লেইট বেবি

লেইট বেবি

একদিন প্রাইভেট থেকে এসে দেখি মা নেই বাসায়। এই সময়ে মা কোথায় যেতে পারে! খুঁজতে খুঁজতে চলে গেলাম ছাদে। গিয়ে দেখলাম মা দাঁড়িয়ে আছে। তারপর গিয়েই জিজ্ঞেস করলাম,

— কি হলো মা? এখানে এইসময়ে কি করো? মা অপ্রস্তুত হয়ে বলে,

– কিছু না, ঐতো কাপড়-চোপড় নিতে আসছিলাম আরকি আমি অবাক হয়ে বললাম,

— কই মা? পুরো ছাদে বা তোমার হাতে- কোথাও তো কোনো কাপড়-চোপড় দেখতেছিনা!
মা কাঁধে হাত রেখে বললো,

– কিছুনা। সারাদিন একা একা ভালো লাগতেছিলো না তাই একটু ছাদে এসেছি মা। কেন তোর কিছু লাগবে? আমিতো তোর খাবার টেবিলেই রেখে দিয়ে আসছি..

— না মা। এইসময়ে তোমায় না দেখে চমকে গিয়েছিলাম একটু। এখন চলো তো, বাসায় চলো তাড়াতাড়ি। খিদে লাগছে, খাওয়ায়ে দিবা।

আরেকদিন দেখলাম মায়ের সাথে দেখা করতে এসেছে পাশের বাসার দুজন আন্টি। একজন মুখে ব্যাঙ্গ হাসি রেখে বললো, ” এই বয়সে এই খবর নিজের কলেজ পাশ করা মেয়েকে না দিলেও তো পারতে মিতালী। ওর বয়স এখন ১৯/২০, এই সময়ে যদি তার ছোট ভাই-বোন আসে কত লজ্জাজনক ব্যপার হবে বিষয়টা তোমার আইডিয়া আছে? ” দ্বিতীয়জন তাকে থামিয়ে দিয়ে বললো, ” ছি:! ছি:! মিতালী! ক’দিন পর তোমার মাথার চুল পেকে, দাঁত পড়ে যাবে আর তুমি কিনা এখন কনসিভ করলা? ” মা তাদের কোনো কথারই কোনো উত্তর না দিয়ে হাসিমুখে তাদের বিদায় দিলো চা, মিষ্টি খাইয়ে। আমায় দেখে ইতস্ত বোধ করবে এই ভেবে পর্দার আড়ালেই রয়ে গেলাম। যা বুঝার তাতো বুঝাই হয়ে গিয়েছে।

অন্য একদিনের কথা, মা বাজার থেকে ছুটতে ছুটতে চলে এসেই দরজা, জানালা সব বন্ধ করে লাইট অফ করে শুয়ে পড়লো। আর সে কি কান্না আমি কিছু জিজ্ঞেস করলেও কিছু বলবেনা এটা জেনেও জিজ্ঞেস করলাম, ” মা কি হয়েছে হঠাৎ? বাজারে কি এমন হয়েছে যে আমার কথা শেষ না হতেই দেখলাম বাবা আমার কথা আটকিয়ে নিজেই বললো, ” তুই রুমে যা সাবিহা। আমি কথা বলবো তোর মায়ের সাথে। ” আমি উঠে চলে গেলাম আমার রুমে। কিন্তু দরজার পাশে দাঁড়িয়ে সবটা শুনে নিলাম। বাজার করতে গিয়ে একগুচ্ছ সেনাপ্রপাতের ভীড়ে চুপসে যায় আমার মা। পাড়া-প্রতিবেশীর সব আন্টিরা মিলে সবার সামনে কত কথাই না শুনালো পরেরদিন সকালে উঠে দেখি দাদিমা ব্যাগ গুছিয়ে রওনা দিচ্ছেন তার ছোট ছেলের বাড়ি। সেই ছেলের বাড়িতে যাচ্ছেন, যে ছেলে তার বউয়ের কথায় একদিন তাড়িয়ে দিয়েছিলো তাকে বাবা হাত ধরে বললো,

– কি হলো মা? কোথায় যাচ্ছেন? দাদিমা হাতটা ধপাস করে ঝাড়া দিয়ে ফেলে দিয়ে বললো,

~ লজ্জ্বা করেনা তোর? আবার জিজ্ঞেস করিস কোথায় যাই? এই বয়সে বাচ্চার বাপ হবি আবার কথা বলিস! মুখ দেখানোর লায়েকও না তোরা। আমি ঐখানেই ভালো থাকবো অন্তত এইসব জিনিস তো দেখতে হইবোনা..

বাবার চোখের জল গড়গড়িয়ে পড়ে যাচ্ছে অনবরত- মা অসুস্থ শরীর নিয়ে পায়ে পর্যন্ত পড়লো দাদির তাও লাভ হলোনা, দাদি সবকিছু বিসর্জন দিয়ে চলে গেলেন বাবা প্রতিদিন মুখ গোমড়া করে বাসায় ফিরতো। কারন তার কলিগরা সবসময় তাকে নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করতো অফিসের বস পর্যন্ত ছাড়েনি বাবা বাজারে পর্যন্ত যেতে পারতেন না, শুধু কোনোরকমে অফিসটা করে বাসায় আসতেন.. বাজার করতো বাসার বুয়াটা। মানুষটা খুব ভালো, মায়ের খুব যত্ন নিতো একদিন বাবা অফিসের খুব গুরুত্বপূর্ণ ফাইল ড্রয়ারে তালাবদ্ধ করে আসলো। পরের দিন গিয়ে দেখে ফাইল নেই। চাবিতো বাবার কাছে তাহলে ফাইল কিভাবে উধাও হলো অফিসের বড়বাবু যখন ডেকে পাঠালেন তখন সেখানে অলরেডি মতিন সাহেব(বাবার কলিগ) ও ছিলো। বড়বাবু জিজ্ঞেস করলেন,

– ফাইলটা দিন। ওটার কিছু তথ্য এখনি আমার জানা লাগবে। বাবা উত্তর না দিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলেন..বড়বাবু হুংকার দিয়ে বললেন,

– মিস্টার সাদিক সাহেব। দাঁড়িয়ে আছেন কেন? ফাইলটা আনতে বললাম। কানে যায়নাই কথাটা? বাবা কাঁপানো স্বরে উত্তর দিলেন, ” স্যার.. ফাইলটা তালাবদ্ধ করেই কাল বাসায় গিয়েছিলাম। কিন্তু আজ আর খুঁজে পাচ্ছিনা..”
– হোয়াট! মতিন সাহেব হাসতে হাসতে বলে উঠলেন,
— স্যার সাদিক সাহেবের এখন আর ওসবের খেয়াল থাকেনা, এখনতো উনার খেয়াল শুধু হেরিডিটির দিকে! হাহ হা হা। বড়বাবুর মুখেও নিন্দা হাসি তাও তিনি মুখ গোমড়া করে বললেন,

– আমি জানিনা কিভাবে,কোথা থেকে পাবেন। তবে আমি ৫ঘন্টার মধ্যে যদি ফাইলটা না পাই তাহলে আপনাকে কঠিন শাস্তি দিবো। কঠিন থেকে কঠিনতর। বাবার মাথায় বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে চোখ রক্তবর্ণ.. কারন বাবা জানে ফাইলটা আসলে কোথায়.. কিছু না ভেবে সোজা বলে দেয়, ” স্যার আমি আর আপনার এখানে কাজ করবোনা। আসলাম। ভালো থাকবেন।” উনি চোখ বড় বড় করে বললেন,

– যাচ্ছেন মানে? আর ফাইলটার কি হবে? চিন্তামুক্ত হয়ে খুব স্বাভাবিকভাবে উত্তর দিলেন বাবা, ” স্যার ওটা মতিন সাহেবকে জিজ্ঞেস করলেই হয়তো জানতে পারবেন। কি মতিন ভাই? আপনার ষোল কলা পূর্ণ হলো তো এবারে? আমি চলে যাচ্ছি অফিস থেকে। আপনি খুশি তো? ” এই বলে বাবা চলে আসলেন আর এইদিকে আমি, প্রাইভেট, ক্লাস যেখানেই যেতাম সেখানেই ক্লাসমেট, বন্ধু-বান্ধবরা হাসি-তামাশায় মেতে থাকতো.. আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতো আমায়।

আমার বেস্ট ফ্রেন্ড নিতুও এই লজ্জ্বার ভয়ে আমার সাথে বিনা কারনে কাট-সাফ করে নিয়েছিলো.. অবশ্য বেশ কিছুদিন ধরেই লক্ষ্য করেছিলাম, ও খুব বাজে ব্যবহার করছে। ক্লাসে যে মেয়েটার সাথে আমার বিবাদ, ভালো সম্পর্ক নেই ও ওর সাথেই বেশি মেলামেশা করতো ইভেন আমাকে দেখিয়ে দেখিয়েই বাইরে কেন ছাদেও যেতে পারতাম না। পাশের বাসার আন্টিদের হাতে একবার পড়লেতো আর রক্ষা নেই এভাবে করেই, একদিন আমরা এক ঘরোয়া হয়ে গেলাম সারা দিন-রাত চব্বিশ ঘন্টা মা বাসায় মুখ লুকিয়ে থাকতো.. বাবা ও তাই। তবে আমাদের বুঝতে দিতোনা। পুরুষদের সহ্যসীমা বেশি। তবে আমি আমার মতো চলতাম। আমার মনে হতো, ‘ আরে বেবি হবে আমার মায়ের সেটা এখন আর তখনই হোক। এখন এতে কার পাকা ধানে মই পড়ার মতো বিষয়? কার কি?’

আমি যখন অনার্স প্রথম বর্ষের ফাইনাল দিবো তখনি আমার ছোট ভাই চিকুর জন্ম হয়। ওর জন্মটা আমাদের জন্য ছিলো আনন্দময় আর আশীর্বাদস্বরুপ। ঐদিনেই বাবার মর মর করতে থাকা সেই কাপড়ের ব্যবসাটা হঠাৎ করে লাভবান হয়ে যায়.. প্রচুর নাম করে ব্যবসাটা। চিকুর নাম দিয়ে শুরু করার জন্যই নাকি এই অগাধ লাভোন্নতি হয়েছে- বাবা বলেন। ওদিকে বাবার ঐ আগের অফিস থেকে বাবাকে ডেকে পাঠান ঐ বড়বাবু। তিনি অনেক আগেই সবটা বুঝে উঠতে পেরেছিলেন। মতিন সাহেব কোটি -কোটি টাকা লোকসান করায় বড়বাবু হার্ট-এট্যাক করেন চিন্তায়,বিদেশে চিকিৎসাধীন ছিলেন এখনো পুরোপুরিভাবে সুস্থ নয়।

বাবাকে অফার করলেন উনার জায়গাটা নেওয়ার জন্য কারন উনার কোনো সন্তান নেই। বউ ছিলো,তাও কিছুদিন আগে মারা গিয়েছে। বাবার অমত থাকা সত্ত্বেও উনার জোরাজোরিতেই বাবা এখন ঐ বড়বাবুর পদটাও নিয়ে নিয়েছেন, তাকে হেল্প করছেন পাশাপাশি তার বিজনেসের উন্নতিও দেখার মতো। একদিন মতিন সাহেবকে বাবা আবিষ্কার করলেন- ব্রিজে শুয়ে শুয়ে ভিক্ষা চাইতে থাকা অবস্থায় বাবাকে চিনতে না পারার দরুন বাবার কাছে ও ভিক্ষা চেয়ে নিলো। বাবার চোখে জল এসে পড়লো,কি অবস্থা হয়ে গিয়েছে লোকটার বাবা জিজ্ঞেস করলেন, ” চিনতে পারছেন আমাকে মতিন সাহেব? আমি সাদিক। আপনার অফিস-কলিগ ছিলাম।”

লোকটা পাগল হয়ে গিয়েছে বুঝতে পারলো বাবা তখন, যখন দেখলেন লোকটা বাবার কথা না শুনে নিজে নিজেই বিড়বিড় করতে লাগলো পরে জানা গেলো, মতিন সাহেবকে অফিস থেকে তাড়ানোর পর পর তার স্ত্রীর মৃত্যু; তারপর একমাত্র ছেলের এক্সিডেন্টে মৃত্যু। ছোট ছেলে তাড়িয়ে দিয়েছে..এই কারনে মানসিকভাবে প্রচন্ড আঘাত পাওয়ায় আজ তিনি পাগল হয়ে গিয়েছেন। বাবা তাকে ডাক্তারখানায় নিলেন,সব খরচ ও বহন করলেন নির্দ্বিধায়.. ইভেন মতিন সাহেবের একাউন্টে লাখ-খানেক টাকাও দিলেন যাতে যতদিন সুস্থ থাকেন ততদিন একটু হলেও ভালো থাকতে পারেন।

আর আমার দাদিমা একদিন আমাদের বাসায় এসে কান্না জুড়ে দিলেন বাবা-মাকে জড়িয়ে। উনার ছোট ছেলে আর ছেলের বউ নাকি অমানবিক অত্যাচার করেছে উনার উপর। ছেলে আর ছেলের বউ খেতো বাজার থেকে আনা টাটকা মাছ-মাংশ আর উনাকে খেতে দিতো শুধু ঝোল আর ভাত। কখনোবা শুকনো রুটি। এই বুড়ো বয়সে এগুলা খাওয়া যায়? বড় নাতিকে স্কুলে দিয়ে আসা,নিয়ে আসার দায়িত্ব পড়েছে তার উপর। প্রতিদিন চারতালা বিল্ডিং বেয়ে যাওয়া-আসা করা এই বয়সের সাথে যায়? সদ্য হওয়া নাতনিকে কোলে নিতে গেলে তার কোলে দেয়নি তার ছোট বউমা। কারন শাশুড়ি নোংরা,কালো। উনার বাচ্চার সৌন্দর্য উবে যাবে নাকি কোলে নিলে এগুলো বলে দাদি কাঁদেন শুধু পাশের বাসায় একদিন তুমুল ঝগড়া আর আওয়াজ। কেন?

যে আন্টিটা আমার মায়ের লেইট বেবি নিয়ে হাসাহাসি করেছিলো সে আন্টি আসলে ছিলেন একজন বন্ধ্যা। উনার বাচ্চা হবেনা বিধায় উনার স্বামী উনাকে খুব মারধোর করতো ইভেন এখন বুড়ো হয়ে গিয়েও লোকটা দমে যায়নি। এখনো আন্টিকে মারে আর বলে, ‘ কি দিয়েছিস আমায় জীবনে? আমার এত সম্পত্তি,বাড়ি,গাড়ি এসব কার জন্যে? লোকের কাছে মুখ দেখাতে পারিনা তোর জন্য।’ আরেক আন্টির বাসায় একদিন চিকু আর আমি গেলাম চিকুর জন্মদিনের মিষ্টি দিতে। গিয়ে দেখি আন্টি নেই। আন্টিকে নাকি আন্টির একমাত্র ছেলে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দিয়েছে, যেকিনা একজন স্বনামধন্য সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। একসময় আমার মাকে খুব গৌরব নিয়দ বলতো, ” মেয়েকে ঠিকমতো পড়াও নি আর আমায় দেখো! আমার ছেলে ইঞ্জিনিয়ার!” বৃদ্ধাশ্রমে গেলাম ভাইকে নিয়ে,প্রচুর ফল-ফ্রুট নিয়েই গেলাম। আন্টি খুশি হয়ে বলেই ফেললো,

~আজ কত বছর ফল খাইনা..

আন্টিকে প্রশ্ন করতে ইচ্ছা হচ্ছে খুব,” আন্টি আপনার ছেলে ইঞ্জিনিয়ার অথচ তার বাসায় আপনার জায়গা হলোনা কেন? আচ্ছা জায়গা হলোনা বুঝলাম। তাইজন্যই তো বৃদ্ধাশ্রমে দিয়ে গিয়েছে কিন্তু দুই-পয়াসা খরচ করে দুটো ফল এনে দিলে তার কোন দিক দিয়ে টাকাটা কমে যেতো? কাকে নিয়ে এত গৌরব ছিলো আপনার? ” আরেকজন আন্টিও আছে। তার বাসায় গিয়ে দেখলাম সেও নেই! অন্য একজন মহিলাকে দেখতে পেলাম। জানতে পারলাম ঐ আন্টির বাচ্চার বয়স ১৮ এ পৌঁছানোর পর জানা গেলো ছেলেটি কানে কম শোনে আর বাকপ্রতিবন্ধী। তাই ঐ আংকেল আন্টিকে ডিভোর্স দিয়ে দিয়েছিলো বেশ কয়েকবছর আগেই। এখন নতুন বিয়ে করেছেন।

আর আমার বান্ধবী নিতুর বয়ফ্রেন্ড আট বছরের রিলেশনকে তোয়াক্কা না করে ঐ মেয়েটার সাথেই বিয়ে করে নিলো যার জন্য একদিন ও আমায় অস্বীকার করেছিলো। আমি সেদিন পাশে গিয়ে বলেছিলাম, ” একদিন তুই আমার দু:সময়ে আমায় নি:সঙ্গ করে চলে গিয়েছিলি। সেদিন থেকে অপেক্ষা করতেছি, কবে তোর ও একদিন দু:সময় আসবে.. সেদিন আমি তোর পাশে গিয়ে দাঁড়াবো, তোকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য। “

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত