বাদামওয়ালা ছেলেটা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। তার এই বারো বছর বয়সে অনেক অদ্ভুত দৃশ্য দেখেছে কিন্তু এমনটা দেখেনি কখনো। পার্কের এক কোণায় বসে রাশেদ বাদামের খোসা ছাড়িয়ে ছাড়িয়ে আলাদা করে রাখছে কিন্তু একটা বাদামও মুখে দিচ্ছে না। এই দৃশ্যের মধ্যে কোন বিশেষত্ব নেই, কিন্তু বাদামওয়ালা ছেলেটা হা করে তাকিয়ে আছে।
-তোমার নাম কী?
-জ্বি, আমার নাম রাজু।
-থাকো কোথায়?
-মোহাম্মদপুর।
-বাদাম বেচে কত পাও?
-দুইশ থেকে আড়াইশ। রাজু আরও বেশি অবাক হচ্ছে কারণ তাকে কেউ তুমি করে বলে না। সবাই তুই তুই করে বলে।
-স্যার, টাকা দেন, চইলা যামু।
-কত টাকা হয়েছে?
-তিন প্যাকেট, পনেরো টাকা।
-আরেক প্যাকেট দাও। আর তুমি এখানে থাক।
-আচ্ছা।
রাজু বুঝতে পারছে না যে সে এখানে থেকে কী করবে। তারপরও বসে রইল। আর রাশেদ একমনে বাদামের খোসা ছাড়াতে লাগল। রিকশা থেকে নেমে মৌরী হাটতে লাগল। পার্কের মধ্যে রিকশা যায় না। মৌরীর হাটতে কষ্ট হচ্ছে কারণ সে হাই হিল পরেছে। যদিও সে যথেষ্ট লম্বা তবুও কেন জানি সে নিজেকে খাটো মনে করে। আজ প্রথম সে রাশেদের সাথে দেখা করবে। এর আগে তার সাথে ফোনে কথা বলত। তাদের পরিচয় মূলত ফেসবুকে। ফেসবুকের পরিচয়ে প্রেমের উপর ভরসা করা নিছক বোকামি কিন্তু মৌরীর মনে হচ্ছে এটা তার ভুল হয়নি বরং একটা সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে।
পায়ে শাড়ি জড়িয়ে যাচ্ছে। ইচ্ছে করছে গ্রামের মাতব্বরদের মত লুঙ্গির মত করে শাড়ি উঁচু করে ধরে হাটতে। এইসব অদ্ভুত চিন্তাভাবনা মৌরীর মাথায় প্রায়ই আসে। কিন্তু তা করা হয় না কখনো। কিছুদূর যেতেই হোচট খেয়ে মৌরীর হাই হিলের একপাটি ভেঙে গেল। এইমুহূর্তে নিজেকে খুব অসহায় মনে হচ্ছে কারণ পার্কে অনেক কাপল তার দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। এই হতভম্ব ভাব কাটানোর একটা উপায় সে রাশেদের কাছ থেকে শিখেছিল। এটা এখন করা যেতে পারে। কিন্তু তা সে না করে স্যান্ডেল জোড়া খুলে খালি পায়ে হাটতে শুরু করল। রাশেদকে এখনো ফোন দেয়নি সে। ফোন না দিয়ে খুঁজে পেতে অবশ্য খুব একটা কষ্ট হবে না। কারণ সে বলেছিল যে লেকের পাড়ে থাকবে।
মৌরী লেকের দিকে হাটা শুরু করল। কিছুদূর গিয়ে দেখল সামনের একটা বেঞ্চে কেউ বসে আছে আর একটা ছোট ছেলে তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। মৌরীর বুঝতে অসুবিধা হল না যে এটাই রাশেদ। সে চুপিচুপি পিছনে এসে দাঁড়াল। রাজু একবার মৌরীর দিকে তাকাতেই ইশারায় তাকে বলতে নিষেধ করল। রাশেদ মুখ না তুলেই বলল, এমনিতেই সাতাশ মিনিট লেট। কোথায় তুমি এসে সরি বলবে তা না করে লুকোচুরি খেলছ। সামনে আস আর এই ছেলেটাকে ত্রিশ টাকা দাও। মৌরী সামনে এসে বলল, তুমি কিভাবে বুঝলে যে আমি এসেছি?
-সবকিছু কি এখনই বলতে হবে? আগে একে বিদায় দাও তারপর সব বলছি।
মৌরী তার পার্স থেকে ত্রিশ টাকা দিলে রাজু বলল, ত্রিশ টাকা না, বিশ টাকা দেন। রাজু বলল, তুমি আমাকে সময় দিয়েছ। তাই তোমাকে দশটাকা বেশি দিচ্ছি। সময় অনেক মূল্যবান হলেও টাকা দিয়ে তা মূল্যায়ন করা যায় না।
-এই তুমি থাম তো। তোমার এত জ্ঞানকথা এ বুঝবে না।
মৌরী টাকা দিয়ে রাজুকে বিদায় দিল। সে “এই বাদাম আছে, বাদাম” বলতে বলতে চলে গেল। এতক্ষণে রাশেদ খেয়াল করল যে মৌরীর স্যান্ডেল তার পায়ে নেই, হাতে করে রেখেছে। সে মৌরীর কাছ থেকে স্যান্ডেল নিয়ে বাকি পাটি থেকে হিলটা ভেঙে দিল।
-এসব কী? তুমি হিল ভেঙে দিলে কেন?
-আচ্ছা, তুমি যা নও, তা কেন দেখাতে যাও?
-মানে?
-তুমি লম্বা নও, কেন এই হাই হিল পরে নিজেকে লম্বা দেখাও?
মৌরী মন খারাপ করল। তখন রাশেদ বলল, আরে আমি মজা করছি। মন খারাপ করার কিছু নেই। কিছুক্ষণ পর মুচি খুঁজে তোমার স্যান্ডেল ঠিক করা যাবে। এখন বস, বাদাম খাও। দেখ, বাদামের খোসা ছাড়িয়ে রেখেছি।
-খোসা ছাড়ানো বাদাম খেতে ভাল লাগে না।
-ঠিক, কিন্তু বর্তমানে সবাই বিশেষ করে আধুনিক মেয়েরা খোসা ছাড়ানো বাদামের মত।
-ওহ আচ্ছা, আমিও কি তাই?
-না। তুমি সেরকম হলে তো আর আমি এখানে থাকতাম না। বাদাম মুখে দিয়ে মৌরী জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা তুমি কিভাবে বুঝলে যে আমি এসেছি?
-তোমারই তো আসার কথা ছিল। নাকি অন্য কেউ এলে খুশি হতে?
-উঁহু, তা নয়। হতে পারে না যে অন্য কেউ যেমন তোমার কোন পরিচিত বা পরিচিতা, তোমাকে দেখে এগিয়ে এল দেখতে যে তুমি কী করছ।
-তা হতে পারে।
-কিন্তু তুমি কিভাবে বুঝলে?
-ফুলের গন্ধে?
-মানে?
-মৌরী ফুলের গন্ধ পেয়ে বুঝেছি।
-প্লিজ বল না।
-তোমার শরীরের ঘ্রাণ পেয়ে বুঝেছি।
-তুমি আমার শরীরের ঘ্রাণ আগে কখনো পাওনি। তাহলে?
-আচ্ছা, তুমি কি CID? সেই কখন থেকে জেরা করা শুরু করছ। সবকিছুর ব্যাখ্যা জানতে হয় না, তাহলে কৌতূহলের আনন্দ শেষ হয়ে যায়।
-আচ্ছা, বুঝলাম। এখন কি এই পার্কে বসে থাকবে? আমার এই যায়গাটা ভাল লাগছে না।
-কেন?
-আরে ওদিকে তাকিয়ে দেখ, সব কপোত-কপোতী কিভাবে গাঘেঁষে বসে আছে। দেখলেই আমার গা ঘিনঘিন করছে।
-ওদের কাছে ওটাই প্রেম।
-তুমি তো একবারও বললে না যে আমাকে কেমন লাগছে?
-এই মুহূর্তে বাংলা কোন কবিতা মনে পড়ছে না। একটা হিন্দি শের মনে পড়ছে কিন্তু পহেলা বৈশাখে হিন্দি শের বলাটা কি ঠিক হবে?
-তুমি নিজের মত বল। তুমি একটা কবিতা বলতে পার।
-আমার কবিতা দিয়ে তোমার উপমা দিতে পারব না। তারচেয়ে হিন্দিটাই বলি। “হুসন কো চান্দ জাওয়ানি কো কামাল কেহতে হে, দেখ কার হাম তুজে একশ গাজাল কেহতে হে উফ ইয়ে সাঙে মারমার সা তারাসা হুয়া শাফাফ বাদান, দেখনেওয়ালে তুজে তাজমাহাল কেহতে হে।”
-বাহবা। তবে বাংলা একটা কবিতা শোনালে আরও খুশি হতাম।
-আচ্ছা, শোনানো যাবে। চল, উঠি। এই জায়গাটা আমারও ভাল লাগছে না। তার আগে তোমার স্যান্ডেল ঠিক করাতে হবে।
-না, থাক। তুমি বরং খালি পায়ে হাট।
-ঠিক আছে।
রাশেদ আর মৌরী পাশাপাশি হাটছে খালি পায়ে। পার্ক থেকে বের হয়ে তারা একটা রিকশা একঘণ্টার চুক্তিতে ভাড়া করল। আজ রাস্তায় গাড়ি কম হওয়ায় পরিবেশটা অন্যরকম লাগছে। রিকশা খুবই মন্থর গতিতে চলছে। এটাই ভাল কারণ এদের কোন তাড়া নেই। রাশেদ তার বাম হাতটা মৌরীর পিঠের উপর দিতে গিয়ে আবার ফিরিয়ে নিল। মৌরী বুঝতে পেরে মিটিমিটি হাসছে।
-হাসো কেন?
-তোমার ভাব দেখে।
-কী করব বল। রিকশাটা একটু ছোট, তাই হাত সামনে রাখতে পারছি না।
মৌরী এবার শব্দ করে হেসে উঠল। মেয়েদের সব হাসিতেই একেক ধরনের সৌন্দর্য আছে। মুচকি হাসি সুন্দর লাগে আবার অট্টহাসিও সুন্দর লাগে। তবে দুই সৌন্দর্যের মধ্যে পার্থক্য আছে। হাসি থামিয়ে মৌরী রাশেদের হাতটা নিজেই নিজের কাঁধের উপর রাখল। মৌরীর চুল থেকে সত্যিই মৌরী ফুলের ঘ্রাণ আসছে। কেমন যেন মাতাল মাতাল ভাব। হুড ফেলে দিতে বলল মৌরী। হুড থাকায় কেমন যেন খুপরি ঘরের মত লাগে। হুড ফেলে দেওয়ায় মৃদু বাতাসে মৌরীর চুল উড়ে রাশেদের মুখে এসে পড়ছে। এরকম সুন্দর মুহূর্ত রাশেদের জীবনে আসেনি। একঘণ্টা সময় কিভাবে কেটে গেল বুঝতে পারল না। রিকশা থেকে নেমে তারা একটা রেস্টুরেন্টে খেতে গেল। রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে তারা হাটতে লাগল। মৌরীর পা ব্যথা করছে। রাশেদ বলল, আমি তাহলে তোমাকে কোলে করে নিয়ে হাটি?
-তোমার মাথা খারাপ?
-মাথা ঠিক আছে। হাটি না, প্লিজ?
-উঁহু, শখ কত?
তারা টিএসসিতে এসে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বসল। কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে মৌরী বলল, আচ্ছা তুমি আমাকে কতটা ভালবাস?
-তোমাদের বিজ্ঞান তাপমাত্রা মাপার জন্য থার্মোমিটার আবিষ্কার করেছে। অনেক কিছু পরিমাপ করার জন্য বিভিন্ন যন্ত্র আবিষ্কার করেছে। কিন্তু ভালবাসা পরিমাপ করার কোন যন্ত্র আবিষ্কার করে নাই।
-কেন করে নাই?
-দুইটা কারণ হতে পারে। প্রথম কারণ, বিজ্ঞানীদের কাছে ভালবাসা বলে কিছু নেই। তাই তারা এটা আবিষ্কার করে নাই। আর দ্বিতীয় কারণ, ভালবাসা পরিমাপ করার জন্য সামান্য এক যন্ত্র যথেষ্ট না।
-তুমি কি সারাদিন এইসব নিয়ে ভাব? লজিক ছাড়া কি আর কিছু নেই তোমার মাথায়?
-আছে।
-কী?
-তুমি। এবার একটা কথা বল, তুমি কি আমাকে ভালবাস?
-তোমার কি মনে হয়?
-আমার মনে হয় তুমি আমাকে খুব বেশি, আমার চেয়ে বেশি ভালবাস। কিন্তু কখনো বললে না তো, তাই…
-তোমাকে যদি ভাল নাই বাসতাম, তাহলে কি আজ তোমার সাথে দেখা করতে আসতাম? আর শুধু মুখে বললেই ভালবাসা হয়?
-তা, ঠিক। তুমি তো আমার মতই যুক্তির উপর নির্ভর করে কথা বল।
-তোমার সাথে এতদিন কথা বলছি, তাই তোমার এই বৈশিষ্ট্যটা আয়ত্ত করে ফেলেছি। আচ্ছা, তুমি কি জান, আমি তোমাকে নিয়ে কী স্বপ্ন দেখি?
-জানি, তবে তোমার মুখ থেকে শুনতে চাই।
-আমি স্বপ্ন দেখি, আমাদের ছোট্ট একটা দোতলা বাড়ি হবে। গ্রামের দিকে কারণ শহরের কোলাহল আমার ভাল লাগে না। তুমি আমি সেখানে থাকব। প্রতিটা জোসনাকে উপভোগ করব ছাদে গিয়ে, পা ঝুলিয়ে তোমার হাত ধরে আর তোমার কাঁধে মাথা রেখে বসে থাকব।
-আমার একটা স্বপ্ন আছে।
-কী সেটা?
-আমার চার সন্তানের জননী তুমিই হবে।
-যাহ, দুষ্টু। তুমি না…
-আমি কী?
-বল না, প্লিজ। তোমার স্বপ্নটা কী?
-আমার একটাই স্বপ্ন আর তা হল, তোমার স্বপ্নগুলো পুরণ করা। এই, তোমার একটা কথা রাখার কথা ছিল রাখবে?
-হুম।
মৌরী গান ধরল, “তোমার খোলা হাওয়া লাগিয়ে পালে টুকরো করে কাছি , আমি ডুবতে রাজি আছি আমি ডুবতে রাজি আছি । তোমার খোলা হাওয় লাগিয়ে পালে তোমার খোলা হাওয়া । সকাল আমার গেল মিছে, বিকেল যে যায় তারি পিছে গো সূর্যের আলো লাল হতে শুরু করেছে। মৌরী চলে যাবে। রাশেদ বলল, যদি অনুমতি দাও তাহলে একটা কাজ করব।
-কী কাজ?
-তোমার গালে….
মৌরী কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না। সে কেঁপে কেঁপে উঠছে। রাশেদ তার দুহাত দিয়ে মৌরীর গালটা ধরল। মৌরী চোখ বন্ধ রাশেদকে জড়িয়ে ধরল। এই ভালবাসা উপেক্ষা করার ক্ষমতা রাশেদের নেই। সেও মৌরীকে জড়িয়ে ধরল।মৌরীকে এগিয়ে দিবে রাশেদ। হঠাৎ থেমে রাশেদ বলল, একটা কাজ বাকি রয়ে গেল।
-কী?
-তোমার গানের বিষয়ে কিছু বলি নাই তো,
মৌরী হাসল। রাশেদ রাস্তার পাশ থেকে কি একটা বুনোফুল নিয়ে মৌরীর চুলে পরিয়ে দিল। মৌরী আবেগে আপ্লুত হয়ে গেল। এত ভাল লাগা তার জীবনে কখনো আসেনি। তার চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরছে। এটা ভালবাসার কান্না, সুখের অশ্রু। সে জানে রাশেদ এখন কী করবে। রাশেদ আদর করে তার চোখের জল মুছে দিবে। রাশেদ তাই করল। মৌরীর চোখের জল আদর করে মুছে দিল।