রক্ত ক্ষরণ

রক্ত ক্ষরণ

বড় আপুর সিজার করে বাচ্চা হওয়াতে ডাক্তার এসে বলে, এক ব্যাগ “এ পজেটিভ” রক্ত লাগবে। আয়ান রুমে বসে বসে কম্পিউটারে গেইম খেলতেছিল। এমন সময় মোবাইলে ফোন বেজে ওঠে। গেইমে মগ্নপ্রায়। কয়েকবার ফোন বাজাতে চমকে উঠে। ফোন রিসিভ করেই ওপাশ থেকে শুনতে পায় রক্ত লাগবে। তড়িঘড়ি করে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে তার বন্ধু আফজালকে নিয়ে রওনা দিল। হাসপাতালে পৌঁছাতেই আয়ানের মা ওরে জড়িয়ে ধরে বীভৎস ভাবে কান্নায় ভেঙে পড়ে। মায়ের দু’কাঁধে হাত রেখে বলল, “বড় আপুর স্বামীর বাড়ি থেকে কেউ আসেনি?” পরনের কাপড় দিয়ে চোখ মুছে বলল, “মৌরি’কে পছন্দ হয়নি দেখে তাই আসেনি।” আয়ান অবাক হয়ে কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে বলল, “তিন বছর আগের কথা এখনো মনে রেখেছে তারা? কেমন শ্বশুর-শ্বাশুড়ি উনারা আল্লাহ্‌ ভালো জানে।”

আয়ানের বন্ধ আফজাল খানিক গম্ভীর কণ্ঠে বলল, “দোস্ত, আমাদের উদ্দেশ্য হলো রক্ত জোগার করা। পারিবারিক ব্যাপার বাসায় গিয়ে ফয়সালা করে নিস।” আয়ান মায়ের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “মা দুলাভাই আপুর খবর জানে?” মা বলল, “কয়েকবার ইমুতে ফোন দিয়েছি, রিসিভ করলো না। হয়তো কাজে ব্যস্ত।”

বড় আপুর সাথে পারিবারিক ভাবে বিয়ে হলেও পরিবর্তে তার স্বামীর পরিবার থেকে যথেষ্ট দুর্ব্যবহার করে। খুটিনাটি ভুল গুলোও বড় আকারে তুলে ধরে দরবার বসে। আয়ানের বড় আপুকে বিয়ে করার দুই বছর পর তার স্বামী বিদেশ যায়।

মা ও আফজালকে নিয়ে আয়ান বড় আপুর বেডে যায়। দেখে আব্বা বড় আপুর সন্তানকে কোলে নিয়ে বসে বসে ঝিমাচ্ছে। আব্বার ঝিমানি দেখে আয়ান মনে মনে বলতেছে, “এখন যদি আপুর শ্বশুর বাড়ির কেউ থাকতো তাহলে এতোটা পরিশ্রম করতে হতো না কারো।” আয়ান তার বড় আপুর পাশে বসে বলল, “ডাক্তার কিছু বলেছে?” সদ্য অপারেশন করাতে তেমন কথা বলতে পারছে না। তবুও বিরবির করে বলল, “ডাক্তার বলছে রক্ত লাগবে। দেখনা ভাই কোথাও রক্ত পাওয়া যায় কিনা! ভাই আমার, তোকে কোলে কাঁধে করে মানুষ করেছি, বড় করেছি, তুই আমার সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে এই টুকু কষ্ট কর।”

বড় আপুর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারলেন না আয়ান। কান্না জড়ানো কণ্ঠে আয়ানেরও কান্না আসছিল। বুক ফাঁটা কান্না চাপা দিয়ে বলল, “তুমি একদম চিন্তা করো না। আমি আর আমার বন্ধু মিলে এক ব্যবস্থা করবো ইনশাআল্লাহ্‌।” এমন সময় ধবধবে সাদা এপ্রোন পরা এক নার্স এসে বলল, “রোগীকে বিশ্রাম নিতে দিন। রক্তের ব্যবস্থা করেছেন?” বড় আপু কাঁপা স্বরে আস্তে আস্তে করে বলল, “আমার ভাই এসেছে, ওই যা যা লাগে করবে।” নার্স আয়ানের দিকে মুখ করে তাকিয়ে বলল, “দেখুন, উনার শরীর খুব দুর্বল। প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে। যত দ্রুত সম্ভব রক্তের ব্যবস্থা করুন। এখন স্যালাইন দিয়ে যাচ্ছি।” আয়ান কিছু জিজ্ঞেস করবে ঠিক ঐ মূহুর্তেই নার্সের মোবাইলে ফোন এলে সে চলে যায়।

বন্ধু আফজালকে সাথে নিয়ে হাসপাতালের ব্লাড ব্যাংকে গিয়েও লাভ হয়নি। উনারা বলল, আমাদের কাছে বর্তমান “এ পজেটিভ” রক্ত নেই। অন্য কোথাও দেখতে পারেন। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামবে, এমন সময় আফজাল বলল, “তোকে অনেকদিন বলেছিলাম, “রক্ত নিয়ে খেলা করিস না। এই রক্তের জন্যই একদিন পাগলের মত ছটফট করতে থাকবি।” আয়ানের চোখের পাপরি গুলো ভিজে যাচ্ছে। বলল, “শহরে তোর তো অনেক ডোনারের সাথে পরিচয় আছে, ওদের সাথে একটু যোগাযোগ করে দেখ কী হয়?” আফজাল পকেট থেকে মোবাইল বের করে কয়েক জনকে ফোন দিলেও রেসপন্স পায়নি। কারো সাড়া না পাওয়াতে আয়ান বলল, “সবার দেয়া রক্ত চেয়ে সাহায্যের পোস্ট না বোঝেই এড়িয়ে চলেছি। তাই বলি আমার হয়ে তুই জরুরী ভিত্তিতে তোর ফেসবুকে রক্ত চেয়ে পোস্ট কর। এমনতো হতে পারে, কারো হৃদয়ে মায়া জন্মাবে!”

আয়ানের কঠিন কথাকে আফজাল সহজ ভাবে নিয়ে হেসে বলল, “তোর ধারণা ছিল ফেসবুকে রক্ত চেয়ে পোস্ট গুলো সব-ই গুজব। কিন্তু এখন, তোর-ই একমাত্র শেষ সম্বল ফেসবুক নামক অবহেলীত যন্ত্রটা।” বড় আপুর আর্তনাদ কান্না জড়ানো কথা শোনে আয়ানেরও শেষ সম্বল হয়ে উঠে ফেসবুক পোস্ট। আফজাল ঠিক-ঠাক মত ঠিকানা দিয়ে রক্ত চেয়ে সাহায্যের পোস্ট করে সিঁড়ি বেয়ে আবার দুজনে বড় আপুর বেডে গেল। দুজনকে দেখা মাত্রই মা বলল, “বাবা’রা, কিছু করতে পারলে? মায়ের কথার জবাব না দিতে পারাতে আয়ান স্থির হয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো। আফজাল বলল, “আন্টি কিছুক্ষণের মধ্যেই ব্যবস্থা হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।”

কিছুক্ষণ পর আফজালকে বড় আপুর পাশে বসিয়ে রেখে ডাক্তারের দেয়া প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী ঔষুধ আনতে যায় আয়ান। ১৫/২০ মিনিট পর ঔষুধ নিয়ে আবার হাসপাতালে আসে। রুমে ঢুকতেই দেখে, বড় আপুর পাশে বসে আছে দুই জন মেয়ে। একজনের বয়স সম্ভবত ২০/২১ হবে, অন্য জনের ২৬/২৮ বছর। আয়ান আফজালকে জিজ্ঞেস করে, “এনারা কে?” আফজাল বলল, “উনারা রক্তদান কারী।” অবশেষে আয়ান ছটফটানি থেকে মুক্তি পেয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “কে রক্ত দিবে?” বড় মেয়েটি বলল, “আমার ছোট বোন মিলি।” আয়ান খানিকটা অবাক হয়ে বলল, “এতটুকু মেয়ে রক্ত দিবে ভয় পাবে না?” ভয়ের কথা শোনে মিলি ও তার বড় বোন দুজনেই হাসতে লাগলো। বড় বোন বলল, “আজ-ই ওর প্রথম রক্ত দেয়া হবে। ওর জন্য ওর মত একজন নারী সুস্থ ভাবে জীবন-যাপন করতে পারবে। একজন বাচ্চা তার মা’কে সুস্থ অবস্থায় আকড়ে ধরে বাঁচতে পারবে। এটা মিলির জন্য অনেক বড় গর্বের বিষয়।”

মিলি আয়ানের বড় আপুর পাশে চুপচাপ বসে আছে। বড় আপু তার মাথায় নিজ সন্তানের মত হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। আয়ানকে কাছে ডেকে বলল, “ভাই, আফজালের মুখে সব শুনেছি। রক্তটাকে ভালোবাসতে শিখ। এক ফুটা রক্ত শুধু রক্ত-ই না, একটা জীবন, একটা প্রাণ।”

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত