। আমি সাধারণত রাস্তা ছেড়ে হাঁটছি। মানুষের সাথে বিশেষ করে মেয়েদের সাথে ধাক্কা খাওয়ার ব্যাপারটা আমার কাছে খুবই অস্বস্তিকর লাগে। যদিও বেশিরভাগ ছেলেরা এই ধাক্কায় ‘মজা’ নেওয়ার চেষ্টা করে। হঠাৎ একটা স্টলের সামনে দাঁড়িয়ে পড়লাম। বইয়ের নাম ‘মেয়েটা’। কভারে নীল শাড়ি পরা একটা মেয়ের প্রতিচ্ছবি। মনে হচ্ছে এই মেয়েটাই মৌরী। আমি বুঝতে পারছি আমার মাথা খারাপের দিকে যাচ্ছে। আগেভাগে চিকিৎসা না করালে হয়তো আমাকে শাহবাগ মোড়ে নগ্নাবস্থায় ট্রাফিক কন্ট্রোল করতে দেখা যাবে।
বইটা যখন ধরতে যাব, তখনি আমার হাতে নরম একটা হাতের স্পর্শ পেলাম। আমার মনে হল এই স্পর্শটা আমার পরিচিত। ঘাড় ঘুরাতে নাকে এলো খুবই পরিচিত একটা গন্ধ। আমার মাথা ঘুরাচ্ছে। গা শিরশির করছে, পা কাঁপছে। আমার মনে হচ্ছে আমি দাঁড়িয়ে থাকতে পারব না, এক্ষণি মাথা ঘুরে ধপাস করে পড়ে যাবো। মেয়েটার রেশমি চুলের দিকে তাকালাম। আমার হার্টবিট বাড়ছে। মনে হচ্ছে হৃৎপিণ্ড ফেঁটে বের হয়ে যাবে। আমি কোনরকম দুই পা এগিয়ে মেয়েটার কাঁধে হাত রেখে ডাক দিলাম, মৌরী!!!
মেয়েটা ঘাড় ঘুরাতেই আমার ভিরমি খাওয়ার উপক্রম। আমার কি হেলুসিনেশন হচ্ছে? আমার সামনে মৌরী দাঁড়িয়ে। সেই খোলা চুল, নীল শাড়ি, কপালে টিপ। আমি কাউকে এই মুহূর্তে আশা করছি যে আমাকে ধরে রাখবে, নাহলে আমি পড়ে যাব। মৌরীর মাতালকরা চোখের দিকে আমি তাকিয়ে রয়েছি। তার ঠোঁটে ঢেউ হচ্ছে। মনে হচ্ছে সেই ঢেউয়ে আমি ভেসে যাব। অনেকক্ষণ পরে আমি বুঝলাম, মৌরী আমার সাথে কথা বলছে।
-এক্সকিউজ মি!
-হ্যাঁ, মৌরী। কেমন আছ তুমি?
-আপনি কে?
মৌরী এমন ভাব করল যেন সে আমাকে চিনতেই পারছে না। তার ভাবখানা এমন যেন সে আকাশ থেকে পড়েছে আর আমার অবস্থা যেন আমার মাথায় মহাকাশ ভেঙে পড়েছে। নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, আমি জ্যাক।
-আমি কোন জ্যাককে চিনি না।
-দেখো, আমার উপর তোমার রাগ আছে, ক্ষোভ আছে, জানি। কিন্তু অন্তত না চেনার ভান করো না, প্লিজ।
আমি তার হাতটা ধরতে গেলেই হাত ঝাড়া দিয়ে বলল, এসব কি হচ্ছে? আপনি স্টুপিডের মত আমার হাত ধরছেন কেন? মেয়ে দেখলেই ইভটিজিং করতে ইচ্ছে করে? রাস্কেল কোথাকার! ততক্ষণে লোকজন জড়ো হয়ে গেছে। আমি কোনরকম চারপাশের মানুষদের দেখছি, তারা একটা ‘শুরু’র অপেক্ষা করছে। যাকে বলে গণপিটুনি। কেউ আমার গায়ে হাত তুললে বাকি সবাই অংশগ্রহণ করবে। কিন্তু শুরু করার কেউ নাই। মুহূর্তের মধ্যে একটা খুব সুদর্শন যুবক এসে মৌরীকে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে? মৌরী বলল, এই ইডিয়টটা আমার ঘাড়ে হাত দিয়ে কথা বলছে। আমি তাকে চিনিই না। আমি বললাম, প্লিজ, এমন করো না। তুমি শুধু আমাকেই চিনতে এবং আমার বিশ্বাস তুমি আমাকে এখনো চেনো। অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। লোকটা বেশ নমনীয় স্বরে বলল, ওনার হয়তো কোথাও ভুল হচ্ছে। তুমি কিছু মনে করো না।
এরপর লোকটা আমাকে বলল, আপনার ভুল হচ্ছে কোথাও। আমি দাঁড়িয়ে রইলাম। আমার নিজের চোখ এত বড় ধোঁকা দিবে, তা কল্পনাও করতে পারছি না। আমি তাকিয়ে আছি মেয়েটার দিকে। পাশের সুদর্শন ছেলেটার হাত ধরে এগিয়ে যাচ্ছে। মৌরী এইভাবে আমার হাত ধরে হেঁটেছিল। এমনকি মাঝেমাঝে স্বপ্নে এসে সে এভাবেই আমার হাত ধরে। আমার সামনের সবকিছু ঝাপসা হয়ে আসছে। শুধু এইমাত্র শোনা গালিগুলো কানে বাজছে, স্টুপিড, রাস্কেল, ইডিয়ট। কণ্ঠটাও তো মৌরীর। আমার সব ইন্দ্রিয়ই কি আমার সাথে প্রতারণা করা শুরু করল? যাক, গণপিটুনির হাত থেকে বাঁচলাম। লোকজন আস্তে আস্তে ভিড় ভেঙে চলে যাচ্ছে, আমি একা ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলাম।
কতক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম জানি না, বেশকিছুক্ষণ পর একটা মেয়ে এসে আমার হাত ধরে টেনে বলল, আমার সাথে আসুন। আমি মেয়েটার মুখ দেখতে পাচ্ছি না, দেখার চেষ্টাও করছি না। আমার ঘোর কাটেনি এখনো। বইমেলার ভিতরে একটা কফিশপ আছে। মেয়েটা আমাকে সেখানে নিয়ে বলল, আমাকে চিনেছেন? আমার মনে হচ্ছে আমার স্মৃতি আমার সাথে প্রতারণা শুরু করেছে। কারণ মেয়েটাক আমি চিনতে পারছি। কিন্তু দেখা যাবে আমি মেয়েটাকে যে নামে ডাকব, সে বলবে যে ও আসলে সে নয়। মেয়েটা বলল, আপনার ছবি দেখিনি। আপনাকে সম্ভবত গতবছর দেখেছিলাম। কিন্তু তার আগে আপনার সাথে আমার কথা হয়েছিল।
-মাইশা।
-গুড। ঠিক বলেছেন। ভাইয়া, আমি কখনো ভাবিনি যে আপনার সাথে আমার দেখা হবে।
-কেন?
-একটা প্রশ্নের উত্তর জানার জন্য।
-কী খাবে? কোল্ড কফি?
-হুম।
আমি ওয়েটারকে ডেকে অর্ডার করলাম। মাইশাকে জিজ্ঞেস করলাম, তোমার যে অসুখটা ছিল, ওটা কি সেরেছে নাকি এখনো আছে?
-আপনাদের দোয়ায় এখন অনেক ভাল আছি।
কুশল বিনিময় করতে করতে কফি চলে এলো। মাইশা কফিতে চুমুক দিয়ে বলল, আপুকে কেন ছেড়ে দিয়েছিলেন আপনি? প্রশ্নটা শুধুমাত্র প্রশ্ন ছিল না, পরোক্ষভাবে আমাকে দোষারোপও করা হচ্ছিল।
-ন্যায় এবং অন্যায়ের মাঝে যখন একটাকে বেছে নিতে হয়, তখন সবাই চেষ্টা করে ন্যায়টা বেছে নেওয়ার জন্য। কিন্তু অনেক সময় দেখা যায়, ন্যায় নিতে গিয়ে অন্যায়টা নেওয়া হয় অথবা একজনের কাছে যেটা ন্যায় অন্যজনের কাছে তা অন্যায়।
-আপনি কি সবসময় এভাবে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কথা বলেন?
-না, তোমার প্রশ্নের সোজা উত্তর আমি দিতে পারব না, তাই। তবে এটুকু বলি, মৌরীর কোন দোষ নেই। তার একটাই দোষ ছিল, সম্পর্কের একটা বছর সে আমাকে পাগলের মত ভালবেসেছিল।
-আর আপনি তাকে
-অভিযোগ করা বাদ দাও মাইশা। আমি তো আমার অপরাধ স্বীকার করেছি। এবং তার জন্য শাস্তিও পাচ্ছি। কিন্তু এটা কি বলবে, মৌরী আমাকে চিনতে পারেনি কেন?
-আপনার সাথে আপুর ব্রেকআপের পর আপু খুব অস্বাভাবিক হয়ে যায়। হঠাৎ একদিন আপুর ব্রেইন স্ট্রোক হয়, তারপর আপু তার স্মৃতিশক্তি হারিয়ে ফেলে। আমি আমার কানকে বিশ্বাস করতে পারছি না। এই সিনেমাটিক ব্যাপারটা যে বাস্তবে হয়েছে, মাইশা আমাকে তা বোঝানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছে। আমার মত যুক্তিবাদী মানুষকে বোঝানো এত সহজ ছিল না। মাইশা ধৈর্য সহকারে বোঝাচ্ছে। ব্যাপারটা আমার মাঝে বিশ্বাস অবিশ্বাসের মধ্যে দোদুল্যমান অবস্থায় থেকে গেলো। মৌরী ফোন দিল মাইশাকে। আমি বললাম, লাউডস্পিকারে দাও। আমি তার কণ্ঠটা শুনি।
-হ্যালো, আপু।
-মাইশা, কোথায় তুমি?
-আমি একা একা ঘুরছি।
-একা ঘুরছ নাকি কোন ছেলের সাথে ডেটিং করছ?
মৌরীর কণ্ঠে দুষ্টামি। আমার সাথে যখন কথা বলতো, এরকম দুষ্টামি করতো। কথা শেষ করার পর মাইশা বলল, ভাইয়া, আমাকে উঠতে হবে। আর আপু-ভাইয়া যদি এদিকে আসে, আর আমাকে আপনার সাথে দেখে ফেলে, তাহলে সমস্যা হতে পারে। অন্তত আমি চাইনা আপুর জীবনে ‘আপনি’ বিষয়ক কোন সমস্যার আগমন ঘটুক।
-ভাইয়া? কোন ভাইয়া?
-তখন আপুর সাথে যে লোকটাকে দেখছিলেন, উনার সাথেই আপুর এংগেজমেন্ট হয়েছে। পহেলা বৈশাখে আপুর বিয়ে। আপু যখন অসুস্থ হয়েছিল, তখন ভাইয়া তার চিকিৎসা করেছিল।
-তোমার ভাইয়া ডাক্তার?
-হ্যাঁ।
আমি কী যেন ভাবছি। কপাল কুঁচকে আছে। মাইশা উঠে বলল, ভাইয়া, আমি উঠছি। আমি ভালমন্দ কিছু বলার আগেই মাইশা উঠে চলে গেলো। মাথায় কেমনযেন জট পাকিয়ে গেছে। আমি মেলা থেকে বের হয়ে টিএসসি এসে ফুটপাতে বসে মস্তিষ্কে নিকোটিন প্রবাহ করছি।
সন্ধ্যা হয়েছে। কোলাহল, গাড়ির হর্ন, হকারের চিৎকার কোনকিছুই আমার কানে যাচ্ছে না। মাথায় এখনো বেশকিছু চিন্তা খেলা করছে। কিছুক্ষণ পর দেখলাম, মাইশা, মৌরী সেই সুদর্শন লোকটার সাথে চলে যাচ্ছে। মৌরী হাত নেড়ে হেসে হেসে কথা বলছে। খুব ইচ্ছা করছে মৌরীর হাতটা ধরতে। মৌরী আমাকে বলেছিল, কোনদিন যদি আমি ছেড়ে যেতে চাই, তুমি আমাকে যেতে দিবে না। আমি তার কথা রাখতে পারিনি। হঠাৎ মাথায় জিদ চেপে গেল। আমি ওদের পিছু নেওয়া শুরু করলাম। ঝামেলা? ঝামেলা করব। এতটা নিঃস্বার্থ হতে পারব না। আমি দ্রুত পায়ে হেঁটে ওদেরকে ধরার চেষ্টা করছি। প্রায় কাছে আসতেই মাইশা পিছনে তাকিয়ে আমাকে দেখে ফেললো। করুণ দৃষ্টিতে মাথা নেড়ে আমাকে নিষেধ করল। তার নিষেধ বার্তা আমি কি শুনব?
আমার প্রিয় ছাদ। সবাই যখন ঘুমাই, আমি তখন রাত পাহারা দিই। আমাকে কেন জানি মনে হচ্ছে পুরো ব্যাপারটার মধ্যে কোথাও কোন ‘কিন্তু’ আছে। আমার আর মৌরীর পরিকল্পনা ছিল আমরা পহেলা বৈশাখে বিয়ে করব। আর সামনের পহেলা বৈশাখে তার বিয়ে। খোলা চুল, নীল শাড়ি, টিপ আমার প্রিয়। সে আজ এই সাজেই এসেছিল। তবুও আমাকে চিনতে পারলো না। তার নাকি স্মৃতিভ্রষ্ট হয়েছে। হঠাৎ কেঁপে উঠল আমার ফোনটা। খুব পরিচিত একটা ফোন নাম্বার ভেসে উঠল মোবাইলের স্ক্রিনে। ০১৬……৯৫ আমার হাত কাঁপছে। কোনরকম ফোনটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে সেই চিরচেনা কণ্ঠটা বলে উঠল, তুমি আমার জীবনটা প্রায় শেষ করে দিয়েছ জ্যাক। আমি অনেক কষ্টে আমার জীবনটাকে গুছিয়ে নিয়েছি। আমি চাই না, তুমি আমার গোছানো জীবনটা এলোমেলো করে দাও। তোমার কাছে অনুরোধ করছি। আমি শুধু জিজ্ঞেস করলাম, তোমার নাকি স্মৃতিশক্তি হারিয়ে গেছে?
-ওটা সবাই জানে। আসলে হারায়নি। তোমাকে এবং তোমার স্মৃতিকে ভোলার জন্য আমি এই নাটকটা করছি। আজ অনেকদিন পর সেই স্মৃতিগুলো তুমি মনে করিয়ে দিয়েছ। প্লিজ, আমাকে ভাল থাকতে দাও।
-একটা কথা জিজ্ঞেস করব?
-করো।
-তুমি কি আমাকে এখন আর ভালবাসো না?
-শাট আপ। তোমাকে আমি ঘৃণা করি। I just hate you.
ফোন কেটে দিয়েছে মৌরী। আমি খোলা আকাশের নিচে স্থবির হয়ে বসে আছি। মৌরীর কণ্ঠে শোনা একটা গজল মনে পড়ছে, “উস মোড় সে শুরু কারে ফির এ জিন্দেগি হার শাহজাহা হাচিন থি হাম তুম থে আজনাবি। উস মোড় সে শুরু কারে ফির এ জিন্দেগি।”