বিয়ের আগেই আমার একটা পরিকল্পনা ছিল। যেটা আগে থেকে বউকে জানাইনি। জানালে সেই পরিকল্পনায় বউ রাজি হওয়ার জন্য আমাকে নানান শর্ত জুড়ে দিবে এই ভয়ে। মাত্র এক বছরের সম্পর্ক আমাদের। খামাখা প্রেম করে সম্পর্কের বারোটা না বাজিয়ে বিয়ে করে ঘরে তুলে এনেছি। এখন বারোটা তেরোটা যাই বাজার ঘরেই বাজুক। দুইজনেই যেহেতু দু’জনকে পছন্দ করেছি তাই আর দেরি করিনি। একজন আরেকজনকে বিয়ের আগে বুঝার চেষ্টা করতে থাকলে জীবন পার হয়ে যেত। এতো বুঝাবুঝির মাঝে আমি নাই। এখন কেবল চিন্তা পরিকল্পনা বাস্তবায়ন নিয়ে। বাসর ঘরে ঢুকতে কেমন যেন নার্ভাস লাগছিলো। ভাবী আমার বুকে ফুঁ দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে “আল্লাহ্ ভরসা” বলে আরো এক কাঠি নার্ভাস করে ফিচকে হাসি দিয়ে চলে গেলো। এতোদিন প্রেম করে বিয়ে তাও কেমন যেন লাগছে।
“কি নার্ভাস লাগছে?”
বউয়ের মুখে এই কথা শুনে মনে হচ্ছিলো ধরণি দ্বিধা হয় না কেন। বউ, ভাবী আর আমার কথা শুনছিলো এতক্ষণ। বউকে বললাম, “প্রথমবার তো তাই একটু ইয়ে ইয়ে লাগছে। পরেরবার ঠিক হয়ে যাবে। চিন্তা করো না।”
“কি বললা তুমি?”
আর কথা না বাড়িয়ে বউয়ের পাশে বসলাম। পরিকল্পনা আজ রাতেই বাস্তবায়ন করতে হবে। এই বাসর রাতেই। অনেকক্ষণ পরে বউকে একটা সুন্দর প্যাকেট গিফট দিলাম। বউ তো দারুণ খুশি হয়ে গেল।
“কি আছে এখানে?”
“খুলেই দেখোনা।”
“না আগে তুমি বলো!”
বউ লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছে খুশিতে। গিফট দিয়ে এমন সারপ্রাইজ দিবো বউ কল্পনাও করতে পারেনি। হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করছে আর আমার দিকে তাকিয়ে হেসেই আবার চোখ নামিয়ে ফেলছে। খুলে দেখছেও না ভিতরে কি আছে। ও হয়তো চাইছিলো এই অনুভূতিটুকু আরো কিছুক্ষণ অনুভব করতে।
এতোদিন শুনে এসেছি বাসর রাতে নাকি জামাই বউ কুটুসকুটুসS করে কতোশত গল্প করে। এটা ওটা কত কিছু করে। আমি তো বুঝেই উঠতে পারছি না যে কি করবো। বউয়ের অবস্থাও হয়তো আমার মতোই। এতোবছর ধরে বাসর রাতের জন্য এতো প্রস্তুতি নিলাম। আর এখন দেখি বাসর রাতে প্রশ্ন কমন পরেনি অবস্থা। শেরোয়ানি পরে আছি। খুলবো নাকি গায়েই রেখে দিবো সেটাই বুঝতে পারছি না। আমার অস্বস্তি দেখে বউ গিফটটা নাড়াতে নাড়াতে বলল খুব আস্তে করে, “তোমার গরম লাগলে শেরোয়ানিটা খুলে ফেলো।”
এই না হলে বউ। ঠিক ঠিক মনের কথাটা ধরে ফেলেছে। বড় বাঁচা বেঁচে গেছি। এতোদিন সেই গানটাই গেয়েছি, “বিয়া করতে আমার শরম লাগে/ শেরোয়ানি পরতে আমার গরম লাগে।” আজ তো শরম-গরম দুইটা রাস্তাই পাড়ি দিয়ে দিলাম। শেরোয়ানি খুলতে খুলতে বউয়ের দিকে তাকাচ্ছিলাম। কি এক ঝিলিমিলি শাড়ি পরে আছে। মুখে মেকাপের কয়েক ধাপের আস্তর। সারা শরীরে গহনা। মনে হচ্ছিলো বউয়েরও হয়তো অস্বস্তি লাগছে।
“তোমার যদি গরম লাগে তো শাড়িটা খুলে ফেলো না।” মনের কথা এভাবে মুখ ফসকে বেরিয়ে যাবে বুঝতে পারিনি। বউ চোখ কটমট করে তাকিয়ে হাতের গিফটটা ঢিল ছোড়ার মতো করে ধরলো। আমি কিছু হয়নি এমন ভাব করে গুন গুন করে গান গাইতে গাইতে শেরোয়ানিটা কাবার্ডে রেখে দিলাম। বউ আরো ক্ষেপে গেল।
“কি সব পান দোকানদারদের গান গাও। ছি!”
“কে বলেছে পান দোকানদারদের গান। এই গানে কি পরিমাণ ফিলিংস আছে বুঝো তুমি।”
“থাক আমার বোঝা লাগবে না। কি ভাষা গানের। শুনলেই তো বমি আসে।”
“কি বলো এতো তাড়াতাড়ি বমি আসে কি করে। সেটা তো একটু দীর্ঘ মেয়াদি প্রসেস তাই না। আর তাছাড়া তোমাকে তো আমি এখনো…”
“দেখো একটাও বাজে কথা বলবেনা। কাঁচা খেয়ে ফেলবো একদম।”
“সে তো আজও খাবে কালও খাবে। বউরা তো জানি জামাইদের মাথা খেতে হেব্বি পছন্দ করে।”
“এবার কিন্তু সত্যি সত্যি আমি রেগে যাচ্ছি।”
গল্প উপন্যাস যদি হতো এই অবস্থায় হয়তো আমি অনেক আদর সোহাগ লারেলাপ্পা ভুজুংভাজুং কথা দিয়ে বউকে শান্ত করতাম। কিন্তু ঐ যে বললাম, বাসর রাতে প্রশ্ন কমন পরে নাই টাইপ অবস্থা আমার। বউয়ের পাশে বসে বললাম, “রাগারাগি তো সারাজীবন করতে পারবে। এখন প্যাকেটটা খুলে দেখো।”
বউ আমার গা ঘেঁষে বসলো। মেয়েরা এমনিতেই একটু আহ্লাদী হয়। নতুন বউ হলে মনে হয় একটু বেশি আহ্লাদী হয়ে ঢেউয়ের মতো জামাইয়ের গায়ের সাথেH ধাক্কা খায়। আবার এক হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরতে গেলেই এমন ভাবে তাকিয়ে সরে যায় যেন ভুল করে কাছে চলে আসছিলো। আর আমি যেন বাসের হেলপার, যে কিনা সুযোগ বুঝে গায়ে হাত দিয়েছি। ওর কাঁধে হাত রাখতেই এমন ভাবে পুরো বডিটা টার্ন করে সরে গেল; নিজেকে ইভ টিজার মনে হচ্ছিলো। যাক বাসর রাতে এতো ইগোফিগো ভাল কিছু না। বউয়ের হাতটা ধরে বললাম, “খুলেই দেখো না।”
বউ প্যাকেট খুলছে আর আমার বুকে দামামা বাজছে। জানিনা কি আছে কপালে। বউ প্যাকেট খুলে আমার দিকে এমন অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলো যে, মনে হয় সে অবাক হবে নাকি রাগ করবে নাকি চিৎকার করবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছেনা। “কি পছন্দ হয়নি তোমার?”
বউ এখনো কথা বলার ভাষা খুঁজে যাচ্ছে। ভাষা গলার কাছে এসে থেমে গেছে। ঠোঁট হালকা হালকা কাঁপছে কিন্তু কিছুই বের হচ্ছেনা মুখ দিয়ে। আমি আবার সেই গান গুন গুন করা শুরু করলাম, “সোনা বন্ধু তুই আমারে ভোঁতা দাও দিয়া কাইট্টালাও “প্লিজ তুমি থামবা। কি রুচি তোমার। অসহ্য একটা গান। আর এটা… এটা কি ধরনের গিফট?” “কেন পছন্দ হয় নাই তোমার?” বউ একটা মোবাইল হাতে নিলো। ভিতরে আরো একটা ছিল। সেটাও বের করলো। দুই হাতে দুইটা মোবাইল নিয়ে সে কি করবে বুঝতে পারলো না। “শোন, একটা তোমার জন্য। আরেকটা আমার জন্য।” “তাই বলে এই নোকিয়া ১২৮০ মডেলের মোবাইল। এইসব ক্ষেত মোবাইল তো এখন রিক্সাওয়ালারাও চালায় না। আর তুমি কিনা বউয়ের আরো কাছে ঘেঁষে বসলাম। ওর কাঁধে হাত রাখলাম। এবার সরে গেল না। আস্তে আস্তে সয়ে যাচ্ছে তাহলে। এটা একটা ভাল লক্ষণ।
“কেন তোমার কি একদমই পছন্দ হয় নাই?”
“মোটেও না। আমার আইফোন থাকার পরেও এই ক্ষেত মোবাইল কিছুতেই ইউস করবো না। কিছুতেই না।”
“একটু মাথাটা ঠাণ্ডা করে চিন্তা করে দেখো, এই নোকিয়ার বেসিক সেটও কিন্তু আইফোনের মতোই…”
“মানে কিসের সাথে কি তুলোনা করছো তুমি?”
“আহা শোন না প্লিজ। দেখো, আইফোনে ব্লুটুথ নেই। এটাতেও নাই। আইফোনে ম্যামরি কার্ড ঢুকানো যায় না। এটাতেও যায় নাA। আইফোনে সরাসরি গান ডাউনলোড করা যায় না। আর এটার তো প্রশ্নই আসেনা। আর তাছাড়া তফাৎ বলতে শুধু এটায় ক্যামেরাটাই নাই। সেদিক থেকে “প্লিজ থামবে তুমি। আমি এই সেট মরে গেলেও ইউস করবোনা। ব্যস।”
“আজ রাতে আমার সাথে এইভাবে ঝগড়া করবে তুমি? সারাজীবন পরে আছে ঝগড়া করার জন্য। বাসর রাত কিন্তু আর আসবে না। আজই তোমায় আমাদের এই নতুন জীবনে প্রথম কিছু গিফট করলাম। তুমি সেটা নিবেনা পুনা?” বউ দেখি এবার একটু শান্ত হলো। মোবাইল দুইটা এমনভাবে ধরে আছে। না পারছে হাতে রাখতে। না পারছে আছাড় দিয়ে ভাঙ্গতে। একটু নরমও হলো ওর গলার স্বর।
“কিন্তু তাই বলে এই সেট ইউস করতে হবে?”
“এর একটা কারণ আছে। সেটা তোমায় এখন বলবোনা। তুমিই হয়তো বুঝতে পারবে। কারণ তুমি বুদ্ধিমতী মেয়ে।”
“কিন্তু আমার ফ্রেন্ডরা কি বলবে। আর তাছাড়া…”
“কারো কথাই কানে নেওয়ার দরকার নাই। আজ থেকে তুমি আর আমি এই দুইটা নোকিয়া সেটই ইউস করবো।”
“কিন্তু ম্যাসেঞ্জারে, ইমোতে তো ভাল কথা বলা যায়। কথাও স্পষ্ট। খরচ নাই শুধু নেট বিল ছাড়া।”
“ঐসব কিছুই লাগবে না। দু’জনেই দু’জনের নাম্বার এফএনএফ করে নিবো।”
“কিন্তু ফেইসবুক? ফেইসবুক কি করে ইউস করবো?”
“সেটা আপাতত আমরা সপ্তাহে একদিন ইউস করবো। তোমার আর আমার আগের ফোন তো আর ফেলে দিচ্ছিনা। ওগুলো আছে। সপ্তাহে একদিন আমরা ব্যবহার করবো। জানি একটু কষ্ট হবে আমাদের। আমরা অভ্যস্ত হয়ে গেছি। আমি লিখালিখিই করি মোবাইলে। ফেইসবুকে পোস্ট করি। আমার জন্যও অনেক সমস্যা হবে।” “কিন্তু আমি সময় কাটাবো কি করে সারাদিন। চাকরি বাকরি করার ইচ্ছে নাই আপাতত। বলো, আমার সময় কাটবে কি করে সারাদিন বাসায়?”
“চাকরি করার ইচ্ছে না থাকলেও ঢুকে যাও কোথাও। সময় কেটে যাবে।”
“জি না। আমি এখন চাকরি করবোনা। শোন, আমার তাহলে একটা শর্ত আছে। যদি শর্তটা রাখো তাহলেই তোমার এই ক্ষেত মোবাইল ইউস করতে পারি।”
মনে মনে এই ভয়টাই পাচ্ছিলাম। কি শর্ত দেয় কিছুই জানিনা।
“ম্যাডাম আগে তো আপনার কি শর্ত তা শুনি?”
“জি না স্যার। সেটা হবেনা। আগেই রাজি হতে হবে। বলো রাজি কিনা?” দশটা না পাঁচটা না একটা মাত্র বউ আমার। সারাজীবন এক সাথেই থাকবো। যেই শর্তই দিকK আমার সাধ্যমতো সেটা রাখার চেষ্টা করবো। আরো কাছে টানলাম ওকে।
“বলো কি শর্ত?”
পুনা হাত থেকে মোবাইল দুটো পাশে রেখে আমার মুখোমুখি বসলো। দুই হাত দিয়ে আমার হাত দুইটা ধরলো। কিন্তু একবারও তাকাচ্ছেনা আমার চোখে চোখ রেখে। এই লাজুক লাজুক, লাজুকলতা বউকে এখন অনেক স্নিগ্ধ লাগছে। লজ্জাটাও মেয়েদের সৌন্দর্য্যের একটা অংশ। অনেক কোমল লাগে।
“একটাই শর্ত। এমন কোন শর্ত দিবোনা যেটা রাখা তোমার জন্য খুব একটা সমস্যার হবে।”
“বলো পুনা।”
“আমাকে প্রতিমাসে ২৫ টা বই কিনে দিতে হবে। আমার পছন্দ মতো। যেই যেই বইয়ের কথা বলবো ঠিক সেই বই। একটা কম হলেও চলবেনা। দিবে তো!”
বউয়ের শর্ত শুনে একটা জোরে লাফ মারতে ইচ্ছে করছিলো। আমিও সারাজীবন চেয়েছি এমন মেয়েই বউ হয়ে আসুক যে প্রচুর বই পড়ে। আমি জানতাম ও বই পড়ে। কিন্তু ও যে এমন বইয়ের পোকা তা জানতাম না। কি যে ঘোড়ারডিমের প্রেম করলাম এক বছর কে জানে!
অনেক আগে থেকেই ইচ্ছে ছিল বউকে একটা লাইব্রেরি দিবো। সেটার জন্য বইও কিনা শুরু করে দিয়েছিলাম। প্রায় সাড়ে এগারো’শ বই জোগার করে ফেলেছি সেই লাইব্রেরীর জন্য। আমাদের শোবার ঘরের পাশেই ছোট একটা রিডিং রুম বানিয়েছি। একপাশে ছোট ফ্লোর বেড। জানালার পাশে ডিভান। আর তিনপাশে বইয়ের তাক। যার প্রায় অনেকটাই খালি। যেই তাকে বই দেওয়া আছে সেই তাক গুলো কাপড় দিয়ে ঢেকে রেখেছি।
বউকে জড়িয়ে ধরলাম। ভয় হচ্ছিলো মনে মনে। আবার না আমাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে বলে, “ছিঃ তোর মা বোন নেই।” কিন্তু না। বউ যেন আরো গভীর করে আমার বুকের ভিতরে ডুবে যাচ্ছে। কানের কাছে ফিসফিস করে বললাম, “তোমার শর্তে আমি রাজি আছি পুনা।” পুনাও আমায় আঁকড়ে ধরলো। আমার চেয়েও আরো আস্তে করে কাঁপাকাঁপা গলায় বলল, “সত্যি।” “হ্যাঁ সত্যি! তোমার জন্য আরেকটা গিফট আছে।” পুনা এবার খিলখিল করে হেসে উঠলো। আমার কাছ থেকে সরে গিয়ে একটা মোবাইল হাতে নিয়ে বলল, “আর যদি কোন উল্টাপাল্টা গিফট দাও তো এই মোবাইল তোমার মাথায় ভাঙ্গবো।” পুনার হাত ধরে ওকে বিছানা থেকে নামালাম। মিটমিট করে ও তখনো হাসছিলো। রিডিং রুমের সামনে গিয়ে বললাম, “চোখ বন্ধ করোনা প্লিজ।”
“জি না। তোমার ভরসা নাই। যা পাঁজি তুমি।
“আহা করো না প্লিজ।” I
“আচ্ছা বাবা করলাম।”
বউ চোখ বন্ধ করতেই রিডিং রুমের দরজা খুলে লাইট জ্বালালাম। ও এখনো চোখ বন্ধ করে আছে। আর মিটিমিটি হাসছে। বুক সেলফের সামনে বউকে দাঁড় করিয়ে বউয়ের পিছনে দাঁড়ালাম। বউকে বললাম, “চোখ খুলো এবার।”
“সত্যি খুলবো?”
“হ্যাঁ খুলো পুনা।”
“আমায় একটু ধরে রাখোনা প্লিজ।” পিছন থেকে বউকে জড়িয়ে ধরলাম। ও চোখ খুলে তাকিয়েই বলল, “এটা কি?” বললাম, “কাপড়টা ধরে টান দাও আস্তে আস্তে, তাহলেই দেখতে পাবে।” ও কাপড় ধরে হালকা টান দিতেই পুরো বুক সেলফ থেকে কাপড় সরে গেল। এতো গুলো বই দেখে ও আমার দিকে অবাক হয়ে ফিরে তাকালো। “এই সব বই তোমার। অনেক আগে থেকেই একটু একটু করে জমাচ্ছিলাম বই। তোমায় দিবো বলে। বাকি অনেক গুলো তাক খালি আছে। দেখো সেই তাক গুলোও বই দিয়ে সাজিয়ে দিবো।”
বউ আমাকে এই প্রথম নিজে থেকে জড়িয়ে ধরলো। আমার বুকে ওর মাথাটা রেখে শক্ত করে ধরে আছে। আমার সারা শরীরে কি যে এক শিহরণ বয়ে গেলো! মানুষ যখন সুখী হতে শুরু করে তখন মনে হয় সবকিছুতেই সে সুখ খুঁজে পায়। নিজেকেও এই মুহূর্তে দুনিয়ার সবচেয়ে সুখি মানুষ মনে হচ্ছে। দুনিয়ার সেরা সুখ যে এখন আমার বুকে।
ওকে পুরো রিডিং রুমটা দেখালাম। ফ্লোরে ছোট্ট বিছানাটা ওর মনে হয় খুব পছন্দ হয়েছে। পাশেই ডিভান। জানালার পাশে ডিভানে হেলান দিয়ে শুয়ে থাকলে আকাশ দেখা যায়। রিডিং রুমের চারদিকে চারটা স্পিকার রেখেছি। আর একটা এমপিথ্রি প্লেয়ার। কোন গান নেই। শুধু ইন্সট্রুমেন্টালL। চালিয়ে দিলাম এমপিথ্রি। শুরুতেই আমার প্রিয় ইন্সট্রুমেন্টাল- দ্য লোনলি শেপার্ডা। হালকা মিউজিকে ভরে গেল পুরো ঘর। পুনা বুক সেলফের সামনে বই গুলোর উপরে হাত বুলাচ্ছে। “সব তো একেবারেই নতুন মনে হচ্ছে।” “নতুন বলতে কি। আসলে অনেক দিন থেকেই বই গুলো জমাচ্ছি। কিছু একটু পুরনোই হয়ে গেছে। তবে একটা বইও কেউ পড়েনি। সেই হিসাবে নতুন।”
“কিন্তু তাই বলে এটা ভেবো না যে প্রতিমাসে আমাকে বই কিনে দিতে হবেনা। গুনে গুনে ঠিক ২৫ টা বই প্রতিমাসেই আমার চাই।” “মানে একটু কি ছাড় দেওয়া যায়না পুনা। এই ধরো মাসে যদি দশ বারোটা…” “একেবারে কাঁচা খেয়ে ফেলবো তোমায়।”
“আরে ধুর। এমনি ফাজলামো করছিলাম। ২৫ টাই দিবো তো।”
পুনা গিয়ে বিছানায় বসলো। পাশাপাশি দুইটা বালিশ দেখে বলল, “শোনো এই রুমের আশা ছেড়ে দাও। আজ থেকে এটা আমার রুম। তোমার প্রবেশ অধিকার নিষিদ্ধ।” বলেই খিল খিল করে হাসা শুরু করে দিলো। আমিও হাসতে হাসতে ওর পাশে গিয়ে বসে ওকে জড়িয়ে ধরে বললাম, “তুমি আমার জন্য নিষিদ্ধ না হলেই হয়। আর সারা দুনিয়া নিষিদ্ধ হলেও আমার কিছুই যায় আসেনা।”
“ইসসস খুব বাহাদুর! এতো ঢংয়ের কথা কি করে বলো তুমি? কোন মেয়েদেরR কাছ থেকে ঢং শিখছো হ্যাঁ! আজ থেকে যদি কোন মেয়ের সাথে লটরপটর করতে দেখি তোমায় একেবারে ঠ্যাং ভেঙ্গে দেবো।”
“আরে ধুর কি যে বলো এইসব। মেয়েদের সাথে তো আমি কথাই বলতে পারিনা। আমার খুব নার্ভাস লাগে। একটু আগেই দেখলে না, বাসর ঘরে বউয়ের সামনেও নার্ভাস হয়ে গেছি।” “থাক আর বলতে হবেনা। আপনার সম্পর্কে ভালোই জানা আছে আমার।” হঠাৎ করেই বেড সুইচ অফ করে দিলাম আমি। পুনা আমায় জড়িয়ে ধরে বললো, “এই কি হলো?” বললাম, “একটু ওয়েট করো।”
বিছানার মাথার কাছে মোমবাতি জ্বালালাম। পাঁচটা মোমবাতি। বউ একটু অবাক হয়ে তাকালো আমার দিকে। কিছু বললো না। মোমবাতির লালচে আলোয় ওকে আরো অপরূপা লাগছিলো। আমি বিছানায় পিঠের নিচে বালিশ নিয়ে হেলান দিয়ে বসলাম। একটা হাত ধরে বউকে কাছে টানলাম। Oও চুপটি করে আমার বুকে মাথা রেখে আমায় জড়িয়ে ধরলো। ওর মাথায় হাত রেখে আরেকটা হাত দিয়ে ওর একটা হাত ধরলাম।
আঙুলের ফাঁকেফাঁকে আঙুল ঘুরে বেড়াচ্ছে। কেউ একটা কথাও বলছিনা। মৃদু ইন্সট্রুমেন্টালের মাঝে দু’জনের নিঃশ্বাসের শব্দ। ও আমার হাতটা কাছে টেনে হাতের উপরে আলতো চুমু দিলো। সময় গড়াচ্ছে। ঘড়ির কাঁটার টিক টিক শব্দের সাথে বুকে হৃৎপিণ্ডের পেন্ডুলাম দুলছে। ওর ঠোঁটের উপরে আঙুল ছোঁয়াতেই আলতো করে কামড় দিলো। হাত সরিয়ে ফেললাম। আবার ঠোঁটের কাছে আঙুল নিতেই ও কামড় দেওয়ার আগেই হাত সরালাম। কামড় দিতে না পেরে আমার হাত জোড় করে টেনে নিয়ে কামড় দিয়ে ফিচকে হাসি দিলো। রাক্ষসী বউ একটা।
একটা খুব মন খারাপ করা সুর ভাসছে রুমের চারদিকের স্পিকারে। কবিতার জন্য দারুণ আবহ। মন খারাপ করা সুর। মোমবাতির লালচে রোমান্টিক আলো। বুকের কাছে বউ। আবৃত্তি শুরু করলাম। “রেল গাড়ির কামড়ায় হঠাৎ দেখা। ভাবিনি সম্ভব হবে কোনদিন। আগে ওকে বারবার দেখেছি লাল রঙ্গের শাড়িতে ডালিম ফুলের মতো রাঙ্গা; আজ পরেছে কালো রেশমের কাপড় আঁচল তুলেছে মাথায় দোলন চাঁপার মতো চিকন গৌর মুখ খানি ঘিরে। মনে হলো, কালো রঙ্গে একটা গভীর দূরত্ব ঘনিয়ে নিয়েছে নিজের চার দিকে, যে দূরত্ব সর্ষে ক্ষেতের শেষ সীমানায় শালবনের নীলাঞ্জনে থমকে গেল আমার সমস্ত মনটা চেনা লোককে দেখলেম অচেনা গাম্ভীর্যে”
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “হঠাৎ দেখা” কবিতাটা পড়ার সময় পুনা একেবারে চুপচাপ আমার বুকে কান পেতে শুনলো। আর একটু পরে পরে আমায় আঁকড়ে ধরলো। আরো অনেক কবিতা ওকে শুনিয়েছি। ওর অনুরোধে আমার লিখা “ইচ্ছে” কবিতাটাও শোনালাম। “আমার খুব ইচ্ছে করে কারো প্রতীক্ষার প্রহর হতে কাকচক্ষু জলের মতো কারো চোখে তীব্র অনুভূতির টলটলা অশ্রুর কারণ হতে ভালবেসে যে আমায় প্রার্থনা করবে ঈশ্বরের দুয়ারে ইচ্ছে করে কারো চুলের সিঁথির ভাঁজে সিঁদুর পরা আশীর্বাদের দাবিদার হতে কবিতাটা আবৃত্তি করার সময় পুনা পাঞ্জাবি খামচি দিয়ে ধরেছিলো আমার বুকের কাছে ।
“তোমাকে বোঝাতে পারবো না এই কবিতাটা আমার কত প্রিয়। বিশ্বাস করবে, প্রথম যেদিন কবিতাটা পড়ি সেদিন তোমায় আশীর্বাদে সিঁথিতে রেখেছিলাম। আমার কাছে তো সিঁদুর ছিল না। লাল রঙের লিপস্টিক দিয়ে সিঁদুর এঁকেছিলাম।” “কি বলো পুনা! আমাকে বলোনি কেন এতোদিনN?” “লজ্জা লাগে নাবুঝি আমার। তখন তো তোমার সাথে আমার কোন কিছুই ছিল না। এক সামান্য পাঠিকা ছিলাম তোমার গল্প-কবিতার। যখন বিয়ের সব ঠিক হলো তখনই ঠিক করে রেখেছিলাম বাসর রাতেই কবিতাটা শুনবো তোমার কাছ থেকে।”
“তখন থেকেই ভালবাসতে আমায়?”
“উঁহু তারও আগে থেকে।”
“কখন থেকে?”
“ইসসস! সব কেনো শুনতে হবে তোমায়! বলবো না পচা।” কি করে যেন খুব দ্রুত ফুরিয়ে গেল রাতটা। কথায় কথায় এতো সুন্দর সময়ের মাঝে টুক করে ঘুমিয়ে পরলো পুনা। অনেক ক্লান্ত ছিলো ও। ভোরের স্নিগ্ধ আলোয় বউয়ের ঘুমন্ত নিষ্পাপ মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম অনেকক্ষণ। কপালে পরেছিলো চূর্ণ চুল। কানের পাশে গুঁজে দিলাম। বউ এক হাত দিয়ে আমার পাঞ্জাবির বুকের কাছে মুঠো করে ধরে আছে। এই মুঠো ছাড়াবার সাধ্য আমার নেই। কোন স্বামীরই বোধহয় থাকে না। থাকতে নেই।
মোমবাতি গলে গলে বিলিন হয়ে নিভে গেছে। যেন মাথার কাছে সারা রাত পাঁচটা চাঁদ জ্বলে জ্বলে আমাদের লালচে জোছনা বিলিয়েছে। সেই গলে যাওয়া জোছনা মোমদানিতে কি এক ঐশ্বর্য নিয়ে পরে আছে। এই গলে যাওয়া জোছনার মতো মোমদানি রেখে দিয়েছি এক পাশ করে। ঘুম থেকে উঠে অন্য কোথাও তুলে রাখবো। মোমদানিটা সারাজীবন থেকে যাক আজকের রাতের স্মৃতি হয়ে। Y
কত ভরসা নিয়ে কত নির্ভরতায় বউ আমার বুকের কাছে ঘুমুচ্ছে। ওকে আরো কাছে টেনে নিলাম। ওর চুলের গন্ধে কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছি। আমি ভোর পছন্দ করি না। সূর্যের আলো আমার সহ্য হয় না। কিন্তু কি আশ্চর্য!জীবনে এই প্রথম ভোরটাকে এতো পবিত্র; এতো অপরূপ লাগলো। পাখীর ডাক। জানালা গলে আসা ফুরফুরে বাতাস। সবই যেন খুবই প্রাণবন্ত। যার বুকের কাছে এমন একটা স্বর্গ ঘুমায় তার কাছে দুনিয়াটাই একটা স্বর্গ হয়ে যায়। পুনা ওর অজান্তেই আমায় একটা স্বর্গ এনে দিলো। ওর কপালে আলতো চুমু দিয়ে চুলের গন্ধে আমিও যে কখন ঘুমিয়ে পরলাম জানি না।