রিহানের আম্মুর আহ্লাদ দিন দিন বেড়েই চলেছে। ছেলে বড় হচ্ছে কোথায় সে সংযমী হবে, তা না সে আহ্লাদের ডিব্বা খুলে বসেছে। সারাদিন অফিস করে বাসায় এসেছি ফ্রেশ হয়ে ভাত খাবো কিন্তু সে ঢং শুরু করেছে। ক্যান্ডেল লাইট ডিনার নাকি করবে! আচ্ছা এসব করার বয়স এখন আছে ?তাছাড়া রিহান বাসায় নেই, নানু বাড়ি বেড়াতে গেছে। রিহানকে ছাড়া এই ডিনার আমার গলা দিয়ে নামবে ? রিহানের আম্মু বলে মোমবাত্তি ডিনার নাকি শুধুদুজনেই করতে হয়। মোমবাত্তি জ্বলিয়ে ফষ্টিনষ্টি করার বয়স কি এখনো আছে ? মানুষ জানলে বলবে কি? ধুর রিহানের আম্মুর কাজকর্ম কিছুই ভাল্লাগে না। আধঘন্টা ধরে নিজে সাজুগুজু করেছে এখন আমাকেও বলে ফিটফাট হয়ে আসতে। কী লজ্জার ব্যাপার বলেন তো ?
কালো শাড়িতে রিহানের আম্মুকে প্রিয়াঙ্কা ত্রিদেবীর মতো লাগছে। কপালে টিপ, খোঁপায় সতেজ রজনীগন্ধা, এটা আমার বউ বিশ্বাসই হচ্ছে না। মনে হচ্ছে সদ্য যৌবনে পদার্পণ করা কোনো কিশোরী, যে রূপের ডালি সাজিয়ে সর্বনাশের অপেক্ষা করছে। আমিও একটা সিল্কের পাঞ্জাবি পরে টেবিলে বসে গেলাম। টেবিল ভর্তি না না পদের খাবার। চিকেন, বিফ, ভেজিটেবল এগ রাইস, লাচ্চি, কুলপি ফালুদা এতোসব কখন করলো! কাজের চাপে ভুলেই গেছিলাম আমারও একটা লক্ষ্মী বউ আছে। রিহানের আম্মুকে ধন্যবাদ দিতেই হয়। আমি বিলাতি কায়দায় হাঁটু গেড়ে বসে রিহানের আম্মুর হাতে চুমু খেয়ে বললাম,
– শত জনমের পুণ্যে তোমাকে পেয়েছি।
জীবন আমার ধন্য হলো প্রিয়া। রিহানের আম্মু তৃপ্ত নয়নে আমার দিকে তাকালো। আহা কতোদিন পর সেই চিরচেনা প্রেমময় দৃষ্টি। তাঁর চোখেও যে প্রেম আছে ভুলেই গেছিলাম। রিহানের আম্মু আমার ঊরুতে বসে মাথাটা বুকের কাছে টেনে নিল। আমি কান পেতে তার হার্টবিট শুনছি। প্রতিটা স্পন্দনে একটাই শব্দ উচ্চারিত হচ্ছে, অনি, অনি, অনি। এমন সময় কলিং বেল বেজে উঠলো!
– কোন শালারে ? রিহানের আম্মু বললো,
– অস্থির হয়ো না, দাঁড়াও দেখি কে আসছে!
– কে আসবে মানে! যেই আসবে নির্ঘাত মার্ডার করে ফেলবো। রিহানের আম্মু আমার পাগলামি দেখে মজা পেয়েছে। হাসতে হাসতে গিয়ে সে দরজা খুলে দিলো। হায় হায় এতো দেখি তিফার আম্মু!
– স্যরি ভাবি এতো রাতে ডিস্টার্ব করার জন্য।
– ইট’স ওকে।
– আসলে ভাবি হয়েছে কি, আমার রুমের লাইটটা হঠাৎ ফিউজ হয়ে গেছে। অনি ভাইয়া কি রুমে আছে?
– অনি রুমেই আছে, দাঁড়ান আমি ডেকে দিচ্ছি! রিহানের আম্মুর ডাক শুনে আমি বিরক্ত বদনে এগিয়ে আসলাম। যেন এতো রাতে তিফার আম্মুর বাসায় যেতে আমার ঘোর আপত্তি। অথচ “মন্দিরেতে কাঁসর ঘন্টা বাজলো ঢং ঢং…”
– অনি, ভাবির রুমের লাইটটা ফিউজ হয়ে গেছে, ঠিক করে দিয়ে আসো। আমি খুব অনাগ্রহের সাথে তিফার আম্মুকে বললাম,
– ভাবি আপনি যান আমি আসছি! তিফার আম্মুকে বিদায় দিয়ে রিহানের আম্মুকে বললাম,
– বেবি তুমি বলছো বলে যাচ্ছি।
– যাও, বেচারি একা মানুষ!
– ওকে বেবি, জাস্ট টু মিনিট ওয়েট!
তিফার আম্মু অতিথিপরায়ন নারী। কাজ সামান্য হলেও প্রতিদান না দিয়ে ছাড়বেন না। তিফার আম্মুর এই “কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি” আমার অনেক ভালো লাগে। ব্যতিব্যস্ত হয়ে তিনি মালাই চা বানাচ্ছেন। এতো তাড়াহুড়ার কি আছে বুঝলাম না ? আমি মোলায়েম সুরে ভাবিকে বললাম,
– আহা ভাবি আস্তে ধীরে করুন আমি তো আর উড়ে যাচ্ছি না! তিফার আম্মুর মুখে রহস্যময় মুচকি হাসি। মনে মনে বলি, প্লিজ এভাবে হাসবেন না ভাবি, ভাইব্রেশন মোড অন হয়ে যাবে। তিফার আম্মুর রুমে লাইট জ্বলিয়ে এসে দেখি নিজের ঘর অন্ধকার। রিহানের আম্মু বাসার দরজা জানালা বন্ধ করে দিয়েছে । অনেকক্ষণ কলিংবেল চেপেও কোনো সাড়াশব্দ নাই। ঘটনা কী ? হঠাৎ জানালা খুলে রিহানের আম্মু বলে,
– এই তোর দুই মিনিট?
বেচারি রেগে গেছে। চেহারায় কিছুক্ষণ আগের সেই পরী পরী ভাব আর নাই। কালনাগিনী ভাব ফুটে উঠেছে। আমি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি, সর্বনাশ এক কাপ চা খেতে ২০ মিনিট শেষ। হায়রে আপেক্ষিক তত্ত্ব। আমি রিহানের আম্মুর দিকে করুন দৃষ্টি দিয়ে বললাম,
– স্যরি জানু, একটু লেট হয়ে গেছে।
– বিশ মিনিট থেকে এসে বলছিস একটু লেট?
– ভুল হয়ে গেছে বেবি !
– এখন ভুলের প্রায়শ্চিত্ত কর!
– কী করতে হবে বলো বেবি, আমি তোমার জন্য সব করতে পারি ?
– কান ধরে একপায়ে বিশ মিনিট দাঁড়িয়ে থাক!
– হায় হায় কী বলো এসব?
রিহানের আম্মু প্রচন্ড একগুঁয়ে মহিলা। কথা না শুনলে পানিশমেন্ট বাড়িয়ে দিবে। আশপাশে কেউ না দেখলেই হলো। প্রাইমারি স্কুলে থাকতে কান ধরে কতো দাঁড়িয়েছি। রিহানের আম্মু জানালা দিয়ে শাস্তি পর্ব অবজারভেশন করছে। তার চেহারার কঠিন ভাব কমছে না। একটু আগে কতো রোমান্টিক ছিল। ধুর তিফার আম্মুর মালাই চা খাওয়াটা মোটেও উচিৎ হয়নি। হঠৎ শুনি পেছনে দাঁড়িয়ে কে যেন হাসছে। আরে এটাতো তিনতলার মুটকি ভাবী, ইজ্জৎ শেষ!
– কী অনি ভাই, এতো রাতে এক পায়ে দাঁড়িয়ে আছেন কেন?
– কুত কুত খেলি, আপনি খেলবেন ? আসেন খেলি! এতো রাতে আসছে তামশা দেখার জন্য!
– অনি ভাই, বেশি চ্যাটাং চ্যাটাং করবেন না। আপনার কানে ধরার ভিডিও রেকর্ড করে রেখেছি, বেশি ভাব ধরলে ইন্টারনেটে ছেড়ে দিবো! হায় হায় মুটকি বলে কি !
– আরে ভাবি আপনার সাথে মজাও করা যাবে না দেখছি।
– ও মজা করেছেন নাকি?
– জী ভাবি, ইদানিং আপনি কিন্তু অনেক স্লিম হয়েছেন, অনেক সুন্দর লাগে।
– থ্যাঙ্কয়্যূ।
মুটকি ভাবির সুপারিশে বাসায় ঢুকার চান্স পেয়েছি কিন্তু ক্যান্ডেল লাইট ডিনার কপালে নাই। আমার সামনে বসে মুটকি ভাবি আর রিহানের আম্মু সব খেয়ে ফেলছে। মুটকি ভাবি আমাকে খেতে ডেকেছিল কিন্তু রিহানের আম্মু বলে,
– আরে ভাবি আপনি খান তো। অনি রাতে কিছু খায় না,সে ডায়েট কন্ট্রোল করছে। তার এক কাপ মালাই চা হলেই হয়। ক্ষিদায় নাড়ীভুঁড়ি হজম হয়ে যাচ্ছে আর রিহানের আম্মু বলে আমি নাকি রাতে কিছু খাই না! আমি নাকি ডায়েট কন্ট্রোল করছি! এই অন্যায়ের বিচার আমি কার কাছে দিবো ? নিষ্ঠুর পৃথিবীতে বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদে।