সাক্ষী শিমুল

সাক্ষী শিমুল

একবার ভেবেছিলাম শাওনের ছবিটা আগুনে জ্বালিয়ে ফেলব। আবার ভাবলাম, যাকে এতকাল ভালোবেসেছি তার ছবি জ্বালাব কী করে? কিন্তু ছবিটি আমার কাছে আর রাখা যাবে না। এতগুলো বছর ছবিটি আমার কাছে লুকিয়ে রেখেছি। আমার স্বামী পর্যন্ত একটিবারের জন্য দেখেনি এই ছবি। ছেলে মেয়ে বড় হচ্ছে। তারা যদি কখনো জানতে চায়, মা ছবিতে তোমার পাশে এই লোকটি কে? তখন আমি কী জবাব দেব? যদি আমার স্বামীই দেখে ফেলে তখন কী উত্তর দেব? আরো আগেই ছবিটির একটি ব্যবস্থা করা দরকার ছিল। বড্ড দেরি হয়ে গেল মনে হয়। সাদা কালো ছবিতে শাওনের মুখে হাসি হাসি ভাব। এখনো কী শাওন এমনি করে হাসে? নাকি সেই শিমুল গাছটির নিচে মাটিতে শানু নামটিই লিখে। এখনো সবকিছু চোখের মধ্যে ভাসে।

আমি তখন সবেমাত্র কলেজে ভর্তি হয়েছি। শিমুলতলী গ্রামের দরিদ্র পরিবারে জন্ম আমার। বাবা যখন মারা যান তখন আমি সবে প্রাইমারী শেষ করেছি। আমার ছোট বোনটি তখন মায়ের কোলে। পরের সময়গুলো মা’কে বাস্তবতার সাথে যুদ্ধ করতে নিজ চোখে দেখেছি। আমার দুই মামা যদি আমাদের পাশে না থাকতেন কবেই রাস্তায় নেমে বাড়ি বাড়ি ভিক্ষে করতে হত।

শিমুলতলী গ্রামের সেই শিমুল গাছের পাশ দিয়েই আমাকে কলেজে যেতে হয়। সকাল বিকাল সেই শিমুল গাছের নিচে ছেলে মেয়ের দল নিয়ম করে খেলতে আসে। এক সময় গাছটিতে ফুল আসে। গাছ জুড়ে লাল শিমুল ফুলে ছেঁয়ে যায়। কৃষ্ণচূড়া আর শিমুল গাছে ফুল ফুটলে দূর থেকে দেখলে মনে হয় গাছে বুঝি আগুন লেগেছে। এই আগুনের দাউ দাউ করে জ্বলে উঠা শিখা নেই। তবুও গাছজুড়ে আগুন লাল ফুল। আমি বুকে বই চেপে রোজ এই পথে কলেজে যাওয়া আসা করি। আমার এই নিয়ম করে আসা যাওয়ার ছন্দ পতন হয় যেদিন থেকে একটি ছেলে আমার পিছু নেয়।

প্রথমদিন তো আমি ভয়েই শেষ। আমার পেছন পেছন একটি ছেলে আসছে। ভাবতেই কেমন অস্থির লাগে। নিরিবিলি মেঠোপথের দুই ধারে পাট ক্ষেত। সন্ধার পর এই পাটক্ষেত নিয়ে পানিতে থাকা পাইন্যা ভূতের গল্প মানুষের মুখে মুখে। আমার ভয় ভূতের নয়। ছেলেটির সঙ্গী সাথীরা যদি পাট ক্ষেতে লুকিয়ে থাকে। যদি আমাকে টেনে নিয়ে যায়। ছিঃ, এসব কী ভাবছি আমি। আড়চোখে ঘাড় ঘুরিয়ে করে দেখি ছেলেটি আমার দিকে তাকিয়েই হাঁটছে। কিন্তু চেহারা দেখে ভয় কেটে গেল। এমন মায়াবী চাহনিতে কোনো পাপ থাকতে পারে না। আমি নির্ভয়ে কলেজে চলে গেলাম। ক্লাস চলাকালীনও বারবার ছেলেটির কথা মনে হল। আমার পিছু নিবে কেন ছেলেটি?

কলেজ থেকে বাড়ি ফেরার পথে দেখি ছেলেটি বাচ্চাদের সাথে শিমুল গাছের নিচে খেলছে। সাতচারা খেলাটি আমিও খেলতাম এক সময়। মাটির কলস, বাসন কোসন ভেঙ্গে যে টুকরো হয় সে টুকরো চারা একের উপর এক সাতটি চারা বসাতে হয়। একটি টেনিস বল দিয়ে সেগুলো ফেলতে হয়। খুবই চমৎকার খেলা। কিন্তু ছেলেটির সাতচারা খেলার বয়স নেই এখন। এই বয়সে ভার্সিটিতে পড়বে। ফাঁক ফোকরে জ্ঞাণী ভাব নিয়ে দাবা খেলতে বসবে। কেরামও খেলতে পারে। তবে বাচ্চাদের সাথে সাতচারা খেলাটা বেমানান।

আমাকে দেখে ছেলেটি খেলা ছেড়ে হাতের ধূলো পরিষ্কার করছে। চোখের চাহনিতে মনে হচ্ছে যেন আমার জন্যই অপেক্ষা করছিল। আমি একবার তাকিয়ে মাথা নিচু করে হাঁটা শুরু করলাম। ছেলেটিও আমাদের বাড়ির কাছের রাস্তার বাঁক পর্যন্ত এল। আমি পেছন ফিরে তাকাতেই ছেলেটির মুখে মুচকি হাসি। এখন আর ছেলেটিকে দেখে ভয় করছে না। বাড়িতে ঢুকে দেখি মা কাঁথা সেলাই করছে। একটা কাঁথা সেলাই করলে মা পায় সত্তর থেকে আশি টাকা। শীতকালেই এর চাহিদা। গরমের দিন তো এই গ্রামের মানুষ বাইরে ঘুমাতে পারলেই বাঁচে। বিদ্যুৎ থাকলেও প্রতিদিন গরমের রাতে চার পাঁচবার করে বিদ্যুৎ চলে যাবার রেকর্ড আছে। মায়ের দিকে তাকাতেই মা একটি শুকনো হাসি দিলেন। মায়েরা শত কষ্টেও ঠোঁটের কোণে হাসি রাখে। হোক সেটা শুকনো হাসি।

পরদিন কলেজ যাবার পথে শিমুল তলায় থমকে দাঁড়ালাম। বাচ্চাদের খেলার আসর নেই আজ। মাটিতে লাভ চিহ্ন এঁকে কে যেন এর ভিতর লিখে রেখেছে (শাওন+শানু)। খুব রাগ হচ্ছে আমার। রাগে চুল টানতে ইচ্ছে করছে। আশেপাশে কাউকে দেখতে না পেয়ে পা দিয়ে লিখাটা যেই মুছার চেষ্টা করছি, গাছের আড়াল থেকে গতকালের পিছু নেয়া ছেলেটি বেরিয়ে এল। বলছে, করো কী তুমি? এত কষ্ট লিখলাম আর তুমি মুছে ফেলবে? আচ্ছা, এই বজ্জাত লোকটার কাজ তাহলে। হঠাৎ গাছের আড়াল থেকে বের হয়ে আসতে দেখে চমকে গিয়েছি। ছেলেটা সামনে না থাকলে চমকে যাবার জন্য বুকে থুথু দিতাম। বুকে থুথু দিলে নিমেষেই ভয় কেটে যায় বলে গ্রামের লোকদের ধারণা।

-রাস্তার মধ্যে আমার নাম লিখলেন কেন? মানুষ দেখলে কী বলবে? আমার বদনাম করতে এসেছেন এই গ্রামে?
ছেলেটি মাথা নিচু করে ফেলল। আড়চোখে তাকিয়ে আবারো চোখ নামিয়ে নিল। আমি কিছু না বলেই কলেজে চলে গেলাম।

আসার পথে দেখি ছেলেটি বাচ্চাদের সাথে খেলছে। আমি এখন ছেলেটির নাম জানি। আমার নামের সাথে তার নাম লিখেছিল। এখন আরেকটু অবাক হলাম। সকালের সেই পুরো নাম মুছে সেখানে লিখে রেখেছে (S+S)
আমার খুব হাসি পেল এমন কান্ড দেখে। শাওন আমার দিকে তাকিয়ে বা হাতে এক কান চেপে ধরল। সে যেন তার ভুল স্বীকার করছে। শাওনকে কানে ধরতে দেখে আমার আরো হাসি পেল। আমি হাঁটছি আর হাসছি। রাস্তার ডানপাশে শাওনও হাঁটছে একই সমান্তরালে। তবে কারো মুখে কথা নেই। মাঝে মাঝে দু’জনই দু’জনের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে মুচকি হাসি। নিরবতাই যেন এই চলার পথের ভাষা।

অনেক রাত অবধি আমার চোখে ঘুম নেই। শ্যামবর্ণ গায়ের রং আমার। নেই কোনো চেহারায় রূপের ঝলক। শাওন কী দেখে আমার পিছু নিল? সে কী সত্যিই আমাকে পছন্দ করে? নাকি ছলনা লুকিয়ে আছে মনের ভিতর? ভাবতে ভাবতেই রোজ রাতে ঘুমিয়ে পড়ি। সকালে ঘুম ভাঙ্গলে মনে হয় ঘুমের মধ্যেও আমি শাওনকে ভেবেছি। কেন এমন হয়? জীবনে প্রথমবার প্রেম এলে কি এমন লাগে? ভাত খেতে বসলে বাসনে আঙ্গুল ঘুরাতে থাকি আনমনে। আমার মনটা যেন পড়ে আছে শিমুল গাছের নিচে। কেন এমন হল আমার? আগেই তো ভালো ছিলাম। শাওনও রোজ দুইবেলা করে চলার পথে সঙ্গী হয়। তার কি কোনো কাজ কর্ম নেই? একদিন শুধু আসেনি। আমার মনে হয়েছিল কী যেন হারিয়ে ফেলেছি আমি। বারবার মনে হয়েছে, শাওন কেন আসেনি? তাকে আসতেই হবে।

মাস খানেক পর একদিন কলেজ থেকে ফিরছি। তখন শিমুল গাছ ভর্তি আগুন লাল ফুল। শাওন এখন একবেলা আসে, শুধু বিকালে। সকালটা আমার মন খারাপ করেই যেতে হয় কলেজে। সে গঞ্জে তার বাবার দোকানে বসে। বিকেলে তার বাবা দোকানে গেলে সে চলে আসে। শাওন আজ টকটকে লাল রঙ্গের শার্ট পরেছে। শিমুল গাছের নিচে যেতেই মনে হল শাওনও একটি ফুল। মাটিতে পড়ে আছে ছোট ছোট শিমুল ফুল। আর শাওন হল সে ফুলগুলোর রাজা, বড় শিমুল ফুল। সে নুয়ে একটি শিমুল ফুল নিয়ে এদিক সেদিক দেখে নিল। এখন সে আমার পাশাপাশি হাঁটছে। সে আমার ডানপাশে। ফুলটি আমার দিকে বাড়িয়ে দিল, হাঁটা থামায়নি। আমি শাওনের চোখের দিকে তাকালাম। আমার কেন যেন মনে হয়, চোখ কখনো মিথ্যে বলে না। মিথ্যে স্বপ্ন দেখায় না। কিন্তু চোখের সে ভাষা বুঝতে হয়।

-শানু, অনেকদিন তো পিছু নিলাম। তারপর পাশাপাশি হাঁটার সাহস করলাম। আর কতকাল অপেক্ষায় রাখবে? তুমি বুঝো না কেন? আমি তোমাকে এত্তগুলা ভালোবাসি। আমি লজ্জায় তাকাতে পারছি না। জীবনের প্রথম কেউ আমাকে ভালোবাসি বলেছে। তাকে কি ফিরিয়ে দেব? কিন্তু আমিও যে এই দিনটির অপেক্ষা করেছি। অপেক্ষায় থেকেছি শাওনের কাছে আসার। আমি শাওনের কাছ থেকে ফুলটি নিলাম। শুধু একটি প্রশ্ন করেছি।

-আমাকে ভুলে যাবে না তো?

জবাবে বলেছিল, এই বুড়ো শিমুল গাছটা সাক্ষী। আমি কখনো তোমাকে ভুলে যাব না। চার মাস পরের কথা। একদিন কলেজ যাবার পথে শাওন সঙ্গী হল। সকালে সাধারণত শাওন আসে না। আজ কী মনে করে যেন এল। আমাকে বলছে, শানু আজ কলেজে না গেলে হয় না? শাওনের দিকে তাকিয়ে দেখি তার চোখে আকুতি। শুধু হাত জোর করার বাকি। আমি মুচকি হাসি দিতেই সে বুঝে নিল, আমি আজ কলেজ যাচ্ছি না। আমার হাত ধরে সরিষার মাঠ পেরিয়ে নদীর পাড়ে নিয়ে গেল। দুর্বা ঘাসে আমাকে বসিয়ে সে শোয়ে পড়ল আমার কোলে। আমি ডানে বামে তাকিয়ে দেখি কেউ দেখে ফেলে নাকি। গরীব ঘরের মেয়েদের অল্পতেই বদনাম রটে যায়। সেদিন বিকেলে আমাকে অনেক অনুরোধ করে গঞ্জের স্টুডিওতে নিয়ে গেল। ওড়না দিয়ে মুখ ঢেকে শাওনের সাথে স্টুডিওকে ঢুকে পড়লাম। পরিচিত কেউ দেখে ফেললে সর্বনাশ। তিনটি ছবি তুলেছিলাম দু’জন একসাথে। সাদা কালো ছবি। শাওন বলল, যখন আমাদের বিয়ে হবে তখন রঙ্গিন ছবি। এখন সাদা কালোই তুলি।

আমি আর অমত করিনি। সেই ছবি থেকে আমাকে একটা দিল। আর দুইটা ছবি শাওন তার মানিব্যাগে রেখে দিল। বাড়ি ফেরার পথে শাওনকে ছেড়ে আসতে ভালো লাগছিল না। তবুও আসতে হল। অনেক সুন্দর একটি দিন কাটল আমাদের। বাড়ি ফিরে দেখি বড় মামা সাথে আরো দু’জন মেহমান নিয়ে আমাদের বাড়ি উপস্থিত। মা আমাকে দেখামাত্র টেনে আমার ঘরে নিয়ে গেলেন। বললেন, “তাড়াতাড়ি আয়েশাকে ডেকে নিয়ে আয়। ওকে বল একটু সাজিয়ে দিতে। তোর মামা অনেক বড় ঘরের ছেলে নিয়ে এসেছে। তোকে দেখতে এসেছে। একবার পছন্দ হলেই তোর সুখের সীমা থাকবে না।”

আমার খুব মন খারাপ হল। চোখ ছল ছল করছে। মনে হচ্ছে পলক ফেললেই চোখ ভর্তি জল নেমে যাবে গাল বেঁয়ে। মামা গত বছর বলেছিল, আমার ভাগনির জন্য এমন পাত্র নিয়ে আসব যাতে দশ টাকাও খরচ না হয় বিয়ে দিতে।
মা মনে হয় সেজন্যই বলেছে পছন্দ হলে সুখের সীমা থাকবে না। মা’কে কিছুতেই শাওনের কথা বলতে পারছি না। আমি বলতে পারছি না, মা আমি পাত্র পক্ষের সামনে যাব না। কারণ সেখানে মামা বসা। যে মামা আমাদের অভাব দূর করেছেন। এখনো যতটুকু পারে সহযোগীতা করে যাচ্ছেন। আমার লেখাপড়ার খরচটুকুও মামা দেন। কিভাবে বলব যে আমি যাব না? আমি মা’কে বললাম, সাজতে পারব না। এভাবে পছন্দ করলে করবে না করলে নেই। বড় জোর মুখ ধুয়ে কমলকান্তি স্নো মাখতে পারি একটু। আমি ভেবেছিলাম ছেলে পক্ষ আমাকে পছন্দ করবে না। ছেলে ও ছেলের চাচা আমাকে পছন্দ করেছে। তারা বলেছে সামনের সপ্তাহে ছেলের বাবা মা এসে তারিখ ঠিক করবে। তাদের কোনো দাবি দাওয়া নেই। মা তো মহাখুশি। আমাকে বিয়ে দিতে তেমন খরচ হবে না। কিন্তু আমার ভিতরটা জ্বলে যাচ্ছে। বারবার শাওনের মুখটা ভেসে উঠছে। আমি শাওনকে ছাড়া থাকব কিভাবে?

-মা আমি একজনকে খুব পছন্দ করি। আমি এই বিয়ে করতে পারব না।

আমার কথা শেষ হতেই গালে ব্যথা অনুভব হল। মা আমাকে চড় মেরে নিজেই কান্না করছেন। ফুপিয়ে কান্না করা যাকে বলে। চোখে পানি নিয়ে মা বলল, “আমাকে একটু বিষ এনে দিয়ে কথাটা বলতে পারলি না? চিন্তা করে দেখেছিস কী বলেছিস? কে বিয়ে এনেছে জানিস তুই? তোর মামা। তোর কোন মামা সেটা জানিস? যে তোকে আর তোর মা’কে রাস্তায় নামকে দেয়নি। তোর সেই মামাকে আমি বলব যে আমার মেয়ে এই বিয়ে করবে না। তার চেয়ে ভালো না আমাকে একটু বিষ এনে দে।” আমি মূর্তির মত বসে রইলাম। আমার চোখের পানি মনে হয় শুকিয়ে গেছে। মরা পাথর মনে হচ্ছে নিজেকে।

বিয়ের আগে আর শাওনের সাথে আমার দেখা হয়নি। আমি মা’কে বলেছি, ঠিক আছে আমি বিয়ে করব। কিন্তু বিয়ে আমাদের বাড়িতে হবে না, হবে মামার বাড়িতে। মা আমার কথা মেনে নিলেন। আমি জানি শাওন আমাদের বাড়ি চিনে। একদিন দুইদিন আমাকে না দেখলেই পাগলের মত ছুটে আসবে। তার চেয়ে বরং আগে থাকতেই মামা বাড়িতে চলে যাওয়া ভালো। আমি শাওনকে বলতে পারব না কিছু। তার মায়াবী চোখের দিকে অপরাধী চোখ দিয়ে তাকাতে পারব না আমি। আমি একদিন শাওনকে জিজ্ঞেস করেছিলাস, ভুলে যাবে না তো? সে বলেছিল, বুড়ো শিমুল গাছটা সাক্ষী, আমি কোনোদিন ভুলে যাব না। অথচ আজ আমি শাওনকে ঠকাতে চলেছি। মনে হচ্ছে অদৃশ্য এক শিকল আমাকে শানুর সাথে মিলতে দিচ্ছে না।

বিয়ের দিন মেয়েরা শ্বশুর বাড়ি যাবার সময় কান্না করবে, এটাই যেন রীতি। কিন্তু সবাই অবাক হয়ে দেখল আমার চোখে পানি নেই। আমি কান্না করছি না। মূর্তির মত বসে আছি। মা আমার চোখের দিকে তাকাতে পারেনি। নিচের দিকে তাকিয়েই মাথায় হাত রেখে দোয়া করলেন। আমাকে বললেন, কয়েকটা দিন গেলেই দেখবি তুই কত সুখী হয়েছিস। মা’কে ছেড়ে, মামা মামীদের ছেড়ে শ্বশুর বাড়ি চলে যাচ্ছি, তবুও আমার চোখে পানি নেই। মনে হচ্ছে আমি সব নিয়ম নীতি ভঙ্গ করেছি।

সেই কান্নাগুলো এখন কাঁদি, একা একা কাঁদি। এত বছর পার হয়ে যাবার পরও কাঁদি। নিঃশব্দ কান্না, শুধু পানি পড়ে টপটপ করে। ছবিটা কেচি দিয়ে কেটে আমার কাছ থেকে শাওনকে আলাদা করে দিলাম। এখন আর কেউ ছবি দেখলেও বুঝবে না আমার পাশে কেউ ছিল বা আমি কারো পাশে ছিলাম। শাওনের ছবিটা পানিতে ফেলে দিলাম। আগুনে জ্বালানোর সাহস আমার হয়নি। আট বছর কেটে গেল। এক ছেলে এক মেয়ে হল আমার। তবুও কোথায় যেন একটু শূণ্যতা। আমি পরিপূর্ণতাকে খুঁজে পাইনি। শাওনকে দেখি না অনেক বছর ধরে। শেষবার দেখেছিলাম বিয়ের দুই বছর পর।

তখন আমার স্বামী গঞ্জে গিয়েছিল হাট করতে। আমি মা’কে খবর দিয়ে মায়ের সাথেই গিয়েছিলাম আমাদের বাড়িতে। পথে সেই শিমুল গাছ। গাছে কোনো ফুল নেই। গাছের নিচে অসংখ্যবার (S+S) লিখা আছে। আমার ক্ষুধার্ত চোখ ডানে বামে তাকিয়ে কাউকে খুঁজে পায়নি এক পাগল ছাড়া। যে পাগলটা শিমুর গাছের শিকড় জড়িয়ে ধরে বিড়বিড় করে কী যেন বলছে। পাগলটার চোখে আমি তাকাতে পারছিলাম না। এই চোখ দুটো আমার অনেক চেনা। সেই মায়াবী দুটি চোখ। যে চোখে তাকিয়ে স্বপ্ন দেখেছি। বিশ্বাস করেছিলাম এই চোখ কখনো মিথ্যে বলবে না। আমাকে ভুলে যাবে না।

সমাপ্ত

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত