আমার পাগলি মা

আমার পাগলি মা

শীত এলেই মায়ের পাগলামোটা বেড়ে যায় । মা তখন হিতাহীত জ্ঞান হারিয়ে বাড়ির পাশে দিয়ে আস্তে আস্তে টিপ টিপ করে হাটতে যাওয়া মানুষটা পায়ের শব্দ শুনে চিৎকার করে গালি গালাজ শুরু করেন – কোন বান্দির পুত যায়রে? আমার খোয়াড়ের হাস মুরগা গুলান সব চুরি পালাস কেন রে ? আমি ছুটে গিয়ে মাকে শান্ত করি – তোমার ভুক লাগছে মা ? চলো তোমারে গা গোসল ধোয়াইয়া গরম গরম ভাত মাইখা খাওয়াই দেই ।

– এহ্ বান্দির মাইয়া আইছে আমারে গরম ভাত খাওয়াইতে ! ওই কুত্তার ছাও ! আমার কোলের পোলাডারে চুরি কইরা হাউস মিডে নাই ? আবার আইছস আমার হাস মুরগা চুরি করতে ? কাছে আয় , কোপায়া তগো কল্লা ফালাই দিমু ।

বছর ছয়েক আগে আমার দুই বছরের ভাইটা পুকুরে ডুবে মরে যাওয়ার পর থেকে মায়ের পাগলামো শুরু হয়েছে । গরমে ভালোই থাকেন । শীতের ৬ মাস মাকে নিয়ে খুব কষ্ট ! এই সময়টায় মাকে রান্নাঘরের সামনের বড় আম গাছটায় বেধে রাখতে হয় ! ছাড়া পেলেই বটি হাতে দৌড়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে যান ! বলাতো যায়না কখন কাকে কুপিয়ে জখম করে বসেন তাই বেধে রাখি । মা হাত পা ছুড়ে কাঁদেন – কোন বান্দির পুতে আমারে বাইন্ধা থুইছস ? আমারে ছাইড়া দে এ এ এ । মায়ের কান্না শুনে বাবা আর আমি আড়ালে কাঁদি । একবার ছাড়া পেলে ২/৩ দিন আর খোঁজ পাওয়া যায়না !

একবার এমন কান্না জুড়ে দিলেন ! বাধন না খুলে উপায় ছিলোনা ! আমার আর বাবার চোখে ফাকি দিয়ে মূহুর্তের মধ্যে হাওয়ায় মিলিয়ে গেলেন ! ৩ দিন পর পাওয়া গেলো কয়েক গ্রাম পরের এক ধানক্ষেতে অচেতন হয়ে পরে আছেন । সেই থেকে আজ পর্যন্ত মায়ের বাধন খোলা হয়না ! পুত্রশোক মাকে স্থায়ীভাবে মানসিক রোগী বানিয়ে রেখেছে ! গ্রামের বাজারে বাবার একটা ছোট মুদি দোকান আছে । সকাল সকাল পা টিপে টিপে পেয়াজ মরিচ ডলে একথালা পান্তা খেয়ে বাবা দোকানে যান । পাছে মা শব্দ পেয়ে গালি শুরু করেন তাই এই সাবধানতা।

মাঝে মাঝে কেমন করে যেনো টের পেয়ে যান । তক্ষুনি শুরু হয় মায়ের বকা – রাক্ষসের বাচা রাক্ষস ! আমার পোলাডারে তুই কব্বরে থুইয়া আইলি কেমনে রে ! ঐ গোলামের পুত গোলাম আমার পোলারে কব্বর খুইড়া তুইল্যা আইন্যা দে । বাবা চুপচাপ পেছনের দরজা পেরিয়ে চলে যান । ফিরে ফিরে মাকে দেখেন আর পাঞ্জাবীর খুটে চোখ মুছেন ! বছরের পর বছর পার হয়ে যায় ! বাবার সামর্থ অনুযায়ী ডাক্তারী চিকিৎসা করিয়েও মায়ের সুস্থ হয়ে উঠা হয়না ! এখন টুকটাক ঝাড়ফুক আর তাবিজের মাদুলিই ভরসা !

সবেমাত্র ক্লাশ সেভেনে উঠেছি , তখন থেকেই মায়ের এই অবস্থা । মাকে একা রেখে স্কুলে যাওয়ার আর সাহস হলোনা ! ঘর সংসার সামলে , মাকে গোসল খাওয়ার ভার নিজের হাতে তুলে নিয়েছি ৭/৮ বছর আগে । বড়মামা বাবাকে প্রায়ই বলেন – বিন্তুরে আর কতোদিন ঘরে রাখবা ? ওর বিয়ার বয়স চইলা যাইতাছে । আর কিছুদিন পর বিন্তুর লাইগা আর পাত্র খুইজা পাইবানা ।

– হ ভাইজান সবইতো বুজি ! কিন্তু হেরে বিয়া দিলে আমাগো সংসার কেমনে চলব ? বিন্তুর মারে গা গোসল কে ধোয়াইব ? মাইয়া ডাঙ্গর হইছে , তারেও আর কতোদিন ঘরে থুইয়া দেওন যাইব ? অসহায় বাবার বুক চিড়ে দীর্ঘস্বাস বেরোয় ! আমারও একটা সংসারের লোভ হয় । ছোট একটা ঘরে ছোট মিটসেফে কিছু হাড়িপাতিলের সংসারের লোভ ! ছোট ছোট দুটো বাচ্চা উচ্চস্বরে মা মা বলে দৌড়ে আমার কোলে ঝাপিয়ে পরবে এই লোভে পেয়ে বসে আমাকে ।

আমিহীনা এই সংসারের কথা ভেবে লোভটাকে বাড়তে দেইনা ! আমার অভাবে বাবা না খেয়ে থাকতে হবে , মায়ের গোসল খাওয়া বন্ধ হয়ে যাবে ভাবতেই আমার স্বপ্নগুলো হাওয়ায় মিলিয়ে যায় । মামারা আজকাল প্রায়ই ঘটক নিয়ে বাবার কাছে আসেন । বাবাকে মায়ের কথা বলে বুঝিয়ে সুঝিয়ে ঘটক বিদেয় করি । মেঝ মামি এবার আটঘাট বেধে এসেছেন । যে করেই হোক আমাকে রাজি করিয়ে ছাড়বেন – তোর বয়সি একটা মাইয়া দেখাতো যার এহনো বিয়া হয় নাই ।

– মামি আমি সবই বুজি ! কিন্তু মা আর বাবার কি উপায় হইব ভাইবা দেকছ ?

– আমি সব ভাইবাই তোর লগে কতা কইতে আইছি । তোর বাপ মায়ের ব্যাবস্থা কইরাই তোরে বিয়া দিমু মা !

– কি ব্যাবস্তা করবা কওতো দেহি ।

হ্যা মেঝ মামির ব্যাবস্থাটা আমার পছন্দ হয়েছে । সামনের ফাল্গুনে মেঝ মামির বিধবা সন্তানহীনা ননদের সাথে বাবার বিয়ে ঠিক করেছি । বিধবা হওয়ার পর থেকেই তিনি খালার কাছেই থাকেন । দক্ষতার সাথে তিনি খালার বিশাল সংসার সামলান । শান্ত শিষ্ট এই মানুষটার সাথে আগে মায়ের খুব ভাব ছিলো । নতুন মাকে সংসারের দায়িত্বের সাথে আমার মায়ের দায়িত্বও বুঝিয়ে দিচ্ছি । নতুন মাকে ঘরে তুলে বাবা লজ্জায় সারাদিন আর বাড়িমুখো হননি । মায়ের বাধন খুলে নতুন মাকে তার সামনে বসিয়ে বলি – দেহতো মা তোমার নতুন বান্ধবীরে পছন্দ হয় নাকি ? অনেক বছর পর মা শিশুদের মতো হাত পা ছুড়ে খিলখিল করে হেসে উঠেন – তোর নাম কিগো ? রাগ করিসনা ! তোর নামডা ভুইলা গেছিি !

– বুবু আমার নাম রেহেনা । আবার ভুইলা গেলে কিন্তু রাগ করুম ।

– আর ভুলুম না । যাহ্ ছোড ছোড হাড়ি পাতিল লইয়া আয় আমরা রান্দা বারি খেলমু ।

মাকে এখন আর বেধে রাখতে হয়না । তিনি তার নতুন বান্ধবীর সাথে হাড়ি পাতিল খেলেন । নতুন মা তার পাশে বসিয়ে নিজের কাজের সাথে সাথে মায়ের সাথে হাড়ি পাতিল খেলেন । আজকাল দেখি দুজন মিলে সাপ লুডুও খেলেন । মাঝে মাঝে দেখি বাবাও ওদের মাঝের জায়গাটা দখল করে লুডু খেলতে বসে গেছেন । ওদের এই ছেলেমানুসি আমি মুগ্ধ হয়ে দেখি । মায়ের জন্য আসলেই এখন আমার চিন্তা হয়না । নতুন মা কোন যাদুতে যেনো মাকে বশ করে নিয়েছেন ।

আজ শ্রাবণের ৯ তারিখ । দুই মায়ের আশির্বাদ নিয়ে আমি শ্বশুর বাড়ি যাচ্ছি । পলক মানে আমার স্বামী আমার কনুইতে চিমটি কেটে বলে – তাড়াতাড়ি না করলে ট্রেন মিস হবে কিন্তু । বাবার হাত ধরে আমি দ্রুত পা চালাই । চলতে চলতে পেছন ফিরে দেখি আমার দুই মা ই আচলে চোখ মুছেন । ওদের চোখে মেয়ের শ্বশুর বাড়ি যাওয়ার আনন্দের অশ্রু টুপটাপ ঝরে পরা দেখে আমিও সামনের দিকে পা চালাই ।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত